।। সেলিম মুস্তাফা ।।
কবি
হারাধন বৈরাগীর 'হাসমতি ত্রিপুরা'
ও অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ পাঠ করে আমার
প্রতিক্রিয়া বিগত ১৫.১০.২০১৮তে ফেসবুকে দিয়েছিলাম । আজ সেটাই আবার এখানে রাখছি ।
খুমপুই
খুম
মানে ফুল । পুই মানে সম্ভবত শ্রেষ্ঠ ।
আর
এটা হয়ত দোলনচাঁপারই আরেক নাম ! শুভ্র নিশিপ্রিয়া, কোমল মদালসা কিন্তু তীব্র !
এমনি এক কবিপ্রিয়ার
নাম হাসমতি । হাসমতি ত্রিপুরা ।
‘পরমা প্রকৃতি
তোমাকে নিয়েই আজকের
কবিতা
চিত্রা ছড়ার জলে উদোম
স্নান করে হাসমতি ত্রিপুরা
ধর্মবোন আমার, লক্ষ্মী
মেয়ে
সাইমার জলে সেই কবে
ধুয়ে ফেলেছে আফিমের মৌতাত ।’ (হাসমতি ত্রিপুরা-আট)
১৯৮০
সালের নভেম্বরে কাঞ্চনপুরে চাকুরীতে ঢুকলাম গ্রামীণ ব্যাঙ্কে । কিছুদিন পর সেখানে
বদলি হয়ে এলেন দেবব্রত দেব । পরিচয় নিষ্প্রয়োজন । সকলেই চেনেন বিশিষ্ট গল্পকার ও ‘মুখাবয়ব’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে । আমাদের আরেক কলিগ শিবেন্দ্র
দাশগুপ্ত । সাহিত্য করেন না, কিন্তু
হাতের লেখা খুব সুন্দর । ব্যস্, হয়ে
গেল । আমরা সাইক্লোস্টাইল করে কবিতার কাগজ করলাম ‘এই বনভূমি’ ।
সম্পাদক হোমিও ডাক্তার সত্যেন্দ্র দেবনাথ । ইনিও কবি, আমাদের মনের আশ্রয় আর শরীরের চিকিৎসক । এখনো দৈনিক সংবাদে মাঝে
মাঝে লেখেন । আছেন আগরতলা জয়নগর ।
‘এই বনভূমি’ কাঞ্চনপুরের প্রথম কাগজ । দ্বিতীয় কাগজ ‘মন্বন্তর’ ।
এটা প্রেসে ছাপা । ধর্মনগর থেকে ছাপিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম । আর এটাও কাঞ্চনপুরের
ইতিহাসে প্রথম কোন ছাপানো কাগজ । এটার পেছনের পৃষ্ঠায় কাঞ্চনপুরের অসমাপ্ত ব্রিজ
নিয়ে একটা মন্তব্য ছিল ‘কাঞ্চনপুরের
দুঃখ’ শিরোনামে । এটা পড়ে ব্রিজ
কোম্পানির ইঞ্জিনিয়াররা খুব ক্ষেপে গিয়েছিল আমাদের ওপর ।
এই বঙ্কিম দেবনাথই ‘হাসমতি ত্রিপুরা’র
কবি । হ্যাঁ, ইনিই আজকের সুকবি ‘হারাধন বৈরাগী’ । ইনি গণ্ডাছড়ায় বদলি হয়ে আরেকটা কাগজ করেন ‘বনতট’ নামে ।
অভিশাপ কখনো আশীর্বাদ হয়ে যায় । দুর্গম
জায়গায় বদলি হয়ে আমাদের জন্য কবিতার ভাণ্ডার খুলে দিলেন বঙ্কিম দেবনাথ ওরফে কবি ‘হারাধন বৈরাগী’ । গণ্ডাছড়ার জগবন্ধু পাড়াকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে কবি হারাধন
বৈরাগী ত্রিপুরার এই সুবিশাল অরণ্যজগতকে যেভাবে উদ্ভাসিত করলেন এক অমূল্য সম্পদ
হিসেবে আমাদের একেবারে হৃদয়ের কাছে, এর
মূল্য এখন বোঝা না-গেলেও একদিন ভবিষ্যৎ তাঁকে তাঁর যোগ্য সম্মান দিতে বাধ্য হবে,
এটা
অবধারিত । কারণ ওখানে যদি কোন হৃদয়বানকে যেতে হয়, সেই অনুমতি নিতে হবে হারাধন বৈরাগীর কাছ থেকেই । আর না-হলে,
সে-যাওয়াকে যাওয়া বলা যাবে না ।
এই অঞ্চল নিয়ে তাঁর একটি গদ্যগ্রন্থও আছে,
যার নাম ‘খুমপুই থেকে সিকামনুকতাই’। এটাতে রয়েছে কথা উপকথার জীবনমালা—খুমবতাং—খুমপুই
ফুলেরই যেন এক মালা, যার তীব্র মাদক সুবাস
আমাদের বিবশ করে টেনে নিয়ে যায় গহীন থেকে গহীনের দিকে । ‘খুমপুই থেকে সিকামনুকতাই’ একটি সম্পদ । ত্রিপুরার সম্পদ । আগামী পৃথিবীর মানুষের সম্পদ ।
একে ডিঙিয়ে যাওয়া যাবে না । এর ভেতর দিয়েই যেতে হবে । কারণ, হারাধন বৈরাগীই এই বনানীর প্রথম ‘রোয়াজা’ ।
প্রথম ‘অচাই’ ।
এবার বইটি পড়ে মনে হল লেখক খুব দ্রুত
নোট-ডাউন করেছেন, যখন যেখানে গল্প আর
ঘটনার সন্ধান পেয়েছেন । ফলে প্রায় একই ধরণের বাক-বিন্যাস এবং কিছু পুনরাবৃত্তি রয়ে গেছে । গোটা বইটি
পুনর্লিখিত হলে আরও সুখপাঠ্য হবে । লেখকের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, ঘরে বসে বসে শুধু কাহিনি শুনে লিখে
যাননি, প্রতিটি জায়গা ঘুরে
ঘুরে দেখে এসেছেন । মূলত ভ্রমণই তাঁর লক্ষ্য আর সে সঙ্গে অপার কৌতূহল ।
তাঁর কবিতার বই তিনটি । ‘হাসমতি ত্রিপুরা’, ‘হৃদি চংপ্রেঙ’ এবং ‘খুমপুইপাড়ায়’
। প্রথম গ্রন্থে তাকে যেভাবে পাই,
পরের দুটিতে একটু সতর্ক মনে হল । যেন
শহুরে বাতাস বিনাশ করতে লেগেছে কবির কৌমার্য ! এমন না-ও হতে পারে, তবু মনে হল আমার । আগে কিছু কবিতা পড়া যাক ।
আলোচনা বা সমালোচনা মূলত সাহিত্যপাঠেরই
রূপভেদ মাত্র । যার কাছে যেমন ।
‘চিঙ্কারা রাত্রির মতো
তুমি, অধরাই
থেকে গেছো
হাসমতি, নিস্তব্ধ
সুন্দিবন
করুই গামাই উদালের ছায়ায়
বাঁশ, বেত,
ছন্ আর
গাইরিঙের তামাটে মায়ায়
দশদিগন্ত ঘুরে ফিরে
তোমার কাছেই থমকে দাঁড়াই !’ (হাসমতি ত্রিপুরা-নয়)
কিংবা
‘...পোড়া জুমের টিলায়
পদ্মগোখড়োর মতো রিয়ার ফণায়
হাসমতি আমার রোদ আলগায় ।’ (হাসমতি
ত্রিপুরা-পঞ্চান্ন)
চিরন্তন প্রেমের কথাই । তেরে জ্যয়সা কোই
নেহি । কিন্তু এখানে পরিবেশটা অন্যরকম তাই হাসমতিও অন্যরকম, প্রকৃতির সঙ্গে একাকার এবং অধরা ।
কবির বনবাস কবিকে সমৃদ্ধ করেছে বলাই বাহুল্য ।
‘বড়দিনের বাদুড়ের মতো ঝুলে আছে
ছিন্নমূল লাফাইতি রিয়াঙের খড়ের চাল
শুকনো লাকড়ির আঁটির ভেতরে
ফেঁসে আছে সান্তাক্লজের দাড়ি...’(হাসমতি ত্রিপুরা-চব্বিশ)
ধর্মের দাড়িও ত্রিশঙ্কু হয়ে আছে । রঙ পাল্টায়
অবস্থা পাল্টায় না । তোমার পৃথিবী তোমারই ! কোন দেবদূত আসে না আঁধার বিমোচনে ।
কারণ—
‘...জঙ্গলের কোন দুয়ার নেই
চোখ নেই বসতবাড়ির মতো...’ (হাসমতি
ত্রিপুরা-ঊনত্রিশ)
তবু কবিই বলতে
পারেন— ‘...আক্রান্ত হই যেন তোমার অসুখে ।’ (ঐ)
হারাধন বৈরাগী প্রকৃত অর্থেই মিশে গেছেন একটি
আদি জনগোষ্ঠীর আত্মায় । তাই তার কবিতা পড়লেই মনে হয়, একটা দায় যেন প্রচ্ছন্ন রয়েছে, যা প্রকৃত অর্থেই মানুষের বিবশতা আর অসহায়তার প্রতি, ব্যক্তি বিশেষ বা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে
গোষ্ঠিবিশেষের প্রতি নয় । এই কবির কবিতার পকড়-টা এখানেই।
একজন জুমিয়া বরক(মানুষ) হয়ে কবি বলেন—
‘...আমার ছাইয়ের ভেতর থাকে না
কপালের অস্থি কিংবা নাভিকুণ্ডল
থাকে দাঁত ও নখ যা দিয়ে জারি রাখে
সন্তান, লড়াই
আন্দোলন ।’ (হাসমতি ত্রিপুরা-ঊনত্রিশ)
এবং এটাই চলতে থাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ।
অ-সভ্যতা, সভ্যতারই
বাই-প্রোডাক্ট যেন। শহরে যা ঘটছে, জঙ্গলেও
তাই। হাওয়া । হাওয়া কেউ বাঁধতে পারে না । একটা পুরো কবিতাই পড়া যাক—
‘গাইরিঙে কেউ এসেছিল
ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে আতকরাই
মাচাঙে পড়ে আছে রিসা
আলুথালু থালা হাঁড়ি কলস লোটা...!
ইয়াক্লির মুখে রক্তের দু’চারটে ফোঁটা
ফসলের শিষে শিষে থমথমে ভাষা ।
নিঃস্পন্দ পড়ে আছে খোঁপার প্রণয়কাঁটা
ঝরে পড়ছে খড়ের চালা হতে
টুকরো টুকরো তামাটে বেদনা ।’ (হাসমতি
ত্রিপুরা-পঁয়ত্রিশ)
হয়ত একটি ধর্ষণের কাহিনি ।
হয়ত একটি বিষাদবিধুর ব্যর্থ প্রণয়কাহিনি ।
রাইমা সাইমার সেই মিথকাহিনির একটা ইঙ্গিতও
রয়েছে যেন এখানে ।
গাইরিঙ হচ্ছে জুম পাহারার অস্থায়ী আবাস,
আতকরাই হল জুমের ধান খাবার জন্য আসা
পাখি, রিসা হচ্ছে নারীর
বক্ষবন্ধনী, আর ইয়াক্লি হচ্ছে সেই
জুমঘরে প্রবেশের সিঁড়ি । শুধু বর্ণনাই । এর বেশি বলা একজন কবির বলা নয় । এই
উল্লেখটুকুই প্রতিবাদ । প্রতিবাদ সময়ের বিরুদ্ধে, চিরকালীন অত্যাচারীর বিরুদ্ধে, পাঠকের বিরুদ্ধে, এমনকি,
স্বয়ং কবির নিজের বিরুদ্ধেও !
কবির বলার কৌশলে নিঃশব্দ চিত্র বাঙ্ময় হয়ে
ওঠে । বস্তা বস্তা কথা না-বলার এই রীতি, দুর্লভ
না-হলেও খুব কম রচয়িতার মধ্যেই লক্ষ করা যায়—
‘...আউলা খোঁপায় খুম্পুই ফুলের থোকা ।
দুপুর দু’ফালা
করে রাইমার তীর ধরে
হেঁটে যাচ্ছে হাসমতি ত্রিপুরা
মণি নড়ছে, চোখ
নড়ছে না
পা মাটি স্পর্শ করছে, নাকি
মাটি পা
বোঝা যাচ্ছে না
কথা হচ্ছে, শব্দ
হচ্ছে না—’ (হাসমতি ত্রিপুরা-ছত্রিশ)
দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে, বাস্তব থেকে পরাবাস্তব বা অধিবাস্তবে
তার গমনাগমন সহজ, শান্ত এবং অলক্ষ্য ।
সেলাই দেখা যায় না । একজন কবির শব্দ-দক্ষতা আর ভাষাশৈলী যখন তার নিরহংকার অস্তিত্ব থেকে উৎসারিত হয়, তখন তাঁর অজান্তেই কবিতা রচিত হয় । নদী
থেকে নারী, নাকি নারী থেকে নদী; পা
আর মাটি কে কাকে স্পর্শ করছে, এই
অতিসাধারণ বাস্তবও এক কুহকের জন্ম দেয় । এ সবই হয়ত একজনের জীবন ‘দেখা’র ফল । চোখের দেখা আর মনের দেখা একাকার হয়ে পাঠককে বিবশ করে
তোলে ।
‘...চোরাচাঁদ
ফোকর গলে ঢুকে পড়েছে মাচাঙের উপর
পাশ ফিরে শুয়ে রয়েছে কেউ নৈশ নদীর বাঁকের মতো...
...বটের কোটরে কেঁদে চলেছে অবোধ লক্ষ্মীপেঁচা
আমার ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়েছি আমি...’ (হাসমতি
ত্রিপুরা-তেতাল্লিশ)
রাতকে বিড়ির মতো ফুঁকছে দুজনে
মোঙ্গলীয় রাতমায়া জড়িয়ে থাকে নৌকোর গলুই
মোহিনী শ্বাসে টান ওঠে, উথালপাতাল ঢেউ
হাসমতি খেলছো তুমি জলের অতলে ।’ (হাসমতি
ত্রিপুরা-চুয়াল্লিশ)
শুধু দৃশ্যের সেটিং করে, রঙের বিন্যাসে, খুবই স্বল্পব্যয়ের কবিতা তুলে আনছে কেরোসিন ফুরিয়ে যাওয়া
চিরকালীন সেই মোঙ্গলীয় রাত যেন, যা
আমাদের কাছে খুলে দেয় গোটা লংতরাই উপত্যকা— সেই আদিম আফ্রিকা যেন !
‘ঢাকনা খুলে রেখেছে রাত
খড়ের চালে উপুড় হয়ে পড়েছে আকাশ ।
আলো নেই, নেই
অন্ধকার ।
কাত হয়ে আছি মাচাঙের উপর
মাঝে মাঝে গাড়ির হেডলাইট সূচের মতো
বিঁধছে বাঁশের ফোকর ।
আলো জ্বলছে—
আলো নিভছে—’ (হাসমতি ত্রিপুরা-বাহান্ন)
কবি অত্যন্ত সিগনিফিকেণ্ট হয়ে ওঠেন যখন তাঁর
উচ্চারণ শুনি—
‘লুকা জ্বলছে
জঙ্গল লাস্যময়ী রমণীর মতো
খুলে ফেলছে রিগনাই, রিসা—
খুলে ফেলছে রাংবতাং, ওয়াখুম,
তয়া
বেংকি, ছুরুং,
মাথিয়া—
লুকা জ্বলছে, বাবা
গড়িয়া ঈশ্বরের মতো
চলেছেন, জঙ্গল
থেকে গির্জার দিকে ।
লুকা জ্বলছে
হাসমতি, ইকোপার্কের
মতো
তুমিও খুলছো, তোমার
যা কিছু অহম অলংকার ।’ (হাসমতি
ত্রিপুরা-আটান্ন)
আর উদাহরণ বাড়াচ্ছি না । তাঁর পরবর্তী
গ্রন্থগুলো হচ্ছে ‘খুমপুইপাড়ায়’ আর ‘হৃদি চংপ্রেঙ’ ।
সেগুলোতে কবিকে আরও আঁটোসাঁটো হতে দেখা যায়, একই সঙ্গে ককবরক ভাষার বাহুল্য এমনভাবে ঘটেছে, যা কবিতাকে তথ্যকেন্দ্রিক করে তুলেছে ।
কবিতায় তাঁর তন্ময়তা যেন কিছুটা হলেও বিঘ্নিত হয়েছে । হয়ত স্থানিকতার চিহ্নায়ন
কবির কাছে জরুরী ঠেকেছে ।
তিনটি কবিতার বইয়েরই প্রচ্ছদ করেছেন
চিত্রশিল্পী ও কবি বাপ্পা চক্রবর্তী । আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে খুম্পুইপাড়ায়’এর প্রচ্ছদটি । গদ্যগ্রন্থটির প্রচ্ছদ
করেছেন চিত্রশিল্পী অমিত কুমার নাথ । রাইমা সাইমা ও নাগরাজের সমাহারে জঙ্গলি
চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত উপত্যকা । সুন্দর ।
কবির
পরবর্তী কাব্যগ্রন্থের জন্য উৎসুক রইলাম ।
তাঁর গ্রন্থগুলোর
প্রকাশক—
হাসমতি ত্রিপুরা
(কাব্যগ্রন্থ) / হৃদি চংপ্রেঙ(কাব্যগ্রন্থ) / খুমপুই থেকে সিকামনুকতাই(গদ্যগ্রন্থ)
;স্রোত প্রকাশনা, কুমারঘাট ।
খুমপুইপাড়ায়
(কাব্যগ্রন্থ);তুলসী পাবলিশিং হাউস,
আগরতলা ।
*** সেলিম মুস্তাফা / ১৫.১০.২০১৮
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন