(C)Image:ছবি |
।। চিরশ্রী দেবনাথ ।।
রিনরিনে বিকেল। ফিঙে পাখির মতো একটি মেয়ে। কলেজ, থার্ড ইয়ার। ফিজিস্ক অনার্স। নাম ওড়না। ওড়নার আজ একটু মনখারাপ। রেলিং দেওয়া লম্বা বারান্দায় দাঁড়ানো। বিকেলের গ্রীবায় হাত রেখে সন্ধ্যা নামছে। ওড়নার দাদু ইজি চেয়ারে বসে মনোযোগ দিয়ে চশমার কাচ মুছছেন।
রিনরিনে বিকেল। ফিঙে পাখির মতো একটি মেয়ে। কলেজ, থার্ড ইয়ার। ফিজিস্ক অনার্স। নাম ওড়না। ওড়নার আজ একটু মনখারাপ। রেলিং দেওয়া লম্বা বারান্দায় দাঁড়ানো। বিকেলের গ্রীবায় হাত রেখে সন্ধ্যা নামছে। ওড়নার দাদু ইজি চেয়ারে বসে মনোযোগ দিয়ে চশমার কাচ মুছছেন।
আমার কিছু
কথা ছিল। দাদু শুনছেন না। তিনি এ মুহূর্তে পৃথিবীর
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করছেন। সেটি হলো চশমার কাচ মোছা। এখন সাত দশমিক আট
রিখটার স্কেলে প্রচণ্ড ভূমিকম্প হলেও তিনি নড়বেন না। চশমার কাচ মুছে যাবেন, মুছেই
যাবেন। আসলে রৌনকবাবু জানেনওড়না এখন কিছু বলবে না। ভেতরে দারুণ
নিম্নচাপ। রাতে ঝরবে অঝোরে এই বৃদ্ধ মানুষটির কাছেই। কারণ মা বাবার কাছে ওড়না ততটা
ফ্রি নয়,যতটা দাদুর কাছে। এ বিষয়ে অবশ্য ওড়না
একদিন নিজস্ব একটি মতামত দিয়েছিল,যে, পৃথিবীতে কাঁদতে হয়
কেবল বিশেষ কোন মানুষের কাছেই। সবার কাছে
কান্নাকাটি করাটা দুর্বল পার্সোনেলিটির লক্ষণ। এখন যদি তিনি মরে যান,তবে
ওড়না কার কাছে কাঁদবে? সে কি পেয়েছে সেরকম বিশেষ কেউ? না বুকে জমিয়ে জমিয়ে নিজে একদিন
পাথর হয়ে যাবে ! যেমন
অনেকেই হয়।
তীব্র
অনুভূতির,তীক্ষ্ণ মেধার ভোরের মতো সরল মেয়েটিকে তিনি বড়ো
ভালোবাসেন। কী হয়েছে,কী সমস্যা,পঁচাত্তর
বছরের রৌনক দত্ত বড়ো চিন্তায় পড়েছেন। রাত বারোটা। ওড়নার ঘরে লাইট জ্বলছে, চুপচাপ পর্দা সরালেন। বসে আছে । কাঁদছে বলে তো মনে হলো না।
ল্যাপটপ খোলা, বিছানাময় বই ছড়ানো।
দাদুকে
দেখেই গম্ভীর হয়ে বলল,
দাদুভাই সমস্যাটা হৃদয়ঘটিত নয়। উঃ যাক। তবে?
ওড়না
গম্ভীর হয়ে বলল ব্যাপারটা রাজনৈতিক।
এই
রে সেরেছে !
আচ্ছা
দাদু তুমি জীবনে কী কী পাপ করেছো?
সর্বনাশ ! রৌনকবাবু সচেতন হয়ে বললেন, সে হবে অনেকগুলো পাপ।
সবগুলো
তো মনে নেই,এই অল্পকিছু মিথ্যে কথা বলা,অসুস্থতা
ইত্যাদি অজুহাত দেখিয়ে বিপদের দিনের বন্ধুকে দুঃসময়ে না দেখতে যাওয়া,ধার চাইলে না করে দেওয়া,বিবাহিত জীবনে কয়েকবার
হালকা প্রেমে পড়া ইত্যাদি।
ওড়না বললো,ঠকিয়েছো কাউকে?কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা?রৌনকবাবু মাথা দুলিয়ে
বললেন,
নাহ, জ্ঞানত না।
তুমি কি জানো দাদু আমি তিনটে পাপ করতে যাচ্ছি।যেগুলো একই সঙ্গে
বিশ্বাসঘাতকতা এবং ঠকানো।
রৌনকবাবু
ভেতরে ভেতরে চমকালেন,বাইরে স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করলেন তা শুনি কী কী
পাপ?
ওড়না একটু চুপ করে থেকে উত্তর দিলো,আমি আমার বন্ধুর কাছ
থেকে ওর গার্লফ্রেন্ডকে ছিনিয়ে আনছি।
আরে ছিনিয়ে আনছিস মানে, তুই কি হোমো সেক্সুয়াল হয়ে
গেলি নাকি?
উঃ দাদু, তুমিও না ! জানো তো আমার একজন রোগা সোগা, ইনটেলেকচুয়েল ছেলে বন্ধু আছে।
হুম্। রৌনকবাবু সরু চোখে তাকিয়ে আছেন নাতনীর দিকে।
তারপর বললেন, তুই তো বললি সমস্যাটা রাজনৈতিক? এখন তো তা মনে
হচ্ছে না।
কেন দাদু প্রেম তো এক বিরাট রাজনীতি ! মহাভারত যত মন দিয়ে পড়ছি ততই আরো বেশী করে
বুঝতে পারছি।
রৌনকবাবু মনে মনে ভাবলেন ওকে মহাভারত পড়তে দিয়ে কি ভুল করলেন, মুখে
বললেন, বুঝলাম। ঝেড়ে কাশ তো, অনেক হয়েছে।
দাদু সামনেই কলেজ ইলেকশন। আমাদের চন্দ্রকেতু লোভে পড়েছে এবং এমন একটি
দলের হয়ে তার যাবতীয় বুদ্ধিদীপ্ত বাচনক্ষমতা উগরে দিচ্ছে যা আমি জাস্ট সহ্য করতে
পারছি না। আর পরী, এতো ব্রিলিয়ান্ট মেয়েটা, যে
তাকে ভুল পথে যাওয়া
থেকে আটকাবে, সে কিনা পেছন পেছন ঘুরছে, ওকে ইনস্পায়ার
করছে।
এখন পরীকে যদি
ওর পাশ থেকে সরিয়ে আনি , তাহলে চন্দ্রকেতু অনেকটাই দুর্বল হয়ে যাবে, মানসিক অবস্থা খারাপ হবে, অমনোযোগী হবে, ফলত সে তার গ্রহণযোগ্যতা
হারাবে।
এটা হলো আমার প্রথম পাপ।
রৌনকবাবু চমকে গেলেন। এই সুন্দর ভালো মেয়েটি কবে থেকে এরকম ধুরন্ধর
হয়ে উঠেছে। এ কি তার
চোখের সামনে বড়ো হওয়া
সেই পাখিটি , যার পাখায় আচমকাই আঁকা হচ্ছে যেন এক অন্ধকার
প্রাসাদের পথ।
কিন্তু ! কিন্তু নয় দাদু, আমি এটা করবো। স্কুল থেকে
আমাদের মনে একটা বিশেষ বোধ জন্ম নিয়েছে, এই বোধের অপমান আমি সহ্য
করতে পারবো না।
কিন্তু, পরীকে কি করে সরিয়ে আনবি?
আমার আকাশকে দিয়ে দেবো।
হোয়াট? রিলেশন কি জিনিসপত্র নাকি যে, ছিনিয়ে
আনবি, দিয়ে দিবি। এভাবে খেলা করে না ওড়না। তুই এরকম কবে থেকে
হয়ে গেলি, এতো নির্মম প্র্যাকটিকেল ! আশ্চর্য !
হ্যাঁ, দাদু, তাই হয়েছি। সব মেয়েরাই
কি নরম নরম, ন্যাকা
ন্যাকা, দুখী
দুখী হবে নাকি ? আমার আইডিয়ালিজমকে যেভাবেই হোক রক্ষা করতে
হবে। আর পরী আসলে মনে মনে আকাশকেই ভালোবাসত। কিন্তু আকাশ লাইকস্ মি।
আকাশকে যদি আমি এখন রিজেক্ট করি,আকাশ খুব কষ্ট পাবে,কিন্তু সেই
মুহূর্তে পরীকে পেলে আকাশ আঁকড়ে ধরবে।
ব্যস।
আকাশ পলিটিক্স করে না। খুব অপছন্দ করে।
মেধাবী ছাত্র, ভবিষ্যতে পি এইচ ডি করবে,বিদেশ যাবে,পরী হ্যাপিই হবে আখেরে।
আর বুঝতেই পারছো এ হলো আমার দ্বিতীয় পাপ।
রৌনকবাবু স্তম্ভিত হয়ে ওড়নার মুখের দিকে দেখছিলেন, ঠোঁট
দুটোর মধ্যে কি শুষ্কতা !
আকাশের টিন এজ চুমুগুলোও কি ফিরিয়ে দেবে কঠিন মেয়েটি ...হেমন্তের
পাতা ঝরা অরণ্য হয়ে গেছে ওড়না, কিছু দূর
গেলেই যেন শুরু হবে বরফের ঠাণ্ডা মরুভূমি।
ওড়না একটু হেসে বললো,আর তৃতীয় পাপের কথা জানতে
চাইবে না দাদু?
রৌনকবাবুর
মাথা ঝুঁকে আছে, মনে
মনে তীব্র চীৎকার করছেন, বলছেন, "না, না, না, এ হয় না ", কিন্তু কেউ
শুনছে না।
ওড়না বললো, আমি চন্দ্রকেতুর কাছে যাবো।
ওকে ভালোবাসি বলবো। আস্তে আস্তে ফিরিয়ে আনবো। আমাদের পথ এক, মনের
দূরত্ব অনেক হলোই
বা।
পলিটিক্স আর আইডিয়ালিজম, খুব
ইম্পরট্যান্ট এই সময়ে।
সামান্য ভালোবাসাবাসির অদলবদল ঘটিয়ে যদি চন্দ্রকেতুকে ফিরিয়ে আনতে পারি, তবে
পরবর্তীতে বড়ো রাজনৈতিক পরিসরে অনেক সুবিধে হবে,আর আমি তো
রাজনীতিটাকেই বেছে নিতে চাইছি।
হয়তো চন্দ্রকেতুকে আপাতত এই ভালোবাসার অভিনয় দেখাতে দেখাতে, ভালোবেসে
ফেলতেও পারি।
তবে অভিনয়টা করবো তো এখন,সেজন্য এটা আমার তৃতীয় পাপ,
কী বলো দাদু?
নাহ্ ওড়না পেছন ফিরে আর দাদুকে দেখতে পেলো না।
রাত প্রায় দুটো, দাদু বিষণ্ণমনে নিজের ঘরের দিকে
চলে যাচ্ছেন, তিনি
হতভম্ব হয়ে গেছেন।
ওড়না দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো, বারান্দার কম আলোয় মেঝের
ওপর চৌকো চৌকো ছায়া পড়েছে, গ্রিলের ফাঁক দিয়ে আসা
অন্ধকারগুলো সেই চৌকোর মধ্যে ঢুকে আছে। যেন দাবার ছক।
একুশ বছরের ওড়না পা মেপে মেপে অনিশ্চিত দাবাখেলায় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে
দিলো,
দেখা যাক !
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন