সপ্তর্ষি বিশ্বাস
ঋত্বিজ রজত জয়ন্তী বর্ষ (২০১৭) সংখ্যা থেকে
১।
লক্ষণীয় হয়,এই,যে, সমগ্র মহাভারতে মহামতি বিদুরের
ব্যক্তিগত জীবন, যে জীবন কুরু-পাণ্ডবের কাহিনি বহির্ভূত, যে জীবনে বিদুর নিজ পত্নী-পুত্র সন্নিবেশিত – তার বিষয়ে মহাভারত অসম্ভব
নিশ্চুপ। এই বক্তব্যের নিশ্চয়তা নির্ণয়ে, যাঁরা মহাভারতের পৃষ্ঠায়
পুনরাবগহনে পরাঙ্মুখ, তাঁদের জন্য ইরাবতী কার্ভে’র ‘Yuganta: the end of an epoch’ গ্রন্থের ‘Father and son?’ নামক অধ্যায় অথবা নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ির ‘কথা অমৃত সমান’এর ২য় খণ্ডের কয়েকটি অধ্যায়
পাঠই যথেষ্ট। মহাভারত ব্যাখ্যাতাদের অনেকের ধারনা,হয়,এই মতোও,যে, কুন্তী ও বিদুরের অন্যতর সংশ্রব
ছিল এবং সেই সংশ্রবহেতু, অন্য চারজন না হোক, অন্তত: যুধিষ্ঠির বিদুরেরি ঔরসজাত। সম্ভবত: বিবাহোত্তর কালে কুন্তী প্রথমবার গর্ভবতী
হওয়াতে, যেহেতু ‘কানা মনে মনে জানা’, পাণ্ডু লোকলজ্জার ভয় বা জনকৌতুহল এড়াতেই চলে গিয়েছিলেন বনবাসে।
ততোদূর যারা মেনে নিতে চাননা
তাঁরা এইটুকু নিশ্চয়ই মানবেন যে কৌরব-পাণ্ডবের আখ্যানের প্রথম থেকে
অন্তিমাবধি বিদুরই ছিলেন কুন্তীর অন্যতম পরামর্শদাতা। সুহৃদ। বান্ধব। ইন্টিগ্রেল ক্যালকুলাসের
হস্তীশূঁড়হেন চিহ্নটির মতন বিদুর বেষ্টন করে আছেন মহাভারতকে।
একই ভাবে নাসির আহমেদও ঘিরে
থাকে শাহিদ খানের পরিবারটিকে – সেই শাহিদ খানের রেলগাড়ি লুঠ
করার আমল থেকে শাহিদের পৌত্র ফয়জল খানের ধ্বংসের পরেও। যেভাবে ধাবমান মৃত্যুর হাত থেকে
সে রক্ষা করেছিল শাহিদ-পুত্র নাবালক সরদার খান’কে তেমনি শাহিদের প্রপৌত্রটিও, অন্তিমে, রক্ষা পায় নাসির আহমেদেরই নিমিত্ত।
এই মহাভারতে ঐ শেষ দৃশ্যটিই
শান্তিপর্ব।
এই দৃশ্যটিই অন্তিমপর্ব যেখানে
বোম্বের কোনো রেল ইস্টিশানের কিনারে খান বংশের একমাত্র যষ্টিটিকে ‘লোরি’ শোনাতে শোনাতে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে নাসির। বাজছে গান ‘এক বগ্ল্ মে চান্দ্ হোগা, এক বগল মে রোটিয়া/ এক বগল মে নিন্দ্ হোগি, এক বগল মে লোরিয়া...” – যে গান বেজেছিল শাহিদ খানের ভাসিপুর ত্যাগ করে
ধানবাদের পথে যাত্রার মুহূর্তে। হ্যাঁ, এই মুহূর্তে শাহিদও উদ্বাস্তু। প্রাণের ভয়ে পলাতক। ১৫
ই অগাস্টে ঘোষিত স্বাধীনতার মূল্যে আমার পিতামহ, প্রপিতামহদের মতই। উদ্বাস্তু ঊর্ধ্ব আসামের ‘বংগাল খেদা’র অত্যাচারে পলাতক বাংলাভাষী জনতার মতই। উদ্বাস্তু পাণ্ডব ভ্রাতাদেরও মত।
ছবিটি নিয়ে লিখতে বসে ফিরে ছবিটি দেখতে গিয়ে টের পাই শাহিদের মতই উদ্বাস্তু যেন এই মানবজাতিও। শাহিদের মতো সে’ও কি চায়না নিদ্রা, বিশ্রাম, স্বপ্ন ... ইংরেজি সাবটাইটেলে গানটির কথা লিখিত আছে
এই ভাবে:
I dream of a bejeweled moon, and some warm bread.
I dream of gentle sleep, and a lullaby in my head.
My dear moon...
এই শান্তির নিদ্রার স্বপ্নেই কি
উপত্যকা থেকে উপত্যকার দিকে যাত্রা করেনি মানুষ, সভ্যতার ঊষালগ্নেরো আগে? এই শান্তির নিদ্রার স্বপ্নেই কি আজো সে ছুটে যায়না গ্রাম
থেকে,মফস্বল থেকে – শহর, নগর, বন্দরের দিকে? তবু সে পায় কি সেই নিদ্রার
সন্ধান না’কি …
চাঁদ, যেন জীবনানন্দের, ইয়েট্সের প্রতীকী চাঁদ, দেখে, চেয়ে চেয়ে দেখে এই যাত্রা…
ফিরে আসি নাসির আর বিদুরের
প্রসংগে। পুনরায়। বিদুর এবং নাসিরের সাদৃশ্য আরোও
এই, যে, বিদুর দাসীগর্ভজাত আর নাসির
আহমেদ শাহিদ খানের ‘তুতো’ ভাই হওয়া সত্ত্বেও সে আদতে ছিল শাহিদের ‘হ্যান্ডেল’। নাসিরের নিজের ভাষায় ‘নোওকর্’। তথাপি বিদুরের যুধিষ্ঠির প্রীতির মতনই অপত্য স্নেহে সে দায় নিয়েছিল সরদার
খানের। কিনারে দাঁড়িয়েছিল সর্বদা।
অন্তিমে, আপাতত:, এই, যে – বিদুর-কুন্তীর যৌন সংসর্গ থাকা না থাকা নিয়ে তর্ক করা গেলেও
নাসির এবং সর্দার খানের পত্নী নাগ্মা খাতুনের মধ্যে, একবার যৌন সংসর্গ ঘটতে চলেছিল, প্রকৃত, কিন্তু অন্তিমে তা ঘটতে পারেনা সেই রাত্রে। ঘটতে পারেনা আর কোনো দিনই। নাসির আহমেদের নিজের কথায় “মেরে আউর নগমা কে বিচ যো হোতে হোতে রহগেয়া থা য়ো ফির কভি নেহি হুই...” – আর সেই “না হওয়া”র নিরিখেই নাসির আহমেদ পৌঁছে গেছে আরো কিছুদূর-বিদুরের দিকে …
এতাবৎ এসে, আমি নিশ্চিত, রেগুলার “হিন্দি বই” দেখা, আমাহেন, বখে যাওয়া চার অক্ষরের বোকা পাবলিকেরা ঠিকই টের পেয়ে গেছে, যে, কে এই নাসির, সরদার, কুরেসি এট্সেট্রা।
“দ্বিজোত্তম, সত্য কূলজাত”দের জ্ঞাতার্থে বলি – ছবির নাম “গেংস্ অফ ভাসিপুর”। পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপ। ছবিটি পরিচালকের এক খণ্ডে
মুক্তির ইচ্ছা থাকলেও অবশেষে পাঁচ ঘণ্টার ছবি একবারে দেখানোর রিস্ক কোনো
ডিসট্রিবিউটারই না নেওয়ায় দুই খণ্ডে ছবিটি মুক্তি পায় ২০১১-১২ সালে।
এই মহাভারতের যেখানে আরম্ভ
সেখানে চল্লিশের দশকের পরাধীন ভারতবর্ষ। সেখানে ধানবাদ শহর। সেখানে শাহিদ খান পেট পালনের কারণে ‘সুলতানা ডাকু’ সেজে লুঠ করছে সরকারী মালগাড়ি
যে গাড়ি লুঠের ‘অধিকার’ – ধানবাদের ‘কুরেশী’দের মতে রয়েছে কেবল তাদেরি।
এই মহাভারতের নেপথ্যে যে কাহিনি, যার জন্ম সেই কৃষ্ণদ্বীপে, সেখানে ১৯৯৩ ইংরেজি। একটি ১৯ বৎসর বয়সের ছেলে উন্মাদ
হয়ে যাচ্ছে দিল্লীর কোনো এক চলচ্চিত্র উৎসবে ডেসিকা’র ‘বাইসাইকেল থিফ’ ছবিটি দেখে। সে তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে
চলচ্চিত্র পরিচালক হওয়ার । পাড়ি জমাচ্ছে বোম্বাই শহরে …
২।
এতোদূর ভূমিকা করে এইবার আমার
যাত্রা হবে আমার প্রতিপাদ্যের দিকে – যে প্রতিপাদ্য নির্মিত হয়েছে
আমার মর্মে,অজান্তেই। ছবিদুটি ( গেংস্ অফ্ ওয়াসিপুর পার্ট ১, পার্ট ২) ২০১২ সাল থেকে অদ্যাবধি প্রায় শতাধিকবার দেখবার
আবডালে আমার মর্মনির্মিত প্রতিপাদ্যটি হয়, এই, যে, ইচ্ছায় বা আকস্মিকতায় –
এই ছবিতেও
ছায়া ফেলেছে মহাভারত। কাহিনিতে। কথনে। অতএব চিত্রভাষাতেও তা হয়েছে প্রতিফলিত আর সেই ছায়াপাত অঘোষিত এবং অবলীল। - এই ছায়াটিকে ধারণ করার
আবডালে এই চলচ্চিত্রটিও হয়ে উঠেছে একটি এপিক।
...” এই চলচ্চিত্রটিও হয়ে উঠেছে একটি এপিক” এই আমার মূল প্রতিপাদ্য। এইবার ইউক্লিডিয় জ্যামিতির
নিয়মে, হে পাঠক প্রয়াস নেই এই
প্রতিপাদ্যের সত্যাসত্য নির্ণয়ে।
৩।
অনুরাগ কাশ্যপের প্রায় সমস্ত
ছবিতেই আমি খুঁজে পাই ‘ইটালিয়ান’ ‘নিও রিয়েলিয়েলিজম’এর সঙ্কেত। রসোলিনী বা ডেসিকা’র মতন অনুরাগের ছবিতেও আবহ পালন
করে এক বিশাল ভূমিকা। রসোলিনির ছবিতে যেমন যুদ্ধ বিধ্বস্ত রাজপথ নির্মাণ করে আত্মহত্যার আবহ অথবা
ডেসিকার উম্বের্তো ডি’তে যুদ্ধবিক্ষত প্রাসাদোপম
বহুতল চালচিত্র হয় প্রোটাগোনিস্ট ‘ডি’র নিঃস্বতার এবং যার নিরিখে দৃশ্যটি পায় বিস্তির্ণতর
মাত্রা তেমনি “গ্যাংস্ অফ্ ভাসিপুর”এ চল্লিশ থেকে নব্বই’র দশক অব্দি সময়ের পট
পরিবর্তনের ইঙ্গিত হিসাবে বড় রাস্তায়, বস্তি অঞ্চলের গলির দেওয়ালে সাঁটা সিনেমা পোস্টারের
মৃদু ব্যবহার, বিশেষ সময়ে জনপ্রিয় বিশেষ টিভি সিরিয়েল ও সিনেমার সূক্ষ্ম
প্রয়োগ দৃশ্যগুলিকে এবং অন্তিম প্রস্তাবে গোটা ছবিকেই দেয় বিস্তির্ণতর মাত্রা।
‘ইটালিয়ান’এবং ‘নিও রিয়েলিয়েলিজম’শব্দদুটির প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হয় এই হেতু, যে, তাঁর নির্মাতা চরিতের দিকে
তাকালে আপাতভাবে মনেহতেই পারে যে অনুরাগের ছবিতে ছায়া ফেলেছে ‘ফরাসী নিউ ওয়েভ”ও। আদতে তা হয়ত সত্য নয় কেননা ‘ফরাসী নিউ ওয়েভ” যেভাবে মার্ক্সবাদী বিশ্ববীক্ষাকে প্রয়োগ করেছে
অনুরাগ এতাবৎ সেই পথে যাননি। বিশেষত: এইছবিতে তো নয়ই। ইতিহাসের গতিপথে উৎপাদন ও বণ্টন
ব্যবস্থার ভূমিকাকে স্বীকার করে নিয়েও অনুরাগ আসলে হেঁটে গিয়েছেন মহাকাব্যেরই দিকে
যা ‘ফরাসী নিউ ওয়েভ” এর বিপরীত না হলেও অভিপ্রেত ছিলনা আবার যা ‘ইটালিয়ান’ ‘নিও রিয়েলিয়েলিজম’এ এসে পড়েছে অবলীলায়।
অনুরাগের ছবিতে ১৯৪৭ সালে
প্রাপ্ত ভারতের “স্বাধীনতা” ও তৎপরবর্তী অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন বাহিত ব্যক্তি মানসিকতার, মনস্তত্ত্বের পরিবর্তন এবং এই ব্যক্তি
মানসিকতার পরিবর্তন হেতু গোষ্ঠীর পরিবর্তনের দ্বান্দ্বিকতা ফিরে ফিরে আসে। -তবে এতাবৎ এ’র গভীরতম প্রকাশ- কাহিনি-মাধ্যমে, চিত্রভাষায় ‘গেংস্ অফ্ ওয়াসিপুরেই’।
“অপেশাদার” বা বলা ভালো “পর্দাসফল” অভিনেতা অভিনেত্রীর প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনুরাগ এতাবৎ ‘গ্ল্যামার এক্টর’ প্রায় ব্যবহারই করেননা ছবিতে। বরং নাওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকির মতন সাংঘাতিক বড় মাপের
অভিনেতা যিনি এতাবৎ ছিলেন দর্শকচক্ষুর প্রায় আড়ালেই তাঁকে অনুরাগ হাজির করেন দর্শক সকাশে। প্রোটাগোনিস্টের ভূমিকায়। অতঃপর বলিউডচাল কিংবা অন্য যেকোনো হেতুর অহেতুকতায়
নাওয়াজুদ্দিন যদি কোনোদিন শাহরুখ খান হয়ে ওঠেন
তবে সেই দায় অনুরাগের নয় অবশ্যই।
৪।
“গ্যাঙ্গস অফ বাসিপুরে”র আরম্ভই ভীষ্মকে অমান্য করে। ভাসিপুরের বৃদ্ধ প্রধানের উপদেশকে লঙ্ঘন করে ।
কুরেশীরা শাহিদ খান কে উৎখাত
করলো। কুরেশীদের দাবী তারা ভূমিপুত্র। শাহিদ “কুরেশী” বংশোদ্ভূত নয়। তবে শাহিদ খানও মুসলমান। উভয়েপক্ষই “সুন্নি”। শাহিদের দাবী অস্তিত্বের দাবী। সেই দাবীতেই তার “সুলতানা ডাকু”র ছদ্মপরিচয়ে রেল ডাকাতি। কুরেশীরা শাহিদের এই “দাবী” দিলো খারিজ করে। অথচ সেই বৃদ্ধ প্রধানের প্রতি ভরসা ছিল শাহিদের। সুতরাং যখন তাঁর কাছে দরবার
বসলো শাহিদ হাজির হলো মৌন এই দাবী নিয়ে, যে, যাপনের প্রয়োজনের কাছে সে অসহায়। অতএব ...
বৃদ্ধ বলেওছিলেন মারামারি, কামড়াকামড়িতে না গিয়ে , যেহেতু জীবনধারণের অধিকার এ
সসাগরা ধরণীতে প্রত্যেকেরই, অতএব শাহিদ ডাকাতি বন্ধ করুক। ডাকাতি চালাক কুরেশীরাই। তবে প্রতি ডাকাতির অন্তে
কুরেশীরা কিছু কিছু “আনাজ” দিয়ে আসবে শাহিদকে । এ যেন শাহিদকে পাঁচটি গ্রাম নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে বলা। শাহিদও সম্মত হয়েছিল তাতে । কিন্তু “বিনাযুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী” নব প্রজন্মের কোরেশীরা তাদের
বৃদ্ধ গ্রামপ্রধানকে অমান্য করে এই প্রস্তাব ঘোষণা করলে শাহিদ বাধ্য হল এই বসতি
ছেড়ে উঠে যেতে ।
এই বৃদ্ধ কেন আমার মনে নিয়ে আসেন ভীষ্মকে? মনের গতিক জানেন না মন নিজেও। আর আমরা, অভাজনেরা, বাইরে থেকে আমরা তার গতির নিরিখের অনুমানই করতে পারি
শুধু। সিনেমা এই কারণেই “ভিসুএল মিডিয়াম”। বৃদ্ধের শুভ্র কেশে, শুভ্র শিরবেষ্টনীতে, বলীরেখায়, মুখময় বয়সের উর্ণনাভ জালে, চশমায়, দৃষ্টির তীক্ষ্ণতায় আদতে মনে পড়েছিল Sotigui Kouyaté ( বাংলায় কি বানান, কি উচ্চারণ হবে তা নির্ণয় আমার
পক্ষে অসম্ভব ) কে যিনি পিড়াত ব্রুকের মহাভারতে ছিলেন ভীষ্মের ভূমিকায়। পশ্চিম
আফ্রিকার এই অভিনেতার উপস্থিতির আবহে যেন সতত থাকে এক অদৃশ্য চালচিত্র যা নীরবে ঘোষণা
করে “Tribal Wisdom” এর সত্যকে। - ওই সূত্র ধরেই মনে আসেন ভীষ্ম, আলোচ্য এই চলচ্চিত্রেও। এই ভীষ্মও বলেন রক্তপাতের অসারতার কথা।
কিন্তু কৌরবেরাও যেমন ভীষ্মের Wisdom কে ফুৎকারে প্রত্যাখান করেছিল এখানে এই কোরেশীদের ক্রোধের মর্মেও ক্রিয়াশীল সেই অহংকারই যা তার পিতা রাজা বলে, ছিল দুর্যোধনের । হয়ত ন্যায্যতই ছিল এই অহং, এই অধিকার বোধ – কৌরবদের। কোরেশীদের। তথাপি রক্তক্ষয়ের অসারতার কথা
বিস্মৃত হয়েছিল কৌরব, কোরেশী – দুই পক্ষই। দুই ভূগোলের। দুই যুগে।
পক্ষান্তরে পাণ্ডবেরা- যারা মূলত: নয় কুরুপক্ষের কারোরই ঔরসজাত-তাদের প্রতিশোধস্পৃহা । তবে পাণ্ডবদের তুলনায় শাহিদ খান’কে স্বীকার করে নিতে হয় নিরীহতর কেননা সে সত্যই চেষ্টা
নিয়েছিল, ভিনগ্রামে গিয়ে তথাকথিত “সৎ পথে “ জীবন যাপনের।
কিন্তু সেখানেও বাদ সাধল তার
নিয়তি । সে খুন হল। খুনের প্রতিশোধ নিতে প্রস্তুত হলো তার পুত্র সরদার খান। ক্রমে কোরেশী আর না-কোরেশীদের লড়াই মোড় নিল এক ত্রিমুখী যুদ্ধে। কাহিনির আরেক প্রস্থানবিন্দু সূচিত হল এই পর্বে। যেন
জীবনানন্দ, যেন “এক বগল মে চান্দ হোগি”র চাঁদ বলে উঠল:
যেখানেই যাও চলে, হয় নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর;
এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনি ধূসর
ম্লান চলে দেখা দেবে যেখানেই যাও বাঁধো গিয়ে আকাঙ্ক্ষার ঘর!’
—বলিল অশ্বত্থ সেই ন’ড়ে ন’ড়ে অন্ধকারে মাথার উপর ।
এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনি ধূসর
ম্লান চলে দেখা দেবে যেখানেই যাও বাঁধো গিয়ে আকাঙ্ক্ষার ঘর!’
—বলিল অশ্বত্থ সেই ন’ড়ে ন’ড়ে অন্ধকারে মাথার উপর ।
(বলিল অশ্বত্থ সেই, জীবনানন্দ দাশ)
৫।
‘মাফিয়া’, ‘কয়লা মাফিয়া’ যে আগেও ছিল তা আমাদের বলেছেন অনুরাগ। দেখিয়েছেনও।
১৯৪৭ এর পরে শুধু যা ঘটলো তা এই মাফিয়াদের প্রভুদের নামগুলি পরিবর্তিত হল মাত্র।
মাফিয়াদের কর্ম প্রণালী ও নিত্যকর্মে পরিবর্তন কিছুই ঘটল না। পরিবর্তন বলতে তারা
ছাড়পত্র পেলো আরো বেশী অত্যাচারের। নৃশংসতার। যে কয়লা মাফিয়া’র কারণে একদা শাহিদ খান অক্ষম হয়েছিল নিজ পত্নীর
মৃত্যুশয্যার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে, যে কয়লা মাফিয়া’র একজনকে প্রকাশ্যে সে হত্যা করেছিল – সে’ই শাহিদ খানই এবার “স্বাধীন” ভারতবর্ষের “কয়লা মাফিয়া”। - শাহিদের এই স্বাভাবিক “মেটামরফোসিস” শ্রেণী চেতনার উন্মেষ ও বিকাশধারার বিশ্লেষণের
প্রক্রিয়ায় যোগ করে দেয়না’কি আরেকটি মাত্রা?
“মেটামরফোসিস” উত্তর শাহিদ খান’কে আমরা প্রথমে দেখি আগুনের আবহে যেখানে সে তার একদা “কমরেড” খনি শ্রমিকদের ঝুপড়ি পোড়ানোর তদারকি করছে মালিকের
হয়ে। পরের দৃশ্যেই জল। ঝড়জল। বৃষ্টি। তুমুল।
আগুন ও জলের এই প্রয়োগ আমাকে
মনে করায় মহাকাব্যে আগুন ও জলের প্রয়োগ। বুদ্ধদেব বসু তাঁর “মহাভারতের কথা”র দশম পরিচ্ছেদ “আগুন-জলের গল্প”তে বিষয়টি যেভাবে বিশদ করেছেন তার অন্তর্যাস, হয়, এই, যে, আগুন ও জল এই দুই বিপরীত শক্তির
মিলন ও দ্বন্দ্বের মর্মে মহাকাব্য রচয়িতাদের নানান গহন ইংগিত সমাচ্ছন্ন।
আগুন ও জলের ভিতর দিয়ে শাহিদ
খান’কে এনে তারপর তাকে তার মৃত্যুর
দিকে ঠেলে দিয়ে অনুরাগও কি রেখেছেন কোনো প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত? জানিনা। তবে অনুভব হয় ওই দুই বিপরীত আবহে, পর পর দুটি শটে শাহিদ’কে না দেখলে তার “মেটামরফোসিস”, অন্তত: আমার মর্মে, পর্দায় হয়ে উঠতনা ততোদূর গ্রহণযোগ্য।
অনুরাগের চিত্রভাষা এভাবেই,ক্রমশ:, কাহিনির মহাকাব্যিক বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে, হয়ে উঠেছে মহাকাব্যিক।
৬।
যে কাহিনির আরম্ভ কোরেশী আর
পাঠানদের সংঘাতে, যার বিস্তার রামাধীর সিং নামক
নব্য খনি মালিকের সঙ্গে শাহিদের দ্বন্দ্বে – সেই কাহিনির পরিণতি ও পরিণাম অবশেষে কোরেশী-খান-রামাধীর’এর এক ত্রিমুখী লড়াইয়ে।
রামায়ণ ও মহাভারত উভয়ই মূলত:
ত্রিমুখী যুদ্ধের কাহিনি ।
রামায়ণে রাবণের প্রতি তার
প্রতিশোধস্পৃহা নিবৃত্ত করতে রাম সঙ্গে নিল সুগ্রিবকে। অথবা বলাযায়, যে, বালিকে হত্যা করে সিংহাসনে
বসবার বাসনায় সুগ্রীবই আঁতাত করল রামের সঙ্গে । অন্তিমে নিরপরাধ রাবণ, যে মূলত: অকারণে অপমানিতা তার ভগিনীর অপমানের শোধ তুলতেই বন্দী করেছিল সীতাকে, হলো ধ্বংসপ্রাপ্ত। রাবণ ধ্বংস হল ঠিক। কিন্তু রামের জীবনেও আর পূর্বের
শান্তি ফিরে এলনা । কিন্তু সুগ্রীব তার রাজ্য চালাতে লাগল সুখেই।
মহাভারতেও যাদব বংশকে শক্তিশালী
করবার কূট “ধান্দা”তেই কৃষ্ণের পাণ্ডব শিবিরে যোগদান । মূলত: । জরাসন্ধ, কংস ইত্যাদির ক্ষমতায় শঙ্কিত, চিন্তান্বিত কৃষ্ণ, বলরাম বা নেতাশ্রেণির অন্যান্য যাদবগণের মনস্তত্ত্ব
খোদ মহাভারত ছাড়াও সংখ্যাতীত মহাভারত ব্যাখ্যাতার মসীতে বিবৃত। অতএব কোনো বিশেষ রেফারেন্স
দর্শানো এক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয়। বরং দেখা যাক কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের নিয়তির দিকে।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরবরা হল
ধ্বংসপ্রাপ্ত । পাণ্ডবরা রাজত্ব পেলেও তার আড়ালে তাদের সন্তান বিয়োগের, আত্মীয় বিয়োগের শোক ছিল প্রবহমান । কিন্তু যাদব বংশের কোনো “core member” ই কিন্তু নিহত হয়নি কুরুক্ষেত্র
যুদ্ধে । যদিও পরবর্তীতে যদুবংশও ধ্বংস হয়েছিল- তথাপি তাৎক্ষণিক ভাবে
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ যাদবদেরকেই এনে দিয়েছিল সবচেয়ে বেশি লাভ। প্রচুর আখের।
অনুরাগের ছবিতেও কোরেশীদের
সঙ্গে সরদার খানের বা তার পিতা শাহিদ খানের দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে রামবীর সিং
চেষ্টা নিয়েছিল তার নিজস্ব “যাদব বংশ” কে শক্তিশালী করে তুলতে । এই ত্রিমুখী যুদ্ধের অন্তর্গত সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার ইঙ্গিত অবশ্যই অনুধাবনীয়। কিন্তু
এই মুহূর্তে তা আমার নিজস্ব প্রতিপাদ্য, যাকে যাচাই করে নিতেই এই অক্ষরপ্রচেষ্টা, তা ব্যাহত হবে যদি লিপ্ত হই সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণে। পরিবর্তে দেখা যাক এই ত্রিমুখী
লড়াই কাহিনিকে উর্বর করেছে কি কি অনবদ্য সম্ভাবনায়, চরিত্রে।
যে কাহিনির আরম্ভ কোরেশী আর
পাঠানদের সংঘাতে, কোরেশী পরিবারের সঙ্গে খান
পরিবারের বৈবাহিক সম্বন্ধের মধ্য দিয়ে অবশ্যই ইতি হতে পারত ওই “ক্রনিক” গৃহযুদ্ধের । কিন্তু বাদ সাধল “সুলতান কোরেশী” ।
সরদার-পুত্র দানিশের সঙ্গে নিজ ভগিনীর বিবাহ যখন সে আপ্রাণ চেষ্টাতেও আটকাতে পারলোনা
তখন সে নিজ আত্মীয়বর্গকে ত্যাগ করে চলে গেল । রামবীর সিং তাকে, ভবিষ্যতে, কোরেশী ও খান পরিবারের মধ্যে এই বৈবাহিক সম্পর্ক
স্থাপিত হওয়ার পরও, আর “মদত” করবে কি না এহেসান কোরেশীর কাছে অন্তত: তখন তা ছিল
অনিশ্চিত । বরং “কোরেশী-খান” জোট যে তাকে যে কোনো মুহূর্তে নিঃশেষ করে দিতে পারে এই
ছিল প্রকৃত বাস্তবতা। টের পাওয়া সত্বেও সে “রাজ্যের আশ্বাস” বা নিরাপত্তার প্রয়োজনে যোগ দিলনা নিরাপদ শিবিরে । - এই অর্থে সেও “জিহাদী” । ‘যে পক্ষের পরাজয় , সে পক্ষ ত্যাজিতে মোরে করনা
আহ্বান’ ...
জিহাদি কর্ণের মতোই তারো মৃত্যু
অসহায় ভাবে । ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে সূর্যদেব এসে ভিক্ষা করে নিয়ে গিয়েছিল কর্ণের কবচ কুণ্ডল
আর এখানে, এই গল্পে, ফয়জল খানের পালিত গুপ্তচর, সুলতান যখন মসজিদে, নামাজনিরত তখনি,মশজিদের পাঁচিলের কিনার ঘেঁষে দাঁড় করানো তার গাড়ীর
ড্যাশ্বোর্ডে রাখা পিস্তল থেকে সবগুলি গুলি খুলে নিয়ে চলে গেল । অতএব আক্রান্ত হওয়ার পর সুলতান কোরেশী আত্মরক্ষাহেতু বৈধ যুদ্ধেরও সুযোগ
পেলোনা ।
৭।
এই ত্রিমুখী যুদ্ধের করাল
ছায়াপাত ঘটেছে অন্তঃপুরেও। রামাধীর সিং এর অন্তঃপুরের খবর তেমন কিছু জানান না
অনুরাগ। মূলত: কোরেশী আর খান পরিবারের নারীচরিত্রদের নানান মাত্রায় উন্মোচিত করে
এই কাহিনি।
নারী চরিত্রদের মধ্যে দুর্গা ব্যতীত
অপর প্রত্যেক প্রধান নারী চরিত্রই নিজ পতির প্রকৃত সহধর্মিণী।
দুর্গা সেই মেয়ে যাকে শয্যাসঙ্গিনী করেছিল সরদার খান। তখন সে বিবাহিত। সে
পালিয়েছে জেল থেকে আর সেই পালানোর প্রক্রিয়ায় তার স্ত্রী নাগমা ও তাদের বড়ছেলে, তখন যে সদ্য কিশোর, নিয়েছে মুখ্য ভূমিকা। কিন্তু দুর্গার দেহ সৌষ্ঠবের
আকর্ষণ, তার পলাতক ও নারীহীন জীবনে, এড়িয়ে যেতে পারেনা সরদার খান।
সরদার খান দুর্গাকে স্ত্রীর
মর্যাদা দেওয়ার পরেও, দুর্গার গর্ভে নিজ
সন্তানোৎপাদনের পরেও সরদারের প্রথমা পত্নী নগমা “সংকটে সম্পদে” পতির পার্শ্বে থাকে সরদার খানের “পিতৃহত্যার প্রতিশোধ” ব্রতের সহায় হয়ে যে “ব্রতে” সে ছিল বিবাহের প্রথম দিনবধি- সরদার খানের সহায়।
একইভাবে নগমার পুত্রবধূ – এহসান কোরেশীর ভগ্নি সমা পারভিন
সেও কোরেশী খান গৃহযুদ্ধের পুনর্সূচনায় , পতিরই অনুগামিনী । পরিণামে তাকে প্রাণ দিতে হয় নিজ
ভ্রাতা সুলতান কোরেশীর গুলিতে।
দুর্গা ভিন্ন অপর নারী
চরিত্রগুলির সপত্নী ছিলনা আর দুর্গার সপত্নী নগমা,হয়তোবা মুসলমান সমাজে বহুবিবাহের বৈধতার দরুনই,অভিমানসহ হলেও,অন্তিমে,মনে মনে, দুর্গাকে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু দুর্গা কদাপি পারেনি
সপত্নীর অস্তিত্বকে পরিপাক করতে। পরিপাক করতে পারেনি সরদার খানের দ্বারা তার
গর্ভসঞ্চার। এই পরিপাক করতে না পারার মূল্যে এই চরিত্রটিতে এসেছে অন্য মাত্রা যা
অপর নারী চরিত্রগুলিতে অনুপস্থিত।
দুর্গা হয়তবা গোপনে রামবীরের
অঙ্কশায়িনীও হয়েছিল সরদার খানের অনুপস্থিতিতে । তার সরদার খানের প্রতি যে ক্রোধ
তা কেবলই সপত্নী ঈর্ষা নয় । সে গর্ভবতী হতে চায়নি । সে মূলত: উপভোগ করতে চেয়েছিল
নিজ যৌবনকে। যৌনতাকে। সে স্পষ্ট বলেওছিল, যে, সে নাগমা’র মতো “বেলুন” হতে চায়না বছর বছর। কিন্তু তাকেও “বেলুন” বানিয়ে দিয়ে বাদ সাধল সরদার খান । তদুপরি সরদার খান হলনা তার একা’র সম্পত্তি ।
নগমা খাতুন যেন এখানে গান্ধারী । সে এক গামিনী । পক্ষান্তরে সে কুন্তীও বটে।
কুন্তীরই মতন সে পুত্রকে ভর্ৎসনা করে, উত্তেজিত করে যুদ্ধে।
আবার দুর্গার সঙ্গে কুন্তী চরিত্রের প্রাথমিক সাদৃশ্য এই, যে, সে’ও কুন্তীরই মতন বহু অঙ্কশায়িনী- ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় । দ্বিতীয়ত সে’ও যুদ্ধই চায় কুন্তীর মতন। সে
তার ক্রোধের নিষ্পত্তি ঘটাতে নিজ পুত্রের নাম পর্যন্ত দেয় “ডেফিনিট” – কেননা সে চায় ঐ পুত্রের জীবনের লক্ষ্য হোক সরদার
খানের পতন । যেহেতু সরদার খান ততদিনে দুর্গারই চক্রান্তে মৃত , অতএব ডেফিনিটকে সে ব্যবহার করে সরদারের বংশ ধ্বংস করতে – ঠিক যেমন কুন্তী যুদ্ধে অনিচ্ছুক যুধিষ্ঠির কে যুদ্ধ প্ররোচনা দিয়ে যায়
অন্তিমাবধি ।
৮।
ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে “গ্যাঙ্গস অফ ভাসিপুর” এমনই এক মাইল ফলক যা অনুরাগ
নিজেও আর পার হয়ে যেতে পারবেন কি’না কেজানে। পাঠক, এই ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, যে, এই রচনাটি যখন লিখিত হচ্ছে তখন “গ্যাঙ্গস অফ ভাসিপুর”-উত্তর “বোম্বে টকিজ”, “আগ্লি”, “বোম্বে ভেলভেট” থেকে “রমণ রাঘব” পর্যন্ত ছবিগুলি অনুরাগদ্বারা নির্মিত ও দর্শক সমক্ষে
মুক্ত হয়ে গেছে। এই ছবির প্রতিটি চরিত্র দাবী রাখে বহুমাত্রিক বিশ্লেষণের। চিন্তার। এই ছবি
বারবারই মনে আনে ‘মহাভারত’কে। পাঠক, সরদার-পুত্র “পার্পেন্ডিকুলার”এর নিধনদৃশ্য কি মনে এনে দেয়না
অভিমন্যু বধের কাহিনিকে? –এই মনে এনে দেওয়ার আবহ কেবল কাহিনিচালিত
নয়। ক্যামেরা চালিত। পার্পেণ্ডিকুলার বন্ধুর সঙ্গে মোটর সাইকেলে বাড়ি ফিরছে। তিন
মিনিটের একটি শট – মূলত: হলদেটে আলোর আবহে। কাট্।
এবার আবহ নীল। আরো দু মিনিট। গপ্পে মশগুল দুই বন্ধু। তারপরই মুহূর্তে চক্রব্যূহ।
গাড়ির হেডলাইটের আলোতে নীলাভ আবহ বিখণ্ড। টানা শট নেই এখানে। কাটা কাটা। কাট্
কাট্ ... সুলতান কুপিয়ে কাটছে পার্পেণ্ডিকুলার। ক্যামেরা উঠছে নামছে কাটারীর
সঙ্গে সঙ্গে ...
এমনি আরো অনেক দৃশ্যের, চরিত্রের অবতারণা করা যায় অবশ্যই। কিন্তু আপাতত: তার
প্রয়োজন নেই যে প্রতিপাদ্যটির যাথার্থ্য সন্ধান ছিল আমার এই অক্ষর প্রচেষ্টার
মর্মে, যে প্রতিপাদ্যটি হয়, এই, যে, ইচ্ছায় বা আকস্মিকতায় – এই ছবিতেও ছায়া ফেলেছে মহাভারত। কাহিনিতে। কথনে। অতএব চিত্রভাষাতেও তা হয়েছে প্রতিফলিত আর সেই ছায়াপাত
অঘোষিত এবং অবলীল। - এই ছায়াটিকে ধারণ করার আবডালে এই চলচ্চিত্রটিও হয়ে উঠেছে একটি এপিক – তা সম্ভবত: প্রমাণিত।
তবে যে দুটি দৃশ্যভিন্ন ছবিটি
কোনোভাবেই এপিক হতে পারত না তার প্রথমটি রাত্রির নিঝুম ছাতে ফয়জলের আত্মোপলব্ধি আর
তার কথন নিজ পত্নী মহসিনার কাছে। অন্যটির কথা বলার আগে বলে নিই যে ছবিটির প্রতিটি
সংগীত, আবহ সংগীতও তেমনি এপিক।
দুর্গাপুত্র ডেফিনিট এসেছে ফয়জলের দেহরক্ষী হয়ে। অন্তর্গত উদ্দেশ্য ফয়জলের নিধন।
ডেফিনিট গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ফয়জলকে। আবহে যে গান হচ্ছে তার ইংরেজি অনুবাদ
(সাবটাইটেলে) এই:
I'm the Devil's son,
raised in the laps of witches.
I'm the keeper of graves,
dogs are my supper.
That's funny 'cos humans like you
are just a snack for me.
I'm the Serpent King, a vulture...
I'm disease and filth.
So what? I'm a cannibal...
I don't even spare cattle feed.
You don't scare me...
I sold the deed I made with the Devil.
Fuck your deed!
I just sold the fucking Devil himself!
পাঠক, এই গান, গানের কথা, সুর – যদি মনেপড়ায় ম্যাকব্যাথের ডাইনীসংগীত তাহলে এই মনেপড়া
কি অন্যায্য?
অন্তিমে বলি সেই দ্বিতীয় দৃশ্যটি যা ছবিটির এপিক
চরিত্রকে সম্পূর্ণ করেছে –
এই দৃশ্যে আবার সেই গান যা দিয়ে
আরম্ভ হয়েছিল শাহিদ খানের যাত্রা:
I dream of a bejeweled moon, and some warm bread.
I dream of gentle sleep, and a lullaby in my head.
My dear moon...
এই বার এই গানকে আবহে রেখে নিহত
ফয়জলের শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে এই মহাভারতের যে বিদুর, সেই নাসির খান। এই ভূগোল ভাসিপুর থেকে অনেক দূরে।
বোম্বাইতে। ইস্টিশানের কাছাকাছি। চলেযাচ্ছে রেলগাড়ি। ফয়জল পত্নী মহসিনা এসেছে
স্নান সেরে।
নাসির খানকে দেখে মহসিনা যে
মাথায় ঘোমটা দিচ্ছে তার হেতু কী? সে’কি শ্বশুরস্থানীয় নাসিরের প্রতি তার স্বাভাবিক সম্মান
প্রদর্শন। না’কি ...
... যেটাই হোক, অন্তিমে এই দৃশ্য এনেদেয় সেই ইঙ্গিত যার মর্মে
শোনাযায় জীবনানন্দের স্বর:
“এই পৃথিবীর রণ,রক্ত,সফলতা সত্য
তবু শেষ সত্য নয় ...”
ছবি ফুরায়।
কিন্তু কাহিনি ফুরায় কি? ফুরায় কি মহাকাব্য? কোনোদিন?
৩রা সেপ্টেম্বর – ৭ই নভেম্বর ২০১৬
বেঙ্গালোর
আরেক ঠিকানা:


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন