।। সেলিম মুস্তাফা ।।
(কবি দীপক চক্রবর্তীর কিছু কবিতা গত
০৮.০৫.২০১৮ থেকে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম । সেগুলোই বিভিন্ন তারিখ অনুযায়ী এখানে
দিলাম বৃহত্তর পাঠকসমাজের নজরে ।)
০৮.০৫.২০১৮
সাতের দশকের মাঝামাঝি । ধর্মনগরে আমরা
যে কয়জন একত্রে সাহিত্যচর্চা করতাম, তাদের
একজন কবি দীপক চক্রবর্তী, যিনি
প্রথমে মুখেমুখে কবিতাটা রচনা করতেন, তারপর
আমাদের চলমান আড্ডায় শোনাতেন । এই চলমান আড্ডা ধর্মনগরের চন্দ্রপুর থেকে শুরু হয়ে
পাবলিক লাইব্রেরী পর্যন্ত এসে পূর্ণ অবয়ব পেত । লাইব্রেরীতে কিছুক্ষণ বইপত্র
নাড়াচাড়া, বই বদলে নেয়া,
দেশ পত্রিকা পাঠ, ইত্যাদি শেষ করার পর আবার রাস্তায় । গন্তব্যের কোন পরিমাপ নেই
। সে আড্ডায় আলোচিত হত কবিতা । পরদিন যথাযোগ্য সংশোধনের পর দ্বিতীয়বার নির্দয়
আক্রমণ এবং চূড়ান্ত রূপ নেবার পর একসময় তা কাগজে জন্ম নিত । এই দীপক চক্রবর্তী
বর্তমানে থাকেন শিলচরে । কবি ও প্রাবন্ধিক তপোধীর ভট্টাচার্যের বাসার কাছাকাছিই
কোথাও তিনি বাসা করেছেন । তার মূল বাড়ি ধর্মনগরে থানার পেছনের রাস্তায় কবি পীযূষ
রাউতের বাসার সংলগ্ন ।
তাঁর প্রথম
কাব্যগ্রন্থ ‘যুক্তাক্ষর’,
( কাছাড় নিবাসী ) প্রয়াত কবি দীপঙ্কর
নাথের সঙ্গে যৌথ । বর্তমান গ্রন্থটির নাম ‘কবিতা
এভিনিউ’, কলকাতা বইমেলায় ২০১৬
সালে প্রকাশ করেছেন ‘বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ’
। সাতের দশকের এই কবিতা-পাগল ত্রিপুরায়
ততটা পরিচিত নন অধিক সময় শিলচরে থাকার কারণে । কবি কিশোররঞ্জন দে আর দীপক
চক্রবর্তী প্রায় একই সময়ে একই ধরণের চাকুরী পেয়েছিলেন বি.এস.এন.এল-এ । এঁরা বয়সেও
প্রায় সমান ।
আমার মনে হয়েছে
দীপকের কবিতায় অন্যান্য জরুরী বিষয়ের সঙ্গে প্রধান ভূমিকা নিয়েছে প্রেম আর
নস্টালজিয়া, রয়েছে এক জন্ম-বাউলের
অনিকেত ফেরারি হাওয়া, যা আমাদেরও সমানভাবে
তড়িতাহত করে । আজ এ গ্রন্থ থেকে দুটি কবিতা আমরা পড়ব । এর কিছু কবিতা ‘পাখি সব করে রব’-এ ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে ।
এইখানে পৃথ্বীরাজ
দীপক চক্রবর্তী
বনের আড়ালে স্বপ্নের নীল ঘোড়া
তোমাকে স্পর্শ করে স্বাস্থ্য জেনেছি—
প্রাণ
কত প্রয়োজন স্বাধীনতা, ঘাস ।
ফিরে এসে জেনেছি, গোপন বিছানায়
কীরকম শুয়ে পড়ে আমাদের
উদ্যমহীন দমকল, ভিটামিন, কুকুর
চর্বিত ফসল ।
এবারে কার্তিকের শুরুতেই আগুন জ্বলেছে
একাকী সহিস, শীত বড় আগুয়ান ।
সেই সব ঘোড়াদের স্বপ্ন আর চোখে নেই,
মলিন ব্যাপার—
মাটি খুঁড়ে ধাতু আসে
ইঁটসুরকি আসে
আমাদের প্রাসাদ মিনার—
কুয়াশায় সব্জিবাগানের কাছে প্রাণ
চেয়েছিল
স্বদেশের লোক
চুম্বন করেছে শুধু ম্যাটালিক ঠোঁট—
তবু হায় সম্বৎসর বে-বুশ্যের শূন্য
হাহাকার ।
এইখানে একদিন, প্রচণ্ড সহিস,
যৌবন শাসন করেছিল পৃথ্বীরাজ !!
********************
পাখি
দীপক চক্রবর্তী
সীমান্তের ওপারে যে সীমান্ত রয়েছে
তারও ওপারে,
সমস্ত সীমানার ওপার থেকে
একটা পাখি প্রায়শই উড়ে আসে
আমার জানালার কার্নিশে ।
অনর্গল কথা বলে—
সীমান্ত হারানো মানুষের কথা বলে
সীমান্ত মুছে দেবার স্বপ্ন দেখায় ।
তাকে কি বলা যায় আমরা ভাল নেই ?
শ্বাপদ নিঃশ্বাসে পুড়ে যাচ্ছে আমাদের
খেতের ফসল
নিজেরাই নিজেদেরকে ডুবিয়ে দিচ্ছি
এক অন্ধ কূপের ভিতর ।
স্বপ্নিল পাখি ফের উড়ে যায়—
দিন গড়িয়ে পড়ে
রাত্রি নামে বিষণ্ণ প্রদেশে ।
হিম রাত্রি জুড়ে শুধু এক
পাখি উড়ে আসে ।
******************
০৯.০৫.২০১৮
দীপক চক্রবর্তীর পরিচয় আমরা কাল পেয়েছি
। সাতের দশকে ধর্মনগরে নবচেতনায় সাহিত্য আন্দোলনের এই সৈনিক নিতান্তই প্রচারবিমুখ
। আজ তার আরও একটি কবিতা আমরা পড়ব ।
আশির দশকের একজন ভারতীয় কবির কাছে
দীপক চক্রবর্তী
আমাদের প্রাত্যহিক সান্ধ্যভ্রমণে
“সন্ধ্যামালতি যবে ফুলবনে ঝুরে”
নিকারাগুয়ার সীমান্তে ঠিক তখনই
উজ্জ্বল যুবতী রাইফেল হাতে অতন্দ্র
প্রহরায় !
তার কি সান্ধ্যভ্রমণ নেই ? সন্ধ্যামালতি নেই,
যুবকের সাথে নেই জ্যোৎস্নায় হাঁটাহাঁটি
এমন কি নৈশকালীন ঘুমটুকুও নেই ?
আশির দশকের একজন ভারতীয় কবির কাছে
এ মেয়ে এক বিরাট প্রশ্নচিহ্ন !
কারণ সে তো ফুল, পাখী, নারী,
ভালবাসা, ঘৃণা, বিবমিষা
এর বাইরে একদিনও কবিতাকে নিয়ে এমন কি
বেড়াতেও যায়নি
বড়জোর রাত্রিকালীন বাড়ি ফেরার সময়
পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করেছে
কী করে সে বুঝবে এ মেয়ে কোন অনন্ত
প্রেমে সীমান্তে নিদ্রাহীন !
নারী বলতে সে তো জেনেছে সন্ধ্যাবেলার
ধূপদীপ, রাত্রিকালীন শয্যা
সে তাই বুঝে না কি করে সৈনিকের পোশাক
পরে
সন্তানকে কোলে নেয় মা—
সাম্রাজ্যবাদীর দল কুঁরে খায় মানুষের
স্বাধীনতা—
সে বুঝে না কোন অনন্ত প্রেমে
এ মেয়ে সীমান্তে নিদ্রাহীন ।
*************************
১০.০৫.২০১৮
কবি দীপক চক্রবর্তী । আজ আমরা পড়ব তাঁর
আরও দুটি কবিতা ।
বুদ্ধিজীবী
দীপক চক্রবর্তী
জলের গভীর থেকে উঠে এসেছে সে, এক জলকুমারী
অনাদি জলের গন্ধ মেখে । সে নারীর
নাভিমূলে জেগে থাকে স্মৃতির অতীত গুহা
প্রস্তর যুগের স্তন ।
তবু, তার ভুরুর পাশের কাটা দাগ
কোনও যুদ্ধের চিহ্ন কিনা
জানি না তা ।
অথবা জেনেছি তাকে
দীর্ঘযামিনী যাপনে
গভীর আবেশে,
দিগন্তের এপারে ওপারে
স্মৃতির সীমানা জুড়ে ।
তবু, তার ভুরুর পাশের কাটা দাগ
কোনও যুদ্ধের চিহ্ন কিনা
জানি না তা ।
****************************
কবির দুঃখ একা থাকে
দীপক চক্রবর্তী
কবির দুঃখ একা থাকে, তার কাছে যায় না তো কেউ
কবি তার দুঃখের কাছে
শীতের ভিখিরির মতন জড়-সড়ো
একা বসে থাকে ।
কেউ এলে হেসে কথা বলে ঠিক
এই তো কবির ঘর-বাড়ি— সন্ধ্যা হলে আলো জ্বলে
সাজানো বসার ঘর— দামি ম্যাগাজিন—
বৌ তার দিয়ে যায় হাল-ফ্যাশানের পেয়ালায়
চা কিংবা কফি ।
কোনো কোনোদিন কবি, সভা-সমিতিতে যায়
কবিতাও পাঠ করে আসর জমিয়ে ।
তবু তার দুঃখের চোখে কেউ রাখে না তো চোখ—
শুধু এক গোপন করাতি আসে, দিয়ে যায় দুঃখের অসুখ ।
কবি তাই একা একা বাড়ি ফেরে,
একা চাঁদ জেগে থাকে মাথার উপর
।
********************************
১১.০৫.২০১৮
দীপক চক্রবর্তী । স্মৃতির জ্বলন্ত ছবি
আঁকার শিল্পী । কবিতা কোথায় থাকে ? শব্দে,
নাকি বাক্যে, জানি না কাগজে, নাকি
মেধায়, জানি না । হয়তো কবিতা
কবিতাই শুধু । তার কোন ব্যাখ্যা দিতে পারলেও, হয়তো-বা দিতে নেই কবি কিছুই জানে না । সে তো শুধু না-বলা
কথাগুলো ধরতে চায় । আজও দু-টি কবিতা পড়ব, দীপক
চক্রবর্তীর ।
নদী
দীপক চক্রবর্তী
রোজ ভোরে নদীকে বলি পথ পাল্টাও ।
একই পথে আর কতদিন চলবে ?
একদিন যারা ছিল,
এক এক করে সবাই পাল্টে নিয়েছে ।
কী বোকার মতন একটা জীবন কাটিয়ে দিচ্ছ !
যদি কোনোদিন স্বাতী ফিরে আসে
অমলা, মৃগাঙ্ক ফিরে আসে—
গল্পচ্ছলে অন্যমনস্ক পাথর ছুঁড়ে দেয়
তোমার বুকে,
তাদেরে বলো না দুঃখ
তাদেরে বলো না স্মৃতি—
আগুন-ঝরানো দিনগুলোর কথা বলো না,
স্বপ্ন-ঝরানো দিনগুলোর কথা বলো না ।
বরং পথ পাল্টানোর কৌশল শিখে নিও ।
একই দুঃখের কাছে— স্মৃতির কাছে
সারাজীবন থাকে না কেউ ।
**********************************
অঞ্জলিদির চোখ
দীপক চক্রবর্তী
একদিন বলেছি তোমাকে, অঞ্জলিদির কথা । ভাল গান গাইত । শৈশব
জুড়ে ছিল তার ছায়া,— এসব বলেছি । কিন্তু তার দু’টি চোখের কথা বলিনি, যে চোখে শুনতে পেতাম ঘর ছাড়ার ডাক,—
বলিনি পুলিশ এনকাউণ্টারে অঞ্জলিদির মরে
যাবার কথা । জীবন জীবন করে মৃত্যুকে এড়াতে চেয়েছি শুধু । বেঁচে থেকে আমরা ফুলের
কথা লিখেছি, পাখির আকাশের কথা—
ভালবাসা, জ্যোৎস্না নিদেন ভাঙা পথঘাটের কথা লিখেছি— অঞ্জলিদির চোখের কথা লিখিনি । আমরা ঘর
করেছি— সে ঘর ছেড়েছিল । কোনও
কোনও নির্জন রাতে আজো কোথা থেকে হঠাৎ উঠে আসে সে দু’টি চোখ । ঘুম ভেঙে যায় । জল খাই, ঘুমের ট্যাবলেট গিলি । আলো জ্বেলে কাগজ পড়তে বসি । নীল আলোয়
রবীন্দ্রনাথ বাজাই । তবু স্পষ্ট দেখতে পাই, কুলি কামিনদের মাঝখানে শুকনো মুড়ি চিবোচ্ছে সে, আর তাদের কানে গুঁজে দিচ্ছে জেগে ওঠার
মন্ত্র । পাততাড়ি গোটানোর আগে সূর্যদেব শেষবার উঁকি দিচ্ছেন তার চোখে মুখে । কিছু
পরে আকাশের কোণে জ্বলে উঠেছিল একটি উজ্জ্বল তারা— স্থির— দীপ্যমান
। আজো জ্বলছে । একজীবনের সময় জুড়ে জেগে আছে ঐ দু’টি চোখ ।
***************************
১২.০৫.২০১৮
...টেবিলের উপর পড়ে আছে অস্বস্তিকর নীরব
কিছু খাতা-বই...
আজ আরও দুটো কবিতা পড়ে আপাতত ইতি ।
ঈশ্বরী
দীপক চক্রবর্তী
বৃত্ত থেকে কেন্দ্রে যাবার যে ক’টা পথ
সবই আমার হাতের মুঠোয় ।
কেন্দ্র বলতে সাজানো ঘর—
পোর্টিকোতে টবের গাছে ফুল ফোটানো ।
কেন্দ্র বলতে উলুস্-খুলুস্ পাখির বাসা
দিগন্ত ছুট হাওয়ার দোলায় পাতার কাঁপন ।
জীবনযাপন খুঁটিনাটির মাঝখানে তাই—
পাত পেড়েছি— আসন-পিঁড়ির ।
সিঁড়ির ধাপে ধাপে
তার রঙ বাহারি মনের তলা ।
এইটুকু পথ হেঁটেই আমি যেতে পারি
একটা পথে নদী পেরিয়ে উড়তে থাকি
অন্য পথে যেতে গেলেই গুঁড়িয়ে ফেল
পেয়ালা-পিরিচ— বুকের পাহাড় ।
ঐ প্রাসাদের সিংদুয়ারে পুড়তে থাকি
কামগন্ধে ডুবতে থাকি ।
হে ঈশ্বরী ক্ষমা করো ।
***************************
প্রতিদিন একা
দীপক চক্রবর্তী
প্রতিদিন একটু একটু করে একা হচ্ছি
স্বপ্ন দুঃস্বপ্নহীন ঘুম ভেঙে প্রতিদিন
দেখছি
ধুলো জমছে জানালার কাচে ।
অন্তরঙ্গ পর্দাগুলোও করুণ মুখে ছুটি
চাইছে
টেবিলের উপর পড়ে আছে অস্বস্তিকর নীরব
কিছু খাতা-বই
কতদিন হলো এই আঙুলগুলো ছুঁয়ে দেখেনি
বই-এর শরীর ।
তোমার শরীর ছুঁয়ে একদিন
সেতারের মতো
বেজেছিল বিকেল ।
আজ কেবলই কিছু না বোঝার ভান করে
মানুষের ভিড়ে মিশে আছি
সাজানো ড্রয়িং রুম অবধি— ভেতর-বাড়িতে যেতে ভয় হয়
পারফিউমে ঢেকে রাখা শরীরী দুর্গন্ধ থেকে
ক্লান্ত ফিরে আসি ।
ঘরে এসে কোনো কোনোদিন শুধুই তোমার কথা
ভাবি ।
ইচ্ছে হয় সমস্ত গার্হস্থ্য ভেঙে অভ্যস্ত
দিনযাপন ভেঙ্গে
তোমার কাছে ফিরে যাই
যেভাবে ভোরের কাছে নতুন গান নিয়ে
পাখিরা ফিরে আসে
।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন