।। চিরশ্রী দেবনাথ।।
আঠারোটি দীর্ঘ কবিতা
লেখক: সেলিম মুস্তাফা
সৈকত প্রকাশন
মূল্য: ১৫০ টাকা
"আমি
আপনাদের কাছে আসিনি
আমি খুঁজছি আমাকেই
আজ সকাল থেকে আমি
গায়েব
কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না
আমাকে
সোস্যাল সাইটের
কল্যাণে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে আমার নাবালক ছবি
ছিঃ ছিঃ! কী কাণ্ড
ভাবুন!
সিনিয়র সিটিজেন হবার
পরও আমি নাবালক রয়ে গেলাম
আর আপনারা হয়ে গেলেন
বোবা শালগ্রাম’
"আমি কোথাও নেই’ অষ্টাদশতম দীর্ঘ কবিতার কয়েকটি পঙক্তি।
তিনি
সেলিম মুস্তাফা।কবি অস্তিত্বের দ্বন্দ্বে ভুগছেন। এই দ্বন্দ্বটি আমার মধ্যেও শাখা
প্রশাখা বিস্তার করছে। আমি কোথায়, আসলেই কি কবিতায় বসতবাড়ি, কবিত্বের
যে কোন বাসস্থান হয় না। সংঘাত আর যাযাবর
মনোবৃত্তিই কবিতা, সবসময় নতুন কিছু চাই।
"নিজেকে
ছাড়া আমি সব দেখি সব শুনি
তোমাকে চিনি আর তাকেও
চিনি
যাকে পাইনি’
এই তাকে
কোন কবি পেতে চায় বলুন, তাকে নিয়েই তো সমুদ্রের সফেন উচ্ছ্বাস।
"আমি তো
নিজেই নিজেকে সন্দেহ করি
আমার শরীরে পাগলের হাত
পা
আমার রক্তে নির্ঘুম
সমুদ্রলবণ’
এই পঙক্তিটি
মনে হলো আমারই কথা। আমার আমাকেই সন্দেহ হয়। কবি যদি ঈশ্বরের দূত হোন তবে সৃষ্টির
প্রতি এই সন্দেহগামিতা তাকে আরো দক্ষ করবে ।
এটা
বইটির শেষতম কবিতা। রচনাকাল লেখা নেই।
সতেরোতম
কবিতা ..."বাবু, ও বাবু’এই কবিতাটি খুব বেশী প্রত্যক্ষ ভাবে সমাজকে
ছুঁয়ে গেছে। কবিতায় উঠে এসেছে ধর্মনগর শহর, দৈনন্দিন যাপনের
খুচরো অভিঘাত। চারপাশে আবর্তিত সাধারণ চরিত্রগুলোর বাঙ্ময়তা, হতাশার ঝুরো বালি, কবির চোখ সমস্ত যাপনকেই চেনা চোখে
পরিচয় করিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন কবির একান্ত কাঠগড়ায়,
যেখানে বিচারক আমার মতো অর্বাচীন পাঠক।
"রাইমোহন’...রচনাকাল দুইহাজার চৌদ্দ।
এখানের কবি বাস্তবতার
লেখক। আধুনিকতার ক্রমাগত বিনির্মাণের প্রতীক হয়ে ওঠে কবিতাটির চরিত্র রিকশাচালক,"রাইমোহন’।
এই কবিতাটিতে কবির
অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব অপেক্ষা দৃষ্টির বহুমুখীতার অভিঘাত প্রাধান্য পেয়েছে। তাই এই
কবিতায় তিনি একজন সরল কবিতার পিতা।
খুব সহজভাবে তিনি বলেন
"মানুষ
কতকিছু খায়,
রিক্সা খেয়েছে, এখন টমটম খায়,
বাসগাড়ি খেয়েছে, এখন রেল খায়,
আগরতলায় তো অটোঅলারা
টমটম..ই খাইয়্যা ফেলাইছে ...
হাড্ডি গুঁড়া কইর্যা দিছে এক্কেবারে!
...
....
খাওন ছাড়া এ দুনিয়ায়
আর আছে কী? সব মিছা!’
"ঘর’...রচনাকাল ...নভেম্বর, ২০১৩
"কবিদের
অশ্বডিম্ব থেকে কখনোই
ঘোড়া বেরোয় না, জঞ্জাল আর অবমাননা,
সব এখানেই আছে, এই ঘরে,
ঘরের ভেতর আরও একটা
ঘরে...অন্ধকারে,
তবু,
ঘর এক দুনির্বার টান!’
আমার
কথাই। যে কবির এই ঘর নেই, সে কবিতা বানাতে পারে না, পারে না নিরন্তর মাকড়সার জাল সরাতে যা ক্রমশ জড়িয়ে
ধরে আছে কবির সমস্ত অস্তিত্বকে। এই জাল সরিয়ে সরিয়ে কবিতার গলা জড়িয়ে ধরা।
"কবিরা যা
বলেন তা কোথাও মেলে না
যা কল্পনা করেন তা
অকল্প্য বেদনা,’
সব মানুষ
অন্তরে অন্তরে কবি। খুনিরও আছে কবিতা, প্রতারকেরও আছে কবিতা, কারণ
কবিতা নির্গমন। সুন্দর এবং অসুন্দরের।
তাই এই পঙক্তিতে আমি কবির সাথে একমত নই। অকল্প্য শব্দটিতে আমি আটকে গেলাম। এখানে কি বলা যায়। যে বেদনা অকল্প্য তা
কল্পনা করবো কি করে? সংশয় রেখে গেলাম কবি।
"জল পড়ে পাতা নড়ে না’....রচনাকাল ...২০০৯
কবিতাটিতে
রয়েছে মধ্যবিত্ত জীবনের কথকতা আর ধার লাগা অনুভব।কবি বলেন,
"আঙুলের দশটি নখে
কিছু তো থাকবেই আঁধার!’
আমার তখন
বলতে ইচ্ছে হলো,
....আঁধার আমাকে আলো দিও, দিও শাপগ্রস্ত কবিতাকাল।
কবি
সেলিম মুস্তাফা বলেন
"রবীন্দ্রসংগীতের
বড় দাম..
কোনো ডায়া..বাঁয়া নেই, মৃদঙ্গ পরাণ...
একই অঙ্গ দুদিকে বাজে!’
"কাঁটাতার’...২০০৯
এই
কবিতায় একটি স্তবক সবকিছু বলে দেয়
"কবিতা
মুক্তির কথা কখনো বলে না।
শুধু প্রতিদিন
নিত্যনতুন
কাঁটাতারে
নিজেরে জড়ায়!’
"আজ পাঠশালা বন্ধ’...রচনাকাল ...২০০৬
এই
কবিতাটি ত্রিপুরার দামছড়ায় বসে রচিত।
কবি এখানে প্রতিটি লাইনে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। এখানে কবিতা নির্মাণের সমস্ত সম্ভাবনাসূত্রকে আশ্চর্যজনক ভাবে জয় করে
হয়ে উঠেছে চরম এক আত্মগত কাল। কবি একই সঙ্গে দুটো সময়কালের কথক।
..."কেহ
কিছু বলে না।
না শব, না শিব।
শব্দ আজ অনন্তকে
ছুঁইয়াছে। অনন্ত ডোম হইয়া তাবৎ মাটির কলস ভাঙিতে লাগিল।
গঙ্গা কাঁদিল।
সতী কাঁদিল।
কেহ টের পাইল না।’
এই অংশটি
এক মোহ সময় কবিতার। তন্ময়তা। কবিতার অনবদ্য ফ্রাসট্রেশন। এসব অংশ হৃদয়ে কোনো
প্রশ্ন তোলে না বলে শুধু পড়ো পড়ো।
"জীবন মহুয়া’...রচনাকাল...১৯৯০
"যারা বলে
ভালোবাসা অপরাধ, আর যারা বলে অপরাধই ভালোবাসা...
তারা প্রণম্য, তবু দেখা হয় না তাদের’
"আমার স্বভাবে
আছে এইসব দ্বিচারিতা
কাঁটার সংলাপ,
মনে হয় ভ্রষ্ট হয়ে আছি
মানুষের কষ্ট হয়ে আছি’
কবিরা
কিভাবে যেন অন্তরের কথা লিখে ফেলেন। কবিতায় প্রতিটি পাপ তাই অবিরাম পবিত্রতার কথন।
শুধু এখানেই কবিতা সব জয় করে বসে আছে।
বারবারই
তিনি দার্শনিক হোন আবার চরম এক সংসারী হয়ে, পিতা হয়ে, ফিরে আসেন গৃহে,
সেই লেবুফুলের চেনা সুবাসিত গন্ধে লালিত কবির বারান্দায়।
"এই পাহাড় ঘুম দাঙ্গা প্রেম ও প্রণিপাত’...রচনাকাল ...১৯৮৩, কাঞ্চনপুর, ত্রিপুরা।
এ
কবিতাতেই আছে, কবির বিখ্যাত লাইন,
"উত্তুঙ্গ
জম্পুই আজ বিষ খাওয়া যুবতীর মতো নীল হয়ে আছে,
তাকালে কষ্ট হয়. ..না
তাকালে আরো’
"কিন্তু
আমরা ভালোবেসেছি, এ কেমন ভালোবাসা!
আমরা সকলেই ভালোবেসেছি
কিছু ফুল কিছু পাখি আর বন্দুক,
ফুল পাখি আর বন্দুক
সবই মেয়েমানুষের দিকে গেছে,
মেয়েমানুষ কোনদিকে
গেছে আমরা কেউ জানি না, আমি জানি না,’
কবি
এখানে মেয়েমানুষ শব্দটির ব্যবহার করেছেন। আমি ব্যক্তিগত ভাবে এই শব্দটি পছন্দ করি না। মানুষ, মানুষী হতে পারে কিংবা
মানব...মানবী, কিন্তু কবিতা এখানে যে কথাকে বলতে চেয়েছে
সেখানে "মেয়েমানুষ’ছাড়া আর সমস্ত শব্দই তেমন জোরালো নয়। তাই এই মেয়েমানুষ একটি
অন্ধকারাছন্ন অবয়ব, রহস্য আর আলো, যার দিকেই অভিমুখ থাকে ফুল, পাখি আর বন্দুকের।
এ কবিতা
কবির যৌবনের কবিতা। ঠিক এসময়কালেই তার অন্য কবিতা
"ইতি জঙ্গল-কাহিনি’...রচনাকাল ....১৯৮২,
তখনই
তিনি লিখেছেন,
"একটি
রূপোর আংটি থেকে যায় তবু
আমাদেরই কারো কনিষ্ঠায়, রক্তে
সঞ্চারিত থেকে যায়
কিছু কিছু বিষ,
বাসুদেব, তুমি কি জান
রক্তে বিষ মেশালো কে?’
এই বিষ আমাদের সকলের মধ্যেই মসৃণভাবে সঞ্চালিত, মাঝে মাঝেই ছোবল দিতে
ইচ্ছে করে, মানবীয় ছোবল।
"আমার
প্রিয়ার শরীরে ছিল পানিফল’...রচনাকাল ...১৯৮২,
"চেয়ার
-টেবিল -কাগজ -কলম তুমি গুলিয়ে ফেলেছো. ..তুমি কেঁদেছো. ..
কাদের যেন ভালোবাসা
...কাদের প্রতি তোমার ভালোবাসা
রক্তে জীবাণুর মতো
তোমার মুখে আরেকজনের
মুখ ...তোমাকে বিব্রত গাছ মনে হয়’
এ এক
আশ্চর্য মুখোশ, অজান্তে মুখে বসে যায় তার যাবতীয় অসহায়তা নিয়ে। আমরা হেরে যেতে যেতে মুখোশ নিয়ে পৃথিবী থেকে চলে যাই।
"বাহান্ন তাসের পর’...রচনাকাল...১৯৭৮, ধর্মনগর, এই বইখানির প্রথম
দীর্ঘ কবিতা।
কবি
সেলিম মুস্তাফার সুপরিচিত কবিতা।
"তুমি জীবন
শেখাবে? কতটুকু জান?
বাহান্ন তাসের পরও আরো
এক তাস থেকে যায়. ..’
"আমি যে
তোমাকে আজ সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি!
একদিন ভালোও তো বেসেছি,
আজও কি মানচিত্রে সেই
চিহ্ন নেই?’
নাই, সে চিহ্ন নাই, সে চিহ্ন মুছতে মুছতে দীর্ঘ জীবনের জবানবন্দি লিখে যায় কবি।
"কিন্তু,
তুমি তো জানতে ...
একটা কুকুরের চেয়ে
একটা চাবুক পুষতে
ঢের বেশি মাংস
প্রয়োজন! তুমি তো জানতে
এ মাংস মাংস নয়, এ আমার মেধা এবং আমারই
হৃদয়’...
এই পাঠ
প্রতিক্রিয়া একটি অসম্পূর্ণ পরিভ্রমণ। আসলে কোন পাঠ প্রতিক্রিয়াই সঠিক নয়। এক এক
সময়ে এক এক কবিতা নাড়িয়ে দিয়ে যায়, আঘাত করে কবিতার নিভৃত গৌরবে।
তবুও এই
আঠারোটি দীর্ঘ কবিতার সঙ্গে আমার এক সপ্তাহ যাপনকাল একটু ভাগ করে নিলাম কবিতার পাঠকদের সঙ্গে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন