মূলত প্রচারবিমুখ এই লেখকের গল্পগ্রন্থ বলতে এখন পর্যন্ত তিনটি, ‘নাকছাবি’(২০০৭), ‘অগোছালো দৃশ্যাবলী’(২০১১), ‘রঙ ভাঙলেই আকাশ’(২০১৩)। তবে গ্রন্থভুক্তির বাইরেই রয়েছে অজস্র লেখা। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে প্রচুর। নাটক ভালোবাসেন। নাটক লিখছেনও দীর্ঘদিন ধরে। সংখ্যায়ও কম নয়। বেশিরভাগ নাটকই মঞ্চস্থ হয়েছে। ‘ক্লাসিক’ নামে রয়েছে নিজস্ব নাট্যদল। লিখেছেন চৈতন্যের সিলেট ভ্রমণ নিয়ে উপন্যাস ‘চন্দনপিঁড়ি’। পেশাগত জীবনে ইঞ্জিনিয়ার। নেশা অভিনয় ও গল্প রচনা। ‘জলজ’ নামে উত্তর ত্রিপুরার সুখ্যাত কাগজের সঙ্গে প্রথম থেকেই যুক্ত। নিজে অনেকদিন সম্পাদনা করেছেন ‘উদীচী’ নামের একটি অতীব সুন্দর সাহিত্যের কাগজ। কবিতার প্রতি আকর্ষণ সেই শৈশব থেকেই। রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন আত্মায় ও মননে। গল্পের ক্ষেত্রে কৃষাণ চন্দর, মান্টো, কাফকা, ইসমত চুগতাই, প্রেম চন্দের রচনার প্রতি গভীর আকর্ষণ। গান ও ছবি তার ভাবনার দুইটি ডানা। জন্ম ১৯৭৫, ত্রিপুরার ধর্মনগরে। দিনভর হাজারো কাজের ভিড়ে, সমস্যার ভেতরে থেকে তিলে তিলে জন্ম নিতে থাকে তার চরিত্রগুলি।
বেশি কথা নয়। গুটি কয় বাক্যেই তিনি সৃষ্টি করেন তার রচনার পরিসর। বড়ো গল্প নয়। অণু কথার মানুষ তিনি। তার রচনা তাই স্বভাবতই পায় ক্ষুদ্র শরীর। কিন্তু বিস্তার তার দিগন্তে ও বহুস্তরে। মার্কেজের মত তিনি তার গল্পে জাদুবাস্তবতার আমদানি করেননি। তবে তার লেখায় ফুটে ওঠা বাস্তবে রয়েছে অপূর্ব জাদু। বিশেষ করে তার গল্পের অনবদ্য বিষয় হল গল্পের প্লট। বেশিরভাগ সময়ে সময় ও রাজনৈতিক প্রভাব তার গল্পের চরিত্রগুলিকে নির্মাণ করে। তার সঙ্গে রয়েছে চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্বের মূলে থাকতে পারে আধুনিক সমাজের যৌন-জীবন ও সংস্কৃতি। থাকতে পারে বর্তমান ধনকামী সমাজের প্রভাব। বিশ্ববাজার ও ভোগবাদী নষ্ট সময়ের অধঃপতন। তবে এইসব বিষয়কে প্রকাশ করার জন্য তিনি বেছে নেন মফস্বলকেন্দ্রিক কোনো অঞ্চল, আধা শহুরে; যেমন ধর্মনগর-- আজকের ভারতের কোনো স্থান। আজকের ত্রিপুরায় তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের কোনো প্রেক্ষাপট। সেই প্রেক্ষিত বড়ো কোনো বিষয় নয়। যে কোনো চরিত্রের দৈনন্দিন যাপন থেকে উঠে আসা একেবারে স্বাভাবিক। উত্তর আধুনিক ভাবনায় ইয়োরোপের কেন্দ্রমুখী সংস্কৃতি বিনির্মাণের যে ভাবনা লক্ষ করা যায়, তার লেখায় সেটাও কখনো কখনো প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। দেরিদার বিনির্মাণবাদ প্রসঙ্গে আলোচ্য হয়ে ওঠে। কেন্দ্র-প্রান্ত বিন্যাস ভাঙার এই প্রবণতা তার লেখায় গুরুত্ব পেয়ে যায়। যদিও রাষ্ট্র ব্যবস্থা, রাজনৈতিক মতাদর্শ ও অর্থনৈতিক অনাস্থা এর উৎস ভূমি। এছাড়া প্রায় প্রতিটি গল্পে আছে কাব্যময়তা। বলার এমন একটি শৈলী তিনি গ্রহণ করেন, পাঠক মাত্রেই তার লেখা পাঠ শুরু করলে শেষ না করে ক্ষান্ত হন না। আরেকটি বিষয় হল প্রতীকের আশ্চর্য ব্যবহার। তার চরিত্রগুলি, বিষয় ও বক্তব্য সিম্বলিক হয়ে ওঠে অনেক ক্ষেত্রেই। প্রসঙ্গে, দীপঙ্কর গুপ্তের অধিকাংশ গল্পই ‘আমি’র জবানিতে লেখা। চরিত্রের সঙ্গে সংযুক্তি ছাড়াও যে বিষয় এখানে বলার তা হল, চরিত্রটি যেন এই সময় ও সমাজের যেকোনও কেউ। প্রায় প্রতিটি গল্পই একটি পৃথক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আবেদন সৃষ্টি করে। প্রতীক, দৃষ্টিকোণ ও স্বল্প কথার কারণে তার গল্প অনেক সময়ে কবিতার কাছাকাছি চলে যায়। এক্ষেত্রে এই প্রবণতা আরো বেড়ে যায়, তার বলার ভঙ্গির কারণে। একটা সুর থাকে তার উচ্চারণে।
এখানে একটি বিষয় বলার যে, দেশ ও কালের প্রভাব কোনো লেখকই উপেক্ষা করতে পারে না। দীপঙ্কর গুপ্তও পারেননি। তার লেখায় সহজেই স্থান পায়, তার পারিপার্শ্বিক। কখনোই তিনি তার যাপিত বাস্তবকে অস্বীকার করেননি। সুতরাং তার লেখায় স্থান পেয়ে যায় স্থানিকতা ও শিকড়চেতনা, দেশভাগ ও তার পরবর্তী সময়ে বাঙালি জীবনের লড়াই, তিল তিল গড়ে ওঠা জীবন ও নৈতিক অধঃপতন। প্রসঙ্গে বলতে হয়, সিলেটি ভাষার অনবদ্য প্রয়োগ তার গল্পের চরিত্রগুলিকে রক্ত-মাংসের করে তুলেছে। আমরা একটু আগেই স্থানিকতার কথা বলেছিলাম। উত্তর ত্রিপুরা মূলত শ্রীহট্ট অধ্যুষিত অঞ্চল। এখানে সিলেটি ভাষায় কথা বলা একটি স্বাভাবিক রীতি। গল্পকার তার বেশিরভাগ চরিত্রকেই এই বাস্তব পটভূমি দান করেন। এই প্রবণতা তার সবগুলি গল্পগ্রন্থতেই দেখা যায়। লেখকের পারিপার্শ্বিক অবস্থান এই প্রেক্ষিতে আরো স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে তার গল্পে সব সময় স্থান পায়, অতি সাধারণ জীবন। রিকশাচালক, নারিকেল গাছ সাফাই যে করে, যে ড্রেনের পাড়ে বসে মাছ ধরে, কৃষক, পতিতা, অকর্মণ্য, মদ্যপ, মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের নানা রকম চরিত্ররা তার লেখায় বার বার উঠে আসে।
প্রথম গল্প সংকলনেই তিনি পাঠকের নজর কাড়তে সমর্থন হয়েছিলেন। ‘নাকছাবি’ নামক বিস্ফোরক চটি বইটি মোট আটটি গল্প নিয়ে লেখা। প্রথম গল্প ‘একটি রাত’ একটি প্রতীকী মনস্তাত্ত্বিক অতি প্রাকৃত গল্প। গল্পটিতে রুমাল, আবির রঙা ঘর, রাত, ডায়েরি সবই এক একটি প্রতীক। গল্পটিতে কেন্দ্রীয় চরিত্রটি ধর্মঘটের কবলে পড়ে জাতীয় সড়ক থেকে অন্ধকার রাস্তা ধরে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। পথে রাত্রি গভীর বলে তাকে আস্তানা দেয় সড়কের পাশে দূর গ্রামের এক বৃদ্ধ। রাত্রিযাপন কালে বৃদ্ধের ছেলের ডায়েরিকে কেন্দ্র করে গল্প ঘনিয়ে ওঠে। সমস্ত গল্পটিতে আছে রুদ্ধশ্বাস চলন। গল্পটিতে স্বপ্নের অনিবার্য প্রভাব রয়েছে। বলা যায়, স্বপ্নই গল্পটিতে ক্লাইম্যাক্স সৃষ্টি করেছে। কিন্তু স্বপ্নকে বাস্তবের পটভূমিতে স্থাপনের মধ্যেই গল্পটি অনবদ্য রূপ পেয়েছে। কোথাও কোথাও রচনাটির মধ্যে কাফকার প্রভাব রয়েছে বিশেষত স্বপ্নের ব্যবহার ও ঘটনা বিন্যাসের ক্ষেত্রে। স্বপ্ন ও রহস্যময়তার বর্ণনা ঘোর সৃষ্টি করে। ডায়েরিতে যে লাইনগুলি লেখা হয়েছে, তার দিকে একবার তাকানো যেতে পারে:
১/ আমি তৃপ্ত, আমি রিক্ত, আমি ক্লান্ত, তৃষ্ণার দাহে এই মরুটা কত উর্বরা ভূমিকে লেহন করে নিয়েছে। তাতে মরুরই পরিসরই বেড়েছে, অই একটুখানি দুর্বল ঘাসের মধ্যে যে প্রাণ আছে তাকে আপন করতে পারছে না।
২/ শক্তির ভার নিজের অগোচরে কেমন করে নিজেকে পিষে ফেলে, তা আমিও বুঝতে পারিনি।
৩/ আমি হয় পাব, নয় নষ্ট করব। যাকে পাইনে তাকে দয়া করতে পারিনে। তাকে ভেঙে ফেলাও খুব এক রকম করে পাওয়া।
৪/ হায় আমার এমন পরিণতি কেন হল। আমি তো ওথেলো হতে চাইনি। বড়ো বটবৃক্ষের মত একটি হৃদয়ের কাছে থেকেও আমার মধ্যে এত অবিশ্বাস কেন। কেন এত ঈর্ষা। আমার ডেসডিমোনা, যে আমার পাশে ঘুমিয়ে। মুখের দিকে তাকালেই একটা নিষ্পাপ চেহারা। আমি সহ্য করতে পারছি না। তোমার জন্য যাকে আমি শেষ করলাম, যার সময় কেড়ে নিলাম, তা ফিরে দেবার সাধ্য আমার নেই।
আপাত সংলাপধর্মী উপরের লাইনগুলি থেকে বিষয়গত ভাবে গল্পের মনোভূমিটি অনুধাবন করা যায়। গল্পটিতে রক্তকরবী, ওথেলো নাটকের কথা ফিরে ফিরে এসেছে। দুটি নাটকের ভরকেন্দ্র কোথায়! রক্তকরবী নাটকে রয়েছে শক্তির ভারসাম্যের কথা। প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলার কথা। তা সে আত্ম-প্রতিষ্ঠানই হোক না কেনো। আবার অন্যদিকে ওথেলো নাটকের মধ্যে রয়েছে চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা। রক্তকরবীতে যেমন ভেঙ্গে যায় রাজার বানানো প্রাকার। ওথেলোতে ডেসডিমোনাকে খুন করতে যায় ওথেলো। তার ভালোবাসা থেকেই শুরু হয় অধিকারবোধ ও আগ্রাসন। দীপঙ্কর গুপ্তের বর্তমান গল্পটিতেও আছে চরিত্রের সেই জটিলতার প্রকাশ। আপাত দৃষ্টিতে একজন নিরীহ মানুষের অবচেতনে রয়েছে তার ক্ষমতা, নিষ্ঠুরতা ও অসহায়তার জলছাপ। যার সঙ্গে সে নিজেও পরিচিত নয়। কোনো অসতর্ক মুহূর্তে তা বেরিয়ে আসে। গল্পের মূল চরিত্রটি আসলে সেই রাতে নিজের সঙ্গে নিজের সাক্ষাৎ করে। নিজেকেই সে চিনতে পারে না। আবির রঙা ঘর যেন নিজের ভেতরের সেই ঘর। চেতনার বহুতল নীচে যার অবস্থান। হঠাৎ আলো পড়ায় সে নিজেই চমকিত হয়। স্বপ্নে আগামী ভবিষ্যৎ দেখে তার নিজের ভেতর ভয় ধরে যায়। রুমালটি তার অধরা স্বপ্ন বা বাসনা। আর জাতীয় সড়কটি নিমেষেই হয়ে ওঠে চেতনার অন্তস্তলে যাবার করিডোর। উপরের এক এবং দুই নম্বর ডায়েরির সংলাপ থেকে তার অতৃপ্ত হৃদয়ের হাহাকার টের পাওয়া যায়। তৃতীয় সংলাপটিতে তার চরিত্রের নিষ্ঠুরতার দিকটি। হয়তো বক্তা নিজেও এর জন্য প্রস্তুত নয়। নিজের ভেতরের এই প্রবণতার কথা সে জানেই না। ডায়েরির এক একটা পাতা খুলে যায়, মনের আরো গভীরে প্রবেশ করে চরিত্রটি। আগামী ভবিষ্যৎ দেখে সে শিউরে ওঠে। পরবর্তীতে খুনের ভাবনায় সে একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে দমে যায়। প্রথমে স্বপ্ন ভাবলেও যখন সকালে কাকতালীয়ভাবে লাল রুমালটি প্রত্যক্ষ করে তখন পালানো ছাড়া আর উপায় থাকে না। অদ্ভুত এই গল্পটিতে কোথাও বাস্তবতাকে ভাঙা হয় না। এমনকি সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে যা হয়, তার মধ্যেও বাস্তবতা নষ্ট হয় না। কিন্তু সামান্য লাল রুমাল দেখার পর যখন বাস্তবতার সঙ্গে মিলে যায়, তখন গল্পটিতে সব কিছু যেন ভয়ানক হয়ে উঠতে থাকে। মুহূর্তেই বাস্তব আর বাস্তব থাকে না। হয়ে ওঠে অতিপ্রাকৃত। এই প্রতীকায়নই গল্পটিকে মুক্তি দেয়। ফ্রয়েডের স্বপ্ন ও মনোঃসমীক্ষণবাদের তত্ত্বটিও এই গল্পের মূল ভিত্তি একথা বলা যেতে পারে। তবে এই থিওরিটি দীপঙ্কর গুপ্তের অধিকাংশ গল্পেই রক্ত সঞ্চার করেছে। বিশেষ করে চরিত্রায়নে এই তত্ত্বের ভূমিকা অপরিসীম।
যেমন ‘অসময়’ গল্পটিতেও ননী সামান্য সাহায্য পাবার জন্য এস ডি এম অফিসে যায়। তার সাঙ্ঘাতিক পেটে ব্যথা। কিন্তু ভয়ানকভাবে সে দেখে সমস্ত অফিস ছোটোবাবু থেকে বড়োবাবু প্রাণায়াম করতে ব্যস্ত। আফিঙের থেকে বড়ো নেশা। ননীর পেটে ব্যথা খুব বেশি। দুশো টাকা চাইলেও পায় একশো টাকা। একটা অদ্ভুত সময়। ননীর পেটে ব্যথা নিয়েও কারো সমবেদনা পায় না। বরং এই একশো টাকা পাবার জন্য ঘুষ দিতে হয়। একটু পর পর সোডা জল খেয়ে খেয়ে তাকে কাটাতে হয়। গল্পের শেষে রক্ত বমি করতে করতে ননী মারা যায়। কিন্তু সে মারা যায় হাসতে হাসতে, কারণ শরীর ভালো রাখার জন্য অফিসের কর্মীরা একটি ঘরে লাফিং থ্যারাপি করছে। সেও সেখানে ঢুকে গিয়েছিল। সমস্ত গল্পটিতে যেন রয়েছে ননীর পরিস্থিতির প্রতি বিদ্রূপ। গল্পটি দাঁড়িয়ে যায় সেখানেই। সিস্টেমই যেন ননীকে খুন করে। ননী দেশের যেকোনও প্রান্তের যেকোনও লোক, যে সিস্টেমের দরজায় দরজায় ঘুরে যায়। কিন্তু অসহযোগিতা ছাড়া কিছু নেই তার। ব্যর্থ ননীকে যেন প্রাণায়ামের আফিং দিয়ে মেরে ফেলা হয়। সিস্টেমের এই শ্লেষ বা বিদ্রূপ আপামর সাধারণ মানুষের প্রতি।
এই নিষ্ঠুরতা তার গল্পের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেই মানুষের মঙ্গলবোধের চেতনাটি ধ্বংস হয়ে যায়। শুভবোধে আর থাকে না। একটা অস্থিরতা ও ক্রুয়েলটি তাই প্রতিটি মানুষের জীবনকে অবিশ্বাসের জায়গায় নিয়ে দাঁড় করায়। আমরা মান্টোর গল্পেও পাই সেই অশান্তি ও অস্থিরতা ও নিষ্ঠুরতা। এটাই মানুষের ভবিতব্য। উপরের দুইটি গল্পের পরিণতি সেই বোধকে আরো ঘন করে তোলে। ‘পৌনঃপুনিক’ গল্পেও চরিত্রহীন অবিশ্বাসী স্বামী রবিজুলকে দেখা যায়, তার সহজ সরলা স্ত্রী সবিনাকে মিথ্যা কথা বলে ভালোবাসার অভিনয় করে তার টাকা লুঠ করে আরেক জনের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে ফের সবিনাকে তালাক দিতে। এই গল্পেও শেষ লাইনটি অনবদ্য। সাবিনা তার তালাক হবার খবর শোনার পর চোখের জল আটকে রাখতে পারে না। “ বাইরে শিমুলের ফল নিয়ে বোধহয় দু’টি বাদুড় ঝগড়া লেগেছে। নিস্তব্ধ রাতকে তাদের আওয়াজ নিস্তব্ধ থাকতে দিচ্ছে না।”
‘বীজ’ গল্পে দেশভাগের ফলে এপারে আসা উদ্বাস্তু পরিবার রিকশা চালিয়ে দিন গুজরান করে। সেসময় দেশব্যাপী কারগিল যুদ্ধ। রিকশায় কারগিল লেখা নিয়ে গড়ে ওঠে গল্পটি। রঘু আর সীতা, আর তাদের ছেলে কুশল। প্রতিটি মানুষের ভেতরে শৈশব থেকেই বড়ো হতে থাকে যুদ্ধের ইচ্ছা। সে লড়াই চাই। বাচ্চারাও যুদ্ধ ভালোবাসে। পথের পাঁচালি-র অপু যেমন শৈশবে মহাভারতের বিভিন্ন চরিত্রের অবলম্বন করে একাকী যুদ্ধ করত, কুশল নামী এই রিকশাওয়ালার ছেলেটিও একা একা কল্পিত শত্রুপক্ষের উদ্দেশ্যে গুলি ছোঁড়ে। মূলত মানুষ মনে মনে যুদ্ধকামী। রামায়ণেও আছে যুদ্ধের কথা। গল্পটিতে রঘু সীতা কুশল যেন রামায়ণের সংস্করণ। যদিও তা নামের জন্যই শুধু, অন্য কোনো কারণে নয়। কুশলের মধ্যেও বেড়ে ওঠা যুদ্ধের বীজ মানুষের প্রবৃত্তিকেই প্রকাশ করে। এই গল্পটিতেও অবচেতনকেই ভাষা দেওয়া হয়েছে। রঘুর সামান্য রিকশাতে কারগিল লেখা আর তার ছেলের মনে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার আকাঙ্ক্ষার মধ্য দিয়েই গল্পটি পরিণতির দিকে এগোয়।
দীপঙ্কর গুপ্তের গল্পের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল মনস্তত্ব। কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলির মনস্তাত্ত্বিক প্রকাশ,আচরণ, চলন ও বর্ণনা তিনি বরাবরই দক্ষতার সঙ্গে করেন। বেশিরভাগ সময়ে তার গল্পগুলি যেকোনও একটি চরিত্রকেই চেতন-অবচেতনের স্তর থেকে প্রকাশ করেন। ‘চেয়ার’ গল্পটিও সেইরকম গল্প। ‘বীজ’ গল্পটি যেমন মানুষের ভেতরে যুদ্ধ ও বীরত্বের প্রতি দুর্বলতা ও কামনাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে, তেমনি ‘চেয়ার’ গল্পটি একটি শিশু মনের ভয় নিয়ে বিস্তার পেয়েছে। ভয়ও মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা। পাশের বাড়ির বারান্দার চেয়ারে একজন বৃদ্ধ রোজ বসে থাকেন। লোকটি মারা গেছে। মানুষ মারা গেলে কী হয়, কোথায় যায় এসব নিয়ে তার কৌতূহল ঘনিয়ে ওঠে। সেই জানা থেকে জন্ম নেয় ভয়।
আবার মুক্তির ইচ্ছা নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘সতীন’ গল্পটি। পেটের বাচ্চা পাঁচ মাসে মারা যাওয়ায় তার স্বামী সতীন নিয়ে আসে। এরপরে সাবিত্রী ঘর ছেড়ে দেয়। আর ফিরে যায় না স্বামী ও সতীনের শত অনুরোধ সত্বেও। ঘর ছেড়ে যে একবার পথের সন্ধান পেয়েছে, তাকে কি আর ঘরে মানায়। বরং সাবিত্রী শাশুড়ির দেওয়া নাকছাবিটি ফিরিয়ে দেয়। প্রসঙ্গে গল্পগ্রন্থটির নামও ‘নাকছাবি’। দীপঙ্কর গুপ্তের গল্পে একজন ব্যক্তি মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, কামনা, ষড়যন্ত্র, অসহায়তা, প্রেম, রাগ, দুর্বলতা, দুষ্টামি, অবদমন মনস্তাত্ত্বিক পটভূমিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এই গল্পে সাবিত্রীর মনের ইচ্ছা কখনোই স্পষ্ট জানা যায় না। সমস্ত গল্পে নানাবিধ কাজ ও অনুরোধের কোনো সদুত্তর তাকে দিতে দেখা যায় না। একটা চাপা দমবন্ধ করা অনুভূতি। এত দিন ছিল সে একলা, স্বামী পরিত্যক্ত। আজ হঠাৎ তার সতীন ও স্বামীর আগমন ও তাকে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগে স্বভাবতই একটু অবাক হয় সে। তার স্বামী অকর্মণ্য, কিন্তু বছর বছর বাচ্চা পয়দা করতে উস্তাদ। সাবিত্রীর সতীনের এখন তিনটি বাচ্চা। কোলে একটা, আর দুটি একটু বড়ো। আরেকটি আছে পেটে। সাবিত্রীর মানসিকতা ও জেদ স্পষ্ট হয় সতীনের প্রতি তীব্র ভর্ৎসনায়, “ কীতালো পুড়ামুখী বছর বছর বাইচ্চা বিয়াইরে, নিজর বায় একবার দেখছছ নি” মেলাতে তার স্বামীও একা পেয়ে তার হাত ধরে বলে, “সাবিত্রী ফিরিয়া চল”। কিন্তু গল্পের শেষে সে তার একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন নাকছাবিটিও ফিরিয়ে ভারমুক্ত হতে চায়। সাবিত্রীর খুব ব্যক্তিত্বময়ী নারী। গল্পের কোথাও তাকে বাচালতা প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। এমনকি যখন তার স্বামী তাকে তাড়িয়ে দেয় বা নিতে আসে। সে সব সময় নীরব। তবে সতীনের প্রতি তার এই উক্তিতে তার ভেতরের স্বাভাবিক বিবেচনাময় ও ব্যক্তিত্বময় মনের সন্ধান সহজে পাওয়া যায়। সেই জন্যই হয়ত সে আর ফিরে যায় না। তাদের ফাঁদে পা দেয় না। কারণ তার সতীন অসুস্থ এবং আবার গর্ভবতী। সুতরাং প্রয়োজনেই যে তাকে নিতে এসেছে ওরা, তা সে সহজেই বুঝে ফেলে।
মান্টোর একটা গল্প রয়েছে ‘টিটওয়াল কা কুত্তা’ নামে। সেই গল্পটিতে একটি কুকুরকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান ও ভারতের সৈনিকদের মাঝে গড়ে ওঠা টানাপোড়েন ও অবশেষে কুকুরটির করুণ মৃত্যু মনে দাগ কেটে যায়। ‘রঘুনাথ’ গল্পটিও পাকিস্তান ও ভারতের যুদ্ধের পটভূমিকা নিয়ে গড়ে উঠেছে। এখানে ইঁদুরটির অবস্থা হয় মান্টোর সেই কুকুরের মত। রঘুনাথ টুকরি বানায়। একদিন সেই টুকরিতে একটি ইঁদুর ফেঁসে যায়। টুকরিবদ্ধ ইঁদুরকে বারবার খোঁচা দেয় রঘুনাথ আর মজা পায়। ধীরে ধীরে যেন মেটামরফসিস ঘটে যায়। রঘুনাথ নিজেকেই খাঁচাবদ্ধ ইঁদুর ভাবতে শুরু করে। আসলে আমরা প্রতিটি মানুষ সিস্টেম বা রাষ্ট্রের কাছে বন্দী ইঁদুরটির মত। একটি রাজনৈতিক বিষয় তথা রাষ্ট্র ব্যবস্থার আগ্রাসনে একজন নাগরিকের স্বাধীনতা যে কীভাবে ভূ-লুণ্ঠিত তারই প্রকাশ ঘটেছে এখানে।
আবার ‘মানিক’ গল্পে ত্রিপুরার উগ্রপন্থী সমস্যা আবহ রচনা করেছে। আমরা জানি আট-নয়ের দশকে ত্রিপুরায় উগ্রপন্থী সমস্যা চূড়ান্ত আকার নেয়। সেই ভয়ের পরিবেশকে অবলম্বন করে হাসির একটা বাতাবরণ সৃষ্টি হয় গল্পটিতে। যদিও গল্পের শেষে ভয়ের চোরাস্রোত থেকে যায়। উগ্রপন্থী কবলিত একটা ভয়সংকুল পরিবেশে একজন সাধারণ ছেলের অবদমিত ইচ্ছা বাইরে বেরিয়ে আসে। সে চায় লড়াই করতে। কোনো একদিন সেই পরিবেশ আসে। হামলাকারী উগ্রপন্থীদের সঙ্গে সে হামলায় জড়িয়ে যায়। ধ্বস্তাধস্তিতে সে কান কেটে নেয় উগ্রপন্থীর। কিন্তু পরে দেখা যায় তার স্বপ্নদোষ এবং মানিক ঘুমের ভেতর তার বৌয়ের কানে কামড় বসিয়েছিল। এই ছম ছম করা পরিবেশে বাবা যখন বলে, “ইগুর স্বপ্ন দেখার দুষ গেল না। দিনঅ যেতা ভাবে, রাইত অতাঔ মনো অয়, আমারে কম জ্বালাইছে নি” তখন হাসির একটা বাতাবরণ তৈরি হয়ে যায়। তবে গল্প শেষে সবাই যখন বলে ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়, তখন আবার ভয়ের আবহাওয়া সৃষ্টি হয়। এখানেই গল্পকারের কৃতিত্ব। ভয়ের পরিবেশে যেমন অনাবিল হাসি সৃষ্টি করেন। তবে মানিক নিয়ে হাসি উঠলেও মনে হয়, সাধারণ শ্রেণি সবসময়ই ঐ মানিকের মত। এমনিতে দুর্বল, কিন্তু হঠাৎ কোন পরিবেশে তার মধ্যেই জাগে অমিত সাহস।
মানুষের লালসা ও লোভের স্বরূপ নিয়ে হালকা মেজাজের ও মজার একটি গল্প ‘প্রসাদ’। মূলত ‘অগোছালো দৃশ্যাবলী’ গল্প-এর বইটিই মানুষের সহজ জীবন চালচিত্র নিয়ে গড়ে উঠেছে। ছোট ছোট বিষয়, পাওয়া, না-পাওয়া, সুখ দুঃখ, আনন্দ এই বইটির ছত্রে ছত্রে কাহিনিকে নির্মাণ করেছে। ‘প্রসাদ’ গল্পে পিসিমা বাড়িতে আনা মুরগির যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ, কিন্তু ঠাকুরের আসনে পাড়া ডিমটিকে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ার আগেই লুফে নেন। তখন আর তার ব্রাহ্মণ বাড়ির সেন্টিমেন্টে আঘাত পড়ে না। এই যে কম্প্রোমাইজটা, স্বার্থের জন্য, নিজের লাভের জন্য একটু নিচে নামতে অস্বীকার না করা, এটাই মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। মানুষের প্রবৃত্তি কেমন হতে পারে তার অনবদ্য প্রকাশ ‘কুমড়ো ফুল’ গল্পটি। এই গল্পে মেয়েটি পূর্ব পুরুষের সমাধিকে নিয়ে থাকে। তার যত্ন-আত্ত্বি করে। মাধব তাকে বিয়ে করতে চায়। তাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য, অন্য কারো হাতে যাতে না পড়ে তার জন্য মাধব ছড়িয়ে দেয় যে সে পাগল। মাধবের অধিকারবোধ ও নিজের করে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা মেয়েটিকে সামাজিকভাবে নিচে নিয়ে আসে। দীপঙ্কর গুপ্ত মানুষের চরিত্রের এই ছোট ছোট প্রতিক্রিয়া, বৈশিষ্ট্যকে খুব গভীরভাবে আলো ফেলে দেখেছেন। গল্পে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন। ‘গর্ত’ গল্পে যেমন করিমের চাচা, চাচাতো ভাইরাই তার সুদিন দেখে ঈর্ষান্বিত হয়। করিমের জমি নিচে, ওদের জমি উপরে। ওরা জল না ছাড়লে সে জল পায় না। কিন্তু কাঁকড়া গর্ত খুঁড়ে দিলে সব জল সেচ ছাড়াই তার জমিতে এসে পড়ে। করিম এই বছর দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়। এই যে সামান্য চাওয়া, নিজের জমির গাছটা যাতে সামান্য জল পায়, তাতেই করিম দেখে নিজের স্বজনদের রাগী চোখগুলো। স্বল্প চাওয়া, আর কিছু নয়। খুব সামান্য স্বপ্ন। কিন্তু তা-ই করে ওঠা এক এক সময় দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। ‘গর্ত’ গল্পে করিম তার জমিতে জল পেয়ে আনন্দে গাছের মত সতেজ হলেও তার বিপরীত চিত্র আছে ‘মানিক মিয়া’ গল্পে। দেশভাগের পর ফেলে দেওয়া মুসলমান পরিবারের ভিটা দখল করায় তার নাম হয়ে যায় মানিক মিয়া। কিন্তু আদতে সে হিন্দু। সমস্ত এলাকার নারিকেল গাছগুলি তার হাতের লাগানো। সে নিজের সন্তানের মত যত্ন করে গাছগুলির। আর এদিকে মোবাইল টাওয়ারের জন্য জমি দরকার। টাকার লোভে এলাকার অনেকেই গাছের মালিকেরা গাছগুলি কেটে ফেলতে চায়। এগুলি কাটার জন্যও ডাক পড়ে মানিকের। একটা অদ্ভুত অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয় তার মনে। কিন্তু কিছু করার থাকে না। চতুর্দিকে অজস্র টাওয়ারে ভরে যাচ্ছে, গাছ কমে যাচ্ছে। যন্ত্রসভ্যতার বিপুল আগ্রাসনের মুখে অসহায় পিতার আর্তনাদ যেন ভেসে আসে। মানিকের অসহায়তা এখানেই যে সে নিজের হাতেই কাটতে হয় নিজের লাগানো গাছগুলিকে। সে গাছের মালিক নয়, কিন্তু এই যন্ত্রণা তার। এ তার পরাজয়। সে অনেক চেষ্টা করে প্রতিরোধ গড়ে তোলার। কিন্তু তার জোরই বা কতটুকু। লক্ষ করলে দেখা যায়, খুব সামান্য ইমোশনকে কেন্দ্র করেই লিখিত হয়েছে গল্পটি। কিন্তু ভেতরে একটা যুগের ইতিহাস। প্রকৃতি নষ্ট করে ফেলছে মানুষের চাহিদা ও কর্মকাণ্ড। গ্রাম ও শহরের দ্বন্দ্ব এখানে ভাষা পেয়ে যায়। বন আর সভ্যতার দ্বান্দ্বিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে মানিক মিয়া যন্ত্রণা পেতে থাকে।
‘কালা মুর্গা’ গল্পটির গল্প কথক স্বয়ং কালা মুর্গা। বাজার থেকে বিক্রি হয়ে মালিকের বাড়িতে যাবার অভিজ্ঞতা বলছে মুর্গাটি। যেকোনও সময় তার জীবন বিপন্ন হতে পারে। আসলে জীবনের অনিশ্চয়তার দিকটি একটি বড়ো বিষয়। যেকোনও সময়েই মৃত্যু হতে পারে। এই অনিশ্চয়তা ও বিপন্নতা থাকলেও কালা মুর্গা বেঁচে যায়। তবে ‘যুদ্ধ’ গল্পের শুয়োরটি বাঁচতে পারে না। এই গল্পটিও শুয়োরের মুখ দিয়ে বলা। তবে রড ঢুকিয়ে করুণ ও নিষ্ঠুর পরিণতির মধ্যে গল্পটির পরিসমাপ্তি ঘটেনি। এখানে অদ্ভুতভাবে গল্পকার অন্য একটি ট্রিটমেন্ট করেছেন। শুয়োরের মাংস খেয়ে অসুস্থ হতে থাকে শহরের সবাই। যুদ্ধ শুরু হয় সেখান থেকেই। একটা প্রতিশোধ রয়ে যায় গল্পটিতে। যেহেতু শুয়োর গল্পের কথক, সুতরাং তার মৃত্যুর পরেও তার মাংস খেয়ে অসুস্থতা ও তার উল্লাসের মধ্যে আছে এক ধরণের প্রতিহিংসা। মনে হয় লেখকের উদ্দেশ্য ছিল তা-ই। এটা এমন একটা বিপন্নতা যাকে এড়ানো যায় না। আজকের ভোগবাদী সময়ে প্রতিটি মানুষের এই করুণ পরিণতি। এই বিপন্নতাবোধ থেকে তার মুক্তির উপায় নেই। সমাজতন্ত্রের মুখোশ পরে আসলে ধনতন্ত্রকামী সমাজ। আর তাই ভোগবাদেরও এত বাড় বাড়ন্ত। আর ভোগবাদের হাতে আজকের বাজারের ফাঁদে পড়ে প্রতিটা মানুষের এই স্বাভাবিক পরিণতি। যেমন, ‘চেনা মেয়ের কথা’ গল্পটিতে আজকের সোশাল মিডিয়ার যুগে অজস্র ভার্চুয়াল বন্ধু-বান্ধবীর থেকেও বাড়তে থাকা একাকীত্ব প্রাধান্য পেয়েছে। মৃত টিয়াপাখি, ঘুণে ধরা কলকব্জা এই অন্তঃসার শূন্য সময়ের প্রতীক হয়ে আসে গল্পটিতে। অন্যদিকে ‘সুন্দরী রিমি’ গল্পটিতে রয়েছে ভোগবাদী সময়ের অন্য একটি স্বরূপ। রিমি দে কবিতা লেখে। এক কালে তার লাস্যে সবাই তার প্রতি আকৃষ্ট ছিল, এখন যৌবন পশ্চিমে, লেখাতেও। এখন সে কম বয়সী তরুণ কবিদের ফোনে মিষ্টি করে আহ্বান জানায়। একদিকে যেমন গল্পটিতে রয়েছে রিমির অসহায়তা। তেমনি পাঠকের মনে তার জন্য করুণাও উদ্রেক হয়। লাস্য শেষ হলে যেমন সব সরে যায়, আজকের কর্পোরেট সমাজ প্রয়োজন ফুরোলেই ছুঁড়ে মারে, রিমি নিজেই ব্যবহৃত হয়ে যায়। বিষণ্ণতা, ক্লান্তি আর নিজের প্রতি ঘৃণা ছাড়া তার আর কিছুই থাকে না। যৌন অবদমন তথা একটু ভালোবাসার জন্য একাকীত্বের অবসাদ কাটানোর মধ্যে আছে আজকের সময়ের অসহায়তা গ্লানি, ক্লান্তি ও বিপন্নতা। ভোগবাদ ও যৌন অবদমনের বিকট চেহারা প্রকাশ পায় ২০১২ সালের দামিনী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। অনুভবী দীপঙ্কর ‘২০১২’ নামে দামিনীকে নিয়ে একটি গল্প রচনা করেন। তবে সময়ের এই অনিশ্চয়তা ও বিপন্নতার মাঝখানেও রয়েছে আনন্দও। সবকিছুকে একরৈখিকভাবে ভাবা যায় না। যেমন ‘চিত্ত’ গল্পে চিত্ত বৃষ্টিতে নালার উপরে বসে মাছ ধরে। তার ঘর যে কোন সময় জলে ভেসে যেতে পারে। কিন্তু মাছ ধরার আনন্দে সে মশগুল। একসময় তার ঘর ভেঙ্গে এসে তার জলেই আটকে যায়। এই বৈপরীত্য তার গল্পের ছত্রে ছত্রে আছে। আজকের ধনকামী সমাজের বাইরে প্রান্তিক যে জীবন তার মাঝেও এর প্রভাব পড়েছে। বহুতল সমাজের প্রতিটি স্তরেই পড়েছে তার নানা রঙের ছাপ। এই ধনতান্ত্রিক কাঠামোর ছাপ মধ্যবিত্ত জীবনে পড়েছে চূড়ান্তভাবে। মধ্যবিত্ত সমাজ ভোগবাদের কবলে পড়ে প্রতি নিয়ত রক্তাক্ত হচ্ছে। ‘স্বপ্নময়ের স্মৃতি’ গল্পে মধ্যবিত্ত জীবনের ব্যর্থতা ও সংকট বিষয় হয়ে এসেছে। ফ্লোরে সাদা ঝকঝকে মার্বেল পাথর বসানো নিয়ে কাহিনিটি। ছ’ফুট বাই ছ’ফুট বারান্দা স্বপ্নময়ের স্বপ্নের। তার ঘরে অভাবের কালো চেহারা। এই চাহিদা তার ভেতরের অসহায় দৈন্যতা ছাড়া কিছুই প্রকাশ করে না। মধ্যবিত্ত জীবনের এই টানাপোড়েন আজকের পৃথিবীতে ভীষণ সত্য একটি বিষয়।
মহাকাব্যিক নয় যে জীবন, যে জীবন এইভাবে গাছে গাছে নারিকেল পাড়ে, যে জীবন নালাতে মাছ ধরে, যে জীবন রিকশা চালায়, তাদের অতি সাধারণ কথাই সব সময় দীপঙ্কর গুপ্তের বেশিরভাগ গল্পের মূল বিষয়। ‘চিত্ত’ গল্পটিও তেমন একটি গল্প, বিষয়গুণেই যা অনবদ্য। ‘মুক্তচিত্ত’ গল্পে মাছ ধরতে ধরতে জলে ঝাঁপ দিয়ে জীবন থেকে মুক্তিলাভের ইচ্ছার মধ্যে রয়েছে এক ধরণের দার্শনিকতা, “মাছের মালিক কে?” তবে এই রকম অনন্ত প্রশ্নের মুখোমুখি লেখক তার চরিত্রদের দাঁড় করান না। মুক্তচিত্ত গল্পটি একটি অন্য ধরণের গল্প। দার্শনিকতাকে লেখক কখনই গুরুত্ব দিতে চান না। জয় গোস্বামী একবার একটি কবিতায় লিখেছিলেন, ‘রাস্তার ধারে এত কাশফুল দাঁড় করাল কে?’ চোরাস্রোতে এখানে ঈশ্বর ভাবনাটি এসে যায়। তবে মূলত দীপঙ্করের গল্পে বাস্তবতা একটি বিষয়। তার লেখায় সমাজ বাস্তবতাকে তিনি সব সময় ধরতে চেয়েছেন। মডার্নিজমের ভাবনাটি পাশ্চাত্য থেকেই আমদানি হয়েছে। তার প্রেক্ষিত ধরেই বিকাশলাভ করেছে পোস্ট মডার্নিজমের ভাবনাটি। মার্ক্সীয় বীক্ষা দীপঙ্করের গল্পকে সমৃদ্ধ করেছে। তার লেখায় খেটে খাওয়া মানুষের জীবন বারবারই এসেছে। এমনকি এইসব চরিত্ররা তাদের লোক জীবন, বিশ্বাস, রীতিনীতি নিয়েই সরাসরি প্রবেশ করেছে। মার্ক্সের দর্শন তার লেখায় ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দিলেও তার চরিত্রগুলি দর্শনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়নি। মানুষের সাধারণ বিশ্বাসকে তিনি কখনো আঘাত করতে চাননি। যার জন্য দেখা যায়, আশাবাদ তার লেখায় সব সময় বড়ো হয়ে থাকেনি। বামপন্থী রচনার শেষে আশাবাদ একটি স্বাভাবিক লক্ষণ।
তবে দীপঙ্কর গুপ্তের গল্পের কোথাও দুঃখে ভেঙে পড়া নেই বা হতাশায় মুহ্যমান হওয়া নেই। যন্ত্রণা আছে, আর্তনাদ আছে কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার চরিত্ররা যেন এই সময় বা সমাজকে মেনে নিয়েছে। প্রতিরোধ আছে। শ্লেষ আছে। রাগ বা ক্ষোভ আছে কিন্তু ভেঙ্গে পড়া নেই কঠিন পরিস্থিতিতেও। জীবনানন্দের “তবে ধরা যাক দুয়েকটি ইঁদুর” এর মত তার চরিত্ররা একটু সময় সুযোগ খুঁজে নেয় বাঁচার আশায়। এ ব্যাপারে তার গল্পের আত্মায় আছে একটা স্থিরতা। লেখকের মনেই আছে সেই ধ্যান। সময়কে দেখার এই ধ্যান কবি লেখক মাত্রেই থাকে। কিন্তু অনেক সময়ই তা বাইরের চাপে অস্থির হয়ে ওঠে। ‘ধ্যানী’ গল্পে গল্প কথকের চোখ দিয়ে বিভিন্ন আসন মুদ্রার ভেতর দিয়ে আশপাশটাকে দেখা অভূতপূর্ব রূপ পায়।
‘সুন্দরী রিমি’তে যৌন অবদমন মুক্তি খোঁজে, পায় না। তার রূপ ঝরে পড়েছে এখন। গল্পনামে সুন্দরী শব্দটিই বিদ্রূপাত্মক। আবার ‘শব্দহীন ভাঙা’ গল্পে একজন সমকামী বা আত্মরতি সম্পন্ন ম্যাডিকেল রিপ্রেজেন্টিটিভ যুবকের নিজের শরীরে নারী শরীর আবিষ্কার করে, অনুভূতির আনন্দকে বড়ো করে তোলে। যদিও সবই কল্পনা। প্রেমের ইচ্ছা জাগে তার। নারীদেহের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে। আবার নিজের ভেতরে পুরুষকেও ধ্বংস করতে চায় না। দেহভিত্তিক এই তাড়না আজকের আধুনিক সময়ের একটি বড়ো ক্রাইসিস। ভোগবাদী সময়ের এই বিপন্নতাবোধ থেকে মুক্তির উপায় নেই। তবু নারীর প্রতি আকর্ষণের ভেতরে এক জন যুবকের স্বাভাবিকত্ব আবিষ্কৃত হয়। এটাই মুক্তি। আবার যৌনতাকেও কিভাবে প্রেম বলে মনে হয়, এর সুন্দর উদাহরণ ‘ল্যাবরেটোরি’ গল্পটি। নামটিও অনবদ্য। স্যার আর ম্যাডামের মধ্যে গড়ে ওঠা রসায়ন। ল্যাবরেটোরির কঙ্কালের সামনে দুটি রক্ত-মাংসের শরীরের দৈহিক মিলন অভূতপূর্ব ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করে। এই কন্ট্রাস্ট গল্পটির সম্পদ। কঙ্কাল যেন দেহ খুঁজে পায়। দেহ যেন প্রেমে মুক্তি খোঁজে। তবে ‘মুক্তি’ গল্পে অণিমা নামে সমকামী নারীটি মুক্তি খোঁজে খোলা আকাশের কাছে। সে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। ‘মুক্ত চিত্ত’ গল্পের চিত্ত মুক্তি খোঁজে জলে নিজেকে বিলিয়ে দেবার মধ্যে, কিন্তু ‘মুক্তি’ গল্পের অণিমা আকাশে মুক্তি খুঁজলেও আকাশকে সে সমকামী নারীর মতই ভাবে। দুটি গল্পের মুক্তি পুরো দুই রকমে। অণিমা শহুরে হলেও চিত্ত যে গ্রামীণ তা সহজেই বুঝা যায়। দুই জনই প্রকৃতিতে মুক্তি পায়, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি কত আলাদা। একজন মাছের মত নিজের শরীর জলে ছেড়ে দিয়ে জানতে চায়, “মাছের মালিক কে?” আর অন্যজন নিজের দেহেই পায় মুক্তি। দীপঙ্কর গুপ্তের লেখার এই হল জাদু। চরিত্রের অবস্থানে তার চাহিদার যে আকাশ পাতাল পার্থক্য, তা তিনি নিপুণভাবে ধরেছেন।
‘সীমানাহীন’ গল্পটি গণিকা ও প্রশাসনের রসায়ন নিয়ে লেখা। সাধারণ একটি শহর রাতের বেলা কতদূর বদলে যায়, তার চিত্র ধরা পড়ে লেখাটিতে। একদল যুবক পুলিশের প্রশ্রয়ে গণিকাদের নিয়ে যায়। খুব স্বল্প কথায় রাতের আকাশে পুড়ে যাওয়া এই গণিকাদের ভবিতব্যের দিকে লেখক আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। লেখক বলেন, “গণিকারা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। নিজেকে কাপুরুষ মনে হয়”—সামান্য দুইটি লাইনেই গণিকাদের চরিত্র ও লেখকের চরিত্র ও অবস্থান ফুটে ওঠে। প্রসঙ্গে ‘রঙ ভাঙলেই আকাশ’ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখতে গিয়ে “আভাষ” অংশে কবি সন্তোষ রায় লিখেছেন’ “গল্প অণুতর হলে কবিতার দিকে যায়। না-গল্প, না-কবিতার মধ্যবর্তী কোথাও স্থান হয় তার। দীপঙ্করের তৃতীয় এই অণুগল্প সংকলনের বোধ এমনই এক স্তরে বিরাজ করে”। ‘রঙ ভাঙলেই আকাশ’ বইটির বেশিরভাগ গল্পই কবিতার আবহ ও গন্ধ পরিগ্রহ করেছে। “সীমানাহীন” বা “২০১২” ইত্যাদি গল্পগুলি তেমনই লেখা। যেখানে “২০১২” গল্পে সারা ভারত তোলপাড় করা দামিনী হত্যার যন্ত্রণা কাব্যিক মাত্রা পেয়েছে। ‘সীমানাহীন’ গল্পটিতে নায়কের প্রতি গণিকাদের উপহাস আর নায়কের তাদের প্রতি করুণা ও প্রশাসনের দ্বিচারিতা ও ভ্রষ্টতা সব মিলিয়ে কবিতাগন্ধী একটি ভারসাম্য তৈরি করেছে। এখানে নারীর একটি ভিন্ন রূপ প্রকাশ পেয়েছে। নারীর যেন দুঃখ নেই। সে জানে পৃথিবীর সকল যুবককে তার দিকে টেনে না রাখতে পারলে তার ব্যবসা হবে না। তাই যে তাকে অন্যভাবে দেখে, তাকে সে কাপুরুষই ভাবে। সেজন্য গল্পকথক তার কাছে উপহাসের পাত্র। কিন্তু “নদীর জন্য” গল্পটিতে নারীটি দুঃখে নদী হয়ে যায়। অজস্র পুরুষের হাত লেগেছে শরীরে। ভোগ ছাড়া পুরুষের কিছুই নেই। সে বুঝতে পারে, “সব পুরুষ পিতা নয় বলেই মাড়িয়ে যায়”। এই লেখাটিতে নারীর অনুভবকে পাওয়া যায়। ‘সীমানাহীন’ লেখাটিতে অসহায়তা ও ক্রাইসিসের চিত্র উঠে এলেও একই জায়গা থেকে লেখা ‘নদীর জন্য’ লেখাটিতে সেই বিপন্নতার স্বরূপ পৃথক। তবে এই দুটি লেখাতেই সমাজের কৃতকর্ম তীব্রভাবে ফুটে ওঠেনি। ‘নদীর জন্য’ লেখাটি নারীহৃদয়ের ভাষা আর ‘সীমানাহীন’ দরদী ও অনুভবী একজন যুবকের চোখে দেখা। সমাজকে এখানে অনেকটাই অতৎপর মনে হয়। যেটা হয় না “সাগর উঠোন” গল্পটিতে। সেখানেও একজন অনুভবী যুবকের চোখে বর্ণনা করা হয়েছে গল্পটি। নদী পাড়ের বস্তিতে থাকা এক নারী যে পেশাগতভাবে গণিকা তার বাড়ির সামনের জন্য প্রশাসনের এক অফিসারের কাছে একটা কালভার্ট চাওয়া নিয়ে গড়ে উঠেছে লেখাটি। নারীটিকে কিন্তু এখানে সাধারণ একজন পারিবারিক নারী বলেই মনে হয়; যে এই যুবককে শ্রদ্ধা করে। সে বলে, ‘তখন আমি রাস্তার লগে দাঁড়াই থাকি খদ্দেরের লাগিয়া। আমরার দিকে মানুষ চায় অইন্য চোউখ লইয়া। আফনার লাখান মানুষর লগে তো তখন কতা কওয়া যায় না।” এই অবস্থানে থেকেও তার যে সম্মানবোধটুকু তা চরিত্রটিকে উঁচু স্থান দিয়েছে। গল্পের শেষে যখন সারা শহরের জল নেমে উঠানটিকে সাগর মনে হয় তখন গল্পটি ভিন্ন মাত্রা পায়। সারা শহরের আবর্জনা যেন বয়ে বেড়াচ্ছে এই ছোট্ট উঠোনটি। সমাজ এখানে দায় এড়াতে পারে না।
‘জলজীবন’ গল্পটি চিরকালীন প্রান্তিক মানুষের জীবন গাথা। ঘর হারানো আর ঘর ফিরে পাওয়ার গল্প। কচুরি পানার জীবন। উদ্বাস্তু। ভেসে ভেসে আসা যাওয়া। নলিনী যখন নদীতে জল আসে, তখন মাছ ধরে জীবন নির্বাহ করে, আর যখন জল নেমে যায়, চড়া পড়ে তখন কৃষিই সম্বল। ছয় মাস সে ঘরে থাকে। বাকি ছয় মাস তার ঘর নেই। ত্রিপুরার উদ্বাস্তু সমস্যাও এখানে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। আজকে সমস্ত বিশ্বেই এই সমস্যা। সিরিয়া হোক, মায়ানমার হোক। গল্পটিতে চিরকালীন যাযাবর মানুষের বেদনাই ভাষা পেয়েছে। দীপঙ্করের গল্পের একটি বৈশিষ্ট্য হল, অতি বিশেষ ঘটনাকে সাধারণ ও সবার করে তোলা।
‘বীজ’ গল্পে শিশুর যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার মধ্য দিয়ে আপামর মানুষের যুদ্ধের প্রতি আকাঙ্ক্ষা যেমন ভাষা পেয়েছে; তেমনি ‘চেয়ার’ গল্পে মৃত্যু নিয়ে শিশু মনস্তত্বের আবহে মানুষের চিরকালের স্বাভাবিক প্রবণতা ভয়কে পুনরাবিষ্কার করা হয়েছে। আবার ‘শুয়োপোকা’ গল্পে একটি শিশুর চোখ জীবনশৈলী তথা প্রেমের পাঠ নেয়। প্রেম-যৌনতা নিয়ে ভুল পাঠ কৈশোরেই অনেক জীবন নষ্ট করে দেয়। যৌন অবদমনের শিকার হয়ে ভুল পাঠ নিয়ে কচি বয়সেই জন্ম নেয় জিঘাংসা, আক্রোশ। শুয়োপোকা একদিন প্রজাপতি হয়। এই গল্পে এই প্রবণতা থেকে বিকশিত হতে থাকা শিশুটি একদিন অপরাধ জগতে প্রবেশ করে। তবে ‘চেয়ার’ গল্পের এই ভয় প্রবণতা জয় হয় ‘বেত’ গল্পটিতে। যদিও দুটির প্রেক্ষিত একেবারেই আলাদা। ‘বেত’ গল্পে বাবার শাসন থেকে মুক্তির উপায় খোঁজে ছেলেটি। একদিন দুপুরে সবার অনুপস্থিতিতে উঁচুতে রাখা বেতটি ভেঙে টুকরো টুকরো করার মধ্য দিয়ে বালকটির ভয়ই পরাস্ত হয়। এই গল্পটি সুন্দর হয়ে ওঠে যখন বাবা ও মা হাসতে থাকে আর ছেলের এই কৃতকর্ম ধরে ফেলে এবং ছেলেটি লজ্জা পায়। এটা যেন এক ধরণের অভিষেক। অভিষেক ভয় থেকে মুক্তির। এখানেও শিশু মনস্তত্ব দারুণভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
দীপঙ্কর প্রতীক রচনায় সিদ্ধহস্ত সে কথা আগেই বলা হয়েছে। তার বেশিরভাগ লেখা একটি প্রতীককেই রচনা করে। যেহেতু তার গল্পগুলি মিতায়তন, সুতরাং এই ছোট পরিসর তার বিষয় ও চরিত্রকে প্রতীক করে তোলে। উপরের বেশিরভাগ গল্পই এর উদাহরণ। আলোচিত ‘বেত’ গল্পটিও আসলে প্রতীকী গল্প। বেত এখানে প্রতীক। বাবার শাসন বা অনুশাসনের প্রতীক। বেত ভেঙ্গে ফেলার মধ্য দিয়ে ভয় জয় করে কৈশোরে পদার্পণ ঘোষণা করে ছেলেটি। ‘শুয়োপোকা’ গল্পটিতেও এই প্রবণতা দেখা যায়। ‘সময়’ গল্পে ঘড়িটি প্রাচীন যুগের তিন জেনারেশনের প্রতীক হয়ে আসে। ঘড়ি ভেঙ্গে যাওয়া আসলে সেই যুগটিই কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া। সিম্বলিক গল্পগুলিতে দীপঙ্কর যথেষ্ট মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। ‘মুখোশের ভেতরে’ গল্পটি তো এই বিষয়ে অনবদ্য। একটি কম্বল মুহূর্তেই হয়ে ওঠে কারবালার প্রান্তর। আঙ্গুরা বিবি সরকারের কাছ থেকে বাছাই করে একটি কম্বল নেয়। দানের এই কম্বলটি সবুজ ও লাল লাল ছোপ ছোপ। আঙ্গুরার আশেপাশে অনেক সাধু। ঘটনা পরম্পরায় আঙ্গুরা হাসান ও হোসেনের কথা, তাদের করুণ মৃত্যুর কথা ভাবতে থাকে। আবার ‘একগোছা চাবি’ গল্পে চাবি হয়ে যায় একই সঙ্গে মুক্তির চাবিকাঠি আবার হয়ে যায় মায়ার শেষ নিশান। যে চাবির গোছা মায়ের আঁচলে ছিল, সেই গোছা থেকেই একটি চাবি মা মারা যাবার পর এসে ঝোলে ছেলের গলায় ধরার সঙ্গে। একটি অদ্ভুত ট্র্যাজেডি জীবনের। একটি নির্মম সত্য, যাকে কখনোই উপেক্ষা করা যায় না। প্রতীকী গল্প তখনই সার্থক হয়ে ওঠে যখন প্রতীক কে প্রতীক মনে হয় না। মালার্মে সিম্বলিক আন্দোলনে ভাষার উপরে গুরুত্ব আরোপ করেছেন বেশি। দীপঙ্কর তার গল্পের ভাষা নির্মাণে এমন একটি টান টান ও ঋজু ভঙ্গি নিয়েছেন, যা তার গল্পকে কবিতার কাছে নিয়ে গেছে। যেমন তার ‘আয়না’ গল্পটিতে দেশভাগজনিত দুঃখ, ফেলে আসা পূর্ব বঙ্গের স্মৃতি বিষয় হয়ে এসেছে কবিতার মত স্বল্প কথায়। এদেশে মাত্র আসা পরিবার বা জন এখনো একটা দ্বান্দ্বিক দোলাচলতায় আছে যে, তার দেশ কোথায়। ‘জলজ জীবন’ গল্পে চিরকালীন মানুষের পরিস্থিতি ও বেদনা ভাষা পেয়েছে, কিন্তু ‘আয়না’ গল্পে এসেছে সেই বেদনা দ্বন্দ্বের চেহারা নিয়ে। সে নতুন দেশকে মেনে নিতেও পারে না, আবার পুরানো দেশে ফিরে যাবার কোনো রাস্তা নেই। দুটি গল্পের মধ্যেই ভাষাগত ঐক্য থাকলেও ব্যঞ্জনা ভিন্নতর। দুটিরই উৎসভূমি দেশভাগ, কিন্তু প্রতীকায়নে দুটি ভিন্নতর স্বাদ দেয়।
ত্রিপুরায় গল্প রচনার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। দীপঙ্কর গুপ্ত তার গল্পকে সবার থেকে আলাদা করেছেন তার রচনার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের জন্য। তার গল্পে কাব্যময়তা একটা স্বভাবগুণ। মিত কথায় তিনি রচনার বিস্তার ঘটান। এ ব্যাপারে তিনি সত্যিই অনবদ্য। আজকের দ্রুত গতির জীবনে কবিতা হয়ে যাচ্ছে, অণু কবিতা। উপন্যাস হয়েছে উপন্যাসোপম। গল্প হয়ে গেছে অণু গল্প। দীপঙ্করের গল্পকে অনায়াসে অণু আখ্যা দেওয়া যায়। এ তো গেলো শ্রেণিগত বিভাজনের কথা। সাহিত্যে শ্রেণির চাইতে বড়ো হল আবেদন। দীপঙ্কর গুপ্তের গল্প সেখানেই অনন্য। অল্প কথায় বিস্তৃতির দিকে তিনি পাঠককে নিয়ে যান। ত্রিপুরায় তথা বাংলা গল্পের জগতে এই ধরণের রচনা দুর্লভ। স্বাধীনতা পরবর্তী আজকের ভারতের মধ্যবিত্ত ও অবহেলিত মানুষের জীবন, তাদের টানাপোড়েন তার গল্পের মূল পটভূমি। সকল টানাপোড়েনের ভেতর থেকে, সমস্যার ভেতর থেকে তার চরিত্রগুলি সার্ত্রের মত ঘোষণা দেয়, “আমি আছি, আমি চিন্তা করছি”। তার গল্পে প্রান্তই হয়ে ওঠে কেন্দ্র। যাকে সমাজে উপেক্ষিত থাকতে হয়, সেই হয়ে ওঠে চরিত্র। সংগ্রামমুখর নিরন্ন মানুষের ভাবনা, দর্শন, বিপন্নতা ও অসহায়ত্বকেই তিনি দিয়েছেন ভাষ্যরূপ। তবে তার গল্প যেমন বেশিরভাগ সময়ে ‘আমি’ হয়ে কথা বলে, তেমনি তার লেখায় তার চরিত্রগুলি তাদের আমিত্বকে কখনোই বিসর্জন দেয় না। অস্তিত্ববাদের সদম্ভ ঘোষক যেন তারা। ধনকামী ভোগবাদী সময়ে টিকে থাকা এক একটি চরিত্র নিজের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবু বিশ্বাস টলছে না।
1 টি মন্তব্য:
ভালো লাগল এই অালোচনা। ড:কবি অভিজিৎ এর দেখার চোখে নাট্যকার দীপঙ্কর গুপ্ত অন্য রূপে ধরা দিল।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন