।। সেলিম মুস্তাফা ।।
...'সাদা বকেদের সাথে কথার খেলাপি করে
মাছরাঙা'...
বিগত ধর্মনগর বইমেলায়
কাঞ্চনপুর থেকে এসেছিলেন কবি অমলকান্তি চন্দ । উপহার দিলেন তাঁর দ্বিতীয় কবিতার বই
‘ভালোবাসার পাথরকুচি’ । তাঁর ছড়ার সঙ্গে পরিচয় ছিল ফেসবুকের
মাধ্যমে । এবছর মার্চে বইটি প্রকাশ করেছেন কুমারঘাটের ‘স্রোত প্রকাশনা’ ।
দুয়েকটি শব্দ-সংকট
থাকলেও বইটির কাগজ বাঁধাই আর মুদ্রণ খুব ভালো । সুন্দর এবং যথাযথ প্রচ্ছদ করেছেন
ধর্মনগরবাসী চিত্রশিল্পী তথা কবি বাপ্পা চক্রবর্তী । গ্রন্থের শুরুতেই কবির সঙ্গে
পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন আরেক কবি মিলনকান্তি দত্ত ।
এ পাঠপ্রতিক্রিয়া
নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত । যারা ইতিমধ্যে অমলকান্তির এই কবিতাগুলো পড়ে নিয়েছেন,
তাদের সঙ্গে আমার অনুভব মিলতে না-ও পারে
বা মিলবে না, ধরেই নেয়া যায় ।
অমলকান্তি বেশিরভাগ
কবিতাই ক্ষুদ্রাকৃতির । দীর্ঘদিন ছড়া লিখছেন, খুব স্বাভাবিকভাবেই শব্দ সম্পর্কে সুন্দর সমীহ রয়েছে । তাঁর
কবিতায় রঙের আর দৃশ্যের নৈপুণ্য সহজেই চোখ টানে । দৃশ্য আঁকাতেই তাঁর তীব্র অবসেশন
রয়েছে যেন । কাব্যিক আদরে কবিতায় টেনে রাখতে পারেন সহজেই । দশদা কাঞ্চনপুর বিখ্যাত
হয়ে আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য, যার
রয়েছে এক তীব্র বুনো আকর্ষণ । কারণ এই দুই জায়গা থেকেই, চোখ তুললেই দেখা যায়, অদূরে
এক আকাশ রোদের নিচে তীব্র কামনায় হাতছানি দিচ্ছে সঙ্গলোভী নীল যুবতি জাম্পুই,
যার হলুদ কমলার তুলনা আর কোথাও নেই ।
তার বনজ সুবাস আর কোথাও নেই । বুনো লতায় তার বাহুপাশ আর কোথাও নেই ।
“নারীকে ছুঁয়ে দেখি অনেকবার
নাভিতে কালো মেঘেরা
কুণ্ডলী পাকায়
মেঘ গাঢ় হলে
কালো ছায়া নেমে আসে
রাতের কামুক চোখে।” (নারী)
অনেক কবির মধ্যেই,
তার নিজের জীবনকে— জীবনের মহার্ঘতাকে ছুঁয়ে দেখার, তাকে স্বীকৃতি দেবার কোন আয়োজন দেখি না,
যা একজন পাঠকের প্রত্যাশার মধ্যে
সঙ্গোপনে থেকেই থাকে, এমনকি পাঠকের
অজ্ঞাতসারে হলেও । এই কবির মধ্যে কিছু যেন পাওয়া যায় ।
“দুটো হাত যতটুকু প্রসারিত করা যায় দক্ষিণ ও বামে
যতটুকু নাগালের ভেতর পাই
লক্ষণরেখা বরাবর বৃত্তের মাঝে ভাসতে থাকি ।
বৃত্তের চারিদিকে ফণিমনসার ঝাড়
ফণাতে ঝুলে থাকে আমার মনখারাপের বেলা ।... ...
আমার সংসার ডমরুর তালে তালে
বৈরাগী তিলক কাটে প্রশস্ত কপালে ।
কষ কষ দুধ শিব ভাঙ
ঢোঁকে ঢোঁকে পান করি বৃত্তের সদর দরজায় বসে ।” ... ...
(সংসার)
প্রায় পুরো রচনাটিই
দিলাম । তৃতীয় পঙক্তিতে ‘লক্ষণরেখা’
শব্দটি আদতে ‘লক্ষ্মণরেখা’-ই
হওয়া উচিত মনে হয় । কবি নিজেকে এখানে নীলকণ্ঠ করে নিয়েছেন । তাঁর এই গণ্ডীবদ্ধ
থাকার যে মানসিকতা বা থিম বা দর্শন,
যা সংসারসুখে বা সংসারবিষে নিমজ্জিত
থাকার অবস্থাকে নির্দেশ করে, তা
থেকে কবি মুক্তি চেয়েছেন বলে মনে হবার মত কোন রচনা অন্তত এই গ্রন্থে নেই । নিজের
রচিত এই দৃশ্যপটেই কবিকে ব্যস্ত থাকতে দেখি এ জীবনের সমস্ত রসায়নকে উপভোগ করার
নেশায়—
ত্রুটিহীন শব্দচয়নে
তাঁর শান্ত কবিতা একটি একটি পঙক্তি নিয়ে এগোয় ধুলোপায়ে—
“... অনেকখানি পথ পায়ে হেঁটে গেলে তুমি ।
যেখানে ধুলোতে রৌদ্র লাভা,
চিকন বুননে সুঠাম দেহযুগল
কাস্তের দাঁতে সুদৃঢ় হয় ভালবাসার বন্ধন । ... ...
ঘন হয় মেঘ,
ওম ওম মাটিতে আতরমাখা গন্ধ
গায়ে মাখে উদাসী সকাল ।” (উদাসী
সকাল)
আরও পড়া যাক—
“... আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে সারারাত ধরে কাঁদলে
আমার ভিজে যাওয়া জামাটা ছড়িয়ে দিয়েছিলাম
সকালে উঠোনে ।
পাশেই তোমার লাল শাড়ি
চুলের লাছি
সোহাগী বালিশ জড়িয়ে আছে রোদ ।
রাত নামলে আমার ঘরে টুপটাপ বৃষ্টি ঝরে প্রতিক্ষণ ।” (রাত-১)
প্রেমের কবি আর
বিরহের কবি, মূলত এক । শান্ত কবির
বিদ্রোহের লক্ষণও শান্ত শীতল কঠিন আর তীক্ষ্ণ ।
“... পীরের তকিতে সুতো প্যাঁচ
আর সোনামুখী সূচ
শরীরে বিঁধে গেলে রজস্বলা হও তুমি ... ...
একদিন সাগরসঙ্গমে
পোয়াতি শিবিরে ত্রাণ বিলি করে প্রশাসন ।” (কলোনি)
একটি দুটি পঙক্তি
তুলে এই কবিকে ঠিকঠাক প্রকাশ করা কঠিন । এর চিত্রময়তা, যা জীবনানন্দীয় গূঢ়তায়
তোলপাড় না-করলেও, এক অদ্ভুত সরলতায়
আকর্ষণ করে যেতেই থাকে ।
ত্রিপুরার বাজারী
আধাশহরগুলির ভিড় এড়িয়ে দেও নদীর পাড়ে গহীন বনের অন্তরে এমন এক কবি থাকেন ভাবতেই
আমার গা শিরশির করে ওঠে, একটা
পুলক জাগে ! শহর কী দেয়, আর
কী দেয় এক নিঃসঙ্গ বনানী, ভাবতে
ইচ্ছে করে আবার !
“আমাকে দাঁড়াতে বললে
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম ঠিক গাছেদের মতো । ... ...
আমাকে গাইতে বললে
শিস্পাখিদের ভিড়ে আমি হারিয়ে গেলাম গাঁয়ের পথে ।
আমাকে কাছে ডাকলে
লক্ষ্য করলাম তোমার মাঝে অসম্ভব পরকীয়া স্বভাব ।
জিরাফের গ্রীবার মতো প্রলম্বিত হাতে সন্ধ্যা আরতি শেষে
স্লেটে লিখে রাখলে আমাদের না-বলা কথা ।” (আমাকে
দাঁড়াতে বললে)
না । কোন চমক নেই ।
শীতের দেও নদীর মতোই যেন । তবে ‘জিরাফের
গ্রীবার মতো’ নিশ্চয় মনে করিয়ে দেয়
সেই নিস্তব্ধতার কথা, যা ‘উটের গ্রীবার মত’ ।
এই পরকীয়া আরও এসেছে আরও মধুর হয়ে—
“...মেয়েটি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল একা
তার চোখের ভাষাতে
মিহি কবিতার ভ্রূণ । ... ...
মেয়েটির সাথে কথা হয়েছিল আমার
স্টেশনের কাছে, কাছে...
...
আরো কাছে ।” (স্টেশনের কাছে)
বিভিন্ন রঙের
চিত্রমালায় কবি সাজিয়েছেন তাঁর হৃদয়-যাতনাগুলি—
“কুপিবাতিগুলোর লকলকে জিভে
পূর্ণিমার আতর মাখা লাল শাড়ি,
বাবার বিয়োগের আগে,
আমার মা নিত্য পরতেন ।
সকালের ঠোঁটে চুমো খেতে খেতে
সাদা কাগজে মোড়া এই জীবন
আঁতকে ওঠে, বরণের
শেষবেলায়
পোড়ামাটির ঘর, দাওয়া,
কুপিবাতিগুলোর
প্রলম্বিত মুখে
কালো ছায়াগুলো ভেসে ওঠে আজ,
আলোর পাদদেশে ছদ্ম বিভীষিকা,
কেবল জঠর পোড়ায় ।” (ঘর-১)
ছবির শেষ নেই—
“জারুলের ফুলে ফুলে নীল আবির ছড়িয়ে
ছেলেটা নদীর দিকে ছুটতে থাকে ।”... ... (ঘরে ফিরে আসেন মা)
“এই তো তোমার ঘর... ...
মাঝে মাঝে জল টলমল চোখের ভিড়ে
বৃষ্টিকে খুঁজি ।
ঘরের ঠিকানা বলে দিতেই
অঝোরে
কেঁদে ফেলে ।” (ঘর-৫)
এত কথার ভিড়ে তবু
কিছু কথা বাকি থেকে যায় । একজন কবির কাছে আমরা কতকিছু যে খুঁজি ! আর না-পেলেই তাঁর
নম্বর কিছু কম করে দিই । কে দেয় পরীক্ষা, আর
কে দেয় নম্বর, কবি তার খবরও রাখে না
!! এমনি, বনের কিশোরীকে নম্বর
দিতে যায় ডোরাকাটা সাপ !
“ডোরাকাটা সাপ থাকে এই পথে
ভাতঘুম শেষে তারা বেরিয়ে পড়ে প্রতিদিন
পাহাড়ের টেরেস ভাঁজে... ...
মিজো কিশোরীর রূপে পাগল সাপেরা
কচি কমলার গাছে গাছে
ভিড় করে ।” ... ...
(ডোরাকাটা সাপ)
একটা গ্রাম্য বাজারের
চিত্র মন কেড়ে নেয়—
“বাজারে ঘুরে যায় সবাই একদিন
মুদির দোকানে চিটার পাত্রে ডুব দিলে
রসালো সাদাপাতায় তামাকের গন্ধ ভাসে বাতাসে ।
ধনীরাম এই গন্ধ শুঁকে শুঁকে কাটিয়ে দেয়
জীবনের অর্ধেক বেলা ।
বাচালির মাঝে বসে বসে
তেতো নুনের গল্প বলে
আজ
বাঁশকরুলে মরিচের ঝাল,
আদার ফুলের বড়া
জিভে চেটে চেটে খেয়েছিল তারা ।
ভিড়ে ভিড়ে পাহাড়ি খারাং জুড়ে নিয়ে আসা
মুঠো মুঠো আলো বাজারে
ছড়িয়ে দেয় জুমিয়া বৌ ।
পরনে উদাল ছাল, ভবঘুরেদের
সভায়
মাছি মারার ঔষধ ফেরি করে কেউ ।” (বাজার)
বিশেষ বিশেষ শব্দ ও
শব্দবন্ধের প্রতি, বিশেষ বিশেষ মেটাফরের
প্রতি, বিশেষ বিশেষ
নস্টালজিক সিক্যুয়েন্সের প্রতি কবিদের অবসেশন থাকে, থেকেই যায় । পকেটের আধুলিগুলো খরচ না-হওয়া পর্যন্ত হাঁটতে
গেলেই শব্দ ওঠে ! এমন কিছু অবশ্যম্ভাবী ঘটনা এখানেও পাই—‘জুমিয়াবেলায়’, ‘শিকারীবেলায়’
‘দহনবেলায়’ ‘বন্ধুবেলায়’ এমন
শব্দবন্ধ নিঃসন্দেহে খুবই সুন্দর, কিন্তু
এই বেলার ভেলায় বার বার ভেসে যাওয়া কিছুটা হলেও একঘেয়েমি নিয়ে আসতে পারে ।
...’সাদা বকেদের সাথে কথার খেলাপি করে
মাছরাঙা’...
গোটা গ্রন্থটিতে এমন
অজস্র সুন্দর দৃশ্য আর পঙক্তিমালা ছড়িয়ে আছে ।
কবিতাগুলো নিশ্চিত এই
সময়েরই রচনা । কিন্তু সময়টা কোথায় ? যে
দৃশ্যগুলো আমরা পড়লাম, তা
শুধু আজ সত্য নয়, অধিকাংশই চিরন্তন,
এমনকি বাজারের দৃশ্যটাও । পাল্টায় তো না
কিছুই, পাল্টানোর কথা আমরা
মুখে বলি মাত্র ! তবু সময়ের মোচড়গুলো কবিরাই তুলে ধরেন আমাদের চোখের সামনে । ‘সাদা বকেদের সাথে কথার খেলাপি করে
মাছরাঙা’ আরও উজ্জ্বল হয়ে এসে
আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করুক । কবি ছাড়া আঙুল তুলে কে দেখাবে আর ?
কবির জীবন আমরা পেলাম,
তাঁর মনস্তত্ত্ব, তাঁর ভাব, তাঁর
রচনার গঠনবিজ্ঞান সবই রয়েছে এখানে । তাঁর পাঠ-ইতিহাসও অনুমেয় । তবু মনে হয়,
সময় আর সমাজ, আর তাদের অধুনান্ত রসায়ন কিছুটা যেন কম পড়লো পাঠকের ভাগে ।
আমি ব্যক্তিগতভাবে থিমেটিক
কাব্যগ্রন্থে বিশ্বাসী নই । এতে একটা চক্রান্ত থাকে, একটা অভিসন্ধি থাকে । কাব্যগ্রন্থ হোক কবির জীবনের ‘কালখণ্ড’ অনুযায়ী । তাই গ্রন্থের নামটার মধ্যে যে একধরণের প্ররোচনা
রয়েছে সেটা ব্যক্তিগতভাবে আমার ভাল লাগেনি ।
কবি সমাজ আর সভ্যতার
সম্পদ । কবি সময়ের উদ্ধত ঝাণ্ডা !
তাঁর পরবর্তী
গ্রন্থের জন্য অধীর অপেক্ষায় রইলাম ।
১৩.০৯.২০১৮
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন