।।পার্থ প্রতিম আচার্য ।।
এই বিষয়ে আমার
প্রথম নিবন্ধটিতে কাস্ট ও ক্লাস কী এই
বিষয়ে বলেছি। এবং বলার চেষ্টা করেছি ভারতীয় সমাজের তীব্র পুঁজিবাদ অভিমুখ কিভাবে
বর্ণ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দিচ্ছে ইচ্ছা নিরপেক্ষ ভাবে – এই বিষয়ে পাঠকদের নিজের চারপাশ অবলোকন
করতেও বলেছি , যেখানে এর উদাহরণ ভুরি ভুরি ।কদ্যপি এই কথার মানে আমি এটা বলিনি যে ভারতে কাস্ট
ব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেছে ।কারণ সেটা যে আছে তার জন্য সমাজবিজ্ঞানী
না হয়ে একজন সমাজ দর্শক হওয়াটাই যথেষ্ট । তবু কোন কোন অত্যন্ত কাছের মানুষরাও
আমাকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বর্ণ-প্রথার বর্বর রূপের পেপার কাটিং তুলে
দেখিয়েছেন । তাদের উদ্বেগের প্রতি আমি মরমি এই কারণে যে তথাকথিত নিম্নবর্ণের অধিকাংশ জনতাই
প্রতিনিধিত্ব করে শ্রমজীবী শ্রেণির।আর এইসব কারণেই এই নিবন্ধে আমি সরাসরি এইসব থেকে উত্তরণ
সম্পর্কে বলবো ।
মার্ক্স থেকে কিছু
কথা
কাস্ট ব্যবস্থা সম্পর্কে মার্ক্সের আলাদা
কোন নিবন্ধ না থাকলেও তার GERMAN
IDEOLOGY কিম্বা CAPITAL গ্রন্থ সমূহে এর
সম্পর্কে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ রয়েছে । যা ভারতের কাস্ট ব্যবস্থার উদ্ভব ও গতিমুখকে
বুঝতে আমাদের সাহায্য করে ।
মার্ক্স তার
পূর্বেকার ভাববাদী ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ গুলোকে খণ্ডন করে কাস্ট সম্পর্কে THE GERMAN IDEOLOGY পুস্তকে লিখেছেন “ভারত ও ইজিপ্টে যে কঠোর (CRUDE) শ্রম বিভাজন তাদের ধর্মে ও রাষ্ট্রে
ডেকে এনেছে একটা কঠোর কাস্ট ব্যবস্থা ,তাকে ঐতিহাসিকরা বিশ্লেষণ করেন - যে কাস্ট ব্যবস্থাই নাকি
সেই শক্তি যা এই কঠোর সমাজ রূপের জন্ম দিয়েছে” ।
মার্ক্স এখানে
বলছেন মানব ইতিহাসের বিবর্তনের পেছনের বস্তুগত কারণটা যে শ্রম-সম্পর্ক (LABOUR RELATION) তাকে ঐতিহাসিকরা দেখেনই নি ।
সুতরাং মোদ্দা
প্রশ্ন হল – শ্রম বিভাজন
কাস্ট ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে না কাস্ট ব্যবস্থা শ্রম বিভাজনের জন্ম দিয়েছে ? মার্ক্সের মতে
শ্রমবিভাজনই কাস্ট ব্যবস্থার জন্মদাতা।ইতিহাস চর্চায় আপনিও তাই পাবেন । শ্রম বিভাজন থেকেই
তৈরি হয়েছিলো বিভিন্ন ধরনের কাজের জন্য বিভিন্ন ধরনের লোকের । কেউ শুধু মানসিক
শ্রম দিত কেউ বা কায়িক , কেউ শুধু অন্যের শ্রমের উপর বসে খেতো । কেউ তথাকথিত নিম্ন বর্ণের আর কেউ উচ্চ
বর্ণের হওয়ার উৎস সেইখানে । কেউ তথাকথিত অপরিচ্ছন্ন দৈহিক কাজে আর কেউ বা তথাকথিত
পরিচ্ছন্ন মানসিক কাজে গেল ।এরপর এল বর্ণ বিভাজন । সুতরাং এর সমাধান সূত্রও লুকিয়ে আছে শ্রমবিভাজনের পরিবর্তনে
।আর এটা না হলে
বর্ণ বিভাজন মিটবে কি ? সেটা যে সংরক্ষণ কিম্বা আন্তঃ কাস্ট বিবাহ দিয়ে হবে না সেটা
সহজেই বোধ্য।এর জন্য চাই শ্রম বিভাজনের পরিবর্তন ।ঠিক যেমনভাবে পুঁজিবাদ তার স্বার্থে
অতীতের সব শ্রম বিভাজন গুঁড়িয়ে মানসিক শ্রমিকদেরও টেনে নামাচ্ছে কায়িক শ্রমে ।
ত্রিপুরায় যারা বর্তমানে বিভিন্ন নির্মাণ শিল্পে কাজ করছেন তাদের বংশ পরিচয় খুঁজে
দেখুন ।(এই বিষয়ে একটি রিসার্চ প্রকাশ করার ইচ্ছা আছে )
তাহলে কি
পুঁজিবাদী বিকাশই কাস্ট ব্যবস্থার অবসান ঘটাবে ?
উত্তর এক কথায় “না”। চলুন দেখি ।
আমার পূর্বেকার
নিবন্ধে আমি লিখেছিলাম বর্তমান ব্যবস্থা ক্রমশ: মুষ্টিমেয় মালিক আর ব্যাপক মজুর দাসে
সমাজকে বিভক্ত করে দিয়েছে/ দিচ্ছে ।এই প্রক্রিয়ায় সে ভেঙ্গে
দিচ্ছে পূর্বের সমস্ত সামাজিক রূপকেও ।আঘাত করেছে বর্ণ ব্যবস্থাকেও। পূর্বেকার তথাকথিত উচ্চবর্ণের লোকদেরও প্রতি নিয়ত: টেনে নামাচ্ছে
মজুরি দাসত্বে ।(মজুরী দাস মানে আপনার আমার মত লোকেরা। উৎপাদকের কাছে আমাদের
শ্রমশক্তি হল আলু পটলের বা মোবাইল ফোনের মত পণ্য ।এখানেও সেই চাহিদা যোগানের সূত্র ক্রিয়াশীল।বাজারে আলু বেশি থাকলে
আলুর দাম কমে আবার উলটো পরিস্থিতিতে দাম বাড়ে ।আমাদের শ্রমশক্তিও একই নিয়মে হরদম বিক্রি হচ্ছে।) এই মজুর বাজারের পরিসংখ্যান তথ্যে একটু চোখ রাখলেই দেখা যায়
হর-বর্ণের মহাসমারোহ এই বাজারে – ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ,শূদ্রের মেলবন্ধন ঘটেছে মজুরী দাসত্বে ।উলটো দিকে মালিকের
শিবিরেও একই রূপ মেলবন্ধন।আপনার আমার চারপাশের বাস্তব ছবিটা স্মরণ করুন কিম্বা নিদেন পক্ষে
আপনি যেখানে কাজ করছেন তাকেই একটু বিশ্লেষণ করে নিন । উপরের বক্তব্য কি সত্যি নয় ?...
লক্ষ্য করবেন উপরের
আলোচনায় আমি অনেকবার / চিহ্ন ব্যবহার করে
হয়েছে/ হচ্ছে ইত্যাদি লিখেছি । এর মানে আমি ভারতীয়
সমাজকে দেখছি একটা ‘গতির’ মধ্যে। গতি হল সুতীব্র ভাবে পুঁজিবাদ অভিমুখে । পুঁজিবাদে উৎপাদন হয়, যা আগেই বলেছি, মুনাফার লক্ষ্যে।আজ পুঁজিবাদ সারা বিশ্ব
ব্যবস্থা । তার সামগ্রিক উৎপাদনের তুলানায় ক্রয়ক্ষমতা সম্পন্ন ক্রেতা কম । এই অবস্থাকে বলে অতি
উৎপাদন সংকট।ফলে পুঁজি বিনিয়োগ
করার ক্ষেত্রে তাদের গতি শ্লথ । সকল জায়গায় একই রকম বিকাশ পুঁজিবাদ করতে পারে না।তাই কিছু অংশে সামন্তীয়
অবশেষ রয়ে যায় ।কিন্তু সামগ্রিক গতিমুখ
যেহেতু পুঁজিবাদের দিকে ফলে সেই গুলো বিকাশের নিয়মে ভঙ্গুর হয়ে পড়ে । কিন্তু বর্ণবাদ সম্পূর্ণ
পিছু ছাড়েনি...
আর একটা কারণেও বর্ণবাদ কে জেগে উঠতে দেখি
আমরা।সেটার হোতা রাষ্ট্র
এবং অনেক ক্ষেত্রেই তথাকথিত নিম্নবর্ণের উচ্চ স্তর (upper strata)।রাষ্ট্র কাজটা করে শ্রেণি ঐক্যে ভাঙ্গন আনতে আর ঐ বিশেষ স্তরটি
করে এটাকে কাজে লাগিয়ে সমাজে বিশেষ সুবিধা নিতে। শাসক শ্রেণির স্বার্থের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় শাসকরাও এতে ইন্ধন
দেয়।উদাহরণ স্বরূপ শাসকের
রাজনৈতিক দলগুলো বেছে বেছে নির্দিষ্ট অঞ্চলে কোন বর্ণের লোক বেশি সেই বর্ণের প্রার্থী
দাড় করান , সে যে শ্রেণিরই হোক
না কেন । অথবা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে জনগণনায় কাস্ট এর ভিত্তিতে গণনা হয় ।ভারতে অর্থনৈতিক ভিত্তিতে
কোন সংরক্ষণ নেই; আছে জাত পাতের নিরিখে
।
অর্থাৎ বলতে চেয়েছিলাম বর্ণবাদ এর
বস্তুগত ভিত পুঁজিবাদের বিকাশে ইচ্ছা নিরপেক্ষ ভাবে ভেঙ্গে গেলেও সচেতন উদ্যোগে পুঁজিবাদ একে
রক্ষা করার প্রয়াস জারি রাখে। এমনকি আমেরিকায় ও দেখুন কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ
বিভাজনকে কি ভাবে টিকিয়ে রাখা হচ্ছে ।
সমাধান
সেই ১৮৫৩ সালে মার্ক্স
লেখেন- “ভারতের শক্তি ও প্রগতিকে আটকাচ্ছে বংশানুক্রমিক শ্রম-বিভাজনের উপর দাড়িয়ে থাকা
কাস্ট ব্যবস্থা নামক নির্ণায়ক বাধা।আর তাকে শেষ করে দেবে আধুনিক শিল্প , রেলওয়ে ব্যবস্থার
বিকাশ”
কিন্তু কিছু পরেই
তিনি লেখেন-
“আমি জানি ইংরেজ
মিল মালিক গোষ্ঠী ভারত কে রেলওয়ে দিয়েছে শুধু এই একমাত্র কারণে যাতে ক্রম হ্রাসমান
ব্যয়ে ভারতের তুলা আর কাঁচামাল তাদের মেনুফেকচার এর জন্য তুলে নিতে পারে”।“ইংরেজ বুর্জুয়ারা
কখনই উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ বা জনতার দ্বারা তার ফলের আত্মসাৎ এর
পথ করে দিয়ে (অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণির বিকাশ ও শ্রমের উৎপাদনের ভোগের উপর তাদের
অধিকার ) তাদের (ভারতীয়দের) বন্ধন মুক্তি ঘটাবে না বা জনতার সামাজিক অবস্থার
বস্তুগত উন্নতি করবে না। কিন্তু তারা যেটা করতে ভুলবে না (ইচ্ছা নিরপেক্ষভাবে)তা
হল এই দুইটি বিষয়(উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ বা জনতার দ্বারা তার ফলের আত্মসাৎ)অর্জনের
বস্তুগত ভিত তৈরি করে দেয়া”। (বন্ধনীর ভেতরের লেখা নিবন্ধকারের।এগুলো অনুবাদের
স্পষ্টতার জন্য)।
সোজা অর্থ করলে
দাঁড়াচ্ছে যতদিন শোষণ মূলক ব্যবস্থা চালু থাকবে ততদিন এইসব শেষ হয়েও শেষ হবেনা ।
কেন শ্রেণিসংগ্রাম
অতি সরল করে বললে
এর বাইরে অন্য কোন রাস্তা নেই। দুঃখের ব্যাপার হল আমরা দলিতরাও এটা বুঝিনা অনেক
সময়ই ।শাসকশ্রেণীর কৌশলে ছুড়ে দেয়া সংস্কার আর মুল মুক্তির পার্থক্য বুঝি না ।মুষ্টিমেয় কিছু
লোককে সুবিধাভোগী বানিয়ে কাস্ট ব্যবস্থার টিকিয়ে রাখার পথ করা হয়। আমরা ভুলে যাই
আমাদের সংগ্রাম শুরু হয়েছিলো সেই দাস যুগ থেকে আর তা বন্ধনমুক্তির সংগ্রাম । আমরা
ভাবি কিছু দলিত চলতি সরকারে ঘুসে গেলেই কেল্লাফতে। কল্পনা করুন না এমন একটা সরকার
দিল্লি তে বসে গেল যার অধিকাংশই তথাকথিত নিম্নবর্ণের ।ব্যবস্থা পালটাবে মনে হয় কি?আইন করে উচ্চ নিম্ন বর্ণের বিবাহ করাবে ? প্রশাসন দিয়ে সামাজিক সম্পর্কের চুল ও নাড়ানো যাবে না ।এটা
সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষা । দলিত প্রতিনিধি সরকার তো দেখেছি- একটা কাজ ওরা করেছে তা
হল দলিত বহুজন বুর্জুয়া বানানো – যাদের লক্ষ্য অন্য শোষকদের সঙ্গে মিলে শ্রমজীবীদের
শোষণ(দলিতদের) ।প্রকৃত মুক্তির
রাস্তা তাই সাম্যবাদী আদর্শে শ্রেণি সংগ্রামের ময়দানে লড়াই চালানো , সমাজতন্ত্রের
লক্ষ্যে ।কারণ এই সমাজই ঘোষণা দেয় যারা কাজ করবে না তারা খেতেও পাবেনা (শিশু বৃদ্ধ
অসুস্থ ব্যতীত )। সেখানে শ্রম বিভাজনের বর্তমান রূপ হবে বাতিল ।মানসিক ও দৈহিক
শ্রম হবে সবার জন্য । একমাত্র তখনই জাত ব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা যাবে
।পুঁজিবাদই এর বস্তুগত ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছে/দিচ্ছে ।
১৪.৫.২০১৭
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন