“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ১৮ জুন, ২০২১

অন্তর্বাস

                                                   ।। শৈলেন দাস ।।

(C)IMAGEঃছবি

তা
কে অবিনাশ
'দা বলেই ডাকে চৈতালি আর  অবিনাশ নাম ধরে ডাকে  চৈতালিকে। শহরের মাঝামাঝি এলাকায় থাকা সত্ত্বেও অবিনাশের একতলা এই বাড়িটা কেমন যেন অগোছালো ছিল এতদিন। ভাড়াটে হিসাবে চৈতালিরা আসার পর থেকে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। চৈতালির নূপুরের রিনিঝিনি যেন মাতিয়ে রেখেছে পুরো বাড়িটাকে।

 চৈতালির চোখ দুটো অপূর্ব, নেশায় ভরা একদম! ছিম-ছাম শরীরের চঞ্চলতা চোখে পড়ার মত। গায়ের রং দুধে আলতা বললে মোটেও ভুল হবেনা। যেদিন প্রথম ধ্রুব চিতলিকে বাড়িটি দেখাতে এনেছিল, তাকে দেখে পুরনো স্মৃতিতে হারিয়ে গিয়েছিল অবিনাশ। বেশ কিছু বছর পর নতুন করে নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হয়েছিল তার। নিজের ব্যক্তিগত অতীতের তিক্ত দিনগুলির কথা কোনোদিনও সেভাবে মাথায় আনেনি অবিনাশ কিন্তু ইদানীং রাতে বিছানায়, সে ভীষণ গুমরে মরছে যেন নিজের মধ্যে।

 একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে তার স্কুল জীবনের সহপাঠী ধ্রুব। সাত সকালে বেরিয়ে সন্ধ্যের বেশ কিছুটা পর বাড়িতে ঢোকে, কখনও কখনও রাত হয়ে যায় ফিরতে। চৈতালি একা থাকবে ঘরে তাই বন্ধুর বাড়িতে ভাড়াটে হয়ে আসা। অবিনাশের কর্মস্থল বাড়ির অদূরেই একটি প্রাথমিক স্কুল। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রায়ই ছুটির কিছুটা আগেই বেরিয়ে পড়ে সে এবং সোজা চলে আসে বাড়িতে। তারপর আর কোথাও বের হয়না।

 কোন একদিন বিকেলে, কিছুতেই নিজের মনটাকে শান্ত করতে পারছিলনা অবিনাশ। অতীত স্মৃতি রোমন্থন করে খড়-কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছিল তার শূন্য মন। ঠিক বেঠিকের ঊর্ধ্বে উঠে নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলনা। তাই একটু হালকা বোধ করার জন্য ছাদে উঠে গেল সে। সেখানে দড়িতে মেলে দেওয়া চৈতালির শাড়ি বেসামাল হয়ে লুটিয়ে উড়ছে অনেকটা জায়গা নিয়ে। পাশেই ব্লাউজ এবং গোলাপি রঙের অন্তর্বাস ক্লিপ দিয়ে আটকানো। সসংকোচে ক্লিপ সরিয়ে অন্তর্বাসটি হাতে নিল অবিনাশ, বুক ভরে যেন ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করল কোন কিছুর। হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজে ছন্দপতন, অন্তর্বাসটি ছেড়ে ধড়ফড়িয়ে তাড়াতাড়ি  নীচে নেমে এল সে। অসাবধানতা বশত: ভুলেই গেল  ক্লিপ দিয়ে সেটি আটকানোর কথা।

 সন্ধ্যের দিকে, বারান্দায় আরাম কেদারায় বসে মোবাইল ঘাটাঘাটি করছে অবিনাশ, মনে চাপা উত্তেজনা। অন্তর্বাসে ক্লিপ না থাকার ব্যাপারটা চৈতালি সন্দেহ করেনি তো? নয়ত আজ এত দেরী  কেন? এতক্ষণ তো ওর চা নিয়ে আসার কথা।

 রিনিঝিনি নূপুরের শব্দ এগিয়ে আসছে!  উত্তেজনায় টান-টান হল অবিনাশের শরীর। অব্যক্ত অপরাধ বোধে নত তার চোখ। চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে সাবলীল মিষ্টি হাসল চৈতালি। কাঁপা হাতে সেটি কোনমতে নিল অবিনাশ। কিছুটা স্বস্তি বোধ করল সে।

 ফিরে যাচ্ছে চৈতালি। কিন্তু হঠাৎ হাঁটার গতি কিছুটা কমিয়ে নিল সে। ঘাড় ঘুরিয়ে চোখে চোখ রাখল অবিনাশের। এগিয়ে এসে কাঁপা গলায় বলল - আমাদের যে দিন গেছে, তা সত্যিই গেছে অবিনাশদা! অতীত কেন প্রতিবন্ধক হবে আগামীর পথে? মাথা নিচু করে রইল অবিনাশ। ব্যর্থতার গ্লানি দুচোখ বেয়ে নেমে আসছে ধীরে। নূপুরের রিনিঝিনি শব্দটা ক্রমশ মৃদু হতে হতে মিলিয়ে গেল খোলা বারান্দায়...।

 

কোন মন্তব্য নেই: