।। নীলদীপ চক্রবর্তী।।
অনিরুদ্ধদেব চকের দ্বিতীয় গলি পার হয়েই বিশাল মাঠটার সামনে এসে কাশেম কাঁধের
বোঝাটা নামিয়ে রাখলো ! ওর হাতে সময় একেবারেই কম। সন্ধ্যায়, বলতে গেলে বিকেল থেকেই শুরু হয়ে যাবে ভিড় ভাট্টা। এর মধ্যেই প্যান্ডেলের কাজ শেষ করা চাই। যদিও এখন বৈশাখ শেষ
হয়ে আষাঢ়ের মাঝামাঝি সময়, কিন্তু ভাগ ছাড়াও বিহু চলবে এই রাজ্যে আরো কিছুদিন। তা চলুক! এতে অনেকের সাথে কাশতেমদেরও লাভ আছে! বুলবন, খসরু, নুরুল, সুজিতরা ওর আগেই এসে পৌছে গেছে মাঠে। গত দুদিন ধরে ওরা ছসাত জন মিলে যেটুকু
অস্থায়ী মঞ্চ দাঁড় করিয়েছে, তাতে শেষ তুলির টান বুলোতে হবে। সন্ধ্যায় মারকাট বিহু শিল্পী রিপুন মহন্ত
আসবেন এই মঞ্চে । অঞ্চলে টান টান উত্তেজনা ! উত্তেজনা আরও বাড়তো, কারণ আসার কথা ছিল এ রাজ্যের হার্টথ্রব জুবিন
গার্গের ! কিন্তু কোনো এক জরুরি কারণে তিনি আসতে পারবেন না... ইত্যাদি! এমনটাই
শুনেছে কাশেম আয়োজকদের কাছে।
গল্পটি ত্রয়োদশ সংখ্যা উজানে প্রকাশিত |
‘আবার মোবাইলটা নিয়া মরছস, আচ্ছা তগরে কে এত মেসেজ পাঠায় ক ত? হালায় পেটের ভাতের চিন্তা নাই, আব্বার মাইয়া নিয়া রঙবাজি?’ কাশেম রেগে মেগে হাতে মোবাইল নিয়ে বসে থাকা নুরুল আর সুজিতকে বলে। ‘তাড়াতাড়ি রশি বান্ধ!’ হাসতে হাসতে সবাই কাজে লেগে পড়ে।
পঁচিশটি বসন্ত পার করে আসা কাশেমের মাথায় আজকাল অন্য চিন্তা
চলে। ওর বাবা মইনুলের যে প্যান্ডেল বাঁধার ব্যবসাটার দায়িত্ব ও
কাঁধে নিয়েছে, এ দিয়ে আর চলছে না! তাই আরও কয়েকরকম কাজের কথা ভাবছে ও। এই যেমন বিহুর মঞ্চের
বাইরে এবছর চারবার তাম্বুল নিয়ে ও প্রায় সারারাত বসেছে। বিক্রিবাট্টা ভালই হয়, কিন্তু গভীর রাতের কিছু খদ্দের পয়সা দিতে
একেবারে নারাজ থাকে, যেন তাঁদের বাবাদের গাছের তাম্বুল এনে বিক্রি করছে ও! ‘শালা হারামির...’ এইভাবে একটা যুতসই গালাগাল দেয় কাশেম ওদের উদ্দেশ্যে!
এবারের মঞ্চটা বিশাল, ঠিক ঠিক ভাবে নামিয়ে দিতে পারলে একটা মোটা টাকা আসবে, যদিও বিহু মঞ্চ নিয়ে ইতিপূর্বের কিছু অভিজ্ঞতা
ওর বা ওদের পেশার ছেলেদের জন্য সুখকর নয়! এই তো গতবার, শান্তি সংঘের আয়োজিত বহাগী বিদায় উত্সবের মঞ্চ
বাঁধতে গিয়ে ওকে ডাহা লোকসান খেতে হয়েছে। শুনতে হয়েছে একটা অত্যাশ্চর্য গালাগাল, ‘ওই মিঞা, বাংলাদেশী...’। যদিও শব্দ দুটো কোনো খারাপ শব্দ নয়, কিন্তু বলার ঢঙে ওর কেমন গালাগাল বলে মনে হয়!
বাংলাদেশ কী ও জানে না! টিবিরোগী ওর বাবার বয়স প্রায় আশি, তাঁকে জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘আমি তো খুব ছোড ছিলাম ঠিক মনে নাইরে বাপ...’। এমনকি ওকে দিয়ে যারা ঘর বাড়ি বাগান পরিষ্কার করায়, ফাই ফরমাশ খাটায় এমন বাঙালিরাও উক্তি করে, ‘কী রে অইদিক থিকা তরা মিঞারা আইসা, বাঙালির তো বারোটা বাজায় দিতাছস!’ আশ্চর্য হয়ে কাশেম ভাবে ‘অইদিক’ মানে কী? আর মিঞারা কী বাঙালি নয়? কে জানে বাবা!
কমিটির বিরাজ বরা এসে কাশেমকে ডেকে বলেন, ‘আমাকে একটু সাহায্য করবি তো, যন্ত্র গুলো এসেছে, স্টেজে টেনে তুলতে হবে’। কাশেম এগিয়ে যায়, যদিও জানে ওসব ফাউ কাজ, ওতে টাকা পয়সা মিলবে না! শুধু চুপচাপ করে যাওয়াই মঙ্গল। ও ভেবে রেখেছে, সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান শুরুর আগেই বিরাজদাকে ডেকে
পেমেন্টের কথা বলবে ও। কারণ বাইরে থেকে ওর বাবার জন্য কিনতে যাওয়া হাসপাতালের ওষুধগুলো পুরো পয়সা
দিয়ে ওঠাতে হয়। মায়ের কথা এখন বড় একটা মনে পড়ে না কাশেমের। ওর বোধহয় তখন সাত কী আট! ইমারত
বানাবার কাজের যোগালি হিসেবে মাথায় আটটি ইট নিয়ে চলতে পারা কাশেমের মাযের কাজের
খামতি ছিল না। একপক্ষের বসবাস নিয়ে অন্য পক্ষের সন্দেহের অবকাশে কিন্তু বাসস্থান
তৈরির কোনও ঘাটতি ছিল না, হৃদয়হীন সহরটিতে! কাশেমের মা আনোয়ারার নিথর শরীরটা এক মেঘলা বিকেলে যখন ওদের
ঘরের আঙিনায় নামিয়ে রাখা হয়, তখন ঝেঁপে বৃষ্টি এসেছিল। কাশেম দেখেছে বৃষ্টি এসেছিল ওর বাবার চোখেও! ইমারতের
তৃতীয় তলা থেকে পা হড়কে পড়ে ওর মা বাঁচেনি! ও কাঁদেনি, শুধু কাঠের মতো উদাসীন চোখে পৃথিবীর যাবতীয় নিষ্ঠুরতার
থেকে অনভিজ্ঞ থাকার কোনো অজানা সংগ্রাম ও চালিয়ে যাচ্ছিল অবিরত!
বড় বড় মাইক স্ট্যান্ড গুলো নিচ থেকে ওপরে তুলে দিচ্ছে কাশেম, আর ওপরে বিরাজ বরা সেগুলি টেনে তুলছেন । ওই সময়
প্রিয়াঙ্কু আর ভাইটি এসে বিরাজদার হাতে একটা ছোট্ট ব্যাগ তুলে দিয়ে বলল, সর্দার মার্কেট, ডেলি বাজার আর চায়না পট্টির কালেকশন শেষ! এসব অঞ্চলে কালেকশন
বড় হ্যাপা ! সবাই বলে কমিটি করে রাখা আছে, ওখান থেকে দেবে! চাঁদা ঠিক মতো ওঠান যায় না, কত আর ভয় দেখিয়ে কাজ আদায় করা যায়! বিরাজ মৃদু তিরস্কার করে
বলেন, এসব কথা তোদের সময়েই শুনতে পাই, আমারা যখন কাজে বেরুতাম, দিনে পনের থেকে কুড়ি ওঠাতাম। কাশেম কাজের ফাকে মনে মনে বলে, ওঠাতে তো ঠিক আছে, তবে হাত হালকা করতে শুধু শুধু এত কষ্ট হয় কেন!
‘বিরাজদা রিপুন স্যারের সামনে আমাদের পাঁচ জনের দলটাকে বিহু নাচতে দিতে হবে
কিন্তু!’ কাশেম খিলখিলয়ে ওঠা শব্দর সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে একদল মেয়ে। সম্ভবত
স্কুল কলেজ! অনিরুদ্ধদেব চকের স্থানীয় মেয়ে এরা । প্রিয় গায়কের সামনে নাচের বায়না
ধরেছে। বিরাজদা তাম্বুলরঞ্জিত বত্রিশপাটি সাজিয়ে হে হে করে ওঠেন, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে! তোদের না দিলে আর কাদের চান্স দেব বল!’ কথা শুনে রাগে গা জ্বলে যায় কাশেমের! ‘আমাদের সাথে কথা বলার সময় কাচা জামের মতো কষা মুখ করে রাখে, আর মেয়েগুলো এলেই, শালা...’ কাশেম ফিরে যায় ওর সঙ্গীদের কাছে।
খসরু প্যান্ডেলের পেছনে গিয়ে ছোট ছোট বাঁশের খুঁটি গেঁথে
মোটা রশি দিয়ে টেনে টেনে বাঁধছে বিশাল টিরপল। কাশেমকে ওর দিকে যেতে দেখে খসরু বলে,
-‘ওই, একটা কথা কমু কাউরে কবি না তো!’
-তর আবার কী কথা, হালায় তাড়াতাড়ি ক !
-ওই স্টেজের নিচে একটা পেটি আছিল, ছেমরাগুলা রাইখা গেছে। বুঝলি না, গান নাচ বাহানা, মাল টানব সারারাইত, তায় এত সব আয়োজন, আর দোকানদারগুলারে দম দিয়া পয়সা উঠানি । আমি অগোর পেটি থিকা একটা মালের বতল ঝাইরা দিছি। তুই আর আমি
খামু।
-একটা কইস্যা লাথ খাবি। চোরামিটা আর ছাড়লি না। তুই খা গিয়া মাল, আমি ওর মধ্যে নাই!
সন্ধ্যার পর মাঝে মধ্যে একটু মদ খেতে খারাপ লাগতো না কাশেমের। কিন্তু যার কাছে
গেলে এই অত্যন্ত কঠিন পৃথিবীটাতেও একটু বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে, তাঁর জন্যই মদটা ছেড়ে দিতে হচ্ছে ওকে। আসমা!
কাশেম বিহুর মঞ্চ অনেক করেছে। অনেককেই নাচতে দেখেছে। কিন্তু আসমার মতো কজন দুরন্ত
বিহু নাচতে পারে! অথচ আসমাকে প্রায় কাঁদতে দেখেছে কাশেম । পাড়ার বা শহরের অনেক বিহু অনুষ্ঠানে ওকে সুযোগ দেওয়া হয়নি
বলে। কেন হয়নি, তা এখন একটু একটু বোঝে কাশেম!কাশেম মাঝে মধ্যে বড় আফসোস করে, আসমার নামটা যদি সোমা হত, কাশেমের নামটা যদি কৃষ্ণ হত! অনেক, অনেক সুবিধে হত ওদের। অন্তত সুন্দর ‘বাংলাদেশী’ শব্দটা ওর কানে গালাগাল মনে হত না! তবে আজকাল ওই নামের ছেলেমেয়েদেরও এই
গালাগালটা শুনতে হচ্ছে বলে ও শুনেছে!
দুপুর গড়িয়ে যেতে যেতে কাশেমদের দলটাকে আরো ত্রস্ত করে তুলল কাজের চাপ ! এখনো মঞ্চে বিশাল ব্যানার বাঁধা বাকি। তারপর উইংস এর কাপড়গুলো ওপর কিছু কাগজের তৈরি নক্সা লাগিয়ে দিতে হবে ওদের।কাশেম দেরি না করে সবাইকে তাগাদা দেয়। একটা ছোট লরি মঞ্চের সামনে এসে দাঁড়ায়। কাশেম চেনে ড্রাইভার নরেশ ছত্রীকে । ওর বাড়ি সদিয়া। সহজ সরল মাঝবয়েসী নরেশদা, মাটির মানুষ। এই শহরের অনিরুদ্ধদেব চকে আছেন গত দেড়মাস যাবত। সদিয়ার ঘরে তিনটি ছেলে মেয়ে আর স্ত্রী। কারও সঙ্গে বেশিকথা বার্তা বলেন না নরেশ। মুখে চোখে সর্বদাই সন্ধ্যার মতো গাঢ় এক বিষণ্ণতা! চারটি পেট পালনের দু:সহ বোঝা টানতে গিয়ে নরেশ ছেত্রীর মতো অনেকেই ওই অঞ্চলে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছেন উদ্বেগ আর হতাশায়! কাশেম জানে। কাশেম জানে সমগ্র শহর, রাজ্য আর দেশ যখন গর্বে মত্ত, ঠিক সেই সময় ওই একই কারণে পুঞ্জিত ক্ষোভে নরেশরা পুড়ছেন। ব্রহ্মপুত্রের বুকে দেশের সবচেয়ে বড় সেতুটি যেন ধারালো অস্ত্রের মতো নরেশদের বুকের ওপর দিয়ে এপার থেকে ওপাড়ে চলে যাচ্ছে । একটা মাঝারী নৌকা নিয়ে নরেশ ধলা থেকে সদিয়া পর্যন্ত যাত্রী টানতেন, দিনে তিন থেকে চারবার । পারাপারের মাঝি ওর সংসারকেও ওই যাত্রী ভাড়া দিয়ে টেনে চলতেন। কিন্তু এখন নৌকা চলাচল হবার আশা ক্ষীণতর হয়ে গেছে । ঝরে যাবার পূর্বাভাস পেয়ে নরেশ শহরে এসেছেন একটু আগাম, মরিয়া হয়ে খুঁজে চলেছেন সংস্থান। কাশেমের বাবার সাথে কীভাবে পরিচয় হয়েছিল নরেশদার, কাশেম জানে না। ও জানে যে ওর বাবার পরামর্শে সঞ্চিত শেষ সম্বল কয়েকটা টাকা দিয়ে এই পুরোনো লরিটা কিনেছেন নরেশদা।
বিশাল একটা জেনেরেটর ওই লরি থেকে নামাতে চার পাঁচজন মিলে
টানা হ্যাঁচড়া করছে। নরেশদা একটা বাঁশ দিয়ে ঠেকা দিয়ে রাখছেন যন্ত্র দানবটাকে। সবাই মিলে বিরাজদার
নির্দেশে মঞ্চের পেছন দিকে নিয়ে রাখলো ওটাকে । জ্যৈষ্ঠের অবরুদ্ধ দহন থেকে উৎপন্ন
মুখের ঘাম মুছতে মুছতে নরেশদা গিয়ে দাঁড়ায় বিরাজদার কাছে।
-‘কী ব্যাপার!’ যেন কোনদিন না দেখা একটা অচেনা মুখের দিকে তাকিয়ে বিরাজ প্রশ্ন করে।
-‘ভাড়াটা...’ কুণ্ঠা আর দ্বিধা মিশ্রিত একটা মিনমিনে স্বর বেরিয়ে আসে নরেশের গলা থেকে ।
-‘ অ্যাঁ...ভাড়া!’ আকাশ থেকে পড়লেন বিরাজ! ‘তোদের কী নিজের পাড়ার প্রতি কোনও দায়িত্ব নেই, শুধু নিজের স্বার্থ আর রোজগারের কথাই ভাবিস? কে যে টেনে টেনে এই বিদেশীগুলোকে এনে দরদ
দেখিয়ে থাকতে দেয়! এখন বোঝ ঠেলা। এই দেশটা থেকে কেবল শুষে নিতেই শিখল, দেবার কিছু নেই! যা এখন জ্বালাস না, ’
বিরাজের রক্তচোখ আর বিপদজনক শাসানি শুনে নরেশদা নীরব হয়ে যায়। ও জানে এখন আর
কথা বাড়িয়ে কোনও লাভ হবে না। ও ধীরে ধীরে অনেক অক্ষমতা আর আর্থিক ক্ষতির ইতিপূর্বে
ঘটে যাওয়া ইতিবৃত্তগুলোকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করতে করতে ক্লান্ত শরীরটাকে লরির
ড্রাইভারের সিটে ফেলে দিল।
প্রায় পনেরটা জাপি আর গামছা দিয়ে একটা একশৃঙ্গ গণ্ডার তৈরি
করে দিয়েছে কাশেম মঞ্চের দেয়ালে । কাশেম স্কুল কলেজ যায় নি; এই অদ্ভুত সুন্দর কারুকাজ ও কোথায় কিভাবে শিখল
ও নিজেও জানে না। অনেকগুলো মুগ্ধ চোখ আর প্রশংসাসূচক মৃদু বিস্ময়বাক্য শুনতে শুনতে
সামান্য জিরোবার জন্য সামনের খোলা ঘাসের ওপর হাত পা এলিয়ে দেয় কাশেম। আর ঠিক সেই
সময়েই ওর চোখ পড়ে আসমার দিকে! ও কী করছে এখানে! কাশেম ধড়ফড় করে সোজা হয়ে বসে। ওই
তো পাড়ার একঝাঁক মেয়ের সঙ্গে ও দাঁড়িয়ে। আর দলটার কথা চলছে বিরাজদার সঙ্গে। কাশেম উঠে দাঁড়াতেই
আসমার চোখ পড়ে ওর দিকে। দলটা থেকে সরে দাঁড়ায় ও। কাশেম সঙ্গীদের নজর বাঁচিয়ে এগিয়ে
যায় ওর দিকে।
শ্যামলা মুখটায় উড়ন্ত চড়াইয়ের মতো হাসি এনে আসমা মুখ নিচু করে, ফিসফিসে আওয়াজ করে-‘আজকে অগোর সঙ্গে নাচুম’।
-‘তোরে ...তোরে নাচতে দিল!’ অফুরন্ত বিস্ময় কাশেমের উৎফুল্ল কণ্ঠে!
-‘হ, পল্লবী আর কাকুমনিগো ঘরে বাগানের কাজ করার সময় কপৌ ফুলের মালা গাথা শিখাইলাম, বিহুর নাচের কয়েকটা ইষ্টাইলও দেখাইলাম। অরা খুব
খুশ। কইছে আমারে অগ লগে নাচতেই হইবো!’
কাশেমের ক্লান্ত শরীরটাতে প্রচণ্ড গরমেও একঝাঁক বৃষ্টির সতেজতা অনুভব হয়।
সব-হারানোর দলের অনভিপ্রেত ছোট্ট প্রাপ্তিটুকু কেমন অসামান্য হয়ে ওঠে ওই দুটি
পুড়তে থাক মানুষ মানুষীর চোখে! আসমা আর দাঁড়ায় না! কাশেম সঙ্গীদের উদ্দেশে চেঁচায়-‘তোগ কাজ হইছে কিনা, যা সব গুলা দুফুরের খাওয়া শেষ কইরা আয়’।
-‘তুই যাবি না’। সুজিত এসে শুধোয় ওকে। কাশেম একটু অস্পষ্ট গুনগুন করে জানায়-‘না, তরা যা। আমি একটু পড়ে...’ সান্টুদার দোকানের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে বিরাজ। এতক্ষণ তাম্বুল চলছিল। এবারে
সান্টুদার থেকে একটা সিগারেট ধরিয়েছে। নির্ঘাত মাগনা! অনেক ভেবে চিন্তে সব দ্বিধা
ছেড়ে কাশেম সরাসরি বিরাজের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়- ‘দাদা কাজ মোটামুটি শেষ। শুধু গ্রীন রুমের পর্দাটা বাকি।
ছেলেরা ফিরা আইলেই দশ মিনিট...’
-‘আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে। সন্ধ্যায় প্রোগ্রামের সময় থাকিস’।
-ঠিক আছে দাদা । থাকুম !
কাশেম কথা খুঁজে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।
-‘কি রে আর কিছু...?’ বিরাজদা ভ্রু কোঁচকান !
-না কইছিলাম, হাজিরা আর মাল ভাড়ার পয়সাটা যদি...
-‘যদি কি ...’ বিরাজদার চোখে অনন্ত বিস্ময় !
-‘না মনে, টাকার একটু দরকার পড়ছিল, যদি কিছুটা এখন পাইতাম!
-‘কি বলছিস কি!’ চোখ কপালে উঠে বিরাজদার। ‘টাকা কোথায়; যে পাবি! অনুষ্ঠান হল না, লোক জন এল না। এমএলএ স্যারও ডুব দিয়ে আছেন। আর এই অবস্থায়..., তোদের কি বুদ্ধিশুদ্ধি একেবারে খতম নাকি! সকাল থেকেই সব গুলো পার্টি খালি টাকা
টাকা করছিস! নিজের করে ভাবতে শেখ, বুঝলি শালা, এটা জাতীয় উত্সব, সবাই মিলে একজোট হয়ে পালন কর। থাকার জায়গা পেয়েছ কি রঙ দেখানো শুরু!
যা ফোট’!
কাশেম আর দাঁড়ায় না। ও বোঝে টাকা পাবার আশা এই জায়গা থেকে অত্যন্ত ক্ষীণ। শুধু ওর মাথায় ঘোরে হাসপাতালের ওষুধের চিন্তাটা! সঙ্গীদলের
অপেক্ষা না করে ও বেরিয়ে পড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে আর কাজ নেই। বাড়িতে গিয়ে চটের বস্তায় রাখা প্রায় চল্লিশটা তাম্বুল কেটে
তৈরি করতে পারলে ভাল। মহন্তনগর মাঠেও আজ বিহুউত্সব। ওদিকে ভিড় ভাট্টা কিছুটা কম। কিন্তু বসবাস করা
লোকগুলোর বিশেষ বদনাম নেই। টাকা পয়সা খরচ করে, কাজের লোকেদের ঠকায় না। একটা কুপি, মোড়া আর টুল নিয়ে ছোটখাটো তাম্বুলের দোকান চলবে বলেই মনে হয়। হাড়িতে এখন উঁকি
দিয়ে লাভ নেই জেনেও কাশেম একবার হাড়ির ঢাকনাটা সরিয়ে দেখে। দু একটুকরা ভাত লেপ্টে
আছে হাঁড়ির দেয়ালে। দৃশ্যটা না দেখলেও ভাল ছিল। কাশেম পেটের ভেতর একটা মোচড় অনুভব
করে। কলসি উল্টে অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাসে জল গড়িয়ে ঢকঢকিয়ে ও গলায় ঢেলে দেয় পুরো
গ্লাস! ঘরের বেড়ায় গুঁজে রাখা কাটারিটা নিয়ে মেঝেয় বসে পড়ে ও
বস্তাটা নিয়ে। তাম্বুলকাটার খিটখিটে শব্দের সঙ্গে পাল্লা দেয় মইনুলের আধমরা শরীরের
একটানা মৃদু গোঙানি!
কাশেম কখন যেন শ্রান্ত শরীরটাকে মেঝেতেই পেতে দিয়েছিল বিশ্রামের জন্য, ও নিজেও জানতে পারে না। পৃথিবীর যাবতীয় ঘুম এসে ঘিরে ধরেছিল ওর দুচোখে। আর ঠিক সেভাবেই প্রথমে স্থবির
হয়ে ধীরে ধীরে অজানা শেষের ঠিকানায় চলে যেতে থাকা একটি জীবনের সাময়িক ঘুম বিকেল
পেরিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত গড়িয়ে গেল। ঘুমটা ভাঙল মড়মড়ে টিনের দরজার সশব্দে ধাক্কা লাগার আওয়াজে। ধড়ফড় করে উঠে বসল কাশেম । শরীরে ওর হালকা জলের ছিটে। দরজাটা থেকে থেকে সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে কপাটের
সঙ্গে। কালবোশেখি! অনেকক্ষণ শুরু হয়েছে। শনশনে শব্দে বাইরে গাছেদের মরণসংগ্রাম!
ইতিমধ্যে ওর বাবা উঠে বসেছে বিছানার এক কোনায়। ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে আছে ওর
দিকে। কাছেই কোথায় হয়ত বেয়াড়া শব্দে বাজ পড়ল । কাশেম নিজেকে সামলে নিয়ে দরজাটা
বন্ধ করতে এগোয়, তখনই বিদ্যুৎ চমকে চরাচর উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে আর সেই অপার্থিব আলোয় খসরু এসে
প্রায় একটা সদ্য কাটা গাছের মতো কাশেমদের মেঝেতে ছিটকে পড়ে। ভিজে কাকের মতো
উদভ্রান্ত খসরুর দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে কাশেম। খসরুকে তুলে ধরে ও জিজ্ঞাসু
দৃষ্টি মেলে ওর মুখে । কোনমতে হাঁপাতে থাকা খসরু উচ্চারণ করে-
-‘তুফানে আমাগো বানানো প্যাণ্ডলটা ভাইঙ্গা দিছে। সব ওলতপলট। অগো আর্টিস্ট বলে
আইয়া গেছে হোটেলে। বিরাজদায় আমারে খবর দিয়া কইলো তগ সবেরে লইয়া আইতে অখুনি!’
মুহূর্তে একটা প্রতিশোধের আনন্দ ফুটে ওঠে কাশেমের ঠোঁটের লুকনো হাসির পেছনে।
খসরু তাড়া দেয় –‘কি রে, চ!’
-আরে দাড়া, এত ঝড় জল, তুই কইলিয়ে যাইতে লাগবো নাকি! ঘরের অবস্থা দেখছস...’
-কি কস, প্রগ্রাম কেমনে হইবো ! চল চল...’
‘প্রোগ্রাম’ কথাটা শুনে কাশেম নীরব হয়ে যায়। বাইরের ঝড় ওর মনের ভেতর এতক্ষণে তোলপাড় তোলে।
সন্ধ্যার বেমক্কা এক বেয়াদব ঝড় এসে পুরো মঞ্চটা দুমরে মুচড়ে দিল! হঠাত্ খুব রাগ
হয় ওর, আকাশপানে চেয়ে কোনও অচেনা আল্লাহর প্রতি একগাদা নালিশও জানায় কাশেম। আর জানাবে
নাই বা কেন! অত সুন্দর করে গড়ে তোলা মণ্ডপটা আবার না দাঁড় করালে এক পয়সাও পাবে না
ও! করলেও যে পাবে তারও কোনও ঠিক নেই! এসব নিয়ে ও চিন্তিতও নয়।
তবুও এ মঞ্চ ওকে তৈরি করতেই হবে। কারণ এই মঞ্চে আজ কাশেমরা নাচবে, কাশেমের সম্পূর্ণ পৃথিবী নাচবে, ওর ভাষা, ওর ধর্ম, ওর বাসস্থানের অঙ্গীকার, এরা সবাই নাচবে!
কাল বিলম্ব না করে ওর যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামের ব্যাগটা কাঁধে
ফেলে, মাথায় একটা পলিথিনের টুকরো পেঁচিয়ে ও যেন সামরিকভাবে তৈরি হয়, সেইসঙ্গে হাঁক পারে- চল, অনেক কাম আছে’। পরক্ষণেই অনিশ্চিত উদ্দেশ্য আর পরিণামের দিকে যাত্রা করে দুটি ঝড়ের মতো
বিপর্যস্ত মানুষ !
*********
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন