“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৮

অনিত্য


।। অর্জুন শর্মা ।।
(C)Image:ছবি
সে নাই। কোথাও নাই । জলে নাই ,স্থলে নাই, অন্তরীক্ষে নাই।বাতাসে নাই , ধূলিতে নাই , আলোতে নাই , আঁধারে নাই । মাটিতে নাই , নদীতে নাই , পাহাড়ে নাই । সে বনে নাই , মনেতে নাই ; নিঃশ্বাসে নাই , প্রশ্বাসে নাই ।
    রাত তখন দুটোর সীমানা ছেড়েছে । স্বরূপরানি বিছানায় উঠে বসেই চীৎকার করে উঠল- নাই , নাই , আমার সে আর নাই । ছিয়াশি বছরের বাগ্‌যন্ত্রে কান্নার সরগম বেজে উঠল । রাগ অনুমান করতে না পারলেও সুর , তাল , লয় যে কেটে গেছে তা অনুমান করতে পারছে পাশের খাটে সদ্য জাগ্রত বিনোদরানি । জেগে উঠেই বুঝেছে যে স্বরূপরানি প্রলাপ বকছে না । এ কান্না বিস্ফোট ফেটে যন্ত্রণার কান্না নয় , অপমানিতের কান্না নয় , স্বর্ণালংকার খোয়ানোর কান্না নয় । এ কান্না একবারই আসে । স্বরতন্ত্রী কেঁপে কেঁপে উঠছে স্বরূপরানির । মাঝে মাঝে বলছে , আহা রে , নাই , নাই , সে নাই , আমার টুলু নাই । বিনোদরানি দিদির খাটে উঠে আসে । হাতের পরশ লেপে দেয় দিদির গায়ে । স্বরূপরানির বাগযন্ত্র সেই ছোঁয়ায় ফুলে ফুলে কেঁপে ওঠে । চাপা ঠোঁটের আড়ালে গোঙানির শব্দ শোনা যায় । জড়িয়ে ধরে বিনোদরানি বলে , কী হয়েছে দিদি ? তুমি কি স্বপন দেখেছ আবার ? তোমার কোথায় কষ্ট আমাকে বল । স্বরূপরানি কেঁদে কেঁদে বলছে , তোরা যে যা বলিস , আমার টুলু নাই । চলে গেছে , আমায় ফাঁকি দিয়ে সে চলে গেছে । যাবার ছিল আমার , চলে গেল সে । তোরা খবর নে । আমার টুলুকে আমার বুকে এনে দে । আমার বুকের ধন আমি বুকে জড়িয়ে রাখব ।
 ততক্ষণে একে একে এসে জড়ো হয়েছে সন্তু , ফুলু ,তাদের বৌ-রা । ছোটরাও  এসেছে । তখনই ফোনটা বেজে ওঠে । ফুলুর ফোনের পর্দায় গুন্টুর নাম ভেসে উঠেছে । কানে চেপে ধরে ফুলু বারান্দায় যায় । ওপারের চাপা গলা বলছে , রাঙ্গাদা , টুলু নাই ,চলে গেছে । দুটো বার মিনিটে সে অনন্ত ধামে চলে গেছে । মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে সে অমরলোকে পাড়ি দিয়েছে।শেষ মুহূর্তে আমি কাছে ছিলাম। সন্ধ্যের সময়ও আমার হাতটা মুঠোর মধ্যে চেপে ধরে রেখেছিল অনেকক্ষণ । আমরা তো জানতাম জ্ঞান নেই । শুধু তো চেয়ে থাকতো । আমি পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম । হঠাৎ  আমার হাতটা তার হাতের মুঠোয় চেপে ধরল । আমি সরাইনি । হাতের পরশে আমায় যেন কিছু বলতে চেয়েছে । আমি বুঝতে চেষ্টা করলাম । মুখে বললাম , কিছু বলবি টুলু ? তার চোখের কোণ বেয়ে জল নামল শুধু । টুলুর বৌ তো সর্বক্ষণ পাশেই ছিল । শেষ সময়ে তার চোখের দিকে আমি তাকাতে পারিনি রাঙ্গাদা । টুলুর বৌ কাঁদছে না।সে এত দৃঢ়তা পেল কোথায় বল তো? শুধু চোখ মুছে বসে আছে । মনে হয় যেন ধ্যান করছে । টুলুর বৌ কি ঈশ্বরকে কিছু বলছে ? হতেও পারে । ও তো নিত্য পুজো করে । কী বলছে বল তো । আমি তো নাস্তিক , তোরাও বলিস । কিন্তু আমার ইচ্ছে করছে টুলুর বৌ-এর মতো বসে ধ্যান করতে । ঈশ্বর কি আমার কথা শুনবেন ? আমি ত কোনদিন তাকে ডাকি নি । কী বলব বলতো ? আমার কী মনে হয় জানিস ? যদি ঈশ্বর আমার আরাধনা গ্রহণ করেন তবে বলি যে , হে অনন্ত বিশ্বয়ের স্রষ্টা , আমার টুলুকে তোমার কাছে স্থান দিও । টুলু আমাদের সবার বড় প্রিয় । সবার ছোট ভাই । ও তো কোনদিন খারাপ কিছু করেনি , খারাপ কিছু ভাবেনি । কারও অনিষ্ট কল্পনা করেনি । তবু তাকেই চলে যেতে হল সবার আগে ।
 আচ্ছা রাঙ্গাদা, ঈশ্বরের কি এমন কোন স্থান আছে ? তুমি তো ধার্মিক , তোমার কী মনে হয় ? টুলুর তো তাহলে সেস্থানে যাবার অধিকার আছে । তুমি কোন উত্তর দিচ্ছ না যে ? আমার কথা শুনে কি অবাক হলে ? আমি এ কয়দিন টুলুর কাছে থেকে থেকে বোধ হয় ঈশ্বরের মহিমা মালুম করতে পেরেছি । বড়ঠাকুর শুনলে হয়তো বলবেন যে আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি । হবে হয়তো । কিন্তু টুলুর সপ্রাণ আর নিষ্প্রাণ মুখাবয়ব অবলোকন করে করে আমার অন্তরাত্মা কেমন যেন আলোড়িত হয়ে উঠেছে । মনে হল আমি এতো দিনে আবার জন্মলাভ করেছি । আমি যেন কিছুই জানতাম না এতোদিন । টুলুর নিষ্প্রাণ মুখে হাসির রেখা দেখতে পাচ্ছি আমি । মনে হল আমাকে চোখ বন্ধ করে সেই কথাগুলোই বলছে যেগুলো পঁয়ত্রিশ বছর আগে সে আমাকে বলত । হাফ প্যান্ট পরিহিত টুলু আমাকে বলছে,সোনাদাদা,ঈশ্বর কোথায় থাকেন?ওই যে তারারা আলো দিচ্ছে সেখানে ? তার চেয়েও দূরে ? ঈশ্বরের নাকি বাগান আছে?সেখানে নাকি ভাল লোকরাই যেতে পারে?মনে আছে তোর , বড়ঠাকুরের কাছে থেকে থেকে সে এসব আয়ত্ত করেছে । রাঙ্গাদা তুই কি শুনছিস আমার কথা?বড়ঠাকুর আর মাকে এতো রাতে কিছু বলিস না । অন্যদেরও বলবি কি? প্রয়োজন বুঝে বলিস । আমরা সকালে টুলুকে নিয়ে আসব । মাকে কীভাবে - - - - আমি কিছু বুঝতে পারছি না ।
    গুন্টুর ফোনের লাইন কেটে গেছে । কিন্তু ফুলু কানে ধরে রেখেছে । ফুলু এখন কী করবে ? সে অবাক হয়ে যাচ্ছে গুন্টুর এতোসব কথা শুনে । মনে করতে পারছে না গুন্টু এক নাগাড়ে এতো কথা তার সাথে কোনদিন বলেছে কিনা । মাকে জানাতে নিষেধ করেছে । মা তো ফোন ছাড়াই জেনে গেছে । ঈশ্বরই কি মাকে খবর দিয়ে গেলেন ? মার প্রায় অর্ধেক বয়সী টুলু । মা টুলু-অন্ত-প্রাণ । যেদিন টুলুর রাজরোগ ধরা পড়ল সেদিনও তো টুলু মাকে জানায় নি । সে ডাক্তারের রিপোর্ট নিয়ে ফিরেছে আর মা বলছিল , টুলু আমার কাছে আয় । বোস । তোকে একটু আদর করি । তোর খুব কষ্ট হচ্ছে , না রে ? কাছে বসিয়ে সেদিন মা টুলুর সারা গায়ে আদর বুলিয়ে দিয়েছিলেন । মা কি জেনে গিয়েছিল টুলুর কষ্ট ? চার ছেলে আর দুই মেয়ের জননী স্বরূপরানি বলতেন , আমার কলজেতে ছয়টা কুঠুরি আছে তোদের ছয়জনের জন্য । তবে টুলুর অংশটা বেশি । ফুলুর এখন সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে । সে কী করবে বুঝতে পারছে না । মার একটা গানের লাইন তার এখন মনে পড়ছে – ‘বিদেশেতে কারও যদি পুত্র মারা যায় ; পশু পাখি না জানিতে আগে জানে মায় । গানটার কথা কি এতোটাই সত্যি ফুলু ভেবে পায় না । মা তো সবই জেনে গেছেন , এখন সে কী করবে ?
    সে ছিল। হাটে ছিল,বাটে ছিল। সুখে ছিল,দুঃখে ছিল,উৎসবে ছিল,   আনন্দে ছিল,নিরানন্দে ছিল।চলনে ছিল,কথায় ছিল,হৃদয়ে ছিল,আহারে ছিল, বিহারে ছিল,খেলায় ছিল।গানে ছিল,সুরে ছিল,তালে ছিল। সে হামাগুড়ি দিত,সে থপথপে পায়ে হেঁটে বেড়াত । সে বনে বাদাড়ে দৌড়ে বেড়াত ,সে পুকুরে ঝাঁপ দিত ।  সে গাছে চড়ত তরতর করে।সে ডিগবাজি খেত,সে কুস্তি লড়ত।সে গান গাইত ,সে দাঁড়  বাইত । সে চাষ করত ,সে পাথর ভাঙত ।  
    পরদিন প্রাক-মধ্যাহ্নে টুলুর দেহ নিয়ে ফিরেছে গুন্টু । টুলুর বৌ মৃতদেহ আগলে বসে আছে । কোন অভিব্যক্তি তার প্রকাশ পায় নি । বাড়িশুদ্ধ লোক কেঁদে উঠল , প্রতিবেশীরা কাঁদল , বন্ধুরা কাঁদল । স্বরূপরানি শুধু মুখ বন্ধ করে হিক্কা ওঠার মতো একটা শব্দ করছিল থেকে থেকে । বয়স্করা বলল , একবার শেষ দেখা না দেখালে কি করে  হবে । বিনোদরানি আর গুন্টুর বৌ স্বরূপরানিকে দুই দিক থেকে ধরে নিয়ে এসেছে টুলুর শবদেহের কাছে । স্বরূপরানি টুলুরে , বাপ আমার , আমাকেও তোর কাছে নিয়ে যা বলে শবদেহের উপর আছড়ে পড়ল ।
    ছিয়াশি-পেরোনো স্বরূপরানি ছয় সন্তানের জননী । সন্তু , ফুলু , গুন্টু , টুলু এই চার ছেলে এবং বিপাশারানি আর বিশাখারানি এই দুই মেয়ে । টুলু সর্বকনিষ্ঠ । আজ থেকে স্বরূপরানি হয়ে গেল পাঁচ সন্তানের জননী । স্বরূপরানিকে উঠিয়ে নিয়ে শবদেহ শ্মশানমুখি করা হল । স্বরূপরানি চুপ হয়ে গেল । তাকে স্নান করিয়ে শুইয়ে রাখা হল ।
 গত বিশ বছরে এবাড়িতে মৃত্যুর ছাপ আরও আছে । বড়ছেলে সন্তুর প্রথম সন্তানটা পাঁচবছর বয়সে জলে ডুবে মরেছে । তাও উনিশ বছর হয়ে গেল । পরের বছর স্বরূপরানির স্বামী হার্টের অসুখে মারা যায় । এখন থেকে বছর দশেক আগে আর একটা ঘটনা ঘটেছিল । গুন্টুর বৌ-এর এক ভাই  এবাড়িতে থাকতো । একদিনের জ্বরে তরতাজা ছেলেটা দুম করে মরে গেল । সে শোক সামলাতে অনেক সময় লেগেছিল ।
    স্বরূপরানির পরপর তিন ছেলে শুক্রেশ্বর , ফুলেশ্বর , গুণেশ্বর । এরপর দুই মেয়ে । সবার ছোট থানেশ্বর , থানেশ্বর চৌধুরী ওরফে টুলু । টুলু নিঃসন্তান । সজ্জন , বিদ্বান । শুক্রেশ্বর ওরফে সন্তুকে সবাই বড়ঠাকুর বলে ডাকে । সন্তু অতিশয় ধার্মিক । মায়ের সতের বছর বয়সের সন্তান । গীতা , উপনিষদ তার নিত্যসঙ্গী বলা যায় । ফুলেশ্বর ওরফে ফুলও ধার্মিক । গুণেশ্বর ওরফে গুন্টু বেজায় নাস্তিক , গম্ভীর । কারও সাতে পাঁচে নেই । স্বরূপরানির স্বামী জ্ঞানেশ্বর  চৌধুরী শহরের বিশিষ্টজন বলে পরিচিত ছিলেন । সৈন্যবিভাগে পনের বছর চাকুরী করার পর ফিরে এসে জ্ঞানচর্চা আর ধর্মচর্চায় মনোনিবেশ করেছিলেন । চারছেলের সবাই প্রতিষ্ঠিত । মিলিটারি ডিসিপ্লিনে রেখে সবাইকে এক সূত্রে বেঁধে কি করে যে যৌথ পরিবার অটুট রেখেছেন তা এশহরের বিস্ময় । স্বরূপরানি চার বৌমা সহ তুলসীমঞ্চের চারপাশে যখন সন্ধ্যারতি করতেন তা ছিল দেখার মতো । ইদানীং লাঠিতে ভর দিয়েও সন্ধ্যারতি করতে ছাড়তেন না । মিলিটারি পরিবারের একজন সৈন্য আজ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পশ্চাদপসরণ নয় , বিদায় নিলেন ।
    শ্মশান থেকে ফিরতে ফিরতে সূর্য পাটে গেছে । সবাইকে দেখে স্বরূপরানি আর একবার বলেছে , টুলুরে আমায় কেন রেখে গেলি বাপ । এরপর আর কোন শব্দ নেই । বিনোদরানি প্রায় মাসখানেক দিদির কাছে আছে । সে স্বরূপরানির একমাত্র ছোটবোন । সেই স্বরূপরানির দেখাশোনার দায়িত্বে আছে । আজও বড়ঠাকুর তার সান্ধ্যকালীন গীতাপাঠের আসরে বসেছে । এই প্রথম স্বরূপরানি পাঠের আসরে নেই । অন্যরাও নেই । একমাত্র গুন্টু আজ শ্রোতা । বড়ঠাকুর ভরাটকন্ঠে উচ্চারণ করছে গীতার শ্লোক । টুলু আজ কোথায় ?সে আছে । সর্বত্র আছে । ঘাসে আছে , শিশিরে আছে , তারায় আছে , । মেঘে আছে , রোদে আছে । শীতে আছে , তাপে আছে । পুজোয় আছে , পার্বণে আছে , মেলায় আছে , খেলায় আছে ,  সে আছে । সে বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে আছে , মেঘ হয়ে আছে , মেঘগর্জনে আছে । সে আছে , চরাচর ব্যাপী আছে ।    
    আজ বারো দিন হল চৌধুরীভবনটুলুহীন । স্বরূপরানি বাক্যহীনা । বড়ঠাকুর ছাড়া সবাই ভাবছে টুলুর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান কীভাবে করা হবে । শেষে বড়ঠাকুর বলল , ব্রাহ্মণ মন্ত্রোচ্চারণ করবে ,আমি গীতাপাঠ করব , কাঙালিভোজন করান হবে , টুলুর আত্মা শান্তি পাবে । সেই ব্যবস্থাই করা হয়েছে । আগামীকাল শ্রাদ্ধানুষ্ঠান । বিকেল থেকেই আঁধার করে মেঘের দাপাদাপি । স্বরূপরানি বলছে , বিনোদ , সন্তুকে আমার কাছে এসে বসতে বল । সন্তু এল । বলল, মাগো তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে ? মা বলল , না বাপ , তুই আজ আমার শিয়রে বসে গীতা পাঠ কর । সন্তু কথা বাড়ায় নি । সান্ধ্যপাঠ আজ এখানেই হবে । মেঘগর্জন হচ্ছে । স্বরূপরানি বলছে , বিনোদ খুব ঝড় এল বলে । তোর মনে আছে  সেই শৈশবে ঝড় এলে আমরা দুইজন মাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতাম ভয়ে । বজ্রপাত হলে তুই কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে ভয়ে কেঁদে ফেলতিস । বজ্রধ্বনিকে ভীষণ ভয় পেতিস । বিনোদ বলছে , দিদি , আমি এখনও বজ্রধ্বনিকে ভয় পাই , কানে এখনও আঙ্গুল দিই ।
সবাই এসেছে । বড়ঠাকুর পাঠ করে চলেছে । রাত হয়েছে । স্বরূপরানি বলছে, আর একটু শোনা । রাত গভীর হয়েছে । স্বরূপরানি বলছে , ‘পিতা নোহসি- -শোনা । হঠাৎ  স্বরূপরানি বলছে , টুলু , টুলু উ-উ-।  বড়ঠাকুর বলছে , গুন্টু তোরা সবাই মার মুখে জল দে । মা চলে যাচ্ছেন । বিনোদরানি দিদিগোবলে কেঁদে উঠল ।
সে আছে , হৃৎস্পন্দনে আছে । কে বলে সে নাই । ঐ যে সে লাঠি ভর দিয়ে হাঁটছে । আছে আছে  । সে পতঙ্গ হয়ে আছে , পাখি হয়ে আছে , ফুল হয়ে আছে । সে মাছ হয়ে আছে , মাছরাঙ্গা হয়ে আছে । শিকার হয়ে আছে , শিকারি হয়ে আছে । সে মাছি হয়ে আছে , কাক হয়ে আছে । সে গাছ হয়ে আছে সে ফুল হয়ে আছে । সে সৌরভে আছে , সে গৌরবে আছে ।  
    পরদিন প্রভাতে খবর রটে গেল চৌধুরী গিন্নী আর নাই । কাছের , দূরের , আত্মীয় , অনাত্মীয় সকলে শেষ দেখা দেখতে এল । সবাই বলছে ছোটছেলের কাছেই চলে গেছেন চৌধুরী গিন্নী ।  কেউ বলছে , বয়স হয়েছে , সময় হয়েছে চলে যাবার । কেউ বলছে , বড় ভাল লোক ছিল । কেউ বলছে , আমাকে একেবারে  নিজের ছেলের মতো মনে করতেন । কেউ বলছে চৌধুরী গিন্নী ভাগ্যবতী । সোনার সংসার রেখে গেছেন ।
    শেষে বাঁশের চতুর্দোলায় উঠেছেন চৌধুরী গিন্নী । তিন ছেলে আর এক জামাতার কাঁধে চড়ে চলেছেন । শবগাড়ি নাকচ করে দিয়েছেন বড়ঠাকুর । সবাই সুসজ্জিত স্বরূপরানিকে বিদায় দিল । আকাশও অশ্রুসজল । কয়েকবার জোরে জোরে মেঘগর্জন শোনা গেল । বিনোদরানি আজ কানে আঙ্গুল দিতে ভুলে গেছে ।
    সে আছে । সে সন্ধ্যাপ্রদীপ হাতে আছে , সে তুলসীতলায় আছে । সে গাছ-কোমর শাড়ি পরে আছে , সে ঘোমটা পরে আছে , সে গরদের শাড়ি পরে আছে । সে বেণী দুলিয়ে আছে , সে আলতা পরে আছে । সে শোলক বলায় আছে , সে খুনসুটিতে আছে । সে সখের যাত্রাপালায় আছে , সে মিছিলে আছে । সে খেলার মাঠে আছে , সে ঘোড়দৌড়ে আছে । সে উপাসনায় আছে , সে মন্দিরে আছে , সে মসজিদে আছে । সে স্তোত্রে আছে , সে আজানে আছে । সে ধূলিকণায় আছে , সে রন্ধ্রে রন্ধ্রে আছে । সে আছে , প্রাণে আছে নিষ্প্রাণে আছে । সে জীবন্ত হয়ে আছে। সে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে ।

* * * *  *
শ্রী অর্জুন শর্মা ,
উদয়পুর, গোমতী
মোঃ-৯৪০২৩৬৬৮৮৮


কোন মন্তব্য নেই: