।। শিবানী দে ।।
একুশ শতকের পৃথিবীকে হঠাৎ যেন গোঁড়ামির উন্মাদনা পেয়ে
বসেছে । রেনেসাঁ (চতুর্দশ- সপ্তদশ শতাব্দী) ও তার পরবর্তী যুগে ইউরোপে যে
মুক্তচিন্তার আলোড়ন দেখা দিয়েছিল, তা পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে তার
তরঙ্গ ছড়িয়েছিল । সেই তরঙ্গের অভিঘাতে একদিকে সাহিত্যের রচনা, দর্শনের আলোচনা এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে পৃথিবীর
বেশির ভাগ দেশে মুক্তচিন্তার প্রসার ঘটেছিল, অন্যদিকে নতুন নতুন পথ ও ভূখণ্ডের আবিষ্কার হয়ে
যোগাযোগ ও বাণিজ্যের উন্নতি হয়েছিল, সংশ্লিষ্ট দেশগুলির সমৃদ্ধি হয়েছিল । ধর্মের
পর্যালোচনা শুরু হয়েছিল, রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা করে
রাষ্ট্রনীতি রচনা করা হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে যেন পৃথিবী উল্টোমুখে
ঘুরতে শুরু করল । যে গতিতে মুক্তচিন্তার প্রসার ঘটেছিল, তার চাইতে দ্রুতগতিতে চিন্তার বদ্ধতা আমাদের গ্রাস করছে । আপাতদৃষ্টিতে এই যে পশ্চাৎগমন, সেটাই কি আমাদের পরিণাম ?
এই আলোচনা রেনেসাঁর প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করলাম, কারণ রেনেসাঁ থেকেই মানবসভ্যতার আধুনিক যুগের সূচনা ।
পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের পর খুবই ধীরে ধীরে সভ্যতার অগ্রগতি হয়েছিল, লক্ষ লক্ষ বছর লেগেছিল গুহা ও বন থেকে গ্রাম তৈরি হতে
এবং গ্রাম থেকে শহর গড়তে । সুপ্রাচীন সভ্যতাগুলো, যেমন মিশরীয়, ব্যবিলনীয়, চৈনিক এবং ভারতীয় সভ্যতা একই সময়ে গড়ে ওঠে নি, সময়ের ব্যবধানে এক এক দেশে সভ্যতার সূর্য কিরণ দিয়েছে, অনেক সভ্যতার জন্ম হয়েছে, যাত্রার গতি ধীর কিংবা দ্রুত হয়েছে, আবার লুপ্ত ও হয়েছে । কিন্তু সভ্যতার অভিমুখে মানুষের যাত্রা একেবারে থেমে থাকেনি ।
সভ্যতার মানে কি ?
অভিধান ঘেঁটে জানা যায়, সভ্যতা হল মনুষ্যসমাজের উন্নততর অবস্থা, যাতে মানুষ সংগঠন গড়ে আরামদায়ক জীবন যাপন করে, এবং কলা ও শিক্ষার মত ব্যাপারের কথা ভাবতে পারে ।
সভ্যতা হল বর্বরতা ও বিশৃঙ্খলার উল্টো অবস্থা । সভ্যতার দুটো প্রাথমিক শর্ত---
(১) মনুষ্যসমাজ যা একটা উন্নত শ্রেণির সামাজিক অবস্থার (যেমন, জটিল আইনগত, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠন) মধ্যে বাস করে । (২) আচরণে, রুচিতে, এবং চিন্তায় উন্নত মানের ছাপ থাকে । পঞ্চদশ শতক থেকে
ইউরোপীয় চিন্তাধারায় এই সংজ্ঞার সংযোজন হয়েছিল, কিন্তু বিশ শতক শেষ হওয়া অবধি পৃথিবীর খুব কম দেশই
এইসব শর্তের খুব কাছাকাছি যেতে পেরেছে ।
ইউরোপীয় রেনেসাঁ বা নবজন্ম ছিল এশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের
সংঘাতের পরিণাম, যে সংঘাত ছিল ধর্মযুদ্ধ নামে
খ্যাত । সেই প্রাক্মধ্যযুগে ইউরোপ ছিল অজ্ঞানের অন্ধকারে আচ্ছন্ন, ধর্ম ও কিছু ধর্মীয় সাহিত্য ছাড়া আর কিছুরই চর্চা ছিল
না । ইউরোপীয় সভ্যতার প্রাচীন জ্ঞানের মশাল যারা জ্বালিয়েছিল সেই গ্রীক ও রোমান
সভ্যতার জ্ঞান খৃষ্টধর্মের প্রচারের পর পৌত্তলিকদের অবদান বলে লোকে পরিত্যক্ত ও বিস্মৃত
হয়েছিল । পঞ্চদশ শতকে মুসলিম তুর্কী বিজেতাদের হাতে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতন ও
তার রাজধানী প্রাচীন নগরী কনস্টান্টিনোপল (আধুনিক ইস্তান্বুল) বিধ্বস্ত হয় ।
কনস্টান্টিনোপল শুধু রাজনৈতিক রাজধানীই ছিল না, ছিল প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সভ্যতার শেষতম সাংস্কৃতিক
রাজধানী ও । বিধ্বস্ত নগরী থেকে পণ্ডিতেরা পুঁথিপত্র নিয়ে পালিয়ে ইতালির
ফ্লোরেন্সে আশ্রয় নেন । সেখানে নূতন করে প্রাচীন বিদ্যার চর্চা শুরু হয়; সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, আদি নানা বিষয়ে প্রাচীন গ্রীকরা যে শাশ্বত অবদান রেখে
গিয়েছিলেন, তা ইউরোপের কাছে নূতন করে
উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে । এইভাবে ইতালি থেকে ইউরোপীয় রেনেসাঁর শুরু হয় ।
অন্যদিকে, ইউরোপে বিস্মৃত হলেও, নবীন ধর্ম ইসলামে দীক্ষিত এশীয় আরবদের গ্রীক (আরবি ভাষায় ইউনানি) জ্ঞানের সঙ্গে অনেকখানি
পরিচয় ঘটেছিল ইজিপ্ট (মিশর) অধিকারের সূত্রে । ওই সমকালে তাদের সাম্রাজ্য ছিল
ভারতের পশ্চিম প্রান্ত থেকে মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা হয়ে দক্ষিণ ইউরোপের কিছু
অংশ পর্যন্ত। সেই বিশাল ভূখণ্ডের জ্ঞানরাশির সঙ্গে তারা পরিচিত হয়েছিল, এবং নিজেদের অভিজ্ঞতা সংযোজন করে মুসলিম পণ্ডিতেরা
অনেক সুসংহত বিদ্যার জন্ম দিয়েছিলেন। এভাবে এক উন্নত সভ্যতা গড়ে উঠেছিল যার তুলনায়
তখনকার ইউরোপকে অর্ধসভ্য বলা যেতেই পারত ।
ইউরোপের কিছু অংশ অর্থাৎ স্পেন, সিসিলি এবং কনস্টান্টিনোপল(বর্তমান ইস্তানবুল)
নিজেদের অধিকারে নিয়ে আসাতে মুসলিমরা(আরব, তুর্ক ) ইউরোপের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘাতে আসে । আগেই তারা জেরুজালেম ও
অন্যান্য খৃষ্টীয় ধর্মক্ষেত্রগুলো সহ পশ্চিম এশিয়া দখল করেছিল । আরব বণিকেরা ইউরোপ থেকে এশিয়া যাবার মাঝপথে নিজেদের অবস্থান জনিত
সুবিধার কারণে শুধু ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অভিমুখী বণিকদের কাছ থেকেই উচ্চ
হারে শুল্ক আদায় করত না, খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীদের
থেকেও জিজিয়া কর আদায় করত । ভারত ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে উৎপাদিত মশলা
ছিল শীতল জলবায়ুর ইউরোপীয় দেশগুলোর
অত্যন্ত প্রয়োজনীয় আমদানি বাণিজ্য । এইসব কারণে ইউরোপীয় বণিকদের তুর্ক ও আরবদের প্রতি ক্ষোভ ছিল । এককালের প্রবল
পরাক্রান্ত বাইজেণ্টাইন সাম্রাজ্য, নানা অন্তর্দ্বন্দ্বে দুর্বল হয়ে পড়ায় ইসলামের নবীন
শক্তিকে বাধা দেবার কেউ ছিল না । এই অবস্থাতে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট
একাদশ কন্সটান্টাইন রোমান ক্যাথলিকদের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু পোপের কাছে সাহায্যের
আবেদন করলে পোপের নির্দেশে ইউরোপের কিছু দেশ ধর্মযুদ্ধে যোগদান করে । এই ধর্মযুদ্ধ
একাদশ শতক থেকে শুরু করে বেশ কয়েকবারই হয়েছিল, এবং বেশির ভাগ সময়েই ইসলামী শক্তির কাছে ইউরোপীয়
শক্তির হার হয়েছিল। যে কোনো যুদ্ধেই সৈন্যদলের সঙ্গে কিছু জ্ঞানপিপাসুও
থাকেন, তারা যুদ্ধটুদ্ধের মধ্যে থেকেও
জ্ঞান চর্চা করেন ।
এইভাবেই ধর্মযুদ্ধের সুফল
ফলে, ইউরোপের পণ্ডিতেরা আরবদের
সংস্পর্শে এসে নতুন জ্ঞানের ভাণ্ডার খুঁজে পান, এবং দেশে ফিরে সেই জ্ঞানের চর্চা শুরু করেন ।
এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী । ফ্লোরেন্সের শরণার্থী গ্রীক
বিদ্বানদের থেকে পাওয়া সাহিত্য, তর্কশাস্ত্র, দর্শনের সঙ্গে পরিচয় হয়ে চিন্তার মান উন্নত হয়েছিল । আরবদের কাছ
থেকে পাওয়া গ্রীক জ্যামিতি, গ্রীক চিকিৎসা শাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, বীজগণিত, রসায়ন শাস্ত্রের চর্চা করে ইউরোপে বিজ্ঞানের ভিত্তি রচিত হল । জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা পৃথিবীর
আকৃতি ও গতি সম্পর্কে নূতন ধারণার জন্ম দিল যা ছিল ধর্মশাস্ত্রোক্ত ধারণার
পরিপন্থী । বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত চার্চের উক্তির সঙ্গে না মেলায়, চার্চের বিরোধিতা করায় বহু বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিককে
(যাদের অনেকেই ছিলেন ধর্মযাজক ও ধর্মশাস্ত্রে সুপণ্ডিত) অনেক প্রাতিষ্ঠানিক
অত্যাচার, এমন কি মৃত্যু পর্যন্ত বরণ করতে
হয়েছিল । কিন্তু অত্যাচার বিজ্ঞানের এবং যুক্তির স্পিরিটকে শেষ পর্যন্ত দমিয়ে
রাখতে পারে নি । তবে রাজশক্তি এবং বণিকশক্তি নিজেদের স্বার্থের আশায় শেষ পর্যন্ত
নতুন বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তগুলোকে মেনে নিয়েছিল, এবং সহায়ক ও হয়েছিল । একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে ।
ধর্মশাস্ত্রে বলা আছে পৃথিবী চ্যাপ্টা (থালার মত), এবং সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে । সেইজন্য লোকের
ধারণা ছিল আটলাণ্টিক মহাসাগরের ওপারে চ্যাপ্টা পৃথিবীর শেষ, এবং সেখান থেকে ফিরে আসা যায় না । কিন্তু যখন
জ্যোতির্বিদেরা প্রমাণ করলেন যে পৃথিবীর আকার গোল, এবং সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে না, বরং পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে ঘোরে, গোঁড়া ধর্মব্যবসায়ীরা তা না মানলেও এই সিদ্ধান্ত
নাবিকদের প্রভাবিত করেছিল, তারা বুঝতে পারছিল যেহেতু গোল
জিনিষের কোনো আদি অন্ত হয় না, পৃথিবীর যে কোনো বিন্দু থেকে
সোজা সামনের দিকে বেরোলে যতদিনেই হোক, সেখানেই ফিরে আসা যাবে । কম্পাস(দিগ্দর্শন যন্ত্র)
এবং অ্যাস্ট্রলাব(অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমা মাপক যন্ত্র)-এর মত সমুদ্রযাত্রায় সহায়ক
যন্ত্র ততদিনে হাতে এসে গেছে । এই সিদ্ধান্তের উপর ভরসা করে অনেক নাবিক
রাজানুকূল্যে জাহাজ ও লোকলস্কর নিয়ে অকূল আটলান্টিকের জলে নতুন পথ খুঁজতে বেরিয়ে
পড়েছিলেন, এবং সফলও হয়েছিলেন । এইভাবেই
আফ্রিকার দক্ষিণতম বিন্দু ঘুরে ভারতে আসবার নতুন রাস্তা পাওয়া গিয়েছিল, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার মত মহাদেশ এবং প্রশান্ত মহাসাগরকে জানা
গিয়েছিল, অনেক নূতন নূতন দ্বীপ ও দ্বীপপুঞ্জের খোঁজ পাওয়া
গিয়েছিল ।
আগে চার্চের আধিপত্য ছিল প্রবল, রাজশক্তিকেও তার কাছে মাথা নোয়াতে হত । অত্যন্ত
শক্তিধর হওয়াতে চার্চ-এর কাজে কর্মে প্রশ্ন করবার, বিরোধিতা করার সাহস খুব কম শাসকেরই হত । কিন্তু
অত্যধিক ক্ষমতা হওয়ায় ধীরে চার্চের ভেতরে আপাদমস্তক দুর্নীতি ও চরিত্রের দোষ দেখা
দিল --- পোপেরা ও তার বাইরে ছিলেন না । নিজেদের ক্ষমতা রাখতে তাঁরা যেন তেন
প্রকারেণ অর্থের উপায় করতেন, খ্রিষ্টান সমাজে একঘরে করার ভয়
থেকে অনন্ত নরকের ভয় পর্যন্ত দেখিয়ে রাজাপ্রজা সকলের কাছ থেকে টাকা আদায় করতেন ।
বিরোধিতা করে দেশে দেশে চার্চের মধ্য থেকেই কত জন যে আগুনে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে
মৃত্যুবরণ করেছিলেন তার সংখ্যা নেই । অন্যদিকে রাজারাও নিজেদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, ক্ষমতাপ্রদর্শন, গৃহযুদ্ধ, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ইত্যাদিতে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন, তাঁদের কোষাগার ভর্তি হবার প্রয়োজন ছিল । তাই তারা
নাবিকদের পৃষ্ঠপোষণ করেছিলেন । নাবিকেরা যখন নূতন দেশ আবিষ্কার করে ফিরেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই সেই ভূমির মালিকানা সেই নাবিকের
পৃষ্ঠপোষক রাজ্যের হত । নূতন ভূখণ্ডে গড়ে উঠত উপনিবেশ । স্থানীয় আদিবাসীদের উপর
অত্যাচার উৎপীড়ন চালিয়ে লুটপাট হত্যা করে সম্পদ কেড়ে
নিয়ে দেশে পাঠানো হত । সেই সম্পদে সেই রাজ্যের সমৃদ্ধি হত, এভাবেই ইউরোপীয় দেশগুলোর, বিশেষ করে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, ইটালি, জার্মানি, হল্যান্ড, ডেন্মার্ক, বেলজিয়াম ---- ইত্যাদি দেশের সমৃদ্ধি হয়েছিল উপনিবেশগুলোর সম্পদে ।
শাসকবর্গের ও ব্যবসায়ীবর্গের হাতে সম্পদ ও শক্তি আসায়
চার্চের প্রতিপত্তি কমল । চার্চের বিরুদ্ধে যে সব প্রশ্ন আগে থেকেই অল্প অল্প
উঠছিল, কিন্তু কঠোর ভাবে দমন করে রাখা
হচ্ছিল, সেইসব প্রশ্ন আরো বেশি করে উঠতে
শুরু হল । চার্চের মধ্য থেকেই ধর্মসংস্কার আন্দোলন শুরু হল । স্বয়ং পোপের আধিপত্য
নিয়ে চার্চের মধ্য থেকেই প্রশ্ন উঠল । এর ফলে পঞ্চদশ শতকে ক্যাথলিক চার্চ বিভাজিত হয়ে গেল, মূল ভাগ ক্যাথলিক, বিরোধী ভাগ প্রোটেস্ট্যান্ট নামে পরিচিত হল ।
সম্পদ বৃদ্ধির অন্য ফল হল পরবর্তীকালের শিল্পবিপ্লব
(অষ্টাদশ/ উনবিংশ শতক) । নূতন নূতন যন্ত্র আবিষ্কারের ফলে আবিষ্কৃত যন্ত্রের সাহায্যে উৎপাদন বৃদ্ধি হল, উৎপাদিত মাল বিক্রির জন্য বাজার চাই । পুরোনো বাজারে
প্রতিযোগিতা বেশি, মুনাফা কম । নূতন বাজার দখলের
জন্য নূতন উপনিবেশের প্রয়োজন হল । বাণিজ্যের জন্য যেসব কোম্পানি গঠিত হত, স্বদেশের শাসকবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা বিভিন্ন দেশে
বাণিজ্য করতে গিয়ে নতুন নতুন উপনিবেশ স্থাপন করল । উপনিবেশগুলো ইউরোপে শিল্পের
উপযোগী কাঁচামাল জোগাত, নানা ফন্দিফিকিরে উপনিবেশের
বাজারে ইউরোপের কারখানায় উৎপাদিত মাল বিক্রি
হত।উপনিবেশবাদ থেকেই পরবর্তীকালে
সাম্রাজ্যবাদের পত্তন হল ।
নূতন দেশ আবিষ্কৃত হলে, যেমন উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা কিংবা অস্ট্রেলিয়া, সেখানকার আদিম অধিবাসীদের সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্রে বলীয়ান নাবিকেরা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে
জড়িয়ে পড়ে, বেশিরভাগ সময়েই সেই যুদ্ধ ছিল
একতরফা । ইউরোপীয়দের কাছে নূতন দেশ হলেও
সেই সব দেশে লোকবসতি ছিল, তাদের মধ্যে অনেকের উন্নতমানের
সভ্যতা ও ছিল । ইউরোপীয় নাবিকেরা তাদের ধ্বংস করে, তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করে নিজের দেশের সমৃদ্ধি বিধান
করে । দেশ দখলের পর বিধ্বস্ত ও হতমান আদিবাসীদের উপর খ্রিস্টধর্ম ও ইউরোপীয়
সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়া হয় । অনেকে নাবিকদের সঙ্গে আসা রোগে মারা যায় । অনেকে আবার
পালিয়ে যায় দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় । জীবনযাপনের জন্য ইউরোপীয়দের খেত খামার কারখানায়
শ্রমজীবীর কাজ করে কেউকেউ । ইউরোপীয় দখলদারদের
মুক্তচিন্তার সঙ্গে নীতিবোধের বালাই ছিল না ।
আফ্রিকা মহাদেশের উত্তরাংশ ছাড়া বাকি ভূভাগের সঙ্গে
পুরোনো পৃথিবীর পরিচয় ছিল না । উত্তরাংশের দক্ষিণে বিশাল সাহারা মরুভূমি এবং
উপকূলে উঁচু পাহাড়, মালভূমি, নদীগুলো জলপ্রপাতবহুল, খরস্রোতা, জলবায়ু উষ্ণ এবং আর্দ্র, তাই ঘন বনে আচ্ছন্ন--- প্রাকৃতিক কারণেই আফ্রিকা
প্রায় অগম্য ও অন্ধকারাচ্ছন্ন বলে কথিত ছিল । কিন্তু পঞ্চদশ শতকের প্রথম দিকে এই
মহাদেশের দক্ষিণ বিন্দু ঘুরে ভারতে আসার রাস্তা খুঁজে পাবার পর আফ্রিকার সীমা
সম্পর্কে ইউরোপীয় নাবিকদের ধারণা হয়ে যায় । ইউরোপীয়েরা বিশেষ করে পর্তুগীজরা
আফ্রিকার এতদিনের অগম্য বলে কথিত অন্দরে ঢুকবার চেষ্টা করতে থাকে । তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল দাস ব্যবসায় । আফ্রিকায়
দাসব্যবসায়ে অগ্রণী ছিল আরবেরা । তারা মিশরের দক্ষিণে সুদান ও আবিসিনিয়া(ইথিওপিয়া)
দখল করে পূর্ব উপকূলের বেশির ভাগই নিজেদের প্রভাবাধীন করে ইসলাম ধর্ম প্রচার এবং
দাসসংগ্রহ করত । আলেকজান্দ্রিয়া বন্দর শহর ছিল দাসব্যবসায়ের প্রধান কেন্দ্র । এখান
থেকে আরবেরা মিশর, পশ্চিম এশিয়া ও ভারতের বিভিন্ন
শহরে দাস বিক্রয় করত । পর্তুগিজেরা পশ্চিম আফ্রিকার দিক দিয়ে মহাদেশের মধ্যে ঢুকে
একদিকে খ্রিস্টধর্ম প্রচার ও অন্যদিকে স্থানীয় সম্পদ আহরণ ও দাস সংগ্রহ করতে থাকে
। স্পেন ও পর্তুগালের নাবিকেরাই ইউরোপীয়দের মধ্যে সর্বপ্রথম নূতন রাস্তার খোঁজে
সমুদ্রযাত্রায় বেরিয়েছিল(কলম্বাস ইতালীয় হলেও স্পেনের রাজারানির আনুকূল্যে ভারতে পৌঁছানোর
রাস্তার খোঁজে বেরোতে পেরেছিলেন, ঘটনাক্রমে আমেরিকার উপকূলে পৌঁছেছিলেন )। ততদিনে আমেরিকার
বিভিন্ন প্রান্তে স্পেন ও পর্তুগালের উপনিবেশ স্থাপিত হয়ে গেছে, সেখানে বন পরিষ্কার করতে, খামার বানাতে, খনিতে কাজ করতে অনেক কর্মীর দরকার ছিল, সেজন্য আফ্রিকার মানুষকে দাস হিসেবে আটলান্টিকের
ওপারে পাঠানো হত প্রচুর অর্থের বিনিময়ে । এই দাসব্যবসায়ে পরে ব্রিটিশ ও ফরাসীরাও যোগ দেয় উত্তর
আমেরিকাতে তাদের উপনিবেশের জন্য । অত্যন্ত নিষ্ঠুর অমানবিকভাবে নিয়ে যাওয়া এইসব
আফ্রিকীয়দের বেশির ভাগই দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় মারা যেত ।
ইউরোপীয় বণিকেরা এশিয়ার যেসব দেশে বাণিজ্যের
উদ্দেশ্যে গিয়েছিল, যেমন ভারত, চীন, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, সেই সব দেশে ধীরে ধীরে স্থানীয় রাজশক্তিকে নানা উপায়ে
তুষ্ট করে বাণিজ্যের সুবিধা আদায় করে নিত । কিন্তু রাজশক্তির দুর্বলতার লক্ষণ দেখা
দিলেই নিজেদের সুবিধার্থে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করতে দ্বিধাবোধ করত না ।
বাণিজ্যের জন্য এলেও তাদের সঙ্গে থাকত সুশিক্ষিত সৈন্যদল এবং উন্নতমানের অস্ত্রভাণ্ডার
। বাণিজ্যের কুঠিগুলোতে দুর্গ গড়ে তারা নিজেদের অবস্থানকে পোক্ত করে তুলত । সেই
পোক্ত অবস্থান থেকে যুদ্ধবিগ্রহে জড়িয়ে পড়তে সুবিধে হত । ভারতে এভাবে তারা কলকাতা, বোম্বাই(এখনকার মুম্বাই), ও মাদ্রাজ(চেন্নাই) গড়ে তুলেছিল। ব্রিটিশ শাসনের
প্রসার হলে এগুলো শহরে পরিণত হয় । শক্তি বৃদ্ধি হলে তারা উপনিবেশ তৈরি করে, সেইসব উপনিবেশের সঙ্গে দেশের সাধারণ লোকের কাজের
সম্পর্ক ছাড়া কোনো মেলামেশা থাকত না । ধীরে ধীরে উপনিবেশগুলোকে এক করে সাম্রাজ্যের
পত্তন হয় । সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল---- উপনিবেশের সমস্ত সম্পদ শোষণ
করে নিজেদের এবং নিজেদের দেশের স্বার্থে খাটানো । সেই লক্ষ্যে স্থানীয় কিছু উন্নতি
দরকারি ছিল, তাই কিছু সাধারণ কাজ চালানোর
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল । কিছু পরিকাঠামো, যেমন রেল, ডাক, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ, ইত্যাদি চালু করা হয়েছিল সাম্রাজ্য সুষ্ঠু পরিচালনের
লক্ষ্যে, কারণ শান্তি ছাড়া উৎপাদন সম্ভব
হয় না । কিন্তু এইসব উন্নয়নের সঙ্গে সাধারণ মানুষের হৃদয়ের যোগাযোগ
ছিল কম, কারণ নতুন শাসকেরা শুধু বিদেশীই
নয়, দেশীয়দের প্রতি তাদের ব্যবহার
ছিল অত্যন্ত অসম্মানজনক ।
তবু এর কিছু ইতিবাচক দিক ছিল। অষ্টাদশ শতকে ভারতে কেন্দ্রীয়
শাসনব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় অরাজকতার প্রাদুর্ভাব হয়েছিল । সারা দেশে অসংখ্য ছোটবড়
রাজ্যের উদ্ভব হয়েছিল, অবিরত যুদ্ধবিগ্রহে দেশে
শান্তির বালাই ছিল না । ব্রিটিশ শাসনে প্রথম কয়েক দশক বাদে আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছিল । উচ্চশিক্ষার জন্য ধনিকশ্রেণির
সন্তানেরা বিলাত যেতেন, সেখানে অনেকেই শিক্ষা ও
স্বাধীনতার প্রকৃত তাৎপর্য বুঝে ইউরোপীয় দেশের সঙ্গে স্বদেশের তুলনামূলক বিচার
করতেন । দেশে ফিরে বইপত্র লেখা, পত্রিকা সম্পাদনা, জনমত ও প্রতিষ্ঠান গঠন, ইত্যাদি কার্যে শুধু নিজেরাই লিপ্ত হতেন না, সরকারকে সংস্কারের জন্য চাপ দিতেন । দেশে যতটুকু শিক্ষার সম্ভাবনা ছিল, সেইটুকুকে কাজে লাগিয়েও অনেকে এই কাজগুলো করতেন ।
আধুনিক যুগে বিদেশী সাহিত্যের আদর্শে আমাদের দেশে সাহিত্য রচিত হয়, বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ বাড়ে । শিক্ষার প্রসার ও
প্রচারের ফলে মানুষের মনে অধিকারবোধ জাগ্রত হয়, শোষকের বিরুদ্ধে জনমত জেগে ওঠে ।
এই শিক্ষিত শ্রেণিই পরে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে
নেতৃত্ব দেন । এরা মূলত ইংরাজি ভাষাতে শিক্ষা লাভ করায় ইংরাজি ভাষায় সারা দেশের
শিক্ষিতসমাজের মধ্যে ভাবের যোগাযোগ সহজতর হয়েছিল । অন্যদিকে, কিছু ইউরোপীয় পণ্ডিত ছিলেন যাঁরা এদেশে এসে এখানকার
সভ্যতা সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে উৎসুক ছিলেন । তাঁরা এখানকার কিছু বিদ্বানদের
সহায়তায় প্রাচীন ভারতীয় ভাষা, ও তাতে রচিত বিচিত্র বিষয়ের
গ্রন্থাদির সন্ধান করে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করেন, নিতান্তই মুষ্টিমেয় লোকের কাছে সীমাবদ্ধ জ্ঞানের
পুনরুদ্ধার ও পুনর্ব্যাখ্যা করেন । আজ যে আমরা ভারতবাসী দেশের প্রাচীন সভ্যতার
গৌরব করি, সেই গৌরব জাগানোর জন্য এইসব
বিদেশী পণ্ডিতের অবদান অবশ্য স্মরণীয় ।
এইভাবে ইউরোপীয় রেনেসাঁর ঢেউ ভারতে পৌঁছেছিল এবং
দেশের মানসিকতায় বিরাট পরিবর্তন এনেছিল । অসংখ্য জাত বর্ণ গোষ্ঠীর মধ্যে একই দেশের
অধিবাসী হিসেবে বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে একতার চেতনা এবং পরবর্তীকালে স্বাধীনতা এরই
প্রাপ্তি ।
এতক্ষণ পর্যন্ত যা বলছিলাম, তা থেকে হয়তো অল্প বোঝাতে পারছি যে ইউরোপীয় নবজন্মের
প্রভাব ইউরোপ ছাড়িয়ে অন্যান্য দেশে ছড়ালেও তা কোথাও
সার্বিক হয়নি । শক্তির আগ্রাসন ছিল, সম্পদের ঔদ্ধত্য ছিল, ধর্মের গোঁড়ামিও ছিল, যা দেশে দেশে সাধারণের জীবনযাত্রাকে সুস্থতার মাত্রায়
পৌছাতে দেয় নি । সার্বিক না হওয়াতে সমাজের সেই অবস্থাকে সভ্যতার পূর্ণাঙ্গ রূপ
কিছুতেই বলা যাবে না । বিভিন্ন দেশে মুষ্টিমেয় কিছু লোক তার সুফল পেয়েছিল । শ্রমিক, কৃষক,ইত্যাদি সমাজের নিম্নবর্গের অবস্থা সর্বত্র একই রকম করুণ ছিল । নিম্নবর্গের লোকদেরই ট্যাক্স দিতে হত বেশি । ফ্রান্সের মত বড় ও তখনকার
দিনে ইউরোপের সব চাইতে ধনী দেশেও কৃষকদের জমির উপর, সম্পত্তির উপর ট্যাক্স দিতে হত, চার্চের মাসোহারা টাকা দিতে হত, জমিদারের কোনো কল (যেমন গম পেষাই করার যন্ত্র বা
জলসেচের ব্যবস্থা) ব্যবহার করলে তার খরচ দিতে হত, তার উপর যুদ্ধবিগ্রহ লাগলে অতিরিক্ত খরচের জন্য বাড়তি
ট্যাক্স ও দিতে হত । ফলে ভাল ফসল না হলে তাদের প্রায় অনাহারে থাকতে হত । অন্যদিকে, অভিজাত ও পুরোহিতশ্রেণির লোকেদের ট্যাক্স ছিল
নামমাত্র । শিল্পবিপ্লবের পর অবস্থা করুণতর হয়েছিল, বড় বড় যন্ত্র আবিষ্কারের ফলে কারখানা গড়ে ওঠে, এতদিন হাতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা কারিগররা কাজ
হারায়, কারখানায় যৎসামান্য পারিশ্রমিকে
কাজের জন্য শহরে ভিড় করে, যারা কাজ পায়, তারা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বস্তিতে থাকতে
বাধ্য হয়, শিক্ষাদীক্ষার কোনো ব্যবস্থা
ছাড়াই । সমাজে ধনী দরিদ্রের ফারাক প্রচণ্ড রকমে বাড়তে থাকে । অনেক স্থানেই কৃত্রিম
দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি দেখা দেয় । শ্রমিকেরা বিদ্রোহ করলেই ছিল কঠোর হাতে দমনের
নীতি ।
এ তো গেল অনেক ইউরোপীয় দেশের ভেতরের কথা । দেশীয়
সমাজের বাইরে গেলে সুসভ্য ইউরোপীয় সমাজের সন্তানেরা নিতান্তই আদিম অসভ্যদের মতনই
কাজ করত, সামনে সভ্যতার মুখোশ ঝুলিয়ে । উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় তারা
আদিবাসীদের জীবন, সভ্যতা সংস্কৃতিকে প্রায়
ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছিল । ভারত, মধ্যপ্রাচ্য বা চীনে তারা অষ্টাদশ শতক থেকে শোষণ
করেছে, কিন্তু ধ্বংস করতে পারেনি, প্রাচীন সভ্য এইসব দেশের সংস্কৃতির কাঠামো ছিল মজবুত, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অনেক বৈদেশিক আক্রমণের ঝড়
ঝাপটা তারা সয়ে এসেছে । চীন এবং মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ উপনিবেশ থাকলেও সেখানে
ভারতের মত দেশীয় শাসকদের উৎখাত করে সাম্রাজ্যগঠন হয় নি । ব্রিটিশেরা চীনে আফিমের ব্যবসা
করত । ভারতের চাষিদের আফিম উৎপাদন
করতে বাধ্য করা হত । সেই আফিম জাহাজে করে নিয়ে চীনে বিক্রি করা হত, ওখানকার সরকারকে যুদ্ধে পর্যুদস্ত করে আফিং ব্যবসায়ের
পথ সুগম করতে বাধ্য করা হত । মধ্যপ্রাচ্যে বাণিজ্যের পথ সুগম করার জন্য উপনিবেশ গড়ার দরকার ছিল, তাই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান, নদী কিংবা সমুদ্রবন্দর, উপকূল সংলগ্ন দ্বীপপুঞ্জে ছিল ব্রিটিশ, ফরাসী, পর্তুগিজ ও ডাচ আধিপত্য । পরে বিংশ শতকের প্রথমার্ধে মোটর গাড়ি ও এরোপ্লেন এবং
শ্রমশিল্পের প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে নতুন আবিষ্কৃত পেট্রলিয়ামের খনির আধিপত্য
লাভের জন্য ব্রিটিশ ও আমেরিকানরা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে ।
আগেই বলা হয়েছে, আফ্রিকা মহাদেশের উত্তরাংশ সুপ্রাচীন কাল থেকেই
পৃথিবীতে পরিচিত ছিল, কিন্তু সাহারা মরুভূমির দক্ষিণ
থেকে শুরু করে উত্তমাশা অন্তরীপ পর্যন্ত বাকি মহাদেশের সম্পর্কে কোনো ধারণা
ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত ছিল না।পর্তুগিজেরা আরবদের হাত এড়িয়ে ভারতে পৌঁছোবার নতুন
রাস্তা খোঁজার চেষ্টা করছিল, সেভাবেই তারা উত্তমাশা অন্তরীপ
ঘুরে ভারতের কালিকটে পৌছে । তার পর থেকে ইউরোপীয় অন্যান্য দেশের নাবিকেরা, যেমন হল্যান্ড, জার্মানি, ইটালি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড---- সকলের নজর এতদিনের আড়ালে থাকা এই বিশাল
ভূখণ্ডের উপর পড়ে । দক্ষিণ আফ্রিকা দুর্গম ও জলবায়ু প্রতিকূল হলেও সম্পদে ভরপুর, বিশেষ করে সোনা ও হিরের অফুরন্ত খনি। ইউরোপে জনসংখ্যা
বৃদ্ধির তুলনায় কৃষিজমি ছিল কম, তাই নতুন ভূমির সন্ধানে শুধু
ইউরোপীয় বণিকই নয়, চাষিরাও উৎসুক ছিল । স্থানীয়
উপজাতিদের পর্যুদস্ত করে তাদের জমি অধিকার করে বড় বড় খামার বানানো হত, তাতে খাটতে আসতে বাধ্য হত আফ্রিকীয় কালো শ্রমিক । প্রটেষ্ট্যান্ট খ্রিস্টধর্মের
শাখা ক্যাল্ভিনবাদী মত এখানে প্রচার হয়েছিল। এই মতের অনুসারে মানুষ ঈশ্বরের
ক্রীড়নক মাত্র, ঈশ্বর তাঁর পছন্দমত কিছু লোককে
বেশি অনুগ্রহ করেন, কাউকে আবার করেন না, সবই তাঁর ইচ্ছা । এই মতবাদ আফ্রিকায় কালো মানুষের এবং আমেরিকায় আদিবাসীদের বিপক্ষে সাদাদের পক্ষে
অত্যন্ত চতুরভাবে প্রযুক্ত করা হয়েছিল । বলা
হয়েছিল, সাদারা মনিব আর কালোরা দাস----
এই ব্যাপারটা ঈশ্বরেরই বিধান । আশ্চর্য এই যে, ধর্মসংস্কার আন্দোলনে যারা দুর্নীতি, ভণ্ডামি ও কুযুক্তির বিরুদ্ধে
লড়াই করে স্বদেশে খোলা হাওয়ার সূচনা করেছিল, তাদেরই ধর্মভাইয়েরা সেই ধর্মের ফাঁক দিয়ে অন্য দেশে
অন্য মানুষদের দাসত্বে বেঁধেছিল ।
উপনিবেশগুলোর দখলদারি নিয়ে প্রথম থেকেই যুদ্ধবিগ্রহ
কম হয়নি । আমেরিকায় স্বাধীনতার যুদ্ধ ছিল ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও আমেরিকান উপনিবেশগুলোর মধ্যে লড়াইয়ের পরিণাম । ইউরোপে ফ্রান্স ও
ইংল্যান্ড ছিল বহু শতাব্দীর শত্রু । ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতে মুখ্যত ইংরেজ অভিবাসী
বসবাস করলে ও ইংল্যান্ডের সরকার তাদের সঙ্গে বিমাতৃসুলভ ব্যবহার করত । তাদের
সরকারের চাপিয়ে দেওয়া অত্যধিক কর দিতে হত, কিন্তু তারা কোনরকম সাহায্য সুবিধা পেত না। একসময় কর
দিতে অস্বীকার করলে ইংরেজ সরকার তাদের বিরুদ্ধে বাহিনী পাঠায় । এই লড়াইয়ে ফ্রান্স
ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোর পক্ষ অবলম্বন করে । শেষপর্যন্ত ইংরেজ সরকার আমেরিকার
স্বাধীনতা ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি । আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে অনুপ্রাণিত
ফ্রান্সের জনগণ নিজেদের দেশে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে, ও উৎখাত করে । ফ্রান্সে সাময়িক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা
হলেও তার সেরকম মজবুত ভিত তখনো গড়ে ওঠেনি । তাই কিছুদিন পর জনগণের নেতা নেপোলিয়ন ও সম্রাটে পরিণত হন । শতাব্দীর বেশি কাল ধরে চারটি
গণতান্ত্রিক সরকারের পতনের ফাঁকে ফাঁকে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় । ১৯৫৮
সালের পর সেখানে স্থায়ী গণতান্ত্রিক
সরকার চলছে । ‘স্বাধীনতা, সাম্য,এবং ভ্রাতৃত্ব’এর প্রবক্তার দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে এত সময়
লেগেছে ।
সারা আঠারো, উনিশ ও বিশ শতকের প্রথম ভাগ ধরে উপনিবেশের বিস্তার ও বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা নিয়ে এইসব দেশের মধ্যে প্রায়ই
ছোটখাট লড়াই চলতেই থাকত । সুবিধামত একে অপরকে দুর্বল করার চেষ্টা করত, তৃতীয় পক্ষের সাহায্য নিত । ভারতে ইংরেজ ও ফরাসীদের
মধ্যে, আফ্রিকায় ডাচ বুওর ও ইংরেজদের
মধ্যে, উত্তর আমেরিকায় ইংরেজ ও
ফরাসিদের মধ্যে লড়াই চলতেই থাকত । ইউরোপে, বিশেষত ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি(প্রাশিয়া), অস্ট্রিয়া ও রাশিয়া----এইসব দেশের মধ্যে পূর্বোক্ত
কারণে প্রায়ই যুদ্ধ হত । এইসব লড়াইয়ের পরোক্ষ পরিণতি বিংশ শতকের দুই লোকক্ষয়ী
মহাযুদ্ধ । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপীয় দেশগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে, উপনিবেশগুলোকে বলপূর্বক দখলে রাখা তাদের সাধ্যে ছিল
না । বিশেষ করে উপনিবেশগুলোর মধ্যেও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে উঠেছিল, আন্দোলন চলছিল, কোথাও সশস্ত্র, ভারতের মত দেশে অহিংস । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বছর দশেকের মধ্যে এশিয়ার বেশির
ভাগ দেশই স্বাধীনতা পায়, আফ্রিকার দেশগুলোর জন্য আরো
কিছু সময় লেগেছিল ।
স্বাধীনতা পেলেও বিশেষ করে ব্রিটেন ও ফ্রান্স এবং
আমেরিকা নিজস্ব স্বার্থের কারণে দীর্ঘদিন ধরে কিছু কিছু দেশে নিজেদের তাঁবেদার
সরকার বসায় । শাসনকার্যে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ না করলেও পরোক্ষভাবে প্রভাব রাখে ।
দক্ষিণ আফ্রিকায় ঔপনিবেশিক সরকার যে বর্ণবিভাজন নীতি চালিয়েছিল, তাতে স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি ন্যক্কারজনক ব্যবহার
করা হত, তাদের শহরের মধ্যে বসবাস করতে
দেওয়া হত না, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, সব কিছুই এই বিভেদনীতি দ্বারা প্রভাবিত ছিল ।
আফ্রিকার বিপুল খনিজ ও বনজ সম্পদের মালিকানা ছিল ইউরোপীয়দের । তাদের আসার আগে
আফ্রিকাতে কোনো সাম্রাজ্য ছিল না, ছিল উপজাতীয়দের নিজস্ব
গোষ্ঠীগুলোর শাসন । প্রত্যেকটি উপজাতির ভাষা, সংস্কৃতি, বাসস্থান, আচারব্যবহার ছিল আলাদা । গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে যে সব সময়ই শান্তি বিরাজ করত তা
নয়, কিন্তু তেমন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ
হত না, তারা নিজেদের সীমা মেনে চলত ।
উপনিবেশগুলি যখন স্বাধীন হল, তখন উপনিবেশ-রাষ্ট্রগুলোর উপর চাপানো কৃত্রিম জাতীয়তা
বেশিদিন টেকেনি, অচিরেই বিভেদ দেখা দেয় ও তার
পরিণামে গোষ্ঠীসংঘর্ষে দেশগুলো আরো বিভক্ত হতে থাকে । বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফলানো
ফসল, যেমন রবার, তেলপাম, কফি, কোকো, ইত্যাদিতে নগদ আদায়ের সম্ভাবনা থাকায় ইউরোপীয়
বাণিজ্যিক স্বার্থের প্ররোচনায় স্থানীয় লোকে সেই ফসলগুলো চাষ করতে থাকে । বনজঙ্গল নষ্ট করে গড়া হয় বিশাল
বিশাল খামার, আফ্রিকার উদ্ভিদবৈচিত্র্য ও
জীববৈচিত্র্য এতে প্রচণ্ডভাবে নষ্ট হয় । বাণিজ্যিক ফসলগুলোর উৎপাদনে রাসায়নিক সার
ও কীটনাশক ব্যবহারে জমির উর্বরতা কয়েকবছরেই হ্রাস পায় । তাই খাদ্যফসলের উৎপাদন
বিপুল ভাবে ব্যাহত হয় । অনেক দেশই দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে, রাষ্ট্রশক্তি দুর্বল হবার জন্য অরাজকতা দেখা দেয় । সেই অরাজকতা ও দুর্ভিক্ষের রেশ বছরের পর বছর ধরে চলে
আসছে । আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে
মানুষ খাদ্য, সুস্থিত জীবন ও কর্মসংস্থানের
আশায় ইউরোপ পাড়ি দিচ্ছে । সমস্যার ভয়াবহতা এত বেশি যে আইনি পথে যাবার উপায় খুব কম
থাকায় হাজার হাজার লোকে বেআইনি পথে ছোট ছোট জীর্ণ নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে
ইউরোপ যাবার চেষ্টায় মাঝসমুদ্রে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারাচ্ছে । আফ্রিকার অনেক দেশই
খনিজ তেল, সোনা, তামা, লোহা, কোবাল্ট, প্ল্যাটিনাম, হিরে প্রভৃতি বহুমূল্য খনিজে সমৃদ্ধ হওয়াতে বহজাতিক
কম্পানিগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে, শাসকগোষ্ঠী ও ক্ষমতাবানদের হাত
করে দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে । অল্পসংখ্যক মানুষের হাতে অনেক অর্থ আসে, দেশের শহরগুলো বড় বড় বাড়ি গাড়িতে ভরে যায়, কিন্তু সাধারণ লোক দুর্ভিক্ষে ও সবল গোষ্ঠীর অত্যাচারে
মার খেতে থাকে । ফলস্বরূপ, বর্তমান আফ্রিকার অনেক দেশেই
সন্ত্রাসবাদ কায়েম হয়েছে । বোকো হারামের মত ভয়ঙ্কর জঙ্গীগোষ্ঠী নারকীয় হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন চালাচ্ছে, মধ্যযুগে ফিরবার হুংকার দিচ্ছে ।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ইউরোপীয় দেশগুলোর উপনিবেশ
থাকলেও রাষ্ট্রনীতিতে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ছিল না । এই অঞ্চলে পৃথিবীর ৬০% খনিজ তেল উত্তোলন করা হয় । অন্যদিকে শিল্পোন্নত ইউরোপ
আমেরিকায় তেল উৎপাদনের পরিমাণ খুবই সামান্য । মধ্যপ্রাচ্যের ইরান, কুয়েত, ইরাক, বাহ্রিন দ্বীপপুঞ্জ, সৌদি আরব, প্রত্যেকটা দেশই তেলসম্পদে ধনী । আধুনিক যুগে
অপরিহার্য এই তেলের বাজারে একচেটিয়া অধিকার জমাতে ইউরোপ ও আমেরিকা সদা সচেষ্ট ।
তাই এখানকার শাসকদের উপর তাদের প্রভাব বিস্তার করে তেল দখলের চেষ্টা করে পশ্চিমী
বহুজাতিক তেল কম্পানিগুলো, যাদের পেছনে তাদের সরকারের
প্রত্যক্ষ মদদ থাকে । মধ্যপ্রাচ্যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরও অনেকগুলো যুদ্ধ হয়েছে, অনেক সরকার পড়েছে, গড়েছে । এই অঞ্চলের স্থানীয় অধিবাসীদের গোঁড়ামি, বিভিন্ন ধর্মীয় ও জনজাতিদের পারস্পরিক বিবাদ
(শিয়া-সুন্নি ইত্যাদি ধর্মগোষ্ঠী, আরব, তুর্ক, ইরানি, কুর্দ, ইত্যাদি জনজাতিদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব), আধুনিক শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব, অনুন্নয়ন--- এইসব ছিদ্রপথে ইউরোপীয় ও আমেরিকানদের
এখানের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে হস্তক্ষেপ সহজ হয়ে পড়ে । ইস্রায়েল রাষ্ট্রের স্থাপনা, শক্তিবৃদ্ধি ও আগ্রাসন, এবং তাতে আমেরিকা ও ব্রিটেনের মদতও মধ্যপ্রাচ্যের
অশান্তিতে ইন্ধন যোগায় । সর্বোপরি, পশ্চিম এশিয়ায় তৎকালীন সোভিয়েত
সরকারের ক্রমবর্ধমান প্রভাব খণ্ডন করতেও পুঁজিবাদী পশ্চিমী দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যের
দেশগুলোকে বোড়ে বানায় । পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোতে হয় রাজতন্ত্র, নয় একনায়কতন্ত্রের সরকার চলছে, সেখানে গণতন্ত্র নেই বললেই চলে । সে অবস্থাতে এইসব
দেশে উন্নয়নের যা মাত্রা ছিল, তা এই সব যুদ্ধবিগ্রহ অশান্তির
ফলে বিনষ্ট হবার পথে । পশ্চিমী জুলুমবাজির বিরুদ্ধে গোঁড়া ইসলামী জঙ্গি গোষ্ঠী
মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, তাদের ঘোষিত লক্ষ্য মধ্যযুগের
ইসলামী স্বর্ণযুগের প্রত্যাবর্তন । পশ্চিমী শক্তি একদিকে চাইছে নিজেদের সংস্কৃতি অনুসারে
এই অঞ্চলে পরিবর্তন আনতে, অন্যদিকে বিভিন্ন মতাদর্শের জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে
অস্ত্র সরবরাহ করছে । অস্ত্রব্যবসায়ীরা
ফুলে ফেঁপে উঠছে । আর সর্বত্র দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের শক্তিবৃদ্ধি হচ্ছে, অবিরত হানাহানি চলছে, আর সাধারণ মানুষ অপরিসীম কষ্ট ভোগ করছে । বর্তমানে
আফগানিস্তানে তালিবান এবং সিরিয়া ও ইরাকে আই এস সন্ত্রাসবাদীদের হামলার দরুন দলে দলে শরণার্থী সীমান্ত পেরিয়ে বিভিন্ন দেশে এমন কি ইউরোপে ও আশ্রয়
নিচ্ছে । মধ্যপ্রাচ্যের অশান্তি বহুমাত্রিক। পশ্চিমী দেশগুলোর একদিকে নিজস্ব
স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্য, অন্যদিকে নিজেদের সংস্কৃতি, রাজনৈতিক ব্যবস্থা চাপিয়ে দেবার প্রচেষ্টা এই অঞ্চলকে
চরম অরাজকতার দিকে, সভ্যতার বিপরীতমুখে ঠেলে দিচ্ছে ।
ভারতে দু’শ বছরের ব্রিটিশ শাসন কালে দেশের সমস্ত সম্পদ শোষণ করে ব্রিটেনে চালান হত, ভারতীয়দের জন্য দারিদ্র্য এবং অসম্মান ছিল বরাদ্দ ।
স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় দেশের প্রাচীন গৌরব সাধারণকে উদ্বুদ্ধ করত বিদেশী শাসনের
বিরুদ্ধে একত্রিত হতে । এই উদ্বুদ্ধকরণে একদিকে যেমন প্রাচীন বিদ্যা ও জ্ঞান
বিজ্ঞানের চর্চার দ্বারা বৌদ্ধিক সমৃদ্ধি হয়েছে, অন্যদিকে কিছু লোককে অতীতচারী হবার দিকে ঠেলেছে, আধুনিক সভ্যতাকে বিদেশী বলে অভিহিত করে প্রাচীন
সভ্যতায় প্রত্যাবর্তনকে মুক্তির পথ বলেছে । এই অতীতচারী শ্রেণির মূলমন্ত্র --– পৃথিবীর যা কিছু জ্ঞানবিজ্ঞান সব কিছুই বেদে আছে।
ভারতীয় সভ্যতাই সব চেয়ে প্রাচীন, সবচেয়ে সমৃদ্ধ । যা কিছু
বহির্ভারতে আবিষ্কৃত হয়েছে, সব কিছুর বীজ ভারতের প্রাচীন গ্রন্থাদিতে
ছিল---- এই ধরণের দাবি । এই ধরণের দাবি পশ্চিম এশিয়ায় আগেই মাথা চাড়া দিয়েছিল
ওয়াহাবি ও খিলাফত আন্দোলনের সঙ্গে । পরে আফগানিস্তান, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশেও প্রভাব বিস্তার করেছে, যার মূল কথা হল ইসলাম ধর্মই সর্বশ্রেষ্ঠ, এবং মধ্যযুগের ইসলামী সভ্যতাই এই মতানুসারীদের
গন্তব্য । ওই সব দেশে ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি দ্বিতীয় শ্রেণির
নাগরিকের মত ব্যবহার করা হয়, তাদের প্রতি হিংসাও চলে, প্রাচীন সভ্যতার প্রত্নকে ইসলামবিরোধী বলে ধ্বংস করা
হয় । এইধরণের মতবাদের কোনো দৃঢ়
যুক্তির ভিত্তি নেই, যুক্তিহীন গোঁড়ামি, একদেশদর্শিতা, অসহিষ্ণুতা, এবং তার ফলশ্রুতিতে হিংসা এর বৈশিষ্ট্য । ভারতের বর্তমান অবস্থাতেও এই লক্ষণ প্রকট ।
সংখ্যালঘুদের প্রতি, দলিতসমাজের প্রতি সংখ্যাগুরু
সমাজের কিছু অংশের দ্বারা নিষ্ঠুরতা ঘটে চলেছে । বাবরি মসজিদ ধ্বংসে এই অসহিষ্ণু
মানসিকতার উৎকট পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল । তার পর থেকে ছোট বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, অশান্তি বেড়ে চলেছে, প্রতিবাদীদের, যুক্তিবাদীদের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে নানাভাবে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে হত্যা ও করা হচ্ছে । এই বৈশিষ্ট্যগুলো ‘সভ্যতা’ শব্দের যা কিছু উলটো ব্যুৎপত্তি, তাই বহন করছে ।
কোনো জাতি, ধর্ম, সংস্কৃতি, সভ্যতা তার পরাকাষ্ঠা(ultimate) হতে পারেনা । চরমে পৌঁছানোর
পর আর কোনো গন্তব্য থাকে না । প্রগতি স্তব্ধ হয়ে যায় । তাই যখনি কোনো ব্যক্তি বা
কোনো গোষ্ঠী এরকম দাবী করে, সে বা তারা আর এগোনোর কথা ভাবে
না, নিজের অবস্থাতেই সন্তুষ্ট থাকে
। চারপাশের যারা এগিয়ে যায়, তারাই সভ্যতাকে বহন করে ।
শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা পিছিয়ে পড়ে, নিস্তরঙ্গ জলে শ্যাওলার মত অনেক
দোষ সেই সমাজকে আবিল করে দেয় । নৃতত্ত্ববিদদের মতে, বর্তমান পৃথিবীতে কোনো জাতিই অবিমিশ্র নয়। কাজেই কোনো
সভ্যতাও একাকী বেড়ে ওঠে নি । কোনো জাতি একা দেশ গড়ে নি । আজ যে সমস্ত দেশের
অধিবাসীদের আমরা দেশের নামে অভিহিত করি, যেমন ব্রিটিশ, জার্মান, আমেরিকান বা ভারতীয়, তারা সকলেই বিভিন্ন
মানবপ্রজাতির সংমিশ্রণ । অতি প্রাচীন সভ্যতার যেটুকু নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে তাতে
দেখা যায় তাদের মধ্যেও যোগাযোগ ছিল, যোগাযোগের ফলে মেলামেশা আসে স্বাভাবিকভাবেই । ভারতের সিন্ধুসভ্যতার সঙ্গে
পশ্চিম এশিয়ার সুমের সভ্যতার যোগ ঐতিহাসিকরা দেখিয়েছেন । প্রাচীন মিশরের সঙ্গে
ইউরোপ এবং এশিয়ার যোগাযোগ ছিল, প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে । এমন কি
দক্ষিণ আমেরিকার কিছু জাতির সঙ্গে উত্তর এশিয়ার কিছু
জনজাতির কৃষ্টির বেশ মিল দেখা যায় । বিভিন্ন ধর্মের পর্যালোচনা করলে দেখা যায়
তাদের মূল কথায় মিলই বেশি, বিভেদ হল আচরণ এবং আচারে । তাই
বহু মানুষের রক্ত এবং কৃতি বর্তমান মানবজাতি ও তার সভ্যতাকে নির্মাণ করেছে । আদি
যুগের কথা ছেড়ে দিলাম, আধুনিক যুগের প্রারম্ভ থেকে যেটুকু
আমরা দেখেছি, তাতে এটাই প্রমাণিত হয় । আধুনিক যুগে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও প্রযুক্তি অবিলম্বে এক দেশ থেকে অন্য দেশে পৌছে যায়, লোক ব্যবসাবাণিজ্য, কূটনীতি, শিক্ষা, পর্যটন, ইত্যাদি কত প্রয়োজনে দেশ দেশান্তরে ভ্রমণ করে, যেখানে যায় সেখান থেকে অভিজ্ঞতা গ্রহণ করে ফেরে । কাজেই বর্তমান পৃথিবীতে কেউ একক
থাকতে পারে না, অনেকের দ্বারা সমৃদ্ধ হয় ।
এমনকি ক্ষমতার ভরকেন্দ্র ও একজন থেকে অন্যজনে, এক গোষ্ঠী থেকে অন্য গোষ্ঠীতে, এক দেশ থেকে অন্যদেশে, স্থানান্তরিত হয়, চিরকাল একজায়গায় থাকে না ।
সেই কারণে শ্রেষ্ঠত্ববাদ এ যুগে অচল । কেউ যখন
শ্রেষ্ঠ নয়, তখন একের মত জোর করে অন্যের উপর
চাপিয়ে দেবার কারো অধিকার নেই । মানুষ হিসাবে সকলেরই জীবনের অধিকার আছে । গোঁড়ামি
সভ্যতার বিপরীত । সহিষ্ণুতা সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায় । প্রাচীন যুগ থেকে এ পর্যন্ত
ইতিহাস একথাই বলছে ।
দখলদারি, লুণ্ঠন, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার, এসব আদিযুগ থেকেই পৃথিবীতে চলে আসছে, কিন্তু যুগে যুগে দেশে দেশে নবজাগরণের হাওয়া ও উঠেছে । মানুষের ডাঃ জেকিল ও মিঃ হাইড
দুটো সত্তাই আছে । তাই সভ্যতার অভিমুখে আন্দোলন চলছে, চলবে । তেলমাখা বাঁশ ও বাঁদরের অঙ্কের মত এগোনো
পিছোনোর খেলা চলতে থাকবে । যেদিন খেলা থামবে, সেদিন মানব সভ্যতা শেষ হয়ে যাবে, না হলে হয়তো অন্য গ্রহে অন্য সভ্যতার সূচনা হবে ।