“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৮

‘অসমক ত্রিপুরা হ’বলৈ দিয়া নহব’ --একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিভাস্য।


 [ লেখাটি  'দৈনিক যুগশঙ্খ' এবং 'নয়াঠাহরে' ক্রমে ১২ ও ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৮তে  প্রকাশিত ]


।।    সুশান্ত কর।।



ত্রিপুরা সম্পর্কে অসমে  জনপ্রিয় ধারণাগুলো বিশ শতকেই গড়ে তুলা হয়।  আহোমেরা  নিজের  ভাষা ছেড়ে অসমিয়া হয়ে যাবার  কথা আমরা  স্বীকার করি, ওই মাত্র কয়েক শতক আগে আসা আহোম ! অসমে প্রাগার্য বডো কার্বিদেরও আমরা অসমিয়া বলে ভেবে নিই!  কিন্তু বাঙালির সঙ্গে ‘খিলঞ্জিয়া শব্দের  উল্লেখ এমন করে করা হয় যেন যেন বাঙালি আঠারো শতকে ভূমধ্য সাগর থেকে আসা টি অবৈধ প্রব্রজনকারী জনগোষ্ঠী মাত্র চাই কি পশ্চিমবাংলাতেও বাঙালি বহিরাগত! খিলঞ্জিয়া তো সাঁওতাল মুণ্ডারাই ! কপাল ভালোবাংলাদেশ অসম একই  প্রদেশ হয়ে রইল না!  হলে পুরো বাংলাদেশ থেকেই  বহিরাগত বাঙালিকে তাড়াতে হতো! কথাগুলো প্রচলিত যুক্তি অনুসারে লিখলাম! যেন  বাঙালির জাতিগঠন প্রক্রিয়াটি অসমিয়াদের থেকে আলাদা! ত্রিপুরা প্রসঙ্গে অসমে গড়ে  তুলা মিথ অর্ধ সত্য অর্ধ মিথ্যাতে পরিপূর্ণ! আমার যুক্তি বলবার আগে  দুটি প্রত্যাহ্বান এগিয়ে দিতে চাই ! ১) কোচবিহারেও রাজা ছিলেন কোচ! শঙ্কর দেব সেখানে  সাহিত্য করেছিলেনকেউ কখনো কেন বলেন না যে আসামকে উত্তরবঙ্গ হতে দেবো না  (অসমক উত্তবঙ্গ হবলৈ দিয়া নহবলকাতার  বাঙালিরা সেটি ভালোভাবে নেবেন না –এর বাইরে আর কী যুক্তি থাকতে পারেলকাতার সঙ্গে  অসমিয়া বৌদ্ধিক শ্রেণির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে।  বইমেলাতেসাহিত্য সম্মেলনে চলচ্চিত্র উৎসবে কলকার  বাঙালিকে ডাকতে হয়। আগরতলা বাঙালিদের না ডাকলেও চলে । ফলে সম্পর্ক খারাপ হওয়াটা কেউ চাইবেন না। ২) দ্বিতীয় প্রশ্ন: অসমকে  মিজোরাম মেঘালয় হতে দেওয়া হবে না –এই কথাটাই কেউ কখনো বলেন না কেন?  অন্যভাবে বলতে গেলে, বাঙালিরা মিজোরামেঘালয় দখল করলেন না কেন ? কেন কেবলই ত্রিপুরা!  ব্রিটিশের শিলঙে দেখি বাঙালির অশেষ ক্ষমতা ছিল !
এখন আসি সেই পরের কথাতে, কেন মেঘালয়মিজোরামকে বাঙালি ত্রিপুরা করল না! কিন্তু ত্রিপুরাকে তো কলইকোচরাজ্যের  আধাকে পুরোপুরি বাংলা করে ফেলল! আসলে  কোচরাজ্যের দরং বিভাগের অসম হওয়া এবং  কোচবিহার কেন্দ্রিক বিভাগের বাংলা হবার  প্রক্রিয়া অনেকটাই একই! কোচরাজ্য অসম এবং  অসমিয়া হতে পারবে  কিন্তু অন্যভাগটি  বাংলা হতেই পারবে নাডিমাসাত্রিপুরা রাজ্যের প্রজাসাধাণ কোনোভাবেই বাঙালি হতে পারবে না সেরকম কোনো  ঐতিহাসিকসমাজতাত্ত্বিক যুক্তি নতুবা বাধ্যবাধকতা আছে কি ইতিহাসের  বিভিন্ন সময়ে কাছা সিলেটের  সঙ্গে চট্টগ্রামরাকান অব্দি ত্রিপুরা রাজ্যের ভেতরে ছিল ! আমরা সিলেটের কামরূপে থাকা দিনগুলো সগৌরবে  স্মণ করি! ত্রিপুরার অধীন সিলেটকে ভুলে থাকার যুক্তি  কীতারউপর এই পুরো অঞ্চল কখনো সুবাহ বাংলা, কখনো বা রাকানের  রাজসভা অধীনে এসেছিলএঁরা শুরুতে আর্য ব্রাহ্মণ ডেকে এনে, পরে   মুলমান পীর ফকিরকে  আশ্রয় দিয়ে এক দীর্ঘ আর্যায়নের প্রক্রিয়া চালিয়েছিল! ফলে এই পুরো অঞ্চলে আর কোনো ভাষাগোষ্ঠী গড়ে উঠবে না, কেবল ভোটবর্মী ত্রিপুরি জনজাতি থাকবেন---এমন করে ভাবার যুক্তি কই? সেইসব মানুষই তো আজকের   বাঙালিচাকমাহাজং! ত্রিপুরার  জনজাতিদের আর্যায়নের প্রক্রিয়াতেই এই সব হলো! অসমে হওয়া অসমিয়ার মতো! ফলে সেখানকার  বাঙালিও বহিরাগত বিদেশী কী করে হয়! অসমে আহোম স্বর্গদেওরা সাত রাজ মারি এক রাজ করার’ মতো বাকি বাকি ভারতে কী হলো কেউ বলে না। মোলেরা দেখি ভাটি অসম থেকে শুরু করে পাকিস্তান অব্দি একই ঘটনা ঘটালো।  বহু ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী মিলে আজকের বৃহৎ  আর্য জনগোষ্ঠীগুলো গড়ে উঠেছিল। বলা হয়, আহোমেরা আসামে এসে স্থানীয় ভাষা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু বাস্তব অন্যরকম। সেই জন্যে তারা কয়েক শতক নিয়েছেন।  স্থানীয় যোগাযোগের প্রধান ভাষা তখন ছিল প্রত্ন-বডো। তারা সেই ভাষা নেন নি। নিয়েছেন, সেই ব্রাহ্মণ তথা বর্ণহিন্দুদের সমকালীন ভাষা এবং ধর্ম। শঙ্কর দেব-মাধব দেব প্রচলিত বৈষ্ণবধর্মের প্রত্যাঘাতেই এরা শাক্ত হবার দিকে ঝুঁকেছিলেন।  সেই ব্রাহ্মণদের অনেকেই ততদিনে অসমে সহস্রাব্দের প্রাচীন বাসিন্দা হয়েছেন সত্য, কিন্তু আহোম রাজারাও অনেককেই ডেকে এনেছিলেন, এবং তাদের এক বড় ভাগ সুবাহ বাংলার থেকে এসেছিলেন।এমন কি নবদ্বীপ থেকেও। এরা সবাই মিলে আধুনিক অসমিয়া ভাষাকে রূপ দিয়েছেন। এই সত্যও অনেকে মানতে এবং জানতে চানই না যে ‘বাংলা’, ‘অসমিয়া’ ইত্যাদি জাতি তথা ভাষা নামও একেবারেই একালীন।   
আমি মূলত ইতিহাসের রূপরেখার কথা লিখছি! যেসব কথা  'অসম ত্রিপুরা করা’র ন্যারেটিভে উঠেই আসে না।  মোঘলের বাংলা সুবাহ না থাকলে ব্রিটিশের বেঙ্গল প্রভিন্সও থাকত না! অন্য কোনো নাম হতো। ‘বাঙালি’ নাম তার থেকেই এসেছে।  বাংলা সুবাহ সম্প্রসারণই  বেঙ্গল প্রভিন্স! যাতে কিনা  অসমের মতো  ত্রিপুরাও প্রবেশ করেছিল। সমগ্র ত্রিপুরা নয়।  একটি অংশ রাজা অধীনে রেখে অন্য এক বড়ো অংশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অনুসারে  জমিদার ছিলেন ত্রিপুরার রাজা।  নোয়াখালি কুমিল্লার বড় অংশের নাম ছিল  চাকলা রোশনাবাদ! তিপেরা জিলা বলেও বলা হতো! সেই সমগ্র অঞ্চলের  প্রজা অন্য  বহু জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বাঙালিও ছিল,  মণিপুরিও ছিল! দেশ বিভাজিত লে কেল বাংলা ভাগ হয় নি! অসম ভাগ হয়েছিলতিপেরা ভাগ হয়েছিল! সেই জন্যেই  মেঘালয় মিজোরাম ত্রিপুরা হল না ! ত্রিপুরাই শুধু ত্রিপুরা’ হল!
তাই ত্রিপুরাতে  ত্রিপুরি রাজার দিনেও বাঙালির  সংখ্যা ততটা  সংখ্যালঘু ছিল না যেমন প্রচার করা হয়।  এমন প্রচারের সময় উদ্দেশ্যমূলক ভাবে তিপেরা জেলাৰ কথাচাকলারোশনাবাদের কথা গোপন রাখা হয়! সেই তিপেরা জেলার জলে বাতাসেই রাজপরিবারের মানুষ  শচীন দেববর্মণের  উদ্ভৱ সম্ভৱ হয়েছিল! তিনি কখনো  বাংলা এবং বাঙালির বিরুদ্ধে কিছু লিখেছিলেন, বলেছিলেন কি? দেশভাগের পরে তিপেরার  জমিদারের প্রজা এক অংশ থেকে অন্য অংশে এসে গেছিলেন।  তাদের তখন কোন যুক্তিতে ভাবতে হতো যে পরে ‘নেসো’ বলে একটি সংগঠন গড়ে উঠবে, আর সেই ঘটনার আশ্রয় নিয়ে অসমের মানুষকে ভয় দেখাবে? বাকি কথাও অনেকটাই একই।
চাকলা রোশনাবাদের  কথা ছেড়ে দিলেও দেশভাগ হলে বিপন্ন মানুষ সেই অংশগুলোতে এসেছিলেন যে অংশগুলো ঐতিহাসিকভাবে ব্রিটিশ বাংলার অংশ ছিল বা তার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। অসমেরও এক বড় অংশ যে মোঘলের দিন থেকে সুবাহ বাংলা অংশ ছিল সেসব  কথা আমরা গোপন কেন করি লাচিত বফুকন তো শরাইঘাটেই মোঘলকে প্রতিহত করেছিলেন।  আজকের  অসমের পশ্চিম এবং দক্ষিণের  সীমাতে কী হয়েছিলসেইসব  প্রশ্ন কি উঠতে নেইঅতএব যে কারণে  মানু উত্তৰ বাংলাদক্ষিণ বাংলাতে গেছিলেনকই  কারণে  অসম এবং ত্রিপুরাতেও এসেছিলেন।  বাকি রাজ্যগুলোতে গেলেও সেই সব রাজ্য থেকে আগেও গেছেন, পরেও গেছেন। থাকতে কেউ যান নি। সে জন্যেই বাকি রাজ্যগুলো ‘ত্রিপুরা’হলো না। এভাবে আসা অধিকাংশ মানুষের আগে থেকে এই সব জায়গাতে আত্মীয় বন্ধু ছিলেনই। এরা কী করে ভাবতেন যে এসব জায়গাতে আসতে নেই? বড় পাপ হবে। মরলে বাংলাতেই মরতে হবে! নিজের আপন লোকজন ভেবে এসে এখনই শুধু বুঝতে পারছেন এই সব লোকজন তো আমার আপন না।
১২ ডিসেম্বর,১৮ যুগশঙ্খ
বেশ,না হয় মানাই গেল যে তাতে আগেকার মানুষের কিছু সমস্যা হয়েছে।  আধিপত্যবাদের সমস্যাও দেখা দিয়েছে। কিন্তু আধিপত্যবাদের সমস্যাটিই তো  আধুনিক সমস্যা! একে  'তোমরা বহিরাগত ! – এখান থেকে চলে যাও!’  বলেই কি সমাধান রতে হবেজাতি জনজাতি দ্বন্দ্ব কি কেবল 'বহিরাগত’রাই  সৃষ্টি করেছেন? এভাবে বলাটিই তো সরাসরি মিছে কথা।  ব্রিটিশ চাইছিল উত্তপূর্ব প্রদেশ গড়ে তুলতে। সেই  বৃহত্ত অসমকে ভাঙলেন কারা? 'বহিরাগত’ বাঙালিই কিউত্তপূর্ব একসঙ্গে থাকলে তো দেখি এখানে ‘খিলঞ্জিয়ার প্রভুত্ব’ এমনিই থেকে যেত। তারজন্যে ‘নেসো’র দরকার ছিল না।  হ্যাঁ, সেই পূর্বোত্তর ভারতবর্ষে বাঙালিও থাকত  বৃহৎ জনগোষ্ঠী হয়ে ! বাঙালির যদি  ত্রিপুরা করা’র কোনো পরিকল্পনা থাকত তবে বৃহৎ অসমের বিভাজন হতে না দিলেই তো লাভ ছিল। সেরকম কোনো চেষ্টাও কি বাঙালি করল?  ষাটের  ভাষা আন্দোলনে তো দেখি, খাসি,  মিজো, মণিপুরি সবাই বাঙালিকে সঙ্গ দিয়েছিলেন। সবাই পৃথক রাজ্য নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বাঙালিকেই দেখি যেখানে যেমন ছিলেন পড়ে রইলেন। আমার জন্ম নাগাল্যাণ্ডে, আমার পরে জন্ম বোন থাকে এখন ত্রিপুরাতে, আমার এক পিসতুতো দাদার পরিবার থাকে মিজোরামে, আর পরিবার মেঘালয়ে। আমি থাকি তিনসুকিয়া, আমার  মা-ভাই বাকি পরিবারের সবাই থাকেন শিলচরে। আমি কি ? নাগা?মিজো,খাসি, অসমিয়া,বাঙালি, সিলেটি, বাঙাল? কিছু একটা যুক্তি তো থাকতে হবে। যদি জানা থাকত, তবে জন্মের আগেই ‘নেসো’র অনুমতি নিয়ে রাখতাম, তোমরাই বলো আমি কী হয়ে জন্ম নিই?


কোন মন্তব্য নেই: