।। সেলিম মুস্তাফা ।।
কবি প্রয়াত হিমাদ্রি দেব-এর কিছু কবিতা
আমি ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম বিগত ০৭.০৬.২০১৮ থেকে ১৮.০৭.২০১৮ পর্যন্ত, আমার একান্ত ব্যক্তিগত কিছু কথামালাসহ ।
আজ সেগুলোই এখানে বৃহত্তর পাঠকসমাজের কাছে রাখলাম ।এ পর্যন্ত আমি বেশ কিছু কবিতা
পড়েছি বিখ্যাত কবিদের । এর মধ্যে কেউ কেউ জীবিত নেই আর । যাদের কবিতা পড়েছি,
তাঁরা হলেন প্রয়াত ফাল্গুনী রায়,
প্রয়াত শৈলেশ্বর ঘোষ, প্রয়াত অরুণেশ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী । এছাড়া ত্রিপুরা পর্ব
থেকে পড়েছি প্রয়াত তপন দেবনাথ, প্রয়াত
জাফর সাদেক, মানস পাল, রামেশ্বর ভট্টাচার্য এবং দীপক
চক্রবর্তীর কবিতা । দীপক চক্রবর্তী মূলত ত্রিপুরার ধর্মনগরের বাসিন্দা, ইদানীং শিলচরে বাস করছেন ।
আজ পড়ব প্রয়াত কবি হিমাদ্রি দেব-এর কিছু
কবিতা আমার ভালোলাগা থেকে।
...বিদায় আমার শূন্য হাতের হাতটি নাড়া
কবি হিমাদ্রি দেব । হিমাদ্রি নন্দন দেব
। জন্ম ৩১-শে আগস্ট ১৯৫১ । মৃত্যু পয়লা এপ্রিল ২০১০ । এই মৃত্যু অত্যন্ত ছিল একটা
অঘটন । মৃত্যুর দুঃখ ছাড়াও কিছু ক্ষোভ আমাদের মনে রয়ে গেছে এখনো !
কবি পীযূষ রাউত কৈলাসহর থেকে প্রথম
সাহিত্যপত্র করেছিলেন ‘জোনাকি’
আর হিমাদ্রি দেব সেই কৈলাসহর থেকেই
করেছিলেন প্রথম মিনি বা অনু সাহিত্যপত্র ‘পরমাণু’
।
বিশেষ করে ত্রিপুরা এবং কাছাড়ে, কবি হিসেবে শক্তিপদ ব্রহ্মচারী এবং
পীযূষ রাউত-এর পর জনপ্রিয়তার নিরিখে যে-নামটি সবচেয়ে বেশি প্রচারিত সেটি হিমাদ্রি
দেব, এতে সন্দেহের কোনই অবকাশ নেই । কবি
হিমাদ্রি দেব, আমাদের ‘হিমাদ্রিদা’ । ত্রিপুরা সড়ক পরিবহন নিগম (টি.আর.টি.সি.)-তে চাকুরি জীবনের
শুরুতে হিমাদ্রিদা ছিল বাস-কন্ডাক্টর । বাসে যখন মাঝপথ থেকে যাত্রীরা উঠতেন,
তখন তারা প্রায়শই কবিকে ফাঁকি দিতেন ।
কারণ হিমাদ্রিদা তখন অন্য যাত্রীদের কবিতা শোনাতে ব্যস্ত । টিকিট কাটবে কে ?
ফলে তাঁকে বসানো হলো কৈলাসহর
টি.আর.টি.সি.-র টিকিট-কাউন্টারে । কিন্তু তাতে তাঁর বরং সুবিধে আরও একটু বেশিই হলো
। তখন তাঁর মুখে একটা কথা লেগেই থাকতো । সেটা হলো— “...যত মড়া ভাইয়্যা যায়, পদ্মারে
ছুঁইয়্যা যায়...” অর্থাৎ তাঁর সঙ্গে
দেখা না-করে কৈলাসহরে প্রবেশ-প্রস্থান অসম্ভব !! এ ছাড়াও কত অদ্ভুত সব ঘটনা । সবই
কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে । সে কথা আরেকদিন বলবো । কারণ আমরা হিমাদ্রিদাকে নিয়ে আরও
অনেক পথ হাঁটবো— পথ যে সে নিজেই এঁকে রেখে গেছে !
“...খরার গুণে গুঁড়া হইলো প্রজাপতির পাখা
যাইতে
যাইতে শেষ হয় না পথ কেবলই আঁকা...”
তাঁর মৃত্যুটা ছিল না কোন সাধারণ ঘটনা ।
ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু । এ ব্যাপারে যথাসময়ে ত্রিপুরার সংবাদপত্রগুলোতে আমরা পড়েও
নিয়েছি এবং যথারীতি ভুলেও গেছি । সংশ্লিষ্ট ডাক্তার নার্সের শাস্তি হবার কথাও
শুনেছিলাম, কিন্তু আদৌ হয়েছিল কি
না তা-ও ভুলে গেছি । তবে ঐ সময় সকল কবিসাহিত্যিক আর পাঠককুল যে ব্যাকুল হয়েছিলেন
তাতে সন্দেহ করার কোন কারণ নেই ।
সেদিন ছিল ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী
সম্মেলন-এর সাহিত্যসম্মেলন। সেদিন কবি হিমাদ্রি দেবও মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন । এর পর
কী হলো তা আমরা জেনে নিচ্ছি তাঁর
সহোদরা শ্রীমতী মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্যের জবানীতে—
“ঐদিন বুধবার ছিল। সম্মেলনে বাংলাদেশ
থেকেও কবিরা এসেছিলেন ।সন্ধ্যায় দাদা
চায়ের সঙ্গে মুড়ি খেয়ে টাউন হলে যায় । কিছুক্ষণ পর মঞ্চের মধ্যেই, বসে ছিল না দাঁড়িয়ে ছিল জানি না,
পা দুটো নাড়তে পারছিল না । অন্যদের জানাতে, কয়েকজন ওকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে
যায় ও বাড়িতে ফোন করে । ৯ তারিখ রাত ১০টার দিকে দাদা আমাকে হাসপাতাল থেকে ফোন করে
বলে ফোনটা সিধুকে (আমার স্বামী) দে, ও
ওকে বলে ‘ আমার
পা অবশ লাগছে, তুমি কালই মুক্তাকে
(আমি) নিয়ে আসো’ । ও বললো, ‘আমার ছুটি নিতে হবে হিমাদ্রিদা, আচ্ছা আমি দেখছি’ ।...’
একটু পরেই বোন মনি ফোন করে বলে ওরা নাকি দাদাকে নিয়ে আগরতলায় আসছে । মনে হয় বেলা
বারোটা বা তার আগে পরে রওয়ানা হয়েছে, তাই
পৌঁছুতে সন্ধ্যা হয়ে যায় । ওর নাকি সি.টি. স্ক্যান হবে, তাই কৈলাসহর হাসপাতাল (আর.জি.এম.) জি.বি.-তে রেফার করে । এখানে
এলে ওকে ভর্তি করে ও অক্সিজেন লাগিয়ে দেয় ।... ...আমি যখন তার কাছে গেছি, আমাকে অভিযোগ করে বলে, ‘অক্সিজেন লাগবে না, তবু দিচ্ছে, খুলে নিতে বল’ ।
অক্সিজেন যখন খুলে নিলো তখন নিজের মোবাইল থেকে মেয়ে বৈশাখীর সঙ্গে কথা বলে এবং
আমার মেয়েকে ফোন দিয়ে বলে, ‘দিদিভাইয়ের
সঙ্গে কথা বল’ । আমাকে বলে,
‘বাড়ি চলে যা, উচ্ছে আলুসেদ্ধ দিয়ে নরম করে ভাত রেঁধে সকাল সকাল নিয়ে আসিস,
আজকের রাতটাই আছি কাল ছুটি নিয়ে তোর
বাড়ি চলে যাবো । ওখান থেকে ডাক্তার দেখাবো । আমরা বাড়ি গিয়ে রান্নার বন্দোবস্ত
করছি হাসপাতালে অন্য যারা এসছে, এদের
খাবার পাঠাবো বলে । জি.বি.-র কাছেই ইন্দ্রনগরে আমার বাড়ি, অটোতে বেশি হলে তিন
মিনিট, বাড়ি পৌঁছে সেদ্ধভাত
বসিয়েছি, কুকারে সিটিও আসেনি,হাসপাতাল থেকে ফোন এলো দাদা নেই। আমরা
চলে আসার পর আমার ছোটভাই দুলালকে তেজোফোর্ট নামে এন্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন আনতে প্রেসক্রিপশন
ধরিয়ে দেয়, ভাই অষুধ নিয়ে আসতে
নার্স ওটা সেলাইনের বোতলে পুশ করে,একটু
পরেই দাদা বৌদিকে বলে, তেতো
তেতো লাগছে, মুখ কাত করে থুথু
ফেলতে ফেলতে মিনিটের মধ্যেই সব শেষ । বড় আঘাত পেয়েছি দাদা । এ কষ্ট কিছুতেই যায় না
। বড় যন্ত্রণা হয়” ।
হ্যাঁ, আমাদেরও বড় যন্ত্রণা হয় । আজও হয় । আগামীতেও হবে, হতেই থাকবে।তাঁর লেখা কবিতা যত পড়ব,
ততোই সামনে এসে দাঁড়াবে তাঁর বন্ধ
ঠোঁটের প্রশ্রয়মাখা হাসিমুখ । কবিতার ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে রয়েছে তীব্র কটাক্ষের
পেছনেও এমন একখানা হাসিমুখ, যা
ঈশ্বরেরই এক চিলতে হাসি যেন ।
সকলের সঙ্গে তাঁর বিরোধ, সকলের সঙ্গে তাঁর টইটুম্বুর ভালবাসার সম্পর্ক, সকলের প্রতি রয়েছে তাঁর অফুরান বরাভয় ।
১.
তথ্য
হিমাদ্রি দেব
ঈশ্বর নেই, তবু যদি ঈশ্বর মানো, তবে মার্কিনীদের মানতে
এতে কোনো পাপ ছিল না
যদি ঈশ্বর নেই জানতে
ঈশ্বর মানে নিরাকার
কিছু
নীরবে প্রণাম করো
তারপর দ্যাখো তুমি
ছাড়া নমাজ রোজা নেই কারো ।
এতো সময় নেই পাখিদের,
পাপড়ি ও বৃক্ষশাখার
নিজের খেয়ে ঈশ্বর বলে—
বনের মোষ চরাবার ।
ওরা ভাবে আকাশকে
আত্মা ভাবলে অবশ্যই তুমি স্বাধীন
এখন তুমি হে
নানা ভুলেভালে হয়ে আছ
পরাধীন ।
০৮.০৭.২০১৮
হিমাদ্রি দেবের মাত্র একটিই কাব্যগ্রন্থ
। ‘বৃষ্টিজল’ । এটা প্রকাশ করেছেন ‘স্রোত’ প্রকাশনা । এছাড়া
তাঁকে নিয়ে ‘স্রোত’ সাহিত্যপত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যাও
রয়েছে, যাতে কবির আরও কিছু
লেখা এবং তাঁকে নিয়ে অন্যদের স্মৃতিচারণ রয়েছে । রয়েছে সাদাকালোয় কিছু পারিবারিক
ছবি । কিন্তু এসব কিছুর পরেও মনে হচ্ছে কোথাও কিছু একটা অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে ।
তাঁর কিছু কবিতা হয়তো এখনো বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে আমাদের
চোখের আড়ালে । কারণ আমাদের স্মৃতিতে কিছু কবিতার এক দুই পঙক্তি এখনো হঠাৎ জেগে ওঠে
যেগুলো এই দুটো বইয়ে নেই বলেই মনে হচ্ছে । ‘স্রোত’-এর
কর্ণধার গোবিন্দ ধর জানালেন হিমাদ্রি দেবের
রচনা সমগ্র ইতিমধ্যে বেরিয়ে গেছে, যা
আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি আগে । সুখবর, হয়তো
সেটাতে আমরা তাঁর সমস্ত রচনা পেয়ে যাব ।
কিন্তু এসব কিছুই বিষয় নয়, বিষয় হিমাদ্রি দেব । কবি হিমাদ্রি দেব ।
কৈলাসহর থেকে তখন ধর্মনগরের
টি.আর.টি.সি.-র লাল বাস ছাড়তো বিকেল ৫টায় । আমি তখন ত্রিপুরা গ্রামীণ ব্যাঙ্কের
টিলাবাজার শাখায় বদলি হয়ে গেছি । কৈলাসহর থেকে বিকেলের এই বাস ধর্মনগরের উদ্দেশ্যে
একবার বেরিয়ে গেলে সেদিন ধর্মনগর আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যেত । আর গাড়ি পাওয়া
দুষ্কর, যাত্রীও ফাঁকা । তাই
দৌড়োতে দৌড়োতে যখন স্ট্যান্ডে পৌঁছলাম, ততক্ষণে
সব টিকিট শেষ । সীট নেই । তখন বাড়তি যাত্রী নেয়া হতো না । ভেতরে ঢুকে টিকিট-কাউন্টারে
হিমাদ্রিদার কাছে গিয়ে বললাম, আমি
বাড়ি (ধর্মনগর) যাব । সে পাত্তাই দিলো না, বলল
বসো । লেখালেখি কেমন হচ্ছে ? ইত্যাদি
ইত্যাদি নানান কথা । আমি টেনশন সহ্য করে করে হুঁ হাঁ করে যাচ্ছি । কবি বিশ্বজিৎ
(দেব) -কে একটু গালাগাল দিল । কোন এক অধ্যাপককে একটু গালাগাল দিলো । তাঁর এইসব
গালাগাল নিয়ে কেউ কিছু মনে করে না । এটা তাঁর নিত্যকাজ । তাদের প্রতি তাঁর
ভালোবাসারই নিদর্শন মাত্র । আমি এটা জানি এবং সকলেই তা জানে । এমনকি যাকে গালাগাল দিচ্ছে, সেই ব্যক্তি সামনে থাকলে সামনাসামনিই বকে দিতো,এতে কোন ভুল নেই। তারপর বলল, শোনো, একটা সম্পাদকীয় লিখেছি । এটাও তাঁর নিত্যকাজ, পত্রিকা নেই অথচ রোজই সম্পাদকীয় লেখে ।
পকেট থেকে একটা দুমড়ানো কাগজ বের করে পড়তে লাগলো । এতে সাহিত্যের লেশমাত্র নেই,
হয়তো রাজনীতি আছে, হয়তো কোন ব্যক্তিবিশেষের প্রতি আছে
তীক্ষ্ণ খোঁচা । মুখে পান, দু-কশ
বেয়ে পানের লাল রস নামছে, কিছু
ছিটকে আসছে আমার ওপর, কিন্তু তাঁর কোন
ভ্রূক্ষেপ নেই,পড়েই যাচ্ছে । এবং
আমার কানে কিছুই যাচ্ছে না । আমার তো ধর্মনগর যাবার টেনশন । গাড়িতে হর্ণ দিচ্ছে ।
হিমাদ্রিদা না-বললে ড্রাইভার গাড়ি ছাড়তে পারছে না। কিন্তু কে কার কথা শোনে ?
এমন অবস্থায় হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে সে বেরিয়ে
গেল, আমি পিছে পিছে । গাড়িতে উঁকি দিয়ে দুটো
তরুণকে হাতের ইশারায় ডেকে নামালো । দুই যাত্রী । তারা একসঙ্গে ধর্মনগর যাচ্ছে ।
হিমাদ্রিদা তাদের একজনের হাত থেকে একটা টিকিট প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে আমাকে দিলো। আর
তাকে বললো,তোমরা একজন আজকে যাও,
আরেকজন কাইল যাইবা। ওরা বিন্দুমাত্র
বিরক্ত না-হয়ে বিনা বাক্যব্যয়ে তার সিদ্ধান্ত মেনে নিলো। আমাকে বললো,যাও। তাঁর মুখে মুচকি হাসি ।
এটা আমার প্রতি তাঁর যতটুকু ভালোবাসা,
তার চেয়ে বেশি তাঁর প্রতি ঐ তরুণদের
ভালোবাসা বিশ্বাস আর অননুমেয় শ্রদ্ধা। এই হলো হিমাদ্রিদা, হিমাদ্রিনন্দন দেব,এক
হিমাদ্রির ভেতরে আরেক হিমাদ্রি, এক
দৈব পুরুষ যেন । এমন চরিত্র দেখাও ভাগ্যের কথা ।
২.
তবু তো জানি না
হিমাদ্রি দেব
পালাতে পালাতে আর যাই
কোথা, আছি তো ভালোই
অনন্ত ভাসানে যায় কত
প্রতিমার মুখ
নদীজল ফিরে আসে শুনি
। আসে কি প্রতিমা ?
সময় বিদ্যুতটানে নিভে
যায়, আকাশ দেখি না
তবু মনোময় সঙ্গোপনে
বিশাল আকাশ !
এতোটা বিস্তৃত আছি,
জাগরণে আছি এতোকাল
কাক-চিল স্বপ্নময় কতো
পাখি উড়ে যায়
তবু তো জানি না,
ভালোবাসার কোন মন্ত্রে
তাবৎ অসুখ সেরে যায় !
***
*** ***
০৯.০৭.২০১৮
“ঈশ্বর মানি না আমি, তাকে এনে বিব্রত করো না…”
হিমাদ্রি দেবকে নিয়ে আরও ঘটনা আছে ।
বস্তুত, সে এমন একটি চরিত্র,
যাকে নিয়ে পাঁচশ’ পৃষ্ঠার একটি উপন্যাস অনায়াসে হয়ে যাবে।তাঁর জীবনের প্রতিদিন
সে একটির পর একটি ঘটনা রচনা করে গেছে। এবারের ঘটনাটিও টি.আর.টি.সি. বাস নিয়েই,
যেখানে আমিও এক যাত্রী। সে ছিল
সত্যিকারেরই এক ‘দাদা’ । কিন্তু সেই ‘দাদাগিরি’ অত্যন্ত
নিভৃত । কবি সাহিত্যিকদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল একটু এক্সট্রা ধরণের ।
তখন অফিস ফেরত সব কর্মচারীরাই শনিবারের
বিকেলের বাস ধরতেন ধর্মনগরের জন্যে । এমনি এক বিকেলে টিকিট কেটে বসে রয়েছি,বাসে নয়, হিমাদ্রিদার পাশের চেয়ারে। বাসে উঠতে দেয় না। বলে, আরে বও বও,দেরি আছে । ঘড়ি দেখলাম, পাঁচটা প্রায় বাজে বাজে। আমি উসখুস্ করি । সব যাত্রী যার যার
সীটে বসে গল্পগুজব করছেন। গাড়ি ছাড়ার সময় পেরিয়ে গেল পাঁচ মিনিট।এমন হয় না। তখন
টি.আর.টি.সি. বাস মানে খুব পাংচুয়াল একটা ব্যাপার। কত গল্প বাস নিয়েই । ঘণ্টায় ৮০
কি.মি.-র কম স্পীডে চলেনা, কোথাও
দেরি করে না, ইত্যাদি ইত্যাদি ।
একটা মোটা দাগের লাল তির চিহ্নের মতো তার চরিত্র সকল যাত্রীদের মনে আঁকা । সকল
মানুষের মনেই তখন ।
ড্রাইভার গলা বের
করে চিৎকার করে বলে, কিতা অইলো, ছাড়তাম্ নি ?
দাঁড়াও, প্যাসেঞ্জার আছে একজন, হিমাদ্রিদা বলে ।
আজ দুটো কবিতা পড়ছি হিমাদ্রিদার ।
৩.
বৃষ্টিজল
হিমাদ্রি দেব
আসলে নোতুন করে পড়তে
হবে ধারাপাত
আলোক উজ্জ্বল
বর্ণমালা
দৈবপাঠশালা থেকে
মুক্ত করতে হবে ।
এইসব উৎসব নাটক থেকে
নিজেদেরে মুক্ত করা
ছাড়া, আমাদের আর পথ নেই
ছেলেরা সকলই জানে ।
তাই তারা জন্ম থেকে বোবা
সব জানে বলে, হিরণ্ময় কলস ছাড়া
সব কলসের জল উচ্ছিষ্ট
করেছে ।
***
*** ***
৪.
লঘুস্বরে-এক
হিমাদ্রি দেব
ঈশ্বর মানি না আমি,
তাকে এনে বিব্রত করো না
বরং তোমার সাথে
পদাবলী, প্রতিপদে গিরিশের পানপাত্রে আঁখি
বরং তোমাকে বলি আমার
প্রশ্বাস হও, উঠতে দাও
মানুষের ভাষায় তুমি
বলো, পাপ নেই, পুণ্য নেই
জগৎ সংসার, এই তোমার বোধের মত আলো ।
***
*** ***
১০.০৭.২০১৮
“...বানাইন্যা ঘর শূন্য হইলো নদীতে নাই জল
কোথায় যাইমু কারে কইমু মঞ্জিলা গো বল্
!”
কবি হিমাদ্রি দেবকে নিয়ে ঘটনার শেষ নেই,
যার প্রত্যেকটি এক একটি গল্পের রূপ ধারণ
করেছে । অনেক কথাও প্রচলিত রয়েছে তাঁকে নিয়ে, যা কখনো পুরো সত্য, কখনো
আধেক । সে অনর্গল কথা বলে, মুখে
পান, কশ বেয়ে নেমে আসে পানের রস, কখনো তা ছিটকে পড়ে শ্রোতার গায়ে,
ঠোঁট বন্ধ, আর দুষ্টুমিভরা মিটিমিটি হাসিটা তাঁর চোখে । কথার কোন
ধারাবাহিকতা নেই, কবেকার কথা কখন বলে
ঠিক নেই, লিঙ্ক খোঁজার চেষ্টা
বৃথা । ভিখিরি থেকে প্রধানমন্ত্রী, আলপিন
থেকে হেলিকপ্টার, সব তাঁর সিরিয়াস
বক্তব্যের অন্তর্ভুক্ত ।
টি.আর.টি.সি. বাস-কাউন্টারের ঠিক
উল্টোদিকে চায়ের দোকান, সব
আড্ডা আর অতিথি আপ্যায়ন সেখানেই ঘটে । গিয়ে বসলেই হলো । চা, বিস্কিট পান সিগারেট আসতেই থাকে, অর্ডার দিতে হয় না । দোকানির সব জানা, হিমাদ্রি দেবের সব অধ্যায় তার পড়া ! অর্ডার দেবার সময় কই ?
মুখ চলছে, কারণ তাঁর কথা সে বলবেই, আর যে অতিথি, তাকে
তা শুনতেই হবে, বুঝলেও, না-বুঝলেও । তার বক্তব্যের নব্বই ভাগই
বকাবকি, যার মধ্যে বিষ নেই,
প্রশ্রয় আর মায়া মমতায় মূলত অন্যের
গুণগানই মাখা। কোন কবি কোথায় কী লিখছেন, সব
খবর তাঁর কাছে থাকতো । তাঁর কথার গূঢ়ার্থ
কে বুঝলো আর কে বুঝলো না, তা-ও
সে ঠিকই টের পেয়ে যেতো । মারাত্মক তাঁর ঐ মিচকি হাসিটা !
একদিন ধর্মনগর থেকে গিয়ে তাঁর কাছে
বসামাত্রই, কোন আপ্যায়ন বা
ভূমিকা ছাড়াই বললো, ইতা কিতা লেখের-বা তোমরার
পীযূষ রাউতে ?
আমি বললাম,
কেনে কিতা অইছে ?
আরে ধুর,
ইতা কবিতা নি কওছাইন ?
বুঝতে পারি, আসলে আমাকে পরীক্ষা করছে সে । বলা
বাহুল্য, পীযুষ রাউতের পয়লা
নম্বর গুণগ্রাহী সে । এত বড় ভক্ত যে পীযূষদা সব সময় তাঁকে নিয়ে আতঙ্কে থাকতো ।
একদিন পীযূষদার ধর্মনগরের থানারোডের বাড়িতে হিমাদ্রিদা হাজির রাত দুটোয় । সম্ভবত
শিলচর থেকে ফিরতে দেরি হওয়াতে অধিক রাতে এই সিচুয়েশন তৈরি হয়েছে । আর শিলচর যাবার
উদ্দেশ্যই হলো শক্তিদা’র
(কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারী) সঙ্গে মোলাকাত । যাক এদিকে গেটে দুমদাম আওয়াজ । রাত
দুটোয় কে গেট খুলবে ? আর ঘর থেকে শোনা গেলে
তো খোলার প্রশ্ন ! শেষে গেটে লাথির পর লাথি পড়তে লাগলো আর মুখে গালাগাল ।হ্যাঁ
পীযূষদা শেষ পর্যন্ত উঠে এসে গেট খুলে দেন এবং
হিমাদ্রিদার রাত্রিবাস সেখানেই হয় । এ ঘটনা পীযূষদা’র মুখেই শোনা । কে বিরক্ত হলো কে খুশি হলো, এ ব্যাপারে সে কিছুই পাত্তা দিতো না ।
কারণ শেষ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গ তো সঙ্গসুধাই !!
বড় কষ্ট হয় বুকের ভিতর !
আজ হিমাদ্রিদার বহুপঠিত কবিতাটি পড়ছি ।
৫.
মঞ্জিলাগো বল্
হিমাদ্রি দেব
রাইতে আইসেন ক্যান্
চুপি চুপি আন্ধার পিঞ্জিরায়
পাতলা ঘুমের মধ্যে
জাইগা থাকি, সবই যে ঘুমায়
রিজিয়ার মায় কইতো,
মঞ্জিলাগো, এতো হাসিস্ ক্যান্ ?
কার সাথে, এতো কথা ! শব্দে করিস ধ্যান ?
একদিন সে চইল্যা গেল
হইলো দেশান্তরী
ওঝায় কয়, ধইরা নিছে আজব দেশের পরী !
মন চইল্লো আগে আগে,
বন চইল্লো পিছে
মনের এক বান্ধব ছিল,
সে উঠলো গাছে !
চাইতে চাইতে দিন গেল,
দিনরে খাইল রাইত
মগজ খাইল, মেজাজ খাইল, করল না আর বাইত ।
খরার গুণে গুঁড়া হইলো
প্রজাপতির পাখা
যাইতে যাইতে শেষ হয়
না পথ কেবলই আঁকা
বানাইন্যা ঘর শূন্য
হইলো নদীতে নাই জল
কোথায় যাইমু কারে
কইমু মঞ্জিলা গো বল্ !
***
*** ***
১১.০৭.২০১৮
মানুষের পাশে পাশে থাকতে থাকতেই হয়তো একজনের
কবিজন্ম হয়ে যায় । মানুষের পক্ষে থাকাই মানবিকতার পক্ষ । প্রকৃতিরই স্বাভাবিক
অংশীদারিত্ব । যখন সময়ের স্বাভাবিকত্বে বাধা উৎপন্ন হয়, কবির হৃদয়ে তার ছায়া আগে পড়ে, আর সে রুখে দাঁড়ায় । ক্ষমতার প্রলোভনে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কোন
মতবাদ যখন আগ্রাসী ছায়াপতন ঘটায়, সেখানেও
কবি তা আগেই টের পেয়ে যান । তবু কিছু মানুষ থাকেন, যারা কবিরই মতন সদা আন্দোলিত, সদা দুঃখী, এবং
শুভচেতনার স্ফূর্তিতে লক্ষে স্থির । আমরা এমন মানুষের দেখা যে পাইনি তা নয় । কবি
হিমাদ্রি দেবও পেয়েছিলেন এমন কিছু মানুষ তাঁর খুব কাছে, যাদের কাছে বার বার তাঁর ঋণ স্বীকার করে গেছেন ।
অলক্ষ্যে, নীরবে, আমরাও
পেয়েছি কিছু কিছু মানুষের সংগোপন স্নেহদৃষ্টি, যা আমরা হয়তো সব সময় টের পাই না, বা মূল্য দিই না, দিতে
জানি না । এই কথাগুলো আমার একান্ত ব্যক্তিগত উপলব্ধি আর বিশ্বাস ।
হিমাদ্রিদার কথা বলে শেষ করার কোন
সীমারেখা নেই । কিছুটা স্থূলদেহী এই শ্যামবরণ মানুষটি যে একজন শতকরা একশ’ ভাগ কবি, তা তাঁকে দেখলে কেউ হয়তো ভাবতেও পারতেন না, যতক্ষণ না তাঁর কোন কবিতা পড়ছেন বা
শুনছেন । কারণ তাঁর চোখের হাসিটা ছাড়া আর কোথাও কবিত্বের প্রকাশ খুঁজে পাওয়া
দুষ্কর । চোখ কি আর সবাই পড়তে পারে ! লোকটা নিয়মিত স্নান করে না। পাশে বসলে
অনতিবিশাল দেহের সৌরভে নাক জ্বালা-ও করতে পারে । আর তাঁর রুমাল হলো বালিশের ঢাকনার
মতো একটা টাওয়েল । সবই অদ্ভুত । তাঁর চিরসঙ্গী একটা বাই-সাইকেল । কিন্তু তাতে চড়া
হয়ে ওঠে না, গভীর রাতে বাড়ি ফেরার
সময় ছাড়া । সে যেখানেই যায় সঙ্গী থাকে কেউ না কেউ, আর মুখে তো আছেই অনর্গল কথা। সে হাঁটে, পাশেপাশে সাইকেলও হাঁটে । সাইকেলটা যদি কথা বলতে পারতো !
আমি তখন (১৯৮৩-র শেষভাগ) কৈলাসহর
টিলাবাজার(বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন)শাখায় বদলি হয়ে গেছি । এলাকাটা মুসলিম-প্রধান ।
একদিন একটি ছেলে এসে পরিচয় করলো । নাম জয়নাল আবেদিন । সে এসে বলো- আফনার নাম নাকি
সেলিম মুস্তাফা ?
আমি বললাম—হ্যাঁ । তারপর আমার আসল নাম বললাম ।
সে হাসে আর বলে,
আমার বিশ্বাস হয় না । সেলিম মুস্তাফাই
আসল নাম ।
তাকে বিশ্বাস করানো
গেলো না । বললাম, আফনারে কেটায় কইছে
আমার নাম ?
--হিমাদ্রিদা ।
--তাই নাকি ?
--কইছে আফনারে দেইখ্যা রাখার লাগি । কুনু
অসুবিদা অইলে আমারে কইয়েন ।
এই হলো হিমাদ্রিদা । তাঁর নির্দেশ কেউ
অবহেলা করেনি কখনো । বলা বাহুল্য, হিমাদ্রিদা
ছিল গোটা কৈলাসহরের ভালোবাসায় মাখানো এক অলিখিত ‘দাদা-চরিত্র’, যার
তুলনা আর কোন ‘দাদা’-র সঙ্গে হয় না ।
আজ তাঁর কবিতা পড়েই আমার কৃতজ্ঞতা
প্রকাশ ।
“...এই
সমুদ্র
এতোই অন্ধ, সে পড়তে পারে না মার্কসবাদ
বদলাতে পারে না দিন
।...”
৬.
চিঠি-২
হিমাদ্রি দেব
( কমরেড
বৈদ্যনাথ মজুমদার করকমলেষু )
পবিত্রতা শব্দটি নিয়ে
গর্ব করেন সাধু-সন্ত’রা
ব্যাখ্যা করেন,
পবিত্রতার মানে, এখন মানে পাল্টে গেছে
শুধু পাল্টাননি আপনি,
রাতদিন যে রক্ত-পতাকা
ওড়ে, সে-ও ফিকে হয়
সময় এভাবে কেড়ে নেয়
অস্পষ্ট করে মানে
আপনি স্পষ্টই আছেন,
আমাদের কাছে ।
আমরা একরকম
ঐক্যবদ্ধভাবে আপনার কাছে আসি
ময়দানে আমরাই জনসমুদ্র
।
অথচ
এই সমুদ্র
এতোই অন্ধ, সে পড়তে পারে না মার্কসবাদ
বদলাতে পারে না দিন ।
বদলে যায় নিজে অথবা
আমরা যারা সব বুঝি
প্রয়োজনে গান গাই,
গান শেখাই
আপনি শুধু ‘সাক্ষী’
সময় তাহলে কি ভোরের
অপেক্ষায় ।
***
*** ***
৭.
ঈশ্বরতত্ত্ব-তিন
হিমাদ্রি দেব
যাদের কোনো মাথা
গোঁজবার জায়গা নেই
জামা নেই
ভজন কেত্তন নেই,
শুধু জেগে থাকা
শুধু কাজ
হাওয়া হয়ে, অগ্নি-তত্ত্বের আলো হৃদয়ে
জড়িয়ে
কর্ম-মুখর কাল,
সারাদিন ছেলেবেলা
দিগন্তবিহীন মাঠে
হেঁটে যায় !
পথিক তোমার সাথে তার
দেখা হয়
হঠাৎ কখনো যদি দেখা
হয়ে যায় !
***
*** ***
১২.০৭.২০১৮
আত্মমগ্নতা ছাড়া কেউ নিজেকে দেখতে কি
পায় ? মনে হয় না । তবে
অন্যের চোখেও নিজেকে দেখে কেউ কেউ । সে-দেখা কখনো অতি-প্রসারিত, কখনো অতি-সংকোচিত, স্বাভাবিক তো কখনোই নয় ! তবু সে-আয়নাতেই
বিভ্রান্ত হয়ে অনেকে আত্মচ্যুত, গর্বিত,
অনেকেই অবসাদগ্রস্ত । তবে এই দেখাও
জরুরী । সব মিলিয়েই নিজেকে খোঁজা ।
হিমাদ্রি দেব এমনই এক ব্যক্তি, যিনি নিজেকে খুঁজে নিয়েছেন আত্মমগ্নতার
সঙ্গে বহির্জগতের সমালোচনা, তীব্র
টিপ্পনীর মিশেল দিয়ে । নিজেকে বার বার উদ্ধার করেছেন অজস্র সম্পাদকীয় লিখে,
যা আজ মনে হয়, কোনটা হয়তো তাঁর নিজেরই বিরুদ্ধে লেখা । হাজার কথা, হাজার কর্মতৎপরতার ফাঁকেও টের পাওয়া
যেতো তাঁর সেই মগ্নতার উঁকি মারা, টের
পাওয়া যেতো তাঁর যন্ত্রণাও । তাঁর ভাবনা তিনি ভেবে চলেছেন । তাঁর সঙ্গে
আলাপচারিতার ফাঁকে তিনি হয়তো এমনই এক কথা বলে বসলেন, যা আপনি কখনোই আশা করেননি, ভাবেননি । কেমন খাপছাড়া ! এটাই ছিল তাঁর ভেসে ওঠা ।
তাঁকে আমরা যত নমনীয় ভেবেছি, তিনি মোটেই তা ছিলেন না । নিজের পথ আর
বিশ্বাসটুকু থেকে তিনি কখনোই টলে যাননি । অকুতোভয় এক আত্মা, যে তাঁর ঘুমঘুম অবয়বের অন্তরে সদাজাগ্রত । বাইরে যত অকাজ,
না-কাজ, কথার ফুলঝুড়ি, হাসির
যাদু সাজিয়ে রেখে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতেন কবিতার ভুবনে । এই আড়ালপ্রিয়তা চট করে ধরা
পড়তো না ।
তাঁর
কবিতায় কখনো কোন এলেবেলে কথা আমরা পাই না । নরম আস্তরণের তলে সব কথা তাঁর এক একটি
শক্তিশেল যেন ।
“মাকে
নিয়ে লিখতে পারি কবিতা, প্রবন্ধ,
গল্প ।
বিশেষ আপ্লুত হলে গান
বলতে পারি মাতৃভূমি ।
কিন্তু জটিল গল্পের মতো
আমার পিতাকে নিয়ে
কখনো কবিতা লিখিনি ...
...ভুলে
যাওয়া ওই কৃষকের সাথে
আজ আমার মায়ের মুখ
মনে করি ।” (তর্পণ)
“আমার সরকার, কিছু না-দিলেও আমার সরকার...” (নেপথ্যে-২)
“আমায় কেউ বাতিল করবে, এমন সাধ্যকার !
সুধাকান্ত, অমরত্ব, তোমার এবং আমার ।”...
(ভজনগীতি-দুই)
হিমাদ্রি দেবকে নিয়ে কারো কারো এমন কিছু
বক্তব্য পড়লাম, যা শুধু বক্তার
অহমিকাকেই জাহির করে । যারা সকলের সব কবিতাকেই নিজের মতন করে চান । কবিতা কি কেবলই
পাঠকের ইচ্ছাপূরণ ?
একজন কবির সব কবিতাই কি এমন হতে হবে,
যাকে ‘সার্থক’ বলা
যায় ? এরকম প্রশ্ন উঠলে আরও
প্রশ্ন ওঠে । কবিতা আর সার্থক, এই
দুটি শব্দেরই-বা অর্থ কী ? আমার তো মনে হয়, একেবারে নবীন যে কবিতা-লেখক, যার ভাষাই এখনো তেমনভাবে নিজস্বতা নিয়ে গড়ে ওঠেনি, তার কথা বাদ দিলে, উপরের কোন প্রশ্নই কোন ‘বোদ্ধা’র প্রশ্ন নয় । কারণ সৃজনশীল তথা মৌলিক কাজে ‘সার্থক’ কথাটার কোন মাণদণ্ড নেই । থাকলে সেটা মৌলিক নয় । যারা
সার্থকতার প্রশ্ন তোলেন, তারা
পূর্বধারণায় বা পূর্বানুমানে আক্রান্ত । এরা স্থবির চেতনার শালগ্রাম শিলা ।
আর ‘কবিতা’ শব্দটা
সে-কথাতেই প্রযোজ্য, যে কথা একজন ‘কবি’ বলবেন । বাকি সব কথা
তাদের বিষয়-আশয়, যারা
কাব্য-সাহিত্যকে মূলধন করে অন্যকিছু করে থাকেন ।
শেষ পর্যন্ত ‘কবি’র
কথাগুলোই থাকে, কী ‘রকম’ বললেন কোন পরিস্থিতিতে বললেন এগুলো পরে অর্থহীন হয়ে যায় । শুধু
‘রকম’-এ আবিষ্ট অনেক কবিকেই মাঝে মাঝে আমরা কবিতা ব্যতিরেক
অনুঘটকরূপী অন্য-মাধ্যমেও ব্যস্ত হতে দেখি । কবিতাতে যেটুকু দিতে পারলেন না,
সেটুকুর ঘোষণা দিতে চলে যান অন্য কিছুতে
। আমার মতে কবিতার জন্য কবিদের এই প্রসঙ্গান্তর হওয়া, কবিতায় তার সঠিক উপস্থিতির অভাবকেই সূচিত করে । মুষ্টি-যুদ্ধের
বিশ্বচ্যাম্পিয়ান ক্যাসিয়াস ক্লে যুদ্ধে যাননি, যদিও তা বাধ্যতামূলক ছিল তখন তার দেশে । এজন্য তার
বিশ্ব-চ্যাম্পিয়ান খেতাবটি ফিরিয়ে নেয়া হয় । এমনকি, যুদ্ধে না-গেলে তাকে কামানের সামনে ফেলে দেয়া হবে বলা হয়েছিল,
তাতেও দমেননি তিনি ।
হিমাদ্রি দেব সহস্র ‘ভিন্ন’ কাজে ব্যস্ত থাকলেও তার কবিতার তথাকথিত ‘সার্থকতার’ জন্য অন্য কোন মাধ্যমের কাছে ধরা দেননি । তাঁর সব কবিতাতে তিনি
শতাংশ উপস্থিত ছিলেন, রয়েছেন । যা বললাম
সবই আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস । অন্য কারো অন্যরকম ধারণা বা বিশ্বাস থাকবে, তা অনুমেয় ।
আজ তাঁর আরও দুটি
কবিতা পড়বো ।
৮.
নেপথ্যে-তিন
হিমাদ্রি দেব
অমরত্ব শব্দটি খুব
প্রিয়তর বলে
অমৃতকুম্ভের জন্য,
এত আয়োজন
এতো তুলকালাম কাণ্ড,
পটে আঁকা লক্ষ্মীমুখ
প্রচ্ছন্ন মায়ায় পাখী
ওড়ে ।
আকাশ পরিধি থেকে
খড়কুটো নেয়, ধরে প্রত্যাশায়
শাখা, বুকভর্তি হাওয়া
শাখায় শাখায় প্রাণ
পল্লবিত ।
সকল অমৃতলোভী দেবগণ,
বঞ্চিত প্রত্যাশী দানবেরা
দৌড়-ঝাঁপ গুঁতোগুতি,
আজীবন রক্তক্ষয়, সংঘর্ষের ইতিহাস রেখে
পরবর্তী প্রজন্মের
কাছে কিছু বলে যায়, সংক্রমণ কালে
আক্রান্ত জীবন কাঁপে,
প্রবঞ্চক দস্যু ও বিধাতা
প্রত্যাশিত নয়
তবুও বাপেরা মায়েরা
ছেলেমেয়েদের জন্য চিন্তিত এখন
যেন এইসব পাপভার এদের
কারোর নয় !
মাতৃহীন শৈশবের কাছে
শব
পিতৃহীন শৈশবের কাছে
শব
অন্ধ কালা বোবা
প্রতিবন্ধীরা গড়াতে গড়াতে যায়
ভিক্ষা চায় ভিক্ষা
দাও মহারাজা !
***
*** ***
৯.
শিলালিপি
হিমাদ্রি দেব
আমাদের ভবিষ্যৎ কী ?
নষ্ট্রাদামুসের মুখে
হাসি
পার্থিব পিতল থেকে
ঠিকরে পড়ছে ভাবীকাল
বালিকার ম্লান মুখ
অতিশয় বাসি ।
উদ্বেগে পিত্তল কাঁদে,
দৈববাণী নাকি ?
গমগম শব্দে নামছে কথা
জ্বল জ্বল করে ভাসছে
ছবি
সকল ছবির মধ্যে,
স্পর্শ করা আছে নষ্ট মেয়ে
সমুন্নত ভাবাবেগ ।
মায়ানগরীর বুকে, সায়রের
শোক-পাখি ওড়ে,
মোহময় ফাগুন পুড়ছে
সর্বনাশা জ্বরে ।
নিজেদের বৃত্তে বন্দী,
সকলে এবার
দিগ-দিগন্ত কি তবে,
শুধু স্তব্ধতার !
***
*** ***
১৩.০৭.২০১৮
আজ কোন কথা না-বলে শুধু পড়া । আজ হিমাদ্রি দেবের তিনখানা কবিতা
পড়বো ।
মৃত্যুর
পর মানুষ কোথায় যায় আমরা কেউ জানি না ।
আস্তিক নাস্তিক, উভয়ই মূলত সন্দেহবাদী । ঈশ্বরবিশ্বাস কারোরই নেই । সত্যি সত্যি
ঈশ্বরে বিশ্বাস করে এমন লোকের দেখা আদতেই কেউ পেয়েছেন কি না, হলফ করে কেউই বলতে পারবেন না । নাকি
সন্দেহই বিশ্বাস ?
আমার মা সংসারের সমস্ত কাজ নিজের হাতে
সম্পন্ন করার সাথে সাথে, তিনবেলাই
ঠাকুর-পূজা করতেন, সন্ধ্যা-আহ্নিক করতেন
। কিছু জিজ্ঞেস করলে মুচকি হাসতেন ।
ওই হাসিটাই হয়তো ঈশ্বর !
হিমাদ্রিদাকেও কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর
দিতো বহু আগের অন্য কোন কথার, আর
মুচকি হাসতো ।
ওই হাসিটাই হয়তো কবিত্ব !
যদি আজও সে হঠাৎ এসে উপস্থিত হয়,
ওই হাসিটাই হয়তো দেখবো তার মুখে !
আমরা তাঁকে খুঁজবো তাঁরই কবিতায় । সে তো
আর আমাদের কাছে বসে নেই !
“...ঘরদুয়ারে সবাই আলেক, ‘তুই আলেক নাই’...
১০.
নেপথ্যে-২
হিমাদ্রি দেব
আমার সরকার, কিছু না-দিলেও আমার সরকার
বাহারী মেঘের মধ্যে,
উড্ডীয়মান আমার পতাকা ।
সরকার থাকলেও কিছু
আসে যায় ? আসে যায় না ।
মিটবে না ক্ষুধা ।
কারো কারো বাড়ি-গাড়ি,
ভারিক্কি পায়ের চাপে
দলে যাবে, আগাছা হৃদয় !
তবু কিন্তু জেতাবোই,
মরে মরে জেতাবোই
মায়াবী, কৈবল্যবাদী নেতাদের
তা না হলে—
ওরা এলে, আমার পিঠের চামড়ায়
বাজাবে যে ঢোল ।
তাই তোল্, হাওয়া তোল !
***
*** ***
১১.
ভজনগীতি-দুই
হিমাদ্রি দেব
শুরু ।। আমায় কেউ বাতিল করবে, এমন সাধ্য কার
সুধাকান্ত, অমরত্ব, তোমার
এবং আমার ।
তারপর ।। বাবার দেওয়া, নামটি না’হয়
আগুন দিয়ে জ্বালাও
হঠাৎ ফাগুন তেড়ে আসবে, এবার তুমি পালাও ।
তারপর ।। সাবান-সোডা বিক্রি কর অস্নাত জীবনে
ধোপা, আমায় স্নিগ্ধ করো বিনীত-চুম্বনে !
***
*** ***
১২.
পাগলাগান
হিমাদ্রি দেব
মাদল বাজে মুরগীটিলায়,
ঊষা বাউরির ঘরে
করম রাজা, মাতাল হয়ে, নাচে ঘরদুয়ারে
কলঘরে, আজ ঘর্ঘর্ নাই
ভোরের মুখে ভোঁ নাই,
তাড়ি খেয়ে, সর্দার মন ভোলায় ।
হাড়িয়া চড়বেক চুলায়,
মাদল বাজাবেক বুড়ায়
বাঁশের পাতা ছুঁবেক
মাটি, এই বাবু, আসবি
বাকিন, তুই আসলিক নাই ।
মরা-চালের মধুর গান,
তুই শুনলিক নাই !
আংরেজী সাহিবের ঘোড়া
সাহিব-মেম জোড়া জোড়া
বালিশিরা কিলাবে
যাবেক নাই
ঘরদুয়ারে সবাই আলেক,
‘তুই আলেক নাই’
চায়ের ফুল, ফুটবেক সাদা
চাঁনছোঁয়া হলুদে মাখা,
বাবুরে তোর
পরাণে স্বাদ নাই !
টুসু-পুজার পাগলা গান,
গায় ভুখা ভগবান
তুই শুনলিক নাই !
লালামাটির এই কাংড়া
পথে
তুই ফিরবিক নাই ?
***
*** ***
১৪.০৭.২০১৮
“...ফসল না তুষ জ্বলে, সমকাল আচ্ছন্ন ধোঁয়ায় ।”...
এই কথা ক’টি পড়ে মনে পড়ে যায় গল্পকার দুলাল ঘোষের সেই ক’টা পঙক্তি, যা আমি বহুবার বহু জায়গায় সুযোগ পেলেই বলে ফেলেছি—
“...কে কারে মারে রে লঘু...সব ধূলায়
অন্ধকার...”
তবে এই ব্যাপারটা যে একেবারে নতুন,
তা কিন্তু মোটেই নয় । সকল সৃজনশীল
ব্যক্তির কাছেই তার সমকাল সবচেয়ে জটিল, সংকটময়
আর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন মনে হয়েছে । আবার যাদের
কারণে এইসব সংকটের জন্ম, তারাও
নিঃসন্দেহে সৃজনশীল । কেউ সমস্যা রচনা করে, আর কেউ তা টের পেয়ে যায় ! তবু জীবন তো চলতেই থাকে ।
এখন দশক অনুযায়ী সাহিত্যের বিচার
বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে, মানে
এটা চালু হয়ে গেছে ।এও সময়েরই এক চাল । দশক অনুযায়ী প্রতিযোগিতা যেন ! আগামীতে বছর
অনুযায়ী হবে । তাতে কে কে ‘অস্কার’
পাবেন, সেটার সিদ্ধান্ত হবে আবার অন্য কোথাও, যেখানে বাইরের আলো-বাতাস ঢোকে না, যেখানে কথা হয় চুপিচুপি, ফিসফিস, যেখানে
দরজার বাইরে জ্বলে লালবাতি ! সেখানে কারো কারো দাহকার্য হয়, কারো কারো দাফন ।
কবি হিমাদ্রি দেবকে যদি কয়েক দশক আগের
কবি বলে সিদ্ধান্ত করে ফেলি, তাহলে
একটা সুবিধে হয় এই যে, তুড়ি
মেরে বলা যায়, হ্যাঁ হ্যাঁ, তাঁর সময়ে তো এমন ছিলোই, কিন্তু আজকের সমস্যা আরও জটিল ! এখন
তিনি থাকলে হয়তো লিখতেনই না আর !!
হ্যাঁ, এমন হলে হিমাদ্রি দেবের কবিতার গ্রাস থেকে নিজেকে মুক্ত তো
করাই যায় !
কিন্তু মনটা কি পরিষ্কার হলো ? আজকের সমস্যাটা আদৌ কী ? সেটা কি আসছে আজকের কবিতায় ? সব সমস্যাকে চাপা দিয়ে নজর কেন্দ্রীভূত
করানো হয়েছে একটিমাত্র বিষয়ে । কেউ তার পক্ষে তো কেউ তার বিপক্ষে । দ্বন্দ্বমূলক
আর স্বার্থমূলক জীবনবাদ একাকার হয়ে ‘হারায়েছে
দিশা’ ! কবিতা রূপান্তরিত
হচ্ছে নালিশে আর স্লোগানে ! অলৌকিক পেষণে লেখানো হচ্ছে এসব ! অন্তত বেশিরভাগ
ক্ষেত্রে তো বটেই !
এর পর শুধু একটা জিনিষই বাকি থাকে,
যার নাম অট্টহাসি, যা দিতেন কবি অরুণ বণিক !
হা হা হা...
তবু আশ্রয় পাবার মতো— উঠে দাঁড়াবার জন্য কিছু কবিতা এখনো
রয়েছে, এখনো লেখা হচ্ছে,
নিভৃতে, শহরের নিঃসঙ্গ কোণে, মফস্সলের
অস্ত-গোধূলির ম্লান আলোকে, তা সে যে-দশকেরই হোক, যে-শতকেরই হোক...
আজ কবি হিমাদ্রি
দেবের তিনটি কবিতা পড়ব । তাঁর সময়ও তো জটিলই ছিল !
“...ধর্মের
ও কর্মের প্রয়োজনে
আকাশে উড়ছে
রক্তপিপাসু বাজপাখি”...
১৩.
ঋণ
হিমাদ্রি দেব
খাতার এ’কোণে জমা, বাকিটুকু দেনার শরীরে
দিনে দিনে বড় বেশি ঋণ
বেড়ে যায় ।
জানালা দরজা খোলা—
হু-হু বাতাসের শব্দ শুনি
গোপন শরীরে নেমে,
কারা যেন কুঠার চালায়
সহজ বনানী নেই,
অরণ্যবিহীন, শূন্যতায়—
আমাদের দেনা বাড়ে,
ক্রমশই ঋণ বেড়ে যায় ।
যে দেবার দিয়ে গেছে,
অফুরান, অ-ফেরা জোয়ারে
জ্বলজ্বল পাণ্ডুলিপি,
সংবেদনে, সাগর লুকনো ।
তবু এ আকাশ পোড়ে,
হৃদক্ষেতে, পোকারা পড়েছে
ফসল না তুষ জ্বলে,
সমকাল আচ্ছন্ন ধোঁয়ায় ।
এই আমি, বেঁচেবর্তে, সংসার-ফসলে তুষ, জ্বলি
তুষানলে
পড়ে আছে ছাইভস্ম,
ভস্মাধার ধরে আছে ঋণের শরীর !
***
*** ***
১৪.
পাঠশালা
হিমাদ্রি দেব
শিশুদের কোনো ঈশ্বর
নেই, পাখিদের নেই কোনো
গানের ইস্কুল ।
ঈশ্বর নির্মিত,
আর শিশুরা নির্মল ।
পাখিদের গান শুনতে,
জেগে থাকে সারারাত
শিউলি ও বকুল !
***
*** ***
১৫.
একবার আকাশ দেখাবো
হিমাদ্রি দেব
মানুষ শ্লোগান
দিচ্ছিল,
আমরা রক্তের বদলে তেল
চাই না
তেলের বদলে রক্তও না
প্রেসিডেণ্ট বললেন আর
ফেরার পথ নাই
যারা বোমা ও
মারণযজ্ঞের পুরোহিত ও পাদ্রী
তারা বলল, প্রত্যেকের ধর্মের ও কর্মের প্রয়োজনে
আকাশে উড়ছে
রক্তপিপাসু বাজপাখি
আর তাকে ফেরাবার পথ
নেই
পথ ছিল সব বন্ধ,
চোখ ছিল সব অন্ধ, মুখ ছিল বোবা
নিউইয়র্কের নিভৃত
প্রাসাদে পায়রার পালকে চোখ রাখতেই
কুয়েলার দেখলেন আস্তে
আস্তে তপ্ত বাতাসে ছাই হয়ে
উড়ছে, দেখলেন মহাসভার সবাই এক একটি পাথর
উঁচু পাহাড় থেকে
ক্রমশ নিচের দিকে ক্রমশ নরকের দিকে
ভাব করার কিছু নেই,
তিনি চিৎকার করতে পারছেন না
তিনি বলতে পারছেন না,
পেণ্টাগন
আমাকে সামান্য আকাশ
দাও
আমি এই আহত পায়রাটাকে
একবার
আকাশ দেখাবো !
***
*** ***
১৫.০৭.২০১৮
কবি হিমাদ্রি দেবকে কেমন ভালবাসতেন তাঁর
শহরের মানুষ ?
আসলে এটা কোন প্রশ্নই না । হিমাদ্রি দেব
একজন কবি মাত্র । আর কবি হলেই তাঁকে ভালবেসে ভাসিয়ে দিতে হবে, বা আদৌ ভালবাসতেই হবে এমন কোন কথা নেই ।
এমন কোন দায় নেই কবির তরফে, পাঠকে
তরফে বা সাহিত্যের তরফে । মানুষ মানুষকে ভালবাসে । মানুষ কবিকেও ভালবাসে মানুষ
হিসেবে । কবিতা সেখানে সূত্র মাত্র হতে পারে । অন্য শহর, অন্য রাজ্য, অন্য
দেশ-এর কথা হিসেবে না-এনেও বলতে পারি হিমাদ্রি দেবকে তাঁর শহরের মানুষ ভালবাসতেন,
খুব ভালবাসতেন, এর জন্য তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে রাস্তার নাম রাখা বা আবক্ষ
মূর্তি স্থাপনের কথা উল্লেখ না-করলেও, টের
পাওয়া যাবে, যদি আমরা টের পেতে চাই
। কারণ হিমাদ্রি দেব কখনোই কোন ‘বিশেষ
মানুষ’ হিসেবে বা ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত গুনগুন করা উদাস-এলিট
কবি’ হিসেবে কারোর সঙ্গে মিশতেন না । মিশতেন
মানুষ হিসেবে মানুষের সঙ্গে এবং নির্বিচারে । আর তাঁর এই মেলামেশা কোন পর্যায়ের তা
তাঁর শহরে ঢুকে যেকোন একজন মানুষের সঙ্গে এপ্রসঙ্গে কথা বললেই বোঝা যাবে ।
নিচের ছবিতে পেছনে মাঝখানে দাঁড়ানো কবি
হিমাদ্রি দেব । সামনে কবি শক্তিপদ
ব্রহ্মচারী, গল্পকার দীনেন
ভট্টাচার্য (কৈলাসহর), কবি
প্রদীপবিকাশ রায় ।
১৬.
তাঁর আরও দুটি কবিতা পড়ছি ।
কাঙালের চিত্রমালা
হিমাদ্রি দেব
কি রূপ দিয়েছো তুমি
কাঙালের ঘরে ভালোবাসা
এতো হাসি !
কলহাস্যে, মুখর করেছো নিঃসঙ্গতাকে !
এখন নোতুন করে
সৃষ্টি হবে, অনুভূতিমালা !
ভোরের পাখির গান,
আবার নোতুন করে শুনতে হবে
আবার নোতুন করে আঁকতে
হবে
স্থির মুহূর্তের
চিত্রমালা !
নাকি পুরাতনই সব,
শর্ত সনাতন, মেঘমালা থেকে
ঝরে পড়া বৃষ্টিজল,
প্রারম্ভিক শব্দমালা
স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণের
শুদ্ধ উচ্চারণ !
***
*** ***
১৭.
মায়ের সীমানায় থাকে
হিমাদ্রি দেব
সহজ বৃক্ষের জন্যে
অলৌকিক হাওয়া কাঁপে
প্রার্থনার ধূপ,
স্নিগ্ধতর বীজমন্ত্র
অঙ্কুর থেকেই ক্রমে
তুলে আনে নীলাঞ্জন
চোখ,
ছায়া ও পাখির মত
এই হউক ফিরে আসা
সহজ বৃক্ষের করতলে
মায়ের সীমানায় থাকে
নতজানু চিরকাল
বৃক্ষ কিংবা ঈশ্বরের
মুখ ।
***
*** ***
১৬.০৭.২০১৮
“...বিদায় আমার শূন্য হাতের হাতটি নাড়া ।”
কবি হিমাদ্রি দেব । “...বিদায় আমার শূন্য হাতের হাতটি নাড়া ।”
মৃত্যুর বহু আগেই যেন বিদায় নেয়া । হয়তো
সকল কবিই এমন ভাবেন যে তাঁর বিদায় যখন হবে, কেমন হবে সেটা । কবি শৈলেশ্বর ঘোষও সম্ভবত এমনই একটা কথা লিখে
গিয়েছিলেন । যাক এসব কথা ।
হিমাদ্রি দেবের, আজকের দ্বিতীয় কবিতাটি পড়ে মন কেমন করে ।
“...তুমি যখন হাত তুলেছো দূর্বাহাতে
তখন প্রদীপ নিবু-নিবু হাল্কা হাওয়ায়...”
স্বরবৃত্তের হালকা চালে লেখা হলেও বড় বিষণ্ণ
লেখা! শ্রদ্ধেয় কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারীরও বিশেষ প্রিয় ছন্দ ছিল স্বরবৃত্ত ।
“...
এই তো খাবার ঢাকা রইলো, ইচ্ছে হলে খাস
খাবো, যখন তোমার চোখে একজোড়া উদ্ভাস...” ইত্যাদি
। সম্ভবত লেখাটির নাম ‘মাকে’
। এটিও বড় করুণ এক রচনা ।
হিমাদ্রিদা ছিল এ জগতে শক্তিদার সবচেয়ে
বড় গুণগ্রাহী । তবে ঘটনা ঠিক এভাবে না দেখে অন্যভাবেও দেখা যায় । কবি মাত্রেই ছিল
তাঁর প্রিয়জন । এ কথা আমরা ইতিমধ্যে জেনে ফেলেছি । তবে শক্তিদা ছিলেন তাঁর কাছে
সবার উপরে, এতে বিন্দুমাত্র
সন্দেহ নেই । এবং তার কাছে শুধু নয়, আমাদের
কাছেও ! বস্তুত, বিষয়বস্তু, তার প্রক্ষেপণ, উপস্থাপনা আর ছন্দ, সবই
শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর কবিতায় মিলে মিশে এমনভাবে একাকার হয়ে যেতো যে ছন্দের উপস্থিতি
টেরই পাওয়া যেতো না । এমন সিদ্ধহস্ত বাংলাসাহিত্যে অবশ্যই দুর্লভ, এখনও । এমন, ভাব, বিষয়,
ছন্দ আর উপস্থাপনার সুন্দর মিলন সত্যি
বিরল । ছন্দ দিয়ে আজও অনেকেই লিখে থাকেন । কারো কারো লেখায় ছন্দ কেমন হাড়গিলার মতো
মুখ উঁচিয়ে থাকে । যাক, আমরা
বলছিলাম কবি হিমাদ্রি দেবের কথা ।
তাঁর আরেক পছন্দের কবি অবশ্যই পীযূষ
রাউত । হিমাদ্রিদার সকল আবদার আর অত্যাচারের ক্ষেত্র কবি পীযূষ রাউত । একবার এক
কবি, পীযূষ রাউত সম্পর্কে কোন খেলো মন্তব্য
করাতে হিমাদ্রি দেব তাকে বিশেষভাবে ধরে এনে তার অফিসের কাউন্টারের নিচে আটকে রেখে
দিয়েছিলেন বহুক্ষণ, এমন শোনা যায় ।
না, কবি হিমাদ্রি দেব ছন্দ মিলিয়ে খুব বেশি লেখেননি । দক্ষতা
থাকলেও এড়িয়ে গেছেন । কোন শৃঙ্খল যে তাঁর পছন্দ ছিল না, তাঁর সারাটা জীবনই তার প্রমাণ, এমনকি মৃত্যুটাও !
আজ আমরা তাঁর আরও দুটি কবিতা পড়বো ।
১৮.
ধর্ম-কিতাব
হিমাদ্রি দেব
ঈশ্বর যদি থাকেন তবে
তিনি কেন লিখবেন কিতাব
জ্ঞানময় সর্বসত্তা
নিজের আলোকিত
শব্দমালায়
জন্ম থেকে আলোকিত
করতে পারেন সকলের হৃদয় ।
নাস্তিকের অস্তিত্ব—
তাই মানি ।
ঈশ্বর সংহার হলে
একদিন দেখা দেবে সেই অবিনশ্বর
যে সমস্ত সৃষ্টির মতো
দীপ্তিময় সুন্দর ও শোভন ।
***
*** ***
১৯.
তুমি যখন হাত তুলেছো
হিমাদ্রি দেব
তুমি যখন হাত তুলেছো
দূর্বাহাতে
তখন প্রদীপ নিবু-নিবু
হাল্কা হাওয়ায়
ভালোবাসায়
নষ্ট-চাঁদের পুঁজের গন্ধ
আঁধার নামে আমার নীরব
জঙ্গি চাওয়ায় ।
বলেছিলাম দ্যাখাবো এক
সোনার মানুষ
সোনাপুরের
মিঠে রোদে ঝিলিক
দেওয়া
কথা আমার কথার মধ্যে
ঝিমিয়ে পড়ে
বিদায় আমার শূন্য
হাতের হাতটি নাড়া ।
***
*** ***
১৭.০৭.২০১৮
আজকের দিন চলে গেলে আর একদিন আমরা
হিমাদ্রি দেবের কবিতা পড়ব । মোট কবিতা পড়া হবে ২৫টি । এতে একজন কবিকে চেনা যায় না
। কবিকে গ্রেফতার করা বড় কঠিন কাজ । শুধু হিমাদ্রি দেব নন, সব কবিই শুধু হাসেন, মুচকি
হাসি । একজন কবিকে জানতে হলে শুধু তাঁর কবিতা পড়ে হয় না । যদিও এমন ধারার প্রচলন
হয়েছে । ধারা যা-ই চালু থাকুক, কবি
কিন্তু সত্যিই হাসেন, সেই মুচকি হাসি ।
কবির কবিতা পড়ে কেন একজন কবিকে জানা
যাবে না ? এ-ও এক প্রশ্ন বটে ।
আবার কবিকে জানার প্রয়োজনই-বা কী ?
সত্যি কথা । কবির কবিতাই তো যথেষ্ট !
তবু প্রশ্ন থেকে যায় ।
এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই ।
পাঠকভেদে, হয়তো এটা যার যার
ব্যক্তিগত কৌতূহল বা তৃষ্ণার ব্যাপার ।
কবিতা পড়তে পড়তে কবির ব্যক্তিগত
সাহিত্যপাঠ সম্পর্কেও একটা ধারণা হয়ে যায় । অনেক কবি লেখকেরই যে বাংলাসাহিত্য
সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার নয়, এমনকি
কারো কারো তো দু-দশক আগের লেখা সম্পর্কেও ধারণা নেই, একথাও কবি-লেখকের অজান্তেই তার রচনায় অলৌকিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়ে
যায় । এটা কোন অপরাধ নয়, এতে
সাহিত্য করার লাইসেন্স যে আটকে যাবে, তা-ও
নয় । তবু মনে জাগে যে, তার সাহিত্য-তৃষ্ণাটা আসলে কোথায়,
এবং সেটা কী রকম ?
কথার টানে, আজ
অবান্তর কিছু কথা হয়ে গেল । কেউ কেউ বিরক্ত হলেন হয়তো-বা ।
আজ কবি হিমাদ্রি দেবের আরও তিনটি কবিতা পড়ছি । তারপর কাল আরও
দুটি কবিতা পড়ে আপাতত শেষ করবো । আজকের প্রথম কবিতাটি স্বরবৃত্তের দোলায় ।
২০.
সমুদ্র-সম্প্রীতি
হিমাদ্রি দেব
ডুবেছিলাম তোমার জলে
তোমার চোখের সাথী
সুখের দোলা দুলেছিল
বনতুলসীর পাতায়
মেঘ করুণায় ঝরেছিলাম,
মেঘ কারো নয় বলে
সখি, তোমার ঘরেই ছিলাম সমুদ্র অন্তরে
হঠাৎ চাবি খুলতো
তোমার জ্বলতো শতেক স্মৃতি
বাবা খোকন খেলতো কি
সব স্বপ্ন নিয়ে খেলা
হৃদয় জুড়ে জোছনা বইতো,
খই রঙের বই পড়া
হরেক রকম স্মৃতি এখন
দে দোল দে দোলা
এখন, তোমার নৌকো জুড়ে তোমার বাড়িঘর
পুকুর জুড়ে বাড়ছে
কেবল নিস্তরঙ্গ জল
সময় তো নেই বলবে আমায়
কেমন চোখ আর স্বাতী
কোথায় তোমার হারিয়ে
যাওয়া সমুদ্র সম্প্রীতি ।
***
*** ***
২১.
নিলাম (দুই)
হিমাদ্রি দেব
একটি পতাকা আমি
বিক্রি করবো । এই পতাকাটি আমি, বহন
করেছি বহুকাল
ধুয়ে-মুছে গেল সব,
রক্তের ভিতরে শুধু রয়ে গেল, এমন পতাকা ।
সন্ততির শিরা-উপশিরা
বেয়ে যে রক্ত প্রবলভাবে ধেয়ে যায়
সন্ততির মনোদুর্গে,
যে পতাকা এখনও উড়ছে ।
আমি এই পতাকার নীচে,
এখনো দাঁড়িয়ে ।
***
*** ***
২২.
অনুমতি
হিমাদ্রি দেব
জলের বিবর্ণতাবোধ নেই
বলে, জল রং মেশে
জলে আকাশ মিশে গেলে,
আমরা নীল সমুদ্র বলি ।
কল্পনা রূপময় হলে,
ছুটে যেতে পারি, গোলার্ধ অবধি ।
রঙের বশবর্তী হলে,
আমাকে তুমি আকাশ ভেবে নিও ।
***
*** ***
১৮.০৭.২০১৮
কবি হিমাদ্রি দেব-এর কবিতাপাঠে আপাতত
বিরতি টানছি আজ পড়ার পর ।
তাঁর রচনার বৃহদাংশই তাঁর নিজের
অস্তিত্ব জড়িয়ে, যেখানে এসেছে এই
সময়ের গণজীবনের সমস্ত অলিগলি ও তার সকল প্রেক্ষিত । তাঁর নিজের আর্তনাদগুলিই ছড়িয়ে
পড়েছে সকলের হয়ে । এখানেই তাঁর বিদ্যমানতার প্রমাণ । হিমাদ্রি দেব নিজেকেই ব্যবহার
করেছেন বারবার এবং প্রতিবার । তাঁর প্রতিবাদ গণ-প্রতিবাদের হিস্যা নয়, দেখনদারী নয় । তাঁর প্রতিবাদ
মানুষের সংকটে মানুষের প্রতিবাদ । তাঁর
স্বার্থপরতার কনফেশানও প্রতিবাদ ছাড়া অন্যকিছু নয় । যা হয়তো আমরা আরও পরে দেখতে
পাবো, অথবা পাবোই না,
কারণ মোটা দাগ না-কাটলে কিছুই আমাদের
চোখে পড়ে না ।
যারা বলেন প্রতিবাদ ছাড়া কবিতা হয় না ।
তাঁরা ঠিকই বলেন । কিন্তু প্রতিবাদ আসলে কী, তাঁরা তা জানেন না । মানুষ তাদের কাছে একটা ভোটার নাম্বার ।
দলের একটা নাম্বার মুছে গেলে, একটা
নাম্বারে পচন ধরলে তাকে বাঁচানোর সমর্থনে যে প্রতিঘটনা, সেটাই তাঁদের কাছে প্রতিবাদ । একজন কবিকে হয়তো নিজের বিরুদ্ধেও
দাঁড়াতে হয় ।
মূলত লিরিক্যাল
হলেও, হিমাদ্রি দেবের বাচনে
কোথাও তেমন গদগদ ভাব দেখি না । তাঁর সমস্ত রচনা প্রায় মিতায়তন । কোথায় থামতে হবে
এই সংযম তাঁর সহজাত যেন । সার্রিয়ালিজম্ তাঁকে কোথাও অতিদিগন্তে নিয়ে যেতে
পারেনি । অসাধ্য অতিশয়োক্তি নেই একেবারেই, যা
এই সময়ের প্রেমের কবিতার একটি হুল্লোড় !
শব্দ ব্যবহারে হিমাদ্রি দেব ছিলেন একেবারেই ঘরোয়া, কিন্তু সুচিন্তিত । এই আটপৌরে শব্দের
চমকহীন পঙক্তি দিয়েই কবি মুগ্ধ করে গেছেন তাঁর অজস্র পাঠক পাঠিকাকে । মনে পড়ে,
তাঁর ‘মাদ্রাজ নগর’ কবিতায়
প্রথম ব্যবহার করেছিলেন ‘মান্দ্রাজ’
শব্দটি । বর্তমান ‘চেন্নাই’ শহরের নাম একসময় ‘মান্দ্রাজ’-ই ছিল হয়তো । আমার বাবাকে ‘মান্দ্রাজ’ বলতে শুনেছি । তাই হয়তো কবিও ‘মান্দ্রাজ’ লিখেছিলেন,
কিন্তু যখন মুদ্রিত হলো তখন সেটা পাল্টে
‘মাদ্রাজ’ করেন । এই কবিতাটি আমি তাঁর স্বকণ্ঠে শুনেছি ।
তাঁর রচনায় অবশ্যই রয়েছে রবীন্দ্রচেতনার
ছায়াপাত, যা হয়তো-বা মূলত
ভারতীয় চিন্তা-কুসুমেরই স্বাভাবিক
সৌরভ মাত্র । এছাড়া তাঁর মধ্যে আর যেসব গৌরবচিহ্ন দেখি, তা-ই একজন কবির উত্তরাধিকার, অর্জন । কবিরা ছিন্নমূল হতেই পারে না । মধুসূদনকে তাই ফিরে
আসতে হয়েছিল ভারতের মাটি ও ঐতিহ্যের কাছে ।
প্রকৃত অর্থেই, এই নিষ্ঠাবান কবির রচনা আরও সময় নিয়ে পড়া দরকার । আমাদের এই
সামান্যপাঠে একজন কবিকে পুরো উপলব্ধি করা সম্ভব নয় । ত্রিপুরার সম্পদ হিসেবে,
বাংলা সাহিত্যের সম্পদ হিসেবে, তাঁকে আমরা নিশ্চয়ই আরও কাছে টেনে নেবো,
তাঁকে স্মরণ করবো তাঁর কবিতাপাঠ ও তাঁকে
নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে ।
২৩.
আত্মনেপদী
হিমাদ্রি দেব
নিজের বলতে, নিজের ছায়ার সাথে, আগুপিছু করে আছি
এ বোবা-কালা, ছায়ার আপন বলে
বিকেলের রূপ, হেজে-মজে যায়, মিলায় আমার মাঝে ।
জেগে উঠতেই, ছায়া জেগে ওঠে, ছুটে যায় কিছুদূর
মা-বাবার ছবি,
যেখানে দেয়ালে স্থির
ছায়া সেই বুকে,
বুক রেখে শুধু বলে, উৎস কোথায়, অজানা এই নদীর ।
***
*** ***
২৪.
মাদ্রাজ নগর
হিমাদ্রি দেব
হৃদয় আমার ডুবে থাকবে
পদ্মানদীর চরে
হায় গো দেবী
তুমি তো আছ মাদ্রাজ
নগরে,
যখন কথা শেষ হয়েছে
সাঁঝের দিব্যি মেখে
রজনীগন্ধা হেসেছিল কোনদিকে
চোখ রেখে ?
এখন ভাসান
ভাসছে ভেলা, ঢেউয়ের উপর খেলা
জীবনমাঝি গান ধরেছে
নেইকো অবহেলা ।
পদ্মানদীর চর
জোনাকিরা টিমটিমিয়ে
গড়ে নেয় শহর
গমগমিয়ে যাচ্ছে মেল,
কোন্দিকে যায় গাড়ি ?
বলেছিলে ভালো লাগলে
যেও আমার বাড়ি
বুকের ভিতর লাইন
পেতেছি এনেছি নীল সাগর
তারই কাছে আছে বুঝি
মাদ্রাজ নগর ?
***
*** ***
২৫.
আমাদের কথা
হিমাদ্রি দেব
ছোট হয়ে যাচ্ছে
সবকিছু
আঁটোসাটো মলাটে মানুষ
।
যেন গল্প অল্প পরিসরে
বড়ো রাস্তা, ছোট গলিপথে
এক দুই তিন করে করে
হেঁটে যাচ্ছে বিশাল
মিছিল !
মা আছে, বাবা আছে, তবু একলা মেয়েমানুষ ।
ড্রেসিং টেবিলে রূপ,
পড়ে থাকে
ড্রয়ারে রূপকথা
ঘরের বাতাস শুধু ঘরে
থাকে
জানে শুধু আমাদেরই
কথা ।
*** সেলিম মুস্তাফা / ০৭.০৬.২০১৮
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন