“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৮

তমা বর্মণের 'মৃত্তিকা মন' গল্পগ্রন্থের পাঠ-প্রতিক্রিয়া


।। সেলিম মুস্তাফা ।।



“...রকারি গাড়িগুলো কখনও-সখনও ধুলো উড়িয়ে আসে । তখন দূর থেকে দেখে মনে হয় সব পরিষ্কার হয়ে গেলে নতুন কিছুর দেখা পাওয়া যাবে !...
তমা বর্মণের গল্প-গ্রন্থ মৃত্তিকা মনপড়লাম । প্রথম গল্পগ্রন্থ হিসেবে চমৎকারী মনে হলো, তাই কিছু কথা বলা । ত্রিপুরার কন্যা তিনি, আমাদের আত্মবিশ্বাসের আরেকটি পালক !
তাঁর সবগুলো গল্পতেই এমনধারা পংক্তিবিন্যাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যা থেকে চট করে টের পাওয়া যায় তাঁর কলম আর মন এমনভাবে একাকার হয়ে আছে, যা সমাজের একেবারে নিচুতলার মানুষের মনের চেপে রাখা আকাঙ্ক্ষাটাকে অনায়াসে রূপ দিতে পারে । আমরা যে এমনই ভাবি,  তমা সেটা পলকেই ধরে ফেলেন । তমা কবিও বটে । হয়তো সেটাও একটা কারণ ।
     মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমরা এমনি করে দেখি তাঁর প্রতি চরিত্রের মধ্যে অনায়াসে ঢুকে পড়ে মনের খবরটি যুক্তিসঙ্গতভাবে বয়ান করতে । তবে মানিকের এই মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কখনো অতিরিক্ত মনে হয়েছে আমার । কী করবো, আমি মূর্খ হলেও পাঠের অধিকার আমারও রয়েছে, রয়েছে মন্তব্য করার অধিকার !
     শ্রীমতী বর্মণের গল্প আমি এবারই প্রথম পড়লাম । আমি মূলত কবিতা-পাঠক, তাই শব্দের দিকে নজর একটু বেশিই থাকে । শব্দ ব্যবহারে এই লেখিকা অদ্ভুতভাবে মিতাচারী । তাঁর সঠিক শব্দ-চয়ন আর পরিমিতিবোধ যথেষ্ট শিল্পিত । ভাষাকে তিনি মোটেও জলের মতো খরচ করেননি ।
     গল্পের ক্ষেত্রে, আমার ধারণা, প্রধান চরিত্র তার বিষয়, আর সেটাকে নিজের মতো বয়ান করাই গল্প । এ ব্যাপারে তাঁর নজর প্রধানত নারী-পুরুষের স্বাভাবিক ভালবাসা, যা হয়তো সংগঠিত সমাজ বা পরিবারের দিক থেকে দেখলে অস্বাভাবিক মনে হতে পারে । অন্তত দু-খানা গল্পে তাঁর এই প্রাকৃতিক ফেনোমেনা লক্ষ করা যায় । এটা বিষয়গতভাবে আমার কাছে নতুন । খুব দুঃসাহসিক কাজ তো বটেই । প্রেম তো বাঁধনহারাই ! সৃষ্টির উদ্দেশ্যই প্রেম, সৃজন ! সেখানে সম্পর্কের গণ্ডী মানুষের তথা সমাজের আরোপিত ব্যাপার । তমা চরিত্রগুলোর মাধ্যমে হয়তো এই শেকলটা ভাঙতে চাইছেন, কখনো ভাঙতে না-পারার যন্ত্রণায় বিদ্ধ আত্মাগুলির আর্তনাদকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন । কিন্তু খুবই শিল্পীতভাবে, না-বলেই বলা, যদি আমার ভুল না-হয়ে থাকে । কিছুটা কবিতার সংগঠন যেন ।
খুব স্বাভাবিক যে নারীমুক্তির একটা বিশেষ ভূমিকা তাঁর থাকবে । এটা এই সময়ের একটা বিশেষ প্রবণতা, যা কারো কারো ক্ষেত্রে মাত্রাবহির্ভূত, খুব জলোভাবে প্রকট, ফলে নারীপুরুষ সকলের ক্ষেত্রেই হাসির খোরাক হয়ে যায় । হয়তো যেকোনো শিল্পই তার সীমা আর ফর্মগত অনুশাসন ডিঙিয়ে গেলেই তার চরিত্র হারায় এবং অন্যকিছু হয়ে যায় । হয়তো, হবার কথা ছিল কবিতা, হয়ে গেল শ্লোগান । হয়তো, হবার কথা ছিল গল্প, হয়ে গেলো কোনকিছুর ম্যানিফেস্টো ! তমা বর্মণের গল্পগুলোতে এই প্রতিবাদ গ্রহণযোগ্যভাবেই এসেছে, কিন্তু কোনভাবেই গল্পের সীমা ডিঙ্গিয়ে যায়নি । তাঁর দক্ষতাটা এখানেই । ফল পেতে হলে ঔষধ খাওয়ানোটাই প্রথম শর্ত, না-ই যদি খায়, ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া আশা করা যায় না । ব্যর্থ শ্রম ! তিনি আমাদের ঔষধ খাওয়াতে পেরেছেন এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই ।
  
   যাত্রাগানে ‘বিবেক’-এর একটা  চরিত্র থাকে, সে কাহিনীর মধ্যে ইঙ্গিতে সূত্রস্থাপন করে । শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র-এর সময়ে এমন ব্যাপার লক্ষ করা যায় অধ্যায়ের শেষে বা শুরুতে । আজকাল করলে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়, কারণ পাঠক হিসেবে এই সময়ের মানুষ অনেক বেশি দীক্ষিত হয়ে গেছেন । আমার ব্যক্তিগত ধারণা, গল্পে উপন্যাসে লেখক থাকবেন অপ্রকট । চরিত্রগুলো নিজে নিজে দাঁড়াবে, স্বাধীনভাবে । সেখানে লেখকের অনুপ্রবেশ গল্পের দুর্বলতাকেই ইঙ্গিত করে । নাটকে চরিত্রের পরিচয় প্রথমেই বলে দেয়া থাকে, শুরুর আগেই । গল্পে এটা চলে না । চালালে চলবে, তবে সেটা বহুযুগের ওপারেরই হবে হয়তো । বর্তমান গল্পগুলোতে কোথাও কোথাও এমন কাজটি যে নেই তা নয়, আছে, কিন্তু অত্যন্ত নিপুণভাবে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে, এবং কোন গল্পেরই শেষে কোন সিদ্ধান্ত বা প্রকট-পরিসমাপ্তি দেখানো হয়নি । পাঠককে ভাবতে বাধ্য হতেই হয় । খুব সুন্দর আর আত্মবিশ্বাসী সমাপ্তি ।
     তমা বর্মণের প্রথম গল্পগ্রন্থ হিসেবে আরও বেশি প্রশংসা তাঁর প্রাপ্য একথা আমার মতো আনাড়ি পাঠকেরও মনে হয়েছে ।
     গল্পের শিরোনাম নিয়ে আমার কিছু দুর্বোধ্যতা রয়ে গেছে । যেকোনো গল্প বা উপন্যাসের নাম যদি জীবনদিয়ে দেয়া যায়, তাতে কোন আপত্তি উঠবে না । সবই জীবনের অন্তর্গত । কিন্তু এটাই শেষ কথা নয় । বিশেষ করে ছোটগল্পে শিরোনামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে আমার মনে হয় । কারণ এখানে বিধৃত হয় লেখকের সেই দৃষ্টিকোণটি, যা চট করে আমাদের নজরে পড়ে না, আর সেটাই গল্প । লেখক, পাঠকের চোখ টানলেন কোথায়, আর তুলির টান দিলেন কোথায়, এখানেই গড়ে ওঠে গল্পের প্রথম চাল, যা গল্পটি শেষ করার পর হয়তো পাঠক-পাঠিকারা টের পান ।

    সমাজ ও পরিবারের মানবিক ও মানসিক দিকগুলো তমা বর্মণ খুব সুন্দরভাবে এবং পরিমিতভাবে তুলে ধরেছেন এই গল্পগ্রন্থের মাধ্যমে, ফলে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য আর তীব্র হয়ে উঠেছে । বর্তমান কালে নারীবাদ এক জ্বরের মতো, তা-ও তিনি তাঁর দক্ষ হাতের ছোঁয়ায় অবিতর্কিতভাবে এনেছেন এবং নির্বাক করে রেখেছেন পাঠককুলকে যা আলাদা প্রশংসার দাবি রাখে অবশ্যই । ভাষাগত স্থানিকতা তাঁর চরিত্রগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে । এখানেই তাঁর পর্যবেক্ষণের ধী প্রশংসাযোগ্য ।
     বইটি করেছেন নীহারিকা। খুব সুন্দর প্রচ্ছদ করেছেন  বিক্রমজিত দেব । সামান্য বানানবিভ্রাট রয়েছে । অন্তত দু-জায়গায় পুড়েশব্দটি পোড়েএবং একজায়গায় পরেশব্দটি পড়েহয়েছে । তাঁর পরবর্তী গ্রন্থের জন্য আমরা নিশ্চিতভাবেই প্রতীক্ষা করতে পারি । 

*** ২৫.০৬.২০১৮




কোন মন্তব্য নেই: