“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ১৯ জুন, ২০২১

প্রাক্তন...

 

                                                      ।। শৈলেন দাস ।।

(C)Imageঃছবি

একে তো করোনা সংক্রমণের ভয় অন্যদিকে ভাদ্র মাসের প্রখর রৌদ্র শরীর নিংড়ে ঘাম বের করে নিচ্ছে। সরকারী দায়িত্ব পালনের হ্যাপা, ভয় ও বিরক্তি সত্ত্বেও বহুতল বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছি। সবাইকে বলতে হবে র‍্যাপিড এন্টিজেন টেস্ট করিয়ে নিতে, সাথে সর্দি কাশি জ্বর ইত্যাদির তথ্য সংগ্রহ করা। আমার সঙ্গে রয়েছে দুজন সহযোগী, আশাকর্মী নীলম'দি এবং  অঙ্গনওয়াড়ি ওয়ার্কার পূর্ণিমা।

দোতলায় একটি ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল টিপতেই সাড়া মিলল। দরজা খুলে মুখ বাড়াল একজন অল্প বয়সী মহিলা। অসহ্য গরমের জন্য অন্তর্বাসহীন ঘরোয়া পোশাক পড়ে রয়েছে সম্ভবত তাই সসংকোচে ডান হাতে তার বুক আড়াল করা। আমার সহযোগী নীলম'দি বলল, “আমরা হেলথ থেকে এসেছি। আপনাদের পরিবারের বিষয়ে তথ্য জানতে চাই।মুখে মাস্ক লাগানো থাকায় আমার ম্লান হাসি সে দেখতে পায়নি তবে চোখের ভাষা যে অন্যরকম ছিল সেটা ওর চোখ এড়ায়নি। সম্ভবত সে কারণেই আমি কিছু বলতে যাব, এমনি থামিয়ে দিয়ে বলল- এটা আমার বাবার বাড়ি, আমি মাকে ডাকছি বলেই সে ভিতরে চলে গেল। অচেনা পুরুষের সামনে এমন পোশাকে দাঁড়িয়ে কথা বলা সমীচীন নয়। তাই বোধ হয় চলে গেছে।

আমার মনে অস্থিরতা, এত দিন পর দেখা হল অথচ সে আমাকে চিনলই না! বিজ্ঞানের মতে, কিছু নির্দিষ্ট স্বর আমাদের হৃৎস্পন্দনকে বাড়িয়ে তোলে। তাই আমি মুখ থেকে মাস্ক সরিয়ে তার মায়ের সাথে কথা বলতে শুরু করলাম এমনভাবে যাতে সে ভেতর থেকে শুনতে পায়। কাজ হয়েছে, দরজার আড়াল থেকে মায়ের কাছে এসে দাঁড়াল সে। সব রকমের সংকোচ এখন গৌণ। সে কথা বলতে শুরু করল আমার সাথে। করোনা উপসর্গের তথ্য দেওয়ার ছলে জানিয়ে দিল তার স্বামী একজন ফ্রন্টলাইন করোনা ওয়ারিয়র। এই শহরেরই প্রাণকেন্দ্রে একটি ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকে ওরা। দুই সন্তানের সুরক্ষার কথা ভেবেই এখন বাবার বাড়িতে চলে আসা। দায়িত্ব পালনে আমাদের টিমের অসুবিধা হচ্ছে কিনা জানতে চেয়ে সে কৌশলে জেনে নিল আমার ডিপার্টমেন্ট। নিজের সুখী জীবনের গল্পের সাথে মিলিয়ে নিল আমার জীবনের ব্যর্থতা! অথচ  একবারও মনে হয়নি সে আমরা প্রাক্তন প্রেমিকা।

যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ শেষ হলে পূর্ণিমা বলল- স্যার, চলুন যাই। ঘরে থাকবেন, সুস্থ থাকবেন এইটুকু বলেই অন্যমনস্কের মত আমি সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে শুরু করলাম। ওরা বলল- স্যার, বাকি ঘরগুলোতে যাবেন না?” আমার কেমন যেন ক্লান্তি লাগছে, বললাম- আজ আর কোন ঘরে যাওয়া হবেনা।”

কোনরকম ভূমিকা ছাড়াই নিজের বিষয়ে এত কিছু বলে ফেলা, পরোক্ষে আমার বিষয়ে জেনে নেওয়া সর্বোপরি অস্বস্তিকর পোশাকে নির্লিপ্তভাবে আমার সামনে দাঁড়িয়ে তার কথা বলে যাওয়া কিন্তু খেয়াল করেছে আমার সহযোগীরা। কয়েকটা সিঁড়ি নীচে নামতেই ওরা  উৎসুক হয়ে জানতে চাইল ব্যাপারটা কী? আমি কিছু বলিনি শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্রুত নীচে নামতে লাগলাম।

            ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছি আমরা। সূর্যের প্রখরতা এখন কিছুটা ম্লান। কোথা থেকে যেন এক খণ্ড মেঘ এসে ঢেকে দিয়েছে তাকে। ব্যালকনি থেকে কাঁপা গলায় ডেকে বলল সে- সাবধানে থেকো সতীশ, খেয়াল রেখো নিজের।চোখের কোণে জলও জমে ছিল হয়ত। আমি আর পিছন ফিরে তাকালাম না।

 

কোন মন্তব্য নেই: