।। সেলিম মুস্তাফা ।।
উড়াল অন্তহীন
‘...কালের ঝাপট লেগে ডানা দু’টো ছিঁড়ে যায়
পুরনো পালক সব খসে খসে পড়ে যায়, আর কোনো দেখা নাই—
আর কোনো লেখা নাই, এবার ওড়ার শুরু তবে পালক ছাড়াই’
কবি অভিজিৎ চক্রবর্তীর সাম্প্রতিক
কাব্যগ্রন্থ ‘উড়াল অন্তহীন’
।
গ্রন্থটি ছন্দোবন্ধ কবিতার ডালি দিয়ে
দু-টি সোপানে সাজানো ।
‘একার ভাসান’ আর ‘জঙ্গল
অনন্তপথ’।
মোটামুটি ৬-এর দশক থেকে ছন্দ-মুক্তির এক
চেতনা কাজ করতে থাকে কবিদের চিন্তাপ্রবাহে । যারা ছন্দ জানেন তারাও বর্জন করতে
শুরু করলেন । তবে একেবারে বর্জন নয়, মাঝে
মাঝে সকলেই ছন্দে লিখেছেনও কমবেশি । ফলে পরবর্তী দশকগুলোতে কবিতাচর্চায় এক প্লাবন
আসে মুক্তির আনন্দে । আসে যথেচ্ছাচারও । এতে ক্ষতি হয়নি, লাভই হয়েছে ভাষা আর ভাবনার ক্ষেত্রে, একথা অনস্বীকার্য । কমলকুমারের কথা আছে— ‘ভাষাকে যে আক্রমণ করে সেই ভাষাকে বাঁচায়’
। তবে কমলকুমার স্বয়ং, আজও, বেশিরভাগ পাঠকের কাছেই দুরধিগম্য ।
ছন্দ
সম্পর্কে আমার জ্ঞান সীমাবদ্ধ । অভিজিতের ‘উড়াল’
ধরতে তাই কিছু যে শ্রম হয়নি তা নয় । তবু
কি পেরেছি ?
কখনো মনে হয়েছে
ছন্দের মহিমা রাখতে গিয়ে কবিকে ত্যাগ করতে হয়েছে প্রকৃত ‘দেখা’, যা
উঠে এসেছিল হৃদয়ের গহন থেকে, গহীন
থেকে । অবশ্যই হৃদয়ের কথাই শেষ কথা নয় আজকের কবিতায়, এটা আমরা সকলেই দেখতে পাচ্ছি, শুনতে পাচ্ছি । আবার, আমরা
তো বাংলা সিনেমার / সিরিয়েলের দর্শকের মতই, চোখের জল ছাড়া বাকিটুকু কমই বুঝি !
এই কবি শব্দপ্রধান, শব্দের গুরুত্ব তার কাছে খুব বেশি, যা সচরাচর এই সময়ের কবিদের মধ্যে কম দেখা যায় । শব্দ বলতে ‘ওয়ার্ড’ আর ‘সাউন্ড’
দু’টোই । আমরা ক্রমশ এর প্রমাণ পাবো পড়তে পড়তে ।
‘জন্ম মুহূর্তের মত ডাকে পাখি
এত তার কথা
প্রতীক, উপমা
এমন বিকেল কবে দেখেছি যে,
জন্মের আগের ঘ্রাণ, আকাশ তেমনি লাল
বিস্মৃতির—... ... (অভিশাপ)
এটাকে হয়ত চরণান্তিক মিলবিহীন মুক্তক বা
গদ্যকবিতা বলা যায় । অক্ষরবৃত্তের দু-মাত্রার চাল, যা সচরাচর লেখা হয়ে থাকে এই সময়ে ।
কবি
অভিজিতের দার্শনিক ভাবনা ও তার তত্ত্ব, কবিতায়
কখনো যেন প্রকটভাবেই চলে আসে । দেখা আর না-দেখার প্রকাশ্য দোলাচল কবিতাকে একটা আর্তিতে
উপনীত করে ফেলে । আমাদের আকুল করে তোলে, কিন্তু
মনে হয় কবিতার বহিরঙ্গের সাযুজ্য যেন কিছুটা বিঘ্নিতই হল । কথাটা হয়তো কবিতার
পক্ষে বেশি বড় হয়ে গেল, তবু
আমার মনে হয়েছে এমন । নিচের উদ্ধৃতাংশে প্রথম দু’লাইনের পর ‘ভালোবাসার
ভেতর’ বলতেই যেন দোলাচলের
সন্ধি-ভাষাটি বিঘ্নিত হয়ে গেল । কাব্যের যে মহলটি গড়ে উঠেছিল, মুহূর্তে ধূলিসাৎ হয়ে গেল বলে মনে হল
আমার । কারণ ‘ভেতরে কেন অনুরণন’
শব্দবন্ধই ভালোবাসাকে কোয়ালিফাই করছে ।
‘কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, কোথায় দাঁড়িয়ে
হে মিত্রপক্ষের চাঁদ, বলো কেন এত অন্ধকার
ভালোবাসার ভেতর...
বাইরে হাওয়া কাঁপে যদি
ভেতরে কেন অনুরণন’ (অবস্থান)
কবি এখানে ‘হাওয়া’ শব্দটি
তিন মাত্রা হিসেবে ধরেছেন । আমার জ্ঞানমতে ‘হাওয়া’ সব
ছন্দেই দুই মাত্রা বহন করে আমাদের কানের জন্য ।
কবি মূলত রোমান্টিক বলে মনে হয়েছে, যদিও সার্রিয়ালিজমকে এড়ানোর প্রচেষ্টা
অনুভব করি, কিন্তু, এই সময়েও, তার জন্য হয়ত আরও তীব্র সাহস বা দুঃসাহস খুব জরুরী হবার দাবী
রাখে । কারণ এই অধিবাস্তববাদ বা পরাবাস্তববাদ কবিতার ভেতর সুদীর্ঘকাল ধরে এমন
জাঁকিয়ে বসেছে যে, অনেকের ধারণাতে এটাই
কবিতার রূপ বলে বিশ্বাস হয়ে গেছে । তাই ঠিক এই জায়গাতে কাজ করতে হলে, নিজেকে তছনছ করা ছাড়া সম্ভব নয় হয়ত ।
রাজনৈতিক
চেতনার নির্যাস খুব সুন্দরভাবেই কাজ করে তার পঙক্তিগুলোতে—
‘...পুলিশি টহল আর নাগরিক শূন্যতায়
মিছিলের অগ্রভাগ পুড়ে যায়
ল্যাজ পুড়ে যায়
আগুনের আঁচে দেখো
আমার স্বদেশ পুড়ে যায়’ ( প্রশাসন)
অভিজিৎ চক্রবর্তী এই সময়ের একজন পরিণত কবি
।
অক্ষরবৃত্তের চাল ছাড়াও অন্য চালের ছন্দে তার
লেখা এই গ্রন্থটিতে রয়েছে । এমন নজির ইদানীং খুব কমই চোখে পড়ে বা পড়েইনি বলতে পারি
। আমরা যদি পিছিয়ে যাই সাতের দশকে, কবি
শ্রী স্বপন সেনগুপ্ত সম্পাদিত সেই বিখ্যাত কাব্য-সংকলন ‘দ্বাদশ অশ্বারোহী’তেও
মাত্র কয়েকজনের লেখাতে ছন্দের খোঁজ পাওয়া যায় । স্বয়ং সম্পাদকও ছন্দে কোন প্রয়াস
নেননি । তার মানে এই নয় যে তাঁরা ছন্দ জানতেন না । ট্রেণ্ড অনুযায়ী হয়ত ছন্দকে
ইচ্ছাকৃতভাবেই বর্জন করেছিলেন অনেকে ।
‘...ছন্দ মানে না বলেই
ফাল্গুনে নাচে বরষা
একা মেঘ থাকে একা
পাথরেরও আছে ভাষা’... ... (ভাস্কর)
অভিজিতের
আরও কবিতা পড়া যাক—
‘ঘুমের ভেতরে নেমে যায় জল
শুধু জল, মায়ার সন্তান সব—
মীনের সন্তান—
স্বপ্নের ভিতর জ্যোৎস্নাগন্ধী ফল
মীনের সন্তান যাবে মলিনতা ধুয়ে
আমিও খুলেই ফেলি পুরোনো বল্কল’ ... ...
(ঋতু)
পুরো কবিতাটিই পড়লাম । শুধু ছবি নয়, ছবির ভেতরে কথাও আছে । তত্ত্বও রয়েছে
সম্ভবত, যা আমার জানা নেই ।
কবির চিত্রকল্প, কল্পচিত্র, বা
দৃশ্যকল্প, যা-ই আঁকেন, তাতে প্রায়শই থেকে যায় কিছু না কিছু
তত্ত্ব । বিষয়-ভাবনার কথা যদি ভাবি, তাহলে
দেখব হয়ত, কবি মিলনকান্তি
দত্তের ভাবনার সমান্তরাল একটি গভীরসন্ধানী আগ্রহ ফুটে উঠছে । এটা গভীর মননেরই ফসল
বলতে পারি । কবি মিলনকান্তি যা-ই লেখেন, তাকে
বিনির্মিত করেই একটা ঝটকা রেখে যান পাঠকের জন্য । আবার কবি সমর চক্রবর্তী তার
তত্ত্বানুসন্ধানে নির্মাণ করেন সমান্তরাল এমন এক চিত্ররূপ যা ভীষণভাবে এই সময়ের ।
আর অভিজিৎ যেন চিহ্নিতকরণেই সীমাবদ্ধ রাখেন নিজেকে । এগুলো একান্তই আমার মনে হওয়া মাত্র, কোন সিদ্ধান্ত নয় অবশ্যই ।
‘কোনটা বাহির
যেখানেই যাও ভেতরই সব
চাঁদ আসে স্থির—
তুমিও জলের কথা ভাবো
নেমে যাও তলে
হাত ধোও, আর
হাত চুপ হয়ে আসে
রহস্য বেড়ে ওঠে’... (রহস্য)
আরেকটি
সুন্দর রচনা—
‘এই বুঝি তোর ঘুম । বয়ে যাওয়া স্রোতের
ধারা
ঘুমের বাইরে আমি সদাজাগ্রত বগুলা
নদীচরে মাছ খুঁজি । পাই না । পাই যা
মাছের কঙ্কাল
বাইরে থেকেই তোর প্রবাহ— ভেতরে খেয়ে যায় মহাকাল’ ...
... (ভ্রমবশত)
এখানে ‘মহাকাল’ শব্দটি
আমার কাব্যচেতনায় অসুবিধে ঘটিয়েছে সামান্য, এই কারণে যে, কবিতার
সমস্ত ঘোর ভেঙে দিয়েছে এই শব্দটি, ফলে
যে কাব্যরূপটি গড়ে উঠেছিল, তা
ভেঙে গেল মুহূর্তে । মনে হয়েছে নিয়তিবাদের স্বীকৃতিস্বরূপ এই শব্দটি উচ্চারণ না
করে অন্য কোন চিহ্নায়ক বসালে কবিতাটি হয়ত আরও গভীর-সঞ্চারী হত ।
ঠিক
পরের রচনায় কবি বলছেন—
‘আর কত নেমে যাব
কতটুকু নেমে গেলে বলা যাবে শেষ—‘...
( নেমে যেতে যেতে)
এটা বব ডিলানের ফর্মা । এই ফর্মায় আজকাল
অনেকেই লিখে চলেছেন । জেনে বা না-জেনে । এটা ত্রুটি নয়, এমন হয়েই থাকে । আমরা না-জেনে আরও বহু কিছু হুবহু করে ফেলি ।
অজ্ঞাতসারেই । কিন্তু সেই মহাকালের আলোচনায় এই আর্তি মূল্য না-ও পেতে পারে ।
কবির ‘লক্ষ্যভেদ’ রচনাটি
মাত্রাবৃত্তে এগিয়েছে কখনো ৬/৪ বা ৬ বা ৬/২ চালে । এখানেও সেই চিরকালীন দর্শন উঠে
এসেছে, যা বার বার কবিকে ক্লান্ত
আর বিষণ্ণ করে তুলছে । সুন্দর তার বয়ান—
‘কেউ না আমি, কিছু নই
তোমার পায়ের পাতার তলার ঘাস...
রঙের বিষাদ...
প্রেমিকা নদীর টান
ধনুকের ছিলা
এরপরে টুপ্
ঝরে পড়া কুয়াসায়
একাকী পাতার’
গ্রন্থটির দ্বিতীয় সোপান ‘জঙ্গল অনন্তপথ’ । বলা বাহুল্য এখানেও কবি যে সময়কে ধরার প্রয়াস নেবেন, তা এই নামকরণেই বিধৃত । এই খণ্ডে কবি
ছন্দের ওপর অধিক মনোযোগ রেখেছেন বলেই মনে হল ।
আমাদের এই অঞ্চলে ছন্দ নিয়ে যারা অধিক কাজ
করেছেন, আমার জানামতো তাঁরা হলেন
প্রয়াত শক্তিপদ ব্রহ্মচারী আর শ্রী ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহ ।
যাঁর কবিতা শতকরা একশ’ ভাগ বিধিবদ্ধ ছন্দের, তিনি শ্রী শঙ্খ ঘোষ । প্রণম্য ব্যক্তি ।
দাঁড়ি কমা সেমিকোলনও তাঁর কবিতায় কথা বলে । কবিতার প্রাণের চেয়ে ছন্দের গুরুত্ব
তাঁর কাছে অধিক, এটা আমরা সেই সাতের
দশক থেকেই জেনে এসেছি এবং আলোচনাও করেছি নিজেদের মধ্যে । কিন্তু শক্তিপদ
ব্রহ্মচারী এক অন্য কবি-সত্তা ! নির্ভুল ছন্দ তো রয়েছেই, কিন্তু তাকে ছাপিয়ে কবিতাই পাঠককে জাগিয়ে তোলে পাঠমাত্র !
তাই, আমরা কবিতার আলোচনাকালে সাধারণত বলেই থাকি যে, ছন্দের একেবার চরম উৎকর্ষে যদি কেউ
পৌঁছেও যান, তিনি বড়জোর একজন শঙ্খ
ঘোষ হয়েই যাবেন হয়ত, কিন্তু একজন শক্তিপদ
ব্রহ্মচারী ? নৈব চ ! আমাদের এই
বলা, শ্রী শঙ্খ ঘোষের প্রতি আমাদের সম্ভ্রম
আর ভালবাসা রেখেই বলা, বলাই বাহুল্য । জীবনানন্দকে রেখে দিলাম
আমার এই আলোচনার বাইরে ।
এ কথা উচ্চারণের তাৎপর্য এটাই যে, ‘ছন্দোবন্ধ কবিতা’-র
যাত্রা দু-রকম উৎকর্ষের দিকে দু-টি পথরেখা হয়ত-বা অতিক্রম করে । ছন্দের যাত্রা শেষ
করে কবিতায় আর ফিরতে পারেন না অনেকেই । এ আমার একান্ত ব্যক্তিগত অনুভব-সঞ্জাত
ধারণা ।
আমরা এবার ফিরে যাই কবি অভিজিৎ চক্রবর্তীর
কাছে ।
এই
খণ্ডে প্রথম কবিতা—
‘নিজের বলতে লেখার ইচ্ছা রাত্রিদিন
নিজের বলতে ছেলের মুখের চারপাশে
হাততালি নাচ, ঘুরে ঘুরে
গানের সঙ্গে হাসতে হাসতে গড়িয়ে যাওয়া...
ভাষার গভীর ডুবের ভেতর একটি গাছের
জেগে ওঠা— যার
দুইপাশে দুই পথের যাওয়া নিরুদ্দেশে
নিজের বলতে দুইদিকে দুই পথের শুরু
দুই দিকে দুই শেষের উড়াল অন্তহীন’ (অতি
ব্যক্তিগত)
বস্তুত, এ লেখাটি কবির দ্বিতীয় অভিযানের নান্দীমুখ বলা যায় । অন্তিম
চরণে কবি বলেই দেন—
‘নিজের বলতে দুইদিকে দুই পথের শুরু
দুই দিকে দুই শেষের উড়াল অন্তহীন’
বস্তুত সকল কবিরই, অন্তত আমাদের দেশে, ‘কবি’
বলে কোন ভিন্ন স্বীকৃতি নেই, উপার্জনও নেই । পরিবারে তিনি চিরকালই এক
গতানুগতিক পথিক, যার লক্ষ্য রুটি
কাপড়া আর মকান অর্জন !
মুখে যতই বলিরেখা পড়ুক, পকেটে যতই পড়ুক টান, তার গোপন শব্দ-অভিযান অব্যাহত রাখতেই হয়,
বাকি সকল পারিবারিক ও সামাজিক অভিযানের
তলে তলে । সবই নিজের, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-মাতা-পিতা-কবিতা,
সবার বাসস্থান একই তাঁবুর অন্তরে,
একই বুকের ভেতর !
আসি কবিতার কথায় ফিরে । এই রচনাটি স্বরবৃত্তে,
নাকি মাত্রাবৃত্তে ? আসলে দুটোতেই মেলানো যায় । কিন্তু এর
চলন স্বরবৃত্তের আদলে । মাত্রাবৃত্তকে অক্ষরবৃত্তেরই আরেক রূপ কেউ কেউ বলেন অংকের
হিসেবে । কিন্তু দোলন অনুযায়ী দেখা যায় এর আত্মীয়তা বেশি স্বরবৃত্তের সঙ্গে ।
শ্বাসাঘাতের কারণেই এমন হয় হয়ত।
তার পরবর্তী রচনাদুটি ৮/৬ মাত্রার
অক্ষরবৃত্তের চলনের উদাহরণ হিসেবে খুবই সুন্দর । একটিতে অন্ত্যমিল নেই, একটি ১-৩ ও ২-৪ পঙক্তির পর্যায়ক্রমিক
অন্ত্যমিল নিয়ে এগিয়ে গেছে । কবি যে ছন্দের একজন দক্ষ কারিগর এতে বিন্দুমাত্র
সন্দেহ নেই । ছন্দ ব্যবহার করতে হলে যেহেতু শব্দকে খুব ভালোভাবে চিনে নিতে হয়,
এ কবির শব্দগত ধারণাও তাই অত্যন্ত গভীর
।
তবু একটা কথা বলার ইচ্ছে জাগে এই যে,
শব্দ মূলত আমাদের কিছু ধারণার প্রতীক,
যা মোটেই চিরাচরিত নয়, কোথাও ক্ষয় পাচ্ছে এর ধারণশক্তি,
কোথাও বেড়েও যাচ্ছে ।
উপরন্তু, এই সময়ে শব্দকে আর প্রতীকও বলতে নারাজ ভাষাবিদরা, শুধু ‘চিহ্ন’ যা
স্বাধীন, বস্তুর সঙ্গে এর কোন
যোগাযোগ পূর্বনির্ধারিত নয়, প্রয়োজনে
একটা সম্পর্ক রচনা করা হয়েছে মাত্র ! আমি বললাম বটে, তবে এত গভীর তত্ত্ব সঠিকভাবে আত্মস্থ করা একটু কঠিন তো বটেই ।
তাই আমার এই বলাটাও কিঞ্চিত দায়হীন ।
কবির এই ছন্দ-দক্ষতার সঙ্গে শব্দ-ব্যবহারের
নতুনত্ব বা বৈচিত্র্য তেমন লক্ষণীয়ভাবে আছে বলে মনে হয়নি । ছন্দ-কৌশলই তার
চিন্তনের সিংহভাগ দখলে রেখেছে বলে ধারণা হয় । তবু আমার বিস্ময় জাগে, ছন্দের এই অনটনের দিনে কবি আমাদের সামনে
খুলে দিলেন এক সুজলা সুফলা শস্যভরা দিগন্ত ।
মাত্রবৃত্তের তীব্র মোচড় নিয়ে এগিয়ে গেছে
তাঁর ‘বিজ্ঞাপন’ কবিতাটি— কোথাও ৭/৪ কোথাও ৭/৩
পর্বানুযায়ী পর্যায়ক্রমিক অন্ত্যমিলসহ এই রচনাটিতে তার ছন্দ-নিরীক্ষা সহজেই মন
কেড়ে নেয়—
‘আবার ভিড়েভাড়ে জ্বলে উঠি
শিরিষে ঘষে ঘষে চমকাই
বাইরে ফলাটুকু ঝলসায়
কথার ডানা খোলা রোশনাই... (বিজ্ঞাপন)
ছন্দের ভাঙন যদি কমপক্ষে পর পর দুবার একরকম
না হয়, তাহলে একথা স্পষ্ট হয়
না যে কবি এখানে আসলে ইচ্ছে করেই এমন একটা নিরীক্ষা করেছেন । ভুল অনিচ্ছাকৃত হয়,
আর যে ব্যতিক্রম বা ত্রুটি ইচ্ছাকৃত
রচিত, তাকেই নিরীক্ষা বলা
হয় সাধারণত । এই দুরকমের ব্যাপারই এই কবির রচনায় চোখে পড়ে । তবে আমার চোখ যে
কতখানি অভ্রান্ত, সেখানেও প্রশ্ন রইলো
!
‘উত্থিতই সারাদিন রাতে নেমে আসে
গলির সকল ভাঁজে প্রেত নামে চাষে
অন্ধেরও কলম আছে অন্ধকার খোঁজে—
ভোজালি শানাতে চায় সুযোগে ও বুঝে... ...
উত্থিতই সারাদিন রাত হলে ঝরে
সারাটা আকাশ নামে অগ্নিসাক্ষী করে (বিবাহ)
নিঃসন্দেহে এটি একটি
পয়ার, ৮/৬ মাত্রার পর্ব আর
অন্ত্যমিলে গাঁথা ।
খুবই
সুন্দর আর নতুন এক উদাসীনতার প্রেক্ষিত জাগানো, অভিমানী ও প্রতিবাদী, ৬/৬,
৬/৬/২/৬, বা ৬/৪ ইত্যাদি মাত্রার পর্বের এই বৈচিত্র্যময় রচনাটি—
‘লিখি মেঘ স্মৃতি থেকে নেমে আসা
দেশ নেই তার একার ভাসান
লিখি রাত আততায়ী চাঁদে ভাসা—পেরিয়ে শ্মশান
মড়া ডাল তাকে ঘুরে ঘুরে নাচা
লিখি শিখা তার উদ্বাহু ডানা
বেঁচে থাকা বিদ্যুৎ ছুঁয়ে বাঁচা—সমান সমান
পাখিরা জেনেছে মেঘ নয় অভিশাপ
পাখিরা জেনেছে হাহাকার
নীচে তুমি দূরে ধেয়ে আসা সাপ—ছোবলে রঙের ছল
দিন বারুদের, দিন লেলিহান
অচেনার পরে অচেনার নদী
লিখি ঢেউ আর জেগে জেগে ওঠা গান—নিরবধি বিষফল
তবু ঘ্রাণে বাঁচে দেহ, নামে জলে
তবু নামে সব শ্রম শুধু গলে
জেনো একা মানুষের আছে এক দেশ
জেনো সব একা ভেতরে, বাইরে নেই রেশ
সবকিছু মোছে, মোছে না সে চাবুকের দাগ
মেঘের দরোজা খুলে ঝাঁপ দেয় ডোরাকাটা বাঘ’ ... ...
(যদি লিখি)
এমনি আরও সব কবিতা রয়েছে, যেগুলো পাঠককে আরও গভীরতার দিকে টেনে
নিয়ে যায় । তবু, এই সময়ের যে গতি,
যে আত্মবিস্ফোরণ, তা থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়েই তাঁর রচনাগুলো যেন সময়ের
পর্যবেক্ষকের দিনিলিপি ।
আরও
একটি কবিতার মুখ—
‘এখন রোদ । খাঁচার দিন । হাহাকার
পুরোনো ভ্রম । বাধ্য গলি । ভাসমান
স্মৃতির রঙে । নিমেষলীন । তোর মুখ
যাবার শেষ । ফেরত নেই । অন্ধতা...
ওড়ার দিন । ওড়ার রাত । চোখে থাক
ডানার ঘায়ে । বাতাস ভারী । বারুদের ...(কোলাজ)
৫/৫/৪
মাত্রার পর্বের মাত্রাবৃত্ত ।
এবার
একটি মহাপয়ার ।
‘ফের কুণ্ডে ফিরে আসা ভস্ম মেখে পড়ে থাকা
দিন
কুয়োর গভীরে একা নামা ঘুরে ঘুরে পরাধীন
পতনের জ্বালা আছে সুখেরও অসুখের ভয়
সব ঘুম রৌদ্রে ওড়ে সব মৃত্যু সীমানা
পেরোয়... (পাল্টা হাওয়া)
কবির গভীর দর্শন ইশারা দিয়ে যায় তাঁর
প্রতিটি কথায় । গোটা রচনাটিই ৮/১০ মাত্রার পর্বে অর্থাৎ প্রচলিত মহাপয়ারের চালে
রচিত । তবে দুটি জায়গায় আমার একটু খটকা রয়ে গেছে । রচনাটির তৃতীয় পঙক্তিতে ১৮
মাত্রা না-হয়ে ১৭ মাত্রা, এবং
এবং ৯ম পঙক্তিতে ১৬ মাত্রা হয়ে রয়েছে । সম্ভবত, ৩য় পঙক্তিতে ‘সুখেরও’
শব্দটি কবি ৪ মাত্রা ধরেছেন । ‘সুখেরও’ আমরা পড়ি ‘সুখেরো’,
অর্থাৎ ৩ মাত্রা । তেমনি ৯ম পঙক্তিতে ‘বললে’ ২ মাত্রা এবং ‘আকাশও’
৩ মাত্রা হবার কথা । ছন্দ-দক্ষ এই কবি
ইচ্ছে করলেই এই অসুবিধে দূর করতে পারতেন ।
পরবর্তী রচনা ‘দিদিমা’, যা
৮/৬ মাত্রার পর্ব বিন্যাসে একটি পয়ার বলেই ধরে নিয়েছি—
‘সবই এখন ঘাস সব যেন মোহ
একাকী আছেন শুয়ে বৃদ্ধ মাতামহ
এই তো সেদিন যেন মালা জপা ভোর
রসকলি চাঁদ ছিল মাথার উপর... ...
দিদিমার দুঃখ জমে অলস প্রহরে
শুধু নেই আর সেই মায়ামাখা স্বর...
... (দিদিমা)
এক বৃদ্ধার সময় না-কাটা অসহ দিনগুলি খুবই
সুন্দর আর তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছে, কবির
সূক্ষ্ম তুলির আঁচড়ে।এই রচনাটিতেও মাত্রা নিয়ে কিছু অসুবিধে ঘটেছে আমার, যদিও সেটা একটি ভালো রচনার পক্ষে তেমন
কিছু মারাত্মক ব্যাপার নয় ।
যে শব্দগুলো আমার সমস্যা করেছে, সেগুলো হলো— সবই / তেলমাখা / রঙচটা / ঘুটঘুটে / পাটভাঙা / বাঁশবন / হাওয়া,
ইত্যাদি । এগুলোর সবই যত মাত্রা ধরা
হয়েছে, তার চেয়ে ১ মাত্রা
করে কম হবার কথা, যদি অক্ষরবৃত্তের
চলনে পয়ার হয়ে থাকে । আমারও ভ্রান্তি হতে পারে, কারণ আমি ছন্দ-পারঙ্গম নই, একথা আগেই বলেছি । আরও একটা কথা, আমার কাছে ছন্দের চেয়ে কাব্যটুকুই বেশি আগ্রহের । ছন্দও,
আমার বিচারে একপ্রকার অলংকার মাত্র,
যার ওপর নির্ভর আর করে না এই সময়ে
কাব্যচেতনা ।
স্বরবৃত্তে রয়েছে এই কবির অধিকাংশ কবিতা এই
গ্রন্থে । আমি আর উদাহরণ বাড়াচ্ছি না ।
এই সময়ে ত্রিপুরায় বসে যারা বাংলা কবিতার
চর্চা করে চলেছেন, আমার ব্যক্তিগত
অনুসন্ধানে টের পেয়েছি এর অধিকাংশই ছন্দোবন্ধ রচনায় আগ্রহী নন । এই অনাগ্রহের কারণ
সঠিক বলা সম্ভব না হলেও, ছন্দভীতি
যে একটা কারণ, এতে কোন সন্দেহ নেই ।
এই পরিপ্রেক্ষিতে কবি অভিজিৎ চক্রবর্তী, তাঁর
সতীর্থদের কাছে এবং এই সময়ের কাছে, অবশ্যই
বিশেষ ব্যতিক্রম । ছন্দ জানা এক ব্যাপার আর তা ব্যবহার করা বা না-করা আরেক ব্যাপার
। তবে কোনটাই অতি আবশ্যক যে নয়, তা
প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছে সময় । তবু কবিকে তো আমরা আইডেন্টিফাই করব কোথাও না কোথাও !
আর সেটাই একজন কবির সার্থকতা, যা
কখনোই কেবল তার ছন্দচাতুর্য, বা
আঙ্গিক বা বিষয় বা বিষয়হীনতা-নির্ভর নয়, অন্য
কোথাও, অন্য কোন সূত্রে,
যা প্রকৃতই ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞানির্ভর নয়
।
আর সেই আলোতে যদি এই কবিকে খুঁজি, তাহলে হয়ত দেখব যে এই কবি তাঁর সময়কে
বার বার ধরতে চাইছেন, অন্য এক দৃষ্টিতে যা
মুহূর্তের, পলকের । কিন্তু
অনেকক্ষেত্রেই তিনি এর ভেতরেও একটা তত্ত্বকেও আঁকড়ে ধরতে চাইছেন যেন, একটা সিদ্ধান্তেও যেতে চাইছেন যেন,
যা তাঁর কাব্যচেতনার চেয়ে দর্শনচেতনার
দিকেই অধিক আনত ।
এখানেও, কবিতায় এই দুটি ব্যাপারে কোন সংঘাত থাকার কথা অনেকেই অস্বীকার
করবেন । বরং প্রশ্ন তুলবেন । এর উত্তর নেই আমার কাছে । কারো কাছে নেই । কারণ কবিতা
ডিফাইন করাই এক মূর্খতা, আজও
আমার তাই মনে হয় ।
‘...নিয়মিত
ফুলের রঙ মিশে যাচ্ছে আলোয়, রোদের
রঙ এসে মিশছে ফুলে । আর তুমি ভ্রম, তুমি
রঙকানা— ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছো’ (কারুকাজ)
‘...সূর্যাস্ত । মলিন তবু নয় । যারা নেমে
পড়ে
তাদের কাছেই শোভা । তাদের কাছেই জয়
বাকি তো রাতের ও দিনের ফাঁকে ফুটে ওঠা
পরাজয়’ (ডুব)
কবি
সময়কে ধরেন—
‘আসলে তো সব পথে মৃত্যুমুখিনতা
আসলে রাতের পরে সীমানা ফেরার
যে কথা বলবে তাকে বন্দী করে রাখা
তুমি আমি লাশ সব লাশের ভাতার
শবদেহ হেঁটে যায় কথা বলে, গায়
ধিকিধিকি অন্ধকারে পাঁজরের জ্বলা
পেটেপিঠে দু’দিকেই পেরেকের পোঁতা
কাঁচাঘুমে শুরু হয় মৃত্যুর কাফেলা’...
... (তন্ত্রকথা-২)
আরও
পড়া যাক— ৬/৬ মাত্রার পর্বে
সুন্দর একটি কবিতা, কখনো ৫ মাত্রায় হঠাৎ
থামা—
‘বদলে যাচ্ছ, যাও
লাঙলের ফলা যদিও চেনেনি মালিক
গোধূলির আলো নিভে জল হিম
সোজা পথ ফেঁড়ে ঢুকে গেছে ছোরা
তার কী হবে... ...
বদলে যাচ্ছ, যাও
কেননা রঙের স্থায়িত্ব নেই কোনও
তাজমহলও তো পাল্টায় ক্ষণে ক্ষণে
কিন্তু তুমি যে হাড় দিয়েছিলে
দধীচির মত বজ্র বানাতে
তার কী হবে’ (যাচ্ছ,
যাও)
আর
একটি সুন্দর মহাপয়ারের (৮+১০) ক’টি
পঙক্তি এমন—
‘ধুলো ওড়ে পায়ে পায়ে আকাশে আকাশে ওড়ে
ধুলো
তুমি ভাবো পাখি, ভাবো মহাকাল ঠোঁট দু’টো
ছুঁলো
এই ধুলো গান হয়ে ছিল বাউলের কালো চোখে
ধুলোর অধিক গান ডেকে ডেকে ওঠে, পথ রোখে... ...
সব ধুলো মন জানে সব মনে আকাশের ঠাঁই
গানের পরের নদী বাজে আজ দোতারা ছাড়াই...
... (ফিরেছি আবার)
কবি অভিজিৎ চক্রবর্তীর জীবনের আর মননের
টানাপোড়েন টের পাই, কথাও হয় । তবু একজন
কবির যন্ত্রণা, কবিতা ব্যতিরেক,
কখনোই চিকিৎসাযোগ্য নয় । এ যন্ত্রণা যার
যার তার তার । আমি তার সার্বিক সাফল্য কামনা করি ।
অনেক কথা হল । আর বাড়াচ্ছি না । কবির
পরবর্তী গ্রন্থের জন্য আগ্রহ রইলো ।
তাঁর এই গ্রন্থটির মলাট করে দিয়েছেন কবি অশোক
দেব । ‘সাতদিন’ ধর্মনগর
থেকে প্রকাশ করেছেন দীপঙ্কর গুপ্ত । মূল্য ১০০ টাকা ।
*** সেলিম মুস্তাফা /
২৬.১১.২০১৮
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন