।। সেলিম মুস্তাফা ।।
কাফের !
শিলচর থেকে তরুণ কবি দেবপ্রতিম দেব পাঠিয়েছেন তাঁর (সম্ভবত)
প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কাফের’ । ৫৮ পৃষ্ঠার একটা ছিমছাম এবং খুবই শোভন একখানা বই । হ্যাপী
দে কৃত সুন্দর প্রচ্ছদ ।
কাছাড়ের বাংলা সাহিত্যে বহুদিন, সেই সাতের দশক থেকে, আমরা দেখে আসছি কোলকাতার ঘনিষ্ট এবং উল্লাসকর ছায়াপতন । দেখে আসছি ১৯শে মে
বিজড়িত ক্রন্দনমুখরতার চটজলদি কোরিওগ্রাফি । এ গ্রন্থটি সম্ভবত এই সমস্ত কিছুর
প্রেক্ষিতেই এক ‘কাফের’ ।
দেবপ্রতিম ইংরাজী সাহিত্যে পোস্টগ্রাজুয়েশন করছেন, বইটির ব্যাক কভারে এমনই লেখা রয়েছে । তাঁর কবিতাগুলো পড়লে
এর সুবাস পাওয়া যায় । একটু বেশিই পাওয়া যায় বোধহয় ।
ফলে, ব্যক্তিগতভাবে
আমার কিছু যে অসুবিধে হয়নি, এমন নয় । কবিতার
রসাস্বাদনে মাঝে মাঝেই বিঘ্নিত হয়েছি । তবু ভাল লেগেছে তিনি ‘কাফের’ বলে । এটা ঐ অঞ্চল
থেকে এটা যেন এক নতুন হাওয়া নিয়ে এলো ।
‘প্রেম’ কথাটি প্রায় অনুচ্চারিত, পরিবর্তে এসেছে ‘প্রেমিকতা’ । এ যেন এই ‘সেল্ফিযুগের’ সঙ্গে মিল রেখেই এক ব্যঙ্গসুন্দর প্রতিবাদ ।
প্রথম কবিতাটির নাম ‘মাল্বিকা’ । কেন এমন এ নিয়ে আমার কোন প্রশ্ন নেই । হিন্দী সিরিয়েলের
প্রভাবেও হতে পারে, না-ও হতে পারে ।
এতে মালবিকার মনে আদৌ কোন বিকার ঘটলো কিনা তা-ও মূল্যবান নয় । কিছু সুন্দর কথা আছে
এই লেখাটিতে—
“তোমার রাশিয়ায় শুধু বরফ
বারুদমাখা রক্ত
শুয়ে আছে, অবরুদ্ধ যাতায়াত ।
.........................................................
তর্কের আদলে
বিবস্ত্র জার্মান বাঙ্কার, কাতুকুতু খেলে
ভয়, ধূসর ক্যালকুলাস—...”
এমনি চমক দেয়া দারুণ সব পংক্তিবিন্যাস রয়েছে তার গ্রন্থটিতে
। শত সপ্রতিভতার আলেপন থাকলেও কবি ঘরের কাছেই ধরা পড়ে যান সেইসব মর্মবেদনার কাছে, যা আমাদের একান্ত আপন অসহায়তা । এই কনফেশনই হয়ত কোন
স্রষ্টাকে তাঁর অভিযানের পথে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যায়...
“...ধর্ষিতার ক্ষত দেখিনি কখনো, দুঃখ বুঝতে পারি;
শব্দহীনতায় যখন
মূক, নতুন ভোরের কথা বলতে পারিনি । ...” (অঙ্গরাজ)
নয়ের দশকের মাঝামাঝি কবির জন্ম । তাহলে ধরা যায় মোটামুটি
প্রথম (?) দশক
বা কিঞ্চিৎ অতীত থেকে তার প্রসববেদনার শুরু । এই সময়ে তারা বাংলা কবিতার
জগতে যা পেয়ে থাকেন উপঢৌকন বা উত্তরাধিকার হিসেবে, সেটা ব্যঙ্গ, শ্লেষ, আপন জীবনকে অস্বীকার করার প্রবণতা, যা সাতের দশক থকে শুরু হয়ে ক্রমশ ক্ষুরধার হয়ে এসেছে
অদ্যাবধি । আবার যেহেতু এখন ইন্টারনেটের যুগ, বাংলা সাহিত্য ছাড়াও অন্যান্য দেশীয় এবং অভারতীয় সাহিত্য মুহূর্তেই পাওয়া যায় চোখের সামনে । কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই
দেখেছি, এর প্রভাব থাকলেও তা সুষম নয়, একটু এবড়ো-খেবড়ো যেন । এর উদ্দেশ্য-বিধেয় বা নতুনত্বের কথা
যদি বাদও দিই, তাহলেও কিছু তো আমাদের পাওনা থাকে তাঁদের
রচনায়, এমন কথা মনে আসে । কিন্তু, সেটা কী ? তাদের পায়ের তলার
মাটিটা কী এবং কেমন ? একমাত্র ভবিষ্যেই
নিহিত রয়েছে এর উত্তর । ততদিন অপেক্ষা ।
সর্বদা সব কথা কবিতা হয় না । সর্বদা সব কথা সত্য হয় না ।
কথা হল দেবপ্রতিম কি আমাদের অনুযোগের লক্ষ্য ? জানি না । সেটা তিনি নিজেই বলবেন ।
“...সাইলেন্সার কেটে ফেলা মোটোরবাইকের মতো
এখন সেলফিবাজ সময়, খোলা আকাশের গান হয়
আর মুক্ত প্রেমিকতায় ভরে যায় ইনবক্স । ...” (রুদ্র)
খুবই শব্দসচেতন এই কবি । হিসেবী কবি । শব্দের মিতাচারে
বিশ্বাসী বোঝাই যায় । তাঁর ছোট ছোট অনেকগুলো রচনা রয়েছে গ্রন্থটিতে ।
“...শীতল ঝড় । জমাট
অক্ষর ।
থামছে রূপক, হয়তো উষ্ণতাও ।
কথা ছিল দেখা হবে ।
কথা ছিল । ...(বাক্স)
আবার শব্দের তুফানও তুলতে সিদ্ধহস্ত । আর এখানেই এক উদ্দাম
কবির সাক্ষাৎ পাওয়া যায়—
“কয়েকজন লোক আমাকে
নিয়ে যাচ্ছে কাঁটাতারের ওপারে
যাদের কোনো আদালত নেই, নেই কোনো পিনাল কোড... ... ...
... লাইটপোস্টের পায়ে বাঁধা আমি একখানা চটিবই
মলাটে আবদ্ধ পাখি— আমি জানি এটা বদ্ধভূমি,
আমার পাশে বয়ে যায় নিশুতি নালায়
রেললাইনে কাটা আগাছার কাট’-মুণ্ড থেকে রক্ত,
মৃত কুকুরের ঘিলু, মৃত ইঁদুরের হাড়, সফেন সাবান-জল,
শুকনো কষের গন্ধ-লাগা রাখেলের দামী চাদর,
আমারই মল-মূত্রে জং-ধরা আমার ছিঁড়া-খুঁড়া কাপড়,
উলঙ্গ মির্জা,
রাত এগারোটায় ভীড় করে আসা
বাষট্টি চড় পিলারে ঠোকর তিল তিল বেধড়ক
জিজ্ঞাসাবাদের পর বলেছি আমি সেই চটিবইয়ের কথা,
মলাটে আঁকা পাখির কথা,
তার কবিতার কথা,
শূন্য দশকের
বিকারগ্রস্ত যোনিদেশের কথাও,
দুর্বোধ্য ক্রিটিকের কথা আঁতেলের ভাষা,
উঁচু-মানের প্রেমের ফাটকা রাবীন্দ্রিক সান্ত্বনা... ... ...
... গেরিলা কবির ঘিলু, গোর্খা আন্দোলনের হাড়, আমার লাশ,
কাশ্মীরী জিহাদের মাসিকের ন্যাকড়ায় মোড়া রক্তাক্ত বইয়ের
পাতা,... ...
... এদিকে অন্ধকার, অন্ধকারের ওপারে— ঘনঘোর পতনরেখা,
মনে রাখবেন— চণ্ডালিকার
প্রেমিক চণ্ডাল নয় । ...
(বদ্ধজনের কবিতা)
তাঁর আরেকটি রূপ— কামনার কাব্যময় অধিপতন...
“তোমার খাবার-ঘরে
আমরা দু’জন, একা ডাইনিং ।
না-শব্দ
সেই ঝুঁকে যাওয়া মেরুদণ্ড, আড়চোখ, চুল সরানো আর
কপালের ভাঁজ,
সেই একই ভাবে তোমার উঠে পড়া, তারপর লুকোচুরি । ... ...
লালচে পর্দার গায়ে দৃষ্টিকোণ, কালো ট্রান্সপারেন্ট
ভেতরে পাকিজা,
ঠিক যখন সমস্ত শহর আলো জ্বালাবে, অন্ধকারে,
অলিগলি রোমন্থন,
নদীর ঊরুদেশে নিখোঁজ, গ্রীষ্মর ঘেমো নদ, আর্ত মিশনারি ।...
... (দ্যা রিভার)
এ ছাড়াও আরও বিভিন্ন আঙ্গিকের রচনা রয়েছে এই দুই মলাটের
ভেতরে । উদাহরণ আর বাড়াচ্ছি না ।
সারা বইটিতে একটি ব্যাপার আমার মনে হয়েছে, কবি তার নিজস্ব ভাষার খোঁজে বেরিয়ে পড়েছেন । নিজস্ব
ভাষাশৈলী কবিতার ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার অবশ্যই । বহুবছর
লিখেও আজও অনেকেই তা খুঁজে পাননি, এ কথা
নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি । দেবপ্রতিমের এ ব্যাপারে একটা বিশাল যুদ্ধ রয়েছে তাঁর
নিজের সঙ্গেই যেন । হয়তো একান্তভাবে নিজেকে উজাড় করে দেয়া ছাড়া সেই লক্ষে পৌঁছানো
না । আমার ব্যক্তিগত ধারণা কবিতা লেখার জন্য যে আত্মপীড়ন, যে যাত্রা আর অভিযাত্রা, সেটাই কবিতা ।
যেখানে শিলচর তথা কাছাড় ছেড়ে অধিকাংশ কবি সাহিত্যিকরাই
বহিঃরাজ্যে আপন আপন নীড় খুঁজে নিয়েছেন,
এবং যারা, যদি কোন কারণে একান্তই ফিরে আসেন কখনো, সেখানে কি ফিরে পাবেন কোনো বনলতা সেনকে, যে বলবে, এতদিন কোথায় ছিলেন
? সেখানে এই কবির উঠে দাঁড়াবার এই
সংগ্রামকে আমার ব্যক্তিগত তরফ থেকে সেলাম জানাই । ‘কাফের’-এর জয় হোক ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন