অনুসন্ধানের যাত্রাটি শুরু হয়েছিল দশক তিন আগেই। তারই ফলশ্রুতিতে ২০০৬তে ‘সিলেটি নাগরির পহেলা কেতাব। ও দইখুরার রাগ’ নামে বইটি সম্পাদনা করে বের করেন অধ্যাপিকা অনুরাধা চন্দ। কিন্তু যাত্রাটি ওখানে থামে নি। ফলে ২০০৮ এর ডিসেম্বরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সিলেটি নাগরি’ নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজিত হয়। তাতে যে গবেষণা নিবন্ধগুলো পড়া হয়---সেগুলোকেই দুই মলাটে বেঁধে আবার নিজের সম্পাদনাতে প্রকাশ করেন অনুরাধা চন্দ ২০১৩তে। তারও হয়ে গেছে বছর পাঁচেক। দুই বইয়েরই প্রকাশনার সঙ্গে জড়িয়েছিল দে’জ। সঙ্গে প্রথমটির সহযোগী প্রকাশক যেমন ছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব কালচারাল টেক্সট অ্যান্ড রেকর্ডস তেমনি দ্বিতীয়টির সহযোগী প্রকাশক ‘মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইন্সটিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজ, কলকাতা। দ্বিতীয়টির নাম ‘স্ক্রিপ্ট আইডেন্টিটি রিজিওন: এ স্টাডি ইন সিলেট নাগরি’ (Script Identity Region: A Study in Sylhet Nāgari)। আমরা মূলত এই দ্বিতীয়টির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতেই কী বোর্ড চাপছি।
সিলেট নাগরি নিয়ে সিলেটিদের বিচিত্র রকম গৌরব বোধ রয়েছে, রয়েছে কৌতূহলও। সম্প্রতি লিপি-ভাষাকে একাকার করে নিয়ে স্বতন্ত্র সিলেটি ভাষার দাবি আসামেও শোনা গেছে। সিলেটে বিলেতে তো দাবিটি বেশ পুরোনো হয়েই গেছে। কিন্তু সেই পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদের উনিশ শতকের শুরুর দিনগুলো থেকে এখানে ওখানে বিচ্ছিন্ন কিছু প্রয়াস বাদ দিলে এভাবে সমবেত বিদ্যায়তনিক গবেষণার বিষয় হয়েছে এই প্রথম।ভূমিকাতে সম্পাদিকার এমনটাই দাবি। আমাদেরও অনুসন্ধান বলে অন্তত ভারতে বাংলাদেশে দাবিটি সত্য। যদিও বিলেতে Sylheti Translation And Research’ (STAR) বলে একটি সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে এই নিয়ে কাজ করছে। সিলেটি নাগরিকে আন্তর্জালের ব্যবহারোপযোগী করবার জন্যে ইউনিকোডে নিয়ে আসবার জন্যেও তাঁরা কাজ করছেন। কিন্তু বিশেষ ভাষাবৈজ্ঞানিক বা ঐতিহাসিক গবেষণাদি যে তারা করেছেন আমাদের মনে হয় নি। তবে ২০১৬তে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আন্তর্জাতিক আলোচনাচক্রেরও আয়োজন করেছিলেন তারা---উদ্দেশ্য সিলেটিকে স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দেয়া। তার বিস্তৃত এখনো আমাদের জানবার সুবিধে হয় নি। সেটি এরকম দ্বিতীয় প্রয়াস। আমরা প্রথম প্রয়াসটি নিয়েই আপাতত লিখছি।
সিলেট নাগরীর কথা গ্রিয়ার্সন তাঁর মহাগ্রন্থে খুব ছোট করে হলেও প্রথম আলোচনা করেছিলেন। লিখেছিলেন, লিপিটির নাম ‘দেবনাগরী’।নিম্নশ্রেণির মুসলমানেরা স্বাক্ষর দিতে গিয়ে এই লিপি ব্যবহার করেন, আর সম্প্রতি এই লিপিতে ‘বাংলা পুথি’ ছাপা হচ্ছে। পরের উল্লেখটি আছে,বি সি এ্যালেন সম্পাদিত ‘Assam District Gazatteers’এর দ্বিতীয় খণ্ডে।ওতেও মোটামুটি গ্রিয়ার্সনেরই প্রতিধ্বনি। এর কিছু পরে পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ এই নিয়ে প্রথম বিস্তৃত এক নিবন্ধ লেখেন ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা’র ১৩১৫ বাংলাতে। ‘সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা’তে তিনি নানা সময়ে যে কটি প্রবন্ধ লেখেন তার মধ্যে প্রথমটির নামেই ‘সিলেট নাগরী’ কথাটি তাত্ত্বিকভাবে প্রথম মেলে।বছরখানিকের মধ্যে প্রকাশিত অচ্যুতচরণ তত্ত্বনিধির ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ বইতেও অতিসামান্যই আছে।এর পরে ‘শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষদ –পত্রিকা’তেও লিপিটি নিয়ে অনেকেই আলোচনা শুরু করেন।তাঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন মোহম্মদ আশরফ হোসেন সাহিত্যরত্ন।এর পরেই সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখটি সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের। অডিবিল-এর ভূমিকা অংশের পরিশিষ্টে বাংলার অন্যান্য লিপির সঙ্গে ‘সিলেট নাগরী’ নিয়েও তিনি বেশ কিছু পঙক্তি ব্যয় করেছেন।লিপি পরিচয় দিতে গিয়ে সুনীতিকুমার লিখলেন,‘a kind of modified Dēva-nāgari,called ‘Silēt Nāgari’ ভাষাবিজ্ঞান সংক্রান্ত প্রায় সমস্ত তাত্ত্বিক আলোচনাতে এর পরে ‘সিলেট নাগরী’ কথাটি চালু হয়ে গেল। সুকুমার সেনও তাই লিখলেন। কিন্তু লিপিনামটি পুথি লিখিয়েদেরই দেয়া বলেই মনে হয়। ‘পহেলা কেতাবে’র ১৩৩৬এর সংস্করণের সম্পাদক তথা সংশোধক মহাম্মদ আব্দুল লতিফের পদে আছে,“ছিলেটি নাগরী পুথি পহেলা কিতাব নাম...”
উনিশ শতকের মাঝামাঝি ১৮৬০ থেকে ৭০ কোনো এক সময় মুন্সী আব্দুল করিম এই লিপির হরফ কাটিয়ে প্রথম তাঁর প্রতিষ্ঠিত সিলেটের ‘ইসলামীয়া প্রেস’ থেকে বই ছাপানো শুরু করেন। পরে পরে কলকাতা এবং সিলেটে আরো কতকগুলো প্রেসে সিলেটি নাগরী বইপত্র ছাপা শুরু হয়।পদ্মনাথ ভট্টাচার্য ছাড়াও পরবর্তী কালে শিবপ্রসন্ন লাহিড়ি,মুর্তাজা আলিও সিলেটি নাগরীতে স্বরব্যঞ্জন মিলিয়ে ৩২টি হরফের কথাই লিখেছিলেন,কিন্তু তারপরেও এই বর্ণমালাতে সংশোধন হয়েছে।অনুরাধা চন্দ লিখছেন,“মনে হয় শুরুতে এই বর্ণমালা দ্বৈতস্বর ও যুক্তব্যঞ্জন বর্জিত ছিল।তবে কালক্রমে বেশ কয়েকটি যুক্তব্যঞ্জন সংযোজিত হয়”। পদ্মনাথ যে ‘পহেলা কেতাব’ ব্যবহার করেছেন তাতে ষোলোটি সংযুক্ত বর্ণ রাখা ছিল, অনুরাধা চন্দের ব্যবহৃত ‘পহেলা কেতাব’ পুস্তিকায় একুশটি সংযুক্ত বর্ণ রয়েছে।পদ্মনাথ এই লিপির বর্ণনা প্রসঙ্গে হসন্ত চিহ্নটির অভাব লক্ষ্য করেছেন,‘যদি হসন্ত চিহ্নটি পরিগৃহীত হইত,তাহা হইলে ‘সমপদ’ যে ‘সম্পদ’ তাহা অনায়াসেই বুঝিতে পারা যাইত।’ হসন্ত চিহ্নের ব্যবহার না থাকাতেই যে দইখুরার পদে ‘প্রেমের মালা’ হয়েছে ‘পেরমের মালা’। লিপির সীমাবদ্ধতাতেই শব্দটি ‘পেরম’ হয়েছে,যা কিনা মান বাংলা বা সিলেটি কোনো শব্দই নয়। যাই হোক, লিপিটি এখন কম্প্যুটারে এবং আন্তর্জালে ব্যবহার উপযোগী করে ‘ইউনিকোড কনসর্টিয়াম’ (The Unicode Consortium) স্বীকৃতি দিয়েছে। সেখানে একক বর্ণসংখ্যা মোটের উপর একই আছে।হলন্ত চিহ্ন,এবং অনুস্বারের জন্যে স্বতন্ত্র সংকেতের ব্যবস্থা রাখাতে যুগ্মব্যঞ্জনের স্বতন্ত্র সংকেতের দরকার পড়বার কথা নয়।তার বিপরীতে চারটি ‘পদ্যচিহ্ন’-এর জন্যে সংকেত রয়েছে।সম্ভবত পর্বাঙ্গ,পর্ব,চরণ,স্তবক ভেদ দেখাবার জন্যে।ইতিমধ্যে কিছু ইউনিকোড ফন্ট তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেগুলো খুব ব্যবহারবান্ধব নয় এখনো। আমরা অতিকষ্টে এই কটি বর্ণ টাইপ করে দেখাচ্ছি... i a i e o k p c t g j ।
একক বর্ণ হিসেবে পাঁচটি স্বর এবং সাতাশটি ব্যঞ্জনের সংখ্যাতে এই অব্দি আর কোনো হেরফের হয় নি।সংখ্যা বোঝাবার জন্যে স্বতন্ত্র কোনো সিলেটি নাগরী চিহ্ন নেই।বাংলা সংখ্যা-সংকেত দিয়েই শুরু থেকেই কাজ চালানো হচ্ছে। অনুরাধা চন্দের কথাতে,“ ...সিলেটি কথ্যভাষার উচ্চারণ ও ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই বর্ণমালা গড়ে উঠেছে।একটি ধ্বনির জন্য একটি বর্ণ,এই নিয়মটি তত্ত্ব হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে হয়।” কথাগুলো অন্যত্র তপোধীর ভট্টাচার্যও লিখেছিলেন। সিলেটিতে স্বরস্বনিম বলতে সত্যিই পাঁচটির বেশি নেই। ব্যঞ্জন স্বনিম বলতে আধুনিক ভাষাবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করেও ত্রিশটির বেশি মেলা কঠিন।এবং অনেকেই যেভাবে ‘ক,প,চ’ আদি সিলেটি বর্ণমালা তালিকাতে বাদ দিয়ে দেন,আমরা অনুসন্ধান করে দেখেছি সেগুলো বাদ দেবার কোনো কারণ নেই। সিলেটি নাগরী বর্ণমালাতেও এগুলো দিব্বি শোভা পাচ্ছে। এই বিষয়গুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ।বাংলা কিংবা দেবনাগরী যে বর্ণমালা থেকেই লিপিটি এসে থাকুক, সংস্কৃতানুসরণ না করে স্বাভাবিক উচ্চারণরীতি অনুসরণ করেছিলেন বলেই কিছু বিভ্রান্তি এই লিপির স্রষ্টারা এড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন বলেই মনে হয়।আরবি লিপি শৈলীরও কিছু প্রভাব অবশ্যই পড়েছে,সিলেটি নাগরী পুথিকে তাই পেছন থেকে পড়তে হয়।কিন্তু আরবি বর্ণমালা সংখ্যা দিয়েও এই লিপির স্রষ্টারা বিভ্রান্ত হয়েছেন এমনটা দেখি না।
লিপিটির দেবনাগরী উৎস নিয়ে অধিকাংশেরই কোনো দ্বিমত নেই।শুধু মুর্তাজা আলি মনে করতেন দেবনাগরীর সঙ্গে বাংলা-কাইথির কাছেও সিলেটি নাগরী ঋণী। কোনটি বাংলা আর কোনটি দেবনাগরী থেকে এসেছে এই নিয়ে শিবপ্রসন্ন লাহিড়ি এবং মুর্তাজা আলির বক্তব্যের একটি তুলনামূলক অধ্যয়ন করে অধ্যাপক উষারঞ্জন ভট্টাচার্য মোটের উপরে মুর্তজা আলির পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন।নাগরীর ফ,র বর্ণগুলো কাইথির থেকে এসছে, এবং ভ বর্ণের সঙ্গে কাইথি ভ-এর মিল রয়েছে বলে মুর্তজা লিখেছিলেন। ‘ফ’-এর সঙ্গে না হোক, কাইথি ‘ভ,র’-এর কথাটি খুব একটা ভুল নয় বলে আমাদেরও অভিমত।আমরা ইউনিকোড হরফগুলো পরীক্ষা করে দেখেছি।
কিন্তু দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হুসেন চৌধুরী বলে এক গবেষক আরবি লিপি শৈলীর প্রভাবে সরাসরি বাংলা থেকেই হরফগুলো এসেছে বলে দাবি করেছেন। এই দাবিটিকে খারিজ করেছেন অনুরাধা চন্দ ‘পহেলা কিতাবে’।
আরবি লিপির প্রভাবটি সামান্য ঘোরালো।অনুরাধা চন্দ লিখছেন,“আরব ও পারস্যে ‘জের’,‘জবর’,‘পেশ’ এই তিনটি স্বরচিহ্ন সামান্য অদলবদল ক’রে নানা ধ্বনির প্রকাশ করা যায়।সিলেট নাগরী লিপিতেও আমরা এই রীতি দেখতে পাই।সামান্য পরিবর্তিত একই অক্ষর দিয়ে ভিন্ন ধ্বনির প্রকাশ সম্ভব।”তিনি প,দ,খ,ছ,ঝ,ধ এই ক্রমে সিলেটি নাগরী হরফগুলোর নজির দিয়েছেন।তিন-চার শতকের দরবারী ভাষা ফারসির প্রসারের ফলে সিলেটি ভাষাবৈচিত্র্যে আরবি -ফারসির উচ্চারণগত প্রভাব বেশ ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। ফারসি লিখতে আরবি লিপির প্রচলনও ছিল। ফলে সিলেট নাগরিতে আরবির প্রভাব কিছুই পড়বে না, সেসব হবার নয়। কিন্তু হরফে সরাসরি আরবির চিহ্নমাত্র নেই। এমনি বই ছাপবার বেলা পেছন থেকে সামনের দিকে পৃষ্ঠা এগোলেও, পঙক্তিগুলো কিন্তু বাংলা বা ব্রাহ্মিপরিবারের লিপির মতোই বামদিক থেকে ডানেই এগিয়েছে। অনুরাধা চন্দ তাঁর ‘পহেলা কেতাব’ সেভাবেই সম্পাদনা করে ছেপেছেন।
এই যে আরবি পরম্পরার সবটা নিলেন না,সেখানে একটি আন্তসংগ্রামের সংকেতও অবশ্যই মেলে। যে কথা রিচার্ড ঈটন বাংলাতে কেন আরবি লিপি চলল না,বোঝাতে গিয়ে লিখেছিলেন।নিছক ইসলাম প্রীতির জন্যেই নাগরীপুথির লেখকেরাও বাংলা লিপি বেছে নেন নি,যদি এমনতর হত তবে আরবি লিপির আরো ঘনিষ্ঠ অনুসরণ দেখা যেতে পারত।এই প্রসঙ্গে মনে করতে পারি,যে হিন্দুদের মধ্যে যেমন রীতি ছিল সংস্কৃত ছাড়া ধর্মগ্রন্থাদি চর্চা করা যাবে না,করলে রৌরব নরক বাস হবে,মুসলমানদের মধ্যেও ছিল,আল্লাহ আরবিতে কোরান দিয়েছেন।অন্য লিপি বা ভাষার ব্যবহার মানেই তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধাচরণ করা।তবু যারা ভারতে হিন্দুস্তানির থেকে উর্দুর উদ্ভব করিয়েছিলেন,তারা সেই ইসলামী সংস্কৃতির সংস্কার করেই করেছিলেন।ভারতেই প্রথম অন্য কোনো ভাষাতে কোরান অনুবাদ হয়,আর সেটি উর্দুতে।তাও উর্দুর জন্যে তারা আরবি লিপি মেনে নিয়ে আপস একটা করেছিলেন।বাংলাতে কেউ কেউ চেষ্টা করেছিলেন।কিন্তু বাংলার মুসলমান সেই লিপিও মানেন নি।অধিকাংশই বাংলা লিপি আর বাংলা ভাষা মেনে নিলেন বলেই বাঙালি আজ এতো বিশাল এক জনগোষ্ঠী।সিলেটি নাগরী লিপি ছিল তার মাঝামাঝি একটি ব্যবস্থা।প্রধানত যে লিপিকে নির্ভর করে সিলেটি নাগরী এল সেটি দেবনাগরী।লিপিটি উত্তর ভারতেও তখনো আজকের মতো জনপ্রিয় ছিল না।সংস্কৃতের সর্বমান্য লিপিও ছিল না।এখনো সংস্কৃত লিখতে বাংলা-অসমিয়া লিপি দেদার ব্যবহৃত হয়। প্রত্যন্ত এলাকার নিরক্ষর বহু মানুষের কাছে বাংলা লিপি পরিচিতও ছিল না। মোগল আমলে রাজকার্যেও ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছিল ফার্সির ব্যবহার।আজ যেমন হয় প্রধানত ইংরেজি এবং হিন্দি। ফলে এক প্রজন্মের ব্যবধানে আজকের আমাদের ছেলেমেয়েদের কাছেও বাংলা লিপির পরিচয় আর সেভাবে নেই।সুতরাং বাঙালি হয়ে কেন বাংলা লিপি জানবে না,এই প্রশ্ন শুধু উন্নাসিক সমাজবিচ্ছিন্ন আধুনিক মধ্যবিত্ত মনেই জাগতে পারে।তাদের কাছে সেদিন বাংলা লিপি শেখা যা,দেবনাগরী শেখাও তাই ছিল।তবু,তারা করলেন কি,জ্ঞান পিপাসার প্রাবল্যে দেবনাগরী-বাংলা যেটুকু বুঝলেন,তাই ভেঙেচুরে অনেক সংক্ষিপ্ত আর সরল একটি বর্ণমালা গড়ে ফেললেন।বর্ণ সংখ্যা রাখলেন ততটাই যতটা উচ্চারণ অনুমোদন করে। তাঁরা ভাষাবিজ্ঞান জানতেন না,কিন্তু এই সরল সত্য বুঝতেন। সেকালে আজকের মতো মান-উচ্চারণরীতি গড়ে তুলবার কোনো উপায় ছিল না। রেডিও,টিভি,রেকর্ড,ক্যাসেট বা কম্প্যুটার কিছুই তো ছিল না।ফলে তাঁরা বাধ্য ছিলেন অনুসরণ করতে সিলেটি উচ্চারণ।কিন্তু যে ভাষাতে কাব্য করলেন সেটি সেকালের সাহিত্যের মান সাধু বাংলা...মহম্মদ আব্দুল লতিফের এই চরণগুলো পড়লে দুই একটি রাবীন্দ্রিক ক্রিয়াপদও দুর্লভ হয় না,“তার পর আরজ করি করিনু তামাম।।/ ছিলেটি নাগরী পুথি পহেলা কিতাব নাম ” কলকাতাকে কেন্দ্রকরে মূলত উত্তরভারতীয় প্রব্রজিত মুসলমানদের প্রভাবে যে ‘দোআশলা’ বাংলা গড়ে উঠেছিল, সুকুমার সেন যাকে লিখেছেন ‘ইসলামী বাংলা’ বলে, সেই ভাষাও সিলেটি নাগরি সাহিত্যে ছাপা জমানাতে দুর্লভ নয়।
এই যে আরবি পরম্পরার সবটা নিলেন না,সেখানে একটি আন্তসংগ্রামের সংকেতও অবশ্যই মেলে। যে কথা রিচার্ড ঈটন বাংলাতে কেন আরবি লিপি চলল না,বোঝাতে গিয়ে লিখেছিলেন।নিছক ইসলাম প্রীতির জন্যেই নাগরীপুথির লেখকেরাও বাংলা লিপি বেছে নেন নি,যদি এমনতর হত তবে আরবি লিপির আরো ঘনিষ্ঠ অনুসরণ দেখা যেতে পারত।এই প্রসঙ্গে মনে করতে পারি,যে হিন্দুদের মধ্যে যেমন রীতি ছিল সংস্কৃত ছাড়া ধর্মগ্রন্থাদি চর্চা করা যাবে না,করলে রৌরব নরক বাস হবে,মুসলমানদের মধ্যেও ছিল,আল্লাহ আরবিতে কোরান দিয়েছেন।অন্য লিপি বা ভাষার ব্যবহার মানেই তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধাচরণ করা।তবু যারা ভারতে হিন্দুস্তানির থেকে উর্দুর উদ্ভব করিয়েছিলেন,তারা সেই ইসলামী সংস্কৃতির সংস্কার করেই করেছিলেন।ভারতেই প্রথম অন্য কোনো ভাষাতে কোরান অনুবাদ হয়,আর সেটি উর্দুতে।তাও উর্দুর জন্যে তারা আরবি লিপি মেনে নিয়ে আপস একটা করেছিলেন।বাংলাতে কেউ কেউ চেষ্টা করেছিলেন।কিন্তু বাংলার মুসলমান সেই লিপিও মানেন নি।অধিকাংশই বাংলা লিপি আর বাংলা ভাষা মেনে নিলেন বলেই বাঙালি আজ এতো বিশাল এক জনগোষ্ঠী।সিলেটি নাগরী লিপি ছিল তার মাঝামাঝি একটি ব্যবস্থা।প্রধানত যে লিপিকে নির্ভর করে সিলেটি নাগরী এল সেটি দেবনাগরী।লিপিটি উত্তর ভারতেও তখনো আজকের মতো জনপ্রিয় ছিল না।সংস্কৃতের সর্বমান্য লিপিও ছিল না।এখনো সংস্কৃত লিখতে বাংলা-অসমিয়া লিপি দেদার ব্যবহৃত হয়। প্রত্যন্ত এলাকার নিরক্ষর বহু মানুষের কাছে বাংলা লিপি পরিচিতও ছিল না। মোগল আমলে রাজকার্যেও ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছিল ফার্সির ব্যবহার।আজ যেমন হয় প্রধানত ইংরেজি এবং হিন্দি। ফলে এক প্রজন্মের ব্যবধানে আজকের আমাদের ছেলেমেয়েদের কাছেও বাংলা লিপির পরিচয় আর সেভাবে নেই।সুতরাং বাঙালি হয়ে কেন বাংলা লিপি জানবে না,এই প্রশ্ন শুধু উন্নাসিক সমাজবিচ্ছিন্ন আধুনিক মধ্যবিত্ত মনেই জাগতে পারে।তাদের কাছে সেদিন বাংলা লিপি শেখা যা,দেবনাগরী শেখাও তাই ছিল।তবু,তারা করলেন কি,জ্ঞান পিপাসার প্রাবল্যে দেবনাগরী-বাংলা যেটুকু বুঝলেন,তাই ভেঙেচুরে অনেক সংক্ষিপ্ত আর সরল একটি বর্ণমালা গড়ে ফেললেন।বর্ণ সংখ্যা রাখলেন ততটাই যতটা উচ্চারণ অনুমোদন করে। তাঁরা ভাষাবিজ্ঞান জানতেন না,কিন্তু এই সরল সত্য বুঝতেন। সেকালে আজকের মতো মান-উচ্চারণরীতি গড়ে তুলবার কোনো উপায় ছিল না। রেডিও,টিভি,রেকর্ড,ক্যাসেট বা কম্প্যুটার কিছুই তো ছিল না।ফলে তাঁরা বাধ্য ছিলেন অনুসরণ করতে সিলেটি উচ্চারণ।কিন্তু যে ভাষাতে কাব্য করলেন সেটি সেকালের সাহিত্যের মান সাধু বাংলা...মহম্মদ আব্দুল লতিফের এই চরণগুলো পড়লে দুই একটি রাবীন্দ্রিক ক্রিয়াপদও দুর্লভ হয় না,“তার পর আরজ করি করিনু তামাম।।/ ছিলেটি নাগরী পুথি পহেলা কিতাব নাম ” কলকাতাকে কেন্দ্রকরে মূলত উত্তরভারতীয় প্রব্রজিত মুসলমানদের প্রভাবে যে ‘দোআশলা’ বাংলা গড়ে উঠেছিল, সুকুমার সেন যাকে লিখেছেন ‘ইসলামী বাংলা’ বলে, সেই ভাষাও সিলেটি নাগরি সাহিত্যে ছাপা জমানাতে দুর্লভ নয়।
আমরা যে বইটি নিয়ে কথা বলব সেটি দ্বিভাষিক। ভারত বাংলাদেশের ষোলজন গবেষকের রচনা এতে ঠাঁই পেয়েছে। আসাম তথা বরাক উপত্যকারও একাধিক গবেষক রয়েছেন। সম্পাদিকার একটি স্বতন্ত্র রচনা ছাড়াও সূচনা এবং সমাপ্তি রচনা দুটিও সুখপাঠ্য গবেষণা নিবন্ধই। পাঠকের জন্যেও এতো সুপরিকল্পিত দিশানির্দেশ যে আমরা এর সমালোচনা লিখতে গিয়ে ভাবছিলাম , এর পরে আর আমাদের লিখবার কী থাকে? তিনি নিছক সম্পাদনা করেন নি, বিষয়টি নিয়ে ভারতে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ক্ষেত্র অনুসন্ধান করে বেড়িয়েছেন। বহু পুথি নিজে সংগ্রহও করেছেন, পাঠও শুনেছেন। লেখকদের অনেকেই তাঁর সঙ্গে পথ হেঁটেছেন, সঙ্গ দিয়েছেন। তার বাইরেও রয়েছেন অনেকেই। আসামে তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অধ্যাপক অমলেন্দু ভট্টাচার্য, আবদুল মুসাব্বির ভুঁইয়া, আবিদ রাজা মজুমদার, সামসুল হক বড়ভূঁইয়া, তুষার কান্তি নাথ, সঞ্জীব দেব লস্কর এবং পার্থপ্রতিম দাস। এছাড়াও বিজয় কুমার ধর, অধ্যাপক আবুল হুসেন মজুমদার, মুজ্জামিল আলি লস্কর এবং সর্বোপরি অধ্যাপক সুজিত চৌধুরী এবং সদ্য প্রয়াত কালিকা প্রসাদ ভট্টাচার্যও নানা সময়ে নানা ভাবে তাঁকে ঋদ্ধ করেছেন। কালিকার থেকেই দইখুরার রাগের নিজের সংগ্রহের প্রথম পুথিটি তিনি পান।
তিনটি ভাগে বইটি পরিকল্পিত। প্রথম ভাগে ‘এলাকা এবং মানুষ’ চিনিয়েছেন, চিনিয়েছেন তার ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি। ছটি ইংরেজি নিবন্ধের লেখক যথাক্রমে সুচন্দ্রা ঘোষ, রিলা মুখার্জি, হরপ্রসাদ রায়, সঞ্জীব দেব লস্কর, স্বপ্না ভট্টাচার্য(চক্রবর্তী), সুদেষ্ণা পুরকায়স্থ। দুটি বাংলা নিবন্ধের লেখক অমলেন্দু ভট্টাচার্য এবং তুষার কান্তি নাথ। দ্বিতীয় ভাগে ‘লিপি এবং ভাষা’। সেই সঙ্গে কারা লিপিটি গড়ে তুলেন, লেখেন এবং পড়েন ---তাদের কথা। এই ভাগে দুটি ইংরেজি নিবন্ধের লেখক আবদুল মুসাব্বির ভুঁইয়া, এবং মীনা দান। তিনটি বাংলা নিবন্ধের লেখক আবিদ রাজা মজুমদার, সাদিয়া চৌধুরী পরাগ এবং সামসুল হক বড়ভুঁইয়া । তৃতীয় বিভাগটিতে কথা হয়েছে ‘লিপি এবং সাহিত্য’ নিয়ে। সেই সঙ্গে সেই সঙ্গে তিনটি নিবন্ধ জানিয়েছে সেই বৃত্তান্ত কী ভাবে একটি নবগঠিত সম্প্রদায় এই লিপি, সাহিত্য এবং তার অন্তর্নিহিত দর্শনে নিজেদের পরিচিতি গড়ে তুলছেন। অথবা উল্টো করে লিখলে ---পরিচিতি গড়ে তুলবার স্বার্থে একটি লিপি এবং সাহিত্যেরও বিকাশ ঘটাচ্ছেন। এই পর্বের তিনটি মূল্যবান প্রবন্ধের দুটি ইংরেজিতে লিখেছেন স্বপন মজুমদার এবং সম্পাদিকা অনুরাধা চন্দ স্বয়ং এবং একটি বাংলা প্রবন্ধের লেখক নন্দলাল শর্মা।
প্রথমভাগে লিপি বা সাহিত্যের কথা বিশেষ নেই। কিন্তু যে পরিবেশে সেই কথা ও কাহিনি তৈরি হয়েছে সেটি এখানে ‘নির্মিত’ হয়েছে। ছবির ক্যানভাস যেমন। অধিকাংশই চেনা কথা। শুরুর লেখিকা সুচন্দ্রা ঘোষ। তাঁর ইংরেজি নিবন্ধের তিনি মেঘনা উপত্যকার পুব দিককার ভূগোল এবং রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে প্রতিবেশী বঙ্গ বা বৃহত্তর বাংলা, আরাকান এবং কামরূপের সঙ্গে সম্পর্কটিও ছুঁয়ে গেছেন। সেই সঙ্গে শ্রীহট্টের নিজস্ব পরিচিতি গড়ে উঠবার আমাদের অনেকটা চেনা কথাই শুনিয়েছেন তাম্রফলক, মুদ্রার সাক্ষ্য সহ। যে কারণে তাঁর লেখাটি শুরুতেই গুরুত্বপূর্ণ—সেটি এই যে--- দ্বাদশ –ত্রয়োদশ শতক অব্দি ইতিহাস পরিক্রমা করে তাঁর সিদ্ধান্ত এই অব্দি নথিপত্রের প্রাথমিক পাঠ বলে গাঙ্গেয় উপত্যকার থেকে ভিন্ন কোনো নতুন বা স্বতন্ত্র লিপি শৈলী মেঘনা উপত্যকাতে দেখা দেয় নি।
রিলা মুখার্জির ইংরেজি নিবন্ধটিতে কিছু ভিন্ন স্বর এর জন্যেই রয়েছে যে সুরমা-মেঘনা নদী পথ, নৌ বাণিজ্যের ইতিহাসটি তিনি বুঝবার চেষ্টা করেছেন। ‘space’, ‘place’ , ‘region’ এমন কয়টি প্রতিশব্দকে এমনভাবে ব্যবহার করে তাঁর নিবন্ধটিকে সাজিয়েছেন যে যথেচ্ছ বাংলা অনুবাদে ব্যঞ্জনাটি ধরা কঠিন। কিন্তু তাঁর ভাষাতে বললে, একটি ‘স্পেসে’র ‘প্লেসে’ রূপান্তরের কাহিনি তিনি বলে গেছেন। কামরূপের সময় থেকেই চীনের সঙ্গে সংযোগ আদির কথা তিনি উল্লেখ করে দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শুরুতে চন্দ্ররাজাদের পশ্চিমভাগ ফলক সম্পর্কে দু’টি তথ্যের উল্লেখ করছেন। এক, এতে পাঁচ-ছ লাইন নাগরি লিপি ব্যবহৃত হয়েছে,যেখানে আমরা জেনে এসেছি অন্যান্য অধিকাংশ তাম্রফলকাদিতেই সংস্কৃতের জন্যেও কুটিল-প্রত্ন বাংলা, বাংলা আদি লিপিই ব্যবহৃত হচ্ছে। দুই, রাজধানী বিক্রমপুরে কামপুচীয় নাগরিকের আসবার সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। ভাটেরা ফলকের প্রত্ন বাংলা লিপির সঙ্গে তিনি কাম্পুচিয়াতে পাওয়া একটি খেমের ফলকের মিলের কথা উল্লেখ করছেন। ঐ সময়ে একটি ছায়াচ্ছন্ন প্রান্তীয় এলাকার থেকে সিলেট একটি বৃহত্তর অঞ্চলের অংশ হিসেবে থাকবার ফলে এই সব হচ্ছে। ভারতমহাসাগরীয় বাণিজ্য ব্যবস্থা (IOTS), মালদ্বীপের সহস্রাব্দ প্রাচীন কড়ি অর্থনীতির উত্থান এবং মোঘল আমলের পরে থেকে পতন, এবং ষষ্ঠ-সপ্তদশ শতকে যখন প্রতিবেশী ত্রিপুরা, জয়ন্তিয়া, মণিপুর, কোচ বিহারাদিতেও যখন রূপার মুদ্রা প্রচলিত তখন সিলেটে কড়ির ব্যবহারের এক চিত্তাকর্ষক বর্ণনা তিনি দিচ্ছেন। জাতীয় ইতিহাসের ছায়াতে প্রান্তীয় ইতিহাসের স্বাতন্ত্র্য ঢাকা পড়ে যায় এই সতর্কবাণীতেই তাঁর নিবন্ধ শেষ হয়েছে।
হরপ্রসাদ রায়ের ইংরেজিতে তৃতীয় নিবন্ধটি চারদিক থেকে সিলেটে তথা পূর্বোত্তরে আর্য, বিস্তৃতভাবে অনার্য নৃগোষ্ঠীগুলোর প্রব্রজনের একটি ঐতিহাসিক রূপরেখা আঁকবার চেষ্টা করেছেন। কোথাও কোথাও পুরাণে ইতিহাসে গুলিয়েছেন বলেও আমাদের মনে হচ্ছে। পাণ্ডবদের নাগাপাহাড় বিজয়ের গল্পকে কোনো প্রশ্ন করছেন না।
সঞ্জীব দেবলস্করের চতুর্থ নিবন্ধটিও ইংরেজিতে এবং বিষয়টির গভীরে গিয়ে বিচিত্র প্রব্রজন থেকে একটি জনগোষ্ঠী গড়ে উঠবার আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটটি ব্যাখ্যা করছে। যেমন শাহজালাল এবং তাঁর সঙ্গীদের দ্বারা এখানে দ্বিতীয় কৃষি বিপ্লবটি হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন, এবং জনজাতিরা শুধু ইসলামই গ্রহণ করেন নি, তাঁরা ভাষাও গ্রহণ করছেন অর্থাৎ বাঙালি হচ্ছেন। জনপ্রিয় ইতিহাসের কথাতে এই ভাষান্তরের কথাটি বিশেষ গুরুত্ব পেতে দেখা যায় না। কাছাড়ের বড়খলা-সোনাই এলাকাতে ক্ষেত্র অনুসন্ধানের উপর ভিত্তি করে তিনি ‘কাছাড়ি’ এবং ‘নাগামৌলবি’দের নজির দিয়েছেন, যারা কাছাড়ি বা নাগাও নন, মৌলবিও নন। তবে শুধু কৃষি বিস্তারই নয়, ডিমাছা রাজদরবারের দণ্ডবিধির নজির দিয়ে তিনি এখানে প্রচলিত বর্ণবিদ্বেষকেও সহজ ধর্মান্তরণের একটি কারণ বলে মনে করেন। কিন্তু সেই ইসলাম ছিলনা কেতাবি শরিয়তি ইসলাম, ছিল হিন্দু বৌদ্ধ ঐতিহ্য সমন্বিত মারিফতি ইসলাম। ফলে যে ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য বিশেষ করে সঙ্গীতের ধারার উদ্ভব হল, সেই পরিবেশেই সিলেটি নাগরি লিপি এবং সাহিত্যও দেখা দিল।
স্বপ্না ভট্টাচার্যের পঞ্চম প্রবন্ধের পরিসর চেনা গণ্ডির বাইরে-- আরাকান। সেখানে নৃগোষ্ঠীগুলো এবং তাদের মধ্যেকার বৌদ্ধমতধারাগুলোর উদ্ভব এবং বিকাশ নিয়ে তাঁর দাবি ‘Some observation’ তুলে ধরেছেন। ভারে এবং ব্যাপ্তিতে প্রবন্ধটি এই সংকলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ। সেই প্রাচীন কাল থেকে সাম্প্রতিক ইতিহাস নিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু বাংলা ভাষা সাহিত্যের ছাত্রদের জন্যে আমরা সংক্ষেপে যেটি বলতে পারি ‘আরাকানের রাজসভা’তে মুসলমান সুফি কবিদের হাতে বাংলা সাহিত্য দেখা দেবার আর্থ-রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটটি স্পষ্ট করেছেন। উত্তর এবং মধ্য মায়ান্মার থেকে এলাকাটির বিচ্ছিন্নতা এক উদার বৌদ্ধ ধর্মীয় পরিবেশ গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। ফলে হিন্দু এবং ইসলামী ঐতিহ্যও সহজেই সেখানকার সমাজের এবং ধর্মের ভেতরে এবং প্রতিবেশে সহজেই জায়গা করে নিতে পেরেছে। ‘হিন্দু’ বলতে আমরা ব্রাহ্মণ্য, যৌগিক, তান্ত্রিক সব ঐতিহ্যেরই কথা বলছি। আরাকান বুঝতে গেলে বাংলা এবং পূর্বোত্তর ভারতকে বুঝতেই হয়। আরাকানের শাসকদের কাছে একদিকে মধ্যদেশের বর্মণ রাজাদের চাপ, আর দিকে মোঘলের চাপ সইতে হচ্ছিল। মোঘলদের বিরুদ্ধে বাংলার সুলতানদের সঙ্গে একসময় ঘনিষ্ঠ আঁতাত গড়ে উঠে। একসময় আরাকানের বৌদ্ধ রাজারা নিজেদের মুসলমান নামও রাখতেন, মুদ্রাতে ইসলামী কালিমাও ব্যবহার করতেন। রিচার্ড ঈটন ভারতে , বিশেষ করে বাংলাতে ইসলামে ধর্মান্তরণের যে inclusion, identification এবং displacement-এর তত্ত্ব উপস্থিত করেছেন, তার প্রথম এবং দ্বিতীয় স্তরটি আরাকানের রাজসভার সেকালীন সাংস্কৃতিক আবহেও স্পষ্ট। ফলে রাজনৈতিক ভাবে মোঘল এবং ধর্মীয় দিক থেকে শরিয়তি ইসলাম বিরোধী বহু সুফি আরাকানে গিয়ে স্থায়ী বাসা করেন। রাজসভাতে কাজ নিয়ে, সাহিত্যও করেন অনেকে। আলাওল যে জায়সীর ‘পদ্মাবতী’ অনুবাদ করেছিলেন---সেটির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটি লেখিকা স্পষ্ট করবার চেষ্টা করেছেন। জায়সী নিজে সুফি ছিলেন, এবং মোঘল বিরোধী শাসকদের পৃষ্ঠপোষণা পেয়েছেন। তাই রাজপুত রাজা রতনসিং তাঁর গল্পে মহিমান্বিত, সুলতান আলাউদ্দিন প্রতিনায়ক এবং শরিয়তি ইসলামের প্রতীক। শ্রীলঙ্কার রাজকুমারী পদ্মিনী বৌদ্ধ ধর্মাদর্শের প্রতীক। তাঁর চরিত্রটি বার্তা লেখিকার মতে, বৌদ্ধ মধ্যপথই সবচাইতে কাঙ্ক্ষিত। জায়সির পদ্মাবতী ঐতিহাসিক চরিত্র কি না, কাহিনির সিঙ্ঘালা আদৌ শ্রীলঙ্কা কি বর্তমান হারিয়ানার একটি এলাকা সেই সব তর্ক আছে। আমরা সেদিকে যাচ্ছি না। যেটি গুরুত্বপূর্ণ---সে হলো আরাকানে যখন এই কাব্য অনুদিত হচ্ছে তখন আসলে কবি এবং পৃষ্ঠপোষক রাজার উত্তরভারতীয় শাসকদের এবং শরিয়তি ইসলামের বিরুদ্ধে ক্ষোভের অভিব্যক্তি ঘটছে। সেন রাজাদের ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসনের তাড়ায় বহু বৈষ্ণবও আরাকানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ফলে সেই বৈষ্ণবদের মধ্যে প্রচলিত ব্রজবুলি শৈলীর আশ্রয় নিলেন আলাওল। আমরা আলাওলের কথা লিখলাম, তিনি দৌলত কাজি, মাগনঠাকুর সহ আরো অনেকের অনেক কথাই লিখেছেন। আঠারো শতকের শেষের দিকে একদিকে মোঘল এবং আর দিকে বর্মণ রাজা বডোপায়ার কাছে আরাকান তার স্বাধীনতা হারায়। আরাকান থেকে মহামুনির প্রতিচ্ছবি নিয়ে চলে যান বর্মণ রাজা, সেই সঙ্গে যায় আরাকানের গৌরবের দিন। ঈটন কথিত displacement প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে এর পরে। সেই নিয়ে তিনি বিস্তৃত লেখেন নি এখানে। তবে বর্তমান রাখাইন-রোহিঙ্গিয়া সংঘাতের পশ্চাদভূমির অনেকটাই ইঙ্গিত মেলে। সেই নিয়ে লেখিকার স্বতন্ত্র অধ্যয়নও রয়েছে। তাঁকে এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বললেই চলে। আরাকানের ইতিহাস সন্ধান করতে গিয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত এই পুরো এলাকাতে বৌদ্ধ ঐতিহ্যকে ইসলামী ঐতিহ্যের থেকে আলাদা করা কঠিন। এমন কি মহামুনি ঐতিহ্যের সন্ধানে তিনি আসামের হাজো অব্দি পৌঁছেছেন যেটি কি না এখনো হিন্দু-বৌদ্ধ-ইসলামী তীর্থ বলে বিবেচিত হয়। ফলে তিনি গোটা পূর্বোত্তর ভারতে এবং বাংলার সমাজে ‘হারানো’ বা ‘লুকোনো’ বৌদ্ধধর্মাদর্শে নিয়ে আরো বিস্তৃত অধ্যয়নের প্রয়োজনের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁর নিবন্ধের কথা লিখতে গিয়ে ভূমিকাতে অনুরাধা চন্দ মনে করিয়ে দিয়েছেন নবীবংশের লেখক সৈয়দ সুলতান, যিনি আরাকানের রাজসভাসদ ছিলেন, সিলেটের তরফ পরগণার থেকেই গিয়েছেন। এবং সিলেট হয়েই সুফি ধর্মাদর্শ চট্টগ্রামের পথ ধরে আরাকান অব্দি গিয়েছে। সুফি দর্শনের পথটি মিথিলা,গৌড় , সিলেট হয়েই আরাকান অব্দি এগিয়েছিল সেসব কথা তথ্য দিয়ে সুকুমার সেন সহ অনেকেই কিন্তু লিখে গেছেন।
এই পর্বে দুই বাংলা নিবন্ধের প্রথমটি লিখেছেন অমলেন্দু ভট্টাচার্য , দ্বিতীয়টি তুষার কান্তি নাথ। অমলেন্দু দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে। সাধারণত দাবি করা হয়ে থাকে হিউয়েনসাং যে ‘সিলিচটল’এর কথা উল্লেখ করেছেন, সেটি আসলে সিলেট। অমলেন্দুর দাবি, এটি শিলচর হতেও পারে। এহ বাহ্য। মনু সংহিতার মতো আর্যব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্য থেকে শুরু করে বৈষ্ণব , শৈব, সুফি ঐতিহ্যের শেকড় থেকে ফসল তাঁর জিজ্ঞাসার বিষয় হয়েছে। সিলেটের রঘুনন্দনের স্মৃতি নয়, বরাক-সুরমা উপত্যকাতে অনুসৃত হয় প্রাচীনতর মনুস্মৃতি। সৈয়দ শাহনূর রচিত সিলেটি নাগরি সাহিত্য ‘সাতকন্যার বাখান’এর নজির দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন নারীর স্বভাব এবং প্রকৃতি বর্ণনাতে কবি মনুস্মৃতি দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেন। ‘বাদসার থান’, ‘ ডরাই ঠাকুরাণী’ , ‘খলকুমারী’ ‘ঘোড়ামুখী’ ‘পাতা খাউরি’ ইত্যাদি লৌকিক দেবদেবীর উৎস, পূজাপদ্ধতি, এবং উপাসক সম্প্রদায় নিয়ে সমস্ত জিজ্ঞাসার শেষে যে ছবিটি তিনি তুলে ধরেন, সেও বাকিদেরই মতো লোকসংস্কৃতির ‘সমন্বয়ী রূপ’। যদিও ‘সমন্বয়ী রূপ’ বলা চলে কি না সেই নিয়ে কিন্তু ঈটন প্রশ্ন তুলেছেন। ভেদবুদ্ধিই যেখানে নেই, সেখানে সমন্বয় বা কিসের?
তুষার কান্তি নাথ ‘দেবী রণচণ্ডী’র উৎস এবং বিবর্তনের সন্ধানে আবারও সেই সমগ্র পূর্বোত্তর ভারত, বাংলাদেশের সঙ্গে উত্তরপূর্ব এশিয়ার সমাজ-সংস্কৃতি-ইতিহাসের দিকে তাকিয়েছেন। তাঁর দাবি, মোঙ্গলীয় ঐতিহ্যের থেকে আসা একটি দৈবধারণার উপরে আর্যব্রাহ্মণ্য প্রলেপ দিয়ে ‘দেবী রণচণ্ডী’ কে গড়ে তুলা হয়েছে। একটি কৌতূহলী প্রবন্ধের তাঁর নিবন্ধটি শেষ হয়েছে। কাছাড়ি রাজসভার অন্যতম সাহিত্যকৃতি ভুবনেশ্বর বাচস্পতির ‘শ্রীনারদীয় রসামৃত’ রাজপরিবারের উপাস্য ‘দেবী রণচণ্ডী’ কোনো উল্লেখ কিংবা বন্দনা কিছুই নেই। কেন?
এই পর্বের শেষ নিবন্ধটি আবার ইংরেজিতে। ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ বইটির লেখক অচ্যুতচরণ চৌধুরী ইতিহাসকে কেমন রূপ দিচ্ছেন---সেটাই ধরিয়ে দিলেন সুদেষ্ণা পুরকায়স্থ। অচ্যুতচরণ পেশাদার ঐতিহাসিক ছিলেন না, তবু তাঁর ইতিহাসটি হয়ে উঠেছিল সেকালের মানে ‘যৌক্তিক এবং বৈজ্ঞানিক’ ইতিহাস গুলোর অন্যতম। যে কারকগুলো এটা সম্ভব করেছে---লেখিকা একে একে চিহ্নিত করবার চেষ্টা করেছেন। অনেকেই তখন একে পশ্চিমা পদ্ধতির, বিশেষ করে পশ্চিমা স্থানীয় ইতিহাসের আদল অনুসরণ করেছে বলে প্রশংসাও করেছেন। লেখিকা দেখিয়েছে, সেসব ছিল। কিন্তু স্থানীয় তথ্যের সন্ধান এবং যাচাই সমস্যা তাঁকে স্থানীয় পদ্ধতি গড়ে তুলেই সমাধান করতে হয়েছিল। নির্ভর করতে হয়েছিল বংশপঞ্জি, লোকশ্রুতি ইত্যাদির উপরে। প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যে দাঁড়িয়েও সেকালের এক ঐতিহাসিক কীভাবে বিদ্যাচর্চার রাজধানী কলকাতা যাবার হাতছানি এড়িয়েও গ্রামের বাড়ি থেকে অসাধ্য সাধন করেছেন সেই গল্প এখনো বহু স্থানীয় ইতিহাসবিদদের প্রেরণার স্থল হতে পারে।
দ্বিতীয় পর্বে যেখানে আলোচনা সিলেটি নাগরিতে প্রবেশ করেছে। এই পর্বের প্রথম লেখাটিই অধ্যাপক আবদুল মুসাব্বির ভূঁইয়ার, যার বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার বিষয়টিই ছিল ‘সিলেটি নাগরি’---তাঁর মতে ‘জালালাবাদী নাগরি’। যদিও তাঁর পড়াবার বিষয় আরবি ভাষা এবং সাহিত্য। সিলেটি নাগরি লিপির উদ্ভব এবং বিকাশের একটি সামগ্রিক ইতিহাসের ছবি তিনি তুলে ধরবার চেষ্টা করেছেন। গ্রিয়ার্সন থেকে শুরু করে পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ হয়ে সুনীতি কুমার, শিবপ্রসন্ন লাহিড়ি, আহমেদ হাসান দাবি প্রমুখ যারাই সিলেটি নাগরি লিপি এবং সাহিত্য নিয়ে অধ্যয়ন করেছেন তাঁদের অধ্যয়নের সঙ্গেও সংক্ষিপ্ত পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। প্রায় সঠিকভাবেই লিখেছেন, সরাসরি বাংলা বা দেবনাগরি থেকে এই লিপি আসে নি। এই দুই লিপির থেকেই সে উপকরণ নিয়েছে, সেই সঙ্গে আরবি –পার্শি ধ্বনিতত্ত্বের প্রভাবেও প্রভাবিত হয়েছে। কিন্তু শিবপ্রসন্ন লাহিড়ি সিলেটি নাগরি লিপির উদ্ভবের কারক হিসেবে শাহজালাল এবং তাঁর শিষ্যদের ধর্মপ্রচারের কাজ এবং কালকে জুড়তে চেয়েছিলেন। সুনীতি কুমারও বুঝি সেরকমই দাবি করেছেন এবং কালও মোটামুটি চতুর্দশ শতক বলে সুনির্দিষ্ট করেছিলেন। আমরা তলিয়ে দেখেছি, সুনীতি কুমার আদৌ সেরকম দাবি করেন নি। শিবপ্রসন্ন লাহিড়ি দাবিটি সঠিক করেন নি বলে উষারঞ্জন ভট্টাচার্য অন্যত্র লিখেছেন। অন্যদিকে আহমেদ হাসান দানি সিলেটি নাগরি লিপির উদ্ভবের সঙ্গে বহু পরের আফগান শাসকদের ভাষানীতি এবং সংস্কৃতির সঙ্গে জুড়তে চান। এই তর্কে আবদুল মুসাব্বির ভূঁইয়ার স্থিতি শিবপ্রসন্ন লাহিড়ির পক্ষে। সিলেটি লিপিতে লেখা সাহিত্যের ভাষাকে তিনি বলেন ‘সিলেটি বাংলা’। সম্পাদিকা অনুরাধা চন্দকে দেখলাম, ‘সিলেটি বাংলা’র দাবিকে মেনে নিতে। গ্রন্থশেষে সম্পাদকীয় মন্তব্যে । ‘সিলেটি’র দাবিটি একেবারে নিরর্থক নয় এর জন্যে যে সিলেটি ছাপটি প্রবল। কিন্তু সিলেটে বাংলা লিপিতে বা প্রতিবেশী এলাকার সাহিত্য তুলনা করলে দেখা যাবে প্রাক-ঔপনিবেশিক কালে সারা বাংলাতেই এমনটা হয়েছে, যাকে ‘উপভাষা’ বলি তার ছাপও পড়েছে, আবার সাধারণ একটি মান বাংলা গড়ে তুলবার প্রবণতাও দেখিয়েছে সাহিত্যের ভাষা। ‘পহেলা কেতাবে’র ছোট্ট নমুনা আমরা দেখালামই। একটি পদের নজির দিতে পারি --- যেটি সিলেটি দেখাবে, সম্ভবত শোনাবেও... “...শুতিলে না আইসে নিদ্রা বসিলে পোড়ে হিয়া/বিষ খাই মরি যাইমু কালার বালাই লৈয়া/প্রতাপ আদিত্যে বলে বিড়ম্বনা আশে/মিছা ভুলি রহিলুম এ ভব-মায়া রসে।” এখন এই রচয়িতা প্রতাপাদিত্য কিন্তু যশোরের রাজা হওয়াই সম্ভব। কিংবা এই সুবিখ্যাত বৈষ্ণব পদ পড়ামাত্র মনে হবে হবিগঞ্জের কারো লেখা, “দেইখ্যা আইলাম তারে---/সই দেইখ্যা আইলাম তারে।/এক অঙ্গে এত রূপ নয়ানে না ধরে।।/বান্ধ্যাচে বিনোদ চূড়া নব গুঞ্জা-দিয়া।/উপরে ময়ুরের পাখা বামে হেলাইয়া---” পদটি কিন্তু, সবাই জানি, জ্ঞানদাসের লেখা। সুতরাং মুহম্মদ আবুল বশর যে লিখেছিলেন,“লিপি আছে ভাষা নেই--- তা বোধহয় বিশ্বলোকে একটাই,আর তা সিলেটি নাগরী লিপি।” আবিদ রাজা মজুমদার তাঁর নিবন্ধে কথাটির উল্লেখ করেছেন। নন্দলাল শর্মা কিন্তু লিখেছেন, এই লিপিতে বাংলা ভিন্ন অন্যান্য ভাষার পুথিও কিছু লেখা হয়েছে। আর ‘বাংলা’ পুথির লিপ্যন্তর তো হয়েইছে।
এই পর্বের দ্বিতীয় রচনাটি ইংরেজিতে। অনুরাধা চন্দের ইতিপূর্বে সম্পাদিত ‘সিলেট নাগরির পহেলা কিতাব ও দৈ খুরার রাগ’ বইটির উপর ভিত্তি করে মীনা দানের ভাষাবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ। অত্যন্ত সুব্যবস্থাপিত কিন্তু সংক্ষিপ্ত আলোচনা। সাধারণত ভাষাবিজ্ঞানের সামগ্রিক ছবি এতো সংক্ষেপে আলোচনা করাই কঠিন। যেখানে লেখিকাকে স্বনিম এবং উপস্বনের তফাৎ অব্দি বুঝিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। ভাষাবিজ্ঞানের চেনা ক্রমকে পালটে তিনি বাক্যতাত্ত্বিক, রূপতাত্ত্বিক আলোচনা সেরে ধ্বনি তত্ত্বে এসেছেন। ভাষাবৈজ্ঞানিক দৃষ্টির থেকে তিনি লিখছেন, স্বল্পশিক্ষিত নিম্নতর শ্রেণির মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না এই লিপি কাঠামোকে গড়ে তোলা। প্রথমত প্রতিবেশী লিপিগুলোর সঙ্গে কোনো রকম বিভ্রান্তি এড়াতে এরা নতুন বর্ণ গড়েছেন। তাঁরা জানতেন একটি বাংলা ভাষাবৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করছেন, ফলে মনে হয়েছে আরবি ফারসির বদলে দেবনাগরি বর্ণবিন্যাসকে আশ্রয় করলেই ভাষার প্রয়োজনটি মিটবে ভালো। উচ্চারণ অনুসারে লিপি গড়তে গিয়ে ধ্বনি প্রতি একটিই হরফ রেখেছেন। উদাহরণ স্বরূপ শিষধ্বনির জন্যে বাংলাতে যেখানে তিনটি বর্ণ রয়েছে, সিলেটি নাগরিতে রয়েছে একটি মাত্র। ফলে বর্ণমালাটি রপ্ত করা নিশ্চয় সহজ হচ্ছিল। যদিও যুক্তাক্ষর নিয়ে তিনি বিশেষ কথা বলেন নি। আশা করেছেন, আরো যেসব শতাধিক পুথি বা বই উদ্ধার করা গেছে সেগুলোর একটি তুলনামূলক আলোচনা ভাষা এবং লিপি সম্পর্কে আরো সব নতুন দিক খুলে দেবে।
আবিদ রাজা মজুমদার নিজেও ভাষাতাত্ত্বিক, সম্পাদিকার কাজের সহকর্মী । প্রচুর ক্ষেত্র অনুসন্ধানে সঙ্গ দিয়েছেন। মূলত এর উপরে ভিত্তি করেই বরাক উপত্যকাতেই যারা এখনো নাগরি পুঁথি পাঠ করেন সেরকম জনাকয় ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছেন। যেমন হাইলাকান্দির ফরাস উদ্দীন চৌধুরী, বাঁশকান্দির শেখ ফরিজ আলী, শেখফকির আলী প্রমুখ। পুঁথি কারা পড়েন, কীভাবে পড়েন সেইসব কথাই লিখেছেন তিনি। সেই সঙ্গে এসেছে বরাক উপত্যকার ভূগোল,ইতিহাস এবং জনগোষ্ঠীগত বৈচিত্র্যের উৎস কথা।
সাদিয়া চৌধুরী পরাগের পরবর্তী বাংলা প্রবন্ধটিও একই পথে হেঁটেছে। তিনি মূলত তাঁর বাংলাদেশের বাড়ির মহিলাদের মধ্যে নাগরি পুথি পড়ার কথা স্মৃতি থেকে লিখেছেন। প্রথম ভাগে তিনি অত্যন্ত সংক্ষেপে নাগরি সাহিত্যের উদয় এবং বিলয়ের কারকগুলো বলবার চেষ্টা করেছেন । শাহজালাল এবং তাঁর অনুগামীদের দ্বারা ভাষায় ভাবনায় পরিবর্তনের একটি প্রেক্ষাপটের কথা স্বীকার করেও গোলাম কাদিরের সাক্ষ্যে আস্থা জানিয়ে তাঁরও বক্তব্য মোঘলদের দ্বারা পরাস্ত আফগানেরাই এই লিপির উদ্ভব এবং বিকাশ ঘটান। ঔপনিবেশিক আমলে বাংলাকে বিধর্মীদের ভাষা বলে প্রচারকে মোকাবেলা করতেই সিলেটে সিলেটি নাগরি সাহিত্যের প্রচার প্রসার বাড়ে। উর্দু-আরবি ফার্সি শব্দপ্রয়োগ হলেও, সিলেটি ভাষারীতির মিশ্রণ ঘটলেও ভাষা এগুলোর বাংলাই। এবং বিষয়ে আসয়েও কেবলই ইসলামী বিষয়ে সীমাবদ্ধ ছিল না, রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনি, পদ্মাপুরাণ ইত্যাদি সহ ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়েও পুথি লেখা হয়েছে। শিক্ষাদীক্ষাতে কোণঠাসা মুসলমান সমাজের কাছে এই সাহিত্য একটি বিকল্প নিয়ে এসেও হাজির হয়। পাকিস্তান আমলের বাংলা ভাষা আন্দোলন যে ঐক্য গড়ে তুলে তাতে সিলেটি নাগরি সাহিত্যের সেই উচ্ছ্বাস স্তিমিত হতে শুরু করে, এবং মুক্তি যুদ্ধের পরে আর স্বাতন্ত্র্য টিকিয়ে রাখবার দরকারটাই নেই হয়ে যায়। তাছাড়া জমিদারি প্রথার অবলুপ্তি, সর্বজনীন শিক্ষা বিশেষ করে নারীদের ব্যাপকভাবে শিক্ষাতে নিয়ে আসাতেও এই সাহিত্যের পাঠক কমে যায়। সাহিত্যের পাঠক এখন আবার বেড়েছে কি না, আমাদেরও জানা নেই । কিন্তু বাংলাদেশ থেকে মূলত বিলেত প্রবাসী কিছু সিলেটির উদ্যোগে আন্তর্জাল জমানাতে যে নতুনকরে লিপি এবং সাহিত্যকে পুনর্জীবিত করবার প্রয়াস চলছে, সেই সংবাদ সম্ভবত তাঁর কাছে পৌঁছোয় নি। বস্তুত সংকলন সম্পাদিকার কাছেও পৌঁছোয় নি।
সামসুল হক বড়ভূঁইয়ার রচনাটি আবিদ রাজা মজুমদারের পরিপূরক বললেই হয়। তিনি ক্ষেত্র অনুসন্ধানে সোনাই এলাকায় যাদের কাছে পুথি দেখেছেন সেরকম জনাকয়েক ব্যক্তির এবং সংগৃহীত পুথির নামোল্লেখ করেছেন। এখনো কোথাও কোথাও কিছু পুথি পড়া হয় বলে জানিয়েছেন। বিশেষ করে মহরম মাসে ‘জংগনামা’ গান এবং নাচের প্রচলন আছে বলে জানিয়েছেন।
তৃতীয় পর্বে সিলেটি নাগরি সাহিত্যের সামাজিক তথা ঐতিহাসিক তাগিদটিকে বুঝবার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রথম নিবন্ধটি লিখেছেন স্বপন মজুমদার। তিনি প্রাকৃতিক তথা অকৃত্রিম এবং কৃত্রিম ভাষা তথা লিপির তফাৎটিকে বুঝবার চেষ্টা করেছেন। কখনো একটি পুরো ভাষাই গড়ে তুলা হয় কৃত্রিম ভাবে যেমন আস্পারেন্তো। আবার ভারতে যখন বহু প্রান্তিক ছোটখাটো জনজাতিদের ভাষাতে লেখালেখি সম্ভব করে তুলতে রোমান লিপির ব্যবহার করা বা করানো হয়---তখন লিপিটি হয়ে যায় কৃত্রিম। সিলেটি নাগরি সেরকম এক কৃত্রিম লিপি। সেই কৃত্রিমতা কখনো প্রতাপের নিজের দরকারে ঘটতে পারে, কখনো বা তাকে প্রতিহত করতে। যখন একদল মানুষে ভেবেছেন স্বাভাবিক বাংলা ভাষা এবং লিপিতে নিজেদের কথা বলবার স্বাভাবিক অধিকার পাচ্ছেন না তখনই এই লিপির দরকার মনে করছেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি চর্যার ‘সান্ধ্যভাষা’র কথাও এনেছেন। যেখানে বাইরের এবং ভেতরের বার্তা ভিন্ন। ‘সান্ধ্যভাষা’তে অবশ্য শুধু ব্যবহারিক ভাষারই কথা বোঝায় না,কাব্যভাষাকেও বোঝায়—যেখানে শব্দের আভিধানিক এবং ব্যঞ্জনার্থ ভিন্ন---সেই কথাটি মনে হল না তিনি মনে রেখেছেন। তাতে অবশ্য সমস্যা বিশেষ হয় না। ঐতিহ্যের দিক থেকে তিনি চর্যার সাহিত্য এবং সিলেটি নাগরি সাহিত্যকে একই গোত্রের মনে করছেন, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ নিছক কোনো সাম্প্রদায়িক প্রেরণাতে লিপিটির উদ্ভব হয় নি, হয়েছে সংগ্রামী প্রেরণার থেকে। বাংলা ভাষা এবং লিপিতে অশিক্ষার ফল এই লিপি তাও নয়। এমনকি উনিশ শতকে ছাপা সাহিত্যে জোয়ার আসবার পেছনে খৃষ্টান মিশনারিদের প্রতিরোধ করবার তাগিদও কাজ করেছে, যে মিশনারিদের পেছনে কিনা শাসকদেরও প্রশ্রয় ছিল। মূলত তিনটি বই ‘পহেলা কিতাব’, ‘আহকামে চরকা’ এবং ‘চরকাফাজিলত’এর উপর ভিত্তি করে তাঁর বক্তব্য তিনি দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য ব্রাহ্মি লিপি বৌদ্ধদের হাত ধরেই এই অঞ্চলে এসে থাকবে। তাঁর লেখাতে দেবনাগরি এবং নেওয়ারির দুই বিকল্প নামও তাঁর লেখাতে পাচ্ছি –যথাক্রমে দেশনাগরি এবং নাগরি। সিলেটি নাগরিতে এই দুইয়েরও প্রভাব থেকে থাকবে। আমরা জানি দেবনাগরি , নেওয়ারি বাংলা বা সিলেটি নাগরি সবই ব্রাহ্মিরই দ্বিতীয় সহস্রাব্দের বিচিত্র রূপান্তর। আর ব্রাহ্মিই সরাসরি এসেছিল, বা বৌদ্ধদেরই হাতে করে এসেছিল---সেরকম বক্তব্য সামান্য সমস্যাসঙ্কুল। কিন্তু একটি নতুন প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। ‘ব্রাহ্মি’ সম্পর্কে এই অভিমতকে দেখা যাচ্ছে সম্পাদিকাও তাঁর সমাপ্তি মন্তব্যতে অস্বীকার করছেন না। কিন্তু দুজনের কেউই কোনো তথ্য দেন নি। আমরা কিন্তু ব্রাহ্মিকে সরাসরি এই এলাকাতে আসবার নজির বিশেষ পাইনি, এলেও সেটি প্রথম সহস্রাব্দের প্রথমদিকেই আসা সম্ভব ছিল। ব্রাহ্মি গুপ্ত স্তর পার করে একদিকে দেবনাগরি, অন্যদিকে কুটিল-কামরূপী স্তর পার করে বাংলা-অসমিয়া লিপিস্তর অব্দি এসেছে। এবং সিলেটে সর্বপ্রাচীন যে লিপিটি মিলেছে সেই নিধনপুর ফলকের লিপি কিন্তু কুটিল-কামরূপী। ফলে সেই সময় বা তারপরে আবার বৌদ্ধদের হাত ধরে ব্রাহ্মির চলে আসাটি সত্য হলেও ইতিহাসকে আরো বহু প্রশ্নের সামনে দাঁড় করাবে। রিলা মুখার্জি চন্দ্ররাজাদের ফলকে দুই একছত্র নাগরি লিপির যে কথাটি লিখেছিলেন, সেটি বরং সত্য হওয়াই সম্ভব। আনুষঙ্গিক আরো বহু নজির যেমন আছে, তেমনি এই সময়টাই প্রত্নরূপ ছেড়ে একদিকে নাগরি আর দিকে বাংলা-অসমিয়া লিপির জন্মক্ষণ।
স্বপন মজুমদারে ভাবনকেই আরো গভীরে নিয়ে গেছে সম্পাদিকা অনুরাধা চন্দের ইংরেজি লেখাটি, যার শিরোনামের বাংলা ভাবার্থ দাঁড়ায় ‘সত্যিকার মুসলমান হয়ে উঠা: সিলেটি নাগরি অভিজ্ঞতা’। স্বপন মজুমদার যদি এই তথ্য জানিয়েছেন যে সুফিরা মধ্য এশিয়াতেই বৌদ্ধ ধর্ম দর্শনের সংস্পর্শে এসেছেন, অনুরাধা তবে এই তথ্যও জানিয়েছেন কামরূপের যোগ দর্শনের বই ‘অমৃতকুণ্ড’ আরবি ফার্সিতে অনূদিত সুফিদের দ্বারাই মধ্য এশিয়া অব্দি ছড়িয়ে পড়ছে...এমন আরো বহু গ্রন্থ পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে সুফিদের দ্বারা অনূদিত হচ্ছে এবং ইসলামী বিশ্ববীক্ষার ভেতরে গ্রহণ করে মানানই করা হচ্ছে। সুসংগঠিত হিন্দু বা ইসলাম ধর্মের প্রতাপের বাইরে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম, সহজিয়া বৈষ্ণব এবং নাথ ধর্মের সঙ্গে সুফি দর্শনের বিচিত্র রসায়নের ইতিবৃত্ত তিনি বর্ণনা করছেন। চারটি পাঠ তিনি নিয়েছেন ‘পহেলা কেতাব’, ‘রাধাপিয়ারি’ , ‘মুফিদুল মুমিন’ এবং ‘মুফিদুল আওয়াম’ । এর মধ্যে দ্বিতীয়টি ছাপা নয়। এর চারপুথিই যদিও প্রায় একই সময়কার--- ‘সত্যিকার মুসলমান’ হবার কাহিনি কেমন পালটে যাচ্ছে তার চিত্তাকর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। নাগরি লিপি তর্কের বাইরেও সামাজিক ইতিহাসের পাঠ হিসেবে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা। প্রথমটিতে শরিয়তি ইসলামকে বিরোধিতা করা হচ্ছে। দ্বিতীয়টিতে সংশয় ‘ চিনিতে না পাইলাম আমি কুনু জন দানা’। তৃতীয়টিতে শরিয়তি পথকে স্বীকার করে নিয়েও মারিফতিকে বর্জন করা হয় নি, কিন্তু চতুর্থটিতে একদিকে সুফি সাধুদের সরাসরি ‘শয়তানের খলিফা’ বলে প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে। বাংলাদেশের ইসলামের বিবর্তনটি স্পষ্ট ধরা পড়ে। রিচার্ড ঈটন কিন্তু অনুরাধা চন্দের পড়া রয়েছে। আমরা যে ঈটনের অন্তর্ভুক্তি, পরিচিতকরণ এবং প্রতিস্থাপনের তত্ত্বটির কথা লিখে এসেছি অনুরাধার নিবন্ধটি কিন্তু সেই তত্ত্বকেই আরো পোক্ত করে। তিনি কেন বা সেই তত্ত্বের উল্লেখ করলেন না, আমাদের কৌতূহল জাগে। দু’জনের বক্তব্য খুবই কাছাকাছি। কিন্তু উল্লেখ না করবার ফল হয়েছে এই যে এককালিক ভিন্নস্বরের পাঠ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লেখিকা লিখছেন, ভালো বা সত্যিকার মুসলমানের ধারণাকে কোনো এক সংজ্ঞার মধ্যে ধরা যাচ্ছে না। মুসলমান সমাজকেও পরিচিতিতে বেঁধে ফেলা যাচ্ছে না।এটি সত্য বটে --- কিন্তু একে কালক্রমিক বিবর্তন বলে ধরে নিতেও অসুবিধে নেই। যদি আমরা মনে রাখি যে পঞ্জিকার কাল এবং সামাজিক বিভিন্ন স্তরের কালের ধারণা ভিন্ন হতে বাধ্য। একই কালে বহু কাল সহবাস করতেই পারে, আর সেটিই হয়েছে। দইখুরা আর তাঁর ‘রাগে’র প্রথম সম্পাদকের কালতো স্পষ্টতই ভিন্ন, চিন্তাপ্রস্থানও দুই বিপরীত মেরুর। নন্দলাল শর্মা এর পরে শিতালং শাহের যে পরিচয় দিয়েছেন তাতেও প্রথম দুই স্তর একই ব্যক্তিতে অস্পষ্ট থাকে নি। অনুরাধার আলোচিত শেষ দুই গ্রন্থে যে ইসলাম ধরা দিয়েছে তাকে তিনিও ‘Modernity’ বলছেন। যথার্থই বলেছেন।এইসব ধর্মীয় সরলরৈখিক অবস্থানকে ‘মধ্যযুগীয়’ বলাটাই আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে জিজ্ঞাসার অভাবটিকে ভালো চেনায়। এগুলোতে মেয়েদের মাঠে কাজ করতে মানা করা হচ্ছে, এবং পর্দাপ্রথা অনুসরণ করতে বলা হচ্ছে। ঠিক সেই সময় যখন বর্ণহিন্দুদের মধ্যে মেয়েদের পর্দার বাইরে বের করে আনবার সামাজিক সংগ্রাম চলছে। আমরা যদি মনে রাখি বর্ণহিন্দুরা ছিলেন মূলত জমিদার, এবং মুসলমান মূলত তাদের রায়ত তথা কেউ কেউ জোতদার---তবে ধর্মের বাইরে বেরিয়ে এই বৈপরীত্যের একটি আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক কারকের সন্ধান মেলা খুব অসুবিধে হবার কথা নয়। বস্তুত কালান্তরের বিপরীতে ‘সামাজিক স্থানান্তর’এর একটি ভাবনাতেও পেয়ে বসে।
শেষ তথা পরের বাংলা রচনাটি শিতালং শাহ ও তাঁর গান নিয়ে নন্দলাল শর্মার লেখা। এর প্রথম ভাগে তিনি স্বাভাবিক ভাবেই সিলেটের, সিলেটি নাগরি লিপি এবং সাহিত্যের, সাধারণ ভাবে ‘মরমী’ দর্শন এবং সাহিত্যের বিকাশ এবং পরিবেশের ইতিবৃত্ত বর্ণনা করে শিতালং শ শাহকে নিয়ে লিখবার পরিবেশটি গড়েছেন। শেষভাগেই শিতালং শাহের জীবন, সাধনা এবং গান নিয়ে বিস্তৃত লিখেছেন। বাউল সুফিদের অনেকেই নিজেদের গানের লেখা বা ছাপারূপ দেবার বিরোধী ছিলেন। শিতালং শাহও তাই। সুতরাং সেই অর্থে তাঁকে লেখক বলা যাবে না।মূলত গোলাম কাদিরের অভিমতের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁরও অভিমত সিলেটি নাগরি লিপি সপ্তদশ শতকের আগেকার নয়। তাঁর অভিমত এই লিপিতে সিলেটি তথা বাংলা ছাড়াও অন্যান্য ভাষার সাহিত্যও কিছু কিছু মেলে। যদিও বা এই লিপিতে প্রেমকথা, শাস্ত্রাচার এমন কি উনিশ বিশ শতকে সমকালীন সমাজবাস্তবতা নিয়েও কিছু পুথি মেলে তবু বিশেষ ভাবে ফকিরদের দ্বারাই এই সাহিত্য ‘শাসিত’ বলে একে ‘ফকিরি লিপি’ও মনে করা যেতে পারে। তিনি সিলেটে অধ্যাপনা করেন। ‘সাধক কবি ফকির শিতালং শাহ’ নামে একটি সংকলনগ্রন্থেরও সম্পাদনা করেছেন। সুতরাং তিনি যখন লেখেন এখন আর কাছাড় ছাড়া কোথাও বিশেষ এই সাহিত্য গান করে পড়া হয় না---তখন তথ্যটি নজরে না পড়ে থাকে না। শিতালং শাহ ১৮০০ খৃষ্টাব্দে করিমগঞ্জের শ্রীগৌরীর কাছে কিত্তা শিলচর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর সুফিতত্ত্বশ্রয়ী এবং ইসলামী দুই ধরণের গানই মেলে। ‘রাগ শিতালঙ্গী’ নামে তার গানগুলো কাছাড় সিলেটে এক সময় বেশ জনপ্রিয় ছিল।সুফিগানগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই বৈষ্ণবীও ছাপটিও স্পষ্ট। লেখক যদিও শিতালঙের সুফিগানগুলোকে ‘দ্বিতীয় পর্যায়ের গান’ বলে লিখেছেন, আমাদের মনে হয় এগুলোই প্রথম পর্যায়ের। শরিয়তি এবং মারিফতি পথের দ্বন্দ্ব একটি তাঁর মধ্যে কাজ করেছিল। যে দ্বন্দ্বটি কিনা সময়ের দ্বন্দ্ব বলে অনুরাধা চন্দ স্পষ্ট করেছেন চারজন গীতিকবির পাঠ নিয়ে আলোচনাতে। বিয়ের আগে তিনি ভুবন পাহাড়ে বহুদিন থেকে সাধনা করবার সংবাদ পাচ্ছি। সেই সাধনার পথ শরিয়তি হতে পারে না। অনুরাগীদের থেকে সংগৃহীত গানের কালক্রম অবশ্য নির্ণয় করা কঠিন। কিন্তু মারা যাবার পরে তাঁর মাজার কেন্দ্রিক কোনো অনুষ্ঠানাদি যাতে না হয় সেই নির্দেশিকা দিয়ে গেছিলেন দেখে মনে হয়, ক্রমেই তিনি মারিফতি পথ থেকে বেরিয়ে আসছিলেন। সেই নির্দেশ এতোই প্রভাবী ছিল যে বহুদিন তাঁর মাজার অরক্ষিত ছিল, পরে সাধারণ দেয়ালে ঘিরে দিলেও উরুস বা সেরকম কোনো অনুষ্ঠানাদি হয় না। নন্দলাল শর্মা শিতালং শাহের বেশ কিছু গানের কলি উদ্ধার করে দিয়েছেন । তাতে একটি বিষয় বেশ বোঝা যায়, ইসলামী গানগুলোর কোনো কোনোটিতে সমকালীন সামাজিক দ্বন্দ্ব বেশ স্পষ্ট। সেদিক থেকে এগুলোতে একটি ‘আধুনিকতা’র ছাপ আছে। যেমন “ বিদদা শিকখা লেখাপড়া ছআলেতে ধুম/ শও কথা নেক আমল হইতেছে গুম/... ফরকন্দাজ মাঝে গেল উঠিয়া শরম/ মাতাপিতারে করে বেহদ্দ ছিতম”। অন্যদিকে শৈল্পিক রুচিতে সুফিগানগুলোই উতরে গেছে বলে মনে হয়। এই যেমন একটি গানের দু’চারটি চরণ এরকম: “ জালাই মমের বাতি পুশাইলাম সারা রাতি গ/ ফুল বিছানাএ আতর ছিটাই ইনতেজার বেদনি।।/ হরেক রংএ জনতর বাজে হরেক কুঠাএ গুপি শাজে গ/ খালি গিরদক কুলে লইআ পুশাইলাম রজনি।” লেখকের দাবি সিলেটি নাগরী সাহিত্যেই নয়, “বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসেও শিতালং শাহ একজন কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব।’
রাধারমণ, হাছন রাজা,লালন ফকিরের গানের পাশাপাশি অতিসাম্প্রতিক আবদুল করিমের গানও যেখানে আমরা আবাল্য শুনে বড় হয়েছি , সেখানে করিমগঞ্জ তথা আসামের কবি শিতালং শাহের গান কেন আধুনিক গীতিমাধ্যমগুলোতে আর সেরকম শোনা যায় না সেটি আমাদের ভাবতে বসায়। শুধু ‘দোহার’ বাংলা বেণ্ড একটি গান ‘শুয়া উড়িল’কে সম্প্রতি আবার বেশ নাগরিক স্রোতাদের মধ্যে নিয়ে এসেছে, এর বাইরে আমরা বহু সন্ধানেও পাই নি।
‘স্ক্রিপ্ট আইডেন্টিটি রিজিওন’-এর মতো বই সাধারণত জনপ্রিয় হয় না। আর জনপ্রিয় না হবার সমস্যা হচ্ছে আগ্রহী জিজ্ঞাসু মনও সহজে এসবের সন্ধান পান না। আমাদের আলোচনা যদি বইটি সম্পর্কে সামান্য পরিচিতি বাড়াতে সাহায্য করে, সেই সঙ্গে পড়বার আগ্রহ এই ভেবেই শ্রম স্বীকার করা।
সিলেটি নাগরি নিয়ে দুটি ধারণাকে আমাদের অন্ধবিশ্বাস বলেই মনে হয়েছে। এক, লিপিটি শাহজালাল বা তাঁর সঙ্গী আউলিয়াদের দ্বারা প্রচলিত। বা তাঁরও আগে প্রচলিত ছিল। তাঁরা একে জনপ্রিয় করেছেন। দুই, সিলেটি লিপি আলাদা তাই ভাষা আলাদা। এই বই এবং অন্যত্র অনুসন্ধান করেও এই দুই সিদ্ধান্তের পক্ষে আমরা কোনো যুক্তি পাই নি। সেই চতুর্দশ শতকে বাংলাদেশে আর কোনো লিপিতে সেরকম সাহিত্যের সন্ধান মিলছে না, মিলবে কেবলই সিলেটি নাগরিতে--- যুক্তি হিসেবেও খুব সবল নয়। যারা এমন দাবি করছেন তারা বাকি বাংলার ইতিহাস নিয়ে বেশি ভাবতে আগ্রহী বলে আমরা দেখিনি। এই বইতেও না, অন্যত্রও না। আর লিপি জনপ্রিয় করবার জন্যে সিলেটি বা বাঙালি তায় মুসলমান এক বিশাল জনসম্প্রদায়ের দরকার। যেটি মোঘল আমলের আগে সিলেট কাছাড় অঞ্চলে হয় নি। মোঘলেরাও বাংলা ভাষাকে সেরকম প্রশ্রয় দেন নি। ফলে বাংলা আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী রাজ্যগুলোতে। আরাকানে, কাছাড়ে, কোচ-কামতাপুরে, ত্রিপুরাতে। তার বাইরের লোকজন একটি ‘সান্ধ্যভাষা’র উপকরণ হিসেবে সিলেটি নাগরির আশ্রয় নিচ্ছেন -- যে প্রক্রিয়াটির কথা স্বপন মজুমদার এই বইতেই ব্যাখ্যা করছেন, সেসব অনেক বিশ্বাস এবং গ্রহণযোগ্য।
দ্বিতীয়ত সিলেটি নাগরি অনেকটা বৈষ্ণবপদের ‘ব্রজবুলি’ ভাষার মতো। যে ভাষাতে কথা বলবার আদৌ কোনো জনসম্প্রদায় নেই। এমন কি সব বৈষ্ণবেরাও সেই ভাষা ব্যবহার করতেন না। সিলেটি নাগরি সেরকম মূলত ‘সুফি’, ‘বৈষ্ণব’ গানে ব্যবহৃত লিপি। বাকি যা কিছু বিষয় বৈচিত্র্য দেখা যাচ্ছে সবই উনিশ শতকের ষাটের দশক থেকে বিশ শতকের ষাটের দশক অব্দি এক শতকের ছাপা গ্রন্থের বাজারের স্বার্থে। এই শতকে সিলেটিরা বাংলা লিপি ব্যবহার করেছেন তার চে’ বহু বেশি। আর লিপি আলাদা হলেই যদি ভাষাকে আলাদা হতে হয়, তবে বাংলা লিপি বলে যেটিকে জানি সেটিকে সংস্কৃত ভাষাই বা কেন বলা যাবে না? বাঙালি তো এই লিপিতেই সংস্কৃত চর্চা করে।আরবি, রোমান, সিলেটি নাগরি সহ বাংলার প্রায় নটি লিপি ছিল, সিলেটি তার মধ্যে একটি। আর ছাপাখানার মুখ দেখেছে রোমান, বাংলা এবং সিলেটি নাগরি লিপি। এই তিনটি। সেই গৌরব তার প্রাপ্য। সম্প্রতি আন্তর্জালে ইউনিকোডেও এসেছে এই লিপি। তাই বলে সাহিত্যিক অন্তর্বস্তুর কোনো ভাষাবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ছাড়াই, লিপির ইতিহাসের কোনো অনুসন্ধান ছাড়াই দাবি করা হবে সিলেটি ভাষার লিপি সিলেটি---সেসব আমাদের অন্ধ বিশ্বাস বলে মেনে নিতে অসুবিধে থাকবার কথা নয়।
অনুরাধা চন্দ এবং সহযোগীদের প্রয়াস সেই সব বিশ্বাসের ভিত নড়বড়ে করে দিয়ে নাগরি সাহিত্যের দিকে নজর ফেরাবে বলে আশা করা চলে। তবে পরবর্তী কোনো প্রয়াসে যেন আন্তর্জাল প্রয়াসগুলোও অন্তর্ভুক্ত হয়। বিলেত থেকে যে প্রয়াসগুলো হচ্ছে তার ব্যাপ্তি বহু ব্যাপক। বিলেতের অধিকাংশ বাঙালিই কিন্তু সিলেটি। সুতরাং তাদের বাস্তবতা বোঝাও আমাদের কাজ। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় এমনি এমনি তাদের প্রয়াসে যুক্ত হয় নি। তাদেরই প্রেরণাতে বাংলাদেশে ইতিমধ্যে আবারও নতুন প্রকাশনা সংস্থা গড়ে উঠছে, যারা সিলেটি নাগরি বই পত্র প্রকাশ করছেন। সেলিম মুস্তফার ‘উৎস প্রকাশন’ সেরকম একটি। সুতরাং নন্দলাল শর্মা লিখতে পারেন পুথি পড়া সংস্কৃতি বাংলাদেশে নেই,কাছাড়ে আছে। পুথি ছাপানো সংস্কৃতি কিন্তু বাংলাদেশে দিব্বি আছে। সেগুলো আন্তর্জালেও সুলভ। স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের নতুন নজরে তাকাবার কাজ ফুরোচ্ছে না।
------ ---- ----
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন