।। শিবানী দে।।
শেষপর্যন্ত বুড়ি আজমির শরিফে গেল । কোনো আত্মীয়কে
সঙ্গে না নিয়েই।
বুড়ির নাম আয়েশা বিবি । রোগা, শিরদাঁড়া অল্প বেঁকে গেছে, বয়স ওর দেওয়া বিভিন্ন তথ্য অনুসারে ষাটের ঘরে, কিন্তু
দেখলে সত্তরের কম বলে মনে হয়না । গায়ের রঙ তামাটে ফরসা, মাথার কাঁচাপাকা চুল বেশ পাতলা। মুখে অসংখ্য
বলিরেখার কাটাকুটি, তারই মধ্যে নাকটা সরু ও সোজা। এক সময় মনে হয় সুন্দরীই ছিল । আদত বাড়ি বসিরহাট
ছাড়িয়ে কোন এক গ্রামে । কৈখালির এক বস্তিতে টালির চালের এক ঘরের ভাড়াবাড়িই বর্তমান
ঠিকানা। কথা বলে এখনো
ইছামতীর পারের ভাষাতেই। আমাদের আবাসনে বেশ ক’টা ফ্ল্যাটে কাজ করে । বয়স হওয়ায় কাজ
করে ধীরে, হাত-পা দ্রুততা হারিয়েছে । মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে
কামাই করে ।
আমি বলি, তোমার বয়স হয়েছে । এখন কি আর বাড়ি
বাড়ি কাজ করে বেড়ানোর সময়? এই বয়সে তো দেশে গিয়ে ছেলে বউ নাতি নাতনি নিয়ে ঘরে থাকবে। এখানে অসুখ বিসুখ
হলে কে দেখবে ?
ওগো না গো । আমার কথায় বুড়ি যেন শিউরে উঠে। ওকে যেন
জেলে যেতে বলেছি। বলে, আমি
ওখানে থাকতে গেলি মরে যাব ।
সেকি কথা, নিজের বাড়িতে গেলে বুঝি লোকে মরে যায়
? তুমিই তো বল তোমার দুই ছেলে বউ
নাতিনাতনিরা তোমায় দেশে একেবারে চলে যেতে বলে ।
সে বলুক গে, আমি তিরিশ বছর ধরে এখেনে আছি । এখেনে
থিকে ফেলাটে ফেলাটে কাজ করে জমকা ছোট মেয়ে দুটোর বিয়ে দিলুম । এই আমতলাতে সবাই
আমাকে চেনে, ভালবাসে । আমি এখেনে ভাল আছি
।
বুড়ির কলকাতা থাকার কী করে যে তিরিশ বছর হল তা অবশ্য হিসেবের বাইরে । ওর যমজ মেয়েদুটির
কিশোরীবেলায় বিয়ে হয়েছে । তখন অবশ্য ও আমাদের ফ্ল্যাটে কাজ করত না । তবে মেয়ে দুটোকে
দেখেছি । দুজনেই একটা দুটো ছেলেমেয়ের মা । মুখ দেখে বোঝা যায় বয়স মেরেকেটে সাতাশ আটাশ বছর হবে । বুড়ি বলে, ওরা যখন ন দশ বছরের, তখন নাকি ওদের নিয়ে আমতলা বস্তিতে এসে উঠেছিল । নতুন কাজ নেবার সময় সে সবাইকে বলে বেড়ায়, সোমা বউদির ফেলাটে
আমি কীজানি দশবছর কাজ করছি । আমাদের এই আবাসন খুব পুরোনো নয়, বছর পনেরো হবে
। আমরা এখানকার সবচেয়ে পুরোনো বাসিন্দাদের অন্যতম । তাই আমাদের বাড়িতে
কাজ করাটা ওর নতুন কোন বাড়িতে কাজ নেওয়ার সার্টিফিকেট, যদিও ওর আমার কাছে কাজে ঢোকার সাত বছর হল, দশ বছর নয় । কাজেই বুড়ির বছরের হিসেবের গাছপাথর নেই ।
ওকে একদিন জিগ্যেস করেছিলাম, গাঁ ছেড়ে এখানে
এলে কেন ? আসলে ওর সঙ্গে আমার বেশ ভাব হয়ে গেছে, কারণ মাঝেমাঝে
সে তার গাঁয়ের গল্প যখন করে, আমিও আমার গ্রামের বাড়ির পুরোনো
অভিজ্ঞতা ঝালাই, তার ধান পাট সবজি খেতের কথা, গাছগাছালি, পুকুর, মাটির বাড়ি
মেঠো রাস্তার কথাতে কথা যোগাই । সেসব কথা রোজের কাজের বাইরে । তো আমার প্রশ্নে
বুড়ি ইতিহাস বলতে শুরু করল ।
ওদের বাপ হঠাৎ মারা গেল । তখন আমার জমকা মেয়ে
দুটো ছমাসের । বড় মেয়েটার বে’ দিয়ে গেছিল ওদের
বাপ। বাকিগুলোকে খুব কষ্ট করে মানুষ করলুম । আমার শ্বউর শাউড়ি ছিল না । চাচশাউড়ি বারে বারে
বলত, তুই
দেখতি ভাল, কাচা বয়স, আবার নিকে’ বস । জমিগুলো
বিক্কিরি করে দে । ছেলেমেয়ে অমনি বড় হয়ে যাবে । আমি বলতুম, না গো চাচি,
আমি নিকে’ বসলে ছেলেমেয়েগুলো কোতায় যাবে ? তুমিই বল বউদি,
ঠিক করিনি ? ধরো আমার বে’ হলে আমি চলে গেলুম, হয়তো সুখেও থাকলুম । কিন্তু যে
আমায় বে’ করবে সে তো আমার ছেলেমেদের নেবে না । ভাত খেতি গেলেই তো আমার মনে
পড়বে ওদের কথা।ওরা খেতি পাচ্ছে কি না, ভাল আছে কিনা।আমি জমিও বিক্কিরি করি নি । পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে মায়ের কাছে রেখে নিজে মেশিনের
কাজ শিখলুম, পঞ্চায়েত
থেকি মেশিন পেলুম । তারপর আবার বাড়ি ফিরে সেলাইয়ের অডারি কাজ করতুম ।
সেলাইমেশিনের কাজ ছেড়ে দিলে কেন ?
পরে আর তেমন অডার পেতুম না । ওরম কাজ আরো অনেকেই করতি লাগল কিনা । এদিকে মেজ মেয়ের বে’ দিলুম, তো ছেলে দুটোও বিয়ের জন্য কাঁই কাঁই করতি লাগল । তো আর কী
করব, ভাবলুম
বে’ দিলে ঘরে বউ আসবে, ঘরের কাজ করবে, ছেলেদের মনেও সুখ হবে ।
তাই ছেলেদের ও ছোট ছোটই বে’ দিলুম । ছোট ছোট বউ এল, কিন্তু আমার হল কাল ।
বউরা অশান্তি করত ?
ছেলেরাও অশান্তি করত, শুধু পরের মেয়ের কথা বলব কেন । ওরা তখন চাষের কাজ করতি শুরু
করেছে, ধান
বিক্কিরি করছে, সব নিজেরা নিচ্ছে । বউয়েরা রান্না করত, কিন্তু আমাকে, ছোট মেয়ে দুটোকে
খেতি দিত না । আমি কোন রকমে শুধু আলুভাতে করে মেয়েদুটোকে খাইয়ে নিজে খেতুম। ইদে ছেলেরা বউ শালি
শাউড়িকে নতুন কাপড় দিত, মা-বুনের জন্যি কিছু নেই । তারপর অডারের কাজ ও
কমে গেল । তখন তো জমকা মেয়েদুটোকে নে’ আমার না খেয়ে মরবার জোগাড় ।
এরকম অবস্থা যখন, তখন একদিন বুড়ির বোন
তাকে কলকাতা যাবার প্রস্তাব দেয়। বোন বোনাই আগেই কলকাতার দিকে থাকত, বোনাই গাড়ির গ্যারেজে আর বোন করত বাড়ির ঠিকে কাজ । বুড়ির কথায়, বুন বললে, কলকাতায় বাড়ি বাড়ি কাজ করলি
গাঁয়ে থিকে মেসিনের কাজে যা পাস, তার চে’ অনেক বেশি পাবি ।
ওর সঙ্গে মেয়েদুটোকে নে’ এখানে চলে এলুম । আমি ঝগড়া করতি পারিনে বউদি, তায় আবার পেটের
ছেলে । তা এর পরে কাজ করি, খাই, ভালই আছি ।
মেশিনটা এখন নাকি
ওর বড়ছেলে চালায়, সে আরো একটা মেশিন কিনে নিজের কিশোর ছেলেকে বসিয়ে দরজির দোকান
করেছে । দুটো মেশিনে বেশ ভাল আয় । আর বুড়ির ছোট ছেলে বাসে কন্ডাক্টারি করে । তার ও আয় ভাল ।
চাষের কাজ তো আছেই । বুড়ি বলে, এখন বাড়ি গেলি বেশ চোখ জুড়োয় । এই শীতের মরসুমে কত সবজি । ধান উঠেছে, বস্তা বস্তা
ভরে ঢের করে রেখেছে । সরষে, কলাই মাঠ ভরতি । পুকুর ভর্তি মাছ। ওরা সারা বছর ধরে
খায়, বিক্কিরি করে । ছেলেদের সমৃদ্ধির
কথায় বুড়ির চোখমুখ সুখের মৃদু হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠে ।
তোমারও তো ওসব দেখতে ভাল লাগে । বাড়ি গেলে নিজেও
ভোগ করতে পারো । তাছাড়া বাড়ির জমিতে তোমারো ভাগ আছে । আমি ওকে তাতাতে
চেষ্টা করি ।
না গো, ওরা সুখে আছে, তাই
দেখে আমার সুখ । আমি তো সব ছেড়ে দিয়েই এসিছি । কী করব আমি জমির
ভাগ দে’ । তা ছাড়া দু ছেলেরই
ছ’টা
সাতটা করে ছেলেমেয়ে, ওদের লাগবে । আমার মেয়েদের ও বে’
হয়ে গেছে, ওরাও খারাপ নেই । আমাকে ত আল্লা ভাল
রেখেছে ।
আল্লার নাম উঠায় জানিয়ে রাখি, বুড়ির
ধর্মকর্মের মধ্যে একমাত্র কাজ হল রোজ ভোরের নমাজ পড়া । সারা দিনে পাঁচ
বারের মধ্যে ও শুধু এই একবারই নমাজ পড়ে । কখনও রোজা রাখে না । বলে, দেশে থাকতে সব
করতুম বউদি । ওখেনে সবার মধ্যে থেকে না করলে লোকে মন্দ বলবে । এখেনে আমি দশবাড়িতে
কাজ করব, না খেয়ে চলব কেরে । উপরওয়ালা ঠিক বুঝবে ।
তবে একটা কাজ করে সে । সারা বছরে কাজ করে যে বোনাসটা সে পায়, তা থেকে অর্ধেকটাই ইদে
দান দিয়ে দেয়। যাকে তাকে দেয় না । সে টাকাটা দিয়ে বস্তির কোনো অনাথ, অসুস্থ,
অতিদরিদ্র কারো জন্য কাপড় কিনে, চাল ডাল কিনে দেয় । বাকি টাকা ও মাইনের
কিছুটা খরচ করে ছেলেমেয়ে বউজামাই নাতিনাতনিদের জন্য । একটা ব্লাউজ একটা গেঞ্জি
হলেও দেয় ।
আমি একদিন জিগ্যেস করেছিলাম, পাড়ার মসজিদে
তো গরিব লোকেদের ইদে কাপড় দেয় । তুমি নাও না ?
সে বলল, ওই কাপড় আমি আর বছর নিইছিলুম, নারাণের মাকে
দিয়ে দিলুম । ওর ছেলে ওকে দেখে না, ওর জন্যিই নিসলুম । আমি তো এখনো খাটতি
পারি, জাকাত
নিতি মন করে না ।
নারানের মা বুড়ির আমতলা বস্তির বয়স্ক প্রতিবেশী, আগে সেও ঝিয়ের
কাজ করত । এখন চোখে ভাল দেখতে পায় না বলে কাজ ছেড়ে দিয়েছে। তার ছেলে
নারায়ন রিক্সা চালিয়ে যা রোজগার করে, মদ খেয়ে ওড়ায় ।সে মাঝে মাঝে বলে,
তোমাকে একদিন আমার ঘরে নিয়ে যাব । দেখবে আমি কত পোস্কের থাকি । আমি
কাজ শেষ করে বাড়ি গিয়ে আমার ঘর পোস্কের করি, কাপড় কাচি, চান করি ।
তারপর রান্না করি । আমার একটা শোকেস আছে । তাতে কাচের কাপডিশ সাজিয়ে
রেখেছি । তোমাকে তাইতে করে চা খেতি দেব ।
কিন্তু তার সময় আর আমার সময়ে মেলে না বলে আমার আর তার বাড়ি যাওয়া
হয়ে ওঠে না । আমার বাড়ি কাজের পর সে আরও দুতিন বাড়ির কাজ করে । তারপর নিজের ঘরে
যায় । আমাকে নিয়ে যাবে কখন । আমিও কখনো ওদের বস্তিতে যাই নি ।
তবে সে যে পরিচ্ছন্ন সে আমি জানি । কাজ বেশ পরিপাটি ।
কাপড়চোপড় পুরোনো হলেও ময়লা নয়, বাসন মাজা হাত ও যথাসম্ভব পরিষ্কার । ঘরে ঢোকার সময় পা
বাইরের কলে ধুয়ে ঢোকে । কাজের বাড়িতে পুরোনো টেবিল ফ্যান, টিভি, মোবাইল ফোন, ঘড়ি এমনি পেয়েছে কিংবা অল্প দামে কিনেছে,
ব্যবহার ও শিখেছে, শহুরে সুবিধেয় আস্তে আস্তে
অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে । কাজে আসতে না পারলে মোবাইলে খবর দেয় ।
ও বলে, গাঁয়ে থাকতে কোতায় এমন ছিলুম ?
তখন খালি পা চলতি হত । পুকুরে চান করতুম, কাপড়
শুধু জলে কাচতুম । মাঝে মাঝে গোল সাবানে কাচতুম । এখন আমি রোজ সাবান দে’ চান করি, সানলাইটের গুঁড়ো দে’ রোজ
পরনের কাপড়, বালিশের ওয়াড় কাচি ।
ওকে বলি, তা এখন তো তোমার চাপ নেই । ছেলেরা
ভাল আয় করে বলেছ । তুমি নিজেও টাকাও কিছু জমিয়েছ । বাড়ি গিয়ে নিজের একটা আলাদা ঘর
করেও তো থাকতে পার । তাহলে ত বাড়ি গিয়ে নিজের মত করে পরিষ্কার থাকতেই পার।
তুমি জান না বউদি । আমার ঘর থাকলি কী হবে ।
নাতিনাতনিগুলোকে তো আর বলতি পারব না যে তোরা আমার ঘরে আসিস নে।ওরা বাচ্চা, আসবেই।আসবে,
আর নোংরা করবে । ধুলোমাখা পায়ে আমার বিছানায় উঠবে।নাকের পোঁটা আমার
কাপড়ে বিছানায় মুছবে।আমার সঙ্গে শুতে আসবে, তারপর বিছানায় মুতবে।এসব
আমার ভাল লাগে না । তাছাড়া আমি এখানে অল্প হলেও পোস্কেরমত খাই । ওখানে বউরা ত
ছোটছেলেমেয়ের মা, তাছাড়া ওদের অনেক কাজ । তাই ওরা এরকম ভাবে
আমাকে দিতি পারবে না । বললে ঝগড়া বাঁধবে । কাজ নেই বাপু আমার গাঁয়ে যেয়ে।এমনি
দুচারদিনের জন্যে মাঝে মাঝে যাব, সবাইকে দেখে আসব।অনেক দিন
ওদের না দেখলে আমারো জান জ্বালা করে । কিন্তু পাকাপাকি থাকতে পারবনা ।
বুড়ির গায়ে শহরের হাওয়া ভালোই লেগেছে । একা থাকতে
অভ্যস্ত হয়ে এত সব ছোট ছোট কথা ভেবে রেখেছে !
বুড়ি বলে, তোমাদের কথা শুনতি ভাল লাগে, তোমাদের সঙ্গে দুটো কথা বলে ভাল লাগে, তোমরা শিক্ষিত
মানুষ । বাড়ি ফিরে কাজ শেষ হলি শুয়ে শুয়ে অল্প সময় টিভিতে সিরিয়েল দেখি, তারপর ঘুমুই । গাঁয়ে ভাল ভাল কথা শুনতি পাওয়া যায় না।খালি রান্না
খাওয়া বাচ্চা সামলানো, চাষ করা এসব। আর ঝগড়া। বউগুলো এ ওর সঙ্গে খালি ঝগড়া করে,
ছেলেগুলোও ভাল মুখে কথা বলে না। ছেলেপিলেদেরকে অল্প বড় হতে না হতে
বিয়ে দেবে, আরো কতগুলো ওদের বাচ্চাকাচ্চা হবে, সারাক্ষণ চ্যাঁ ভ্যাঁ।
একদিন কাজে এসেছে, বুড়ি বড্ড
চুপচাপ । আমি ভাবলাম হয়তো শরীর খারাপ । জিগ্যেস করতেই ঝরঝর করে চোখ থেকে জল পড়তে লাগল ।
তারপর হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আজ আমার বড় নাতি ফোন করেছিল । একথা সেকথার পর
বললে, দাদি, তুই তো অনেক
টাকা জমিয়েছিস । কদিন আর বাঁচবি । তুই মরলে তোর সব কিছু ভাগ হয়ে যাবে। তার চাইতে
টাকাগুলো আমাকে দিয়ে দে, আমি দোকানটা বড় করব । শুনে আমি
ফোনটা কেটে দিলুম ।
বুড়ি আবার কাঁদতে লাগল।আমি কবে মরব, সেজন্যে সবাই
মুখিয়ে আছে বউদি । কদিন আগে ছুটি করে বাড়ি গেসলুম না ? সেদিন
আমার কত খাতির।পুকুর থেকে মাছ ধরেছে বড় ছেলে।বললে, মা কত দিন
পরে এসেছে, পুকুরের মাছ খাক । শহরে এরকম টাটকা মাছ পায় না ।
বড় বউ ভাল করে রেঁধে খাইয়েছে।সন্ধে বেলা আমায় একা পেয়ে বড় বউ বলেছিল, আমাদের তো খাবার মুখ অনেকগুলো । তোমার জমিটা আমাদের নামে লিখে দাও না।তোমার
বয়স হয়েছে, জমি দে’ আর কী করবে। আমরাই
তো তোমাকে দেখব।পরদিন ছোটছেলের বাড়ি খাবার কথা । সেখেনেও তেমনি খাতির । ছোট বউ একই
কথা বললে, আলাদা করে, নুকিয়ে।আমার জমি
দিলি ওরা আমায় দেখবে।মরবার কথাটা শুধু বলে নি । আজ নাতি বলছে। আমি এজন্যেই বাড়ি
গিয়ে থাকতে চাই না বউদি।ওরা আগেও আমায় দেখে নি। এখন আমার জমির, জিনিষপত্রের, টাকা পয়সার উপর
সবার লজর ।
আমি ওকে সান্ত্বনা দিতে বললাম, তুমি কী ভেবেছ,
শহরের লোকেদের মধ্যে এরকম নেই ? সব ছেলেরা
ওদের মা বাবাকে দেখে ? যাদের তুমি শিক্ষিত বলছ, তাদের মধ্যেও এরকম অনেক আছে যারা বাবা মাকে দেখেনা, শুধু বাবা মায়ের বাড়ি আর
টাকার উপর লোভ । তাই মন খারাপ করো না ।
না গো, তোমাদের মধ্যে এরকম নেই ।
তুমি জান না, আমাদের মধ্যে ও আছে । শিক্ষিত,
পয়সাওলাদের মধ্যে বরং এরকম অনেক বেশি থাকে। পয়সা বেশি, খাঁইও বেশি । মাঝে মাঝে টিভির খবরেও দেখায়, বুড়ো
বাপ-মাকে ছেলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, টাকা পায়নি বলে মেরে
ফেলেছে, খেয়াল করে দেখো, আমি ওকে বললাম ।
বুড়ি একটু শান্ত হল । তারপর বলল, মেয়েগুলোও কম
নয় । যখনি আসবে, এসেই বলবে, এটা দিয়ে
দে, ওটা দিয়ে দে । আমি ওদের মা, তায়
বুড়ি বেওয়া, তাই আমার যেন কোন ভাল জিনিষ থাকতে নেই । পুজোয়
একটা শাড়ি দিলে তুমি, সেদিন আরো একটা পুরোনো সিলিক শাড়ি
পেলুম । একটু ছিঁড়ে গেছে, তাই ওবাড়ির বউদি দামি শাড়িটা আমায় দে’ দিয়েছে। মেয়েরা শাড়িদুটো দেখে আমায়
দে, আমায় দে বলতে নেগেছে । বলছে, তুই
শাড়ি দে’ কী করবি, বুড়ো হয়ে গেছিস ।
আমি বুলেছি, আমি বুড়ো হই আর যাই হই, শাড়িগুলো
পরব, কাউকে দেব না, পরে ঠাকুর দেখতে
বেরোব । একজনকে একটা কিছু দেব, আরেকজন এসে বলবে, তুই ওকে দিয়েছিস, আমায় দে এবার । চারটে মেয়ে দে দে
করে আমার মাথা খেয়ে ফেলবে । আমি বুড়ো হয়েছি, সে জন্যি ওদের
সব দিয়ে দিতে হবে ।
বুড়ি চোখের জল মুছল । আমি জিগ্যেস করলাম, ছেলেদের তুমি কী
বললে ?
আমি ওদের বললুম, দেখ,বাপু,
আমি তো এখনো মরিনি, আল্লার রহমে খেটে খেতি
পারছি । তোমরা আমার জমিতে চাষ করে খাচ্ছ, খাও। কিন্তু আমার জমির উপর শুধু
তোমাদের ভাগ নয়, তোমাদের বোনেদের ভাগও রয়েছে । আমি একসময়
অনেক কষ্ট করেছি, জমি বিক্কিরি করতি পারতাম, করিনি, রেখে দিয়েছি। এখনও আমার জমি আমার থাকবে,
আমার জিনিষপত্রও আমি কাউকে দেব না। আমার মরবার পর যা হবার হবে।
একটু থেমে বলল, আগে ভয় করতাম । সবাইকে জিগ্যেস করে
করে চলতাম, সবার মন বুঝে চলতাম । নিজের জন্যি না রেখে যে যা
চাইত দিয়ে দিতাম । কিন্তু দিয়ে কাউকে খুশি করতি পারিনি । এখন আর দেব না বউদি । সে
যেই হোক না কেন । আমি ভেবেছি এবার আজমির শরিফে খাজাবাবার দরগায় যাব । কেলাবে বলেছে
ওদের ওখানে লোক আছে নে’ যাবার জন্যে।আরো কোতায় কোতায় নে’ যাবে, ঘোরাবে । পনেরো হাজার করে টাকা দিতে হবে, বাসে নে
যাবে, নে আসবে। পাড়ার কেউ কেউ যাবে । আমি যাব ওদের সাথে ।
বুঝলাম, শহরের হাওয়া বুড়ির মনের সাহস বাড়িয়ে
দিয়েছে । দুদিন হল সে একমাসের ছুটি নিয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন