“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ২৪ মে, ২০১৭

অনুরাগ ভৌমিক এর ১৫ টি অনুগল্প

।। অনুরাগ ভৌমিক ।।
ব্লগ পোষ্টঃ +Rajesh Chandra Debnath 
 
ধনা
........
"টেহা থাকবো পইরা,
মানুষ যাইবো মইরা ।"
কথা গুলি যে বলছে সে একজন দিন মুজুর,গাছ কাটে । কারো বাড়িতে গাছ ছাটানো,গাছের ডালা কেটে চেলি করা ইত্যাদি কাজ তার । পাগল নয়,সন্ধ্যার পর একটু বাংলা খায় আর নানা ছড়া আওরাইতে আওরাইতে বাড়ির দিকে চলে ।
ব্রিজের কাছে যে লোকটি বসে সবজি বিক্রি করে তিনি খুব ভালো মানুষ । অনেক কষ্ট করে দূরের বাজার থেকে সবজি কিনে এনে এখানে বেচেন । আমি প্রায়ই তাঁর থেকে কিনি,
অনেক গল্প ও করি । বয়স্ক লোকদের থেকে অনেক জানা যায়,তাই ।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ । এক ভদ্র মহিলা জিজ্ঞেস করে" কচুর লতি কত?"তিনি বলেন "কুড়ি টাকা মোডা"
দশ টাকা মুলিয়ে চলে যাচ্ছেন তিনি । তখনই অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা সে আপন মনে বলছে ছড়াটা । অনেকে আমার মতো হাসছে ।
মাঝে মাঝে সে গানও গায় । বিরহের গান,দেহ তত্ত্বের গান । কোনো কোনো সময় বুক পকেটে মোবাইলে কীর্তন বাজে ।
কৌতুহলাসক্ত হয়ে তার সম্বন্ধে জানতে চাই । সবজি বিক্রেতা লোকটি বলেন,"তার নাম 'ধনা',থাহে পূর্ব গকুলপুর । গায়ে বায়ে এক সময় অসুরের মতো আছিল,এখনতো
সে তুলনায় কিছুই নাই । তবে তার দুঃখ আছে অনেক । এক সময় বৌ আছিলো,পুলা আছিলো,সে প্রায় দশ বার বছর আগের কথা । কী যে হইলো ব্রিজের কাজ করার জন্য কলিকাতা থাইকা একটা ছেলে আইছিলো,তার সাথে ভাইগ্যা গেছে টেহা পইসা,ভালো খাইবো পরবো এই লোভে । তারপর থাইক্যা 'ধনা' সন্ধ্যার পর একটু পাগলামী করে । কারো সাথে মারামারি করে না,নিজের মনে ছড়া আর গান গায় । তবে পরের উপকার করে খুব । মাঝে মধ্যে আমার ইহানে বয়,খুব কষ্টের থাইক্যা কয়,"দাদা পুলাডারে একটু দেখতাম ইচ্ছা হয় ।"জীবনে আর কোনো সাধ আহ্লাদ নাই ।"কত কইছি আর একটা বিয়া কর,তে শুনে না ; কয় "খুব ভালবাইস্যা শিপ্রারে বিয়া করছি,কারোরে এমন ভালোবাসতাম পারতাম না ।"চোখে জল ও আইয়া পরে ।"
এই পেঁপে কত?এক ভদ্রলোকের ডাকে আমাদের কথোপকথন শেষ হয় । "বিশ টেহা কেজি ।" আমাদের আগরতলা আরো অনেক কম,পোজা বইয়া এতো দাম দিয়া নিয়ে কী লাভ?"
"চললাম দাদা,"
"আইচ্ছা,"
তিনিও গুছাতে শুরু করলেন তার মালগুলি । "আমারে করলা পরদেশী"গাইতে গাইতে 'ধনা' ব্রিজের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়...
...............................................................


চিঠি
........
"তুই আমার বাড়িত থাইক্যা বাইর হ,তুই আওনের পর থাইক্যা আমার ঘর অ যত অশান্তি/"এমন কথা বলতে পারলো দাদা,খুব আঘাত লেগেছে বাসন্তীর মনে/যে দাদা একটা তুচ্ছ চকলেট ও ভাগ করে খেতো...
খুব কাঁদে/যে নদী তার বাল্য কালের সহচরী,তার পারে বসে/এখানে এসেই একটু শান্তি পায় সে/দুঃখ সুখের কথা বলে নদীটির কাছে,নদীটিও তার সাথে কথা কয়/
বৌদি একটা অপবাদ ছড়িয়ে দেয়,পাড়ার বৌ মারা পরিমলের সাথে নাকি বাসন্তীর ফষ্টিনষি্ট/এ ছাড়াও প্রতিক্ষণ কোনোনা কোনো ত্রুটি ধরে,শুধু গায়ে পড়ে ঝগড়া করে/
দুবছর আগেও অবস্থা এমন ছিলোনা/অরুণ রাজ মিস্ত্রীর কাজ করতো/ভালো রোজগার/দুই ছেলে নিয়ে সুখের সংসার/সইলো না বেশিদিন/বিল্ডিং এর কাজ করার সময় পাঁচতলার ছাদ থেকে পড়ে মারা যায়/কেউ কেউ বলেছে গোপন শত্রুতা/সেই থেকে বাসন্তী দাদার এখানেই/
"তোরা অনেক বড় হ,মানুষ হ,অন্যের গলগ্রহে যাতে বাঁচতে না হয়/এ জীবন মানুষের সেবায় নিয়োজিত হোক/ভালো করে মনদিয়ে পড়াশোনা করবি/আশ্রমে বলেছি তোরা মা বাবা হীন/তাই যখন অনেক বড় হবি,আসবো দেখা করতে/নিয়ে যাবো তোদের..."
কিছুক্ষণ আগেই চিঠিটা পোষ্ট করে আসে/ভাদ্রের দুপুর/নির্জন/আজ মাকে খুব মনে পরছে তার,অরুণকেও/ছেলে দুটোকে একবার দেখতে ইচ্ছে করছে/দূরে কাশ ফুল দোলছে/হুহু করে বাতাস আসে/ধীরে ধীরে সে নেমে যায় নদীর বুকে/চারদিক থেকে জল এসে মুছে দেয় চোখ/শব্দ করে বলে উঠে গোমতী "কোলে আয়...
...............................................................
কাক
.........

সকাল বেলা খুব চিৎকার করছে শালিক দুটো/রাজ মহল এপার্টমেন্টের দু একজন ছাড়া অন্যেরা ঘুমাচ্ছে এখনও/রিতা এমন সময় দুতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ায়/সোনালী ওড়নার মতো রোদ ছড়িয়ে আছে চারদিকে/দেখে অদূরের কদম গাছের মতো একটা গাছের তলায় শালিখ ছানাটা পড়ে মরে আছে/মা আর বাবা শালিখ দুটো চিত্কারে ভরিয়ে দিচ্ছে আকাশ/একবার উড়ে আসে মাটিতে,আবার গিয়ে বসে গাছের ডালে,বাসার কাছে/সদ্য সন্তান হারানোর অসহায় কান্না/খুব কষ্ট হচ্ছে রিতার/
এখানে এসেছে প্রায় পনর বছর/সাগর তখন নার্সারি তে পড়ে/রিতা প্রথমে আসতে চায়নি/সায়ন্তন ফ্লেট কিনেছে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই/বাবার চিন্তা ছেলেকে ভালো এডুকেশান দেওয়া/
বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে পর পর দুটো সন্তান/ছেলে/সাগর আর সজল/খুব সুখের সংসার/অতীত ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারেনা,একা থাকলে অনেক সময় মনে পরে/সেই কষ্টের দিন/সারাদিন খুঁজেও ঐ দিন সজলকে পাওয়া যায়নি/দিনের শেষে অন্য পাড়ার একটা ছেলে রফিক এসে ঘরের পেছনের কুয়ো থেকে তুলে আনে সজলের নিথর দেহ/সায়ন্তনের এক কাকতো ভাইয়ের বাড়ি এক সীমানায়/সম্পর্ক ভালো ছিলো না দু পরিবারের/এর পেছনে তাদের অদৃশ্য হাত,এমন ভাবতো অনেকে/মনে হলে হাউ মাউ করে কাঁদে আজও রিতা/
পরদিন একটা কাক আসে তাদের বাড়ি/আম গাছটায় বসে ডাকে/বিদারিত চিত্কার করে/বারান্দায় বসে কাঁদছিলো রিতা/কিছু খাবার দিলো কাকাটাকে/তার মনে হয়েছে সজল যেন এসেছে/এর পর প্রতিদিন কাকটা আসতো/তাকে খাইয়ে মনে হতো সজলকে যেন কাছে পায়/প্রতিক্ষণ থাকতো আশেপাশে/অনেকেই তাদের বাড়ি আসলে দেখতে পেতো কাকটাকে/সায়ন্তন ও ব্যাপারটা লক্ষ্য করতো/মাঝে মাঝে চোখে জল আসতো/সাগরও ছোট ভাইয়ের মতো আদর করতো/
গ্রামের বাড়ি যে দিন ছেড়ে চলে আসে সেদিনও কাকটা এসেছিলো কী চিৎকার করেছে,এখনও মনে পড়ছে রীতার,আ হা হা/ঐদিন কিছু খায়নি সে/উড়ে উড়ে শুধু আকাশ ফাটানো চিৎকার করেছে/রীতার মনে হয়েছে সজলকে যেন একা ফেলে যাচ্ছে/তারপর কয়েকবার গিয়েছে সেই বাড়িতে,খুঁজ নিয়ে জেনেছে সেদিনের পর থেকে কাকটা আর আসেনি/
নিজের অজান্তেই দুফোঁটা চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়েছে/সায়ন্তন উঠে গেছে,সাগরকে ডাকতে যায় রিতা...
...............................................................
শ্রাবণ দিনে
..................

বিয়ের পরদিন সকালে চা খেতে খেতে টিভিটা ছাড়ে নির্মল,চোখ রাখে স্থানীয় চ্যানেলে/মনে পরে এমনই বর্ষামুখর শ্রাবণে কনে বৌ সেজে মালা চলে যায়,পাশের গ্রামে/
একই পাড়ার আলো হাওয়ায় বড় হয়েছে ওরা/পড়াশোনা ও একই ক্লাসে/তাদের কলঙ্ক চুড়িতে চুড়িতে বাজতো এক সময়/মালার ইচ্ছা ছিলো পালিয়ে যাবার,কিন্তু এই অল্প বয়সে মা ভাই বোনদের কথা ভেবে পিছিয়ে গিয়েছে নির্মল/কাপুরুষের মতো প্রেমের কাছে হেরে গিয়েছে সে/
নদীর ঘাটে প্রায়ই দেখা করতো তারা/পাট ক্ষেতের সরু আলপথ দিয়ে যাবার সময় হাত ধরে টান দিলে,সোজা বুকে জড়িয়ে ধরতো মালা/সে এক স্বর্গীয় অনুভূতি,আজ ও
ভুলতে পারেনা নির্মল/মালা বলতো"তুমি না একটা অশব্য"/
তারপর একদিন ভাগ্যকে নিয়ে চলে আসে এই শহরে/শুরু করে বাঁচার সংগ্রাম/গৃহ শিক্ষক হিসাবে আজ অনেক পরিচিত সে/দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে দশটা বছর/ভেবেছিলো বিয়েই করবেনা/কিন্তু বাড়ির বড় ছেলে...
খবর দেখতে দেখতে হঠাত আঁতকে উঠে,আবারও এক্সিডেন্ট, "অটো চালক গুরুতর আহত হয়,হসপিটাল যাওয়ার পথেই প্রাণ হারায়/"পর্দায় দেখাচ্ছে চালকের মৃতদেহ,পাশে চিৎকার করছে বছর ত্রিশের এক মহিলা/সঙ্গে আত্মীয়,পরিবার পরিজন/
চোখ ও কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে/তার বুকফাটা অসহায় চিৎকার কয়েক ফোঁটা নোনা জল হয়ে চোখ দিয়ে বেরিয়ে চায়ের কাপে ডুবে যায়...
.............................................................
উপহার
............
"তোমাকে এই শাড়িটা আর এই নেকলেস টা পরতেই হবে,না হলে ভাববো পছন্দ হয়নি ।"হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় অমিতের । ঘড়ি দেখে রাত প্রায় তিনটা । বোতল থেকে একটু জল খায় । চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ । বিয়ের তৃতীয় বার্ষিকীতে কথা গুলো বলেছিলো,আজ আবার...। দেয়ালে চেয়ে থাকে উদাস ।
গভীর প্রেম ছিলো অঞ্জনা ও অমিতের মধ্যে । এই তো সেদিনের কথা,দেখতে দেখতে কত গুলি বছর কেটে গেছে । হবেই তো অঞ্জনা যে ছেড়ে গেছে সেও তো বার বছর প্রায় ।
বাপের বাড়ি থেকে প্রচুর না হলেও ভালোই সম্পদ পেয়েছিলো অঞ্জনা । মা বাবার একমাত্র মেয়ে । তাতে অমিতের আপত্তি । তারপর বৌ এর প্রস্তাব তার একটা ইস্কুল করার ইচ্ছা এই টাকায় ,রাজি হয় অমিত । প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে অঞ্জনা উপহার দেয় তার স্বপ্নের স্কুল । দ্বিতীয় বার্ষিকীতে দেয় তাদের একমাত্র কন্যা রুমি,যে এখন ডাক্তারি পড়ছে । তার স্বপ্নের সাথে সামিল হতে একসময় ব্যাংকের চাকুরিটা ছেড়ে দেয় অমিত ।
বর্তমানে 'দীপ্তি বিদ্যা মন্দির' এর নাম রাজ্য জুড়ে । পুরোটা দেখে যেতে পারেনি অঞ্জনা । সেই কষ্টের দিন মনে করতে চায়না অমিত,তবুও মনে পরে । ডাক্তার যেদিন জানায় মাত্র ছয় মাসের আয়ু আছে,চিকিত্সা করিয়ে আর লাভ হয়নি । অঞ্জনা বলতো,"তোমাকে দুটো সন্তান দিয়ে গেলাম,তাদের তুমি দেখো ।"কাঁদতে কাঁদতে অমিত বলতো,"আমি তোমার সন্মান রাখবো অঞ্জু ।"
চোখের কোল বেয়ে জল পড়লো দু ফোঁটা,মুছে ফেলতে গিয়ে মনে পরে আগামীকাল তাদের পঁচিশতম বিবাহ বার্ষিকী । মেয়েটা কাছে থাকলে ভালো হতো । অমিত দেখে অঞ্জনার ছবিতে দেওয়া মালাটা একটু নড়ে ওঠে...
...........................................................
জুঁইয়ের মা
.................

"জানো জুঁইয়ের মা রাগটাকে বশ করতে পারলে জীবনটা অন্যরকম হতো ।"মাঝে মাঝে এ কথাটা বলেন । হাসে জুঁইয়ের মা,ইংগিতটা বুঝে এখনও বকুল দিদিমণিকে ভুলতে পারেননি সমীরবাবু ।
তাঁর খুব নিয়ম মাফিক জীবন । ভোরে ঘুম থেকে ওঠা,
মর্নিংওয়াক,প্রাণায়াম,স্নান,গীত
া পাঠ,খাওয়া দাওয়া ।
হাটে বাজারে,চায়ের স্টলে কোনো আড্ডা নেই ।যা আড্ডা-আলোচনা ঘরে । বাড়িতে সব সময় বন্ধুদের ভিড় । বয়স প্রায় সঁচাত্তর হলেও সুস্থ এবং সবল ।
এত বড় বাড়িতে একা থাকেন । জুঁইয়ের মা দুই বেলা এসে রান্না করে দিয়ে যায় । সে ছাড়া এই বৃহৎ দুনিয়ায় আর কেউ নেই তার । এজন্য অনেক কলঙ্ক ও সহ্য করতে হয়েছে জুঁইয়ের মাকে ।
এমনি করে দিন তো চলে যাচ্ছে । সেই পঁচিশ বছর আগে বিধবা জুঁইয়ের মা ভাসতে ভাসতে এই ঘরে এসে ঠেকে । বয়সতো এখন কম হলো না,প্রায় পঞ্চাশ ।
সোমবারে একদিনের ছুটি নিয়ে জুঁইয়ের বাড়ি যায় জুঁইয়ের মা । পরদিন এসে শুনে সমীরবাবু হসপিটাল,হার্ট এটাক্ট । সাতদিন পর স্বাভাবিক হয়ে ফিরে ঘরে । জুঁয়ের মা ভাবে সে থাকলে হয়তো এমনটা হতো না ।
"আমার সব সম্পত্তি তোমার নামে করে দিতে চাই । কাল উকিলকে আসতে বলেছি । সময় ফুরিয়ে এসেছে । আর বাকি কয়টা দিন দেখো আমাকে ।" ধীরে ধীরে কথাগুলো শেষ হয় । চুপ করে বসে থাকে জুঁইয়ের মা । তার চোখে জল । অনেকক্ষণ পর বলে," ইহানে একটা বৃদ্ধাশ্রম কইরা দেন । আমনে সহ কয়েকজন থাকবেন । আমি সেবা করুম । সবাই আশীর্বাদ দিবো । টেহা পইসা দিয়া কী কইরাম?" কথাটা সমীরবাবুর মনে ধরে । অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে জুঁইয়ের মার দিকে...
...............................................................
মায়া
........

"ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাত্ পূর্ণমুদচ্যতে ।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে ।।"
প্রথম প্রথম খুব কষ্টের মনে হতো এই আধ্যাত্ম জীবন । ধীরে ধীরে মানিয়ে নিয়েছে । ব্রহ্ম মুহূর্তে ঘুম থেকে ওঠা,
পাহাড়ি ঝর্ণার জলে স্নান করা,শরীর চর্চা,ধ্যান,সাধনা
আরও কত কী নিয়ম । এখন তো বেদ উপনিষদ কণ্ঠস্থ ।
এই পথে এসেছে প্রায় পনর বছর । বিভিন্ন স্থানে ঘুরেছে গুরুর সাথে,ধ্যান,গুরু সেবা,শত পরীক্ষায় উন্নীত হয়েই তার এই সিদ্ধি লাভ । এর মধ্যে শঙ্কর নামটাও পালটিয়ে হয়েছে স্বামী শঙ্করানন্দ গিরিরাজ মহারাজ । তার গুরুর দেওয়া নাম । ইদানীং চেনা যায় না বড় দাঁড়ি,জটা চুল,পরনে লাল সালু ।
দিন চলে যাচ্ছে ভালোই । কোনো কিছুতে আসক্তিহীন আর ঈশ্বর পূজায়,শান্তির সন্ধানে ।
আজকাল কী এক মায়া তার পিছু করছে । বলতে পারছে না সে । একটা ব্যথা হচ্ছে অজান্তেই । খুঁজে পাচ্ছে না নিদান । গুরুকেও জানাতে পারছে না ।
এক জনপদে ভ্রমণে গিয়ে একটু বিশ্রামে বসে সে । গঞ্জিকা সেবন শেষে হেলান দেয় পাথরে । দেখে তার অতীত তাকে ডাকছে । ক্রমে মন ছুটে স্মৃতির ওপাড়ে । এই গাঁজা খাওয়া আর নানা পাগলামি নিয়ে ঝগড়া হতো পৌলমীর সাথে । মেয়েটা জন্মাবার এক বছর পর তাকে ছেড়ে চলে যায় পৌলমী । তবু নেশা ছাড়তে পারেনি শঙ্কর । তারপর সব মায়া মমতা ত্যাগ করে ত্রিপুরা ছেড়ে সোজা চলে আসে হিমালয়ে,সাধন মার্গে । মেয়েটার কথাই মনে পরছে খুব । নামটা কী মনে করতে পারছে না,মনে পরেছে 'মুন্নী'
এই যে কুয়াশা ঘেরা পাহাড়,পাইন,দেবদারু,ঝাউ বৃক্ষ,
রডোডেনড্রন ফুলের হাসি,এরা যেন ষোল বছরের এক কিশোরী হয়ে ডেকে ওঠে"বাবা" । সে ও দেখতে পায় মুন্নীর করুন মুখ । দু ফোঁটা অশ্রু চলে আসে । হঠাৎ চোখ খুলে,
কষ্টটা তখনও তার বুক ছুঁয়ে আছে । মনে পরে সন্ন্যাসীদের জাগতিক লোভ,মায়া থাকনে নেই । উচ্চারণ করতে থাকে সে-
"ঈশা বাস্যমিদ সর্বং যত্কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ ।
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনম্ ।।……
...............................................................
রাজার সাজে
.....................

হেলমেট না নিয়েই বেড়িয়ে পরে প্রতীম । ব্যস্ততায় মনে নেই । জায়গায় জায়গায় ট্রাফিক পুলিশ । আজ জরিমানা না দিয়ে উপায় নেই ।
শহরে ঢুকার পথে ফোন আসে । পকেট হতে এনড্রয়েড সেটটা বের করে কানে দেয়,কদিন আগেই কিনেছে । প্রমা,খুশিতে দেহ মন উড়তে শুরু করে । ঠিক তখনই সামনে পরে স্পীডব্রেকার,হঠাৎ এমন ভাবে ব্রেক কষে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কাত হয়ে পড়ে যায় । এতদিনের সহচর বাইকটা তার উপর চড়ে উঠে । ফাগুনের কৃষ্ণচূড়া,পলাশের মতো লাল হয়ে যায় রাস্তা ।
"এক রাশৌচ সমসপ্তকে..."কী হিসাব করে গণক ও বলেছে রাজ যোটক । প্রমার বাড়ির লোকেরা তো এক দেখাতে চয়েজ করে ফেলেছে । করবেই তো মা বাবার একমাত্র সন্তান,আরো নূতন চাকুরি ।কদিন পরই শুভ অনুষ্ঠান । আনন্দিত সবাই ।
ফোনের ঐ প্রান্ত হতে ভেসে আসছে শুধু "হ্যালো...হ্যালো..." । তার নীরব হাত এগুতে পারছে না আর । কত মানুষে ভরে গেছে চারদিক । স্থির চোখ গুলো দেখছে,দেখছে সুন্দর সুসজ্জিত গাড়ি,বন্ধু,আত্মীয় স্বজন...সে চলছে রাজার সাজে...
...............................................................
টাফি
.........

উপরতলা থেকে নেমে কলাপসিবল গেইটটা খুলতেই বারান্দায় বাঁধা টাফি ঘেউ ঘেউ করে ডেকে ওঠে । ভয় পাবার উপক্রম । খুব সকালে বৌ যখন ফুল তুলতে যায় অথবা নোংরা ফেলতে,বড্ড ভয় পায় । মেয়েতো নিচে নামতে চায়না । বলে "বাবা ঘেউ ।" সুবিধা হলো এই ভাত খেতে না চাইলে বা ঘুমাতে না চাইলে বলি "মা টাফি আসবে ।"
দুতলা বাড়িটার সামনে ছোট্ট উঠান,কয়েকটা ফুল গাছ,দুটো আম গাছ,একটা কাগজী গাছ,আর একটা কারিপাতা গাছ গেইটের কাছে । সব মিলিয়ে এক প্রকার সুন্দর ।
দুদিন হয় এক পরিবার ভাড়া এসেছে নিচ তলায় । লোক সংখ্যা ছয় ।কর্তা,গিন্নী,
ছেলে,মেয়ে,কাজের মহিলা,সন্তানের বাড়া আদরের টাফি ।
টাফি বলিষ্ঠ ও নাদুসনুদুস । ডাকে না যেন গর্জন করে । অল্প কিছুদিনেই তার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যায় । এখন পূর্বের মতো ধমকায় না । মায়া জন্মায় তার উপর । সকাল বিকাল ডাক না শুনলে,তাকে না দেখলে ভালোলাগেনা । ইদানীং বেঁধে রাখেনা আর । কাছে এসে ঘ্রাণ নিয়ে গায়ে উঠতে চায়,হাত পা চাটে । ডাকলে লেজ নাড়ে । সে-ই দুই ফেমেলিকে ভালোবাসার সূত্রে বেঁধে দেয় ।
হঠাৎ কেমন যেন উলট পালট হয়ে যায় । কাকু কাকিমা সকালে অফিস চলে যায়,দেবাণু হোটেল খুলে এক বন্ধু মিলে,তপা ক্লাস টুয়েলভে ভালো রেজাল্ট করে ভর্তি হয় আগরতলা,চলে যাবে কিছুদিন পর,প্রায় আঠারো বৎসর কাজ করে আসছেন যে কাজের মহিলা তিনিও বাড়ি চলে যাবেন,ছেলেকে বিয়ে করিয়েছেন কিছুদিন হয়,তাই । টাফিকে দেখার মতো আর কেউ রইলো না,একা হয়ে পরে সে ।
রবিবার বিকেলে কাকিমা সব খুলে বলছেন আমাকে । টাফি কাছেই বসে ।
আমার এক বন্ধুর সাথে কথা হয় । সে এসে দেখে যায় গতকাল । আগামীদিন নিয়ে যাবে । সবাই একটু শান্তির ছায়া পায় । এই নিয়ে কথা বলতে বলতে অনেক রাত হয় ।
হাউ মাউ শুনে ঘুম ভাঙ্গে ভোরে । নিচতলা থেকে আসছে চিৎকার । কী হতে পারে?কোনো অঘটন?শশব্যস্ত হয়ে ছুটি সপরিবারে । গিয়ে দেখি,কাকিমা আর তপা "ও টাপি রে" বলে কাঁদছে । পাশেই নীরব শুয়ে আছে টাফি । হৃদয় বিদারিত কান্নায় আকাশ বাতাস ভরে ওঠে । "কাউকে দেবোনা,তুই আমাদের এখানেই থাকবি । এবার তো ওঠ ।" নাহ সে আর উঠে না,আর উঠবেওনা ।
টাফিকে কোথাও পাঠাতে হলোনা,সে নিজে থেকেই চলে গেলো । তাকে নিয়ে আর কারো ভাবতে হবেনা...
..........................................................
পাগলি
............

স্বামী আর তার জা এর ঘনিষ্ঠতা নিয়েই বকবক করে পাগলিটি । এক নেতাকেও বকে । আড়ি পেতে শুনে যা বুঝতে পারি । নবীনের চা এর স্টলের পাশেই বড় বট গাছটার নিচে তার সংসার । মাঝে মাঝে চা খাওয়াই । খুশি হয় । ভিক্ষে করে পাওয়া অনেক গুলো টাকা সে আমাকে সাধে । বয়স আর কতো হবে,চল্লিশের অনেক নিচে ।
কোনো কোনো দিন নিজে থেকে চেয়ে চা বা সিঙ্গারা খায় । খাওয়াতে পেরে এক অকৃত্রিম সুখ পাই । কোনোদিন শহরের পথে দেখা হলে চিনতে পারে,হাসি দেয় । হঠাৎ মনে হয় প্রগলভ যৌবনা এক নারী । উপযুক্ত চিকিত্সায় ভালো হয়ে উঠতে পারে । ধীরে ধীরে তার সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে ।
কর্মব্যস্ততায় চা এর স্টলে যাওয়া হয়না বহুদিন । আজ একটা কাজেই এদিক দিয়ে যাচ্ছি । দেখি সে নেই । জানতে পারি ইদানীং আসে না । সময় করে উঠতে পারিনি,অনেক কথা বলার ছিলো । জানার ছিলো অনেক ।
শূন্য বট তলের দিকে তাকালে মনে পরে তার কণ্ঠে গাওয়া গান,কপালের বড় ফোঁটাটার কথা । ইশারায় ডাকলে বলতো,"আমি এমন মাইয়া না" । দুঃখেও একটা হাসি চলে আসতো মুখে ।
লেখা গুলো সোমেন যখন ডাইরির পাতায় লিখছে,গভীর রাতে,তখনও একটা কষ্ট অজান্তে ছুঁয়ে যায় তাকে...
..............................................................
রাত্রি

........
অনুরাগ ভৌমিক
গকুলপুর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে এই মেলা বসে । মূলত উদয়স্ত কীর্তন । ইতস্তত প্রচুর লটারির দোকান । অন্যান্য দোকান ও আছে,আর আছে সাধু বাবাদের গঞ্জিকার আসর । "বাবা প্রসাদ" বলে দশটা টাকা এগিয়ে দিলে সাধুরা তাকে ডেকে নেয় কাছে । এর আগে ও অনেকবার প্রসাদ নিয়েছে অমলেশ ।
মেলায় প্রচুর আনন্দ হয়েছে । খেয়েছে কতকিছু । কিনেছে একটা চশমা,টুপি,রঙিন ছবি যুক্ত একটা বই'নব দম্পতির যৌন জীবন'
রাত দেড়টা । ভিড় কমে গেছে । প্রায় ছয় মাইল তাকে যেতে হবে হেঁটে হেঁটে । একা । ভাবতেই কেমন করে উঠে বুক । মেলা থেকে বেড়িয়ে দাঁড়ায় এসে পথে । মনে মনে বলে একটা কুকুর ও নেই রাস্তায় ।
পথ নিঝুম । শুধু ঝিঁ ঝিঁর ডাক আর আকাশে চাঁদ ছাড়া কেউ সজাগ নেই । হঠাৎ পেছন ফিরে দেখে সুন্দর একটা কুকুর সঙ্গে চলছে । মাঝে মাঝে দু এক কথা জিজ্ঞেস করে,আবার হাসে । মনে মনে একটা নাম দেয় তার 'রাত্রি' । মনে পরে বাসন্তীর কথা । এমন গাঁয়ের মেলায় সে আসতো । জন ঢেউ এ যেন অমলেশ কৃষ্ণ আর বাসন্তী রাধা হতো । কেমন আছে বাসন্তী কে জানে ?
হাঁটতে হাঁটতে পথ ফুরায় না । বাড়ি পৌঁছে রাত প্রায় তিনটায় । ভাবছে কী খাওয়াবে 'রাত্রি' কে । ঘরে গিয়ে থালায় রাতের খাবার বেড়ে বাইরে নিয়ে এসে দেখে 'রাত্রি' নেই । খুব কষ্ট হয় মনে,বন্ধুর মতো যে এতো উপকার করেছে,তাকে কিছু খাওয়াতে পারে নি । হয়তো আর দেখা হবে না এই জীবনে । ব্যাপারটা অলৌকিক ও মনে হয় তার কাছে । বন্ধুর কথা ভাবতে ভাবতে কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে সে...
............................................................
শ্রীপর্ণা
...........

হোটেল 'SUN' থেকে বেরিয়ে সামনের বড় পুকুরটার পাড় ঘেঁসে একটু এগিয়ে গিয়ে পানের দোকানের সামনে দাঁড়ায় অনুপম । অনতিদূরেই কালীবাড়ি । এই সাইডটায় সন্ধ্যা হলে অনেকগুলো চাটের দোকান বসে । পেরিয়ে গেলেই অনেক কাপড়ের দোকান । পৃথিবীর অন্যান্য বিখ্যাত শহর থেকে এ শহর অনেকটা ছোট হলে ও খুব ভালো লাগে তার । বিশেষ করে শ্রীপর্ণা এখানেই চাকুরি করে শুনেছে । অনেকদিন যোগাযোগ নেই । এই শহরের টানে মাঝে মাঝে আসে । কাজের পাশে যদি দেখা হয়ে যায় ।
এদিকটায় টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে । "মিঠাপাতি পানে কী হবে স্যার?""হালকা কিমাম,জ্যৈষ্ঠ মধু,একশ বিশ,বাবা এলাচি,বাবা সুপারি এই ।" হঠাৎ দেখে সুন্দরী একটি মেয়ে তার দিকে আসছে । দেখে এ যে পর্ণা,তার হাত পা শরীর যেন আকাশের সাথে মিশে যাচ্ছে । ঠিক প্রথম প্রথম যেমনটা হতো । অনুপম কে দেখেনি পর্ণা,এগিয়ে একটা মিষ্টির দোকানের দিকে চলে গেছে । পর্ণার এমন কিছু পরিবর্তন হয়নি,আগে থেকে একটু ফেটি হয়ে গেছে শুধু ।
সুন্দর সুযোগ । আর দেরী না করে এখনই কথা বলবে । ক্ষমা চেয়ে নেবে অতীত ভুলের । কী বলবে প্রথমে?ভাবছে । তবুও বলবে । বলতে হবে,অনেক কথা ।
পানে স্বাদ নেই আজ । ফেলে দেয় । এগিয়ে যায় পর্ণার দিকে । এমন সময় একটা গাড়ি এসে থামে । গাড়ি থেকে নেমে একটা ছোট্ট ফুটফুটে জ্যোত্স্নার মতো মেয়ে "মাম্মী মাম্মী"বলে জড়িয়ে ধরে পর্ণাকে । তারপর নামে মোটামোটি এক সুপুরুষ । প্রাণটা হু হু করে উঠে অনুপমের...
স্যার ব্রেকফাস্টে কী দেবো?এই ডাকে একঘেয়ে সকালটা পৌঁছে যায় তার বেডরুমে...
...............................................................
আম
.........

মিঠু ড্রাইভার,আমের পেটি ভেঙ্গে নয়,বেরিয়ে পড়ে থাকা
কয়েকটা আম, রেখে দেয় বাড়ি নিয়ে ছোট্ট মেয়েটাকে দেবে । মাঝে মধ্যে এমন নেয় ঘরে । তারপর গাড়ি আমে ভর্তি করে চলে যায় ডেলিবারি দিতে ।
বাড়ি যাওয়া হয়না তিন দিন । ভোরে ফোন এসেছিলো বৌ এর । মেয়ে বলেছে "বাবা আম এনো ।" পৃথিবীতে এই মেয়েটিই সবকিছু তার ।
ফিরে এসে মালিককে সব বুঝিয়ে দিয়ে,গাড়ি নিয়ে রওনা হয় বাড়ি । বিশালগড় পেরিয়ে হঠাৎ কী যে হলো বুঝতে পারেনি সে । সম্মুখ হতে আসা বড় গাড়িটি ধা করে বাড়ি মেরে দ্রুত পালিয়ে যায় । মিঠুর গাড়িটি তাকে নিয়ে কাত হয়ে শুয়ে পড়ে । রক্তে ভাসে রাস্তা ।
আশেপাশের অনেক লোক আসে । মাছ বাজারের মতো ভিড় জমায় । হৈ চৈ,বহু কথায় ভরে উঠে চারদিক ।
মেয়ের জন্য রাখা আম গুলি ছড়িয়ে পড়ে পথে । কেউ কেউ কুড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে একটা দুটো । এ বছর প্রথম বাজারে আসা আম ।
মিঠুর অর্ধনিমিলিত চোখ দেখছে তার ছোট্ট মেয়েটি ছুটতে ছুটতে এসে জড়িয়ে ধরছে তাকে,বলছে"ওরা আম গুলি নিয়ে যাচ্ছে বাবা..."
...........................................................
পরিবার
............

কোনো কোনো দিন দুইশ আড়াইশ টাকা ও রোজগার করে নিমাই । মালিকের রিক্সা চালিয়ে এতো রোজগার করা কম কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয় । তবে প্রতি রাতে বাড়ি ফেরার পথে প্রায় পঞ্চাশ ষাট টাকা বাজে খরচ হয়ে যায় । খেয়ে শিখে ফেলেছে । এখন ছাড়তে পারছে না । যদিও তেমন উদ্যোগ ও নেই । এই নিয়ে সংসারে যত ঝগড়া । হাত ও তুলে সন্ধ্যার উপর । এক মেয়ে এক ছেলে নিয়ে ভালোই চলছে চারজনের পরিবার এখন । কেবল বড় মেয়ে,মেয়ের জামাই অথবা আত্মীয় স্বজন যে দিন আসে তখন একটু টানা হিঁচড়েতে পড়ে ।
আজও খেয়েছে, খেয়েছে একটু বেশি । অনেক রাত করে বাড়ি ফিরেছে । আসার পথে তাসখেলা দেখছিলো তাই দেরী । কিছু মাছ নিয়েছিলো,প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে । সে দিকে হোশ নেই তার ।
ঘরে ঢুকে কী একটা নিয়ে বচসা বাঁধে বৌ এর সাথে । ঝগড়া তুমুলে গিয়ে পৌঁছে । রাগের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হাতের কাছের বটি দা টা নিয়ে দিয়ে দেয় এক কোপ । সঙ্গে সঙ্গে ঝর্নার মতো রক্ত স্রোত সারা ঘরে । চোখের সামনে কাঁপতে কাঁপতে সন্ধ্যার দেহটা নিথর হয়ে যায় । ভয়ে,কষ্টে পাগলের মতো হয়ে উঠে নিমাই । মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে,"হায় আমি একি করলাম" ।
হঠাৎ চোখ খুলে সে । লাইট টা অন করে । বোতল থেকে অনেকটা জল খেয়ে গলাটা ভেজায় । চোখের কোনে তখন ও অশ্রু লেগে আছে । দেখে,খাটে কী সুন্দর ঘুমায় তার পরিবার । দেখে সন্ধ্যার শাড়িটা পুরনো হয়ে গেছে । ব্লাউজটা ছেঁড়া । মনে মনে ঠিক করে কাল একটা ব্লাউজ কিনে আনবে বৌ এর জন্য...
..............................................................
প্রাতঃভ্রমণ
.................

'দীপালি কুঞ্জ' বড় রাস্তার পাশে বাড়িটি আজ ও দাঁড়িয়ে থাকে । গেইটে লেখাটা মলিন হয়ে গেছে । কাছে না গেলে বোঝা যায়না ।
বাড়ির যিনি মালিক সত্তর ঊর্ধ্ব বয়স্ক ভদ্রলোক । একা থাকেন । এক মেয়ে বিয়ে হয়ে গেছে বহুকাল আগে । বৌ গত হয়েছেন কুড়ি বছর । নিন্দুকেরা বলে সুইসাইড,এমনিতে হার্ট এটাক্ট না জ্বর হয়েছিলো ।
যুবতী বয়সে দীপালির প্রথম পোস্টিং গাঁয়ের এক স্কুলে । তার মামার বাড়ির কাছে । গুরুপদদের বাড়িতে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করে সে । সদ্য ত্রিশের যুবক গুরুপদ,দীপালি একুশ । ধীরে ধীরে দুজন খুব কাছে আসে । শরীর পর্যন্ত গড়ায় ওদের কাছে আসাটা ।
একসময় ট্র্যান্সফার হয়ে চলে আসে তার জন্ম শহরে । তারপর ক্রমে গুরুপদের জীবন থেকে ও সরে গিয়ে এই শহরেই সংসার পাতে । বুকে পাথর চাপা দিয়ে গুরুপদ চির কুমার থেকে যায় । গুরুপদ ও চলে আসে এই শহরে কিছুদিন পর । একটা প্রাইভেট স্কুলে চাকুরি নেয় ।
শহরের দুই প্রান্তে দুটো দীর্ঘশ্বাস বেঁচে থাকে সবার আড়ালে । প্রতিদিন প্রাতঃভ্রমণে বের হলে এই দীপালি কুঞ্জের সম্মুখ দিয়ে হেঁটে যেতো সে । স্কুলে যাবার ক্ষণে একটু দেখা হবে,এই উদ্দেশ্য । শীত গ্রীষ্ম বারো মাস চলছে । গত প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর । দীপালি যে নেই তবুও প্রত্যেক দিন এখান দিয়ে হেঁটে যায় গুরুপদ ।
গল্পটা বলতে বলতে বৃদ্ধ লোকটির চোখ জল পূর্ণ হয়ে ওঠে । প্রতিদিন আমরা একসাথে মর্নিংওয়াক করি,গল্প বলি । আগামীদিন আমার গল্প বলার পালা...
…………………………………………………………………


কোন মন্তব্য নেই: