“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ১১ আগস্ট, ২০১৭

ভাম


                 ।। শিবানী ভট্টাচার্য দে।।                                                          

দিন ধরেই এরকম হচ্ছে । রাতের দিকে একটা ভাম  ডাইনিং টেবিলের উপর ট্রেতে সাজিয়ে রাখা ফল খেয়ে যাচ্ছে 
 ভামটার রাস্তা বেশ সোজা । লিভিং স্পেসের খোলা জানালা দিয়ে ঢোকে, ডাইনিং স্পেসের জানালা দিয়ে বেরিয়ে যায় । জানালাদুটোর ঠিক নিচের দেওয়ালে ওর পায়ের ছাপ আছে । লিভিং স্পেসের জানালার নিচে পায়ের আঙ্গুলের ছাপ নিচের দিকে, ডাইনিং স্পেসের জানালার নিচে পায়ের আঙ্গুলের ছাপ উপরমুখো । ব্যাপারটা আবিষ্কার করে কৃষ্ণা মজুমদারের নিজেকে বেশ বুদ্ধিমতী মনে হয়েছিল । পায়ের ছাপের মালিকের যাতায়াতের  রুট আবিষ্কার করে তিনি পুলকিত হয়েছিলেন, তবে সে ব্যক্তিটি কে তা ধরতে পারেন নি।
প্রথম প্রথম তিনি ভেবেছিলেন হনুমান ফল খেয়ে যাচ্ছে । কারণ তিনি জানেন হনুমান ফল খায়, বাড়িতে ঢুকেও পড়ে । পাশের বাড়ির সুজাতা ভাদুড়িকে বললেন কথাটা ।  সুজাতা ভাদুড়ি ওঁকে একপ্রস্ত জ্ঞান দিলেন । হনুমান ? হতেই পারেনা । হনূমানের পায়ের ছাপ আরো বড় হয় । হনুমান জানালার এই গ্রিল দিয়ে গলতে পারবে না ।
ছোট হনুমান ও তো হতে পারে ?  কিংবা কাঠবিড়ালি ?
 সুজাতা ওঁর অজ্ঞতা দেখে হাসলেন । হনুমান  রাতের বেলা আসবে না । আমার বাপের বাড়ির  ওদিকে  হনুমান  আছে  ওরা দিনের বেলাতেই আসে । মাঝে মাঝে তো ভাতের হাঁড়ি ও উঠিয়ে নিয়ে যায়  কাঠবেড়ালি ও রাতের বেলা বেরোয় না ।
সুজাতা ভাদুড়ির বাঁদুরে জেনারেল নলেজে একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে কৃষ্ণা বললেন, আমি ভাই কখনো গ্রামে থাকিনি, সারা জীবন সিটিতে কাটিয়েছি  বাঁদর কাঠবেড়ালির  উৎপাত কখনো পাইনি   এই প্রথম দেখছি 
 সুজাতার বাপের বাড়ি বর্ধমানের দিকে কোন এক গ্রামে 
দুই মহিলা কী বিষয়ে কথা বলছেন শুনতে সামনের ফ্ল্যাটের দেবযানী দত্ত কৌতূহলী হয়ে দরজা খুলে উঁকি দিলেন । আলোচনার বিষয়টি তাঁর কাছে স্পষ্ট হলে তিনি বললেন, , তাই কাল একটা গন্ধ পেয়েছিলাম । মনে হচ্ছিল যেন ভামের গন্ধ, কিন্তু এখানে ভাম কোত্থেকে আসবে ভেবে গা করিনি । সত্যি তা হলে ভাম এসেছিল ।
অন্য সময় হলে দেবযানী  আলোচনায় অংশ নিতেন না । তাঁর বাপের বাড়ি কোচবিহারে, বাচনে সেদিককার টান ।  কৃষ্ণার কানে তা বড্ড বিজাতীয় ঠেকে । দেবযানী ও একটু দূরত্ব রেখে চলেন । এখন দুই প্রতিবেশী মহিলাই অন্ধকারে হাতড়াচ্ছেন দেখে তিনি তাঁর অনুমানটা বলে ফেললেন ।
ওঁরা দুজনেই কথাটাকে তেমন একটা পাত্তা দেননি । গন্ধ শুঁকে জানোয়ারের পরিচয় বোঝা মহিলার কথা কতটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে সেটাও তাঁদের তাৎক্ষণিক বিচারযোগ্য ছিল । তবে সেই মুহূর্তে অভিজিৎ মজুমদার বাজার সেরে ঘরে ঢুকছিলেন, তিনি কথাটা শুনে ফেললেন । বললেন, হাঁ, ভাম হতে পারে ।
কৃষ্ণা বললেন, ভাম ফল খেয়ে যাচ্ছে বলছ ?
মনে হচ্ছে তাই । 
প্রতিবেশিনীর অনুমান স্বামীর সমর্থন পেয়ে যাওয়ায় কৃষ্ণা খুব একটা প্রীতিবোধ করলেন না ।
অভিজিৎ  চাকরিজীবনে বড় সরকারি অফিসার ছিলেন, তা নিয়ে কৃষ্ণার অহঙ্কারবোধ এখনো আছে  তিনি যখন বলেছেন, তখন জন্তুটা ভাম না হয়ে যায় না  কৃষ্ণা অবশ্য ভাম কখনো দেখেননি, চিড়িয়াখানায় গেলে বাঘ সিংহ ইত্যাদি বড় জন্তুর দিকে নজর যায়, তাদের ছবিও দেখা যায়, ভামের মত এলেবেলে জন্তুর চেহারা কেমন কে আর খবর রাখে ।
সোসাইটি  অফিসে কমপ্লেন করতে হবে গো  বলতে বলতে তিনি অভিজিতের পেছনে পেছনে ঘরে ঢুকে গেলেন । বাকি দুই মহিলাও যে যার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন ।
প্রথম মজুমদারদের ফ্ল্যাটেই ভামটি হানা দিয়েছিল  ওঁরা একতলায় থাকেন । একতলার জানালা দিয়ে পশুপাখি আসতেই পারে  ফ্ল্যাটবাড়িটির সামনেই দুচারটি ফুলের গাছ, তারপর ঘোরানো রাস্তা, রাস্তার অন্যদিকে  আবাসনের  সীমানা ঘেরা দেওয়াল । দেওয়াল ও রাস্তার মাঝের অংশে লাইন ধরে বেশ বড় বড় গাছ, নিম, ছাতিম, দেবদারু, পাম, দুএকটা করে আম,  জাম, বকুল, কৃষ্ণচূড়া  যে কোম্পানি আবাসনটি বানিয়েছিল, তারা বেশ কিছু গাছপালা লাগিয়ে দিয়েছিল । সেগুলো এতদিনে বড় হয়েছে । তাতে দিনের বেলা দুচারটি পাখি এসে বসে,  পশুদের মধ্যে কদাচিৎ একআধটা কাঠবেড়ালি দেখা যায় । দেওয়ালটি  চারফুটমত  উঁচু, তার উপর দুই প্রস্থ কাঁটাতারের ঘেরা   তাই আবাসনের লোকে নিশ্চিন্ত থাকে, রাতে জানালা খোলা রেখে ঘুমোয় । কৃষ্ণা স্টিকার সাঁটা দামি কাশ্মীরি আপেল আনেন, কালো আঙ্গুর, মর্তমান কলা এনে  গ্লাসটপ ডাইনিং টেবিলে সাদা ট্রের উপর সাজিয়ে রাখেন, তিন রকম ফলের উজ্জ্বল রঙ্গে বাহারি টেবিলের আরো বাহার খোলে । প্রতিবেশীরা তাঁর সৌন্দর্যবোধের তারিফ করে, তাঁর খরচা করার শক্তি দেখে ঈর্ষা করে   
এখন মাঝে মাঝেই সকাল বেলা দেখছেন দামী কাশ্মীরি আপেলগুলো আধখাওয়া, আঙ্গুরগুলোর বোঁটা সারা  মেঝেয় ছড়ানো, কলার অবস্থাও তথৈবচ ।
 কৃষ্ণা অভিজিৎকে বললেন, এখন মিসেস ভাদুড়ির মত কৃষ্ণনগরের মাটির আপেল আঙ্গুরই সাজাতে হবে দেখছি ।
অভিজিৎ খবরের কাগজ পড়তে পড়তে বললেন, কেন ? জানালা দুটো রাতে বন্ধ করলেই তো হয় । কৃষ্ণা ভাবলেন, সত্যি তো, তাঁর মাথায় কথাটা আসেই নি । জানালা বন্ধ করে রাখলেই তো সমস্যার সহজে সমাধান হয়ে যায় । বেডরুমে  এসি চালানো থাকে, বাইরের হাওয়ার দরকার হয় না ।
জানালা বন্ধ করার পর থেকে মজুমদারদের বাড়িতে ফল বেঁচে গেছে  কিন্তু প্রতিবেশীদের বাড়িতে ভামের আনাগোনা শুরু হল । আজ একতলায় শুভাশিস দত্তদের ফ্ল্যাট, কাল তেতলায় ধনেশ্বর আগরওয়ালদের  ফ্ল্যাট, পরশু অন্য বিল্ডিং-এর দোতলায় অমিত সাহাদের ফ্ল্যাট, তার পরদিন চারতলায়  অসীম মণ্ডলদের ফ্ল্যাটেও ভাম হানা দিল । কারো বাড়িতে কলা কারো বাড়িতে আপেল খেয়ে খেয়ে বোধ হয় অরুচি ধরেছিল; অথবা যাদের বাড়িতে সে যাচ্ছিল, তারা এক এক করে জানালা বন্ধ করার উপায় অবলম্বন করাতে  কিছু না পেয়ে সে একদিন প্রতুল ঘোষদের ব্যালকনিতে একটা পায়রা ডিম পেড়ে তা দিতে বসেছিল, সেটাকে মেরে  খেয়ে গেল, ব্যালকনিতে পায়রার পালক ছড়িয়ে রইল 
পায়রা মারার পর একটা  আতঙ্কের ভাব এসেছে সবার মনে, জন্তুটা আদৌ অহিংস নয় । যাদের বাড়িতে বাচ্চা আছে, তারা অতিরিক্ত চিন্তিত হয়ে পড়ল । সায়ন্তনী ব্যানার্জি নিজের ক্লাস সিক্সে পড়া মেয়েকে বলে রাখলেন, সে রাত্রে যেন একা একা টয়লেটে না যায় । ভাম আক্রমণ করতে পারে । মেয়ে পৃথা অবশ্য তাকে দেখতেই বেশি আগ্রহী ।  প্রসিতা মণ্ডল তাঁর বিবাহিত মেয়ে সৃজিতাকে জানিয়ে দিয়েছেন, এদিকে ভাম বেরিয়েছে, সে যেন আপাতত বাপের বাড়িতে না আসে, কারণ তার একবছরের ছেলে আছে ।
 অসীম মণ্ডল বলেছেন, তুমি বাড়াবাড়ি করছ, মেয়েটাকে ভয় দেখাচ্ছ । ভাম আবার বাচ্চার কী করবে ? প্রসিতা বলেছেন, না বাবা, আমি রিস্ক নেব না । যে জন্তু পায়রা মারতে পারে, তার  একটা বাচ্চাকে অ্যাটাক করতে সময় লাগবে ?
কিন্তু ব্যাপার হল অভিজিৎ মজুমদারের মত অনুসারে অনেকেই তাকে ভাম বলছে বটে, কিন্তু কেউ তাকে এতাবৎকাল প্রত্যক্ষ করেনি  প্রথম দেখা দিল সে  শিলাদিত্য মুখার্জিকে । প্রেয়সী ও শিলাদিত্য মুখার্জি চারতলায় থাকেন । তাঁরা একরকম নিশ্চিন্তই ছিলেন যে চারতলার ঘরে ফল খেতে কেউ ঢুকতে পারবে না, বিশেষ করে সকলের ধারণা হয়েছে যে জানোয়ারটা আর যা হোক বাঁদর নয় ।
একদিন রাত্রিবেলা শিলাদিত্য টয়লেটে যাবার জন্য উঠেছেন । এটাচড টয়লেট তাঁর জন্য মানা, কারণ রাত্রে ঘুম চটে যাবে বলে  তিনি জল ব্যবহার করতে প্রায়ই ভুলে যান । প্রেয়সী তাই তাঁকে ডাইনিং স্পেসের লাগোয়া কমন টয়লেট ব্যবহার করতে বলেন । শিলাদিত্য সেদিন বেডরুমের দরজা খুলে টয়লেটের দিকে পা বাড়িয়েছেন, দেখেন সামনে দুটো লাল লাল বাল্ব  জ্বলজ্বল করছে  চমকে ঘুম ঘুম ভাব চটে গেল, ‘ওরে বা-বা-বাপরেবলে চেঁচিয়ে উঠলেন । সঙ্গে সঙ্গে দুটো লাল বাল্বের মালিক চারপেয়ে কালোমত  কিছু একটা ডাইনিং রুমের জানলা বেয়ে গ্রিল দিয়ে শরীর গলিয়ে বেরিয়ে গেল । প্রেয়সীর ঘুম ভেঙ্গে গেল, বেরিয়ে এসে বললেন কী হয়েছে ? এমন কি বুবান ও পাশের ঘর থেকে ঘুমচোখে দরজা ফাঁক করে দেখল ।
শিলাদিত্য তখনো কাঁপছেন । আস্তে আস্তে বললেন, ভাম এসেছিল । প্রেয়সী বললেন, বাব্বা, চারতলার উপরেও ভাম এসে গেছে ? তোমাকে কামড়ায় নি তো ?
না, শিলাদিত্য কোনরকমে বলতে পারলেন । ক্লাস সেভেনে পড়া বুবান বলল, ভাম ? সিভেট? ও আবার মানুষকে কামড়ায় নাকি? তোমরা এমন চেঁচাচ্ছ যে বাঘ পড়েছে মনে হচ্ছে। বলে দরজা বন্ধ করে দিল। 
প্রেয়সী আলো জ্বালালেন । টেবিলের উপর দুটো কলা ছিল, তার একটি আধখাওয়া । পুরোটা খেতে পারে নি । আরেকটার খুবলানো খোসা মেঝেয় পড়ে আছে ।
বুবানের কথায় বল পেয়ে প্রেয়সী স্বামীকে বললেন, ভয় পেয়েছ খুব ? জন্তুটা আর যাই হোক, মানুষ খায় না । 
অন্ধকারের মধ্যে ওরকম লাল লাল চোখ দেখলে তুমি নির্ঘাত মুচ্ছো যেতে । শিলাদিত্য এতক্ষণে কথা ও আত্মসম্মান দুইই ফিরে পেয়েছেন ।
তিনি জানালা বন্ধ করতে গেলেন । প্রেয়সী বললেন, আর কী হবে জানালা বন্ধ করে । কলা তো খেয়েই গিয়েছে । এখন কি আর আসবে । ইস, আমি দেখতে পেলাম না ।
একটা বেডালের চাইতে বড় সাইজের জন্তু । অন্ধকারে গায়ের রং বোঝা যাচ্ছিল না । সেটা  আবার দেখবার কী আছে ?
শিলাদিত্য সোসাইটির সেক্রেটারি । কয়েকদিন থেকেই শুনছিলেন কারো কারো ফ্ল্যাটে ভাম ঢুকছে, ফল খেয়ে যাচ্ছে, দু একটা লিখিত অভিযোগও  পেয়েছিলেন  মিটিং ডাকবার সময় হচ্ছিল না । রবিবার ছাড়া সময় থাকেও না, বেশির ভাগ ফ্ল্যাট মালিক এবং কোন কোন মালকিন ও কর্মরত । দুচার জন, অভিজিৎ মজুমদারের মত, রিটায়ার্ড । এখন শিলাদিত্য নিজেই যখন ভামের মুখোমুখি হলেন, পরের রবিবারে মিটিং কল করলেন  
মিটিং-এ সকলেই আসতে পারেননি, তবে ভাম-আক্রান্তরা একশ শতাংশ  উপস্থিত হলেন । শিলাদিত্য শুরু করলেন, মেম্বাররা সকলেই জানেন, কিছুদিন ধরে ভাম এসে ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে ঢুকছে, ফল খেয়ে নোংরা করে যাচ্ছে । সেজন্যই আজ জরুরি ভিত্তিতে মিটিং ডাকা হয়েছে । আপনারা বলুন এ ব্যাপারে কী করা যায়।
ঠোঁটকাটা অমিত সাহা  বললেন, কাল আপনার বাড়িতে ঢুকেছে, তাই এতদিন পরে মিটিং ডেকেছেন । কবে থেকে সমস্যাটা শুরু হয়েছে । আজ ফল খাচ্ছে, কাল পায়রা মেরে যাচ্ছে, পরশু বাচ্চাদের অ্যাটাক করবে । কমপ্লেক্সের ভেতর এত গাছপালা রাখার কোন দরকার নেই  গাছপালা থাকলেই রাজ্যের সাপ খোপ ভাম বাঘ আসবেই ।
মজুমদার বললেন, আরে, সাহাবাবু, বাঘ আবার কোত্থেকে এখানে আসবে ? সাপ বর্ষাকালে কখনো সকনো দেখা যায় ঠিকই, এবারও একদিন বেরিয়েছিল । সিকিওরিটির ইরফান মেরে ফেলেছে ।
ওই সাপটা না মারলেই হত । আমি দেখেছি, ওটা ছিল হেলে । ব্যাঙট্যাং খেতে এসেছিল আর কি  দত্ত বললেন ।
সাপ দেখলেই মারা উচিত  কী করে বুঝবেন বিষ আছে কী নেই  বুঝতে বুঝতেই ছোবল মেরে পালাবে । আগরওয়াল বললেন ।
সব সমস্যার মূল ওই পোড়ো জলা জমিটা  ওটা থাকাতেই সাপ খোপ ভাম সব আসছে । তায় আবাসনের ভেতরেও এত  গাছ । আমার অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে রাত দশটা বেজে যায়, শুতে শুতে বারোটা । সকাল বেলা এত পাখি কিচির মিচির করে যে ঘুমোতে দেয় না । সাহা বললেন । 
গাছ আছে বলেই তো আমাদের আবাসনটা এত সুন্দর, ঠাণ্ডা থাকে । শহরে এমনিতেই গ্রীনারি কমে যাচ্ছে , গ্রীনারি বাড়ান উচিত । আর আপনারা গাছে সমস্যা দেখছেন । সম্বিত ভট্টাচার্য বললেন 
শহরে রাস্তা আর ফ্লাইওভার বানানোর নামে কত গাছ কাটা যাচ্ছে, গাছপ্রীতি থাকলে সেগুলো বন্ধ করুন গে ।  মুখার্জি বললেন । আমাদের এখানে গাছপালা আছে বলে ভোরবেলা বাইরের লোকজনও হাঁটতে এসে যায়  সিকিওরিটি গার্ডের সঙ্গে রোজ ঝামেলা হয় । আমরা মালি রেখে গাছ করব, বাগান করব, আর লোকে সেটা এনজয় করবে এটা মানা যায়না । তার চেয়ে গাছপালা না থাকাই ভাল ।
সম্বিত ভট্টাচার্য বললেন, এ তো নিজের নাক কেটে পরে যাত্রাভঙ্গ হচ্ছে মশাই ।
শিলাদিত্য বললেন, যে ভাবে সকলের সুবিধে হয়, সেভাবেই ডিসিশন নেওয়া হচ্ছে । বাইরের লোকজন ঢুকলে সিকিওরিটি ব্রিচ হবে  পশু পাখি গাছপালার জন্য নিজেদের সেফটি, নিজেদের কম্ফোর্ট ছাড়ার মানে হয় না । করলে সেটাই হয় নাক কাটার সামিল, বুঝলেন ভটচাজবাবু ।
সকলে শিলাদিত্যকে সমর্থন করলেন ।
আবাসনের পেছনে দেওয়ালের অন্যপাশে দু বিঘে মত জমি আছে । আবাসন ছাড়াও এদিকে অনেক বাড়ি উঠেছে এবং উঠছে । জলা বুজিয়ে জঙ্গল কেটে বাস্তুজমি ও রাস্তা তৈরি হয়েছে বেশি বছর হয়নি । এখানে যারা সিকিওরিটি গার্ডের চাকরি করে, তাদের বেশির ভাগই এদিককার স্থানীয় লোক  জলা জমির মাঝে মাঝে যে দুচার ঘর বসতি ছিল, এবং শহর তার থাবা বাড়ানোর ফলে বসতি এখন বস্তিতে পরিণত হয়েছে, তাতেই থাকে  তারা বলে, আগে এখানে বড় বড় জলা আর জঙ্গল ছিল । সমস্ত জলাজমি বিক্রি হয়ে গিয়ে বাড়ি রাস্তাঘাট হয়েছে, পড়ে আছে শুধু ওই দুবিঘে জমি  সেই জমির মধ্যে এখনও খানিকটা জলা বজায় আছে, আশেপাশের আবাসনের জল গড়িয়ে ওখানে জমা হয় । জলার পাশে দুএকটা মাঝারি গাছ, আর কিছু ঝোপঝাড় । মালিকানাতে কিছু গণ্ডগোলের জন্য জমিটা এখনও বিক্রি হয় নি । আশেপাশের লোকেরা দেওয়ালের উপর দিয়ে ছুঁড়ে বাড়ির আবর্জনা  ফেলে আবর্জনা নেবার লোক রোজ সকালে এলেও অনেকেই  আলস্য অথবা ব্যস্ততাবশত দিতে পারেন না, পরে বাড়ির কাজের মেয়েকে ফেলতে বলেন । কাজের মেয়েরা আর কোথায় ফেলবে, তারা ওই পোড়ো জমিতেই ময়লার পুটুলি ছুঁড়ে ফেলে । জলাটি আস্তে আস্তে আরো ছোট হয়ে আসছে । তবুও কিছুটা নিরিবিলি পেয়ে সেখানে কাঠবেড়ালি, বেজির মত দুচারটে পশু, গিরগিটি, আর কয়েকরকম সাধারণ পাখি থাকে । আর থাকে ওই ভাম ।
আগরওয়াল বললেন, ওই জমির ব্যবস্থা এবার হয়ে যাবে আশা করছি ।
সবাই উৎসুক মুখে আগরওয়ালের মুখের দিকে তাকালেন ।
মালিকেরা ওই জমিটা বিক্রির ব্যাপারে একমত হয়েছে । 
আপনি কিনছেন ? 
ভাবছি নিয়ে নেব ।
কী প্ল্যান করছেন জমিটার ব্যাপারে ?
আগে তো জমিটা হাতে আসুক ।আগরওয়াল আর কিছু আপাতত বলতে চাইলেন না ।
আগরওয়াল প্রোমোটার, কাজেই সবাই একদিকে নিশ্চিন্ত হলেন যে জমিটা এবার সভ্য হবে । মহানগরের শহরতলির আধুনিক বাড়িঘরের পাশে এসব জঙ্গুলে জায়গা এক্কেবারে বেমানান ।
মিটিং-এর মূল এজেণ্ডায় ফিরে এলেন সবাই । শিলাদিত্য বললেন, আপাতত ভামের হাত থেকে কী করে নিস্তার পাওয়া যায় ?
সাহা বললেন, ব্যাটা সিকিওরিটিগুলো সারা রাত পড়ে পড়ে ঘুমোয় । একটু জেগে ওটাকে পিটিয়ে মারলে হত । যা জ্বালাচ্ছে ।
 ঘোষ বললেন,  বন্যপ্রাণী মারলে জেল হবে মশাই । তার চেয়ে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টকে খবর দেওয়া হোক । তারা এসে ভাম ধরে নিয়ে যাক । 
 প্রস্তাবে সকলে একমত হলেন ।

সেই  অনুসারে ফরেস্ট আফিসে দরখাস্ত হল, সেখান থেকে লোক এসে আবাসনের এদিকে ওদিকে কয়েকটা খাঁচা বসিয়ে দিয়ে গেল ভাম ধরবার জন্য  খাঁচার মধ্যে দেওয়া হল ফলের টুকরো । দুতিনদিন পর পর ফল পালটে দেওয়া হয়, কিন্তু ভাম সেদিকে মাড়ায়ও না  খোলা জানালা পেলেই যথারীতি ফ্ল্যাটের  ভেতরে ঢুকে গোটা ফল খেয়ে যেতে থাকল । ঘরে মানুষের সাড়া না পেলে সে সন্ধ্যেবেলাও এসে ফল খেয়ে যাচ্ছে ।
মিটিং কল হল আরেকদিন  ভাম তো জ্বালাচ্ছে । জানালা খুলে রাখা যাচ্ছে না । বন্ধ ও করা যাচ্ছে না আজকাল, যা গরম, তায় প্রায়ই লোডশেডিং হচ্ছে  এসি তো আর  ইনভার্টারে চলে না ।
গাছগুলো কেটে দিন । ঝোপঝাড় কমান । বোর্ড মিটিং-এ ডিসিশন ফাইনাল হল । গণতান্ত্রিক নিয়মের মিটিং, মিটিং-এ মেজরিটির মতই গ্রহণযোগ্য । সম্বিত ভট্টাচার্য, শুভাশিস দত্ত এরকম দু-একজনের বিরুদ্ধ মত থাকলেও ধোপে টিকল না ।  আবাসনের যত বকুল, অশোক, আম জাম রঙ্গন টগর ইত্যাদি বেশি পাতাওলা গাছ, ঝোপঝাড় কেটে দেওয়া হল । বড় গাছের ডাল কেটে মুড়িয়ে দেওয়া হল, ছোট গাছ মূলসুদ্ধ উজাড় । সাপের জন্য কার্বলিক অ্যাসিড ছড়ানো হয়েছিল, তাতে অনেক গাছ  মূল থেকেই মরে গেছে, আবাসন পরিষ্কার হয়ে গেছে  বাসিন্দাদের অনেকেই খুব খুশি । গাছ থাকাতে কিছুটা আলো আটকাচ্ছিল, এবারে রাতের বেলাও দিনের মত আলো  শুধু বেশি গরমের দিনে গাছের তলায়  আবাসনের ছোট ছেলেমেয়েরা ছুটির বিকেলে লুকোচুরি করত, শিশুরা টলমল পায়ে নিচের ঘাসে হাটত, ফুল প্রজাপতি  পাখির দিকে তাকাত, সঙ্গে মায়েরা থাকত, গল্পগুজব করত, সেটুকু হচ্ছে না । তাতে অসুবিধে নেই খুব একটা । শিশুরা  ট্রাইসাইকেল, অল্প বড় ছেলেমেয়েরা  বাইসাইকেল চালাচ্ছে, ক্রিকেট খেলছে, কোচিং যাওয়া তো আছেই  গাছ কাটায়  আরেকটা লাভ হয়েছে । কারো কারো দুটো তিনটে গাড়ি ছিল, কিন্তু আবাসনে গ্যারেজ স্পেস ফ্ল্যাটপিছু একটাই ।  খুব অল্পসংখ্যক যাদের গাড়ি নেই, তাদের গ্যারেজ ভাড়া নিয়ে বাড়তি গাড়ি রাখা হত, নইলে আবাসনের ভেতরে রাস্তার উপরই । রাস্তার উপর রাখা গাড়িগুলোর উপর গাছের ডালে বসা পাখিরা বিষ্ঠাত্যাগ করে নোংরা করত । এবারে গাছ কেটে ফেলায় সেই জায়গায় গাড়িগুলো রাখা যাচ্ছে নিশ্চিন্তে  যাদের একটার বেশি গাড়ি ছিল না, তারা আরেকটা গাড়ি কেনার প্ল্যান করছেন । নইলে সব জায়গা বেহাত হয়ে যাবে ।
ভোরবেলা পাখির কলকলানি কিছু কমেছে, সাহা এখন সকাল বেলাও ঘুমোতে পারেন  কিন্তু ভামটা এখনো হানা দেয় । এখন  বর্ষা চলছে । আগরওয়াল জলাতে মাটি ভরানো শুরু করেছেন, কিছু ঝোপঝাড় কাটিয়েছেন, কিন্তু বর্ষার জন্য ভাল করে কাজ করা যাচ্ছেনা । পুজোর পর  জমিটায় পুরোদমে হাত দেবেন ।
এবছর পুজোয় বড্ড বৃষ্টি, বর্ষায় ও অত হয়নি । আবাসনের ভেতরে  জল জমে গেছে । জল আগে গড়িয়ে যেত জলাটার দিকে, এখন সেটাতে জল ধারণের জায়গা নেই । জমা জলের জন্য আনন্দ উৎসব মাটি । প্রসিতা মন্ডল ভেবে পান না, শহরে এত বৃষ্টি কেন হয় । শহরে তো চাষবাস হয় না, হয় গ্রামে  বৃষ্টি সেখানে হলেই পারে  এই ব্যাপারে প্রেয়সী মুখার্জি ও একমত । শহরে বৃষ্টি হয়ে কী হবে । যেখানে দরকার সেখানে হলেই হয় ।
দেবযানী দত্ত বলে ফেললেন, বৃষ্টি আবার ওরকম  জায়গা বেছে বেছে হয় নাকি ?  জলভরা হাওয়ার গতিপথে যেসব  জায়গা, সেসব স্থানে বৃষ্টি হবে, দরকার থাক না থাক ।
প্রসিতা ও প্রেয়সী দেবযানীর দিকে তিরস্কারভরা দৃষ্টিতে তাকালেন । বৃষ্টির জন্য এত ঝামেলা হচ্ছে, জল জমে যাচ্ছে, বাড়ি থেকে বেরোনো যাচ্ছে না, আর উনি বৃষ্টিকে সাপোর্ট করছেন ! গেঁয়ো যত্তসব । 
কালীপুজোর পর শুকনো দিন শুরু হল  আগরওয়াল বড় বড় ট্রাকে মাটি ফ্লাইঅ্যাশ এনে ফেলে জলাটাকে আগে ভাল করে বোজালেন   ঝোপঝাড় সব কেটে অল্পদিনের মধ্যেই লেবার ক্যাম্প বসালেন । বিদ্যুতের টেম্পোরারি কানেকশন নিয়ে  দিন রাত কাজ চলতে থাকল  আরেকটা আবাসন হবে, আরেকটা  মানুষের বসতি ও সম্পত্তি বিস্তারের প্রস্তুতি ।
এই আবাসনের অনেক অধিবাসীই ওখানে নতুন আরো একটা ফ্ল্যাট  বুক করে ফেলেছেন  কারো মেয়ের নামে, কারো ছেলের ভবিষ্যৎ সংসার বসানোর জন্য, কেউ বা দাম বাড়লে বিক্রি করে দেবেন । ওখানে ফ্ল্যাটগুলো বড় বড়, কাজেই কেউ কেউ এখানকার ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে বড় ফ্ল্যাটে শিফট করবেন বলেও ভাবছেন । আবাসনটা বেশ উঁচু করে নির্মাণ করা হচ্ছে, এখানকার মত জল জমবে না ।
 ভামটা আর আসে না, হতচ্ছাড়া এতদিনে বিদায় নিয়েছে           
---------------------------

 (গল্পটি গত   ৮/৮/১৭ তারিখে 'যাপনকথা।গল্পের উত্তর-পূর্ব' ফেসবুক গ্রুপেও পোষ্ট হয়েছে। শিবানী ভট্টাচার্য দে)


কোন মন্তব্য নেই: