।। চিরশ্রী দেবনাথ।।
(C)Image:ছবি |
আসলেই কি
একজন সচেতন কবি সবসময় ব্যক্তিগত কথা লিখেন?
তিনি কি
শুধুই নিজেকে দোহন করেন, শোষণ করেন আর আত্মপাপ লিখেন?
এসমস্ত
প্রশ্ন বহু চর্চিত, বহুরকম উত্তরে প্রমাণিত, বিতর্কিত এবং সমাধানহীন
ভাবে রয়ে গেছে।
যা একজন
নতুন লিখতে আসা তরুণের কাছে প্রথম চ্যালেঞ্জ।
আমাদের ক্ষুদ্র
পুরোনো পৃথিবীর বক্ষে ঘটতে থাকা সংগ্রাম, অত্যাচারী এবং অত্যাচারিত ব্যক্তিসত্তার রক্তপাত ও রক্তপাতহীন বিস্ফোরণ ,
ধ্বংস, বিশ্বাসহীনতা সবকিছু নিয়ে লেখা হয়ে
গেছে, হয়ে চলেছে অজস্র অজস্র কবিতা।
কবিতার
পটভূমি সীমান্তহীন, ঝড়বিক্ষুব্ধ।
এই ঝড়
বাইরের এবং তার চাইতেও বেশী হৃদয়ের।
ঠিক
এখনের সময়ে মানুষ কবিতা লিখতেও সাবধান হয়ে যাচ্ছে । যার অপর নাম কবিতার মৃত্যু।
মানুষকে আঘাত দিয়ে, প্রকৃত অবস্থান চিহ্নিত করা সব কবির দায় না হতে পারে, তবে কোন কোন কবির অবশ্যই দায়। তিনি যখন তা লিখতে পারেন না, তখন তিনি মেষ হয়ে যান কবি থেকে। বহন করতে থাকেন ক্লেদ।
হতাশায়
বার বার নিজেকে আঘাত করেন। তার কবিতা হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত নেশাগ্রস্থতা।
একজন
সচেতন লেখক রাজনৈতিক। রাজনৈতিকতা মানে অন্ধ
সমর্থন নয়, একজন
লেখকের রাজনৈতিকতা মানে অন্ধকারের বিরুদ্ধে, আলোর দিকে কলম
চালনা করা।
তাই এ
বিশ্ব লেখক বিশেষ করে কবিদের ভয় পায়। কারণ তিনি মূলে কুঠারাঘাত করেন।
বিশ্বের যেকোনো
প্রান্তে যখনই নিষ্ঠুরতা হয়েছে কবি কবিতা লিখেছেন, প্রশ্ন ওঠে তাতে কি কোন লাভ হয়েছে? মানুষ বিদ্রূপ করেছেন, কি লাভ এইসব ছাইপাঁশ লিখে,
কিছুদিন পর এই ছাইপাঁশই হয়ে উঠেছে মানুষের ভাষা, আমরা এখনো আরো বহুকাল বার বার বলি এবং বলতে থাকবো,
"অদ্ভুত
আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ
যারা অন্ধ, সবচেয়ে বেশি চোখে দেখে
তারা ;"(জীবনানন্দ দাস)।
যখন দুঃসময় এসেছে, কবিতার লাইন হয়ে উঠেছে
সহজতম, কঠিনতম।
এ বছর যে কবির
জন্মশতবর্ষ, সেই
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ভাষায়,
"প্রিয় ফুল
খেলবার দিন নয় অদ্য
ধ্বংসের মুখোমুখি
আমরা’
কবি চরম অনুভূতিশীল, পৃথিবীকে সবসময়ই কি
নষ্টনীড় মনে হয় তার, কবি সমর সেনের তাই মনে হয়,
"নষ্টনীড়
পাখি কাঁদে আমাদের গ্রামে
রক্তমাখা হাড় দেখি
সাজানো বাগানে’
আমাদেরও
তাই মনে হয়, সদ্য
লিখতে আসা তরুণ কবিরও তাই মনে হয়। এসময় হতাশার। পাশাপাশি আশার। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক
কবিতা হিসেবে যা পাঠ করছি, প্রায় সব কবিতাই মানব মনের ধ্বংস স্তূপটির উপর লিখিত।
মনে হয়
সারা পৃথিবী জুড়ে দুঃখের রাগরাগিণী বাজছে, আনন্দধারা বহিছে ভুবনে, এ
কথাটি একজন সময়ের বাহকও সোচ্চারে লিখতে পারছেন না।
সর্বসময়ে
এটাই প্রবল সত্য যে, কবি যখন কবিতা লিখতে শুরু করেন, তার মনের নেতিবাচক দিকটির
প্রাধান্য বেশী থাকে। সমস্ত বিতৃষ্ণা, বিক্ষোভ, অপমান তিনি কবিতায় ঢেলে
দেন। তাই তো কবিতাই কবির মুক্তি।
আর
পাঠকের? তার
মুক্তি কিসে?
একজন
কবিতাপ্রিয় পাঠক ক্লান্ত শরীরে দিনশেষে
, একখানি কবিতার বই নিয়ে বসেছেন, তিনি
কি পড়লেন, শুধুই ব্যর্থতা, জীবনের
গ্লাসে গ্লাসে একজন কমদুঃখী কবির ( মানুষের ), দুঃখচাষ।
তারপর বই
বন্ধ। এবং সেই পাঠক তখন গান শুনছেন, ততোধিক দুঃসময়ে লেখা এক সুকবির দুঃখের উত্তরণ ঘটিয়ে
নিজেকে সমাহিত করার গান। আমার ব্যক্তিগত
অভিজ্ঞতা তাই বলে। হয়তো এ অভিজ্ঞতা ততটা ব্যক্তিগত নয়, তাই লিখতে সাহস করা।
কোন কবির
কারো মতো লেখা উচিত নয়। জীবনের ভীষণ পুরনো কথাগুলোকে একটু নিজের মতো করে বলা, এমনভাবে বলা যাতে
ব্যক্তিগত সত্তার সীমারেখা বিলীন হয়ে অন্তত আরেকজন পাঠকের অন্তরে বেজে ওঠা যায়।
"মানুষের
ভাষা তবু অনুভূতিদেশ থেকে আলো
না পেলে
নিছক ক্রিয়া ; বিশেষণ ; এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল "(
জীবনানন্দ দাস)।
কবি
মাত্রই আধুনিক। তিনি আধুনিক মননে। তিনি যদি আধুনিক না হোন তবে তিনি কবি নন। তাকে আধুনিকোত্তর হতে হবে। আধুনিকতা মানে
সুন্দর, আরো
সুন্দর ,আরো অনেক বেশী খোলা হাওয়া।
কবিতায়
নতুন কিছু আর বলার নেই ...সেই মানুষ, প্রেম, কাম, গাছ, ফুল, পাখি, নদী বারে বারে ব্যবহৃত হয়েছে, বলেছিলেন কবি
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তাহলে কেনই বা অজস্র তরুণের হৃদয়ে নিরন্তর এই আকুতি?
সবাই কি শুধু কিছু হতে
চান, সবাই কি
শুধু প্রকাশমুখী? সবাই কি পুরস্কার পেতে চান? হয়তো এই সহজ অভিযোগ সবার ক্ষেত্রে সত্য নয়।
কবিতা
সুন্দর। মানুষ সুন্দরের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এটা মানুষের স্বাভাবিক জৈব প্রবৃত্তি।
কবিতা
একটি ধারাবাহিকতা।
সমস্ত
ধারাবাহিক জিনিস উত্তরসূরি ছাড়া ব্যর্থ। তরুণ কবি নিজের অজান্তেই কবিতার উত্তরসূরি।
তাই এতো
কবি।
তার
যোগ্যতা অযোগ্যতার বিচার বাংলা কবিতার গবেষকরা যুগে যুগে করবেন।
তবুও
ভালো লাগে না কবিতার রহস্যকে ভেঙে দেবার সস্তা আয়োজনও।
"জল ফুরালে পাঁক নিতে হয় ",আধুনিক কবি ও কবিতা
সম্পর্কে তিনের দশকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন।
কবিতারতিতে
মগ্ন একজন আধুনিক কবির কাছে,
এর চাইতে বেশী সতর্কবাণী আর কি হতে পারে।
কবিতায়
ইতর রসিকতা এবং অবান্তর অশ্লীলতার প্রয়োগ, ভাঁড়ামি বা ম্যানারিজম বার বারই ঘুরে ফিরে আসে এবং
আসছে, এসবও কবিতার ইতিহাসের অন্তর্গত অবশ্যই, কিন্তু এ ধরনের সৃষ্টি কবিতার কোন ইতিহাস রচনা করেনি বলেই আমার মনে হয়।
স্মার্টনেস
কবিতাকে আকর্ষণীয় করে, কিন্তু প্রকাশের ভঙ্গিটি শুধু আকর্ষণীয় হবার নেশাতে মগ্ন থাকলে সেইসব
সৃষ্টির স্থায়িত্ব বা গভীরতা নিয়ে সংশয় জাগে।
কবিতাকে
অবশ্যই দৃশ্য ও স্পর্শময় হতে হবে।
"তোমাদের
কবিতায় কেন সেই আগুন দেখি না
নিঃশব্দে যা পোড়ায়, কিন্তু নষ্ট করে না?’ (লেখক...অজ্ঞাত)
কবিতা
নেতৃত্ব দেয় না, জ্ঞান দেয় না, কবি মনের খুশিতে, মনের বিষাদে, অন্তরের প্রেরণায় লিখেন, সেইসব কথা সবসময় মান্য।
কিন্তু
কোনো কবির খেয়ালখুশি বা প্রলাপোক্তি সবকিছুই কি মেনে নিতে হবে! নতুন রসায়ন আবিষ্কারের তাগিদে কিম্ভূত সৃষ্টিকে কি
কেউ কোনদিন মেনে নিয়েছে?
কবিতা
যখন প্রকাশিত হয়, তখন
তাকে পাঠকের দরবারেই দাঁড়াতে হয়
। বিভিন্ন পাঠক নানাভাবে তাকে পড়েন
বা সেটি নিতান্তই অপঠিত হয়ে আবর্জনার স্তূপে স্থান পায়।
যেকোনো
রকম কবিতাই পাঠকের উষ্ণতা ছাড়া ব্যর্থ।
কবিতার মানদণ্ড
হয়তো এটাই।
এই
প্রশ্নগুলো বা কথাগুলোও কবিতার মতোই পুরাতন। তবুও আমরা দিনরাত এসব নিয়ে নিয়ে তর্ক
করি। কারণ কবিতার আলোচনায় অসীম আনন্দ।
শুধুমাত্র
কাল্পনিক সৌন্দর্যের বিস্তার,
স্নিগ্ধতা, বন্দনা এ সবকিছু নিয়ে প্রাচীন
কবিরা সার্থক কবিতা রচনা করে গেছেন, সার্থক কারণ আমরা এখনো
তা পড়তে ভালোবাসি, কিন্তু কল্পনা সুন্দরী থেকে রক্তাক্ত পথে
কবিতার যাত্রা শুরু হয়েছে সেও বহুকাল।
"আমার
কবিতা করে বসবাস বস্তি ও শ্মশানে
চাঁড়ালের পাতে খায়
সূর্যাস্তের রঙ লাগা ভাত’
...( কবি শামসুর
রহমান )।
"কবিতা তো
ছেচল্লিশে বেড়ে ওঠা অসুখী কিশোর
ইস্কুল পালানো সভা, স্বাধীনতা, মিছিল, নিশান
চতুর্দিকে হতবাক দাঙ্গার আগুনে
নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসা
অগ্রজদের কাতর বর্ণনা।’
কবিতার
শক্তি তার মাধুর্যে, তা যতই ছোট কিংবা দীর্ঘ হোক না কেন। বাংলা কবিতা পাশ্চাত্য অভিঘাতে যেমন
মুক্তি পেয়েছিল তেমনি বিস্তার
ও গভীরতা পেয়েছে।
এখানে
অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত ফরাসি কবি গিলভিকের কয়েকটি পঙক্তির অনুবাদ লিখতে খুব ইচ্ছে করছে।
অনুবাদ করেছেন ফরাসী ভাষা ও সাহিত্যচর্চার অন্যতম পরিচিত নাম চিন্ময় গুহ। তিনি
তার
অনুবাদ সংকলনটির পূর্বকথায় বলেছেন,
"চতুর্দিকের ধস ও স্থিতিহীনতার মধ্যে ফরাসি কবিতাকে আমার সবসময়ই মনে হয়েছে
তীব্র ও অপরূপ এক প্রতিরোধ। "
আধুনিক
ফরাসি কবিতার মূল সুর হচ্ছে,
"চূড়ান্ত সংকটের মধ্যেও জীবনের অন্তহীন রহস্যকে অস্বীকার না করা ",এবং একই সঙ্গে ফরাসি কবিতা প্রতিবাদের এবং প্রতিরোধের হাতিয়ার।
ফরাসি কবি গিলভিকের,
এক
......
"গাছটি
বেঁচে রয়েছে
কাঠের মতো,
পাখির মতো,
নড়ছে না।....(শীতের
গাছ)
দুই
.....
গোলাপগুলি,
যেন ঠোঁট
যেন শরীর
....(গোলাপগুলি যেন ঠোঁট )
তিন
......
চলো, আর একবার আমরা নিচু হই।
পৃথিবী পিঁপড়েদের জন্যেও। ...(চলো, আর একবার )
বাংলা
কবিতার বিষয়, রীতি,
সর্বদাই ভাঙচুর প্রিয়। সেখান থেকে প্রায়ই এই হাহাকার ভেসে আসে বাংলা
কবিতার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কোনো কোনো অগ্রজ কবি পরবর্তী প্রজন্মকে তুচ্ছ করতে চান।
এগুলোরও কিছু না কিছু সারবত্তা আছে। যা বাস্তব। সাহিত্যের ক্ষেত্রে এর থেকে
অব্যাহতি নেই।
মঙ্গলকাব্যের
যুগ থেকেই, আমরা
লক্ষ করি যে, অহংতাড়িত কবি অন্যকে হেয় করেন। তাঁর লেখা ছাড়া
অন্যের লেখায় ভবিষ্যতের আলো খুব একটা দেখেন না।
"প্রথমে
রচিল গীত কানা হরি দত্ত
মূর্খে রচিল গীত না
জানে মাহাত্ম্য’...(বিজয় গুপ্ত)
কবিকে
খুব পরিশ্রমী হতে হয়। কারণ কবি স্বনির্মিত গবেষক।
উপন্যাস
হঠাৎ করে লেখা যায় না। একটা পরিকল্পনা, পড়াশোনা, সময়কাল ধরে নিয়ে তবে
এগোতে হয়। প্রবন্ধ লিখতেও বিস্তর খাটুনি। প্রবন্ধের পাঠক লেখকের মৌলিকত্বের পাশাপাশি বিভিন্ন রেফারেন্স
চায়।
গল্প
মানেই একটি মজবুত ঘর। ভালো শক্তপোক্ত কাঠামোর মধ্যে নরম সুখ গুঁজে দেওয়া।
আর কবিতা
...কোন নিয়ম নেই, তাই সবচাইতে কঠিন, সবচাইতে ব্যাপক, সবচাইতে সমৃদ্ধ।
হাজার
বছরের মণিমাণিক্যে ভরপুর সুবিশাল বাংলা কবিতার প্রাঙ্গণে যে নতুন কবি কবিতা লিখতে
আসবেন, তাকে
উদভ্রান্ত কিংবা দায়হীন হলে চলবে না।
কবিতাটি
লেখার পর তাকে সুন্দর করে পাঠ করতে হবে। সেই পাঠই অনেককিছু বলে দেয় একজন বুদ্ধিমান
কবিকে। নিজের বিচারক হওয়া কবির প্রথম কাজ।
কবিরা
কবিতা লিখবেন, কাব্যরসই যার প্রধান শর্ত।
স্মরণীয় পঙক্তি
রচনার খন্ডসিদ্ধি, সার্থক কবিতা নয়।
সেখানেও
বিতর্ক। একটি সুদীর্ঘ কবিতার তীক্ষ্ণ দুটো বা তিনটি লাইনই তো শেষ পর্যন্ত আমাদের
উপজীব্য হয়। তাহলে?
আসলে
কবিতা হবে আলোর ঝলক, আশার শিখা। কবিতা যোদ্ধার হাতের সেই অস্ত্র যা শস্যের চাষ করে,
যে বিদ্রোহ আমাদের কাছে অবাস্তব, কঠিন মনে
হয়, কবির কলম
বাহিত হয়ে তাই হয়ে উঠে বধির সমাজের ভাষা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন