“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ৯ মে, ২০১৭

আধুনিক বাঙালি


।। সুরজিৎ মণ্ডল।।
(C)Image:ছবি
বাঙালি বড় মন ভোলা জাতি, খুব সহজেই ভুলে যায় নিজের গৌরবময় ইতিহাস। বাঙালির মত উজ্জ্বল ও গৌরবময় ইতিহাস ভারতবর্ষে অন্য কোন জাতির আছে বলে আমার মনে হয়না। তার জ্বলন্ত প্রমাণ রূপে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজা রামমোহন রায়, স্বামী বিবেকানন্দ, সুভাষ চন্দ্র বসু এমন আরো কতশত বাঙালি ও তাদের কর্মজীবন, যারা মহৎ কাজের দ্বারা সারা মানব জাতির উন্নতি করে গেছেন। জাতির কথা নাহয় বাদই দিলাম, বাংলা ভাষার যে ইতিহাস তা কি মনে রেখেছে আধুনিক বাঙালিরা? যে ভাষার সাহিত্য এশিয়া মহাদেশে প্রথম নভেল প্রাইজ পেয়েছিল আজ সেই মাতৃভাষায়  কথা বলতে লজ্জা পায় বাঙালি। আমার মনে হয়না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে ছিলেন, কী ছিলেন আধুনিক বাঙালি বাড়ির বাচ্চারা ঠিক জানে বলে। অনেকই জানে না। তাই ভবানীপ্রসাদ মজুমদার লিখেছেন, "জানেন দাদা আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসেনা।"
             
             কথা যখন উঠলো আর একটা ঘটনা যা শুনলে সত্যি অসহ্য লাগবে আপনাদের। এই কবিতাটির চরণ দু একটি "বাংলা জানি কেমন কেমন খুব দুর্বল প্যানপ্যানে, শুনলে বেশী গা জ্বলে যায় একঘেয়ে আর ঘ্যানঘ্যানে " চরণ গুলো বললাম কারণ ঘটনাটি এর সাথে জড়িত এবং অসহ্য লাগার কারণ এই যে আমারই এক বান্ধবী ডিপিএস থেকে উচ্চতর মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করে টালিগঞ্জে কি যেন কোর্স করেছে। একদিন হঠাৎ আমার একটি পোস্টে কমেন্ট দিল "Bengali peoples are very annoying and they shouting at others without any reason."- বলছে যে বাঙালিরা খুবই বিরক্তিকর এবং তারা কোনো কারণ ছাড়াই অন্যের উপর চিৎকার চেঁচামেচি করে। আমি বললাম এরকম যুক্তিহীন দোষ দিচ্ছ বাঙালির উপর আর বললাম যেহেতু তুমিও বাঙালি তাই তোমারও জানা উচিত বাঙালির ইতিহাস। তুমি তো উল্টো দিকে যাচ্ছো। ও বলল, "If I care," সোজা অর্থে, আমি কেয়ার করিনা। বুঝলাম ও বাংলা বুঝতে চায়না ইংরেজিতেই লিখলাম, Basil plant is very close to our heart we even worship it but for a dog it has no value and never bothers to pee on it. But a dog's peeing at the basil plant never diminishes the devotion that we have for it. But yes we feel bad and angry with the dog for its behaviour but Again we also need to keep in mind we can't be a dog to teach the dog a lesson!- তুলসী গাছের প্রতি আমাদের মনে প্রচুর শ্রদ্ধা এমনকি আমরা পূজা করি তুলসী গাছকে কিন্তু একটা কুকুরের জন্য এর কোনো মূল্য নেই এমনকি এর উপর মুতেও যায়। তুলসী গাছে কুকুর মুতার ফলে কিন্তু তুলসীর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা কমে যায়না। কিন্তু হ্যাঁ কুকুরটার এমন ব্যবহারের জন্য ওর উপর আমাদের অনেক রাগ উঠে কিন্তু তারই সাথে আমাদের এটাও মাথায় রাখতে হবে যে একটা কুকুর কে পাঠ পড়ানোর জন্য তো আর আমরা কুকুর হতে পারিনা। ইংরেজি ম্যাডাম আর উত্তর দিল না। কথাটা বলার অর্থ এই যে কোন পর্যায়ে এসে পড়েছে বাংলা সমাজ এটা সত্যি চিন্তনীয়।
       আর কিছু এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলে বুঝবেন, খুব সংক্ষেপে বলছি। আমি তখন দ্বিতীয় সেমিস্টারে পড়ি-পাস কোর্স, বাংলা বিভাগে আমরা সাতজন ছাত্র-ছাত্রী এবং বিষয়টি তে  আমাদের পাঠ্য ছিল 'সোনার তরী' কাব্যের চারটি কবিতা- সোনার তরী, যেতে নাহি দিব, বসুন্ধরা ও সমুদ্রের প্রতি, চারটা গল্প ছিল- ফসিল, আদাব, টোপ ও হারানের নাথ জামাই, সঙ্গে ছিল একটি নাটক ফেরারি ফৌজ। পরীক্ষা প্রায় কাছেই ছিল, একদিন আমাদেরই ক্লাসের দুটি মেয়ে বলেছিল, "বাংলাটা একদম বাজে লাগে পড়তে।" আমি বলি রবীন্দ্রনাথ যদি তোদের মত ভাবতো তবে বাংলা ভাষা এতো উন্নত হত না আর উনার রাশি রাশি কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, গান, প্রবন্ধ ইত্যাদিও পেতাম না আমরা। ওরা বলে উঠল,"না লিখলেই ভালো হতো, আমাদের পড়তে হতনা বোরিং বাংলাটা।" আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিলাম বাড়িতে এসে আমার প্রিয় বন্ধুকে কথাটা বলতেই সে বলেছিল, "এদের জন্যই তো রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন 'আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্ক ভাগী ' অর্থাৎ তিনি বাংলাকে ভালোবাসে কবি সব কলঙ্কই মাথা পেতে নিতে রাজি। আমার সহপাঠীদের আর কিছু বলিনি।
              কলেজের ক্যান্টিনে একদিন খাওয়া দাওয়ার পর বিল হয়েছিল একশ পয়তাল্লিশ টাকা একটি মেয়ে উঠে বিল দিতে গেল কিন্তু ক্যান্টিনের আন্টি কত টাকা যে দিতে বলেছিল তা বুঝতে না পেরে সে ফিরে এসে আমাকে বলেছিল, একশ তো বুঝলাম, কিন্তু পঁয়তাল্লিশ মানে কত রে? আমি হতাশ হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলাম হায়রে দেশের ভাষা, শেষে বলে দিলাম 'ফোর্টিফাইভ'
           আর একবার কলেজেই স্নাতকের প্রথম বর্ষের একটি মেয়ের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর  চেয়ে নিয়েছিলাম, ভালো লেগেছিল আমার আর তারও এম.আই.এল ছিল বাংলা। দু-চার দিন কথা হওয়ার পর সে একদিন আমায় বলে, " হিন্দি মে বাত করো না" আমি বলি কেন? বাংলাতে কি দোষ আছে? বলে," নেহি বাস ব্যঙ্গলি আচ্ছা নেহি লাগতা।" আমি বলেছিলাম হামকো আবার হিন্দি ভালো নহি লাগতা। এই আধুনিক বাঙালির কিছু দৃষ্টান্ত আরো অনেক আছে এমন। কিন্তু আবার ভালো লাগে এইটাই যে কেউ কেউ ছোটবেলা থেকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করেও নিজের চেষ্টায় বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে নিজের মধ্যে। এমনি একটি ঘটনা ঘটেছে আমার সাথে। কয়েক দিন আগে আমার পাড়ার একটি ছেলে আমাকে বলল,দাদা তোমার কবিতা গুলো ফেসবুকে পড়ি খুব ভালো লাগে। আমি ধারণাই করতে পারিনি সে বাংলা জানতে পারে বলে। ব্যাপারটা খুবই ভালো লেগেছে আমার। বাঙালি মনভোলা জাতি তাও আজও অনেকের মধ্যে বেচে আছে বাংলা। কিন্তু ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের 'বাংলাটা ঠিক আসে না' কবিতার অভিভাবকের মত যদি সকল বাঙালি অভিভাবকেরা নিজে বাঙালি হয়ে ছেলে-মেয়ের বাংলা না জানায় লজ্জা বোধ না করে তবে বাঙালির গৌরবময় ইতিহাসের মত ভবিষ্যৎ টা আর হবে না।

কোন মন্তব্য নেই: