শেষ পর্যন্ত যাওয়াটা হল। ধলা সদিয়া ব্রিজ ওরফে ডঃ ভূপেন হাজরিকা সেতু, দেশের দীর্ঘতম সেতু ৯.১৫ কি.মি, ১৮২টি ভারবাহী স্তম্ভ সমন্বিত। এ হল ব্রহ্মপুত্রের সেই অংশ বছর ২৭/২৮ আগে যেখানটায় নদীখাতের আরেকটু নিম্ন এবং গভীর অঞ্চল আমরা
যন্ত্রচালিত বড় নৌকোয় পেরোতাম । তখন অরুণাচল প্রদেশের তেজুতে থাকতাম। তেজু থেকে বাসে ডিগারু নদী, নৌকোয় পেরিয়ে সুনপুরা, আবার বাসে সদিয়া, সদিয়ায় বাস থেকে নেমে ব্রহ্মপুত্রের
পারে বাঁশের বেড়ার হোটেলের বেঞ্চিতে বসে টাটকা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে ফেরি ধরতাম। হোটেলের দরজার কাছেই টুলের উপরে বাঁশের ঝুড়িতে মাছ ভেজে রাখা, বড় বড় পিস, মাছভাজার সুগন্ধে ম ম। দেখলেই খিদে দ্বিগুণ চাগিয়ে উঠত। নদীর ওপারে ধলা, ধলা থেকে তিনসুকিয়া বা ডিব্রুগড়ের
বাস। প্রায় সারাদিন লেগে যেত। ডিব্রুগড়
থেকে তেজু ফ্লাইট ছিল, তবে সব সময় তো আর অত বিলাসিতা চলত না, তাই এ পথে বছরে এক-দু বার যাতায়াত করতেই হত। ব্যাগ, বাক্স, বাচ্চা সামলে বরের পেছনে
ওঠা নামা--- নদীর শোভা দেখার সুযোগ বড় কম ছিল। আকাশপথে আবার মাত্র ২৫ মিনিট, বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া, প্লেনে উঠে বসতে না বসতেই সময় শেষ।
সেই বিশাল নদীটি প্রকৌশলের
কাছে এতদিনে ধরা দিয়েছে। তাই তাকে দেখতে যেতেই হয়। অবাক বিস্ময়ে
তাকিয়ে চারদিকে দেখছিলাম, একটা দৃশ্যও যেন মনোযোগের বাইরে থেকে না যায়। এর বিশালতা দুচোখে ধরা যায়না, একবার এপাশে, একবার ওপাশে ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে হয়, ক্যামেরাতে বারবার স্ন্যাপ নিতে হয়। এই নদীকে কোনো বিশেষণে বাঁধা কঠিন----বিশাল, মহানদ, মহাবাহু--- সব শব্দই যেন বর্ণনায় কম
পড়ে। এ এক অনন্য নদী। ন’ কিলোমিটারের বেশী দীর্ঘ সেতু
হেঁটে তো পেরোনো যাবে না -— ২৮ বছর আগে হলে চেষ্টা করতাম --- তাই খানিকটা গাড়িতে এগোই, আবার নেমে গিয়ে কিছুদূর হাঁটি --- একবার সেতুর এধার দিয়ে তো
আরেকবার ওধার দিয়ে চলি, খানিক দাঁড়াই, দেখি, ছবি তুলি, চোখ ফেরাতেই যেন পারছিলাম না ---- যেন পাগল হয়ে উঠেছিলাম, দৃশ্যাবলীকে একবার মনের ভেতর, একবার ক্যামেরার ভেতর চিরস্থায়ী করে রাখতে চাইছিলাম।
নিচে বালুচর, তারপর নদীর এক বাহু, আবার চর, আবার নদীর বড় ধারা, দূরে আবার কোনো কোনো বাহু মিলে
গেছে-- আবার চর, বড় চরে ঝাউবন, কোনো চরে ঘাস, কোনোটাতে আবার শুধুই চিকচিক করা সাদা বালি, জলচর পাখির কলকলানি, আবার শীর্ণ জলস্রোত, এভাবে বেশ কয়েক অংশে নদী বইছে, জলে বুনো হাঁস, অল্প জলে বক চরছে, শীতকাল বলে জল টলটলে স্বচ্ছ। দুপুরের রোদ পড়ে ঝিকমিক করছে। দূরে দূরে দু একটা নৌকো । দেখতে দেখতেই হঠাত আকাশের কোণে গুরগুর ---
মেঘ করে আসছে, অতএব, গাড়িতে ফেরা। এবারে আর নদীর পারের বাঁশের বেড়ার হোটেলে নয়, ঝকঝকে ধাবায়, আজকাল ওইসব হোটেলে খেতে মধ্যবিত্ত উন্নাসিক।
এই উজান আসাম আমার
জন্মভূমি; পৈত্রিক নিবাস এবং বড় হয়ে ওঠা বরাক উপত্যকায় হলেও পরবর্তী
জীবনে খুঁজে পাওয়া আমার জীবনসঙ্গীর জন্ম ও লালনভূমিও এখানে। কিছু দূরে অরুণাচল প্রদেশ আমাদের দুজনেরই অনেকদিনের কর্মস্থল। আমার সন্তানেরা ও এই ত্রিকোণ ভূমিখন্ডেই জন্ম নিয়েছে। এখানের সঙ্গে আমার রক্ত ও আবেগের সম্পর্ক। এই সমস্ত উত্তরপূর্ব ভারতের প্রায় প্রতিটি রাজ্যে আমার
আত্মীয়বন্ধুজন ছড়িয়ে আছে। এদিককার কোনো ভালো
খবর আমাকে উদ্দীপিত করে, গর্বে ফুলে উঠি। এখানের কোনো নিরাশাব্যঞ্জক খবরে মুষড়ে পড়ি। এখানে এসে মনে হল দেশের এই দীর্ঘতম সেতুটিতে আমারও প্রাণের আকাঙ্ক্ষা, প্রার্থনা
জড়িয়ে আছে।
উত্তরপূর্বে যখন থাকতাম, তখন ঘুরে বেড়ানোর সময় খুব কম ছিল। তাই রাস্তা ধরে যাবার সময়ে যতটুকু হয়, ততটুকু ছাড়া আর কিছুই দেখা হয়নি। তাই ধলা-সদিয়া সেতুর পর এবার আমাদের লক্ষ্য ছিল শিবসাগর ও কাজিরঙ্গা।
শিবসাগর শহর ডিব্রুগড় থেকে
প্রায় দুঘণ্টার রাস্তা। পুরনো এই শহরই মধ্যযুগের প্রারম্ভ থেকে শেষ অবধি আহোম রাজত্বের উত্থান পতন দেখেছে। শহরটি মনে হল কিছুটা সরকারের দ্বারা অবহেলিত, তাই অপরিচ্ছন্ন, সকালবেলা ছড়ানো আবর্জনার
জন্য রাস্তায় হাঁটতেও অসুবিধে হয়ে যায়। একটু বেলায় ঝাঁট
দেওয়া শুরু হয়, রাতের দিকে শহরের বাড়ির এবং দোকানপাটের সব আবর্জনা আবার রাস্তায়। পানের পিক তো
আছেই। বোধ হয় অতিষ্ঠ হয়ে বাজারে এক জায়গায় কেউ লিখে
রেখেছে, ‘ইয়াত থুকিলে নিজর মাবাপেকর মুখত থুকা
হব’!
আঙ্গুলে গোনা কয়েকটি থাকার হোটেল আছে শহরে, খাবার জায়গা কয়েকটাও আছে, কিন্তু খাবারের মান ভালো নয়। যা হোক, আমরা তো থাকব এক রাত মাত্র। সকালে পৌছালে না থাকলেও
হয়, তবে আমরা অনেকদিন পর আসামে এসেছি, তাই ‘লাহে লাহে’ই করছি সবকিছু। ডিব্রুগড় থেকে
বেরোতেই সাড়ে দশটা ।
গড়গাওঁয়ের কারেং ঘর |
শিবদৌল |
খানিকটা দূরে জয়দৌল, জয়মতী কুওঁরীর স্মৃতি মন্দির। পাশে জয়সাগর, বিশাল দীঘি। স্বামী ও দেশের জন্য যে মহীয়সী নারী রাজশক্তির অমানুষিক অত্যাচার সয়ে প্রাণ ত্যাগ
করেছিলেন, সেই অনন্যচরিত্র জয়মতী। তাঁর পুত্র রুদ্রসিংহ পরবর্তীকালে রাজা হয়ে মায়ের
স্মৃতিতে এই মন্দির নির্মাণ ও দীঘি খনন করিয়েছিলেন। মন্দিরে নাকি
একসময় বিষ্ণুপুজো হত। আরো পরবর্তী রাজা শিব সিংহের সময়ে শাক্তধর্মের
প্রভাবে আহোম রাজত্বে বিষ্ণুপুজো বন্ধ হয়ে যায়, মন্দির ও পরিত্যক্ত হয়। শিবসিংহের রানি
ফুলেশ্বরী কুওঁরীর তৈরী করানো শিবদৌল এবং লাগোয়া দেবীদৌলে আজো পুজো হয়। তাই এই মন্দিরগুলোর
কিছুটা যত্ন আছে, বোঝা যায়। জয়দৌলের বাইরের দেওয়াল রং হারিয়ে কালো হয়ে গিয়েছে। জয়দৌল এবং শিবদৌল
একই রকমের স্থাপত্যরীতির। মন্দিরের দেওয়াল যেন ভাঁজে ভাঁজে খুলেছে পদ্মের পাপড়ির মত। নিচে থেকে অন্তত তিন থাক কারুকার্য আছে, দেবদেবীর মূর্তি, ফুলপাতার নকশা, ইত্যাদি, কিন্তু অনেক কারুকার্য ক্ষয়ে
ভেঙ্গে গেছে। বেশ দৃষ্টিনন্দন
মন্দিরগুলোর আরো যত্ন করা জরুরি। শিবদৌলের পেছনদিকে রাস্তা পেরিয়ে বিশাল শিবসাগর
দীঘি। শীতের সকালে কুয়াসাচ্ছন্ন। কিছু জলচর পাখি খাদ্যের সন্ধানে জলে সাঁতার কাটছে। শিবরাত্রি উপলক্ষে কিছু উৎসব হবে---তার বিজ্ঞাপন পড়েছে চারদিকে। মন্দিরের ভেতরে
পুজো দিতে ঢুকলাম। পুজো দেবার আসল উদ্দেশ্য হল ভেতরটা ভাল করে দেখার
সুযোগ নেওয়া। পুরুতমশাইয়ের সঙ্গে আলাপ হল, উনি নাকি আদতে কাশ্মীরী
ব্রাহ্মণ। ভক্তরা আসছেন, নিয়মমত পুজো দিচ্ছেন, কোনো ঠেলাঠেলি তাড়াহুড়ো
নেই, সেবায়েতদেরও
কোনো দুর্ব্যবহার নেই, যা আমরা উত্তর ভারতীয় মন্দিরে দেখে থাকি। বড় ভালো লাগল। সব মিলিয়ে অদেখা ইতিহাসকে প্রত্যক্ষ করে ফিরলাম।
মহিষাসুরমর্দিনী---শিবদৌলের দেওয়ালে |
দেবীদৌল |
শিবসাগর থেকে বাসে যোরহাট, যোরহাট থেকে অন্য বাস ধরে চললাম
কাজিরঙ্গা জাতীয় উদ্যানের উদ্দেশে । রাস্তার ধার ধরে বিশাল উদ্যান, কোথায়
নামতে হবে আমাদের জানা ছিল না, ড্রাইভারকে
আমাদের উদ্দেশ্য জানিয়ে বললাম ঠিক জায়গায় নামিয়ে দিতে। ঠিকঠাক জায়গায় নামার পর
অটোওলাকেই বললাম আমাদের বাজেট এবং চাহিদা মত
একটা ভাল হোটেলে পৌছে দিতে, সে
একটা হোমস্টে-তে পৌছে দিল। বাড়ির মালিক মিঃ বরদলৈ আমাদের পছন্দ করলেন, আর আমরা তাঁকে এবং তাঁর ঘরকেও। তবে
খাওয়াটা বাইরে খেতে হবে, কারণ তাঁর বাড়িতে রান্নার লোক নেই,
বাড়িতে তাঁরা তিনজন মাত্র লোক, তিনি
রিটায়ার্ড শিক্ষক, তাঁর দুটো মেয়ে, বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, ছোট মেয়ে এম এ পাশ করে চাকরির খোঁজে আছে, আর তাঁর স্ত্রী পায়ের অসুবিধা নিয়েই
চাকরি করেন, কাজেই রান্নাবান্নার
অসুবিধে। অল্প দূরেই বাজারের কাছে খাবার হোটেল আছে, নামও বলে দিলেন। সম্পর্ক ব্যবসায়িক, পরিচয় সদ্য, সামান্য
ভাষাজ্ঞানের দৌলতে আমাদের কাছে দুদিনের জন্য উনি আত্মীয়ের মত হয়ে গেলেন, অনেক গল্প করলেন। এব্যাপারটা
ভূভারতে একমাত্র আসামেই বোধ হয় সম্ভব।
বরদলৈবাবুর উপদেশ অনুসারে আমরা ভোর ছটায়ই বেরিয়ে পড়লাম ফরেস্ট অফিসে টিকিট কাটতে। আমরা জীপ সাফারি করব, আমাদের কোমর-হাঁটুব্যথার জন্য হাতিসাফারি সম্ভব হবে না, আর হাতি সাফারি করতে গেলে নাকি ভোর চারটেয় বেরোতে হয়! তার মানে ঘুম থেকে উঠতে হবে তিনটেয়। আমাদের মত আরো কিছু দর্শনার্থী জমা হল, আমরা প্রথম জিপেই স্থান পেলাম। খোলা জিপ, প্রয়োজনে দাঁড়িয়েও দেখা যাবে। জিপ চলতে শুরু করতেই মাঘের কনকনে ঠান্ডা টের পেলাম, মাথা নাক মুখ ও যথাসম্ভব ঢেকে ফেললাম।
এর আগে আমি দুটো জাতীয় উদ্যানে ভ্রমণ করেছি, গির, ও ডুয়ার্সের গরুমারা, এবারে তৃতীয় উদ্যানে এলাম। প্রত্যেকটা জায়গার চরিত্র কত আলাদা । বছর তিনেক আগে গির-এ গিয়েছিলাম। ওখানকার জঙ্গল রুখাসুখা, অক্টোবর মাসেও শুকনো, ঘাস ও কাঁটাঝোপের আধিক্য, বড় গাছ কম। এবারের জার্নির প্রথমটায় গরুমারাতে গিয়েছিলাম। অনেকখানি জায়গা জুড়ে শুকনো নদীখাত, অল্প জল বইছে, ধু ধু নুড়ি ও সাদা বালুর চর। রাস্তার দুধারে বড় বড় গাছ, কিছু লাগানো গাছ ও আছে। জঙ্গলের এলাকাতেই কিছু বসতিও আছে। এমন কি ওই অঞ্চলে কিছু কিছু জায়গায় রবার বাগান ও লাগানো হচ্ছে।
এই ধরণের কর্মকাণ্ডের পরিণতি জীবকুলকে বিপন্ন করে তোলে। গরুমারাতেও বুনো মোষ ও গণ্ডার দেখেছি ওয়াচ টাওয়ার থেকে, সংখ্যায় কম। নদী ও ঝিলের জলে অনেক পাখির সাক্ষাত মেলে। মূর্তি নদীর চরে বিকেলের দিকে ময়ূরের দল নেমে আসে। তবে কাছে থেকে দেখা মুস্কিল, একটু দেখবার জন্য দাঁড়ালেই পালিয়ে যায়। ওখান থেকে শিলিগুড়ি ট্রেনে ফেরার পথে মহানন্দা স্যাংচুয়ারি পড়ে, পড়ন্ত বিকেলে বন থেকে বেরিয়ে আসে ময়ূরের পাল,
ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা যায়। তখনই বরং তাদের ভাল দেখেছি, আর এত উজ্জ্বল রঙের ময়ূর বোধ হয় কমই দেখেছি। হয়তো সবুজ প্রকৃতির কোলে বলেই তাদের এত ভালো লেগেছিল।
কাজিরঙ্গায় আমাদের গাইড মিঃ গগৈ বললেন, এই উদ্যানে নাকি বাইরের কোনো জীব রাখা বা কোনো গাছ লাগানো হয় না এখানকার জীববৈচিত্র্যের নিজস্ব চরিত্র বজায় রাখতে। বাইরের জীব এখানকার আবহাওয়া বা স্থানীয় জীবজন্তুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে থাকতে নাও পারে।
তার থেকে এখানকার আদি বাসিন্দা জন্তুদের অনিষ্ট ও হতে পারে। এখানে যদি আদৌ কোনো গাছ লাগানো হয়, তা হবে এখানে যে ধরণের গাছ পাওয়া যায়, তারই চারা বা বীজ। জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে বিরোধ না ঘটানোর জন্য এখানে রাস্তা ও পিচবাঁধানো হয় না, নদীর পুলগুলো ও কংক্রিটের নয়, কাঠের। কাজিরঙ্গাতে অনেকগুলো জলা, বেশ কটা ছোটবড় নদী আছে, ব্রহ্মপুত্র তো আছেই।
সুন্দরভাবে বুঝিয়ে তিনি বললেন, বন্যার ও উপযোগিতা আছে। বন্যার ফলে পলি পড়ে, গাছগাছালির পাতা পচে সার হয়, জল সরে গেলে ঘাস গাছ গাছড়া বৃদ্ধি পায়, তৃণভোজী জন্তুর খাবারের জোগান বাড়ে, তখন মাংশাসী প্রাণীও খেতে পায়।
বন্যায় গোড়া আলগা হয়ে গাছ পড়ে গেলে গাছ মরে যায় সত্যি, কিন্তু সে গাছে পোকা, উই, পিপড়ে প্রভৃতির বাড়বাড়ন্ত হয়, তারা আবার পাখি, বনরুই ইত্যাদির খাদ্য। কাজেই বনাঞ্চলে কোনো কিছুই অপ্রয়োজনীয় নয় । তবে বনের মাঝে মাঝে কিছু কিছু জায়গা খানিকটা উঁচু করে দেওয়া হয়েছে, যাতে বন্যার সময় পশুরা আশ্রয় নিতে পারে। জীববৈচিত্র্যের ঐতিহ্য বজায় রাখার জন্যই কাজিরঙ্গা ইউনেস্কো (UNESCO) দ্বারা স্বীকৃত বিশ্বঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে।
কাজিরঙ্গার তিন ভাগ---পূর্ব, মধ্য এবং পশ্চিম। পূর্ব কাজিরঙ্গা পরিযায়ী ও স্থানীয়--- সব পাখিদের দেখার জন্য
আদর্শ, কারণ সেদিকে
ব্রহ্মপুত্র ও তার সংলগ্ন জলাভূমি আছে। সবচেয়ে বেশি জন্তুর আবাস হল মধ্য কাজিরঙ্গা। এখানে উঁচু উঁচু ঘাসের বন, বড়বড় গাছের ঘন অরণ্য, মাঠ, আগাছা, জলা, ছোট নদী সবই আছে, যাতে সবরকম জন্তুই থাকতে পারে। পাখিও আছে। আয়তন ও বেশি। আমাদের ও সেখানেই নিয়ে যাওয়া হল।
হাতির দল রাস্তা পেরোচ্ছে। |
জলার ধারে হরিণ চরছে |
জিপ বনের মধ্যে অল্প এগোতেই হরিণের পরিবার--- নিশ্চিন্তে ঘাস খাচ্ছে। হরিণেরা দলে, বন্য শুয়োর একা একা, চরে। হরিণের বেশ কয়েক প্রজাতির । বন্য মোষ চোখে পড়ল । বন মোরগের পরিবার রাস্তার উপরে চরছে। গণ্ডাররাও একা একা চরছে, তবে কাছে চোখে পড়ল না।
তবে সারা রাস্তায় গণ্ডারের মলের ঢিবি---তার মানে তারা রাতে রাস্তাতে থেকেছিল, দিন হতে নেমে গেছে। রাস্তার উপর বনমোরগ চরছে। দেখতে প্রায় গৃহপালিত মোরগের মতই, শুধু একটু কৃশ। এক জায়গায় হঠাৎ ড্রাইভার গাড়ি থামাল, আমাদের বলল একেবারে শব্দ না করতে। হাতির পাল রাস্তা পেরোচ্ছে। সামনে তাকিয়ে দেখি, সত্যিই তো। একটা বড় হাতি আমাদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে, দলের অন্যরা রাস্তা পার হচ্ছে, দলে বাচ্চাও আছে। কাজিরঙ্গায় আসা সার্থক হয়ে গেল।
হাতিরা রাস্তা পেরিয়ে ঘাসবনে ঢুকে গেল। ঘাসগুলো এত উঁচু যে হাতিদেরও প্রায় লুকিয়ে ফেলল। এই ঘাস ওদের খাদ্য। হাতিরা চলে গেলে জিপ আবার এগোল।
আরো খানিকটা এগিয়ে একটা পরিষ্কার মাঠমতন জায়গার মিনিট দশেকের যাত্রাবিরতি। এখন দেখলাম, আমাদের পেছন পেছন আরো চারপাঁচটা জিপ এসেছে। তার মানে আমরা সত্যি ভাগ্যবান, যে জন্তুগুলো আমরা দেখতে পেয়েছি, পেছনের জিপের লোকেরা তার সুযোগ কম পেয়েছে।
এই জায়গাটার দুপাশে বিল। জলায় দেখলাম পেলিকান, হাড়গিলা, সারস, নানা ধরণের হাঁস, বক । ছবি নেওয়াটা বড্ড মুশকিল, ক্যামেরা তাক করতে করতে জন্তুরা সরে যায়।
আমাদের তো সাধারণ মোবাইল ক্যামেরা। দ্বিতীয়ত, ছবি তুলতে গেলে দেখা হয়না ভাল করে। তবুও কিছু ছবি নেওয়া হল।
বনের মধ্যে প্রচুর উচু উঁচু শিমুলগাছ এই প্রাক্বসন্তে আকাশপ্রান্তের অনেকটা লাল রঙ ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে। উঁচু গাছে বাজপাখি বসে আছে, গাইড দেখাল। ক’জন বিদেশি পর্যটক ও পেছনের জিপে এসেছে। ওদের হাতে দূরবীণ, ওরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়েই পর্যটনে আসে।
যা দেখলাম, যা পেলাম, তাতে মন ভরে গেল, মনে হল জীবন সার্থক। ফিরে যেতে যেতে তবুও আবার দেখবার বাসনা রইল।
বুনো মোষ |
অর্কিড |
ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মুক্তমঞ্চ |
তাঁতবোনায় মগ্ন শিল্পী |
কাজিরঙ্গা জাতীয় উদ্যান দেখার পর আমাদের হাতে সময় ছিল। বরদলৈবাবুর উপদেশে বিকেলবেলায় আমরা গেলাম দু কিলোমিটার দূরে অর্কিড ও উদ্ভিদবৈচিত্র্য উদ্যানে। এখানে উত্তরপূর্বের নানা জাতীয় অর্কিড, ভেষজ গুল্ম, ক্যাক্টাস, ফলফুলের গাছ, এই অঞ্চলের হস্তশিল্প, হাতেবোনার তাঁত, তাঁতজাত কাপড়, কাঠ ও বাঁশবেতের জিনিষ ইত্যাদি রাখা আছে। সেইসঙ্গে আসামের ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্বিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর পরিচয় এবং ফোটোগ্রাফও গ্যালারি করে সাজিয়ে রাখা আছে। একটা মুক্ত মঞ্চ আছে, যেখানে গায়ক ও নৃত্যশিল্পীরা একের পর এক জনজাতীয় গান, নাচ, করে যাচ্ছে। আসামের সাংস্কৃতিক পরিচয় করিয়ে দেবার এ এক সাধু প্রচেষ্টা । উদ্যান ঘুরে দেখার পর আমরা সেখানে বসে বেশ কিছুক্ষণ আসামের লোকগীতি শুনলাম, মিসিং, নাগা ও অসমীয়া বিহু নাচ দেখলাম ।
এই অভিজ্ঞতা আমাদের বাড়তি পাওয়া হল। অনেক আনন্দস্মৃতি নিয়ে কাজিরঙ্গাকে বিদায় জানালাম।
আমরা কাজিরঙ্গা থেকে বাসে নগাওঁ হয়ে লামডিং, সেখানে দুদিন আতিথ্যগ্রহনের পর ট্রেনে বদরপুর ও সেখানে আবার দুদিন থেকে ট্রেনে আগরতলা গিয়েছিলাম। নতুন ব্রডগেজ রেলপথে এই প্রথম যাওয়া। মিটারগেজে আগে অনেকবার যাতায়াত করেছি, এই রাস্তার দুপাশের দৃশ্যাবলী অতুলনীয়। আগে ট্রেন ধীরে চলত, সময় লাগত, কিন্তু জানালার কাছে বসতে পেলে গাড়ি অনেকক্ষণ
থেমে থাকলেও বিরক্তি ধরত না, বাইরের দিকে তাকিয়ে সময় কেটে যেত।
তখন থ্রি-টিয়ার স্লিপার ক্লাসেই যাতায়াত করতাম।
হাফলং স্টেশন |
এবারে দুর্ভাগ্যবশত আমাদের টিকিট কাটা ছিল এসি থ্রি টায়ারে, আর কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের জানালাগুলো যে ঘষা কাচে তৈরি তা জানা ছিল না! পাহাড়লাইনে ব্রডগেজ লাইনে ট্রেন পেয়েছ এই ঢের! আবার স্ফটিকস্বচ্ছ জানালা পেতে হবে, মামাবাড়ির আবদার! কাজেই আমার এত সাধের রেলযাত্রা বদরপুর অবধি বৃথা গেল। তবে বদরপুর থেকে আগরতলার যে ট্রেন ধরলাম, তাতে অবশ্য জানালা পরিষ্কার ছিল। দেখে চমৎকার লাগল যে ত্রিপুরার দিকে রেলস্টেশনগুলো বেশ সুন্দর সাজানো। আগরতলা ও উদয়পুর স্টেশন দুটো তো রীতিমত সুন্দর। অন্যত্র এইরকম স্টেশন করলে কি রেলের খুব ক্ষতি হত!
সামনেই ত্রিপুরার নির্বাচন। আগরতলা থেকে আমাদের কলকাতার টিকিট মাস তিনেক আগে কাটা, নাহলে এই সময়ে
যাওয়ার ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতাম। অসুবিধে হবে---কি আর করা, আজকাল বিমানের টিকিট
ক্যান্সেল করলে উলটে টাকা দিতে হয়। কারণ আপনি যখন কেটেছিলেন, তখন সস্তার(!) টিকিট
নিয়েছিলেন, আর যখন ক্যান্সেল করাচ্ছেন, বিমান কর্তৃপক্ষ তৎকালের রেটে ক্যান্সেল
করবে, কাজেই তৎকালের টিকিট বাতিল করিয়ে ফাইন টাইন কেটেকুটে যা থাকার কথা তা আপনার
কেনা টিকিটের দামের চাইতে বেশি(যদিও বিমান টিকিটের দাম এত বেশি কেন হয় তা বোঝার অগম্য)। তাই তার সঙ্গে আপনার কেনা টিকিটের যা ফারাক, তা উলটে এয়ারলাইন্সকে
দিতে হবে! তাই আমাদের প্রোগ্রাম বজায় রইল। আমরা নির্বাচনের তিনদিন আগে ত্রিপুরা পৌছলাম। নির্বাচনের আগের দিন আমাদের উড়ান।
ট্রেনে গেলে যা হয়---সহযাত্রীদের সঙ্গে গল্পগুজব করতে
করতে ও শুনতে শুনতে যাওয়া যায়, বেশ সময় কেটে যায়। কিছু সহযাত্রী পেয়েছিলাম, যারা
শুধু ভোট দিতেই ত্রিপুরা যাচ্ছেন। তাদের কেউ কলকাতা, কেউ যোরহাট কেউ বা আর কোথাও,
ত্রিপুরার বাইরে থাকেন জীবিকার জন্য। দূর থেকে টাকা পয়সা খরচ করে শুধু ভোট দেবার
জন্য সপরিবারে যাওয়াটা একটু অস্বাভাবিক লেগেছিল। আজকালকার নাগরিকেরা কি এতটাই রাজনীতিসচেতন হয়ে উঠেছে! একসময় ট্রেনের
কামরায়ই নির্বাচনী স্লোগান শুনতে পেয়েছিলাম, ‘চলো পালটাই’।
আমরা রাজনীতির লোক নই, কোনো রাজনৈতিক তত্ত্বের একনিষ্ঠ
ভক্তও নই, তবে যে কোনো সাধারণ মানুষের মতই
দুর্নীতি, অন্যায়, অত্যাচার দেখলে মনে কষ্ট পাই। মনে মনে চাই দেশের লোক জীবনযাত্রার সুবিধাগুলো উপভোগ করুক, মানুষকে খাদ্যের অভাবে চিকিৎসার
অভাবে যেন ধুঁকতে না হয়, পার্টিবাজির বা দাঙ্গাবাজদের কুচক্রে যেন মরতে না হয়।
প্রত্যেকেই যেন খেয়ে পরে অন্তত কিছুটা
শিক্ষা পেয়ে আলোকিত জীবন যাপন করে। যে রাজনৈতিক দল দেশের মানুষকে এটা দিতে পারবে,
সে-ই ভাল, সে-ই সরকারে আসুক।
যে দুএকজন রাজনীতিক নিজে দুর্নীতিগ্রস্ত নন এবং তাঁর
পরিবারের কেউ ও অ্নৈতিক সুবিধে নেয় না, এবং তিনি নিজে যথাসাধ্য ভাল কাজ করার পরও তিনি বা তাঁর দল হেরে যান তখন খারাপ লাগে। তবে ব্যাপারটা হল যে নেতা ঠিক থাকলেও তাঁর
দলের যারা জনসাধারণের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে তারা যদি দুর্নীতিগ্রস্ত,
ক্ষমতালোভী ও উদ্ধত হয়, তার দায়ও নেতার উপরে পড়ে। অনেকদিন ধরে কোনো দল ক্ষমতায় থাকলে দলের সভ্যদের অনেকেরই এরকমের
ঔদ্ধত্য আসে, তারা সাধারণের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। গণতন্ত্রে বহুস্বর থাকেই---
সেই স্বর যদি শাসকের থেকে ভিন্ন হয়, তারা তাকে গলা টিপে
মারতে চায়। পশ্চিম বাংলায় কয়েক বছর আগে এই ব্যাপারটা দেখা গিয়েছিল। সেই কারণে মানুষ
মরিয়া হয়ে পরিবর্তন এনেছিল। অথচ মুখ্য নেতৃত্ব সেখানেও দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল না।
ত্রিপুরায় পৌছে হোটেলে ছিলাম। ঘোরাফেরার ফাঁকে ফাঁকে
সাধারণ লোকের সঙ্গে আলাপে আরো কিছু কথা শুনলাম---কেন্দ্রের শাসক দল শুধু দলের ও সরকারের মাথাদের প্রচারে পাঠিয়ে ক্ষান্ত
হয়নি, যথেষ্ট টাকা খরচ করেছে, ক্লাবগুলোকে টাকা বিলিয়েছে।(পশ্চিম বাংলায় বর্তমান শাসকদল এ
ব্যাপারে গুরু) তাই নিচুতলার খাটুনির লোক যথেষ্ট পাওয়া গেছে, ভোটার ও পাওয়া গেছে। সেই টাকা কোথা থেকে এসেছে তা তো
বোঝাই যায়, নির্বাচনের সময় যাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়, তারাই ব্যাঙ্কের লক্ষকোটি টাকা নিয়ে বিদেশে পালায়। এইসব আলাপচারিতায় আমাদের তখন এই নির্বাচনের ভাবী ফল
সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা হয়ে গিয়েছিল। রাজনীতিতে ভোটে জেতাই সব, জিতলে পরে
প্রতিশ্রুতি আর কোন দল রাখে! তবুও, ত্রিপুরাবাসীর পছন্দকে স্বাগত।
আগরতলায় হোটেলকর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় আমরা প্রথমদিন উদয়পুরের মাতাবাড়ির ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির, নীরমহল, সিপাহীজলা স্যাংচুয়ারি (চিড়িয়াখানা)দেখলাম, দ্বিতীয়দিনে কুমিল্লা বর্ডার, কমলাসাগর-কসবেশ্বরী মন্দির, চৌদ্দ দেবতার মন্দির, ও উজ্জয়ন্ত রাজপ্রাসাদ-মিউজিয়ম ও আগরতলার ভারত-বাংলাদেশ চেকপোস্ট । নির্বাচনের জন্য গাড়ি খুব কম, তাই এর বেশি কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
ত্রিপুরেশ্বরী বা ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির পুরনো শক্তিপীঠ, জনশ্রুতি অনুসারে ৫১পীঠের অন্যতম। এখানকার দেবী ত্রিপুরার রাজাদের পূজিত হতেন। মন্দিরটি লাল রঙের, খুব বড় কিছু নয়, পুরোনো বাংলার মন্দিরের মতোই, বেশি সাজসজ্জা নেই। মন্দিরের কাছে একটি বড় দীঘি, জলে অসংখ্য বড়বড় কার্প জাতীয় মাছ। মন্দিরের কাছে দোকানগুলোতে দেবীর নৈবেদ্যের জন্য বিক্রির উদ্দেশ্যে যে প্যাড়া পাওয়া হয়, তা খুব সুস্বাদু, খেয়ে মনে হয় খাঁটি দুধের তৈরি ।
নীরমহল |
উজ্জয়ন্ত রাজপ্রাসাদ |
মাতাবাড়ি ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির |
কাঁটাতারের বেড়ার একপাশে গেট |
ইন্দো-বাংলা সীমান্তে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক |
নীরমহল মুঘল-রাজপুত স্থাপত্যশৈলীর অনুকরণে বানানো ত্রিপুরার রাজাদের প্রমোদভবন, ভিতের কাছটা লাল, উপরের অংশ সাদা। ভেতরে রাজার থাকবার ঘর, বাইজিদের থাকবার জায়গা, নাচমহল, থিয়েটারের জন্য মুক্ত মঞ্চ, স্নান খানাপিনা রসুইএর জায়গা, হাওয়ামহল, বাগান, রক্ষীদের থাকার জায়গা সব আছে। জলের উপর নির্মিত মহলটি খুবই সুন্দর লাগে, এবং রাতে আলো জ্বাললে নিশ্চয়ই অপূর্ব দেখাবে, কারণ একটি বড় বিলের মধ্যে এর অবস্থান। যেতে হয় নৌকো করে। তবে বিলে এখন জল শুকিয়ে যাচ্ছে। মাঝি বলল, গোমতী নদীর এক শাখা এই বিলের মধ্য দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। সেখানে গভীরতা কিছু বেশি, বাকি অংশের গড় গভীরতা তিন/চার ফুটের বেশি হবে না। কিনারাগুলো ভরাট করে চাষ হচ্ছে, রাস্তা বা বাঁধ কিছু একটা তৈরি হচ্ছে একপাশে জলের মধ্য দিয়ে! নীরমহলের পেছন দিকে জল প্রায় নেইই। এ অবস্থা চলতে কিছুদিন পরে নীরমহল নামের সার্থকতা কতদিন বজায় থাকবে ভাবনার বিষয়। মাঝির মুখে শুনলাম দেশবিভাগের পর নাকি ছ’শ উদ্বাস্তু মৎস্যজীবী পরিবারকে নীরমহলের বিলে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কালক্রমে সরকারি মদতে আরো দুহাজার মৎস্যজীবীকে এখানে বসানো হয়। ফলে মাছে টান পড়ে। এখন তাই বিলের জায়গায় জায়গায় জাল দিয়ে ঘিরে চিংড়ি চাষ ও হচ্ছে। তবুও এত লোকের জীবিকার সঙ্কুলান হচ্ছে না, তাই বিলের চড়ায় চাষবাস হচ্ছে। মাঝির কথায় বেশ অসন্তোষের ছায়া।
পথে যেতে যেতে দেখলাম বিশাল বিশাল টিলা এলাকা জুড়ে রাবার বাগান। প্রথমদিকে যেসমস্ত টিলাতে কবছর জুম চাষ করার পর চাষযোগ্য না থাকাতে পরিত্যক্ত হত, সেগুলো্র অনেকগুলোই সাফ করে রবার বাগান করা হত। পরে অন্য টিলাও রবারচাষের আওতায় আসে। গাছগুলোর নিচের দিকে অল্প কেটে সেখানে কৌটোর মত পাত্র বাঁধা, তাতে রবার রস জমছে। এই কৌটো প্রতিদিন সকালে খুলে নিয়ে মেসিনে কিছুটা শুকিয়ে চৌকো চ্যাপ্টা শীট(sheet) বানানো হয়, তারপর রোদে শুকোনো হয়। যখন অনেক মাল জমে যায়, সেগুলো ট্রাকে করে অন্য রাজ্যের বা দেশের রবার ইন্ডাস্ট্রিতে পাঠানো হয়। রবার বাগানগুলো ব্যক্তিমালিকানার, তাই রবারবাগিচার অধিকারীদের এবং সরকারেরও রয়্যালটি থেকে বেশ অর্থাগম হচ্ছে। কিছু লোক শ্রমিকের কাজে নিযুক্তি পাচ্ছে। এখন শীতকালে পত্রহীন ন্যাড়া গাছগুলো, এইসব বাগানে কোনো আগাছাও জন্মায় না, কোনো বন্যপ্রাণী, পাখি, কিছু এই বনে বাস করে না। যদ্দূর শুনেছি, রবারগাছ মাটির আর্দ্রতা উর্বরতা শুষে নেয়, এর
রক্ষণাবেক্ষণে অপর্যাপ্ত কীটনাশকের প্রয়োজন, মানে ভবিষ্যতে এই সমস্ত টিলাজমি চিরতরে বন্ধ্যা হয়ে যাবে। পরিবেশ বজায় রেখে উন্নয়ন---সোনার পাথরবাটি, অন্তত এদেশে।
সিপাহীজলায় একটি ছোট চিড়িয়াখানা আছে, এখানে গাছপালা বেশি, অনেকখানি জায়গা জুড়ে বন, এটা অভয়ারণ্য হিসেবেও গড়ে উঠতে পারত। কিন্তু তা হয়নি, আমাদের ড্রাইভার বলল, আগে এটা অভয়ারণ্যই ছিল, পরে চিড়িয়াখানা বানানো হয়েছে। লাগোয়া বনের অনেকখানি জায়গায় রবারবাগিচাও লাগানো
হয়েছে। আর কোনোদিন অভয়ারণ্য এখানে গড়ে উঠবে বলে মনে হয়না।
পরদিন কমলাসাগর ও কসবেশ্বরী কালীমন্দির। কালীমন্দিরটি একটু টিলার উপর, তেমন কোনো বিশেষত্বহীন। কমলাসাগর একটা বড় দিঘি, ত্রিপুরার রাজারা মন্দিরের পাশে বড়বড় দিঘি খনন করাতেন, এটা বেশ ভাল জনহিতকর কাজ। কমলাসাগরের ওপারে সীমান্তের কাঁটাতার, কাঁটাতারের ওধারে বাংলাদেশের কুমিল্লা রেলস্টেশন। এদিকে রাস্তা, এই রাস্তা ধরেই আমরা যাব, রাস্তার ধারে বর্ডার হাট, কাঁটাতারের একধারে একটি লোহার গেট। প্রতি রবিবার করে এই ফটক খুলে দেওয়া হয় বাংলাদেশি হাটুরেদের জন্য। কিছু উল্লেখ করে দেওয়া জিনিস, যেমন লুঙি, গামছা, স্থানীয় শাকসবজি, ফল, এইধরণের জিনিসই ঐ হাটে ক্রয়বিক্রয় হয়। কত কাছে ওপার, একই রকম দেখতে, শুধু কাঁটাতার একই দেশকে দুভাগ করে দিয়েছে!
ত্রিপুরায় দু-জায়গায় বর্ডারের কাছে গেলাম; এরপর বিকেলের দিকে, আগরতলা চেকপোস্ট, উল্টোদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এখানে কাঁটাতারের ওপারে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক একটি সবুজ লাল গম্বুজ। আগরতলা-ঢাকা বাস সদ্য এসে পৌছেছে, যাত্রীদের কাগজপত্র পরীক্ষা করে ছাড়া হচ্ছে। আমরা অনেক দূর থেকে এসেছি শুনে গেটের ভেতরে খানিকটা এগিয়ে যাবার মৌখিক অনুমতি দেওয়া হল, আমরা শেষ গেট অবধি এগিয়ে গেলাম, আর এগোলেই বাংলাদেশ। একই রকম সবকিছু, কিন্তু আলাদা দেশ। শুধুই মনে হচ্ছিল,
এত কৃত্রিম অস্বাভাবিক ভাগ কী করে হল!
পতাকা নামানোর অনুষ্ঠানে আমরা থাকব না, কারণ তাহলে অনেক সময় অপেক্ষা করতে হবে। এখন বেশ চড়া রোদ। ফিরে এলাম ।
এই বর্ডারে যাবার আগে শহরের মধ্যে উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ ও মিউজিয়াম দেখে এসেছিলাম। প্রাসাদটি নিও- ক্লাসিক্যাল, মানে প্রাচীন রোমান, মধ্যযুগীয় মুঘল স্থাপত্যের সঙ্গে
আধুনিক স্থাপত্যের নিপুণ সংমিশ্রণে
নির্মিত। সাদা ধবধবে প্রাসাদটি পুরো উত্তরপুর্বের গর্ব বলা যেতে পারে, খুব
সুন্দর। সামনের গেটটা ও প্রাসাদোপম। গেটের পর সাজানো বাগান অনেকটা জায়গা জুড়ে। বাগানে মহারাজা রাধাকিশোরমাণিক্যের পূর্ণাবয়ব মূর্তি যিনি প্রাসাদটি উনবিংশ
শতকের একেবারে শেষের দিকে (১৮৯৯-১৯০১)নির্মাণ করান।‘উজ্জয়ন্ত’ নামটি রবীন্দ্রনাথের
দেওয়া। রবীন্দ্রনাথ রাধাকিশোরমাণিক্যের বন্ধু ছিলেন। প্রাসাদটি রাজাদের বাসস্থান ছিল, বর্তমানে মিউজিয়ামে
রূপান্তরিত করা হয়েছে। এটি উত্তরপূর্বের বৃহত্তম মিউজিয়াম। মিউজিয়ামে ত্রিপুরা ছাড়াও
উত্তরপূর্বের অন্যান্য রাজ্যগুলির সাংস্কৃতিক পরিচয় দেবার প্রচেষ্টা করা হয়েছে প্রত্নতাত্বিক
নিদর্শন, ফোটোগ্রাফ, মডেল ইত্যাদির মাধ্যমে।
সময় শেষ হয়ে এলো, কিন্তু ভ্রমণ সম্পূর্ণ
হলনা। কত কিছু দেখা বাকি থেকে গেল। দেখা কবেই বা সম্পূর্ণ হয়!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন