।। সেলিম মুস্তাফা ।।
“চৌকাঠ পর্যন্ত এগিয়ে...”
চাঁপাবেড়িয়া, বনগাঁ,
উত্তর ২৪ পরগণা থেকে তিনটি কবিতার বই
পাঠিয়েছেন কবি সুশান্ত ভট্টাচার্য । কবিকে ফেসবুকে পাওয়া যাবে “সংকেত সুশান্ত ভট্টাচার্য” নামে । “সংকেত” শব্দটি
তাঁর সম্পাদিত কোন পত্রিকার নাম । কবির জন্মসাল ১৯৬৪ । লেখালেখির ১৯৮৭ সাল থেকে ।
যে বইগুলো তিনি পাঠালেন সেগুলোর নাম “চৌকাঠ পর্যন্ত এগিয়ে”, “রাজার পোস্টঅফিস” ও “ঘুমিয়ে
পড়েছে সব ভাষা” ।
কবি ব্যক্তিগতভাবে আমার পরিচিত নন ।
ভালবেসে বই পাঠিয়েছেন । তাই কবিতাগুলো পড়তে হয়েছে কবি-ব্যক্তিকে কবিতা থেকে
বিচ্ছিন্ন রেখেই, এমনকি কবিতাগুলোকেও
তাদের জন্ম-পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে । তাই সব ভালবাসা, ভালোলাগা, আলোচনা,
সবই শুধু তাঁর রচনাকে ভিত্তি করে ।
কিছুটা Art for art”s sake-এর
ধরণে যেভাবে শুধু শিল্পটিকেই বিচার্য ধরা হয় । তবে সেটাও আমার মতো অদীক্ষিত লোকের
পক্ষে সম্ভব নয় । তাই, শুধু
আমার ভালোলাগা আর ভালো না-লাগাকে কেন্দ্র করে দু-চার কথা ।
বইয়ের ব্লার্ব থেকে জানা যায়, তিনি বিশ্বাস করেন যে ভাষা ঘুমিয়ে পড়েছে
। গ্রন্থগুলো পড়ে, ভাষাকে জাগাবার তার
ইনোসেন্ট প্রয়াস নজরে আসে । তাঁর কবিতা লেখার নিরলস শ্রম আমাকে টেনে রাখে, শ্রদ্ধা আর মুগ্ধতা জাগায় ।
তবু একটি কথা বলতেই হয় । তিনি শব্দ-ক্ষেপণে
অত্যন্ত চঞ্চল, যা পোয়েটিক
জাস্টিফিকেশনকেও কোন কোন সময় লঙ্ঘন করেছে এমন ভাবে যে কবিতার নিটোলতাকে, অনিবার্যতাকে তছনছ করে ফেলেছে বলে মনে
হয়েছে ।
একটি বাক্যে (ভাষায়) সংযোজিত শব্দাবলীর
অনিবার্যতা বা তার গঠনতত্ত্ব সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা না-থাকলে— যা আসে আমাদের পূর্বধারণা, অবধারণা বা কমনসেন্স থেকে, তাকে ভাঙার চেষ্টা সার্থক হতে পারে না ।
একটা শৃঙ্খলাকে আর একটি শৃঙ্খলা দিয়েই প্রতিস্থাপন করা যায় বা বদলে দেয়া যায়,
বা ভাঙা যায়, এমন মনে হয় আমার । আধুনিকতাবাদের বড় লক্ষণ বিচ্ছিন্নতাবোধ (Alienatin)
এবং নিরাশা বা হতাশা (Despair)। আর এই সবকিছুর ওপর সমকালীন ভাষা দাঁড়িয়ে
। ভাষাকে জাগাতে হলে, তার রসায়ন জানা
সর্বাগ্রে প্রয়োজন বলে মনে হয় আমার ।
তাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রচুর । অজস্র
পুরস্কারও পেয়ে গেছেন ইতিমধ্যে, এছাড়া
সম্মানিত হয়েছেন বহুবার । সুনীল গাঙুলি, জয়
গোস্বামী, অমিতাভ গুপ্ত এবং শঙ্খ
ঘোষ তাঁর ভালোলাগার কবি ।
আজ এই কবিতাপাঠের মাধ্যমেই তাঁর
গ্রন্থগুলোর প্রাপ্তিসংবাদ জানাবার সুযোগ নিলাম ।
“...গোপনতা খুলে দেখি
সবখানে তুই
যেন আবডালে বসে আছে
একটি বাবুই।” (বাবুই)
চৌকাঠ পর্যন্ত এগিয়ে এসে দেখা যায়
প্রেমই তার মুখ্য বিষয় । নানান ভঙ্গিতে প্রেমেরই রূপদর্শন, কখনো বাকপ্রতিমায়, কখনো
সরাসরি দার্শনিক বাক্যে । ভাঙার তুমুল আগ্রহে কবি বার বার কবিতার লেখ্যরূপকে
ধ্বস্ত করার প্রয়াস নিলেও তা প্রতিবারই কোন প্রচলিত ফর্মেই আত্মসম্বরণ করেছে ।
কবির খুবই প্রিয় সিঁড়িভাঙা অংকের আদলটি ।
“...আত্মা থেকে সরিয়ে নিয়েছি মাটি
মন্থনে বিষ
হাট করে
খোলো,
অবাক জানালাটি...
ওপারে জেগেছে
মুনিয়ার ঠোঁটে
ঠোঁট ছোঁয়ানোর দায়
নিখাদ থেকে
সাদা
পাতাগুলো,
কত কী ফেরত চায় !”... (মুনিয়া)
খুব সুন্দর শব্দ চয়ন । আরও কিছু পড়া যাক ।
“...হোমের আরতি থেকে,
কখন তুই
নিভে যাওয়া পিলসুজ।
পূজারীর অগোচরে
ঈশ্বর
কামড়ে দিল ঠোঁট
স্তন থেকে ফিনকি দিয়ে ওঠে পুঁজ ।
ভেতরে অনন্ত ডুব, জগৎ
ইশারাময়
সাংকেতিক...
সংক্রামক...
আজ একটা আত্মহত্যার চূড়ান্ত বোঝাপড়া হোক । (দ্বৈত সঙ্গীত)
তাঁর ভাষা কিছুটা যেন টেলিগ্রাফিক ।
লক্ষ করি যে অন্ত্যমিল দেবার একটা প্রচ্ছন্ন প্রবণতা তাঁকে শেষ পর্যন্ত বেঁধেই
রাখে, অথচ তিনি মুক্তি
চেয়েছিলেন । কোথাও না কোথাও একটা অন্ত্যমিল দেবার সুযোগ পেলে তিনি তা হাতছাড়া করেন
না । আমার কাছে এটা একটু প্রথাগতই মনে হয়েছে, কখনো মনে হয়েছে রচনাটির কৌমার্য হয়ত বিঘ্নিতই হল । তবে এটা
সম্ভব হয়েছে, তাঁর অধিগত অফুরান
শব্দভাণ্ডারের দৌলতেই । শব্দ নিয়ে কবির যে খেলা, তা চমৎকার হলেও, বিষয়ের
অন্দরমহলে তাঁর চলাফেরা অবহেলিতই রয়ে গেছে বলে আমার মনে হলো । বিষয়-সর্বস্বতা যেমন
কাম্য নয়, তেমনি ফর্মের
ক্যারিকেচারও মন টানে না ।
কবিতা তাহলে কোথায় থাকে ?
হয়ত এর খোঁজেই যে পথচলা, তা-ই কবিতা ।
হাংরি কবিতা, এংরি কবিতা, নিম
কবিতা, না-কবিতা, বিষয়হীন কবিতা, কাট-আপ কবিতা, যে
কবিতাই হোক, সবই কিন্তু
কবিতা-মন্দিরের সিঁড়ির কাছেই আকুলিবিকুলি করে চলেছে । হ্যাঁ আজ অবধি । অর্থাৎ,
যে ধরণের কবিতাই হোক, তাকে শেষ পর্যন্ত “কবিতা”ই হতে হচ্ছে বা হতে হবে । কারণ বিষয়হীনতাও একটা বিষয়, আর না-কবিতাও কবিতা । বব ডিলানের ফর্মেট
নিন, আর বাকোয়াস্কি, বা বারোজ, বা
একান্ত অচেনা কোন আত্মা বা চেহারাই নিন, অন্তিমে
তাকে কবিতাই হতে হবে । কারণ আমরা লিখছি কবিতা । আর তা যদি না হয়, তাহলে তো “কবিতা” বলা
বা আলোচনার প্রয়োজনই হয় না ।
দেখা যায় একটি নিখুঁত রচনাও
কবিতাপদবাচ্য হয়ে ওঠে না, কারণ
সেটা হয়েই ওঠেনি । এবং এই “হয়ে-ওঠা”র কোন লিখিত বা গুরুনির্দেশিত ফর্মুলা
নেই । এই বিষয়টাতে অনেকের আপত্তি থাকতে পারে । যুক্তি-তর্কের বাইরে গিয়ে কবিতার “হয়ে-ওঠা”র কোন লৌকিক বা অলৌকিক ব্যাপারে অনেকেরই বিশ্বাস নেই ।
সেক্ষেত্রে একথাও বলতেই হয় যে, “সকলেই
কবি নয় কেউ কেউ কবি” এই কথাটাও আর কোন
অর্থ বহন করে না । আবার একটি কবিতা আরেকটির মতন হলেই গেরো ! বাতিল ! কারণ কোন লেখার
“মৌলিকতা” একটি বড় বিষয় । কেন এমন হয় ? হয়ত পড়াশোনা থেকে, অনবধানবশত
অন্যের পঙক্তিকে নিজের বলে মনে হয় কখনো ।
এই বিপদ থেকে বাঁচার একটাই পথ, নিজের মধ্যে থাকা, শুধু নিজেকেই, নিজের জীবনকেই ব্যবহার করা ।
এই কবি মাঝে মাঝেই চমকে দিচ্ছেন—
“...নিরাভরণ
তোমার ব্যথার পাশে
একটু একটু
সরিয়ে দিচ্ছি মাটি...” (তোমার ব্যথার পাশে)
“...ঢেউয়ের পর
ঢেউ জুড়ে
দিই
স্বভাবে ছিঁড়েছি উড়বার কৌশল
অপরাহ্ণের ভাঁজ খুলে দেখি
নেভা
তারাটির
বুকে দু”ফোঁটা জল । (স্বভাবে ছিঁড়েছি)
খুব সুন্দর কথাগুলো । অপরাহ্ণের ভাঁজ
খোলার কল্পচিত্র বিষণ্ণতা ঘনিয়ে আনে । কবির সুন্দর ভাবনা আর দেখার চোখ অন্ত্যমিলের
গ্যাঁড়াকলে বারবারই যেন এক বিলাসিতায় পৌঁছায়, যা বক্তব্যের পরিবেশকে ক্ষুণ্ণ করে । “কৌশল”-এর
সঙ্গে “জল”-এর মিল দেবার এই কৌশল কবির
শব্দ-চতুরালিকেই নির্দেশ করে মাত্র ।
আমি এটুকুই বুঝতে চাই যে, “চৌকাঠ পর্যন্ত এগিয়ে”, কবি দেখলেন “ঘুমিয়ে পড়েছে সব ভাষা”, যা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ পর্যবেক্ষণ, কিন্তু কবি কি ডিঙোলেন শেষ পর্যন্ত সেই চৌকাঠ ? দেখা যাক আরও কিছু কবিতা পড়ে—
“...আমি পড়ি দু”অক্ষরে একটা দেশ
আমি পড়ি
জলশূন্য মেঘ
আমি পড়ি
বিষণ্ণ তালপাতা
আমি পড়ি
ছেলেকে ভাত বেড়ে খেতে দিচ্ছে
ইন্দির ঠাক্রুন
সব মেঘ সর্বজয়া— ছলোছলো
হরিহর— ছড়ানো উদ্বেগ
এই হাত অঞ্জলিচর্চিত
এই হাত যত সব আত্মঘাতী পাখিদের
ঠুকরে খাওয়া আলো...” (সব মেঘ সর্বজয়া)
ভাষা আসে কোথা থেকে ? আমার ব্যক্তিগত ধারণা, ভাষা আসে বিষয় থেকে । বিষয় স্থির করে
দেয় রচনাটির ভাষা কেমন হবে । আবার ভাষা সচেতনভাবে পাল্টে দিলে, বিষয়ও কিঞ্চিত অন্য কথা বলে ।
এক একটি ব্যক্তি কিছু বিষয়ের স্তূপ,
কিছু “ধারণা”-র
স্টক । শব্দের স্তূপ তাকে পাথর করে রেখেছে । তাই নিজেকে না-ভাঙলে শব্দ পথ পাচ্ছে
না, শব্দের বিস্ফোরণ না-ঘটলে ভাষা রূপ
নিচ্ছে না ।
কবি সুশান্ত ভট্টাচার্য অত্যন্ত
শব্দ-সচেতন কবি । শব্দের অতুল ভাণ্ডার তাঁর রয়েছে । হয়ত শব্দের সমাহারকেই ভাষা
ভেবেছেন কবি ! চৌকাঠ পর্যন্ত এগিয়ে, মূলত
আমরা সকলেই থমকে যাই । ঘরের অন্ধকারে বসে একা একা ভেবে যা সত্য ভাবি আর যা
পরিবর্তন করার কথা ভাবি, ঘরের
বাইরে এলেই চোখ ধাঁধিয়ে যায় । কত হাজার হাজার পঙক্তি রচিত হচ্ছে রোজ । বাইরে কোথায়
খুঁজি ! কী পাল্টাবো আমি ? কী
করে পাল্টাবো ?
শব্দের আঘাতে শুধু শব্দই হয়, পৃথিবী জঞ্জাল মনে হয় ! তবু তিনি কিছু
কাজ করেছেন এই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, যা
আর নতুন মনে হয় না । বিশেষণকে বিশেষ্যরূপে ব্যবহার । বেশ কয়েকটি রচনায় এমন বিন্যাস
রয়েছে । এটার চল হয়েছে বেশ আগেই । আমি নিজেও যে এমন করিনি তা নয় । তবে এটার
ব্যবহার উৎকট হলে বড্ড চোখে পড়ে । আমার মনে হয়েছে এতে কবিতার তেমন কোন উৎকর্ষ
বিকশিত হয় না আদৌ ।
কোন রচনায় যদি রচনাকারের সপ্রতিভতা রচনার
চেয়ে বড় হয়ে ওঠে, যদি চোখে আঙুল দেয়,
তাহলে রচনাটি যে মার খেল, তা বলাই বাহুল্য । আমি শুধু আমার
ব্যক্তিগত রুচি থেকেই কথাগুলো বলছি । এটা কোন সিদ্ধান্ত অবশ্যই নয় । তেমনি আমার ভালোলাগাগুলোও
নিতান্তই ব্যক্তিগত । এখানে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই । আবার বিশেষণের এরকম গাঁথুনি
কোথাও যে মুগ্ধকর হয়নি তা-ও নয় ।
“...পাথরের নিঝুমটুকু বোঝে নাকি রক্তের দায় ?” ... (ভূমিকা
জুড়ে দিলেই) >নিঝুমটুকু ।
“...ধ্যানের নির্জন দিয়ে চিনি”... ... (আগুনখাঁচা)
>নির্জন ।
“...জলের নির্মম জেগে ওঠে”... ...(বিরতির রেখাগুলি) >নির্মম
।
“...চুপের ভেতর নেমে অতলান্ত ছুঁয়ে ফেলাকেই।”... ...(কবিতা এভাবে ভাবি) >চুপের ।
এই কবির সাহিত্যপাঠ যথেষ্ট রয়েছে,
তা টের পাই । এই বিশ্বের তাবৎ ঘটনা
দুর্ঘটনাও তার মননে ক্রিয়াশীল । সুনীল থেকে অয়দিপাউস, একুশ থেকে শাহবাগ তাকে আলোড়িত করে যায় । তবু মূলত তিনি এক অন্তর্লীন
কবি— যদিও চঞ্চলতা তাঁর সহজাত ।
“অনেকগুলো পাথর কখন পথ হয়ে গেছে
একটিই পথ কখনও অনেক, অনেক
টুকরো পাথর”... (পথ
ও পাথর)
“...একটা আঁশবটি উবু হয়ে শুয়ে আছে
যেন বজ্রকঠিন, যেন
আধভেজা সত্তর” । (সত্তর)
তার ভাষা, তার শব্দ, তার
বাকপ্রতিমা, ঝক্ঝক্ করে ।
অনেক কথাকে একসঙ্গে ধরতে চান । দীর্ঘকবিতাকে মুঠোর মধ্যে এনে ফেললে আমাদের পাঠের
অভ্যাস কিছু হলেও ধাক্কা খায় । হয়ত আমাদের এই অনভ্যাসের ভেতর দিয়েই তাঁর তরতর করে
চলে যাওয়া—
“বাতাসের কি উনুন থাকে, কাজল
লতা
ভাসতে ভাসতে কতদূর যায়...
দূরে ওই ছলাৎ ছলাৎ পাড় ভাঙছে
অনাহূত সত্তর লিপিবদ্ধ, তারও থাকে দায় ।
যত ভাসান-রীতি মুখস্থ করেছি এতদিন
লুকোনো ছুরির মাথায় সময় ছলকায়
নৌকোর গলুই শুধু ধাক্কা মারে, কার ছিন্ন শির
কে এখন শিরা কেটে দেখায় রুধির ।
কে এখন কবিতা সম্ভবা— ধ্যানের
নির্জন দিয়ে চিনি
এত যে বকুল শ্বাস, তবু
সে দীপ্ত মেহগিনি ।
আগুনের কি খাঁচা থাকে ? এতো পাখি, গুপ্ত
কথকতা
ইঁদুরের ছদ্মবেশ— দাঁতে
কেটে কে খায় আমার কবিতা ?” (আগুনখাঁচা)
শঙ্খ ঘোষের একটি ছোট্ট কবিতা আছে,
যা এই কবিতার একটি পঙক্তি মনে করিয়ে দিল
। “কার ছিন্ন শির” । এমন হতেই পারে । শব্দের পাশে শব্দ বসিয়ে, ছন্দের ছুরির ফলায় যিনি কবিতাকে ধরেন
তিনি শঙ্খ ঘোষ । তাঁকে ভালবেসে, তাঁকে
এড়িয়ে যাওয়া খুব কঠিন ।
কবি সুশান্ত ভট্টাচার্যের অধিকাংশ রচনাই
কিছুটা কোলাজধর্মী । ঠিক একইভাবে বলা যায় গোটা গ্রন্থটাই যেন একটা গোটা কোলাজ ।
এটা আমার কাছে দুঃসাহসিক । কারণ এখানে কমপক্ষে নিজেরও একটা স্যাটিসফেকশনের ব্যাপার
থেকেই যায়, যদিও অনেকেই তা মানতে
রাজী হবেন না । আজকাল সার্থকতা বলে কিছু আছে তা অনেকেই মানেন না ।
“ব্যথা মাড়িয়ে খালি পায়ে বৃষ্টি হেঁটে গেছে ।
জীবনের অর্ধেকটাই তো ক্রুশকাঠ
অর্ধেকটা যীশু
পেরেক কি
শুধু ক্ষমার উপমা ?
বন্ধুর লাশ পুড়িয়ে এলাম
পিচরাস্তায় কুকুর শুঁকছে
রক্তমাখা জামা ।
গুলিটি ঠিক কোথায় লেগেছিল
গুলিটি ঠিক কারা চালিয়েছিল
সেটা বড় কথা নয় ।
এত কৃষ্ণচূড়া একসাথে ফুটে উঠতে
আগে কখনো দেখিনি ।
ব্যথাকে মাড়িয়ে বৃষ্টি চলে যাবে
ঝড় চলে যাবে
এমন কি
চালি বাঁধার মানুষ ।
নৈঃশব্দ্যের বাজনা বাজিয়ে হাঁটবে তুমুল
বন্ধু, তোমাকে
তো দিয়েছি সব
ভাঙনের একুল, ওকুল...” (বধ্যভূমি)
সময়কে মুহূর্ত মুহূর্ত করে ধরার একটা
প্রয়াস খুব চোখে পড়ে । এই কবির যেন এটাই দর্শন । অস্তিত্বের ভেতরে মায়া আর
বিভ্রমের খোঁজ, যা তাঁর রচনায় দানা
বাঁধতে বাঁধতে আবার বাস্তবের কঠিন পাথরে আছড়ে পড়ছে । একথা অনস্বীকার্য, সব কবিতার কবি নিজেকে ১০০শতাংশ ঢেলে
দিতে অসমর্থ রয়েছেন, হয়ত বেশি বেশি লেখার
কারণে এমন ঘটেছে ।
ভাষা নিয়ে তাঁর যে ভাবনা, তাতে রয়েছে এই সময়ের সেই গূঢ় সমস্যাটি,
যা নিয়ে কমবেশি সকলেই ভাবিত । অর্থাৎ
ভাষা মরে যাচ্ছে, বা মরে গেছেই
ইতিমধ্যে । তবে একজন কবির মুখে “ভাষা”
শব্দটি নিশ্চয় আরও গভীর অর্থ বহন করে ।
আর সেই ক্ষেত্রটিতে কাজ করতে হলে কবি সুশান্ত ভট্টাচার্যকে যে আরও গুরু দায়িত্ব
বহন করতে হবে একথা নিশ্চিত । কারণ আমরা সকলেই জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে কমবেশি
নিয়মের মধ্যেই ঘোরাফেরা করে থাকি বা করছি, কিন্তু
ভাবছি অন্যরকম । নীৎসের একটা কথা আছে এরকম— “I fear we are not getting rid
of God, because we still believe in grammar” (Nietzsche) ।
“একটি অপূর্ণতার কাছে শূন্য খাঁচা রেখে আসি
বাসনায় থাকে কিছু অতিরিক্ত ক্ষয়
তবু খাঁচাটাই সত্যি—এর
চেয়ে বেশি কিছু নয় ।” (সপ্তক-সাত)
“পাখিরও লালসা থাকে,
জিভ থেকে লালা ঝরে
ভেজায়
অক্ষর
যা লিখি হাওয়া দিয়ে লিখি
কবিতা, আসলে
উঠোনে মেলে দেওয়া খড় ।” ( সময়-অসময়ের কবিতা –দুই)
আত্মা থেকে জল কুড়োতে
এসেছে কেউ কেউ ।”
(কবি মৃত জেনেই)
খুব সুন্দর তাঁর কিছু কিছু অনুভূতি আর বাকচিত্র—
“...হলুদ নদীর জল
ছুঁইয়েছি কি ছুঁইনি
কতো নিচে নেমে এসেছিলো চাঁদ...” (বরাত)
“...সরস্বতী ঘুমিয়ে পাশে আমি খাট থেকে নেমে
ওর বীণাটি বাজাতে বসেছি ।” (ও
মাধবী) কিংবা
“... আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে
ঝোড়ো বাতাসের আটচালা ।” (বেলা
শেষের খেয়া)
এবার একটি পুরো কবিতা পড়ি এবার । কবিতা কখনো বুকের কেন্দ্রস্থল
থেকে বেরিয়ে এলে যা হয়—
“মেয়েটি ফ্রায়ডিয়, বড়
বেশী ইন্ট্রোভার্ট, বেশ গুছিয়ে কথা বলে
দু”পাশে
ছড়ানো নির্জন বালি দিয়ে একা একা ঢেউ আঁকে
আমি ওর শরীরের ভাষা বুঝি গোপন তিলটি পর্যন্ত,
তখন আমি ঠিক ভীরু চণ্ডালের মতো
আত্মঘাতী মাকড়শা
।
লগি কিম্বা বৈঠা ধরার কোন কু-অভ্যাস আমার জানা নেই
জানা নেই পাপ স্খলনের প্রাক মুহূর্তগুলি ডাউনলোড করে
অনলাইন কী ভাবে বান্ধবীকে পাঠাতে হয় ।
যা কিছু গভীর গোপন সব যেন কাগজকুচির মতো
চুপসে যাওয়া কণ্ডোম ফুঁ-দিয়ে পৃথিবীর পরিধি বাড়ানো,
ঢাকনা খুললেই প্রাণভোমরা রোমাঞ্চকর থ্রিলার—
গ্রীক ট্রাজেডি, ঘন
ঘন ফ্লাশ-মুড-অফ—
পারছি না, এভাবে
কী সব সহ্য করা যায়, মেনে নেয়া যায় সব
কিছু ।
তোর র্যাঁবোকে কি মনে আছে ? –সাইলক ! পিকাসোর ভাস্কর্য ।
মিশরের নীলনদ, টাইগ্রিস,
পাতায় মোড়া টয়ট্রেনগুলি ?
কৃষ্ণের কালিয়াদমন ?
বিদ্রূপের মতো একা আরতিময় বিনীত কথোপকথন ।
ভেজা অন্তর্বাসের ভেতর একটা সরল কাঠপিঁপড়ে কেমন অনাবিল—
আর মেয়েটি দাঁত দিয়ে নখ খুঁটছে— শরীরের তো একটাই জানালা ।
হলুদ শাড়ি উড়ছে হাওয়ায়— মনে নেই আজ তোর অষ্টমঙ্গলা” (অষ্টমঙ্গলা)
কবি ছন্দ সম্পর্কে ঠিক কতখানি ওয়াকিবহাল,
তা তাঁর কবিতাগুলো পড়লে ধরা পড়ে না । দু’এক জায়গাতে স্বরবৃত্তের দোলন টের পাওয়া
গেলেও, তা অক্ষুণ্ণ নয় (“ভালোবাসার জন্য”), বা সেটাকে কবির ইচ্ছাকৃত ভাঙন বলেও ঠিক
মানা যাচ্ছে না । তার “বিনয়”
কবিতাটি মাত্রাবৃত্তে লেখার প্রয়াস টের
পাওয়া যায় । স্বরবৃত্তে অনেক ত্রুটি মার্জনীয় হয়ে থাকে, কিন্তু মাত্রাবৃত্তে সেটা একেবারেই সম্ভব নয় । অক্ষরবৃত্তের
(গদ্যছন্দের) সরল আর গম্ভীর চলনও কবি ব্যবহার করেননি । তবে বুঝতে আমারও ভ্রান্তি
ঘটতে পারে, একথা বলাই বাহুল্য ।
কিছু গদ্যকবিতা কবি লিখেছেন । সেখান
থেকে কিছু কিছু টুকরো পড়ি ।
“পাথরে আঘাত করি, শব্দ
ওঠে ছলাৎ ছলাৎ, যেন কোন লণ্ডভণ্ডের
ভেতর ধাতব আভাস বিনুনি খুলে শুয়ে আছে, খোলাস্তন,
কৃষ্ণতিল হাঁটুর উপরে । অনাদর কুড়োতে
বসেছি, কী নিয়ে তার কাছে
যাবো; ধার করা মাটির বেহালা
লাল আবির মেখেছে, আজ বুঝি নুড়ি কুড়োবার
দিন, এক একটি শব্দের পাশে “য”-ফলা জুড়ে দিই নিজেকে কেমন ব্যঞ্জনবর্ণের মতো লাগে, এতো লিরিক হাওয়া চলে হাওয়ার পাশ ঘেঁষে,
ইডিয়েট, টেবিল চাপড়ে না হয় দু-একটা শিউলি ঝরালে, তা বলে দেশটা কি কুমোরটুলি হয়ে যাবে !...” (দামিনী
কথা)
“...তোমার দিকেই ঝুঁকে আছে স্মৃতিভ্রষ্ট তোমার কঙ্কাল, কোন প্রস্তর যুগ হা মেলে... ট্রিগারে
আঙুল নেই জামারও হাতলে নেই হাত, জুতোর
ভেতরে নেই পা । মুখ নেই মুখোশের বদলে মুখ ঢাকা রমণের ছেঁড়া অন্তর্বাস । আমি
প্রাচীন দেবতা— বুড়ো জগন্নাথ আমার
পাশে আলপিনকেও কেমন উৎফুল্ল দেখায় । গার্লফ্রেণ্ড কিংবা টয়লেট মাঝখানে একটু ব্রেক
। আপনি কমিউনিস্ট, প্রগতিশীল । কৃপণের
মৃত্যুশোক...ন্যাপথলিন...ট্রেচার বদল...”
(কৃপণ)
“...সরল ভিক্ষের উপর ঘুমিয়ে আছে তোবড়ানো এনামেল বাটি । খুঁটে খাবার
হরিৎ বাসনাও কখনও সরস্বতীর কোমর, মেঘ
মেয়ে— কান্না মানে
জন্মান্তর, আধ হাতা মুসুরির ডাল,
দুধে জল... চালে কাঁকর যে যার নিজস্ব
বিশ্বাসে কাঁপে, মায়াবী আগুন-ঝড়ে
স্মৃতি জল, নন্দিনীরা একা একা
ভাসে ।” (ভাসান)
“...মাংসে কতটা ডোবালে নখ তাকে বলাৎকার বলে...” (জলের ঋণ)
সম্ভবত বাক্যের এই বিন্যাসটা বব
ডিলান-এর আঙ্গিকের অনুগত । এই ফর্মটা জেনে বা না-জেনেই ইদানীং অনেক কবি করছেন ।
অজস্র । এমন হতেই পারে । তবু তার কথাই তো মনে পড়ে যায় !
জীবনানন্দের গাঢ় ছায়াপাত থেকে কবি
অদ্ভুতভাবে বেঁচে গেছেন বলে মনে হলো । এটা তাঁর ক্রেডিট নিশ্চিতই ।
রবীন্দ্রনাথকে একপাশে যদি সরিয়ে রাখি,
তবে বাংলা কবিতার ইতিহাসে তিন-এর দশক
আর ছয় ও সাতের দশক অত্যন্ত জরুরী বলে মনে
হয় আমার কাছে । ভাষাগতভাবে কিছুটা এলেও, কবির
কাব্যচেতনায় এই দশকগুলোর তেমন কোন ঢেউ পড়েছে বলে আমার মনে হয়নি ।
কবি খুবই ফ্লেক্সিবল অবস্থায় আছেন,
ফলে তাঁর পক্ষে অনেক কিছুই
দুঃসাহসিকভাবে করে ফেলা সম্ভব । তাই আমাদের অনেক দাবি তাঁর কাছে রেখে, আপাতত ইতি ।
তিনটি গ্রন্থেরই মলাট খুবই সুন্দর ।
“রাজার পোস্ট অফিস” এর প্রচ্ছদ করেছেন সুশোভন দত্ত ।
“চৌকাঠ পর্যন্ত এগিয়ে” এর প্রচ্ছদ করেছেন স্বপন মজুমদার ।
“ঘুমিয়ে পড়েছে সব ভাষা” এর প্রচ্ছদ করেছেন পার্থ প্রতিম দাস ।
২৮.১০.২০১৮
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন