“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৮

কবি সুমনা রায়ের কাব্যগ্রন্থ 'উড়ান'-এর পাঠ-প্রতিক্রিয়া


।। সেলিম মুস্তাফা ।।

... 'ঢেউ আসে আর ফিরে ফিরে যায়’...


      তো সকলের জীবনেরই বেদনাবিধুর কাহিনি ! এমনকি একজন সফল মানুষেরও একই বিড়ম্বনা । কেউ বলে, কেউ বলে না ।
      এমনই কিছু মর্মকথার ডালি সাজিয়ে, কবি সুমনা রায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ উড়ান’, সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ত্রিপুরার স্রোতপ্রকাশনা থেকে । বাহান্নটি রচনা রয়েছে এতে । সুন্দর কভার করেছেন প্রশান্ত সরকার । সুমনা ত্রিপুরারই এক সুকন্যা, বিবাহসূত্রে মুম্বাইবাসিনী । 
     এই কবি সকল বিঘ্নের মধ্যেও খুঁজে নেন শেষ পর্যন্ত একটি পথ যা অস্পষ্ট হলেও নিরাশার নয় ।

‘...দূরের আজানে প্রতিশ্রুতির সুর ভেসে আসে
যেন আরও এক নতুন সূর্যোদয়ের...        (নতুন সূর্যোদয়)

     জীবনকে প্রাত্যহিক বাস্তবতার উপকরণে সাজাতে ভালবাসেন এই সময়ের নবীন কবিরা । এক নামী কর্পোরেট সংস্থার সিনিয়র ম্যানেজার সুমনাও অংক আর জ্যামিতির ভেতর দিয়েই নিজের দর্শনকে রূপ দিতে ভালবাসেন আর তাতেই কবির জীবন আর কাজের নিখাদ সম্পৃক্তটা ফুটে ওঠে

জমানো সমস্ত মেঘ পুড়ে গেলে
ভাগশেষে শুধুই ধূধূ আকাশ
ভাগফলে ধূসর একাকীত্ব’... ...   (বৃষ্টির ফোঁটা)

     নিজেকে বিশ্লেষণেও অকপটতা তাঁর পরিচ্ছন্ন মননেরই পরিচায়ক

‘...নিজস্ব কোন আলো নেই আমার
শুধু অন্ধকার
যা আমাকে আমার কাছেই
                আড়াল করে রাখে... ...
মহাশূন্যে মিলিয়ে যায়
                 ধোঁয়া আর ধূপের কাহিনি’... ...(অনন্তঘুম)

     এই সময়টাকে, বেদনাহত হলেও, কবি ঠিকই চিনে নেন

‘...বিজ্ঞাপিত সুখের পাশে গুটিশুটি পড়ে থাকে
ব্যক্তিগত দুঃখগুলো;... ...
পুরোনোকে ঝেড়ে ফেলার সময় আসে,
দোকানে দোকানে লেগে যায় সেল,
জীবনের দিকে এগিয়ে আসে সস্তা ইশারা;

পুরোনো জীবনের গল্প খোঁজে
নতুনের বর্ণমালা ।              (বর্ণমালা)

     তবু দুঃখ তো থাকেই, যাকে কিছুতেই ভোলা যায় না, বিলুপ্ত করা যায় না

‘...সরীসৃপ জীবন গুটিয়ে ফেলে জমানো ক্ষোভ
আর খুঁজে ফেরে গোপন আস্তানা ।
ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা আর জ্বালাতে পারে না আগুন... ...
ঢেউ আসে আর ফিরে ফিরে যায়’... ...               (নিজস্ব ত্রিকোণমিতি)

     কিন্তু একজন কবির পক্ষে যা সবচেয়ে বড় বিষয়, সেটা হচ্ছে, সময়ের সমস্ত লাঞ্ছনার পরও নিজের সঠিক অবস্থানটা আবিষ্কার করা, যা তাঁকে এপর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছে, প্রতিদিন রাখছে, এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনের আলোর খবরের প্রতীক্ষায় । এটা বানানো কোন সূর্যোদয়ের কথা নয়, এটা কোন ইউটোপিয়ান-জগতও নয়, এটা প্রকৃতই নিজের দৈনন্দিন অবস্থান, যা বারোমাস্যা বিলাপের আড়ালে আমরা ওভারলুক করি বা স্বীকার করতে চাই না । কবি সুমনার কবিতার পঙক্তিতে সেই ইঙ্গিতই এলো, যা প্রকৃতই আছে কোথাও, নইলে আমরা বাঁচবো কেন ?

‘...এক নিঃস্ব আঁচলের অপেক্ষায়
দূরে কোথাও হয়ত থেকে যায়
আগামীকালের
         নতুন এক গুচ্ছ চাবি ।      (চাবি)

     হয়ত থেকে যায়বাক্যে এই সংশয়, মূলত একজন কবির আত্মবিশ্বাসই । কবিরা এমনই বলেন । আর রাজনীতিকরা বলেন নিঃসংশয়ে, যা মিথ্যা আর বানানো । দোলাচলই একজন কবির এগিয়ে যাবার আসল অস্ত্র বলে আমার মনে হয় !

     কবি তাঁর হাটকবিতায় বলেন

‘...সমস্ত কোলাহলের শেষে
মুঠো মুঠো রাত
ছড়িয়ে ছড়িয়ে থাকে পুরো হাট জুড়ে ।
বেচাকেনার অমীমাংসিত শ্রম
ক্লান্তিতে হেলে পড়ে থাকে ।
ঝিঁঝির নৈশ সঙ্গীত আর
তারাদের মন্দিরা রচে যায় যুগলবন্দী;

রাত্রির দ্রাবিত জ্যোৎস্না তখন
কষে যায় শূন্য থেকে
       শূন্যে ফেরার পাটীগণিত ।       (হাট)

     কথায় বলে আয় ব্যয় শূন্য স্থিতি। জীবনটাও যে এমন এরই একটা চিত্র আমরা পাই এই হাটের কল্পে । এমনি আরও কিছু বেদনালিপি

‘...দেওয়াল থেকে খসে পড়ে পলেস্তারা
ফ্রেম থেকে খুলে পড়ে স্মৃতি;... ...
বিছানায় ছড়িয়ে থাকে অসুখ ।

...জীবন ভুলে যায়
ব্যূহ থেকে বেরোনোর সূত্র,... ... (জাতিস্মর জীবন)

     কবি নিজেই নিজের পথের কাঁটা, এই আবিষ্কার তাঁকে আরও প্রাজ্ঞ করে তোলে

এগিয়ে যাবার দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে
জানালার গরাদ ধরে উঁকি দিয়ে থাকি,... ... (শূন্যতা)

     আরও একটি সুন্দর দৃশ্যে প্রকাশ পায় কবির দুর্দমনীয়তা

দু-তিনটে অতিথি চড়াই
ঝুল বারান্দায় জমা রেখে যায়
           নিজেদের কানাকানি
অবাধ্য হাওয়ারা এড়িয়ে চলে ফ্লেমিং সূত্র ।
হেনরির কাছে শিখেছে জীবন
একটু একটু করে অন্ধকার কেটে যায়
আলোর পাঠ খুঁজে খুঁজে;
স্বপ্নরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে
চূর্ণ করে চোরা চাওনির দ্রাবিত অভিমান ।
রঙিন কলম স্পর্ধা আঁকে সাদা-কালো সংসারে
আর লিখে চলে একান্ত নিজস্ব এক অভিধান ।         (নিজস্ব অভিধান)

     নিছক প্রেমের সস্তা আর অযথা কোন বিভ্রম রচনার শব্দ-খেলা নেই কোথাও এই গোটা বইটিতে, এটা এই সময়ে সামান্য হলেও উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ।
     
কবিতা বা যেকোনো শিল্পই কোন না কোনভাবে এক ধরণের অনুকৃতিই । এটা মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা । তবে যখন তা কেবল অতীত থেকে উঠে আসে, তা কোন বিশেষ তাৎপর্য তেমন বহন করে না, যদি না কবির ভবিষ্যৎ-দর্শনেরও (কল্পনা) ব্যক্তিগত অনুকৃতি টেনে নিয়ে আসে । এর জন্য হয়তো চাই তীব্র মনন আর আত্মিক বিস্ফোরণ । বলা হয়, আত্মা বিস্ফোরণ না করলে শব্দ বিস্ফোরণ করে না, আর শব্দ বিস্ফোরণ না করলে বাক্য বা ভাষা বিস্ফোরণ করে না ।
     শত বন্ধনে থেকেও কবি মূলত এক মুক্ত পাখি, যার ডানা ঝাপটানোর বাতাস পাঠক মনেও তোলে শিহরণ !

পথের শেষেই থাকে আরো একটা নতুন পথের শুরু
পথ জানে সেকথা, নদীও জানে
তাই সে বাঁকে এসেও রাখে না কোন কান্না’... ... (আলপনা)

কিংবা

 ‘...কালো দুঃখগুলোর দিকেই মেলে ধরে মন
আবাহনী মুদ্রায় ।
একলা একলা আরও একা হয়
মুখোমুখি দাঁড়ায় আরও এক নতুন যুদ্ধের ।       (রাতের পাঠশালা)

     এই কবির প্রায় সবগুলো রচনাই আত্মজৈবনিক অনুমান হয় । ফলে বিষয়গতভাবে খুব একটা বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে ওঠেনি বলা যায়, একই সঙ্গে একথাও দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে হয় যে এমন এক আন্তরিকতা লেখাগুলো ছুঁয়ে আছে যার জন্য তাঁকে একটু আলাদা করেই চিহ্নিত করতে হয় এই সময়ের মেকি বাগাড়ম্বরের প্রেক্ষিতে ।

‘...রঙ্গমঞ্চে পালাবদল
খুশিও রঙ বদলায়... ...
ধর্ম অধর্ম ভুলে থাকা মন
হন্যে হয়ে খোঁজে নিজেকেই ।   (উৎসব)

     এমনি আরও উপলব্ধি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যা তার সংগ্রামী মানসকেই প্রকাশ করে

লড়াই লড়াই আর লড়াই
একটা থেকে আরেকটা
ভেতরে বাইরে
নিজের সাথে নিজেকেই
লড়িয়ে দেবার লড়াই’... ...    (লড়াই)

কিংবা

ঝড়ের তাণ্ডব থেমে গেলে নিঃশ্বাস শুধু বোনা থাকে
নীরবতার ভাঁজে, কোঁচকানো চাদরে
লেখা থাকে না কোন নাম
হাতের রেখা সরল হয় না বলে

আঁকাবাঁকা পথেই এগিয়ে চলি
     পেন্সিলে কম্পাসে’... ...      (ঝড়)

     কবি আরও এগিয়ে যান, আরও উড়ান ভরুন আকাশ থেকে মহাকাশে, এই কামনা রেখে তাঁর পরবর্তী গ্রন্থের অপেক্ষায় রইলাম ।
     স্রোত প্রকাশনার বেশ কটি গ্রন্থ পাঠ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, তাই বলতে চাই তাঁরা যেন বানান সম্পর্কে আরও একটু সচেতন হন । এই বইটিতেও প্রচুর অস্বীকৃত বানান রয়েছে । ছাপাও সুন্দর নয় এই বইটির, টাইপ অতিরিক্ত ছোট, আর কোন কোন শব্দ সাদা কুয়াশার ভেতর হারিয়ে গিয়ে পঙ্গু হয়ে আছে । আজকের দিনে এই ছাপা আর ভুল বানান আকাঙ্ক্ষিত নয় মোটেই !
                                            *** সেলিম মুস্তাফা / ০৫.১২.২০১৮




কোন মন্তব্য নেই: