।। সেলিম মুস্তাফা ।।
শৈলেশ্বরের কবিতা আমরা
অনেক পড়েছি ।আজকের দিনে যেসব
কবিতাকে ওয়ান লাইনার / টু লাইনার ইত্যাদি বলা হয়, রবিঠাকুরেরও তেমন লেখা ছিল
‘স্ফুলিঙ্গ’। কেউ কেউ
‘ছিন্ন কবিতা’ বলেন
। আমাদের এ অঞ্চলে অনেকেই লিখেছেন, এবং লিখছেন । শৈলেশ্বরের এমন কবিতার একটি সংকলন আছে । “আমাদের এই বীজক্ষেত”, যা প্রকাশ করেছেন কল্যাণী বসাক,
‘উজান’, কোলকাতা-৩২ থেকে
। বইটির দুটি
সংস্করণ রয়েছে । আমার কাছে প্রথমটি । এতে সবই আছে, কিন্তু প্রকাশকাল নেই । ৩০ পৃষ্ঠার চটি পুস্তক । মলাট খুবই
সুন্দর, তবে ভেতরটা বানান-বিভ্রাট আর অসুন্দর মুদ্রণের জন্য সম্ভ্রম আদায় করে না ।
কবি সাত্ত্বিক নন্দীর সহায়তায় এই সংস্করণের প্রকাশকালটি
জানা গেছে । এটি ১৯৯২ সালে
প্রথম প্রকাশিত হয় । এতে ১০৫টি
১/২/৩/৪ পংক্তির কবিতা
রয়েছে । দ্বিতীয় সংস্করণটি নাকি ২০০৯
সালে প্রকাশিত ।
আমি ব্যক্তিগতভাবে কোন কবিতাকেই ‘ছিন্ন কবিতা’ বলতে
রাজী নই । আমার কাছে, প্রকাশিত সব কবিতাই পূর্ণাঙ্গ কবিতা । বইটির
পেছনের মলাটে প্রকাশিকা অবশ্য ‘ছিন্ন কবিতা’-ই বলেছেন । যারা পড়বেন, তাদের
অনুরোধ ছড়ার মত গড়গড় করে না-পড়ে, পূর্ণাঙ্গ কবিতা পড়ার ধৈর্য নিয়ে
পড়লেই এগুলোর আত্মাকে ছোঁয়া যাবে হয়তো । এই গ্রন্থটি প্রকাশমাত্রই অত্যন্ত সমাদৃত হয়েছে জীবনের কোন অনুভূতিকেই এড়িয়ে যাননি শৈলেশ্বর । তাঁর এই লেখাগুলো পড়ে চট করে ভেতরে ঢুকতে পারি না । এটা আমার ব্যক্তিগত অক্ষমতা । পড়ার পর অনেকক্ষণ ভাবতে হয় । ভাবতে হয় এজন্য যে, বেশির ভাগ লেখাই যে অর্থ প্রকাশ করে চলেছে, তার প্রকৃত তাৎপর্য অন্য কোথাও ।
“...বুর্জোয়া আর বিপ্লবী ক্রমেই হতেছে ভাই ভাই !”
১.
গায়ক পাখি গান করে, শিকারীকে প্রণাম জানায়
পৃথিবীতে অন্ধকার— এখনই
জোয়ার আসার সময়
২.
ফুল যখন ফোটে
কী তার মানে
হয়
বোবাচাঁদ কুয়াশায় কাঁদে—
কী তার মানে
হয়
এখানেই ধূলায় গড়াগড়ি গিয়েছিল এক কবির
হৃদয়
৩.
বহুদিন মাটির বেদনা
হয়ে বেঁচে থাকে
যে মানুষ
টের পায় বুকের
ভিতরে লুকান এক ঘড়ি
শব্দের ঋতু পরিবর্তন ভালবাসা, মৃত্যু যৌনতার প্রহরী
৪.
বাতাসে মৃত্যুর রেণু,
ফুল তোকে দিয়ে
গেলাম কিছু বঞ্চনা
সমস্ত আসার শেষ উজ্জ্বলতা ছিলি, সাংসারিক হৃদয়টি আজ পুরোপুরি কানা !
৫.
ওরে সন্ন্যাসী— রক্তের চোরাকারবারী, বাঘের আত্মায় বসতি
পাখি মেরেছি আমরা
কিন্তু মাংস ভোজনের এই আহ্বান কার প্রতি—
৬.
স্বপ্ন বৃক্ষটির সাথে স্তব্ধতার আজও কিছু
কথাবার্তা হয়
কুক্কুরীর গন্ধে কুক্কুরেরা মাংস ভূখণ্ড তোলপাড় করে
নিজের পচনশীল মাংস
মুখে নিয়ে মানুষ
৭.
যে পথে মৃত্যু আছে সে পথে জীবনও আছে
মাংসগ্রথিত কংকাল অন্ধ
টিলায় নাচে
৮.
মানুষের স্বপ্ন মানুষের স্বভাববশতই মরে !
৯.
আমার প্রতি কোষে
প্রতি কলায় কী এক রস ঝরে
এই সুযোগে ক্ষুধা আর বমন নিজেদের ভালবাসা সারে
১০.
গরিবের কাঁথায় তোকে
শুতে হবে একদিন
সৌন্দর্য বা তার লাশ
এক হাতে উকুন
বাছিস অন্য হাতে
মুখে তুলিস ভাতের
গ্রাস
১১.
খাঁচার পাখি দাঁড়ে
বসেই কলের গান করে
বনের পাখির গান শুনে সবাই ছি ছি করে
হিজড়েরাই আজ দাঁড়িয়ে আছে জীবনের দুয়ারে
১২.
নারী আর মদ প্রাচীন এই দুই পদার্থ আমাদেরও চাই
দুঃখ আর দূরত্ব প্রাচীন দুই উপসর্গ আজো আমাদের চাই
বুর্জোয়া আর বিপ্লবী ক্রমেই হতেছে ভাই ভাই !
১৩.
এক স্ত্রীলোক নিজের শরীরে নিজেরই প্রতিচ্ছবি খোঁজে
পাপ আর পুণ্য
দুপাশে রেখে নরখাদক সেখানেই মজে
ভালবাসা ওজন দরে কিনে নেব বলে আমরা এসেছি গ্রাহকের সাজে !
১৪.
তেল আর কয়লা
জীবাশ্মঘটিত এই দুই পদার্থ আজ বিপন্ন
মানুষ যৌনতার সুগন্ধী দিয়ে মেখে নেয় তার অন্ন
১৫.
সুচেতনা, তুমিই একদিন
সমুদ্র থেকে উঠেছিলে ভেনাস
অন্ন তুমি মাটির
প্রাণ চন্দ্রালোকে চিরনগ্ন আমাদের ত্রাস !
১৬.
একদিন ভগবান পৃথিবীতে ছিলেন, এখন থাকেন
স্বর্গে
ভুল করে কেউ কেউ তাকে খুঁজতে যায় মোমিনপুরের মর্গে !
১৭.
হ্যা, ওরে মৃত্যু, তোকেই ডাকছি আমরা,
আমাদের কথা শোন্
কত প্রণামী পেলি
তুই সেটাই আগে গোন্
১৮.
সমুদ্রে এক সূর্য
ওঠে— পাহাড়ে আর এক সূর্য ওঠে
নর্দমার মাছিগুলি বসে আছে সৌন্দর্যের ঠোঁটে !
১৯.
নারীর হৃদয়— অগভীর
সমুদ্রে অজানা ভয়
নারী তোর শরীর
অন্ধকারে তীর্থযাত্রীর মন্দির মনে হয় !
২০.
আমরা খাতক আমরা
মহাজন তবে কি মৃত্যুর কাছে ঋণী
অরণ্যের অন্ধকারে বাঘের চোখ ছিল ষোড়শীর যোনি !
২১.
ব্যবহৃত হতে হতে মনে হয় জীবন
কিছু নয়
পুরানো ঘায়ের পুঁজ
পড়ে বলে আমাদের বাঁচার ইচ্ছা হয় !
২২.
স্বাধীনতার দখল ধুয়ে
যায় একদিন, ক্ষুধা হয় মর্মের ঘুন
ধর্ষিতাও হেসে ওঠে শরীরে পায় যখন নিসর্গের ভ্রূণ !
২৩.
সিঁড়ির নয় ধাপে
বসে থাকে শুক্লপক্ষের নয় গণিকা
কৃষ্ণপক্ষে তারা ঈশ্বরের আত্মীয়— বাস্তবের প্রহেলিকা !
২৪.
এদিকে এগিয়ে এল উৎসব— ফুটপাত পুরুষ
আর
ফুটপাত নারীর তখন অনশন—
ফুটপাত শিশুরা চায় তাদের বাবারা শহরের
বুকে
শুরু করুক
হলকর্ষণ
২৫.
এক কবিকে ভালবেসেছিল রুমা হালদার, এক বাঁদরকেও
ভাল লেগেছিল তার—
কবির হৃদয়ে একই সঙ্গে ফুটে উঠেছিল চাঁদ আর তার
পাদপ্রদীপের অন্ধকার !
২৬.
কোনটা জীবন আর কোনটা মহাজীবন পোকারা সেটা জানে
কামনার রজ্জুতে বাঁধা
এক ভিখারিও বুঝেছিল তার মানে !
২৭.
এক একদিন মনে হয় সূর্য যেন না ওঠে— সব্জিবাজারে ঘুমাক হৃদয়
জানোয়ারেরা মানুষকে বলে,
তোর বাঁচা এক অবক্ষয়
২৮.
সূর্যকে সমুদ্রের বুকে যে ধরে রাখে—
অন্ধকারের ওপারেও
কেবলই অন্ধকার একথা
যে জানে
দুই হাতে দুই নারীকে কাছে টেনে
আনে—
মড়া তুই কথা বল্ শুয়ে আছিস
পূর্বপুরষের শ্মশানে !
২৯.
এক বিছানায় সহবাস
করে কালো মেয়ে
আর কালসাপ
জ্বরের ঘোরে জীবনবৃক্ষটির আমৃত্যু এই প্রলাপ
৩০.
বাহান্ন বসন্তের ইতিহাস তুই বাহান্ন বর্ষায় করেছিস চাষ
যাকে ভালবাসা দিস সেই হবে তোর সর্বনাশ
রোদ পোহাতেই কেটে
যাবে মানুষের সাধের
পৌষমাস !
৩১.
ভালবাসা যদি না জাগে তবে তো ধর্ষণের স্বাধীনতা আছে
ভয় হয় পতনশীল হৃদয়টি ফিরে নিতে
হয় পাছে !
৩২.
ফেলে দেয়া সামগ্রী যারা ঘরে তুলে
নেয়
শূন্যই যাদের হয় ন্যায়ের বিচারালয়
ভিখারিনী নিজের শরীরকে জিজ্ঞাসা করেছিল,
নিজের দুঃখকে তার কেন এত ভয় ।
৩৩.
যে নির্জনতা বেছে নিয়েছিলাম, সেখানে কেন এত কোলাহল
বেশ্যা চোর আর সন্ন্যাসীর মধ্যে শুরু
হয়েছে নিঃশব্দ চলাচল
৩৪.
কে নষ্ট করেছে
তোমাদের কুয়ো— ঐ ছোটজাতের দল,
তাদের মেয়েমানুষ অবশ্য তত ছোট নয়
জ্ঞানের পথেই খেয়ে
নিতে হয় যত নিষিদ্ধ ফল !
৩৫.
শয়তান একদিন জানতে
চায়, আমাকে কেমন
লাগে—
আমরা তো যে যার বিষ খুঁটে
খাই, অমৃত থাকে
তোরই ভাগে !
৩৬.
আত্মহত্যার আগে জানতে
চেয়েছিল একজন,
ভালবাসার আগে কী ছিল ভালবাসার পরে কী হবে
মাতৃগর্ভের ক্ষেতটি ভরা ছিল গম আর যবে—
সত্যপুষ্পটি রক্তখাদ্য নিয়ে ফুটে ওঠে নীরবে
!
৩৭.
মানুষকে ভৌতিক কথা শোনাও হে আনন্দ
হে প্রচারক
সময়বন্ধনের হাসিটি ঝরাও
ঠোঁট থেকে—
যৌনতা আমাদের ক্ষুদ্র সঞ্চয়
শিকার করা পাখির
পাখ্নাগুলি চিনে নিয়েছে তাদের শাবক
৩৮.
একটি দুটি করে ফুটে উঠছে তারা,
ওরা আমাদের কেউ নয়
ক্ষমতার অঙ্কে সৌন্দর্যের স্থান— আমাদেরকে তার কেবলই ভয় !
৩৯.
তখন শীত, প্রয়োজনের আগুন জ্বালিয়ে নিয়েছে ভিখিরি আর
তাদের মেয়েমানুষেরা
কাছেই ঘোরাঘুরি করছে সে-রাতের খদ্দের যারা
নিঃসঙ্গ ফুল নিজের
নেশায় নিজেকে নিয়ে
হয়ে আছিস আত্মহারা !
৪০.
অভিজ্ঞতা উত্তীর্ণা নারী, বিষণ্ন ঝুলে-পড়া স্তন
ঈশ্বরপ্রদত্ত গর্তে এখনও
চায় সে মন্থন
হৃদয়ের উর্বর অংশে
আমরা মৃত্যুবীজ করেছি বপন
৪১.
রোদ বৃষ্টি মদ আর নারী একজনকে করে তুলেছে জ্ঞানী—
সময়ের যোনিতে প্রবিষ্ট বুদ্ধ খাবার চেয়েছিল একথা আমরা জানি
৪২.
মানুষ কেন আত্মহত্যা করে ভাটিখানায় বসে
এক প্রেমিক ভেবেছিল সে-কথা
সৈরিন্ধ্রী কত পুরুষের বুকে তুই রেখেছিস মাথা
নিজের স্বাধীনতায় অসন্তুষ্ট মানুষ
বেছে নেয় পরাধীনতার ব্যথা
৪৩.
বন্ধুগণ, স্বপ্নসুন্দরীদের ডাক দাও—
মিছিল থেকে চলে যাই উৎসবে
জ্যোৎস্নালোকিত ছায়াপথ তো একদিন আমাদেরই হবে
!
৪৪.
আকাশের ওপারে আর এক আকাশ— থাক,
এই ছিল আমাদের দাবী—
সেখানেই লুকিয়ে রাখব
আমরা রুমা হালদারের ছবি !
৪৫.
নিজের শবকে উপহাস
করে কবি আর ভাঁড়
ধর্ম কুকুরের রূপে
কুক্কুরীকে প্রকাশ্যে করে প্রহার !
৪৬.
আমরা শরীরের জয়গান
করি, আমরা শূন্যের জয়গান করি
ক্ষুধা তৃষ্ণা এইসব
অসুখ আর যৌনতায় মরি
নৌকা তীরে ভেড়ার
আগেই এক গাছে
বাঁধা হয়ে যায় দড়ি !
৪৭.
সরস্বতী নূরজাহান স্বপ্না বোস আর সুচরিতা সরকার
বলেছিল ঃ যৌনতা
আর মৃত্যু কেবল
এ দুটিই তাদের
সংস্কার !
৪৮.
ফুল ফোটামাত্র তার বুকে পোকায় বেঁধেছে বাসা
আমি কেবলই শুনতে
পাই এক পাগলের ভয়ের ভাষা !
৪৯.
বাতাসে ঘৃণা, ধূলায়
অবিশ্বাস— সন্দেহভরা বুক
জননীকে যদি ডাকিস
তবে কি সারবে
এ অসুখ !
৫০.
এখন মানুষের শব্দ
নাই রাতজুড়ে কেবল
কুকুরের কান্না
ফুলের পাপড়িতে ধরা আছে তথাগতের নিঃসঙ্গতার বেদনা ।
৫১.
একদিন রুমা হালদারকে বলেছিলাম, এই তোর খাদ্য, এই তোর বিছানা
স্বপ্নভঙ্গ হয়ে গেছে
আমাদের— অরণ্য জ্বলছে— ওই আমাদের কল্পনা ।
৫২.
গন্তব্যে পৌঁছাবে বলে কিছু মানুষ উঠে পড়ে লুম্বিনীর বাসে
প্রতিবাদ করেছিল যে সে জারজ, তার লাশ পড়ে আছে ময়দানের ঘাসে
জানি আমরা একা—
আমাদের হৃদয়ে এক সচল রাত্রি আসে ।
৫৩.
হে ক্ষোভ হে ক্ষুধা ভালবাসার হে ক্ষণপ্রাণ আধার
শোন, নদীর বুকে
হারিয়ে যাওয়া সোনাসন্ধানীগণ
এখন অধরা সময়,
হৃদয়ের মূর্তিগুলি দাও বিসর্জন ।
৫৪.
পোষাক বর্জন করতে
পারিনি আমরা, ভালবাসা বর্জন করেছি
গণিকার মজা হৃদয়ের আমরা অছি হয়ে আছি !
৫৫.
ফুলরূপে তুই সময়ের
নির্যাস, গন্ধে আমাদের দীর্ঘশ্বাস
নিজেকে পূর্ণ করতে
তুই মালিকের চাবুক
চাস ।
৫৬.
সমুদ্রের ধারে বসেছিল কবি শুনবে সে জাহাজের বাঁশী
নষ্ট ভ্রূণের মত ভেসে যেতে দেখেছিল নিজের অনুভূতিরাশি
দুঃখের নিরাপত্তা আছে বলেই আমরা হয়েছি
অবিশ্বাসী !
৫৭.
তুমি রাত্রির সঙ্গীত, স্তব্ধতার প্রশ্বাস, চিরশূন্যের নাড়ি
তুমি পশুর অজ্ঞান, অপরাধীর প্রার্থনা, দৃষ্টিহীনের হাতঘড়ি
আমাদের যথাসর্বস্ব লুঠ করে নিয়ে তুমি
হয়েছ ফেরারী !
৫৮.
মৃত্যুর কোন ইতিহাস নাই কেবল শরীরেরই ইতিহাস আছে
স্বাধীনতা যদি শূন্য
মনে হয় দড়ি নিয়ে ঝুলে পড়িস
ফুলে ভরা গাছে
!
৫৯.
ধর্ষিতা হবার পরেও
এক স্ত্রীলোক বলেছিল, আমি বাঁচব, আমি বাঁচব
ধর্মাধিকরণ জেনো, আমরা
তোমাদের ভগবানের রক্তমাংস খাবো
৬০.
সিংহাসনে বসার পর সবাই ধৃতরাষ্ট্র, অন্ধ
আমরা নেশাতুর বলে আগেই পাই নর্দমার গন্ধ !
৬১.
খদ্দের ধরবে বলে এক মেয়ে দাঁড়িয়েছিল ধর্মতলার মোড়ে
হাসি পায় তার—
শহরে আজকাল চোখে
পড়ে না একটিও
ভবঘুরে !
৬২.
এখন বসন্ত বাতাসে আতরের গন্ধ—
পুরুষ-লাঞ্ছিতা সৈরিন্ধ্রী ফুটপাতে করে রান্না
নিজের বুকে কীট লুকিয়ে রেখে ফুল কেন তোর এই কান্না !
৬৩.
স্বাধীনতার এক গান আছে, পরাধীনতারও এক গান আছে
—একই তাদের
সুর
সহবাস শেষ করে কুক্কুর কুক্কুরী পোহায় হলদে রোদ্দুর !
৬৪.
হাত দুটি এই বাড়িয়ে দিলাম, শেকল
পরাবি কে আয়
আমাদের ঘুমের মধ্যেই ইঁদুরেরা হৃদপিণ্ড তুলে নিয়ে খায় !
৬৫.
বিশ্বাসও আমাদের মুক্তি নয়, অবিশ্বাসও মুক্তি নয়
শূন্যের পাখি ধরে যে তার আছে পদে পদে ভয় !
৬৬.
বাস্তব আমাদের পায়ের
জুতা, ভাবের নাম চাঁদ
নিজের চারপাশে আমরা
রচনা করি ঐশ্বরিক ফাঁদ !
৬৭.
স্বর্গ থেকে এই গণিকালয়ে একদিন তুমি
নেমে এস যীশু
তীর্থযাত্রীরা সঙ্গে নিয়ে
চলেছে বালিকা মাতা
ও পোষা এক পশু !
৬৮.
গোয়ালঘরে ঢুকেছিল এক বাঘ তার বাঘিনীর খোঁজে
প্রকৃতির দুই পা বুকে নিতে হয় প্রতিটি নৈশভোজে !
৬৯.
চাঁদকে খায় রাহু—
রাহুকে চাঁদ
কাঁদ রে আনন্দতরু আর একবার কাঁদ
!
৭০.
অবেলায় ঘুম ভাঙে
আমাদের কালবেলায় জেগে থাকি
রুমা হালদারের ভালবাসার দাম দেওয়া এখনো যে বাকি !
৭১.
কামরূপে কামেশ্বরী মহাযোনি আনন্দে আপ্লুতা
লিঙ্গদণ্ড কালসাপ ভুলতে
পারে না নিজের
বিষের ব্যথা !
৭২.
‘কে এক নারী এসে ডাকিল
আমারে; বলিল, তোমারে চাই
স্তন্যদায়িনী তোর নিস্তন বুকে আবার যদি নিজেকে ফিরে পাই
!
৭৩.
আমাদের আকাশে আলো নাই অন্ধকারও নাই— আমরা শুধু বেঁচে
আছি
কখনও হই আকাশের তারা কখনও হই জঞ্জালে বসা মাছি
!
৭৪.
আমরা শরীরসর্বস্ব—শরীরই আমাদের সর্বস্ব
ভিখিরি হই বটে তবে কোনদিনই হই না নিঃস্ব !
৭৫.
সূর্য অস্ত গেলে
মাইল মাইল একাকিত্ব নিয়ে ঘোরে মরুচিতা
সাহারা এখন ঠাণ্ডা হয়েছে— কথা বলছে
শবের নির্জনতা !
৭৬.
সমুদ্রঝড় এক ইতিহাসের দুয়ার খোলে— ডাঙায়
তোলে জাহাজ
নীলিমার ফল খেতে
যায় পাখিরা ঐ— গুঁড়ো হয় হৃদয়ের সমাজ !
৭৭.
প্রকৃতির বুকে চেপেছিল পুরুষ— মৃত্যু দেখেছে সেই ঘটনা
দীর্ঘশ্বাস বঞ্চিতের নেশা— অমানিশা ভরা ছিল মিলনের চেতনা !
৭৮.
অপরাধের পৃথিবীর উপর জ্বলজ্বল করছে শান্তির মলাটখানি
ঘটনা এই ঃ পুরুষ আর নারী
পরস্পরের শরীর থেকে
সংগ্রহ করে নেয় দানাপানি !
৭৯.
জলের স্বভাব চাই আমরা— অজানা আগুনে
পোড়ে আমাদের বুক
সৃষ্টির মানচিত্র চেনে তারা যাদের একদিন
হয়েছিল অসুখ !
৮০.
নিরবধি সময়কে গিলে
খাও তুমি হে সমাধি, হে সুখের
ঘড়ি
বস্তুত জীবন আমাদের সাপের গর্ত, সাপটিকে পাই না যতই তাকে খুঁড়ি ।
৮১.
আমাদের পূজা মানেই
অন্ধকারের স্নেহসত্তা চেটে চেটে খাওয়া !
৮২.
মায়ের গলায় মুণ্ডমালা— জুড়ায় না তবু বুকের জ্বালা
আমরা তোরই জীবনভোগী— জলের উপরে নুনের
ঢেলা ।
৮৩.
শব্দতরুর ফুলগুলি দেব তোর পায়ে— আমরা
তো অচেতন ভয়ে
আমাদের জোতের সীমায়
আরও ক’টি তারা ফুটবে আজ
বেঁচে থাকার দাম মেটাতে বোবা হৃদয়
মেনে নিয়েছে পতিতার কাজ !
৮৪.
যেখানেই রক্ত ঝরে বালুকা বর্তমান তাই শুষে নেয়
যতই দূরত্ব বাড়ে
ততই এগিয়ে চলে নিজস্ব সময়
লম্পটের বুকে ভালবাসা জাগলে আর মৃত্যু নয় !
৮৫.
আমরা এক সমুদ্রকে জানি যে আরও নুন চায়
আমরা এক নদীকে
জানি যেখানে স্নান
করে নিজেকে বদলাই
আমরা যে হৃদয়ের কথা বলি তার কোন প্রাসঙ্গিকতা নাই
এক উৎসবকে জানি—
যেখানে মিলিত হয় বোন আর ভাই
!
৮৬.
হে প্রাচীন সূর্য,
হে সময়ের বীজ—অন্ধকারে বুকের ধুকপুক
ভালবাসার পৃথিবীতে কিছু খুন খারাপী না হলে
হালকা হয় না আমাদের বুক ।
৮৭.
মানুষ ভাবে নদীর
মুখ ঘুরিয়ে দেবে
নিজের হাতে খাল কেটে
কালরাত্রির রাজা স্বপ্নগুলি পরিষ্কার করিস নিজের
জিভে চেটে ।
৮৮.
যে পাখিকে মেরেছি একদিন সে কেন আজ বুকের ভিতরে
ডাকে
একের পর এক পর্দা সরিয়ে আমরা
খুঁজে চলেছি তাকে
।
৮৯.
ধর্ষণ করার পর ভালবাসা জাগে— মাতালের মনে পড়ে মাকে
মলমূত্রময় সংসারে জন্ম
বটে তবু শব্দের আত্মা নৈঃশব্দ্যেই থাকে !
৯০.
অনুমানের ঈশ্বর কোন ভাষা দিবি তুই এই সব গণিকাপুত্রের মুখে
মানুষ নিজের বাণিজ্যের লভ্যাংশ খোঁজে পোষা
মেয়েমানুষের বুকে !
৯১.
তুমি শব্দের শক্তি
আলোর অসীম নীলিমার দুঃখ
ভালবাসার শূন্যতা যৌনতার আনন্দ সকল নেশায়
তুমি যুক্ত
শান্তির সন্ধানে ফাটকা
বাজারে গিয়ে তোমায়
করেছি মুক্ত !
৯২.
মুখে ছিল মাটির
মমতা, চোখে ঘোর,
হৃদয়ে মশলার গন্ধ
অযোনিসম্ভূত শয়তান অবচেতনের অন্ধকার তোর খুবই
পছন্দ !
৯৩.
বৃশ্চিকমণ্ডলী থেকে সরে এসে রাহুসন্ন্যাসী মাটিতে বেঁধেছে ঘর
জননীর দুগ্ধধারা একদিন মুখে পড়েছিল— পেঁচার পৃথিবীতে জানে প্রহর
শীতের রাতে এক উদ্বাস্তু মেয়ে দেখতে
চেয়েছিল তার পথের
ঈশ্বর
৯৪.
কিছু শব্দ রেখে
যাব নিজের জন্য
কিছু শব্দ দেব মৃত্যুকে উপহার
আততায়ীর নৈঃশব্দ্যের মত কিছু শব্দ চেতনায় ছিটিয়ে দেবে নির্বাহী অন্ধকার !
৯৫.
নাচো নাচো নাচো
আকারের প্রেত বিকারের দেবতা
হৃদয়ে আমাদের বাস্তবিক এক আলো— প্রকৃতির বুকে পশুর মমতা
!
৯৬.
ঝরে পড়বে এই ধানের শিষ— নূরজাহান রুমা হালদার এবং সরস্বতী
যদিও পর্বতে উৎপন্ন নদী তবু আমাদের বাজারের কাছে এসে হারায় সে গতি
!
৯৭.
সময় আমাদের নৌকা,
শূন্য আমাদের জল
মৃত্যুর আলোকে আমাদের পৃথিবী চির উজ্জ্বল !
দুঃখের মূর্তিটাকে পূজা করে যত গরিবের দল !
৯৮.
প্রাচীন জীবন এখনো
দেখি স্বপ্ন আর নেশায় বাঁচে
বস্তু আর ভাবের
মিলন হয় অন্ধকারের আনাচে কানাচে !
৯৯.
ঊরুর গভীরে শ্বাপদের চোখ
বুকের অভ্যন্তরে এক আনন্দলোক
আমাদের হৃদয়েই স্বাধীনতার জুয়াখেলা হোক !
১০০.
তুমি ক্লীবের স্বপ্ন খুনির কল্পনা দুঃখের খনি
আনন্দের নর্দমা তুমি
আজ কেবলই
অধরা সময়ের কন্ঠস্বর শুনি !
১০১.
সকলেই পায় তাকে
সমকামী বা বিষমকামী
উপরে ওঠে অনুভূতিযান কিন্তু বস্তুসংলগ্ন থাকে ওড়ার জমি !
১০২.
ফুল তোকে বুঝেছি আমি, ফোটা তোর সময়ের হাসি
আলিঙ্গনে ধরি যাকে
সে তো শূন্যের উচ্ছ্বাস কল্পনারাশি !
১০৩.
একদিন কল্পনায় আনন্দ
ছিল আজ শরীরে
ধরেছি তাকে
আত্মহত্যা বন্দীর স্বাধীনতা— নগ্নের প্রস্ফুটন স্বপ্নালোকে !
১০৪.
এই ফলন্ত ঊরু,
পূজার নৈঃশব্দ্য বুকে সংসার স্বপ্ন কিছু
নাই
রহস্য নদীর জলে স্নান করা আমরা
তো তোরই ভালবাসা চাই !
১০৫.
প্রকৃতির পূর্ণতা আমি—
ছিঁড়ে নে আমাকে,
চিবিয়ে খা
আমার রক্ত মাংসে
ফুলের রূপ— যত অসুখের চিকিৎসা !
*** সেলিম মুস্তাফা ২৭.০৭.২০১৮
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন