।। চিরশ্রী দেবনাথ।।
আমি কালো মেয়ে। এ কথাটি জানতাম না ছয় বছর বয়স পর্যন্ত। আমার
বাবা আমাকে প্রিন্সেস বলতো আর মা প্রজাপতি। আমি শুধু আনন্দ জানতাম। কি সুন্দর
পৃথিবী ছিলো আমার। আমি স্কুলে ভর্তি হলাম। আমাকে প্রিন্সিপাল
নতুন ক্লাসে নিয়ে এসে বসিয়ে দিয়ে গেলেন।
চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। একটি মেয়ে এগিয়ে এলো আমার দিকে, খুব অবাক হয়ে
তাকালো, তারপর বলল তুমি এরকম কেন দেখতে? আমি ক্লাসের সবার দিকে তাকালাম, আমি তাদের মতো নই,
কম কালোও নই। কালো খুব কালো আমি।
আমার প্রথম কান্না। প্রথম মনখারাপ। প্রথম আয়নায় দাঁড়ানো। প্রথম
নিজেকে দেখা। লুকিয়ে থাকা। মা বুঝতে পেরেছিলেন, যেন এটা তার জানা ছিল। এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, কেন মা, সেদিন একসঙ্গে আমাকে প্রকাণ্ড
বাস্তবে ঠেলে দিয়েছিলেন ? একটু একটু মনখারাপের জমি তো আগে থেকেই তৈরি করতে পারতেন।
আসলে মা পারেননি। মা ধবধবে ফর্সা ছিলেন।
সেই ছয় বছরের স্কুল থেকে ফিরে আসা বর্ষার দুপুরে মা আমাকে বুকে জড়িয়ে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিতে লাগলেন। আমি মা কে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলাম। মাও কাঁদতে লাগলো। সেই থেকে একজন ফর্সা আর একজন কালোর একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নার
শুরু।
স্কুলের
ফাউন্ডেশন ডে তে নাটক হবে, "পরীর দেশে’।
আমাদের ক্লাসের সব মেয়েকে নেওয়া হলো, এমনকি
শ্যামলা মেয়েকেও, কিন্তু আমি বাদ গেলাম, কারণ আমি নিখাদ কালো। কালো পরী কি হয় কখনো?
মা
বাবার সঙ্গে বসে নাটক দেখলাম। ভেতরে কাঁদলাম। কিন্তু বাইরে ঝরলো না। কারণ আমি তখন ক্লাস এইট।
কান্না গেলা শিখে গেছি।
গান
গাইলাম। ইংলিশ ব্যান্ডের গান। বাবা শেখাতো গান ও গিটার দুটোই। সারা স্কুল আমার
সঙ্গে গাইলো। আমার কালো রঙে স্কুল ছেয়ে গেলো।
ক্লাস ইলেভেন। প্রথম ভালো লাগা। জানতাম আমাকে কেউ চিঠি লিখবে না গোলাপি চিরকুটে, শিউলির দিনে।
নাম তার সাগরকেতু। অন্য স্কুলের। কোচিং ক্লাসে দেখা হতো। ভীষণ
ব্রিলিয়ান্ট। অগোছালো চুল। ভারী লেন্স। শুধু মনে হয়
দূরে কোথাও তাকিয়ে আছে।
আমার সঙ্গে সব ছেলেদের দারুণ বন্ধুত্ব।
মেয়ে বন্ধুরা আমাকে খুব নিরাপদ ভাবতো। ভালোবাসা দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ভয় নেই। আমাকে ভুল করে ভালোবাসার ভুল কেউ করবে না। অতএব আমি বিশ্বাসী । ততদিনে আমি মানিয়ে নিয়েছি। এক্সপেক্টটেশন নেই আমার।
তবু কিশোরীবেলা। অভ্রান্ত ভালোলাগা, কালবৈশাখীর মতো আমাকে
উড়িয়ে দিচ্ছে মুহূর্ত ভেঙে ভেঙে, পড়ার টেবিল উপচে উপচে। একটি খুব অপমান পেতে সাধ হলো।
সেই ছেলেকে বলে ফেললাম, চোখ বন্ধ করে। একটি হাসি,
একটি অট্টহাসি শুনলাম। আর তাকালাম না।
কোচিং ছেড়ে দিলাম।
বাড়ি, আমার গভীর পড়ার টেবিল, এন্ট্রান্স পরীক্ষা। মেডিকেল। ডাক্তার হলাম।
বদলে দেওয়া যায় না মানুষের গায়ের রঙ। জানি সব বায়োলজিক্যাল
মিথোস্ক্রিয়া। তবুও....। জয়েন
করেছি আজ এক সাঁওতাল গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সবাই কালো এই
গ্রামের। আমি তাদের কালো ডাক্তার। যেতে পারি ইচ্ছে করলেই ঝাঁ চকচকে শহরের
নার্সিংহোমে। আমার ফর্সা, সুদর্শন ডাক্তার বন্ধুরা জয়েন করেছে অনেকেই
এখানে ওখানে।
যাবো না।
এটাকেই বলে পালানো। নিজের থেকে, ফর্সা রং থেকে।
সব অর্জিত হলো শুধু সেই তাকানোটা সহ্য করতে পারি না। সেই যে চেম্বারে
যেকোন পেসেন্ট ঢুকলেই
প্রথমেই আমার অসম্ভব কালো রঙের দিকে তাকায়। যেন মেলাতে পারে না,
পারে না কিছুতেই। তাই আমি কালো মানুষদের সঙ্গে থাকি, একটি তাকানো থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে।
ন্যাশনাল কনফারেন্সে এসেছি। এপ্রিলের দিল্লী।
গনগনে দুপুর। ফিনফিনে লু । লাল শাড়ি পরেছি। টকটকে লাল। একমাত্র লাল কালোতেই যে দুলে ওঠে পৃথিবী।
প্রতিবাদ।
জেদ।
যেন রোদে দ্রবীভূত হবো।
হোটেলের পাঁচফুট বাই তিনফুট বিশাল আয়নায় দেখছি আমাকে। একদম
আগুনের মতো লাগছে।
বলবো
।পুরো দেড়ঘণ্টা সময় বরাদ্দ আমার প্রেজেন্টেশনের জন্য।পুরস্কারও আছে। WHO এর
প্রতিনিধি তুলে দেবেন হাতে।
পলাশবন সাঁওতাল পরগণার গ্রামীণ স্বাস্থ্য
পরিষেবার আশ্চর্য উন্নতি হয়েছে। সব বাঁধা ভেঙে আধুনিক অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা পৌঁছে
যাচ্ছে গ্রামে গ্রামে। স্বাস্থ্য কেন্দ্রটির ভোলও বদলে গেছে। এসবই সম্ভব হয়েছে এক
তরুণী ডাক্তারের আন্তরিকতায় আর পরিশ্রমে।
আজ তাই ডা:
শাল্মলী রায় বিশেষ ভাবে আমন্ত্রিত।
তাকাচ্ছে আমার দিকে সবাই খুব বেশি করে।
ভেতরে একটি কান্না , ঠাণ্ডা বিষ
ছুটছে যেন!
কোনদিন কি মেরে ফেলা যাবে এই তাকানোকে?