।। সুপ্রদীপ দত্তরায়।।
(C)Image:ছবি |
জায়গাটি আশ্চর্য রকমের নীরব ।
আশেপাশে একশ মিটারের মধ্যে কোন জনবসতি নেই । ন্যাশনাল হাইওয়েতে বাস থেকে নেমে
খানিকটা পায়ে হাঁটা পথে চড়াই বেয়ে চার কোয়ার্টারের একটি দোতালা বাড়ি। খুব বেশি
দিনের পুরনো বাড়ি নয়। অফিসটাই এখানে চালু হয়েছে বছর দশেক ।তারও দুই বছর পর তৈরি
হয়েছে এই কোয়ার্টার । লোকজন এখানে না থাকার ফলে অনেকটাই অবিন্যস্ত । আসলে এই পথটা
অফিস থেকে শর্টকাট।
মুল পথটি অনেক ঘুরে প্রায় এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ফটকে এসে মিশেছে । এখানে সবাই সাধারণত এই শর্টকাট পথটাই
ব্যবহার করে থাকে । আমরা তিনজন এখানে থাকি। আমরা বলতে আমি, অনুপ আর স্বাগত । আগে এই অফিসটি ফ্ল্যাগ স্টেশন ছিল । নীচের দুটো কোঠা
ওদের দখলে থাকায়, উপরের একটা কোঠা আমার জন্য বরাদ্দ হয়েছে ।
প্রথম যেদিন আমি এখানে এসে জয়েন করি, আমি বুঝতে পারছিলাম
আমাকে নিয়ে আমার কলিগদের মধ্যে একটা ইতস্তত ভাব কাজ করছিল । অনুপ তো প্রথম পরিচয়ে
লজ্জা ছেড়েই জিজ্ঞেস করলো, " আপনি এত কিছু থাকতে এই
চাকরিটা কেন বেছে নিলেন?
আমি
প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না, এই চাকরিটা খারাপ কিসে । বললাম, " কেন ?"
---
" না এই এমনি ।"
বললাম, " বুঝলাম না --।"
---
" আসলে শহরের হুলস্থূল ছেড়ে এমন একটা নির্জন জায়গাতে আপনার
বয়সী মেয়েরা খুব কম আসে কিনা, তাই বলছিলাম ।"
---
" আমার যে নির্জনতাই বেশি পছন্দ ।" আমার উত্তর কতটুকু মনে
ধরলো বুঝলাম না । তবে কথা বেশিদূর এগোয় নি । আমার বস পিয়ন মারফত লাগেজ কোয়ার্টারে
পাঠিয়ে দিয়েছিলেন । স্বাগত আমাকে শর্টকাট পথে কোয়ার্টারে নিয়ে এলো। নির্জন পথ , দুপাশে ঘন ঝোপ ঝাড় । তারই মধ্যে দিয়ে পায়ে হাঁটা পথ ।রোজ চলাচলের ফলে
ঘাসগুলো সরে গিয়ে পথ তৈরি করে দিয়েছে । কিছুটা যাবার পর হাতের ডান দিকে একটা কুয়ো।
অনেক দিন ব্যবহার হয়নি বলে মনে হল । কুয়োটির ঠিক পাশেই একটা বাঁশের লাইট পোস্ট, তাতে একটা বাল্ব ঝুলছে । আমার খুব অবাক লাগলো। মনের ভাবটা গোপন না করে বলেই ফেললাম,
" বাবা:, এই পাহাড়ে কুয়ো ! জল পাওয়া যায়
তো ? "
স্বাগত
উত্তরে বললে, " জানি না ম্যাডাম --।"
---
" জানি না মানে ? আপনারা কোথাকার জল
ব্যবহার করেন ?"
---
"নীচে থেকে আসে । এই কুয়ো কেউ ব্যবহার করে না ।"
---
" তাই --- ?"
---
" হ্যাঁ ম্যাডাম, আর একটা কথা সবসময়ই মনে রাখবেন --"
---
" কী ---- ?" আমি বললাম ।
---
" কক্ষনো সন্ধ্যার পর এই রাস্তায় চলাফেরা করবেন না । "
---
" কেন --?"
---
" সন্ধ্যার পর এই রাস্তাটি নিরাপদ নয় ম্যাডাম ।"
মনে
মনে হাসলাম, ওরা
জানে না ক্যারাটেতে
আমি রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করেছি। স্বাগত আরো কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু কোন কারণে আর বললো না।
খানিক
পরেই আমরা কোয়ার্টারে পৌঁছে গেলাম । জায়গাটি নির্জন হলেও সুন্দর । একটা নিজস্ব
সৌন্দর্য আছে । প্রথম দর্শনেই পছন্দ হয়ে গেল ।
বললাম, " আমার জন্য কোন ঘরটা বরাদ্দ হয়েছে ?"
আমার
প্রশ্নে স্বাগত খানিকটা বিব্রত বোধ করলে । বলল, " আসলে ম্যাডাম,
এই মুহূর্তে আমরা দুজন নীচের দুটো কোঠায় আছি, ওপরের দুটোই খালি । আপনি
চাইলে আমরা দুজন এক ঘরে শিফট হয়ে আপনাকে অন্যটি ছেড়ে দিতে পারি ।
আমি
সাথে সাথে বাঁধা দিয়ে বললাম, " তা কেন ? আমার
ওপরের ঘরে থাকতে অসুবিধা নেই ।"
--- আমাদেরও কোন অসুবিধা নেই ম্যাডাম । আপনি নীচেই থাকুন। "
---
" হঠাত এই সেক্রিফাইস ? কারণটা জানতে পারি ?"
আমি
বুঝতে পারছিলাম স্বাগত ঠিক কি
উত্তর দেবে বুঝতে পারছিল না । আমতা আমতা করে বললে , " আসলে
আপনি একা থাকবেন তো, তাই যদি ভয় পান সেজন্যই বলছিলাম ।"
---
" প্রয়োজন নেই, তারচেয়ে আমাকে দোতালার পুব দিকে ঘরটা দিলেই চলবে ।
সকালে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সূর্য দেখার মজাই আলাদা ।"
আমার
কথা তখনও শেষ হয় নি। স্বাগত আঁতকে উঠে বললো, " না না ঐ ঘর দেওয়া
যাবে না, আপনি তারচেয়ে পাশের ঘরটিতে চলে যান ।"
কোন
আপত্তি নেই, একটা ঘর হলেই চলবে । দোতালাটি তুলনামূলক ভাবে নিরাপদ
। কোন বিপদ এলে নীচে দুজন আছে, অসুবিধা নেই ।
ওরা
আমার জিনিসপত্তর ঘরে ঢুকিয়ে মোটামুটি ভাবে থাকার মত করে চলে গেল । যাবার আগে
স্বাগত বলে গেল রান্না না করতে। আজ রাতের খাবার ওদের ওখানে খেতে হবে ।
সেদিন
আর অফিস যাই নি। হাত পা ধুয়ে, বিছানায় টানটান শুইয়ে আছি। পাশেই
জানালার ফ্রেমে পৃথিবীটা জীবন্ত বাঁধানো । মন্দ লাগছিল না । কখন যে ঘুমিয়ে
পড়েছিলাম মনে নেই । ঘুম যখন ভাঙলো, তাকিয়ে দেখি ঘরে আলো
জ্বলছে, জানলা দরজা সব ভেজানো । তার অর্থ আমি ঘুমে থাকা
অবস্থাতে কেউ এসেছিল । লজ্জা পেলাম ।
রাতে
খেতে বসে বললাম, " সরি, খুব টায়ার্ড লাগছিল , তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । আমাকে
ডাকতে পারতেন আপনারা ।
---
" কখন ম্যাডাম ? "
---
"এই সন্ধ্যাবেলা বা ঐরকম কোন একটা সময় , যখন
আপনারা আমার ঘরে গেছিলেন ।"
---
" আমি তো যাইনি ম্যাডাম ।" অনুপ বলল ।
---
" আমিও না ।"
---
" তার মানে? তাহলে আমার দরজা জানালা বন্ধ
করে দিল কে ? লাইটই বা কে জ্বালিয়ে দিল ? " আমি বললাম ।
ওরা
নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি সেরে বলল --- "ও কিচ্ছু না, হয়তো
লিংডো আসতে পারে , তবে আজ রাতটুকু আপনি নীচে কাটিয়ে দিন, কাল সকালবেলা কিছু একটা ব্যবস্থা হবে ।"
আশ্চর্য, ওদের কথাগুলো কেমন যেন
অসংলগ্ন লাগছিল । আমার ভালো লাগলো না। খাবার শেষে আমি আমার ওপরের ঘরেই থাকার
সিদ্ধান্ত নিলাম। ওরা আমাকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে স্থির থাকলাম । ঘরে এসে দরজাতে খিল দিয়ে শুয়ে
পড়েছি। প্রথমে ঘুম আসছিল না । নতুন জায়গা বলেও হতে পারে । সঙ্গে আনা শীর্ষেন্দু
সমগ্র নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই । রাতে দুবার কড়া নাড়ার
শব্দে ঘুম
ভেঙেছিল । মনে হচ্ছিল কেউ যেন দরজাতে কড়া নাড়ছে । কিন্তু অনেকক্ষণ কান পেতে থাকা
সত্ত্বেও আর কোনও আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায় নি। শুধু রাতজাগা কোন পাখির ডানা নাড়ার
শব্দ আর কান ঝালাপালা করা একঘেয়ে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ।
পরদিন
ভোর বেলা ঘুম ভেঙে গেল । আমি সাধারণত লেট রাইজার । কিন্তু সেদিন খুব সকালেই ঘুম ভেঙে গেল।
হয়তো জায়গার গুণে হতে পারে । বাইরে বেরিয়ে আসতেই দেখি অনুপ আর স্বাগত দুজনেই আমার
জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে বসা। বললাম, " কি ব্যাপার, এত সকালে ?"
---
" আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম । রাতে ঘুম হয়েছিল তো ?" অনুপ বললে ।
বললাম, " হ্যাঁ --- "
---
" কোন ধরনের অসুবিধা বা কিছু ?"
চট
করে মনে পড়ে গেল মধ্যরাতে দুই দুইবার কড়া নাড়ার শব্দ । আমার স্পষ্ট মনে আছে । তবে
কি এই কীর্তিটি ওদের কাজ ? ইচ্ছে করেই ব্যাপারটা চেপে গেলাম । বললাম,
" না: তেমন কিছু না । এই নতুন পরিবেশে যা একটু হয়। "
কথাটা
ওদের খুব একটা
বিশ্বাস যোগ্য হয়েছে বলে মনে হলো না । অনেকটা অবিশ্বাস্য সুরে বলল, " আপনার কপাল ভালো, তবে
সাবধানে থাকবেন ।"
অফিসে
যাওয়ার সাথে সাথেই বসের সাথে দেখা । প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন কাল রাতে কোন অসুবিধা
হয়েছে কিনা । আমি যতই উনাকে বোঝাতে চেষ্টা করি যে, তেমন কিছুই হয় নি , ততই তিনি আমার অল্প বয়সের
দোহাই দিয়ে বারবার সাবধান
থাকতে অনুরোধ করেন । অগত্যা আমি
প্রসঙ্গ পাল্টাতে চেষ্টা করায় উনি আমাকে দু’একটি কাজের দায়িত্ব দিয়ে
আবারও সাবধান করে বললেন যে আমার যে কোন অসুবিধাতে আমি যেন উনাকে জানাতে সংকোচ না করি। আমি মাথা নেড়ে সম্মতি
জানিয়ে চলে এলাম ।
অফিসে
খুব বেশি লোকজন নেই, আমাকে নিয়ে নয়জন। অফিস বিল্ডিং এ দুটো কোয়ার্টারে আমার বস আর
ডেপুটি থাকেন । আমাদের কোয়ার্টার অফিস থেকে দুশো মিটার দূরে । সরকারি কোয়ার্টার নয়,
ভাড়া নেওয়া । বাকিরা দুরে শহরতলিতে থাকে ।
আমার
রুমে আমি একাই বসি। চেম্বারে স্থিতু হয়ে বসতেই অফিসের পিয়ন ছেলেটি এককাপ চা নিয়ে
হাজির। এই মুহূর্তে আমিও মনে মনে এককাপ চা চাইছিলাম । চায়ের কাপটা টেবিলের উপর
রেখে একগাল হেসে ও দাঁড়িয়ে রইল । বুঝলাম পয়সা দিতে হবে । বললাম, " কত ---- ?"
আমার
কথায় সে
আঁতকে উঠে বললো, " নেহি নেহি ম্যাডাম, পাইসা নেহি চাহিয়ে ।" কথাগুলো বলতে বলতে সে চেম্বার থেকে ছিটকে
বেরিয়ে গেল ।
খানিক
বাদে আমি ওকে দেখলাম আমার কোঠার আশেপাশে ঘুরঘুর করছে । খবর নিয়ে জানলাম লোকটার নাম
লিংডো। গতকাল ওই আমার লাগেজ পৌঁছে দিয়েছিল । হাতের ইশারায় কাছে ডেকে বললাম, " কিছু বলবে ।"
লিংডো
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো । জিজ্ঞেস করাতে বললে, " ক্যাসে হ্যাঁয় আপ ?
কালরাত কোই তকলিফ তো নেহি হুয়া হোগা ।"
দেখলাম
ওর গলাতে উৎকণ্ঠা । বললাম, " নেহি -- ।"
---
" লেকিন ম্যাডাম ইয়ে জ্যায়গাটো ঠিক নেহি হ্যায় ।"
---
" কিউ
----?"
---
" ইহাপে উও হ্যাঁ ম্যাডাম ।" বলেই সে
দুইচোখ বড় বড় করে অদৃশ্য কারো উদ্দেশ্যে বার কয়েক প্রণাম ঠুকলো ।
আমি
অবাক । লিংডোর এই অদ্ভুত আচরণে আমার খুব হাসি পেল । বললাম, " তোমার ওই
"উও" লোকটা আমাকে খুব ভয় পায় ।"
আমার
হাসি তাকে মোটেই
খুশি করতে পারল না । অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বলল, " হাসিয়ে মত ম্যাডাম,
ভগবান না করে আপকো পাকড়ে , নেহি তো পাতা চলতা
।
---
" বেশ মানলাম, তোমার ওই উও লোকটা খুব
শক্তিমান । কিন্তু তুমি কি দেখেছ কখনো ওইরকম কোন লোককে ?"
----
" দেখা তো ম্যাডাম , বহুত দেখা ।"
---
" আচ্ছা, কেমন দেখতে বলোতো ।" আমার
বেশ মজা লাগছিল ওর কথাগুলো ।
লিংডো
চারপাশে একবার দেখে নিয়ে আমাকে একটা খুব গোপনীয় তথ্য দেওয়ার জন্য আমার দিকে
খানিকটা এগিয়ে এলো। আর ঠিক তখনই আমার বস হাঁক দিলেন, " লিংডো ইধার
আও ।"
লিংডো
সঙ্গে সঙ্গে সাহেবের হুকুম তামিল করতে ছুটলো। যাবার আগে আমাকে আশ্বস্ত করে বলে গেল, খুব
শীঘ্রই সে আমাকে গোপন খবরটি জানিয়ে যাবে ।
সারাদিনে
আর লিংডোর আসার সময় হলো না । আমিও নানা কাজে বেমালুম ভুলে গেলাম সব কথা ।
বিকেলবেলা দিনের আলো থাকতে থাকতেই স্বাগত এসে হাজির ।বললে, " চলুন, সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে হবে। "
আমার তখনো বাজার
হাট কিছুই করা হয়নি , খাব কি। বললাম, " আমার
একটু বাজার যাবার ছিল । "
--- সে আপনাকে ভাবতে হবে না । দুয়েক দিন আমাদের সাথে খাওয়া দাওয়া করুন,
তারপর আপনার অসুবিধা হলে আলাদা ব্যবস্থা করে নেবেন ।
--- অসুবিধার কি আছে? আপনাদের অসুবিধা না হলে আমার কি ।
আমার জন্যে তো ভালোই হবে । --- আমি বললাম ।
--- তবে আর চিন্তা নেই ।আপনার দৌলতে অন্তত মুখের স্বাদটা ফেরাতে পারবো। স্বাগত
হেসে বলল । দুজনেই হাসলাম ।
টেবিলে
জমা ফাইল পত্তর গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম । স্বাগত খুব তাড়া দিচ্ছিল সূর্যের আলো থাকতে
থাকতেই শর্টকাট পথে ফিরে যেতে । আমি ফেরার পথে পুরো রাস্তাটি ভালো করে লক্ষ্য
করলাম,
কোথাও কোনো অস্বাভাবিক কিছুই আমার নজরে এলো না । তবে এই ঝোপ জঙ্গলে
সাপ জোক থাকা অসম্ভব নয়। কোয়ার্টারের সামনে আসতেই লক্ষ্য করলাম সকালে রৌদ্রটা মেলে
দেওয়া ভিজে কাপড়গুলো নেই । অবাক কাণ্ড, আমি আশেপাশের জায়গা
ভালো করে খুঁজে দেখলাম, কোথাও নেই ।
স্বাগত
জানতে চাইলে সব খুলে বললাম । লক্ষ্য করলাম ওর চোখে মুখে একটা ভয়ের ভাব। আপন মনে
বিড়বিড় কিছু একটা বলল, আমি বুঝতে পারিনি । বলল, " চলুন ভেতরে যাই ।"
ঘরে
এসে অবাক, আমার কাপড়, ইনার গার্মেন্টস সব
শুকিয়ে ঠিকঠাক করে ভাঁজ করে রাখা । আমি আশ্চর্য হলাম, এমনতো
হবার কথা নয়। তালা বন্ধ ঘরে লোক ঢুকলো কি করে? আমি আড়চোখে তাকিয়ে আমার
অন্যান্য জিনিসপত্র দেখে নিলাম, কোথাও কোনো কিছু চুরি হয়ে
যায় নিতো।দেখলাম কিছুই হারিয়ে যায় নি। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম কাল অফিস ফেরার পথে একটা
তালা কিনে আনবো। কাউকে কিছু বললাম না ।
সেদিনও
মধ্য রাতে দরজাতে সেই খটখট আওয়াজ । আমার ঘুম ভেঙে গেল । বাইরে কারো শব্দ করে
হাঁটার আওয়াজ পেলাম । আমি মনে মনে মোটামুটি প্রস্তুত ছিলাম । অন্ধকার ঘরে
নিঃশব্দে হাতের আন্দাজে বালিশের পাশে থেকে টর্চ লাইটটা তুলে নিয়ে দরজা বরাবর তাক
করলাম,
কিন্তু সুইস অন করলাম না । শিকারি বিড়ালের মতো তৈরি রইলাম দরজা খোলার অপেক্ষাতে।
একটা বিড়াল বোধহয় ইঁদুর শিকার করল কোথাও , তারই বীভৎস আর্তনাদ । একটা পেঁচা আচমকা এই
আওয়াজে ভয় পেয়ে পাশের কোন একটা গাছ থেকে উড়ে গেল । ঝিঁঝিঁ পোকারা বিরক্তিকর ডানা নাড়া বন্ধ করে চুপচাপ ।
আবার আশেপাশে শ্মশানের নিস্তব্ধতা । আমি বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম কিন্তু আর কোন
শব্দ নেই । অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। সেই রাত্রে আর কোন
অসুবিধা হয়নি । তবে ঘুম খুব ভালো হলো না। সকালবেলা উঠতে অনেক দেরি হয়ে গেল । হয়তো
আরো কিছু দেরি হতে পারতো কিন্তু অনুপের ক্রমাগত কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল ।
লজ্জা পেলাম । দরজা খুলে দেখি অনুপ উদ্বিগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে । বলল, "শরীর ঠিক আছে তো ? "
লজ্জা পেয়ে বললাম, " হ্যাঁ ঠিক আছে ।" একবার মনে হল অনুপের সাথে গতরাতের বিষয়ে আলোচনা করা
প্রয়োজন, পরে নিজেই নিজেকে বিরত করলাম । মনে মনে স্থির করলাম,
আরেকটু দেখে নেওয়া প্রয়োজন । দিনের বেলায় কে বা কারা ঘরে আসে সেটা
জানাও খুব জরুরি
। ভাবলাম দুপুরের দিকে একবার কাউকে না জানিয়ে কোয়ার্টারে যাবো। দেখতে হবে কারা
আমার অবর্তমানে আমার ঘরে আসে। দুপুরবেলা দুবার চেষ্টাও নিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সম্ভব
হলো না । অফিসেই নানা কাজে দিনটি ব্যস্ততার মধ্যে কেটে গেল । আমি আর অনুপ দুজনে
মিলে একটা প্রজেক্ট তৈরি করছি। পরদিন সকালবেলা সেইটি নিয়েই আমার বসের কলিকাতা
যাবার কথা । আজকের মধ্যে যেভাবেই হোক শেষ করতে হবে । এদিকে দিন শেষ হয়ে আসছে ।
আমাদের কাজ শেষ হচ্ছে না । অনুপ আমাকে তাড়া দেয়, আমি অনুপকে
তাড়া দেই , কিন্তু কিছুতেই কাজ শেষ হতে চায় না । বরং উলটো
তাড়াহুড়োতে কাজে জটিলতা সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছিল । অনুপের ক্রমাগত টেনশন বাড়ছে ,
বললে, " আজকে আর শর্টকাট পথে কোয়ার্টারে
যাবো না । রিস্কি হয়ে যাবে ।"
আমার
বস বাড়ি ফেরার পথে বারবার মনে করিয়ে দিলেন সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে । কিন্তু কাজ
শেষ হলে তবেই না ফিরব । লিংডো দরজাতে একটা টুল নিয়ে বসা । বারবার তাড়া দিচ্ছে, বলছে
, " ম্যাডাম ইয়ে জ্যায়গাটো ঠিক নেহি । আপলোগ বহুত দের করদিয়া। আজ তো
কিসিভি কারণসে ছোটা রাস্তাতে মত জাইয়েগা । ওর ভয়মাখা মুখটা সত্যি দেখার মতন।
আমি
মনে মনে স্থির করলাম, আজ শর্টকাট পথেই বাড়ি ফিরব । একবার যদি ওদের ভুল
ভাঙিয়ে দিতে পারি তবে আগামী দিনগুলোতে নিশ্চিত শান্তি ।
কাজ
শেষ হতে হতে রাত সাতটা বেজে গেছে । লিংডো আর অনুপের মুখ শুকিয়ে গেছে । ওরা কেউ শর্টকাট
পথে কোয়ার্টারে ফিরতে রাজি নয়। প্রয়োজনে পুরো রাত ওদের অফিসে কাটিয়ে দিতে আপত্তি
নেই । আমরা সদর রাস্তায় এসে একটা শেয়ার কার বা পুল কার কিছু একটার জন্য অপেক্ষা
করতে থাকলাম । কিন্তু পাহাড়ি জায়গাতে রাত সাতটা মানে অনেক রাত । কোন ধরনের কোন
গাড়ি ঘোড়ার নামগন্ধ
নেই। আমরা দাঁড়িয়ে আছি রাস্তার উপর । যত সময় যাচ্ছে ততই টেনশন বাড়ছে । আমি লিংডোকে
বলে একটা টর্চের ব্যবস্থা করলাম । অনুপকে বললাম, " শুধু
শুধু ভয় পেয়ে লাভ নেই । তারচেয়ে চলুন নিজেরা সাহস করে যাই। এমনও তো হতে পারে, আমরা শুধু শুধু ভয় পাচ্ছি, আসলে ভয়ের কিছুই নেই
।"
আমার
কথা শেষ হবার আগেই অনুপ রেগে গিয়ে বলল, "আপনাদের নিয়ে এই
সমস্যা, কোন
কিছুতেই গুরুত্ব দিতে চান না।"
---
"এখানে গুরুত্ব দেবার মত কিছু নেই অনুপ । আমি বললাম ।
---
" আছে, ঐ কুয়োটা ভালো নয়। "
---
" কুয়ো ভালো মন্দে আমাদের কিছু যায় আসে না । আমরা এই মুহূর্তে ঐ কুয়ো থেকে জল
তুলতে যাচ্ছি না ।"
---
" আমি জল নিয়ে কথা বলছি না, ঐ কুয়োটাতে
কিছু একটা আছে ।"
অনুপ
বিরক্তি সহকারে বলল।
---
" তাই ? কি আছে ওখানে ? আপনি দেখেছেন কিছু ? " আমার এতগুলো প্রশ্নে কি উত্তর দেবে বুঝতে
পারছিল না অনুপ ।
---
" ওকে কিছুটা বোঝাতে পেরেছি ভেবে বললাম, " তাছাড়া ঐ কুয়োটির পাশে আলোর ব্যবস্থা আছে । আলোতে শুনেছি আপনার তেনারা
নাকি বের হন না ।"
---
"ওখানেই তো সমস্যা ---।"
----
" মানে -- ?" আমি অবাক ।
---
" মানে খুব সহজ, রাত্রিবেলা কেউ যখন ঐ পথ দিয়ে যাতায়াত করে তখন ঠিক
কুয়োটির সামনে আসা মাত্রই জ্বলে থাকা লাইটটা হঠাত করে বন্ধ হয়ে যায় । আর ঠিক তখনই
কেউ একজন ----।"
---
" কেউ একজন কি ---- ?" আমি বললাম ।
---
" কেউ একজন টেনে কুয়োতে ফেলে দেয়। "
বুঝতে
বাকি রইল না যে পুরোটাই একটা বুজরুকি গল্প । বললাম, " বেশ তো আপনার
ইচ্ছে করে আমার সাথে চলুন , নইলে
থাকুন এখানে । আমি চললাম ।" এই বলে আমি সত্যি সত্যি রওয়ানা দিলাম । আমাকে
এভাবে যেতে দেখে দুজনেই কিংকর্তব্যবিমুঢ়। দুজনেই প্রায় একসাথে চিৎকার করে উঠলো ।
অনুপ দৌড়ে গিয়ে আমার হাত টেনে ধরে অনুনয় করে বলল, প্লিজ
।"
কিন্তু
ততক্ষণে আমার জিদ চেপে গেছে । তাছাড়া একটা ভীতু ছেলে মাঝ রাস্তায় আমার হাত ধরে
টানাটানি করবে, সে আর যেই করুক আমি সহ্য করার পাত্রী নই । এক ঝটকায়
হাত ছাড়িয়ে বললাম, " পথ ছাড়ুন , আমাকে
যেতে দিন।"
এক
ধাক্কায় অনুপকে সরিয়ে দিয়ে আমি হনহন করে হাঁটা দিলাম। চলতে চলতে পেছনে না তাকিয়েও
বুঝতে পারছিলাম ওরা হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে আছে ।কিছুটা পথ বড় রাস্তার উপর দিয়ে
এগিয়ে আমি সেই বিতর্কিত শর্টকাট পথে চড়াই বাইতে লাগলাম । হাতে শক্ত করে ধরা জ্বলন্ত
টর্চ । একা একা হাঁটছি। চারদিকে শ্মশানের নিস্তব্ধতা । শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডানা
নাড়ার বিরক্তিকর শব্দ । একবার মনে হল, কাজটা বোধহয় ঠিক হলো না ।
আমার এখানে চাকরি করতে আসা। অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই । অযথা এই রিস্কটা না নিলেও
চলতো। ভেতরে ভেতরে যে একদম ভয় ছিল না তা নয় । হাতের মুঠোতে ধরা টর্চটি ক্ষিপ্রতার সঙ্গেে এপাশে
ওপাশে ঘুরাতে ঘুরাতে এগিয়ে চললাম । একটা গা ছমছম করা ভয় । একবার ভাবলাম ফিরে যাই,
কি প্রয়োজন এত সাহস দেখানোর । তারপর মনে হল আজ যদি ফিরে যাই তবে
সারাজীবনের জন্য কথা থেকে যাবে । আর কোনদিন মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারবো না ।
হঠাৎ
মনে হল আমার বা পাশের ঝোপ থেকে একটা শব্দ ভেসে আসছে ।যেন আমার সাথে সাথে কেউ একজন
ঝোপের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে । সমস্ত শরীরে কেমন একটা অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল । আমি
তৎক্ষণাৎ ঐ জায়গাটাতেই সাহস করে দাঁড়িয়ে গেলাম । এছাড়া অন্য কোন পথও খোলা নেই ।
ভালো করে শব্দটা লক্ষ্য করতে থাকলাম, মনে হলো মাটিতে ঘষে ঘষে কিছু একটা এগিয়ে যাচ্ছে । আমি
দাঁড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে মনে হল শব্দটাও থেমে গেছে । আমি সাবধান হয়ে গেলাম ।
জায়গাটি নিরাপদ নয়। ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই সতর্কতার সাথে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে ধারণা
নেওয়ার চেষ্টা নিলাম । হঠাৎ মনে হলো আমার পা ঘেঁষে ঠাণ্ডা পিচ্ছিল কিছু একটা
নড়াচড়া করছে । টর্চের আলো এক ঝটকায় পায়ের উপর ফেলতেই বুকের রক্ত হিম হয়ে যাওয়ার
অবস্থা । একটা কালো মোটা সাপ আমার পা ঘেঁষে যাচ্ছে । ভয়ে শরীর পাথর হবার উপায়।
হঠাত পিছন থেকে কে যেন এক ঝটকায় পিছনে টেনে নিয়ে গেল । কিছু বুঝে উঠার আগেই অনুপ
ফিসফিস করে বললো, "ভয় পাবেন না , আমি
এসে গেছি ।"
মনে
একটা বিশাল বল ফিরে পেলাম। আমার লাফ দেওয়াতে সাপটা নিমেষে আমার দিকে ফণা বাগিয়ে
ফোঁস করতে লাগল । অনুপ চাপা গলায় বলল, " একদম নড়বেন না
।"
আমি
স্থির,
যেকোনো মুহূর্তে ছোবল খেতে পারি। সাপটি কিছুক্ষণ ফণা তুলে ভয় দেখিয়ে
নিজের থেকেই চুপচাপ রাস্তা পার হয়ে চলে গেল । নিজের অজান্তেই ভিতর থেকে একটা
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো । আমি তাকিয়ে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম কত বিশাল ছিল এই সাপটা । অনুপকে ধন্যবাদ
দিলাম ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবার জন্য । আমরা আবার হাঁটতে শুরু করলাম । আমি টর্চ হাতে
সামনে, পিছন পিছন অনুপ ।দুজনেরই মুখে কথা নেই । ভিতরে ভিতরে
একটা উত্তেজনা, একটা ভয় আবার সাথে সাথে একটা সংকল্প আমাদের
পারতেই হবে ।
দুর
থেকে কুয়োটি দেখা যাচ্ছে । একটা সাধারণ কুয়ো, মুখটা বাঁধানো নয় । ঠিক
মুখে সিমেন্টের রিং বসানো । পাশেই একটা বাঁশের খুঁটিতে একটা ১০০ পাওয়ারের বাল্ব
জ্বলছে । সমস্ত জায়গাটা ঐ বাতির আলোতে আলোকিত । অনুপকে বললাম, " একদম ভয় পাবেন না । আমরা একা নই।"
খুব
সাবধানে পা টিপে টিপে এগোচ্ছি । বুকের মধ্যে রক্ত চলাচল বন্ধ হবার উপক্রম । পা
দুটো ভারী হয়ে আছে । তবু জিদ, আজকেই তার শেষ দেখে নেব ।
কুয়োটির
খুব কাছে আসতেই যথারীতি হঠাৎই বাতিটা টপ করে নিভে গেল । আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অনুপ ভয় পেয়ে একটা অদ্ভুত অস্ফুট আওয়াজ তুলে পিছন
ফিরে পালাতে গেল। আমার তখন বীভৎস মানসিক অবস্থা । চারপাশে ঘন অন্ধকার, আর নিস্তব্ধ । এতক্ষণ ধরে কান ঝালাপালা করা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকটাও নিমেষে
উধাও । এবারে আমি সত্যি সত্যিই
ভয় পেয়েছি । তক্ষুনি দু পা পিছিয়ে খপ করে অনুপের হাতটা টেনে ধরলাম যাতে আমাকে
ফেলে পালাতে না পারে, আর
আশ্চর্য ঠিক সাথে সাথেই আবার বাতিটা জ্বলে উঠলো ।
বাতিটা
জ্বলতেই আবার সব স্বাভাবিক । আবার সেই ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ।সব আগের মতই । অনুপ বলল, " চলুন ফিরে যাই। এই অবস্থায় এগিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না ।"
---
" কিন্তু এখন আর ফিরে গিয়ে রাস্তায় থাকা ছাড়া উপায় নাই ।"
আমি বললাম ।
--- তবে কি সারা রাতটুকু এখানেই কাটাবেন ?"
আমি
বুঝতে পারছিলাম ভয়ে রাগে অনুপের এখন মাথা প্রচণ্ড গরম । বললাম, " মাথা ঠাণ্ডা রাখুন ।
এই পরিস্থিতিতে মাথা গরম করলে চলবে না । আমরা দুজন হাত ধরে এগিয়ে যাবো , এবারো যদি বাতিটা নিভে যায় তখন দুজনেই সামনের দিকে ছুটে জায়গাটি পার হয়ে
যাবো। " এইটুকু বলে আমি ওর হাতটা শক্ত করে ধরলাম ।
অনুপ
এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে বলল, " আমি পারব না ।"
---
" আপনাকে পারতে হবে ।"
---
" অসম্ভব ----।" অনুপ একেবারে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ।
আমি
ওকে বোঝালাম এটা পাগলামি করার সময় নয় । ঠাণ্ডা মাথায় সাহসে ভর করে এগিয়ে যেতে হবে
। ভয় পেলে চলবে না । অনেক বোঝানোর পর আবার দুজনে হাত ধরাধরি করে রওয়ানা দিলাম ।
অনুপকে যতই সাহস দেই না কেন, নিজের
ভিতরে তখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ চলছে । ভয়ে পা দুটো ভারী হয়ে আছে । কিছুতেই চলতে চায় না ।
একটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা বাতাস ভিতরের কাঁপুনিটা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে । ভয়ে ভয়ে এগিয়ে
চললাম । বুঝতে পারছি দুজনেরই হাত পা কাঁপছে তবু ঠিক আগের জায়গাটাতে আসার আগে
অনুপকে আরো একবার সাহস দিলাম । মনে মনে দুর্গা নাম জপে যাচ্ছি । হাতে জ্বলন্ত টর্চ
লাইট শক্ত করে ধরা । এবারেও ঠিক কুয়োটির পাশে আসা মাত্রই দপ করে আবারও আলো নিভে
গেল । কোথা থেকে পৈশাচিক আওয়াজ ভেসে আসছে । দমবন্ধ করা পরিস্থিতি । আমি অনুপকে
বললাম, " ছুটুন---।" আমিও সব শক্তি দিয়ে ছুটতে
গেলাম । কিন্তু পায়ে কিছু আটকে গিয়ে দুরে একটা জায়গাতে ছিটকে পড়লাম । আমার হাত
থেকে অনুপের হাতটা ছুটে গেল । অন্য হাতের টর্চটাও ছিটকে গিয়ে দুর কোথাও পড়েছে ।
আমার কোন হুঁশ নেই । একটাই মাত্র চিন্তা কি করে নিজেকে বাঁচাবো। উঠে দাঁড়ানোর
শক্তি নেই, হামাগুড়ি
দিয়ে শরীরটাকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে থাকলাম ।শরীর কিছুতেই
এগুতে চাইছে না । আমি ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছি । একটা ঘোরের মধ্যে চলেছি । এই
মুহূর্তে আমার কিছুই মনে আসছে না । আমার সাথী অনুপ, আমার
চাকরি, আমার
বন্ধু বান্ধব কাউকে মনে আসছে না । বারবার মনে হচ্ছিল আমি আর বাঁচবো না । এজীবনে যত ঠাকুর দেবতার নাম
জানা ছিল সব নাম নিয়ে চিৎকার করে ডাকতে শুরু করলাম ।মনে হচ্ছিল এই মুহূর্তে ওরা
ছাড়া কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবে না । মৃত্যুভয় যে কি সাংঘাতিক সেদিন আমি হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি
করছিলাম ।একটা সময়ে মনে হলো আমি কুয়ো থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে এসেছি। তখনও
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারিনি, অনুপের বুকফাটা চিৎকার আমাকে সম্বিত
ফিরিয়েে আনলো। এক নিমিষেই শরীরের সমস্ত রক্ত শুকিয়ে কাঠ । আমার জন্য অনুপের আজ এই
বিপদ । আমি অন্ধকারে অনুপকে খুঁজতে লাগলাম । হঠাত পিছন ফিরে দেখি টর্চ লাইটটা
পাহাড়ের ঢালু গায়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে, আর তারই চলমান আবছা আলোতে অনুপ কুয়োর পারে পরে
আছে । তার পাদুটো কুয়োর মুখের উপর রাখা আর দু’হাতে শক্ত করে
সেই বাল্ব ঝোলানো বাঁশটা ধরা । মনে হচ্ছে যেন কেউ তাকে কুয়োর ভিতরে টানার চেষ্টা
করছে আর ও বাঁশটা আঁকড়ে প্রাণপণে বাঁচার চেষ্টা করছে । আমি সঙ্গে সঙ্গে ওকে বাঁচানোর জন্য সমস্ত শক্তি দিয়ে উঠে
দাঁড়াবার চেষ্টা নিলাম। যেই মুহূর্তে আমি আবার অনুপকে বাঁচাতে কুয়োটির দিকে এগিয়ে
যেতে উদ্যত হয়েছি , ঠিক তখনি কে যেন আমাকে কষে একখানা চড়
হাঁকালো। আমি দুরে গিয়ে ছিটকে
পড়লাম। এত জোরে চড় আমি আর কোনদিন খেয়েছি বলে মনে পড়লো না । কান মাথা ঝিমঝিম করতে
লাগলো । আমি ওখানেই শুয়ে পড়লাম।
তারপর
কী হয়েছে আমার জানা নেই । যখন সম্বিত ফিরলো তখন আমি সরকারী হাসপাতালে । নার্সদের
কাছ থেকে যতটুকু জানা গেল তার সারমর্ম নিলে একটা অন্য গল্প তৈরি হয়ে যায়। আমরা
দুজনে নাকি পরদিন সকালে অফিসে যাইনি ।
তাই অফিস থেকে খোঁজ নিতে এসে লিংডো আমাদের দুজনকেই যার যার ঘরে প্রচণ্ড জ্বরে
বেহুঁশ অবস্থাতে পায় । তারপর অফিস থেকেই যথারীতি হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আমি
বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবি এ কি করে সম্ভব। আমিতো কুয়োর পাশে পড়েগিয়েছিলাম । সেখান
থেকে আমাদের কোয়ার্টারে বিছানায় আনলো কে ।এতবড় শরীরটাকে কিভাবেই বা নিয়ে এলো ,
আমিই বা কেন কিছুই বুঝতে পারলাম না, আমার কাছে
ধোঁয়াশা লাগছিল সব। ভেতরে ভেতরে সত্যিটা জানার একটা তীব্র তাগিদ অনুভব করছিলাম ।
অথচ একটা লোক নেই যে সত্যিটা বলতে পারে । লিংডোকে মনে মনে খুঁজছিলাম, যদি কিছু জানা যায়। কিন্তু এত এত লোকের মধ্যে লিংডোর দেখা নেই ।
শেষে
দুদিন পর ভিজিটর কমে যাওয়ার পর লিংডো
আমাকে দেখতে এসে চুপিচুপি বলল , " আপ বহুত নসীবওয়ালে হো
। সাংমা ম্যাডাম নে আপকো
বাঁচা দিয়া ।"
---
" সাংমা ম্যাডাম ? উনি
আবার কে ? "
---
" আপসে পহেলে যো বড়াবাবু থি উনকা বিবি। বহুত আচ্ছে আউরত থে।
বহুত পেয়ার করতা থা হামলোগোকো। উসকা একলৌতি বেটি যব কুয়ো মে গিড়কে মর গেয়ি উসিকি বাদ উহ পাগল জ্যেইসে হো গেয়ি
থি । একরাত সাংমা সাব ঘরমে নেহি থে তো উনকা বিবি ফাঁসি মে লটক গেয়ি ।
----
" তাই নাকি ?" আমি অবাক ।
--- হ্যাঁ ম্যাডাম, সাংমা সাব উসকা বাদ নোকরি ছোড়কে চলা
গিয়া। সাংমা সাবতো চলা গিয়া লেকিন উনকা বাচ্চি অবিভি তঙ্ক করতা হ্যায়। রাতকো উসি
রাস্তে সে জানেসে এহি বাচ্চি
বহুত ডর দিখাতা হ্যায় । কভিকভি জানভি লে লেতি হ্যায়। আপলোগ নসীবওয়ালে, ইসলিয়ে সাংমা ম্যাডাম নে আপলোগোকো বাঁচা
লিয়া । সাংমা ম্যাডাম কভি কিসিকা
খারাব নেহি করতি হ্যায়।"
লিংডোর কাহিনিতে
কতটুকু সত্য আছে, আমি যাচাই করে দেখিনি। সেই সাহসও আমার ছিল না ।
হাসপাতাল থেকেই চাকরির পদত্যাগ পত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। পরে খবর পেয়েছি অনুপও নাকি ঐ চাকরিটা ছেড়ে
দিয়েছে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন