“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ৭ জুন, ২০২১

বজ্রাঘাতে হত… ইতি অষ্টাদশ গজঃ…


।। পার্থঙ্কর চৌধুরী ।।

গাঁও জেলার বামুনি পাহাড়ে সাম্প্রতিক কালে দেড় ডজন গজরাজের আকস্মিক বজ্রাঘাতে মৃত্যুর খবরটা অতিমারি জনিত মৃত্যুর চাইতে কোন অংশে কম ভয়ঙ্কর নয়। কাজিরাঙ্গা থেকে একদিকে হোজাই জেলার ডবকা আর অন্যদিকে কারবি-আংলং পাহাড়ে হাতীদের নিত্য নৈমিত্তিক আসা-যাওয়ার পথ (Elephant Corridor mapping) কেমন রয়েছে, তার হাল- হকিকতই বা কি; মানব নামক দানবের উৎপীড়নে সেই পথ আজকের দিনে কতটুকু নির্বিঘ্ন রয়েছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ নিয়ে আমাদেরই একখানা গবেষণাপত্র সম্প্রতিকালে জেনিফার পেস্টরিনি  সম্পাদিত এবং

শ্রীলঙ্কা থেকে প্রকাশিত ‘Gajah’ নামক জার্নালে বেরিয়েছে। জেনি-র ওই জার্নালে এর আগেও ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের পাথারিয়া অঞ্চলে থাকা সীমিত সংখ্যক স্ত্রী হাতির জীবন যাপনের দুর্দশার কথাও প্রকাশ পেয়েছিলো। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তা অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও, প্রদীপের নিচটা বরাবরের মতো অন্ধকারই থেকে গেছে!  বিষয়টা নিয়ে উত্তর পূর্বের একে একে সব সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞদের সাথে একদিকে যেমন কথা হয়েছে, তেমনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃত হস্তী-বিশেষজ্ঞ (Elephant man of India) বাঙ্গালুরুস্থিত ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সাইন্সের অধ্যাপক রমন সুকুমার স্যারের সঙ্গেও বছরদিন আগে কথা হচ্ছিল। আজ অব্দি কোন হিল্লে হল না! বরাক উপত্যকার আজকের দিনে সাকুল্যে ৭টি হাতি রয়েছে। হারাধনের এই সাতটি ছানার তিনটি ( ১টি করে পুরুষ ও স্ত্রী, এবং তাদের একমাত্র শিশুশাবক) রয়েছে কাটাখালের জঙ্গলে, বাকি চারটে (সবক’টিই স্ত্রী) পাথারিয়ার জঙ্গলে রয়েছে। ভিসা পাসপোর্ট ছাড়াই গোটা বছরে ওদের পাঁচ থেকে ছ’বার ভারত–বাংলাদেশের মধ্যেকার জঙ্গলে আনাগোনা অব্যাহত।

এখানে বলে নেওয়া উচিত যে হাতির সংখ্যা গোটা দেশের মধ্যে সবচাইতে বেশি রয়েছে কর্ণাটকে, এর পরেই রয়েছে আসাম। যদিও ২০১৯ এর হাতি সুমারির তথ্য এখন পর্যন্ত হাতে আসেনি, কিন্তু ২০১৭-র তথ্য অনুযায়ী আসামে মোট ৫,৭১৯টি হাতি ছিল, যা এর আগের তথ্য (২০০২ সালের) তুলনায় ৪৭৩টা বেশি।  রক্ষণশীল অনুমানেও ২০১৯-র আসামে হাতির সংখ্যা প্রায় ৬০০০-এর বেশি হবে, এতে সন্দেহ নেই। এবং এই সংখ্যার বেশির ভাগই রয়েছে মধ্য আসামের বিস্তীর্ণ অরণ্যভূমি জুড়ে। দক্ষিন আসামের কামরূপ, ধুবড়ি, মানকাছর বডোল্যান্ড ইত্যাদি এলাকাতেও কম বেশি হাতি রয়েছে। গুয়াহাটির অদূরে থাকা রানী-গাড়ভাঙ্গা সংরক্ষিত বনাঞ্চলের হাতীদের নিয়েও আরেকখানা গবেষণাপত্র এরই মধ্যে প্রকাশ পাবে।  ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ প্রান্তের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকা জুড়ে তিনটি এলিফেন্ট করিডোর রয়েছে। এ গুলোর প্রথমটা কাজিরঙ্গা থেকে পাশে থাকা লাওখোয়া/ বুড়াচাপরি অভয়ারণ্য। দৈর্ঘ্য- ৫০-৫৫ কিলোমিটার। দ্বিতীয়টা কাজিরঙ্গা থেকে থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ক্রমে বাগসার সংরক্ষিত বনাঞ্চল, ডিজো সংরক্ষিত বনাঞ্চলের দক্ষিন অংশ হয়ে, ধলাপাহাড় হয়ে, সোয়াং সংরক্ষিত বনাঞ্চল, বামুনি সংরক্ষিত বনাঞ্চল, কঠিয়াতলি হয়ে হোজাই-র পাশে থাকা ডবকা সংরক্ষিত বনাঞ্চল অবধি বিস্তৃত।দৈর্ঘ্য- ৬০-৬৫ কিলোমিটার । এবং তৃতীয়টা কাজিরঙ্গা জাতীয় উদ্যান থেকে সোজা দক্ষিণ দিকে  উত্তর কারবি আংলং অভয়ারণ্য অবধি বিস্তৃত। দৈর্ঘ্য- ৪৫-৫০ কিলোমিটার (ছবি-১)। এই করিডর গুলোর মধ্যে দ্বিতীয়টি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ, এবং এই করিডরের মোটামোটি মধ্যভাগেই রয়েছে বামুনি পাহাড়, যেখানে সম্প্রতি এক সাথে দেড় ডজন হাতির মৃত্যু হল।

গুয়াহাটি ভিত্তিক যাবতীয় সব সংবাদ মাধ্যম দিনরাত এক করে একের পর এক ব্রেকিং নিউজ, বিশেষজ্ঞদের দিয়ে আলোচনা ইত্যাদি করিয়েছে যদিও, কিন্তু কারো মুখেই করিডোর গুলোর কথাটা উঠে আসলো না! তাঁদের কেউই উল্লিখিত করিডোরের স্বাস্থ্য সম্পর্কে না ওয়াকিবহাল, না সংরক্ষণ-মুখর। অন্যদিকে বন বিভাগও নিজেদের ঢাক এই বলে পেটাচ্ছে যে সাম্প্রতিক দিনে রাজ্যে ২২২ বর্গ কিলোমিটার বনাঞ্চল বৃদ্ধি হয়েছে। তবে ওটা ২০১৭ থেকে ২০১৯, এই দুবছরের তুলনামূলক তথ্য; এবং শতকরার হিসেবে সেটা তেমন কোন সন্তোষজনক নয়। আবার অনেকেই ফেবু-টুইটার মাধ্যম বজ্রাঘাতের এই থিয়োরিটা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন।  আবার অন্যদিকে প্রাইভেট কোম্পানি কর্তৃক বামুনি পাহাড় বেদখলের তত্ত্বও আলোচনায় এসেছে। সময়টা কঠিন! অতিমারি-জনিত সেমি লক-ডাউন। দুর্যোগের ঘনঘটা। অনেকেই করোনাক্রান্ত... মৃত্যুর মিছিল আনলিমিটেড। যেহেতু ঘরের বাইরে পা রাখার জো প্রায় নেই, তাই হাতে সময়ও আনলিমিটেড। অনেকের আবার আনলিমিটেড মোবাইল ডাটাও ! এর জন্যই কি এত্তোসব বহুমুখি তথ্য !!

হ্যাঁ, খবরটা প্রথম পেয়েছিলাম ১৩ মে-র সন্ধ্যেবেলা। দুর্ঘটনাস্থল লাগোয়া জায়গায় বাড়ি রয়েছে এবং এই নির্দিষ্ট বিষয়ের (Study of Elephant corridors বা করিডোর অধ্যয়ন) উপর গবেষণারত ছাত্র জ্যোতি বিকাশ বৈশ্যকে সে রাতেই ফোনে পাকড়াও করলাম। অতিমারির এই দিনে সদ্য-বিবাহিত ছাত্রটার উপর প্রভাব খাটাতে নিজের কিছুটা খারাপও লাগছিল বৈ কি! কিন্তু, গবেষণার স্বার্থে, বিষয়টা তো আর হাতছাড়া করা যায় না। মরিগাও জেলার যেখানে ছেলেটার বাড়ি, সেখান থেকে বামুনি পাহাড়ের দুরত্ব ৫২-৫৪ কিলোমিটার। ছেলেটার বাইকের নম্বর জোড় সংখ্যার। পরদিন অর্থাৎ ১৪ তারিখ, মরিগাও জেলায় জোড় সংখ্যার গাড়ি চলার অনুমতি রয়েছে, কিন্তু পাশের নওগাঁ-তে বেজোড়! সে আরেক হ্যাপা। যাকগে! জোড়-বেজোড় বিষয়টাকে জোড়াতাপ্পি মেরে ছেলেটা গিয়ে ওখানে পৌছালো এবং নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বামুনিপাহারের উপর থেকে আমাকে ফোন করলো। তখন সময় সকাল আটটা।

বামুনি পাহাড় বলে যেটাকে এতক্ষন বলছি, সেটা হচ্ছে গিয়ে বামুনি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। নগাও জেলার কঠিয়াতলি বন বিভাগের আওতায় থাকা এই বামুনি বনাঞ্চল প্রায় এক লক্ষ পঞ্চান্ন হাজার হেক্টর জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বনাঞ্চলের এখানে সেখানে ছোট থেকে মাঝারি পাহাড় দিয়ে ঘেরা। এই পাহাড়ি পথের চরাই- উতরাই দিয়েই ধলাপাহাড় পেরিয়ে সোয়াং বনাঞ্চল হয়ে  হাতিগুলো বামুনি পাহাড়ে এসে পৌছায়।

স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী তেরো মে দিনটির ৩-৪ দিন আগে থেকেই সেখানে বজ্র-বিদুত সহ মুশলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। ইন্ডিয়ান মেটেরোলজিকেল ডিপার্টমেন্ট-এর ওয়েবসাইটে দেওয়া পূর্বাভাসেই উল্লেখ রয়েছিল যে ১২ তারিখ থেকে পরবর্তী ৫ দিন দমকা হাওয়া (প্রায় ৭-১১ কিলোমিটার বেগে) এবং বজ্রবিদ্যুৎ সহ সেখানে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা, এবং বাস্তবে হয়েছিলও তাই। আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম বলে একটা আভাষ আবহাওয়া দপ্তর দিয়ে থাকে।  গভীর সমুদ্রে  মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের ক্ষেত্রে যেমন তা প্রযোজ্য, লোকগুলোকে বারণ করা হয়, উত্তর পূর্বের বনাঞ্চলের বনকর্তাদের বন্যপ্রাণীদের গতিবিধি লক্ষ্য করে,  তাদের জন্যও অনুরূপ পদক্ষেপ গ্রহন করাটাও মনে হচ্ছে আশু কর্তব্য। কিছু একটা আগাম পদক্ষেপ হাতে নিলে, হাতীদের করুন মৃত্যু নিয়ে জনমানসে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, তাতে কিছুটা হলেও মলম লাগানো যেতো। যাকগে, ভবিষ্যতের জন্য এ এক শিক্ষা হয়ে রইলো! এনিয়ে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত Oryx-জার্নালে আমাদের একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন ইতিমধ্যেই প্রকাশ পাবে।

 বার্তালিপি ৩০ মে, ২০২১

মারা যাওয়া ১৮টি হাতীদের মধ্যে  ৫টা মাদা এবং ১৩টা স্ত্রী। এর মধ্যে ৪টা বাচ্চা হাতি। ১৪ টা পাহাড়ের চুড়ায় এবং বাকি ৪টার মৃতদেহ পাহাড়ের ঢালু এলাকাতে ছড়ানো। বামুনি পাহাড়ের উপরিভাগ, যে স্থানটা হাতীদের গনমৃত্যুর সাক্ষী, সেখানে গাছপালা প্রায় নেই বললেই চলে। এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দু-চারটা সেগুন গাছ, মাঝারি ধরনের ঝোপ-জঙ্গল আর বাঁশঝাড়। এদের কোনটাই গহীন জঙ্গলের চারিত্রিক বৈশিষ্ট নয়! অতএব, একটা কথা পরিস্কার, যতই ২২২ বর্গ কিলো মিটার বনাঞ্চল বৃদ্ধির দাবী করা হোক না কেন, মাথার উপর বৃক্ষ-চন্দ্রাতপ (ছাউনি) না থাকা করিডোর দিয়েই হাতীদের চলাচল করতে হচ্ছিল! আর এর দায় কি শুধু সরকার বাহাদুরের উপর? ওই যে বললাম,  কাজিরঙ্গা থেকে ডবকা পাহাড়, দীর্ঘ ৬০-৬৫ কিলোমিটার এলিফেন্ট করিডোরের মাঝে মধ্যের বিশাল জায়গা জুড়ে গত দু-তিন দশক ধরে শুরু হয়েছে ধানচাষ। জমির মালিক সরকার, ধানের মালিক গেরস্ত। রাজ্যের প্রায় অধিকাংশ বনাঞ্চল জুড়েই অবৈধ গেরস্তদের এরকম ‘অনধিকার-চর্চার’ দৃশ্য চোখে পড়ে। উপত্যকার রজনিখালে বছরদিন আগে যা হয়েছিল, গোটা রাজ্যজুড়ে সেরকম ব্যাপক অভিযান চালানো  মনে হচ্ছে খুবই দরকার। অন্ততঃ বন্যপ্রাণী এবং তাঁদের আবাসস্থল রক্ষাকরার জন্য।

বজ্রপাতের ফলে এই দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার স্বপক্ষে কথা বলার জন্য দু-দুখানা ফটো আমাদের হাতে এসেছে। একটাতে দেখা যাচ্ছে যে বজ্রপাতের ফলে হাতির শুড়ের মধ্যে কিছুটা অংশ ছেঁকা লেগে পুড়ে গেছে (ছবি-২) এবং  অন্যটাতে সে জায়গায় থাকা গাছগুলোর পাতা ঝলসে গেছে (ছবি-৩)। ইতিমধ্যে, অর্থাৎ  ২৩ মে, ২০২১ তারিখ ময়না তদন্তের রিপোর্টখানাও বেরিয়ে এসেছে। গুয়াহাটির খানাপাড়াস্থিত আসাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক এস, এম, তামুলি এবং সহকারি অধ্যাপক এ, ডেকা মরা হাতিগুলোর চামড়া, রক্ত এবং দেহকোষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানিয়েছেন যে, হাই ভল্টেজ ইলেকট্রিক কারেন্টের আঘাতে হাতিগুলোর শরীরে প্রচুর ক্ষতের দাগ পরিলক্ষিত হয়েছে। রিপোর্টে উনারা এটাও উল্লেখ করেছেন যে হাতিগুলোর দেহের উপরিভাগের চামড়া তার নিচের টিসুগুলো থেকে আলাদা হয়ে গেছে, দেহের কোষ গুলো থেঁতলে গেছে, ধমনী এবং শিরাগুলো ফেটে চৌচির হয়ে গেছিল, ফলে আভ্যন্তরিন রক্তপাত ঘটেছে।

যদিও পুরো ঘটনাটাই দুর্ভাগ্যজনক, এবং আসাম তথা গোটা ভারতে এমন ঘটনা এর আগে শোনা যায় নি, কিন্তু এ জাতীয় ঘটনা পৃথিবীতে  যে এর আগে কক্ষনো ঘটে নি, তা নয়। অন্তত দু-দুবার ঘটেছে। ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই আমেরিকার উটা-র ‘মিল কেনিয়ন পিক’-এ বজ্রাঘাতে একসাথে ৬৫৪টা ভেড়া মারা যায়। আবার ৬-৭ বছর আগে (২০১৬ সালের আগস্ট মাসে) ইউরোপের নরওয়েতে  একইভাবে বজ্রপাতে ৩২৩-টা বল্গাহরিণ মারা গেছে যাদের মধ্যে ৭০টাই ছিল হরিনশাবক। বজ্রপাতে বন্যপ্রাণী মারা যাওয়ার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আমেরিকার জাতীয় মহাসাগর ও বায়ুমণ্ডল প্রশাসন (NOAA)-এর বজ্র-বিদ্যুত বিশেষজ্ঞ জন জেন্সেনিয়াস (John Jensenius) বলেছেন যে খোলা আকাশের নীচে থাকা প্রাণীদের দেহে দুভাবে বাজ আঘাত হানতে পারে। প্রথমটা সরাসরি প্রাণী দেহে এসে পরে; এবং দ্বিতীয়, তির্যক বা সাইড ফ্ল্যাশ। সরাসরি যেটা এসে পরে, সেটা অবজেক্ট অর্থাৎ প্রানিদেহ-কে (অথবা যেখানে প্রানিটা রয়েছে সেই মাটিকে) স্পর্শ করে, ফলে প্রানিদেহ অথবা সেই মাটি তড়িতায়িত হয়ে পড়ে। আর যে মাটি তড়িতায়িত হলো, সেটা ৫০ থেকে ৮০ মিটার ব্যাস জুড়ে সেই মুহূর্তে (সাময়িকভাবে) কারেন্ট থাকে। এমনিতেই প্রাকৃতিক কোন দুর্যোগের সময় বনের পশুরা স্বাভাবিকভাবেই এক জায়গায় জটলা বেঁধে থাকে। এটা তাদের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি। এর ফলেই একসাথে এতগুলো প্রাণী মারা যায়। দ্বিতীয়টা, অর্থাৎ সাইড ফ্ল্যাশ সম্পর্কে জেন্সেনিয়াস বলেছেন, ঘটনাস্থলে যদি উঁচু গাছপালা থাকে, তাহলে বাজ এসে প্রথমে পরবে সে গাছ গুলোর উপর, এবং সঙ্গে সঙ্গে তা ছিটকে গিয়ে পাশে থাকা প্রাণীর উপর পড়ে। হটাত করে আসা সেরকম কারেন্ট প্রাণীদের নার্ভাস সিস্টেম কে আক্রমন করে এবং এর ফলে স্নায়ু-তন্ত্র তথা মস্তিষ্ক আচমকা স্থবির হয়ে পড়ে। তবে এ দুটোর মধ্যে  সাইড ফ্ল্যাশের ক্ষেত্রে প্রাণীদের কম মাত্রায় হলেও বাঁচার সম্ভাবনা থাকে। এবং সেটা সম্ভব হয় যদি খুব অল্পসময়ের মধ্যে প্রাণী টাকে সি-পি-আর (অর্থাৎ Cardio-Pulmonary Resuscitation) করানো হয়। তবে উন্নতদেশগুলো বন্যদের জন্য ঐ CPR-এর কথা ভাবতে পারে, আমাদের এখানে যেখানে সাধারন একটা ‘ক্যাথ-ল্যাব’-এর অভাবে পথে ঘাটে সায়ন্তন-রা মারা যাচ্ছে, সেখানে ওমন ভাবনা করাটাই ব্যাকুলতা বৈ কি আর হতে পারে?

এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে চলে আসছি। এবারের পরিবেশ দিবসটা এলো বলে…। এ বছরের থিম, ECOSYSTEM RESTORATION, অর্থাৎ ‘বাস্তুতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা’। রাজ্যের বামুনি পাহাড়ের একদল হাতি মরে গিয়ে একটা কথা প্রমান করে দিল যে আমরা যে যাই বলি না কেন, বনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য  বন্যদের মধ্যে নেই! হাতীদের বলা হয় ‘আমব্রেলা প্রজাতি’ (Umbrella species)। অর্থাৎ এদের ভালভাবে রক্ষা করলে চেনা-অচেনা অন্য হাজার প্রজাতির সুরক্ষা এমনি এমনিই হয়ে যায়। তাই বলছিলাম, তাদের সুরক্ষার জন্য  বেদখল মুক্ত করে করিডোর গুলোতে ব্যাপক বৃক্ষ-পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এ সময়ের আহ্বান। আজদের দিনে অমন একখানা পদক্ষেপ হাতে নিলে, এ গাছগুলো যখন বড় হবে, অর্থাৎ, পনেরো-কুড়ি বছর পর আসামের পাহাড়ে একই ধরনের বজ্রপাত হলে সেদিন হাতিগুলোকে হয়তঃ বা ওমন বেঘোরে প্রান হারাতে হবে না…   

কোন মন্তব্য নেই: