“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৮

নারীদের যুদ্ধ : বিংশশতকের নাইজেরিয়ার মহিলাদের আন্দোলন


    ( ছবি-- উইকিপিডিয়া থেকে)
   ।।   শিবানী ভট্টাচার্য দে ।।
                                      
হিলাদের অধিকারের আন্দোলনকে আমরা সাধারণত পাশ্চাত্যের শ্বেতাঙ্গ মহিলাদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দেখি কবে কোথায় পাশ্চাত্যের মহিলারা অধিকারের জন্য আন্দোলন করেছিলসেই সব ঘটনাই বেশির ভাগ তুলে ধরা হয় এটা ঠিক যে আজ মেয়েরা যে অধিকার ভোগ করছেযেমন বাইরের কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে সমান তালে সরকারি এবং বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রে কাজ করতে বেরোতে পারছেরাজনীতি  সহ বিভিন্ন  প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দিতে পারছেভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারছেএর পেছনে পাশ্চাত্য মহিলাদের অবদান অনেক কিন্তু অন্যান্য মহাদেশেবিশেষ করে আফ্রিকায়আরো বিশেষ করে বললে ঔপনিবেশিক নাইজেরিয়ায় মহিলারা যে ব্রিটিশ শাসন তথা পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বাধিকার রক্ষার্থে রীতিমত লড়াই করেছিলতার খবর আমরা প্রায় জানিই না বর্তমান কালে শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসের ছেঁড়া পাতা অল্প অল্প করে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেবেরিয়ে আসছে অনেক বীরত্ব ও বুদ্ধিমত্তা এবং সংগ্রামের রক্তক্ষয়ী  কাহিনি  ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের নাইজেরিয়ার মহিলাদের এই লড়াই ইতিহাসে ‘আবা নারীদের লড়াই’, অথবা শুধুই ‘নারীদের যুদ্ধ’ নামে স্থান করে নিয়েছে ‘আবা’ ছিল নাইজেরিয়ার উপকূলবর্তী একটি প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্রশহরটির চারদিকে ঘেরা গ্রামগুলো থেকে নারীরা এখানে ব্যবসা করতে আসত  
উনিশ শতক পর্যন্ত উত্তরাঞ্চল বাকি বাদে আফ্রিকা বাকি বিশ্বের কাছে  অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ বলে  পরিচিত ছিলকারণ মূলত মহাদেশটির দুর্গমতা আর বর্ণবাদী বিশ্বের কাছে কালো মানুষেরা ঠিক মনুষ্যপদবাচ্য ছিল না বহুশতাব্দী ধরে কত বলপ্রয়োগ করেকত ছলচাতুরিতে কালো মানুষকে ধরে দাস হিসেবে বিক্রি করা হয়েছেহত্যা করা হয়েছেতার ইয়ত্তা নেই তাদের চেহারাকে বিদ্রূপ করা হয়েছেতাদের জমিতাদের সম্পদ লুণ্ঠন করা হয়েছেতাদের সহজ জ্ঞানকে উপেক্ষা করে শ্বেতাঙ্গদের বিদ্যার শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করে সেই বিজাতীয় বিদ্যা শেখানো হয়েছে যাতে দেশে বিভেদের সৃষ্টি হয় অথচ দেখা যায়  যে  নারীদের অধিকার ও গণতন্ত্রের কিছু পাঠ এই আফ্রিকার কালো মানুষেরা ইউরোপ তথা সারা পৃথিবীকে শেখাতে পারত  
ইউরোপীয়রা সারা সস্তা কৃষিজমিবনজ ও খনিজসম্পদে ভরপুর আফ্রিকাকে নিজেদের উপনিবেশ বানিয়ে নিজেদের মধ্যে একরকম বাঁটোয়ারা করে নিয়েছিলব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের ভাগে আরো অনেক কলোনির সঙ্গে নাইজেরিয়া ও পড়েছিল নাইজেরিয়াতে---- নামটি ব্রিটিশেরাই নাইজার নদী থেকে বানিয়ে নিয়েছিল---অনেক উপজাতি বাস করত তাদের মধ্যে  প্রধান ছিল ইগবো(Igbo), ইবিবো(Ibibo), আনদনি(Andoni), অরগনি(Orgoni), বন্নি(Bonny), ওপোবো(Opobo) প্রত্যেকটি উপজাতি ছিল স্বাধীনএদের শাসনব্যবস্থা ছিল গণতান্ত্রিকতাদের সরদার ছিল গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত  উপজাতিদের মধ্যে কখনোসখনো সংঘর্ষ হলেও সাধারণত এক উপজাতি অন্য উপজাতির সীমা অতিক্রম করত না তাদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রথা থাকলেও প্রতিটি নারীর স্বাতন্ত্র্য  ও স্বাধীনতা ছিল নারীদের মধ্যে যারা শাসকের পত্নী ছিলতারা শাসনকার্যে প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণ করতে পারত কৃষি ও ব্যবসাবাণিজ্য বেশির ভাগই মেয়েদের হাতে  ছিল গৃহক্ষেত্রেও নারী পুরুষ সহযোগী হিসেবে কাজ করতদুজনেরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল
সমাজে তাদের প্রতি কোনো অন্যায় হলে এই নারীরা সংগঠিতভাবে তার প্রতিকার করতএর অনেক ঐতিহাসিক নজির রয়েছে ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে আগাবাজা নামক স্থানের নারীরা একমাসের জন্য তাদের বাড়ি ছেড়ে গিয়েছিলকারণ তারা মনে করছিল তাদের তখনকার সমাজে পুরুষেরা গর্ভবতী নারীদের হত্যা   করছে মেয়েদের একসঙ্গে গ্রামে অনুপস্থিতির কারণে বিব্রত গ্রামের মুখ্য ব্যক্তিরা নাচার হয়ে মহিলাদের উদ্বেগ দূরীকরণের জন্য ব্যবস্থা নেয় মহিলাদের প্রতিবাদের একটি মুখ্য এবং শক্তিশালী অস্ত্র ছিল ধর্ণা  সমাজের যেসব পুরুষ নারীদের অবমাননা করেমূল্য দেয় নাতাদের নারীদের দ্বারা পরিত্যক্ত হবার এবং তাদের সামনে নারীদের ধর্ণা বসবার ঝুঁকি থাকত মেয়েরা ভগিনীত্বে(sisterhood) বিশ্বাসী ছিল একজনের প্রতি অন্যায় হলে সমাজের অন্য নারীরা এগিয়ে আসত বিশেষ করে কেউ যদি তার স্ত্রীর প্রতি অন্যায় করতঅথবা বাজারের নিয়ম ভঙ্গ করত(কারণ বাজারে মেয়েদেরই ভূমিকা মুখ্য ছিল),  তাহলে মেয়েরা প্রতিবাদ করতই পরস্পরকে সংবাদ দেবার একটা উপায় ছিল পাম গাছের পাতা প্রেরণ যে এটা পেতসে বুঝে যেত তাকে প্রতিবাদ মিটিং-এ ডাকা হচ্ছে  সে আরো কাউকে পাতাটা পাঠিয়ে দিতযে পেত সে আরো কাউকে এভাবে অতি অল্প সময়ের মধ্যে একে অনেকের সাথে যোগাযোগ করে মহিলারা প্রতিবাদ করতে নামত  তারা তারপর অভিযুক্ত লোকটির বাড়িতে যেততার বাড়ি ঘেরাও করততার পুরুষত্বের অপমানজনক কথা বলততার উঠোনে জমা হয়ে নাচগানের মাধ্যমে অভিযোগগুলো ব্যক্ত করত উদ্দিষ্ট ব্যক্তি তাতে সাড়া না দিলে তার দরজায় দুমদাম আঘাত করা হতপ্রিয় বা মূল্যবান জিনিষ ভাংচুর  করা হতদরজা কাদামাটি লেপে বন্ধ করে দেওয়া হত যতদিন না লোকটি অনুতপ্ত হয়ে তার আচরণ না শোধরায়এই ধর্ণা চলতেই থাকত অনেক সময় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের স্ত্রীরাও স্বামীর উপর চাপ দিত প্রতিবাদী মেয়েদের কথা শোনার জন্য দোষীর সাহায্যে অন্য পুরুষেরাও এগুতো নাবরং তারা বলতলোকটি নিজের দোষেই নিজের উপর মেয়েদের ক্রোধ ডেকে এনেছে  
ঊনবিংশ শতকেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা নাইজেরিয়াতে উপনিবেশ স্থাপন করে৫০০ বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ভাষাভাষী উপজাতীয়দের এক কৃত্রিম ছাতার নিচে নিয়ে এসে ধর্মের ভিত্তিতে দুটো আলাদা আলাদা প্রোটেক্টোরেট রাজ্যউত্তর নাইজেরীয় প্রোটেক্টোরেট এবং দক্ষিণ নাইজেরীয় প্রোটেক্টোরেষ্ট্রের সৃষ্টি করে প্রটেক্টোরেট রাজ্য উপনিবেশের রকমফেরযেখানে রক্ষার দেবার নামে রক্ষাকর্তা রাষ্ট্রটি স্থানীয়দের দ্বারা পুতুল সরকার গঠন করিয়ে দেশটাকে নিজেদের কব্জায় রাখত  স্থানীয়দের দ্বারা পরিচালিত হলেও মাথার উপর ব্রিটিশ রাজপ্রতিনিধি থাকতআভ্যন্তরীণ শাসন সেই রাজপ্রতিনিধিদের অঙ্গুলিহেলনে চলত বৈদেশিক ব্যাপারে স্থানীয় সরকারের কোনো ভূমিকা তো ছিলই না আপাতত আমরা দক্ষিণ নাইজেরিয়ার ঘটনার কথাই এখানে বলতে যাচ্ছি
নাইজেরিয়ায় ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপন হয় ১৮৮৫ সালেতখন উপনিবেশগুলোর দায়িত্বে ছিল রয়াল নাইজার কোম্পানি ব্রিটিশেরা এখান থেকে পাম তেলপাম শাঁসও কাকাও (কোকো পাউডারের বীজযার পাউডার থেকে চকোলেট হয়রফতানি করত পরবর্তীকালে নাইজেরিয়ার উপকূলভাগে খনিজ তেলের সন্ধান মেলে ১৯০১ সালে ব্রিটিশ সরকার কোম্পানির হাত থেকে শাসনের ভার ব্রিটেনের রানির  নামে নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়এবং প্রটেক্টোরেট গঠন করে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার স্থানীয় শাসন ব্যবস্থা  স্থানীয় উপজাতিদের উপরই ছেড়েছিলকারণ তা হলে উপজাতীয়দের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো ঝামেলাতে না গিয়েই অবাধে বাণিজ্য করা যেত প্রভেদ হল শুধু আগে উপজাতিদের শাসক ছিল সমাজের দ্বারা নির্বাচিত শাসকএখন তারা উপজাতীয় হলেও ব্রিটিশদের মনোনীতফলে শাসকের নির্বাচনে সমাজের  ভূমিকা কমে গেল এই মনোনীত প্রতিভূরা  ব্রিটিশের সহায়ক ও তাঁবেদার ছিলকিছু আর্থিক  সুযোগসুবিধা পেত,  এবং ক্ষমতা পেয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এরা দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অত্যাচারী হয়ে উঠেছিল স্বাভাবিকভাবেই এদের সঙ্গে বাকী স্থানীয়দের সম্পর্ক ভাল ছিল না এই ব্যবস্থায় শাসনের  যেকোনো ব্যাপারে মেয়েদের সম্পূর্ণ অবহেলা করা হল ব্রিটিশ সরকারের মতে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমাজে শৃঙ্খলা থাকবে---এই জন্য নারীদের ক্ষমতায়ন বন্ধ হল এই সরকারের উপজাতীয় প্রতিভূদের বলা হত ওয়ারেণ্ট চিফ(warrant chief) এদের মুখ্য কাজ ছিল জনগণনা এবং জনসাধারণের সম্পদের পরিমাপ করা যাতে কর আদায় করতে সুবিধা হয়
মেয়েদের মধ্যে ওয়ারেন্ট চিফদের কার্যকলাপ মোটেই সমর্থন পায় নি অনেকদিন ধরেই অসন্তোষ দানা বাঁধছিল এর কারণ ছিল অনেকগুলো-- ওয়ারেন্ট চিফদের দুর্নীতিস্কুলের ফি বৃদ্ধিএবং জবরদস্তি শ্রমদান আগে মেয়েদের ও নাবালকদের বাইরে কাজ করতে হত নামেয়েরা নিজেদের ঘরখেত খামারের কাজ ও ব্যবসায়ে ব্যস্ত থাকত এখন তাদের এবং শিশুদের অনেককেও জোর করে শ্বেতাঙ্গ  ঔপনিবেশিকদের বাড়িতেও কাজ করতে পাঠানো হত ব্রিটিশ উপনিবেশ হবার ফলে এখানে খ্রিস্টধর্মের প্রচার হয়েছিলস্কুল খোলা হয়েছিলকিন্তু স্কুলের ফি মুদ্রামূল্যে দিতে হতযা আদিবাসীদের কাছে সহজলভ্য ছিল না কাজেই সেই ফি বাড়লে কী অবস্থা হত তা সহজেই অনুমেয়  
আবা নারীদের যুদ্ধ’ যাকে বলা হয়তার তাৎক্ষণিক কারণ ছিল প্রত্যক্ষ কর চাপানো ১৯২৭ সালের এপ্রিল মাসে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার নেটিভ রেভিনিউ অ্যমেন্ডমেন্ট অর্ডিন্যান্স নামে একটি সংস্কার আইন এনে সেই আইন বলবৎ  করতে কিছু ব্যবস্থা নেয় ডব্লিউ ই হান্ট নামে এক ব্রিটিশ অফিসারকে একটা কাজের ভার দেওয়া হয়সেটা হল পুরো পূর্ব নাইজেরিয়ার পাঁচটি জেলার অধিবাসীদের এই নতুন অর্ডিন্যান্সের সুযোগসুবিধা ও লক্ষ্যের বিষয়ে অবহিত করানো আসলে ১৯২৮ সালের এপ্রিল মাসে যে প্রত্যক্ষ কর চালু হবেতার ভিত্তি প্রস্তুত করাই ছিল এই অর্ডিন্যান্সের লক্ষ্য ১৯২৮ সালে পুরুষদের উপর কর ধার্য হয় কোনো রকম ঘটনা ছাড়াইবারো মাস ধরে প্রচারের সুফল ছিল এটা পরের বছর নতুন  জেলা অফিসার এসে দেখলেন যে কর আদায়ের যে নামের নথিভুক্তি আছেতা পর্যাপ্ত নয়,  কারণ তাতে একজন পুরুষের কজন স্ত্রীবাচ্চাএবং গৃহপালিত পশু আছে তার হিসেব নেই ব্যাপারটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনা হল এবং নতুন করে গণনার আদেশ দেওয়া হল  আবা শহরের নিকটবর্তী ওকোলো শহরের নারীদের সন্দেহ হলএই লোকগণনার আসল উদ্দেশ্য হল নারীদের উপর কর চাপানোযেমন আগের বছর পুরুষদের উপরে হয়েছিল মহিলাদের মধ্যে এই নিয়ে অসন্তোষ এবং  প্রতিবাদ সংক্রান্ত আলোচনা শুরু হল কিন্তু যেহেতু তাদের রাজনৈতিক অধিকার ছিল নাতাদের অসন্তোষ সরকারের কানে পৌঁছাল নাঅথবা পৌঁছালেও সরকার গ্রাহ্য করল না
১৯২৯ সালের ১৮ নভেম্বর ওকোলো শহরে এমেরেউয়া নামে একজন ওয়ারেণ্ট চিফ-এর লোক নোয়ান্যেরুরা নামে একজন বয়স্ক মহিলার বাড়িতে এসে জানালসে মানুষছাগল ও ভেড়া গুনতে এসেছে নোয়ান্যেরুয়ার স্বামী আগেই মারা গিয়েছিলতাই বাড়ির কর্ত্রী হিসেবে তার কাছেই ওয়ারেণ্ট চিফকে আসতে হয়েছিলঅন্যথায় স্থানীয় নিয়ম অনুসারে গৃহকর্তার সঙ্গেই  দেখা করতে হত নোয়ান্যেরুয়া ভাবল যে লোকটি বলছে, “তোমার কাছে কী কী এবং কতগুলো জিনিস আছে যে আমরা  ট্যাক্স বসাতে পারি?” সে খুব রেগে গিয়ে জিগ্যেস করল, “তুমি কি তোমার বিধবা মাকেও গুনেছিলে ?” সে আসলে বলতে চাইছিল, “ইগবো সমাজে মহিলারা ট্যাক্স দেয়না দুজনের মধ্যে তুমুল তর্কাতর্কি বেঁধে গেলএবং লোকটি মহিলাটির গলা চেপে ধরল
নোয়ান্যেরুয়া শহরের চৌরাস্তায় পৌঁছে গেল যেখানে ইতিমধ্যেই মহিলারা নিজেদের উপর কর বসানোর ব্যাপারে মিটিং করছিল সে নিজের উপর হওয়া ঘটনার কথা বলল নোয়ান্যেরুয়ার কথা শুনে তাদের বিশ্বাস জন্মাল যে তাহলে মহিলাদের উপরও কর বসছেইসন্দেহ নেই তারা পামগাছের পাতা পাঠিয়ে নিজেদের শহর ও আশেপাশের অন্যান্য জেলাতেও মহিলাদের আহবান জানাল দশ হাজার মহিলা  প্রতিবাদী ওয়ারেণ্ট চিফ ওকোগো-র অফিসের সামনে সমবেত হয়ে তার ইস্তফা ও বিচারের দাবি জানাল তাদের প্রতিবাদের অস্ত্র ছিল সেই পুরোনো পন্থাধর্ণানাচগানের মাধ্যমে নিজেদের অভিযোগ ব্যক্ত করাও অনুসরণ করে উত্যক্ত করা তাদের স্লোগান ছিলমেয়েরা পৃথিবী শেষ হওয়া অবধি ট্যাক্স দেবে না বিপ্লব ছড়াচ্ছিলআরো আরো অন্য স্থানের মহিলারাও আন্দোলনে যোগ দিচ্ছিল
ওকোলো শহরের প্রতিবাদের মুখ ছিলেন তিন জন নারীইকোন্নিয়ামোয়ান্নেদিয়াএবং ন্ওয়ুগো এরা বুদ্ধিমতী ও বাকপটু ছিলেনবুঝিয়ে সুজিয়ে মহিলাদের উগ্র হিংস আন্দোলন থেকে বিরত রাখতে পেরেছিলেন বৃদ্ধা নোয়ান্যেরুয়াও অহিংস আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন তবুওএকবার রাস্তা বন্ধ করে   প্রতিবাদ করার সময় রাষ্ট্রের সশস্ত্র সেনা দুজন মহিলাকে হত্যা করে তখন মহিলারাও উগ্র আন্দোলনের পথে নামে বিপ্লব প্রায় ছহাজার বর্গকিলোমিটারের কুড়ি লক্ষ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লেও তারা কাউকে হত্যা করেনিযদিও কয়েকজন ওয়ারেণ্ট চিফকে তারা শারীরিক নিগ্রহ করেছিল দশটা স্থানীয় কোর্ট তারা পুড়িয়ে দিয়েছিলআরো বেশ কয়েকটার ক্ষতিসাধন করা হয়েছিলকোর্টের কর্মচারীদের বাড়িঘর আক্রান্ত হয়আবাম্‌বাওসিএবং আমাতার ইউরোপীয় ফ্যাক্টরি লুট করা হয় ছেচল্লিশটি কারাগার আক্রমণ করে বন্দিদের ছেড়ে দেওয়া হয় জবাবেসরকার সৈন্যবাহিনী নামায় পঞ্চান্ন জন মহিলাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিলআরো অন্তত পঞ্চাশ জন আহত হয়েছিল ব্রিটিশ সরকার পুরো আন্দোলনকে ‘আবা মহিলাদের দাঙ্গা’ বলে চিহ্নিত করে দেয় ১৯৩০ এর ৯ জানুয়ারি ঔপনিবেশিক সরকার বিদ্রোহ বিধ্বস্ত হয়েছে বলে ঘোষণা করলে পর সেনাবাহিনী ফিরে যায় সমস্ত মাস ধরে প্রতিবাদী মহিলাদের আটক করে তিরিশের বেশি সমবেত বিচারের আয়োজন এবং শাস্তি কার্যকর করা হয়েছিল
বিদ্রোহের পর শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিক সরকার যে অনুসন্ধান কমিটি বসিয়েছিলতাতে একজনও স্থানীয় লোককে নেওয়া হয়নি সাক্ষী হিসেবে যে সমস্ত উপজাতীয় লোককে ডাকা হয়েছিলতাদের মধ্যেও নারীর সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য  গোটা ঘটনাকে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত নারীদের পাগলামি বলে বর্ণনা করা হয়েছিলএবং প্রতিবাদ-আন্দোলনকে ‘দাঙ্গা’ বলে নথিভুক্ত করা হয়েছিল   
তবে এই আন্দোলনের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী এর পর দেশে সরকার মহিলাদের অভিমতকে কিছুটা গুরুত্ব দিতে আরম্ভ করেএবং ক্ষমতাসীন পুরুষের পত্নী নয় এমন মহিলাদেরও কিছু কিছু সরকারি কাজে  অংশ নিতে দেওয়া হয় কোনো কোনো জায়গায় মহিলাদেরও ওয়ারেন্ট চিফ-এর পদে নিযুক্তি দেওয়া হয় এইভাবে নারীর ক্ষমতায়ণ শুরু হয় এই আন্দোলন থেকে প্রভাবিত হয়ে পরবর্তীকালে তিরিশচল্লিশ এবং পঞ্চাশের দশকের অনেক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিলযেমন ১৯৪০ এর কালাবার এবং ওয়েরি-তে তেলকল শ্রমিকদের প্রতিবাদ১৯৫৬ সালে আবা এবং অনিতসা-তে করবিদ্রোহঅর্থাৎ অন্যায্য কর বসানোর প্রতিবাদে বিদ্রোহ এই আন্দোলনের দৃষ্টান্ত সামনে রেখেই আফ্রিকার অন্যান্য দেশেও ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে

(তথ্যসূত্র -- উইকিপিডিয়া) 




                                                            

                                               


কোন মন্তব্য নেই: