।। শিবানী দে।।
আমাদের বাড়িতে
কতকগুলো ট্রাঙ্ক ছিল, বাড়ির বড় সদস্যদের
আলাদা আলাদা ট্রাঙ্ক। সেগুলো যখন ওঁরা খুলতেন, আমাদের ছোটদের কৌতূহলের সীমা থাকত না। আমরা
ট্রাঙ্কের চারপাশে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে দেখতাম, শিশু
ভাইবোনরা যখন জিনিষপত্রের উপর ঝাঁপাতে আসত, তখন কড়া
ধমকে আমাদের বাচ্চাগুলোকে নিয়ে দূর হটতে হত, তখন আমরা
উঁকি মেরে একটু দূর থেকে দেখতাম। প্রতিবারই ট্রাঙ্ক
খোলার সময় দেখতে আসতাম, নতুন কিছু তেমন
দেখতাম না, কিন্তু তবুও মনে হত
এবারে নতুন কিছু রহস্য, অদ্ভুত কোনো সামগ্রী
লুকোনো আছে, যা ডালা ওল্টালেই বেরোবে।
প্রত্যেকটি
ট্রাঙ্কের মালিকানার মত, তার ভেতরের বস্তু, গন্ধ, আলাদা আলাদা
ছিল। মালিকদের আমাদের প্রতি ব্যবহার ও আলাদা ছিল।
মায়ের
ট্রাঙ্ক খুললে আসত ন্যাপ্থালিনের গন্ধ। ভেতরে শাড়ি, ব্লাউজ, আমাদের ভাল
জামা সুন্দর করে ভাঁজ করা---মা সেগুলো
বছরে একবার রোদে শুকোতে দিতেন। যেদিন খুলতেন, আমরা ন্যাপ্থালিনের গন্ধ পেয়েই আমরা হাজির হতাম দেখতে। ভেতরে
সিল্কের দু- তিনটে শাড়ি, অন্য শাড়ি আরো তিন-চারটে। আমরা
শাড়িগুলোতে হাত বুলোতাম, সিল্কের নরম, মসৃণ ঠাণ্ডা আরাম লাগত। মা বলতেন, কাপড়ে হাতের ধুলো লাগাচ্ছিস । নিজেদের
জামাগুলোও একবার খুলে দেখতে চাইতাম, কে জানে কখন
এগুলো পরার আবার সুযোগ হবে। আমাদের এক-দু সেট জামা তোলা থাকত বিশেষ কোনো
উৎসব আমন্ত্রণে যাবার জন্য। মা খুলতে মানা করতেন, বায়না করলে ট্রাঙ্ক বন্ধ করে দিতেন।
বাবার দুটো
ট্রাঙ্ক ছিল, একটাতে বাবার কাপড়, সোয়েটার,আলোয়ান ইত্যাদি শীতবস্ত্র, কিছু কাগজপত্র । সে ট্রাঙ্ক
খুললে ন্যাপথালিনের গন্ধ। অন্যটি তে শুধু থরে
থরে বই। কাপড়বাঁধানো, কাপড়জড়ানো
শাস্ত্রীয় বই, কাপড়জড়ানো নয় এমন
বইও কয়েকখানা। বাবা সেগুলো মাঝে
মাঝে খুলতেন। সেসব বইতে কি লেখা আছে জানতে খুব কৌতূহল
হত। কিন্তু এখানে হাত দেওয়া আমাদের ছোটদের পক্ষে সম্পূর্ণ
নিষিদ্ধ ছিল। বাবা বলতেন, এগুলো তোমাদের জন্য নয়, হাত দেবেনা। আমরা
সম্ভ্রমমিশ্রিত কৌতূহলের সঙ্গে সেগুলো খানিকটা দূর থেকে দেখতাম। সেই
ট্রাঙ্কের গন্ধ ছিল আলাদা, একটু ধুলোধুলো, নাক সুড়সুড়োনো গন্ধ।
ঠাকুমার
ট্রাঙ্ক ছিল সবচেয়ে আশ্চর্য জিনিষে ভরা। তার গন্ধ ও কেমনকেমন। সেটার আবার
হুড়কো ভাঙ্গা, ফলে তালা লাগানোর
ব্যাপারই নেই । সেটা খুললে দেখা যেত
রুদ্রাক্ষের মালা, অনেকদিন গত ঠাকুরদার
চশমা, গীতা, কিছু রহস্যময় পোঁটলা, ঠাকুমার ছোটমেয়ে, আমাদের ছোটপিসি, যিনি বিয়ের
বছরখানেক পর সন্তান হবার সময় মারা গিয়েছিলেন, তাঁর হাতে
লেখা গানের খাতা, তাঁর বানানো একটি আসন, একটি লম্বা কৌটো, তাতে সাধারণ খুচরো পয়সা, পুরোনো দিনের অচল তামার পয়সা, রূপোর একটি টাকা, ফুটো পয়সা। অন্য একটি
বেঁটে কৌটোতে কতকগুলো কড়ি। সেই কড়ি
থেকে যখন আমাদের চারটি কড়ি দিয়েছিলেন খেলবার জন্য, আমাদের কি আনন্দ! আমরা বেশি ঘাঁটাঘাঁটি
না করলে তিনি বকতেন না, বরং ঠাকুরদার জিনিষ, পিসির জিনিষগুলো খুলে খুলে আমাদের দেখাতেন।
কিছুদিন পর
যখন তিনি কাকার সঙ্গে তাঁর ওখানে বেশ কিছুদিনের জন্য যাবার তৈয়ারি করছিলেন, ছোটপিসির খাতাখানা বের করে আমাদের দিয়েছিলেন। আমরা মানে
আমার তিনবছরে বড় দিদি ও আমি। আমরা দেখছিলাম খুব
সুন্দর গোটাগোটা অক্ষরে খাতা ভর্তি কত কবিতা, ঠাকুমা
বলেছিলেন সেগুলো গান। পিসি অনেক জনের কাছ থেকে, অনেক বই থেকে সেগুলো সংগ্রহ করেছিলেন।
সেই
খাতাখানা পেয়ে আমি খুব পড়তাম, কবিতাগুলো মুখস্থ
করে ফেলেছিলাম, নিজের সুরে সেগুলো
গাইতামও। পরে দিদি যখন হাইস্কুলে ভর্তি হল, (আমি তখনো নিচু ক্লাসে,) ওর সঙ্গে ওর স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তী দেখতে
গিয়েছিলাম। ও হরি, ওখানে সবাই পিসির
খাতার গান গাইছে! তখনি জানলাম, আমি এতদিন নিজের সুরে যা গান গাইতাম তা হল
রবীন্দ্রনাথের গান! রবীন্দ্রনাথের নাম আগেই জানতাম, দুচারটে কবিতাও মুখস্থ করেছি, সেই রবীন্দ্রনাথের গান পিসিও আমাদের জন্য তাঁর খাতায় রেখে
গিয়েছেন বলে খুব আনন্দ লাগছিল। শুধু রবীন্দ্রনাথের
উপর অভিমান হচ্ছিল কেন তাঁর গান আমার সুরে
গাইলে ভুল হবে!!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন