“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৮

দেবাশ্রিতা চৌধুরীর কাব্যগ্রন্থ 'গোধূলির দিনলিপি'

।।  সেলিম মুস্তাফা ।।


...নিজস্ব নদীটি নিজেরই থাকে অতি সঙ্গোপনে... 


কবি দেবাশ্রিতা চৌধুরী এমনই বলেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ গোধূলির দিনলিপি’-তে । বইটি তিনি স্বয়ং আমাকে উপহার দিয়েছিলেন ২০১৮-র আগরতলা বইমেলায় । আমি সম্মানিত বোধ করছি এজন্য । আবার একই সঙ্গে প্রশ্নও জাগে নিজের যোগ্যতা নিয়ে । কবিতা বোঝার মতো দীক্ষা আসলেই আমার ততোটা নেই । আর এই জায়গা থেকেই আমার ভালো লাগা আর না-লাগাটুকু ইচ্ছে করে একান্তই নিজের মতন করে বলার ।

  সকল কবির মধ্যেই একটা দ্বৈতসত্তা হয়তো থেকেই যায়, যা তাকেই বিব্রত করে সবচেয়ে বেশি । হয়তো অতি কাছের লোকটিকেও । কবিরা তাই চিরঅচেনা ।

  “...ঘাসের জঙ্গলে
  ছোট্ট একটি ঘাসফুল হয়ে হয়ে মিশে যাবো
  আরেকটা আমি ঘাসফড়িং
  হয়ে আমাকে খুঁজে পাবো...     (ফেরা)

 স্বামী সন্তান সংসার নিয়ে বিশাল বটবৃক্ষের মতো যে চিরকালীন নারীসত্তাপুরুষতান্ত্রিক সমাজের পর্দার আড়ালে মূল যে অস্বীকৃত-চালিকাশক্তি, কবি এখানে যেন সেই সত্তারই বোধন ঘটান বারবার, জয়ে পরাজয়ে, কখনো সরাসরি, কখনো সহনশীলতার আড়ালে, যা প্রকৃতপক্ষে সেই সত্তার জয়ই ঘোষণা করে বারবার

  “...নিজেকে মনে হয়
  যেন একটি মাটির স্তূপ
  দূর থেকে দেখি কেউ খানিকটা নিয়ে গেলো,
  আধখানা রইলো পড়ে
  বিষাদগ্রস্ত আমি কোনখানা
  তাই অবোধ্য ! ...........

  কর্ষণে উৎপাদনেও সম্মতির
  অপেক্ষা আছে কি ?”           (মাটি)

পিকাসো চিত্রে কিউবিজমকে এনেছিলেন অত্যন্ত দক্ষতায় । চিত্রের মাধ্যমে জীবনকে দেখা বিভিন্ন কৌণিক অবস্থান থেকে, সোজা কথায় এটুকুই আমার বোধগম্যতা । কবি বিজয়া মুখোপাধ্যায় (সম্ভবত) তাঁর কবিতায় একবার বলেছিলেন, যার সাদা বাংলা এমন— “তোমাকে এদিক থেকে দেখলে ভীম মনে হয়, ওদিক থেকে দেখলে অর্জুন” (হয়তো হুবহু বলা গেল না দুর্বল স্মৃতির প্রতারণায়)। কেউ বলবেন দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ । বস্তুত এগুলো মাত্র নামকরণ । জীবনকে কি আর শুধু নামপদ দিয়ে বাঁধা যায় ? তাই গোটা ব্যাপারটাই যদি কেউ বলেন মুর্খামি, তাতেও আমার ব্যক্তিগতভাবে কোন আপত্তি  নেই । জীবন জীবনই । তবু আমরা দেখি নিজেকে উল্টেপাল্টে । এ-ও জীবনই ! তাই দেবাশ্রিতা বলেন

  “একা একা একা
  উল্টোদিকে ফিরে থাকা
  নিজের সাথে দেখা
  দূরে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে
  ওড়নাতে মুখ ঢাকা

  সে কোন জন ! আমি নাকি
  আমার ছায়া তা কি...”  (ফেরা)

কিংবা

  “একটি স্বপ্ন বুকের ভেতর গুমরে মরে
  আরেকটি সে ঘুরে বেড়ায় ভর দুপুরে...”  (স্বপ্ন)

কিংবা

  “খণ্ড খণ্ড টুকরোগুলো
  জুড়ে জুড়ে অবিকল
  চিত্র ক্যানভাসে
  আবার টুকরো টুকরো
  ছড়িয়ে ছত্রখান ।
  ফের জুড়তে বসা
  এ কেমন খেলা !”    (খেলা)

মনে পড়ে W.B Yeats-এর পঙক্তি
  
   ...Things Fall Apart; the centre cannot hold;
   Mere anarchy is loosed upon the world.      (The Second Coming)

 নারীর মুক্তির কথা আমরা বলি । নারী পুরুষ সকলেই বলি । নারীবাদীরা খুশি হন । কিন্তু এই খুশি হয়তো শুধু বাদ’-এরই  জয় আর খুশি । কিন্তু মুক্তি কই ? কিরকম সেই মুক্তি ?

  “...ইচ্ছেরা সব যা ছুটে যা
  প্রখর আলোর বাঁধন মুক্তির
  আনন্দে ঘুরে আয় এঘর ওঘর
  ভোরের আলোর কাছে ডানা দুটি
  রেখে ফিরিস,

  তোর খাঁচাতেই তুই   (ইচ্ছে)

 খাঁচা ভাঙা বড় সহজ নয় । ভাঙলেই কী হবে, আর না-ভাঙলেই বা কী ? এই উত্তরও সহজ নয় ।

 কবিতার বিভিন্ন আন্দোলন, কবিতার পূর্বাপর ইতিহাস আমি জানি না । আমি জানি না বিশ্বে কবিতা কোনদিকে দিশা নিয়েছে । তিরিশের দশকে কবিতা কেমন ছিল, চল্লিশ পঞ্চাশে কেমন হলো পাল্টে, জানি না । ষাটে এসে কেমন পাল্টে গেল তার রসায়ন আর অভিসন্ধান, সত্তরে কেন উন্মাদ হয়ে গেল কবিতা, আশি থেকে কেন তীব্র হয়ে উঠলো তার তির্যক আচরণ, কেন নালিশে শ্লেষে বিদ্রূপে বিক্ষত হতে পছন্দ হলো তার, আমি জানি না । কতখানি বিষয় আর কতখানি রূপসজ্জা দিতে হয় কবিতায় আমি জানি না । কিন্তু কবিতা অবশ্যই বলার একটি মাধ্যম। আর সব মাধ্যমেরই একটি অলিখিত অনুশাসন রয়েছে । কান্নারও রয়েছে রকমফের । সুর ও বাণীর মেল সঠিক হলেই সঙ্গীত । কিন্তু আমার জানা উড়ো খবরেরমতো জানা বলে কবিতার পাঠ আমার কখনোই সম্পূর্ণ হয় না । অধরা থাকে । সেই যে Miles to go !! তাই যতটুকু বুঝি ততোখানিই বলার সাহস রাখি ।


 প্রাণের কথা, ক্ষোভের কথা, সহজ কথা বুঝে ফেলি তাই, বুঝে ফেলি এ বিশ্বে কোন কথাই গোপন থাকে না

  "ঝর্ণা অঙ্গীকার করেছিল
  আবৃত রাখার
  কথা রাখেনি
  নদীর কাছে উন্মুক্ত হলো,
  নদীও প্রতিশ্রুত ছিল অপ্রকাশে
  সেও কথা রাখেনি
  সমুদ্রের কাছে দিলো
  উজাড় করে ।
  আর সাগর তা ছড়িয়ে দিল
  অনন্ত আকাশে...

  ফল্গুর মতোই
  কেউ ঢেকে রাখতে জানে না ।"   (গোপন কথাটি)

 নারীত্বের মহিমাটি দেবাশ্রিতা খুব সুন্দর করেই ব্যক্ত করেন, তাঁকে ছোঁয়নি এখনো কোন অধীর জটিলতা

  “দেশলাইয়ের বাক্সটি জানে
  বারুদবুকে বেঁচে থাকার মহিমা
  জ্বালায় জ্বলে যাওয়া আছে
  তবু পুড়তে চাওয়া অপরিসীম...

  পুড়বে জেনেও ঝাঁপ আগুনে
  জ্বলে পুড়েই সুখ ।"           (পতঙ্গ)

কিংবা

  “এমন তো কথা ছিলো না
  নিজস্ব নদীটি কারো কাছে
  সমর্পিত হবে !...

  কত খড়কুটো ভেসে আসে
  কিছু তুলে আনা আর

  কিছু ফেলে দেওয়া যায় ভেসে ।

  শুধু নিজস্ব নদীটি নিজেরই থাকে
  অতি সঙ্গোপনে ।"                  (কথা ছিলো না)

 প্রতিবাদের এক ধীর আত্মবিশ্বাস কবিকে প্রতিষ্ঠিত করে

  “... কে তুমি ঘোমটার আড়ালে ?
  ক্ষুধার অন্ন সন্ধানে আর কোন
  পথ ছিল না বাকি;
  তবে কেন দরদর আঁখিধারা
  থরথর কম্পন !

  কোন লাজে মুখ ঢাকো অবগুণ্ঠনবতী
  এ তোমার নয়
  যারা দিয়েছিল অঙ্গীকার অন্ন বস্ত্রের
  জেনো শুধু এ লজ্জা তাদের ।"            (লজ্জা)

 আর কথা বাড়াচ্ছি না ।  কিছু কথা না-বলা রইলো যদিও ।
 এ কবির সরলতাই তাঁর সম্পদ । কোথাও কবিতাকে ডিঙিয়ে গেছে বিষয়-ভার । কখনো  দার্শনিকতা প্রকট হয়েছে বলে মনে হয়েছে আমার, যা কাব্যকে হয়তোবা বিরক্ত করেছে । কিছু বানান-বিভ্রাটও রয়ে গেছে বইটিতে । তবে বইটির অত্যন্ত সুন্দর শরীর । প্রচ্ছদ-শিল্পী চারু পিন্টু কে আমি চিনি না, কিন্তু প্রচ্ছদ খুবই অর্থবহ আর সুন্দর । নীহারিকা প্রকাশনীর আরও প্রচ্ছদ আমি দেখেছি চারু পিন্টুর করা কাজে । সবগুলোই যথেষ্ট সম্ভ্রম আদায়কারী । নীহারিকা প্রকাশনীকে ধন্যবাদ এমন কাজের জন্য । কবির পরবর্তী গ্রন্থের জন্য প্রতীক্ষায় থেকে এখানেই ইতি ।

                                                                   ১৬.০৬.২০১৮




কোন মন্তব্য নেই: