“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ৫ আগস্ট, ২০১৭

জীবনের দাম : শিলচরের লালবাতি এলাকায় পাচারকৃত শিশুরা




(C) The Caravan

                                       




মূল ইংরাজি : সরিতা সন্তোষিণী
বাংলা অনুবাদক :    শিবানী ভট্টাচার্য দে
[ সরিতা সন্তোষিণী অসমের একজন স্বাধীন সাংবাদিক। তিনি মানবাধিকার, উন্নয়ন ও লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে লেখালেখি করেন। তাঁর এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় ‘দ্য কারাভান’ নামেরইংরেজি আন্তর্জাল ওয়েবজিনে গেল ১লা জুলাই, ২০১৭তে। আসাম তথা পূর্বোত্তরের বৃহত্তর বাঙালি পাঠকের কাছে নারী নিপীড়িনের এই করুণ কাহিনি পৌঁছে দিতে আমরা এর বাংলা অনুবাদ করে দিলাম--- শিবানী ভট্টাচার্য দে]


২০১১ সালের দিকে অ্যাগ্‌নেস খারসাইং খবর পেলেন যে একটি মেয়ে অসমের শিলচর শহরের লালবাতি এলাকা রাধামাধব রোড থেকে পালিয়ে শিলঙয়ে তার বাড়িতে ফিরে গিয়েছে । খারসাইং, যিনি প্রায় ছবছর ধরে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করছিলেন, ভাবলেন, মেয়েটিকে খুঁজে বের করবেন । তিনি তাকে পেলেন শিলং-যের এক বস্তিতে, ফিরে আসা মেয়েটি তার এক বোনের সঙ্গে সেখানে থাকছিল । মেয়েটি খারসাইংকে তার তিনবছর শিলচর বাসের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিল---- তার উপর কী যৌনশোষণ চলছিল, কী ভাবে খদ্দের, বেশ্যালয়ের মালিক, ও পুলিশ সকলেই তার উপর দৈহিক ও মানসিক অত্যাচার চালিয়েছে । সে খারসাইংকে আরোও বলেছিল যে রাধামাধব রোডে শিশু ও নাবালিকা মেয়েদের পাচার একেবারে সাধারণ ঘটনা 
শীঘ্রই, খারসাইং ভাবলেন, রাধামাধব রোডে উদ্ধারকাজ চালানোর একটা প্রচেষ্টা শুরু করা দরকার । তিনি মেয়েটিকে জিগ্যেস করলেন সে তাঁর সঙ্গী হতে রাজি কি না । সে রাজি হল । সাধারণ মতে, এই লালবাতি অঞ্চলটি উত্তরপূর্বের বৃহত্তম---শিলচর শহরের মাঝখানে, মূল বাজারের ভেতরে একটি নিরিবিলি সরু গলির ভেতরে । গলির দুধারের বাড়ি এবং ঝুপড়ি, এবং সংযুক্ত ছোট ছোট কানাগলিতে আরো কয়েকটা ছোট ছোট বাড়িতেও দেহব্যবসায় চলে। সব মিলিয়ে ৭০টি এধরণের জায়গা, যেখানে কুড়িজন পর্যন্ত মেয়ে থাকতে পারে । প্রত্যেকটি বাড়িতে একজন করে মালকিনবা ম্যাডামবলে সম্বোধিত কর্ত্রী, যে পাচারকারীদের থেকে মেয়ে যোগাড় করে পুলিশকে ঘুষ দিয়ে । গাট্টাগোট্টা কিছু মহিলা বাড়িগুলো পাহারা দেয় বাড়ির বাইরে মেয়েরা খদ্দেরের অপেক্ষায় টুলে বসে থাকে ।
খারসাইং অসমের তৎকালীন পুলিশের অতিরিক্ত মহানির্দেশক অনিলকুমার ঝা-কে ফোনে যোগাযোগ করে উদ্ধারকাজে সাহায্য করতে আবেদন করলেন । ঝা প্রথমটা গররাজি ছিলেন, বললেন, “আপনি কেন ওখানে যেতে চান? ওটা তো বিপজ্জনক জায়গা । খারসাইং গত অগাস্টে আমাকে ফোনে বলেছিলেন, ঝা তাঁকে ভয় দেখালেন, বললেন, “ওরা আপনাকে বড় অসমীয়া দা নিয়ে আক্রমণ করবে ।কিন্তু খারসাইং-এর জেদি  অনুরোধে শেষপর্যন্ত সাহায্য করতে রাজি হলেন । (আমি যখন গত ডিসেম্বরে ঝা-কে ফোন করেছিলাম, তিনি উদ্ধারকাজে সাহায্যের কথাই বলেছিলেন, প্রথমটায় রাজি না হবার কথা উল্লেখ করেননি ।)
২০ জানুয়ারি, ১০১২। প্রায় মাস ধরে পরিকল্পনা করে খারসাইং শিলচর থেকে পালিয়ে আসা মেয়েটি ও জনাদশেক অসম ও মেঘালয় পুলিশকর্মীর সঙ্গে রাধামাধব রোড গেলেন । প্রায় দুঘণ্টার তল্লাসিতে তাঁরা তিন চারটে পতিতালয় খুঁজে দেখলেন, সেই বাড়িটাও যেখানে ফিরে আসা মেয়েটা থাকত। মেয়েটা সেই বিশেষ ঘরটাও দেখাল যেখানে সে থাকত খারসাইং-এর মনে পড়ে, ঘরটা ছিল অন্ধকার, দেওয়ালে একটা যিশুখৃষ্টের ছবিও ছিল । বেশির ভাগ গলিই ছিল অন্ধকার ও নির্জন, যেহেতু কাউকে দেখা যাচ্ছিল না, তল্লাসি ছিল দীর্ঘ । একটি মেয়ে, যে শিশু অবস্থায় শিলং থেকে পাচার হয়ে এসেছিল, এবং খারসাইং-কে চিনত, পালিয়ে যাওয়া মেয়েটির গলার স্বর শুনে একটা ঘর থেকে বেরিয়ে উদ্ধারকারীদের কাছে এল । যে পতিতালয় থেকে আগের মেয়েটি পালিয়েছিল, সেই বাড়িতেই এই মেয়েটি কয়েক বছর ধরে আছে । সে উদ্ধারকারীদের বলল যে পতিতালয়ের মালিক তল্লাসি শুরু হবার আগেই মেয়েদের লুকিয়ে পড়তে বলেছিল, কিন্তু সে নির্দেশ অমান্য করে ঘরেই রয়ে গেছে ।
খারসাইং এখন বিশ্বাস করেন যে স্থানীয় পুলিশ আগে থেকেই বেশ্যালয়ের মালিককে সতর্ক করে দিয়েছিল যেন অল্পসয়সী মেয়েদের লুকিয়ে ফেলা হয় ।তা সত্ত্বেও উদ্ধারকারী দলটি একটি নবছরের শিশুসহ চারটে মেয়েকে পায় । বাচ্চা মেয়েটিকে রেখে তার মা পালিয়ে গিয়েছিল ।
গত দশকে অসম শিশুপাচারের বড় কেন্দ্র হয়ে দাঁডিয়েছে । জাতীয় অপরাধ পঞ্জীকরণ ব্যুরর ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, অসমে ১৩১৭টি শিশুপাচারের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে---- যা দেশের যে কোনো রাজ্যের চেয়ে বেশি, সারা দেশের ৩৮% । ২০১৫ এর নভেম্বর মাসে অসম সি আই ডি এই বিষয়ে যে রিপোর্ট দিয়েছিল, তাতে দেখা যায় ২০১২ সালের পর থেকে অন্তত: ৪৭৫৪ জন শিশু হারিয়ে গিয়েছে । রিপোর্ট বলছে, তার মধ্যে ২৭৫৩ জনই ছিল মেয়ে । একই রিপোর্টে দেখা যায়, শুধুমাত্র ২০১৪ সালেই ১২৯ জন মেয়েকে পাচারকারীরা জোর করে দেহব্যবসায়ে নামিয়েছে ।
শিশু অধিকার আন্দোলন কর্মী মিগুয়েল কুইয়া আমাকে বলেছিলেন, অসম, বিশেষ করে গুয়াহাটি শুধু উত্তরপূর্বেরই নয়, অন্যান্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রেরও, বিশেষ করে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সংযোগের মধ্যবিন্দু। পপুলেশন কাঊন্সিলনামে একটি বেসরকারি সংস্থা ২০১৪ সালে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল যাতে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া নাবালিকা মেয়েদের বাণিজ্যিক যৌনশোষণের জন্য উত্তরপূর্বের যে চারটি রাজ্য অগ্রণী, অসম তাদের অন্যতম ।
জাতিবৈরিতা এবং বাৎসরিক বন্যায় অসমের লক্ষলক্ষ লোক প্রতিবছরই বাস্তুচ্যুত হয়, সেইসঙ্গে রাজ্যের অর্থনৈতিক অনুন্নয়ন এবং দারিদ্র্যের দীর্ঘ ইতিহাসের জন্য এখানকার জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পাচারকারীদের শিকার হয় । পাচারকারীরা শিশুদের মা-বাবাকে বাচ্চাদের জন্য ভাল মাইনের চাকরি জোগাড় করে দেবার টোপ দিয়ে তাদের হাতে তুলে দিতে বলে ২০১০ থেকে ২০১২এর মধ্যে যৌন পাচারের জন্য শুধু অসমেই ৫০১ জন গ্রেফতার হয়েছিল, কিন্তু তার মাত্র ১% এরই সাজা হয়েছিল ।
রাজ্যের সর্বদক্ষিণ জেলায় অবস্থিত শিলচর পাচারব্যবসায়ের এক মুখ্য গন্তব্যে পরিণত হয়েছে । মুখ্যত: সিলেটিভাষী, ১৩৬০০০ জনসংখ্যা নিয়ে শিলচর হল রাজধানী গুয়াহাটির পরই অসমের সব চাইতে বড় শহরাঞ্চল, কিন্তু অনেকেরই বিশ্বাস, মহানগর হবার যোগ্যতামানে পৌঁছানোর জন্য এখানে এখনো বিশেষ উন্নয়ন হয়নিসরু রাস্তার পাশে ঢাকনাহীন চওড়া নালা, বাড়তে থাকা জনসংখ্যা ও বাড়ির চাপ এবং যানবাহনের স্রোতে নাজেহাল এক শহর । অসমের বাকি অঞ্চলের সঙ্গে হালে যোগাযোগ ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে । কবছর আগে ব্রডগেজ রেল হয়েছে, শিলচরের বিমানবন্দরে প্লেনের আনাগোনা বেড়েছে, তার মানে লোকে বিমানভাড়া যোগাড় করতে পারে । চারপাশের জাতীয় সড়ক ও মেরামত এবং সম্প্রসারণ হচ্ছে। বাংলাদেশের সীমানা বড়জোর সড়কপথে তিন চার ঘণ্টা, সেজন্য বহুসংখ্যক অভিবাসীর আগমন চলেই আসছে । উত্তর পূর্বের অন্যান্য রাজ্য, মণিপুর, মিজোরাম, মেঘালয়, ত্রিপুরায় ও এখান থেকে সহজেই যাতায়াত করা যায় ।
শিলচরের লালবাতি এলাকায় নারী ও শিশুপাচারের নির্দিষ্ট কোন সংখ্যা বা তথ্য নেই, এই নিরন্তর চলা ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে শহরের কর্মকর্তা সকলেই কমবেশি ওয়াকিবহাল । স্থানীয় এবং আঞ্চলিক সংবাদপত্র পাচারের আড়ত বলে উল্লিখিত লালবাতি এলাকাটি থেকে নাবালিকা উদ্ধারের খবর প্রায়ই ছাপে । যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা নাগরিক সমাজ সংস্থা স্বীকার করে যে খদ্দের বা বেশ্যালয়ের মালিকের পরিচিত না হলে অন্যদের এখানে প্রবেশ করা ঝুঁকিপূর্ণ ।
২০১২ সালে তৈরি অসম রাজ্য শিশু-অধিকার রক্ষা কমিশন-এর রিপোর্ট অনুসারে লালবাতি এলাকায় অন্তত: ১০০ জন শিশু আছে । রিপোর্টে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, জায়গাটা ঝুঁকিপূর্ণ বলা হলেও কমিশন ওখানে যাবার ব্যাপারটা পুনর্বিবেচনা করার কথা ভাবছে। অনেক উদ্ধারকৃত মেয়েদের কথা অনুযায়ী, শিলচরে যে মেয়েরা পাচার হয়ে আসে, তাদের অনেক সময়েই কিছুদিনের জন্য অন্য রাজ্যের লালবাতি এলাকায় রাখা হয়। ব্যাপারটা প্রমাণ করে যে গণিকাপল্লীগুলোর মধ্যে আন্তঃরাজ্যিক যোগাযোগ আছে। রাধামাধব রোড থেকে পুলিশ ফাঁড়ির দূরত্ব মাত্র ১০০মিটারের মত, কিন্তু স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে বেশ্যালয়ের মালিকেরা সাঁটগাঁট করে কাজ করে বলে অনেক অভিযোগ আছে ।
২০১৬সালের অগাস্ট মাস থেকে আমি লালবাতি এলাকা থেকে উদ্ধার পাওয়া দুই নাবালিকা, বেশ কয়েকজন মানবাধিকার কর্মী, সমাজসেবী, এবং উত্তরপূর্বের কয়েকজন উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলেছি । এই সময়কার একাধিক উদ্ধারের কেস অনুধাবন করে বেশ বুঝতে পারলাম শিলচরে বাণিজ্যিক যৌন শোষণের জন্য  শিশুপাচারের ঘটনা প্রায়ই ঘটলেও সরকার তা বন্ধ করতে এবং যারা ওখান থেকে হয় পালিয়েছে নয়তো উদ্ধার হয়েছে, তাদের পুনর্বাসন দিতে একেবারেই ব্যর্থএই ব্যাপারে আইন প্রয়োগকারী বিভাগ(অর্থাৎ পুলিশ), যারা তল্লাসিতে দেরি করে এবং পাচারকারীদের মদত দেয়, তারাই শুধু নয়, বিচার বিভাগ সহ আর সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগের বিরুদ্ধে ও সমান ভাবে অভিযোগ ওঠে ।
গতবছরের অগাস্টের কোনো এক সপ্তাহান্তে আমি, শিলচর থেকে পালানো সেই মেয়েটির সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলাম । মেয়েটির বয়স এখন ২২ বছর। আমি যখন তাকে তার জীবনের কথা জিগ্যেস করলাম, সে বলল, “কোত্থেকে শুরু করব? কতকিছুই বলার আছে। সেসব ভাবলেও কান্না পায়।
খুব অল্প বয়সে তার মায়ের ক্যান্সারে মৃত্যু হয়েছিল, আর তার জনমজুর বাবার পেটের কোনো রোগেতিন ভাই ও দু বোনকে নিয়ে সে শিলঙে একটা ভাড়াবাড়িতে থাকত। ভাইবোনদের মধ্যে সে ছিল তৃতীয়, বড় ভাই ছিল সংসারে একমাত্র রোজগেরে। মেয়েটি বলেছিল, “আমরা খুবই গরিব ছিলাম, তাই স্কুলে যাওয়া কখনো হয়নি ।
দশ বছর হবার আগেই তাকে মুম্বাই পাচার করা হয়েছিল। থানে জেলার ডোংরি এলাকায় একটা আশ্রমে সে একবছর কাটায়। হয়তো খুব ছোট থাকায় তখন কেউ তার কোনো ক্ষতি করেনি। শিলং পুলিশ তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে ।
এরপর তেরো বৎসর বয়সে শিলঙেই ড্রাইভারের কাজ করা একজন লোকের সঙ্গে তার পরিচয় হয় । সে তাকে জিগ্যেস করে, মেঘালয়েরই অন্য কোনো এক শহরে বিস্কুটের দোকানে কাজ করতে রাজি কিনারাজি হলে সে টাকা পাবে এবং প্রতিমাসে বাড়িতে পাঠাতে পারবে । সে রাজি হল। লোকটি আমাকে যেদিন নিয়ে যাবে, সেদিনই পাঁচশ টাকা দিল, এবং আমার মনে আছে আমি সেই টাকা আমার ভাইবোনদের দিয়েছিলাম, বলেছিলাম যে আমি কাজ করতে যাচ্ছি,” মেয়েটি আমাকে বলেছিল। রাধামাধব রোডে পৌঁছানোর পরই সে বুঝতে পারল যে সে লালবাতি এলাকায় বিক্রি হয়ে গেছে ।যখন গণিকালয়ের কর্ত্রী তাকে খদ্দেরের সঙ্গে শুতে বলল, সে রাজি হয়নিমেয়েটির জবানীতে, “মালকিন আমাকে মারতে শুরু করল, বলল সে আমাকে টাকা দিয়ে কিনেছেআমি বললাম, “ঠিক আছে”, কারণ এখন আমাকে কোনোভাবে মানিয়ে নিয়ে থাকতে হবে। আমি প্রত্যেকটা দিন আমার ভাইবোনের কথা ভেবে কাঁদতাম।
লালবাতি এলাকায় তার থাকার দিনগুলোর কথা মনে করে মেয়েটি বলেছিল যে তাকে প্রতিদিন দশ থেকে কুড়ি জন পর্যন্ত খদ্দের তাকে নিতে হত।কোন কোনও সময় দুজন একসঙ্গে---- মালকিন যা বলত, তাই আমাদের শুনতে হত।মালকিন মাঝেমাঝে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দিত। সে কখনো আমাকে এক টাকাও দিত না । কখনোসখনো আমি খদ্দেরকে আমাকেই টাকা দিতে বলতাম । কিন্তু মালকিন ধরে ফেলত, মেরে ধরে টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যেত কোনো কোনো সময়ে যখন ওখানে খানাতল্লাসি হবার আগাম খবর আসত, মেয়েদের বাক্সে লুকিয়ে রাখা হত অথবা যেতে হত কাছেপিঠের হাসপাতালে, তল্লাসি শেষ না হওয়া অবধি সেখানে অপেক্ষা করতে হত । মেয়েটি একবার গর্ভবতীও হয়েছিল, কিন্তু মালকিন তাকে জোর করে গর্ভপাত করায় সে বলেছিল, “আমি যখন আট মাসের গর্ভবতী, তখন তারা আমার বাচ্চাটাকে মেরে ফেলল। ডাক্তার আমাকে কিছু ওষুধ দিল, আর কাজ হয়ে গেল। তাদের কোনো সহানুভূতি নেই, তারা চায় তুমি শুধু কাজটা কর ।
মেয়েটি আমাকে বলেছিল যে কিছু মেয়ের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যে এই ধরণের কাজ ভালো । কিন্তু সে কখনো একথা মানে নি। কোনো খদ্দের যদি আমাকে বাছত, আমি মুখ ফিরিয়ে তাকে গোল্লায় যেতে বলতাম। কিন্তু শেষপর্যন্ত আমাকে যেতেই হত, নাহলে মালকিন মারধোর করত ।” 
তিনবছর আগেই সে পালানোর চেষ্টা করেছিল। তার ছোট জীবনের এই অংশের কথায় এসে তার গলায় একটু ইতিবাচক স্বর। এক রাত্রে মালকিন তাকে খুব মেরেছিল। আমি তাকে বললাম, যত ইচ্ছে আমাকে মারো, আমি যদি আজ থাকি, তাহলে নিশ্চিত করব যে কোনো অল্পবয়সী মেয়ে যেন এখানে না থাকে ।গুয়াহাটি থেকে বছর পাঁচেক আগে পাচার আসা একটি নাবালিকা মেয়ের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়েছিল। দুজনে পালাবার সঙ্কল্প করল ।
মেয়েটি বলছিল, পরদিন সকালবেলা বৃষ্টি পড়ছিল; ম্যাডামের মেয়ে, যে তাদের উপর নজর রাখছিল, তাকে তারা ব্রেকফাস্টের জন্য পুরি আনতে বলল। সে বেরিয়ে যেতেই আমরা দুই বন্ধু দৌড় লাগালাম। কিছু লোক আমাদের পেছন পেছন দৌড়াচ্ছিল, কিন্তু আমরা পালিয়ে যেতে পারলাম”, মেয়েটি তার গল্প বলে যেতে থাকল। তারা প্রথমে একটা অটো, তারপর একটা বাসে উঠল, বাসে কিছু স্থানীয় লোক বলছিল তারা লালবাতি এলাকা থেকে পালানো মেয়ে, কিন্তু তারা শক্ত হয়ে বসে রইল ।  ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে একটা খবরের কাগজের দোকানদারকে তারা অনুরোধ করল একটু সাহায্য করার জন্য।আমাদের তখন প্রচণ্ড খিদেতেষ্টা পেয়েছে, পালাবার সময় আমরা গায়ের দোপাট্টা, পায়ের চটি কিছুই আনতে পারিনি।দোকানদার তাদের ঘণ্টাদুয়েকের জন্য তার দোকানে লুকিয়ে রাখল কারণ মালকিনের ছেলে ও লালবাতি এলাকার অন্যান্য মহিলারা ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে তাদের খোঁজাখুজি করছিল সে তাদের খাবার, কিছু টাকা ও একটা মোবাইল ফোন দিয়ে শিলং যাবার শেয়ারের জিপে টিকিটও কেটে দিল । জিপের যাত্রী কয়েকজন সেনাকর্মী তাদের রক্ষা করার ভরসা দিল, রাস্তায় তাদের খাবারের দামও দিল ।
মেয়েদুজন শিলং পৌছাল রাত একটায়। আগের মেয়েটি আমাকে বলছিল, সে তার পুরোনো বাড়ি খুঁজেই পাচ্ছিল না, রাতটা দুজনে একটা নাশপাতি গাছের নিচে কাটাল পরের কয়েক সপ্তাহ ধরে সে তার শহরের নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তার ভাইবোনদের খোঁজ পেল । একটা ঘর ভাড়া নিয়ে মেয়েদুটো সেখানে কিছুদিন থেকেছিল। মাসতিনেক পর অন্য মেয়েটিকে তার বাড়ি গুয়াহাটিতে ফিরে যেতে বলেছিল ।
যদিও নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য এবং তথ্যের ভিত্তিতে এটা প্রমাণিত যে শিলচরে নারীপাচার অত্যন্ত বেশি হারে বাড়ছে, সরকার এবং তার আইনপ্রয়োগকারী বিভাগ, (যাদের মধ্যে পুলিশবিভাগ আছে, এবং তার অনেক কর্মীই এই অপরাধের সহায়ক) সমস্যাটি স্বীকার করেনা ।আমি বেশ কজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে দেখা করেছি যারা  সব জেনেশুনেও পাচারের প্রতিরোধকল্পে কোনো ব্যবস্থাই নেন নি শিলচর শহর যে জেলার সদর, সেই কাছাড় জেলার পুলিশসুপার রাকেশ রৌশন তাঁর অফিসে বসে আমাকে গত মার্চমাসে বলেছিলেন, “শুধু লোকের ধারণার উপর নির্ভর করে আমরা কোনো কাজ করতে পারিনাআমাদের তথ্য চাই, স্পষ্ট করে কমপ্লেন করা চাই । অভিযোগ বা নির্দিষ্ট খবর এলে আমরা ব্যবস্থা নিই ।
আমি তাকে বললাম যে অনেক শিশু যারা লালবাতি এলাকা থেকে পালিয়ে গেছে, অথবা উদ্ধার হয়েছে তারাই নজরদারি না থাকা শিশুপাচারের সাক্ষ্য দিচ্ছে, এবং আরো অনেক বাচ্চা ওখানে থাকতে পারে। রৌশন আমাকে বললেন, “এসব যে খুব বেশি মাত্রায় হচ্ছে তেমন কোনো খবর আমাদের কাছে নেই। পাচারকে আমরা খুব বড় ইস্যু বলে মনে করিনা ।রৌশন অল্পদিন হল শিলচরে নিযুক্ত হয়েছেন, বললেন যে পুরোনো সমস্ত কেস-এর আপডেট তাঁর কাছে নেই, তবে তিনি সেগুলো খতিয়ে দেখতে উৎসুক।
আমি তারপর ডেপুটি পুলিশ সুপার সুধাংশু দাসের সঙ্গে দেখা করলাম। আমাদের কথাবার্তার মধ্যেমধ্যে বারবার তিনি অন্য একজন পুলিশ অফিসার স্বপন দে এবং একজন সাংবাদিকের সঙ্গে ফোনে কিছু আলোচনা করছিলেন । যখন আমি কথা বলার সুযোগ পেলাম, তাঁকে আমাদের টেলিফোনে কথাবার্তার বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে বললাম যে আমি শিলচরে শিশুপাচারের বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে চাইছি । দাস জেদ করে লালবাতি এলাকার ভেতরে গিয়ে শিশুপাচার ও তাতে পুলিশের সহযোগের বিষয়ে আমার মিথ্যা ধারণা দূর করতে বললেন। বেশিরভাগ লোকই আমাকে নিজে থেকে লালবাতি এলাকার ভেতরে যেতে নিষেধ করেছিল, কিন্তু দাসের সঙ্গে কথা বলার কয়েক ঘণ্টা পর ভাবলাম জায়গাটা বাইরে থেকে অন্তত একবার দেখব ।প্রবেশপথ বাঁশের বেড়া দিয়ে আটকানো । কাছেই কয়েকটা ছোট ছোট পানের দোকান, এবং ধাবা যেখানে দেশি মদ বিক্রি হয় । একজন স্থানীয় লোক যে আমার সঙ্গে ছিল, পুরো রাস্তা ধরে অস্বস্তি বোধ করছিল। সে বলল যে স্থানীয় লোক সবাই জানে পাচারকারীদের সঙ্গে পুলিশ জড়িত থাকে, তাই কারো কিছু করবার উপায় নেই, লোকে নিজেদের জীবন নিয়ে চুপচাপ থাকে ।
দাস তাঁর অফিসে বসে আমাকে বলেছিলেন, “আমরা যদি বেশ্যাবৃত্তি বন্ধও করি, তাহলে তা সব জায়গাতে ছড়িয়ে পড়বে । ইতিমধ্যেই এটা শিলচর শহরের চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে । বেশ্যাবৃত্তি অত্যন্ত পুরোনো পেশা।আমি তাকে লালবাতি এলাকায় শিশুদের উপস্থিতির কথা জিগ্যেস করলাম, এবং বললাম কোনো পুলিশ অফিসার ওখানে কি হয় সেব্যাপারে কিছু জানেন কিনা । দাস বাধা দিয়ে বললেন তাঁরা লালবাতি এলাকায় বাচ্চাদের খুঁজতে যান না---ভাবখানা যে তিনি মনে করেন শিশুপাচার কোনো সমস্যাই নয়। পুলিশ ওখানে এমনি এমনি যায়না । যখন কোনো ছোটখাটো অপরাধ, যেমন চুরি ইত্যাদি হয়, পুলিশ তখনি শুধু অপরাধীকে ধরতে সেখানে যায় ।
            বেশ্যালয়গুলোতে শিশুদের উপস্থিতি সম্পর্কে দাসের আরো একটা থিওরি ছিল। তিনি বললেন, “আমি যখন জন্মেছি, তখনও এই লালবাতি এলাকা ছিল । আমরা তাদের ঝামেলা করিনা, কারণ তারা ওখানকার যৌনকর্মীদের এবং বেশ্যালয়ের মালিকদের সন্তান। ওদেরও তো বাচ্চা হয় ।আমি আবার তাকে বললাম যে ওখান থেকে যেসব শিশুকে উদ্ধার করা হয়েছে, তারা সকলেই পাচারের শিকার, এবং কিছু নির্দিষ্ট কেসের ব্যাপারে জিগ্যেস করলাম, কিন্তু আমি যতক্ষণ না লালবাতি এলাকা দেখতে গিয়েছি, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি উত্তর দিতে অস্বীকার করলেন। সাক্ষাৎকারের পর শিলচর-ভিত্তিক এন জি ও বরাকভ্যালি ওয়েলফেয়ার ডেভেলপমেণ্ট সোসাইটি-র প্রকাশিত একটি গবেষণা গ্রন্থে পুনঃপ্রকাশিত একটি পুরোনো খবরের কাগজের প্রবন্ধ থেকে জানতে পারলাম যে, উধারবন্দ থানার এখনকার ওসি স্বপন দে ছিলেন ১৯৯৯ সালে সাসপেন্ড হওয়া চারজন অফিসারের অন্যতম, কারণ, রেড্‌লাইট এরিয়া থেকে পালিয়ে যাওয়া একটি মেয়েকে ধরে পুলিশ আবার তাকে তার পাচারকারী সেই বেশ্যালয়ের মালিকের কাছেই ফিরিয়ে দিয়েছিল।
এরপর আমি গেলাম উজ্জ্বলার শিলচর অফিসে---উজ্জ্বলাহল কেন্দ্রীয় সরকারের নারীপাচার ও বাণিজ্যিক যৌনশোষণ প্রতিরোধকল্পে গঠিত একটি সংস্থা। ওখানকার কর্মীরা আমাকে বলল যে ২০১২তে সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা হবার পর লালবাতি এলাকাটি থেকে ২৮জন মেয়ে উদ্ধার হয়েছে। তার মধ্যে অনৈতিক পাচার প্রতিরোধ আইন(Immoral Traffic Prevention Act)অনুসারে কুড়িটি কেস পঞ্জীকৃত হয়েছে, কিন্তু তার মাত্র দুটো কেসে সাজা দেওয়া হয়েছে । উদ্ধারকৃত মেয়েরা এবং তাদের পরিবার ভয় পায় দুটো ব্যাপারকে--- একদিকে দীর্ঘ জটিল আইনি কার্যপ্রণালী এবং অন্যদিকে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে বিপদের সম্ভাবনা কর্মীরা আরোও জানাল, তারা প্রায় দুবছর থেকে কোনো সরকারি অর্থ পায়নি । যখনি তারা নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রকে জানিয়েছে, তাদের বলা হয়েছে টাকা মঞ্জুর হাবার কাজ চলছে । এখন উজ্জ্বলাওখানে নিজেদের কাজ চালিয়ে যাবার জন্য অসুবিধায় পড়েছে ।
২০১২সালে তদানীন্তন কাছাড়ের উপায়ুক্ত হরেন্দ্রকুমার মহন্ত সাংবাদিকদের কাছে বিবৃতি দিয়েছিলেন যে রেডলাইট অঞ্চল বন্ধ করে দেওয়া হবে, কারণ একটা শহরের কেন্দ্রস্থলে এধরণের অনৈতিক কাজকর্ম চলতে দেওয়া যেতে পারে না । কিন্তু এখন এটা পরিষ্কার যে জেলা প্রশাসনের এই কথা রূপায়ণের জন্য কোনো বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি । সরকার আজো কোনো বিশেষ খোঁজ খবর করেনি, জরিপ বা উৎখাত কিছুই হয়নি।
একমাত্র সরকারিসংস্থা যারা ওখানে কিছুটা নিয়মিত যায়, সেটা হল অসম রাজ্য শিশু অধিকার রক্ষা কমিশন(Assam State Commission for Protection of Child Rights)গত মে মাস পর্যন্ত সংস্থার চেয়ারপার্সন ছিলেন রুমনি গগৈ। ২০১৬র অগাস্টে তাঁর গুয়াহাটি অফিসে আমি তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলাম ।২০১৫তে রাধামাধব রোডে তাঁর একটি ভিজিট সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, জেলা অফিসারেরা যাঁরা তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন, জায়গাটার ভয়ানক অস্বাস্থ্যকর অবস্থার কারণে হাত দিয়ে নাক বন্ধ করে যাচ্ছিলেন । গগৈ বলছিলেন, তিনি বিশ্বাস করেন, তাঁর যাবার খবর পেয়ে পাচার হয়ে আসা সকল শিশুকেই লুকিয়ে রাখা হয়েছিল । শুধুমাত্র ওখানকার ম্যাডামরাঅনিচ্ছার সঙ্গে কথা বলতে সামনে এসেছিল । তবুও তিনি একটি ছ সাত বছরের শিশুকে দেখেছিলেন । বাচ্চাটির সঙ্গে এবং যে মহিলাটি তার অভিভাবক বলে দাবি করছিল, তারসঙ্গে কয়েকটা কথা বলে আমার বিশ্বাস করার কারণ ছিল যে কয়েক বছরেই বাচ্চা মেয়েটিকে কাজেলাগানো হবে। আমি গগৈকে জিগ্যেস করলাম যে, সন্দেহ যখন হয়েছিল, তখন তাকে কি তিনি উদ্ধার করতে পারতেন না? তিনি বললেন, “আমি যদি এই মেয়েটাকে নিয়ে যেতাম তাহলে কি হত জানো? আমি এখানে আর কখনো ঢুকতে পারতাম না। পরিদর্শনের পর তিনি সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগকে যৌনকর্মীদের বাচ্চাদের পুনর্বাসনের জন্য একটা প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু কোনো জবাব পাননি ।
২০১১ সালে পালানো মেয়েটির সঙ্গে খারসাইং যে রেইড-এ ২০১২ সালে গিয়েছিলেন, তার ফলশ্রুতিতে উদ্ধারকৃত মেয়েদের থেকে আরো অনেক ন্যক্কারজনক তথ্য পেয়েছিলেন । তাদের একজন তাঁকে জানিয়েছিল, একবার সে আর একটি মেয়ের সঙ্গে ওখান থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু দুজন পুলিশকর্মী তাদের ধরে আবার সেই বেশ্যালয়েই ফেরত দিয়ে যায়, মোটা টাকা ঘুষের বিনিময়ে!
ফেব্রুয়ারি ২০১২তে খারসাইং  উদ্ধারকৃত মেয়েদের পক্ষে জাতীয় মানবাধিকার রক্ষা কমিশনের কাছে দুটো আলাদা অভিযোগে দরখাস্ত করলেন--- একটা হল মেয়েদের পাচার ও বাণিজ্যিক যৌনশোষণ করা হয়েছে, এবং লাগোয়া শিলচর সদর থানার পুলিশ অপরাধীদের সহায়তা করেছে, দুই নম্বর দরখাস্ত উদ্ধার হওয়া মেয়েদের ক্ষতিপূরণ। এর জবাবে কমিশন পুলিশ অফিসারদের শিশুপাচারে অপরাধীদের মদত দেবার বিষয়ে অসম সরকারকে খোঁজখবর করতে নির্দেশ দিল, এবং অসম নির্যাতন-উদবর্তী ক্ষতিপূরণ প্রকল্প (Assam Survivor Compensation Scheme)এর নীতি অনুযায়ী পাচারের ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য যে এক লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দেবার বিধান আছে, তা কার্যকর করতে বলল। 
খারসাইং-কে ২৮জানুয়ারি ২০১৪ তারিখে লেখা একটা চিঠিতে জাতীয় মানবাধিকার রক্ষা কমিশন উল্লেখ করে যে কাছাড়ে পুলিশ সুপার বিবৃতি দিয়ে কমিশনকে জানিয়েছেন যে অভিযোগকারীরা অভিযুক্ত শিশুপাচারকারীদের সঙ্গে যোগসাজস থাকা কোনো পুলিশকর্মীকে সনাক্ত করতে পারে নি । কিন্তু কমিশন যোগ করেছে, এই বিবৃতির কোনো মানে হয় না, কারণ সনাক্ত করার জন্য পুলিশকর্মীদের কোনো প্যারেডে ডাকাই হয়নি । মানবাধিকার কমিশন বিশেষ জোর দিয়ে উল্লেখ করেছে যে দেখেশুনে মনে হয় পাচারব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত পুলিশকর্মীদের আড়াল করবার জন্য এবং যাদের প্রতি সুস্পষ্টভাবে অভিযোগের আঙ্গুল উঠেছে, তাদের বাঁচানোর জন্য এটা একটা ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টা।কমিশন বলেছিল তারা ৫মার্চ ২০১৪এর মধ্যে আরো একবার তদন্ত করে তার রিপোর্ট পাঠাতে পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছে।
এততসত্ত্বেও মাত্র ২০১৫র নভেম্বর মাসে, (অর্থাৎ দেড়বছরের ও বেশি সময়ের ব্যবধানে) পুলিশ একটি উদ্ধারকৃত মেয়েকে সনাক্তকরণ প্যারেডে ডেকে পাঠায় আমরা সকালেই পৌছে গিয়েছিলাম সেই থানায় যেখানকার অফিসাররা মেয়েদের শোষণে যুক্ত ছিল; সেখানেই সন্ধে অবধি আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল,” খারসাইং বলেছিলেন । মেয়েরা কুড়িজনের মধ্য থেকে সনাক্ত করেছিল দুজনকে, একজন পুলিশ কর্মী, নাম মিন্টু শীল, সে তখন করিমগঞ্জ জেলার একটি থানায় অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে কর্মরত, আর অন্যজন তপন নাথ, ভূতপূর্ব হোমগার্ড; দুজনেই আগে শিলচর সদর থানায় কর্মরত ছিল । সনাক্তকরণ প্যারেডের মাত্র একমাস আগে আসাম পুলিশ দিবসে পুরস্কৃত ৪৪জন পুলিশ একজন ছিল এবং মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ এর হাত থেকে প্রশংসাসূচক মেডেল লাভ করেছিল । শিলচর থেকে আগে পালানো সেই ২২বছরের উত্তরবর্তী মেয়েটি অগাস্ট মাসে আমাদের কথোপকথনের সময় ঘেন্নার সঙ্গে জানিয়েছিল যে নাথ একবার তার কাছে যৌনপরিষেবা চেয়েছিল, কিন্তু সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল ।
খারসাইং পুলিশের সেই প্যারেডের পরের আর কোনো খবর পাননি, যদিও এর মধ্যে ১৮মাস পেরিয়ে গিয়েছে । কমিশন সরকারি কর্তাদের থেকে এখনও খবরের অপেক্ষা করে যাচ্ছেঅগাস্ট ২০১৫ থেকে অক্টোবর ২০১৬ পর্যন্ত কাছাড় জেলার পুলিশ সুপার ছিলেন রাজবীর সিং, যিনি আমাকে অগাস্ট মাসে  ফোনে জানিয়েছিলেন, যে দুজন অভিযুক্ত পুলিশ কর্মীর বিরুদ্ধে চার্জশীট গঠন করা হয়েছে এবং কোর্টের আদেশ অনুসারে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে ।
এই সময়ের মধ্যে ২২বছরের সেই শিলচর থেকে পালানো মেয়েটি অসম ও মেঘালয় পুলিশের সঙ্গে আরো একটা উদ্ধারকার্যে গিয়েছিল । সেই সময়ে সে গর্ভবতী ছিল । সে স্মরণ করল, ওই কাজের সময় গুয়াহাটির একজন মোটাসোটা অফিসার বেশ্যালয়ের মালিকদের সঙ্গে কথা বলছিল এবং তাকে ঘুষ দিলে সে সহায়তা দেবে, এমন ও বলছিলআমার তো কোনো ফোন ছিল না, থাকলে আমি রেকর্ড করতাম ।আমি তাকে বললাম, এটা তো ভাল করছ না ।অফিসার রেগে গিয়ে তাকে লালবাতি অঞ্চলে ছেড়ে আসবার হুমকি দিয়েছিল ।
মেয়েটি আমাকে বলেছিল যে মালকিনদের অনেকেই তাকে আক্রমণ করে চাইত, গালি দিত । কিন্তু তারা কিছু করতে পারত নাআমার সঙ্গে যে দুজন শিলং পুলিশের কর্মী ছিল, তারা ছিল খুব ভাল।একবার এক উদ্ধারকার্যে সে ও তার সঙ্গীরা একজন মহিলা ও তার বাচ্চাকে উদ্ধার করলে একজন মালকিন তাকে বলেছিল, “তুমি এখানে বারবার আসছ আমাদের মেয়েদের নিয়ে যেতে, আমাদের ব্যবসা শেষ করতে ? আমরা তোমাকে তা করতে দেব না । আমরা তোমাকেই শেষ করে দেব ।মেয়েটি আমাকে আরো বলেছিল, অনেক মেয়ে ওইসব এলাকায় আছে যারা পালাতে চায়, বাঁচতে চায়, কিন্তু তাদের ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, অথবা লুকিয়ে রাখা হয়েছে ।
গতবছরের গোড়ার দিকে দুটো বেসরকারি সংস্থা, একটি নেপাল ভিত্তিক মাইটি নেপালএবং অন্যটা মেঘালয় ভিত্তিক ইম্‌পালসরাধামাধব রোডে দুটো উদ্ধার অভিযান চালায় এবং তখন নির্যাতিতদের উদ্ধার এবং সুবিচারপ্রাপ্তির সরকারি ব্যবস্থাপনার মধ্যে গুরুতর অসঙ্গতি প্রকট হয়
২০১৬র ২রা জানুয়ারি তারিখে, যার মাত্র দিন কয়েক আগে যখন মাইটি নেপাল’-এর দুজন তদন্তকারী অফিসার রেড-লাইট এলাকাটি তল্লাসির জন্য জরিপ করেন, ‘ইম্‌পাল্‌সএবং স্থানীয় পুলিশ এখানে তল্লাসি চালিয়ে দুজন নাবালিকা সহ ১১জন মেয়েকে উদ্ধার করে ।ইম্‌পাল্‌স’-এর প্রতিষ্ঠাতা হসিনা খারবিহ্‌ আরো কয়েকজন মহিলা সহকর্মীর সঙ্গে সেই অভিযানে ছিলেন; তিনি আমাকে বলেছিলেন, অভিযানের আগে তিনি অসম পুলিশের মহানির্দেশক মুকেশ সহায়কে ফোনে সোজাসুজি যোগাযোগ করেছিলেন । তিনি রেইডে বেরোনোর মাত্র ১৫মিনিট আগে ফোন করে স্থানীয় পুলিশের কাছ থেকে সহায়তা চেয়েছিলেন যাতে খবর বাইরে না যায় , তবুও যখন উদ্ধারকারী দল লালবাতি যখন এলাকাতে ঢুকল, তারা দেখল গেট বন্ধ,এবং বেশির ভাগ বাচ্চাকেই লুকোনো হয়ে গেছে । যে কোনোভাবেই হোক, বেশ্যালয়ের মালিকদের কাছে খবর পৌছে গেছে ।
উদ্ধারকৃতদের মধ্যে তিনটে নাবালিকা ছিল, যাদের প্রত্যেকেই নেপালি, এবং তাদের একটি গুয়াহাটিতে সরকারি পঞ্জীকৃত পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানো হল সমাজকর্মী মিগুয়েল কুইয়া, রাজ্য নারী ও শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে রাখা অন্য আটজনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তিনি আমাকে বলেন যে তারা একটা কথাই বারবার বলছিল, লালবাতি এলাকায় অনেক বাচ্চা আছে । একজন বছর ২৭এর উদ্ধারকৃত গর্ভবতী মহিলা, যার তিনটে ছেলে এবং একটি মেয়ে আছে, কুইয়াকে বলেছিল, সারা দেশ থেকে মেয়ে আনতে দালাল আছে, এখানে এনে তাদের বিক্রি করা হয়। বেশ্যালয়ের মালিকেরা মেয়েদের সঙ্গে খুবই খারাপ ব্যবহার করে, এবং খদ্দেরের দেওয়া সব টাকা কেড়ে নেয়। আটজন মহিলার বেশির ভাগই বলেছে যে কোনো না কোনো জায়গা থেকে তাদের ধরে পাচার করা হয়েছে, এবং দেহ ব্যবসায়ের কাজে জোর করে লাগানো হয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা অনেকটা স্বেচ্ছায়ই এইকাজ করতে স্বীকার করছে কারণ আর কোনো উপায় নেই।
কিন্তু একজন বছর পঁচিশের মেয়ে বলেছিল, সে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনপেশা নিতে বাধ্য হয়েছে । সে যখন ছোট ছিল, গুয়াহাটিতে একটি বাড়িতে কাজ করত, তারপর বছর দশেক আগে সে পাচার হয়ে যায় ।এখন সে নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে চায়। সে কুইয়াকে বলেছিল, রাধামাধব রোডে একটা ছোট ঘরে তাকে রাত দশটা থেকে সকাল আটটা অবধি আবদ্ধ থাকতে হত, ‘কাজকরতে না চাইলে মারধোর জুটত। আরো একটি মেয়ে সরকারি সাহায্য চেয়েছিল যাতে তাকে আর লালবাতি এলাকায় জবরদস্তি ফিরে যেতে না হয় । মিগুয়েল বলছিলেন, উদ্ধারকৃতদের মধ্যে দুজন মহিলা ছিল নেপালের, যারা অত্যন্ত চিন্তিত ও হতাশাগ্রস্ত ছিল, কারণ ২০১৫র ভূমিকম্প দেশে তাদের পরিবার প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । তারা কোথায় ফিরে যাবে বুঝতে পারছিল না । কুইয়া আদালতের অনুধাবনের সুবিধার জন্য সমস্ত তথ্য সহযোগে বিবরণ প্রস্তুত করেছিলেন । একটি মেয়ে বলেছিল, উপযুক্ত সুরক্ষা পেলে যৌনপেশা ছেড়ে নেপাল থেকে শিলচর মেয়েপাচার বন্ধ করার কাজে সাহায্য করতে রাজি; কুইয়া সেই মেয়েটির কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করে তাকে সাহায্যের সুপারিশ করেছিলেন ।
কিন্তু রাজ্যের হোমে ব্যাপারটা অন্যরকম দাঁড়াল । ২০১৬র এপ্রিল মাসে একটি স্থানীয় বাংলা সংবাদপত্র জানাল যে মেয়েদের চালাকি করে আবার লালবাতি এলাকায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ।ওই মাসেই আগে উল্লিখিত ২৫বতসরের মেয়েটি আবার পালিয়ে থানাতে গেল তার স্বামী ও বেশ্যালয় মালিকের বিরুদ্ধে নালিশ লেখাতে কয়েকজন রিপোর্টারকে সে বলল, তারা যখন গুয়াহাটিতে সরকারি হোমে ছিল, তখন শিলচরের লালবাতি এলাকার বেশ্যালয়ের মালিকরা কয়েকজন লোকের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল । তারা মেয়েদের বলেছিল যে মেয়েদের বাড়ি যাবার সুবিধা করে দিতে তারা ওদের বাড়ির ঠিকানা খুঁজে সাহায্য করবে । সংবাদপত্রটি লিখেছে, যদিও মেয়েরা একটু সন্দেহ করছিল, হোমে থাকাটা এত অসহনীয় ছিল যে মেয়েরা শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেল । কয়েকজন রক্ষা পাওয়া মেয়ের মতে, হোমের কর্তৃপক্ষ থেকে সাধারণ কর্মী সকলেই দুর্ব্যবহার করত, খাবার ছিল অত্যন্ত খারাপ, টয়লেট জঘন্য নোংরা ।
কুইয়ার কাছে প্রাপ্ত কোর্টের নথি অনুযায়ী, মেয়েরা কিছু প্রয়োজনীয় কাগজে দস্তখত করল, সরকারি হোম তাদের ছেড়ে দিতে রাজি হল । কোনো এনজিও-কেই জানানো হলনা । কোর্ট রায় দিল মহিলারা তাদের অভিভাবকদেরসঙ্গে বাড়ি চলে যেতে পারে, তারা উঠানো হল লালবাতি এলাকায় ।দুমাস বাদে ২৫বতসরের মেয়েটি যে দশ বছর আগে পাচার হয়েছিল, বেশ্যালয়ের মালিকের প্রচণ্ড অত্যাচার অসহ্য হওয়ায় একদিন মরিয়া হয়ে পালিয়ে গেল। সংবাদপত্র অনুসারে, মেয়েটি এন জি ও-র উপরেও খাপ্পা ছিল,তাদের উদ্ধার করার নামে এরকম দুরবস্থায় ফেলে দেবার জন্য।
খারবিহ্‌ কিছুদিন পর শিলচর গিয়ে যখন জানতে পারেন যে আটটি মেয়ে কোর্টের আদেশ অনুসারে হোম থেকে ছাড়া পেয়েছে, মেয়েদের তথাকথিত অভিভাবকদের নাম ধাম ফোন নম্বর ইত্যাদি জোগাড় করার চেষ্টা করেন, কিন্তু সক্ষম হন না । তিনি হতাশ হয়ে যান, তাঁর নিজের এন জি ও একজন অভিযোগকারী হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের কোর্টের রায় ও পরবর্তীতে মেয়েদের হোম থেকে ছাড়া পাওয়া--- কিছুই জানানো হয় নি ।
কুইয়া আমাকে গত অগাস্টে বলেছিলেন, আমাদের সুপারিশ ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট ।পঁচিশ বছরের মেয়েটির বাড়ির ঠিকানা ও বাবার নাম আমরা দিয়েছিলাম, এবং অনুরোধ করেছিলাম যে তথ্যটি যেন যাচাই করে দেখা হয়, একজন পরিদর্শক কিংবা জেলা সমাজকল্যাণ আধিকারিক সেই ঠিকানায় গিয়ে পরিবারটির সামাজিক পটভূমি যাচাই করে আসেন । সেই মেয়ে বা অন্য উদ্ধারকৃত মেয়েদের এইসমস্ত নিরীক্ষণের পরই বাড়ি পাঠানো উচিত ছিল । 
কুইয়া-র এই বিস্তৃত রিপোর্টের সঙ্গে খারবিহ্‌-র সংস্থা ইম্‌পাল্‌সও একটা মনস্তাত্বিক রিপোর্ট প্রস্তুত করে রাজ্য হোমে পাঠিয়েছিল । তাদের সুপারিশ ছিল যে মেয়েদের মানসিক চিকিৎসা এবং সুস্থতার জন্য কয়েক মাস পুনর্বাসন কেন্দ্রে রাখা উচিত। খারবিহ্‌ আমাকে গত সেপ্টেম্বর মাসে ফোনে বলেছিলেন, আমরা একটা স্থানীয় দলকে মেয়েগুলোকে খুঁজতে শিলচর পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু যথেষ্ট তথ্য, ফোন নম্বর ইত্যাদি না থাকাতে ব্যাপারটা সহজ ছিল না । লালবাতি এলাকায়ও আরো একবার প্রবেশ করা সহজ ছিল না।আমি যখন ডি এস পি সুধাংশু দাসকে জিগ্যেস করলাম তিনি জানেন কিনা আটটি উদ্ধার করা মেয়েকে ঠকিয়ে আবার লালবাতি এলাকায় ফেরত পাঠানো হয়েছে, জবাবে তিনি  বললেন তাঁর কাছে এরকম কোনো তথ্য নেইঅন্যদিকে, এস পি রাকেশ রৌশন বললেন, ব্যাপারটা তিনি শুনেছেন, আটজন মেয়ে স্বেচ্ছায়ই ওখানে ফেরত গেছে, এবং যৌনব্যবসায়কে অপরাধমূলক না বলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা উচিত । তিনি এও বললেন যে মেয়েগুলোকে ঠকিয়ে নিয়ে যাবার ব্যাপারটা তিনি জানেন না ।
কেসটা আরো ঘোলা হয়ে পড়ল । ১জুন ২০১৬ তারিখে কুইয়া সি আই ডি পুলিশ পুপারকে উদ্দেশ্য করে একটা অভিযোগ পত্র পাঠালেন যে আটজন মেয়ের মধ্যে তিনটি নাবালিকা নেপালি মেয়ের দুজনে অভিযোগ করেছে যে কাউন্সেলিং এর সময় উদ্ধারকারী দলের এন জি ও-র সদস্য এক বা দুজন, তাদের সঙ্গে যৌনতা করেছে । কুইয়া এইব্যাপারে তদন্ত ও অপরাধীদের শাস্তির আবেদন করলেন । চিঠিটা কাছাড়ের তদানীন্তন পুলিশ সুপার রাজবীর সিং-এর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হল, তিনি আমাকে বলেছিলেন, ব্যাপারটা সম্পর্কে তিনি জানেন এবং শিলচর কোর্টে এ সম্বন্ধে একটা কেসও রেজিস্টার করা হয়েছে । আজ পর্যন্ত কুইয়ার সেই চিঠির কোনো জবাব দেওয়া হয় নি বা মেয়েদুটোর কোনো বিবৃতি নেওয়া হয় নি । কুইয়া আমাকে বলেছিলেন, “আমি অসমের কয়েকটা জেলায়ই পাচারের উপর কাজ করেছি, পুলিশ সুপাররা কথার জবাব দিয়েছেন, সহায়তা করতে উদ্যোগ নিয়েছেন, কিন্তু এই প্রথমবার মাসের পর মাস চলে গেল, কেউ কোনো যোগাযোগ করেনি, ব্যবস্থা গ্রহণ তো দূরের কথা।
বছরখানেক একটি সরকারি হোমে কাটানোর পর নেপালি নাবালিকা তিনটিকে ডিসেম্বর ২০১৬ তে নেপালে তাদের বাড়িতে পাঠানো হল। খারবিহ্‌ বলেছিলেন যে তিনি মানবপাচার প্রতিরোধ সংস্থার গুয়াহাটি অফিসে আবেদন জানিয়েছেন যে তারা যেন তাদের অধীন শিলচরের শাখাকে কেসগুলোর তদন্ত ত্বরান্বিত করতে এবং অগ্রগতির নিয়মিত রিপোর্ট দিতে নির্দেশ দেয় । শিলচরের উজ্জ্বলা শাখার ভূতপূর্ব নির্দেশক পৌলোমী দত্তরায় ইম্‌পাল্‌স’-এর হয়ে স্বেচ্ছায় খোঁজ খবর করছিলেন, কিন্তু তিনিও বললেন, পুলিশের কাছ থেকে তিনি প্রায় কোনো সহায়তাই পাচ্ছেন না ।
গত অগাস্টে গুয়াহাটিতে একটি কাফেতে এই কেস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল একজন শিশু অধিকার কর্মীর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল । তিনি বলেছিলেন, নেপালি নাবালিকারা কোনো সুবিচার পাবে বলে তাঁর মনে হয় না । মেয়ে তিনটির বাড়ি নেপালের প্রত্যন্ত অঞ্চলে । তাদের দুজন---এর মধ্যে একজন দুমাসের জন্য আর একজন বছরখানেকের জন্য শিলচরের লালবাতি এলাকায় কাজ করেছে, দালালেরা ভাল মাইনের চাকরির লোভ দেখিয়ে তাদের পাচার করেছিল, তৃতীয় নাবালিকাটি বছর পাঁচেক আগে নিজের এক আত্মীয়ের দ্বারাই অপহৃত হয়েছিল, তখন তার বয়স ছিল ১২ বৎসর । সমাজকর্মীটি আমাকে বলেছিলেন, মেয়েগুলো এত ভয় পাচ্ছিল যে অনেক দিন পর্যন্ত তারা নিজেদের আসল নামটা ও বলেনি । ওরা কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। কাউন্সেলিং-এর সময় তারা বলছিল তাদের কিভাবে মারা হত, তারা অন্যদের মার খেতেও দেখত, এবং মারধোরের পর একটা ছোট ঘরে বারেবারেই বন্ধ করে রাখা হত। যদি বা কখনো পালাত, পুলিশ তাদের ধরে যৌনহেনস্থা করত, তারপর আবার বেশ্যালয়ে ফেরত দিয়ে যেততারা অন্য শহরের লালবাতি এলাকায় ও থেকেছে, একজন কিছুদিনের জন্য দিল্লি ও থেকেছিল । সমাজকর্মীটি আমাকে বলেছিলেন, বেশিরভাগ উদ্ধারপ্রাপ্ত মেয়েরাই এইধরনের অভিজ্ঞতার কথা বলে, কিন্তু শুনছে কে!
উজ্জ্বলা প্রকল্পের শিলচর শাখার একজন কর্মী বলেছিলেন যে গতবছর জানুয়ারি মাসে ১১জন মেয়ের উদ্ধারের পর থেকে যৌনপল্লীর মালিকেরা ভেতরের খবর বাইরে না যাবার উদ্দেশ্যে বাইরের লোকেদের ওখানে প্রবেশে খুব কড়াকড়ি করেছে । কুইয়া এবং খারবিহ্‌ দুজনেই দৃঢভাবে বলছেন যে কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হোক, কারণ সমস্ত বেশ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার বহু স্পষ্ট কারণ রয়েছে ; এবং ভেতরের সকল মেয়েকে উদ্ধার করে পুনর্বাসন দেওয়া হোক । কিন্তু লালবাতি এলাকার বিরুদ্ধে এইভাবে জোরালো অভিযান চালিয়েও দেখা যাচ্ছে যে যৌনপাচারের ব্যবসায় অন্যান্য জায়গায়ও সম্প্রসারিত হচ্ছে । পৌলোমী দত্তরায়ের মতে, আপাতদৃষ্টিতে শান্ত শিলচর শহরে এখন বেশ কয়েকটি পাচারকারী নেটওয়ার্ক আছে, যারা লালবাতি এলাকায়ই শুধু নয়, তার বাইরে ভাড়ার ফ্ল্যাট কিংবা বাড়ি থেকে ও কাজ করে এবং তাদের খদ্দেরদের সঙ্গে সামাজিক সংযোগমাধ্যমে যোগাযোগ করে।
এই বছরের মার্চের এক ঠাণ্ডা কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে আমি ২০১১সালে শিলচর থেকে পালানো মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম; মেয়েটি বস্তির একটা ঝুপড়ি ঘরে তার তিনটি সন্তানের সঙ্গে থাকে । আমরা একটা একজনের খাটে বসেছিলাম, বাচ্চাগুলো আমাদের চারপাশে নিজেদের মধ্যে মারামারি ও খেলা করছিল। তার সঙ্গে দেখা করবার আগে আমি দুবার ফোনে কথা বলেছি, একবার আগের অগাস্টে, একবার ডিসেম্বরে । দুবারই তাকে বেশ উৎসাহী মনে হয়েছিল । এবারে তাকে বেশ ক্লান্ত ও সমস্যাগ্রস্ত মনে হল । পালিয়ে আসার পর থেকে তাকে অনেক সংগ্রাম করতে হচ্ছে, এবং সে বারবার বলছিল, সরকার তাকে টাকা না দিয়ে একটা বাড়ি দিলে বরং সুবিধে হত ।
সে বলল, তার এক বন্ধু লালবাতি এলাকা থেকে উদ্ধার পেয়েও আবার ওখানে ফেরত গিয়েছে , আরো একজন নিজের বাচ্চাকে বেচে দিয়েছে কিছু টাকার জন্য । আরেকটা মেয়ে, যাকে আমি ২০১২ সালে বাঁচিয়েছিলাম, আজকাল মাদক বিক্রি করে । তার এখন আরামের জীবন, একটা গাড়ি ও আছে । সে আমাকেও এই কাজ করতে বলেছিল, কিন্তু অ্যাগনেসের প্রতি শ্রদ্ধাবশত: আমি মানা করে দিয়েছি । আমি তাকে বলে দিয়েছি, আমি টাকার লোভে অন্যের জীবন নষ্ট করতে চাই না ।
সে এখন জীবিকার জন্য একটি মিশনারি হোমে নার্স হিসেবে কর্মরত তার ছোট বোনের উপর নির্ভরশীল। তার অতীতের জন্য সে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও বিমাতৃসুলভ ব্যবহার পায় । তার কোনো রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড নেই, তাই কোনো সরকারি ভর্তুকি বা প্রকল্পের সুবিধা থেকেও সে বঞ্চিত ।সরকার থেকে তাকে যে তাকা দেওয়া হয়েছিল, সেই টাকা দিয়ে সে একটা বাড়ি বানাতে চেয়েছিল, সেখানেও সে ঠকেছে, কারণ তাকে যে জমি বিক্রি করা হয়েছিল, সেটা বিক্রেতার ছিল না । তাই তাকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল । আমি কী কাজ পাব ? সে জিগ্যেস করছিল । আমাকে কে কাজ দেবে যখন দেখবে আমার তিনটি বাচ্চা আছে ? তার চাইতে যদি আমাকে একটা বাড়ি দেওয়া হত, আমি সেখানে শান্তিতে থেকে একটা দোকান বা কিছু করতে পারতাম ।
বেশিরভাগ উদ্ধারপাওয়া মেয়েদের সমস্যা একই রকম। উজ্জ্বলার শিলচর হোমে আমি একটি ১৭ বছরের মেয়েকে পেয়েছিলাম, যে ১১ বছর বয়সে পাচার হয়ে লালবাতি এলাকায় এসেছিল । আসার এক সপ্তাহ পরেই মালিক মেয়েটিকে জোর করে রজঃস্রাব হবার পিল খাইয়ে দেয়, যাতে সে তাড়াতাড়ি যৌনব্যবসায়ের কাজ শুরু করতে পারে । এই মেয়েটিও তার উপর অত্যাচারের বর্ণনা দিয়েছিল। বলেছিল, “আমার মালকিন আমাকে এইখানে লাথি মারত”---মেয়েটি নিজের তলপেটের নিম্নাংশে আঙ্গুল দেখিয়েছিল ।
সেও ঘরে বন্ধ করে রাখার কথা বলেছিল, বলেছিল পুলিশ কিভাবে বেশ্যালয়ের মালিকদের আগাম খবর দেয় ।আমরা অনেকদিন খাবার খেতে সময় পেতাম না, অনেক খদ্দের এসে যেত ।অনেক সময় রাতে পাঁচজন লোক এসে যেত, কখনো দিনের বেলাও আসত । আমরা বেশি ঘুমোনোর সময় ও পেতাম না । মাঝে মাঝে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেওয়া হত খদ্দের নেবার জন্য ।
চার বছর এভাবে কাটানোর পর সে গুয়াহাটি পালিয়ে গিয়েছিল । কয়েক মাস একটা সরকারি বাচ্চাদের হোমে কাটানোর পর আরো কয়েক মাস সরকারি উন্নয়নমূলক প্রচেষ্টা কেন্দ্রেকাটিয়েছিল । সেখানে তাকে গৃহসহায়িকার কাজ শেখানো হয়েছিল, এবং এক বাড়িতে কাজও পেয়েছিল।
কিন্তু সে আবার পালিয়ে শিলচর চলে এল। এইবারে মালিক তাকে নিজের বাড়িতে রাখল এবং বলল যে শিলচর সদর থানার ওসি বদলি হলেই অবস্থার পরিবর্তন হবে এবং মেয়েটি আগের মত কাজ করতে পারবে । এই সময়ের মধ্যে বেশ্যালয়ের মালিক তাকে কলকাতার সোনাগাছিতে বিক্রির চেষ্টা করছিল, কিন্তু আনুমানিক বয়স নির্ণয় করার এক্সরে পরীক্ষা করে তার বয়স কম প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ওরা নিতে রাজি হলনা । আসলে”, মেয়েটি বলেছিল, “আমার আসার উদ্দেশ্য ছিল অন্য, চাইছিলাম ঝগড়া করে আমার টাকাগুলো ওর কাছ থেকে আদায় করব, কিন্তু আমি শেষ পর্যন্ত ওর সঙ্গে পেরে উঠিনি ।নভেম্বর মাসে সে মালিকের বাড়ি থেকে পালাল এবং এবারে পুলিশ তাকে উজ্জ্বলা হোমে নিয়ে রেখে দিল ।
আমি যখন ওকে দেখেছিলাম, ১৭ বছরের মেয়েটিকে খুব দুঃখিত ও দ্বিধাগ্রস্ত দেখাচ্ছিল । বাবা মা অল্পবয়সেই মারা গেছেন, একমাত্র কাকার ঠিকানা সে জানলেও কাকা তাকে নিতে রাজি নয় ।আমি তো লেখাপড়া জানিনা, কিন্তু কোনো কাজ পাবার আশা করছি । আর যদি কিছুই না পাই, তাহলে আত্মহত্যা করব,” চোখের জল ফেলতে ফেলতে মেয়েটি বলেছিল ।
২২বছরের যে মেয়েটি ২০১১ সালে শিলচর থেকে পালিয়েছিল, সে বলেছিল, সে মাঝেমাঝে এত অসহায় অনুভব করে যে আবার লালবাতি এলাকায় ফিরে যাবে কিনা ভাবে। গত কয়েকবছরে একাধিকবার তাকে বাসস্থান থেকে উৎখাত হতে হয়েছে । সে বলেছিল, “আসলে, ওখানে আমি এর চাইতে ভালো অবস্থায় ছিলাম । দুঃখ ছিল, কিন্তু এত সমস্যা ছিল না । কিন্তু ফিরে আসার পর অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছে । ওখানে আমার খাবার সমস্যা ছিল না, শোবার জন্য অন্তত একটা বিছানা ছিল । সারাক্ষণ কেউ ভয় দেখাত না, ‘এক্ষুনি বাড়ি খালি করে দাও।
কথোপকথনের শেষ পর্যায়ে সে বলছিল, তার এখন খুব ক্লান্তি লাগছে, প্রচণ্ড রাগও হচ্ছে। সেই কথার সূত্র ধরে সে বলল, খারসাইং তাকে বলেছেন, তিনি আবার উদ্ধারকার্যে রাধামাধব রোডে যাবেন, সে যেতে রাজি কিনা । সে জোর দিয়ে বলেছে, “আমি অবশ্যই যাব; ওরা বাচ্চাদের কেন ওখানে রাখবে?”
           


কোন মন্তব্য নেই: