পাগলি মাসি
কবে সে কারও মাথায় বুলিয়ে দিয়েছিল সান্ত্বনার হাত,
তার করুণ ভেজা চোখে পেয়েছিল কেউ সহানুভূতি,
তার অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসা আশ্বাসবাণীতে
কেউ হয়েছিল উদ্বুদ্ধ, আশা খুঁজে
পেয়েছিল জীবনের।
মনের ভেতরে ডুব দিয়ে সে তুলে আনত সত্যবচন,
জীবনের প্রতি যে বিশ্বস্ত, তার ভাগ্যে ফলে যেত আশীর্বাদ।
কিন্তু মানুষ বড় পরনির্ভর, নিজের শক্তি খুঁজতে অনীহা,
চেষ্টা করবার পরিবর্তে সমস্যা নিয়ে আসে তার কাছে,
‘মাসি, তুমি করে দাও সমাধান, তুমি পথ দেখাও।’
বোঝে না তারা, সে আসলে বলত,
আশা মানেই জীবন, নিরাশা প্রচণ্ড
মিথ্যা।
প্রতিদিনই সূর্য ওঠে, নতুন দিনের
জন্ম হয়।
ভক্তদের যাচ্ঞার ভারে তার শরীর শীর্ণ, মাথায় পাকায়
সম্ভ্রান্ত জটা,
অনিদ্রার ঘোরের ঢুলুঢুলু চোখে তাকে তার উপাস্যের মতই দেখায়,
তার সামনে ধুপ ধুনো, খিচুড়ি
লাবড়া প্যাড়া ফলমূলের ভোগে
প্রতিদিন দেবীর কৃপা পাবার আশা।
বিরক্ত, বিতৃষ্ণ, ঘুমের জন্য আনছান, দেবীর তা হতে নেই,
দেবীর আসন বাঘের পিঠে, বাঘের হাজার
দাঁত নখ।
আজ নিভন্ত প্রদীপের মত তার প্রাণ ধুক ধুক করে,
এখন সে শুয়ে আছে পিছন ফিরে লেপমুড়ি দিয়ে
মাথার জটা মেঝেয় লুটোয়।
ধূপের সুঘ্রাণ ভেদ করে আসছে পেচ্ছাপের কটু গন্ধ,
সাজানো ভোগ নৈবেদ্যে বসছে মাছি, বসছে তার মুখেও।
বড় বড় নখওলা হাতে তাড়াচ্ছে ক্ষীণ প্রাণশক্তিতে
নাছোড় ঘ্যানঘেনে আবদারের উত্তরে অবোধ্য চিৎকার।
বাজছে কাঁসর, বাজছে ঘণ্টা, মন্দির সাজছে ফুলে,
ক্লান্ত বৃদ্ধা শেষ অপেক্ষায়, ওরে, ক্ষান্তি দে, শান্তি দে।
কাঁটা তারের বেড়া
ওই তো কাঁটাতারের বেড়া, একটি বন্ধ লোহার দরজা
সপ্তাহান্তে খোলে, পশরা বসে বিকিকিনির
হাঁটে।
হৃদয়েরও কি বিনিময় হয়? মা কস্বেশ্বরী
স্নেহের আঁচল বিছায় কমলাসাগরের ঘাটে ?
একই তো দেখতে দুটো ধার, কোনো ফারাক নেই কোথাও।
একই মানুষ, একই রকম বোল।
এপারের গাছ ডালপালা মেলে ওপারে ছায়া ধরে,
ওপারের মেঘ এপারে ঝরায় জল।
এপারের ঘাস হামা দিয়ে এগোয় কাঁটাতারের তলায়,
ওপারের লতা এধারে বেয়ে ওঠে।
এধারের বক ওধারে উড়ে জলায় মাছ ধরে, ওধারের শালিখ
এধারের জমিতে দানা খুঁটে।
ওধারের আজান হাওয়ার সাথে এধারে ভেসে আসে,
এধারের হাওয়া ওধারে ভাসায় ঘণ্টার মিঠে বোল ।
মানুষের হাত কেন পলকা বেড়ার দুধারে গোটানো?
বেড়া ভাঙ্গ, খোল, দুয়ার খোল।
রবার বাগান
রবার বাগানের ন্যাড়া মাথার উপর চাঁদ উঠেছে
উদোম জমির গায়ে উপর অজস্র কাটাকুটি
লোভের বলিরেখাময় মাটির শরীর
আগাছা নেই ঘাস নেই, নেই কোনো পাখির কাকলি
নেই ঝিল্লির ডাক কিংবা জোনাকির স্ফুলিঙ্গ
উলঙ্গ গণিকা নিঃশব্দে বসে মৃত্যুদিনের প্রহর গোনে
চাঁদের আলোয় তার ধূসর বার্ধক্য আজ বড়ই প্রকট
কত অল্প সময়েই এই গোলককে ধূসর করে দেওয়া যায়
এ অতিবৃষ্টির বিষুব সবুজ অঞ্চলেও
আদিগন্ত উদোম টিলাগুলো লাভের রবার গাছ পোষে
রবারের চৌকো টুকরোগুলো রোদে শুকোয়
গাড়িতে বোঝাই হয়ে যায় কোন দূরে দূরান্তরে
মুঠো মুঠো টাকা ঘরে আসে, টাকা!
পাকা ঘর, গাড়ি, কত বিলাসসামগ্রী
সন্তানেরা যাবে দিল্লি, ব্যাঙ্গালোর, আমেরিকা
অনেক টাকার বড় প্রয়োজন
অল্প সময়েই কত জীবনকথার ঝাঁপ ফেলা যায়
ধর্ষিতা উদোম জননী পড়ে থাকে শূন্য রবার বাগানে
সারা অঙ্গে কাটাকুটি নিয়ে সূর্য ও চাঁদের আলোর নিচে
তার আর সন্তান হবে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন