।। সেলিম মুস্তাফা ।।
“...সরকারি
গাড়িগুলো কখনও-সখনও ধুলো উড়িয়ে আসে । তখন দূর থেকে দেখে মনে হয় সব পরিষ্কার হয়ে
গেলে নতুন কিছুর দেখা পাওয়া যাবে !...”
তমা
বর্মণের গল্প-গ্রন্থ ‘মৃত্তিকা মন’ পড়লাম । প্রথম গল্পগ্রন্থ হিসেবে
চমৎকারী মনে হলো, তাই কিছু কথা বলা ।
ত্রিপুরার কন্যা তিনি, আমাদের
আত্মবিশ্বাসের আরেকটি পালক !
তাঁর
সবগুলো গল্পতেই এমনধারা পংক্তিবিন্যাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যা থেকে চট করে টের পাওয়া যায় তাঁর কলম আর মন এমনভাবে একাকার
হয়ে আছে, যা সমাজের একেবারে
নিচুতলার মানুষের মনের চেপে রাখা আকাঙ্ক্ষাটাকে অনায়াসে রূপ দিতে পারে । আমরা যে
এমনই ভাবি, তমা সেটা পলকেই ধরে ফেলেন । তমা কবিও বটে । হয়তো সেটাও একটা
কারণ ।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমরা এমনি করে দেখি
তাঁর প্রতি চরিত্রের মধ্যে অনায়াসে ঢুকে পড়ে মনের খবরটি যুক্তিসঙ্গতভাবে বয়ান করতে
। তবে মানিকের এই মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কখনো অতিরিক্ত মনে হয়েছে আমার । কী করবো,
আমি মূর্খ হলেও পাঠের অধিকার আমারও
রয়েছে, রয়েছে মন্তব্য করার
অধিকার !
শ্রীমতী বর্মণের গল্প আমি এবারই প্রথম পড়লাম
। আমি মূলত কবিতা-পাঠক, তাই
শব্দের দিকে নজর একটু বেশিই থাকে । শব্দ ব্যবহারে এই লেখিকা অদ্ভুতভাবে মিতাচারী ।
তাঁর সঠিক শব্দ-চয়ন আর পরিমিতিবোধ যথেষ্ট শিল্পিত । ভাষাকে তিনি মোটেও জলের মতো
খরচ করেননি ।
গল্পের ক্ষেত্রে, আমার ধারণা, প্রধান
চরিত্র তার বিষয়, আর সেটাকে নিজের মতো
বয়ান করাই গল্প । এ ব্যাপারে তাঁর নজর প্রধানত নারী-পুরুষের স্বাভাবিক ভালবাসা,
যা হয়তো সংগঠিত সমাজ বা পরিবারের দিক
থেকে দেখলে অস্বাভাবিক মনে হতে পারে । অন্তত দু-খানা গল্পে তাঁর এই প্রাকৃতিক
ফেনোমেনা লক্ষ করা যায় । এটা বিষয়গতভাবে আমার কাছে নতুন । খুব দুঃসাহসিক কাজ তো
বটেই । প্রেম তো বাঁধনহারাই ! সৃষ্টির উদ্দেশ্যই প্রেম, সৃজন ! সেখানে সম্পর্কের গণ্ডী মানুষের তথা সমাজের আরোপিত
ব্যাপার । তমা চরিত্রগুলোর মাধ্যমে হয়তো এই শেকলটা ভাঙতে চাইছেন, কখনো ভাঙতে না-পারার যন্ত্রণায় বিদ্ধ
আত্মাগুলির আর্তনাদকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন । কিন্তু খুবই শিল্পীতভাবে, না-বলেই বলা, যদি আমার ভুল না-হয়ে থাকে । কিছুটা কবিতার সংগঠন যেন ।
খুব
স্বাভাবিক যে নারীমুক্তির একটা বিশেষ ভূমিকা তাঁর থাকবে । এটা এই সময়ের একটা বিশেষ
প্রবণতা, যা কারো কারো
ক্ষেত্রে মাত্রাবহির্ভূত, খুব
জলোভাবে প্রকট, ফলে নারীপুরুষ সকলের
ক্ষেত্রেই হাসির খোরাক হয়ে যায় । হয়তো যেকোনো শিল্পই তার সীমা আর ফর্মগত অনুশাসন
ডিঙিয়ে গেলেই তার চরিত্র হারায় এবং অন্যকিছু হয়ে যায় । হয়তো, হবার কথা ছিল কবিতা, হয়ে গেল শ্লোগান । হয়তো, হবার কথা ছিল গল্প, হয়ে গেলো কোনকিছুর ম্যানিফেস্টো ! তমা
বর্মণের গল্পগুলোতে এই প্রতিবাদ গ্রহণযোগ্যভাবেই এসেছে, কিন্তু কোনভাবেই গল্পের সীমা ডিঙ্গিয়ে যায়নি । তাঁর দক্ষতাটা
এখানেই । ফল পেতে হলে ঔষধ খাওয়ানোটাই প্রথম শর্ত, না-ই যদি খায়, ক্রিয়া
প্রতিক্রিয়া আশা করা যায় না । ব্যর্থ শ্রম ! তিনি আমাদের ঔষধ খাওয়াতে পেরেছেন এ
বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই ।
তমা বর্মণের প্রথম গল্পগ্রন্থ হিসেবে আরও বেশি
প্রশংসা তাঁর প্রাপ্য একথা আমার মতো আনাড়ি পাঠকেরও মনে হয়েছে ।
গল্পের শিরোনাম নিয়ে আমার কিছু দুর্বোধ্যতা
রয়ে গেছে । যেকোনো গল্প বা উপন্যাসের নাম যদি ‘জীবন’ দিয়ে
দেয়া যায়, তাতে কোন আপত্তি উঠবে
না । সবই জীবনের অন্তর্গত । কিন্তু এটাই শেষ কথা নয় । বিশেষ করে ছোটগল্পে
শিরোনামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে আমার মনে হয় । কারণ এখানে বিধৃত
হয় লেখকের সেই দৃষ্টিকোণটি, যা
চট করে আমাদের নজরে পড়ে না, আর
সেটাই গল্প । লেখক, পাঠকের চোখ টানলেন
কোথায়, আর তুলির টান দিলেন
কোথায়, এখানেই গড়ে ওঠে
গল্পের প্রথম চাল, যা গল্পটি শেষ করার
পর হয়তো পাঠক-পাঠিকারা টের পান ।
বইটি করেছেন ‘নীহারিকা’ ।
খুব সুন্দর প্রচ্ছদ করেছেন বিক্রমজিত দেব
। সামান্য বানানবিভ্রাট রয়েছে । অন্তত দু-জায়গায় ‘পুড়ে’ শব্দটি
‘পোড়ে’ এবং একজায়গায় ‘পরে’
শব্দটি ‘পড়ে’ হয়েছে
। তাঁর পরবর্তী গ্রন্থের জন্য আমরা নিশ্চিতভাবেই প্রতীক্ষা করতে পারি ।
*** ২৫.০৬.২০১৮
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন