।। বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।।
(C)Image:ছবি |
‘একটি ধানের শীষের উপর একটি
শিশির বিন্দু’। এই শিশির বিন্দু দেখার সৌভাগ্য আমাদের অনেকেরই জীবনভর আর হয়ে উঠল না। কারোও
ভাগ্যে নেই তো কারোও ইচ্ছে নেই। সেদিক দিয়ে চিন্তা করলে উপরওয়ালা আমাকে বোধ করি দু’টোই দিয়েছেন উজাড় করে। শীতের
প্রথম সূর্যোদয়ে ধানের নধর সবুজ পাতায় টলটলায়মান পুঞ্জীভূত শিশির বিন্দুতে
সূর্যালোকের প্রতিফলনে যে অপরূপ সৌন্দর্য উদ্ভাসিত হয় তা স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য
আমার হয়েছে।
শিশির বিন্দুরই মতো
আমাদেরই চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক কিছুরই রসাস্বাদনে আমরা বরাবরই উদাসীন।
আমাদের নজর দূরে, বহুদূরে ধাবমান। কাছের সৌন্দর্য আমাদের চোখেই পড়ে না। প্রকৃতির স্নেহধন্য এই
উজান আসামে প্রকৃতি যে কত সৌন্দর্য আমাদের চারপাশে বিছিয়ে রেখেছেন আমরা ক’জন তার খবর রাখি ? পাওয়াই রেল গেটে দাঁড়িয়ে রেল
লাইন বরাবর উজান পানে তাকিয়েছেন কখনো ? তাকালে দেখতে পেতেন কীভাবে দু’টো সমান্তরাল লোহার পাত গিয়ে
সোজা প্রবেশ করেছে দূরান্তের পাহাড়ে। মার্ঘেরিটা থেকে কেটেটং যাওয়ার পথে বাঁদিকে
ধানের ক্ষেতে পড়ন্ত সূর্যের রক্তিমাভা দেখেছেন কখনো ? দেখলে সূর্যাস্ত দেখার জন্য
কন্যাকুমারী বা মাউন্ট আবু ছুটতে হত না। বরগোলাই থেকে মার্ঘেরিটা যাওয়ার পথে রেল
লাইনের কাছে কিংবা ডিব্রুগড় জেলার দিহিংহোলা গ্রামের বুক চিরে যাওয়া কুলুকুলু
দিহিংকে আপন খেয়ালে বয়ে যেতে দেখেছেন কখনো ? তিনসুকিয়ার গুইজান থেকে উজান
ভাটিতে ডিব্রুকে দু’ভাগ হতে, পরিযায়ী পাখি আর জল থেকে ছলকে ওঠা শুশুককে দেখেছেন কখনো ? আমি দেখেছি।
আমার নিত্য পরিব্রজন।
কাজের ফাঁকে কত যে সৌন্দর্য, কত ইতিহাস, কত ঘটনা-দুর্ঘটনা আমার প্রতিদিনের সঙ্গী। কিছু ঘটনা গল্পের মতোই সত্যি।
ক’দিন আগে তিনসুকিয়া থেকে লিডু
যাব বলে সকালেই উঠে বসি আমাদের আনকোরা সখের ঝাঁ চকচকে ডেমু ট্রেনে। এই গাড়িখানায়
উঠলে নিজেকে বেশ একটা গর্বিত গর্বিত বোধ হয়। কেন জানি না মনে হয় এবার বুঝি আমরা
কোন এক মহানগরীর বাসিন্দা হয়ে গেলাম। তো সেদিনও কামরায় উঠে দরজার পাশেই একটা বসার
জায়গা পেয়ে গেলাম। গুছিয়ে বসে মোবাইলের ইনবক্সটা খুলে জমে থাকা বার্তাগুলো পড়ে শেষ
করে বাইরে তাকালাম। পিছিয়ে যেতে থাকা প্রকৃতিকে প্রাণভরে উপভোগ করতে থাকলাম। গাড়ির
ভেতরে কত রকমের যাত্রী। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব বয়সের স্ত্রী পুরুষের
সমাহার। বসে, দাঁড়িয়ে, ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানারকম গল্প গুজবে ব্যস্ত সবাই। হকাররা ব্যস্ত পসরা
নিয়ে। এক অন্ধ ভিখারি গান গেয়ে গেয়ে হাত পেতে খুচরো পয়সা চেয়ে নিচ্ছে সবার কাছ
থেকে। একটা দুটো টাকা ভিক্ষা দিয়ে রাজ্যদানের স্বস্তি নিয়ে আমরা আপন গরবে গর্বিত।
মাকুম থেকে কয়েকটা
ছেলে ছোকরা উঠে আমার পাশের দরজাটার হাতল ধরে দাঁড়াল। কিশোর বয়স। গুণে দেখলাম মোট
চারটি ছেলে। পরনে ছিন্ন, চোস্ত জিনসের প্যান্ট আর রঙিন, ময়লা টি-শার্ট। পায়ে জুতো।
সঙ্গে কোনও বস্তু নেই। সমবয়সী চারটে শৃঙ্খলাহীন ছেলে অনর্গল নিজেদের মধ্যে
দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলে যেতে থাকল। তীব্র বেগে ছুটন্ত ট্রেনে দরজার একেবারে কাছে
দাঁড়িয়ে থাকায় কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল আমার। ভাবলাম বারণ করি। কিন্তু পরক্ষণেই
সামলে নিলাম নিজেকে। আজকালকার ছেলে ছোকরা। ন্যূনতম সম্মান বোধ ওদের থাকে না। এরকম
বখাটে ধরণের কিশোররা তো এখন আকছার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে দিনভর। ওদের কিছু বলতে
যাওয়া মানে নিজেই নিজের অসম্মান ডেকে আনা। তাই বিরত থাকলাম যদিও চোখটা পড়ে থাকল
ওদেরই দিকে। টিকেট কেটেছে কি না সন্দেহ হলো। ডিগবয় স্টেশনে ট্রেন থামলে সব ক’টাই নেমে পড়ল যদিও তিনটে ছেলে
আবার উঠে দাঁড়াল একই জায়গায়। অর্থাৎ এক সঙ্গীকে বিদায় জানাতেই নেমেছিল সবাই।
ট্রেন পাওয়াই
স্টেশন ছাড়াতেই একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গেল। ওরা গল্পে এত মত্ত ছিল যে কখন
টিকেট পরীক্ষক মশাই এসে একেবারে সামনে দাঁড়িয়েছেন বুঝতেই পারেনি। হঠাৎ সামনে দেখতে
পেয়েই কী করবে বুঝে উঠতে না পেরে একেবারে ছুটন্ত গাড়ি থেকেই লাফিয়ে নেমে যেতে
চাইল। পরীক্ষক মশাইও এ লাইনে একেবারে পাকা বলেই মনে হলো। বোধ হয় আগেভাগেই আঁচ করতে
পেরেছিলেন। খপ করে হাত বাড়িয়ে ধরে ফেললেন ছেলেটাকে। কিন্তু মনে হয় সময়ের এক চুল
গণ্ডগোল হয়ে গেল। প্রায় পড় পড় অবস্থায় ঝুলতে থাকা ছেলেটাকে টেনে উঠাতে পারছিলেন না
কিছুতেই। আমার দিকে চোখ পড়তেই বললেন- “একটু ধরুন তো”। ঝুলন্ত ছেলেটার সঙ্গী দুটো
কিশোর ইতিমধ্যেই কামরার অন্য দিকে ছুটে পালিয়েছে। আশেপাশে দাঁড়ানো বাকি যাত্রীরাও
দিশেহারা ভাবে কী করবে না করবে ভেবে পাচ্ছিল না। আমি তখন মোবাইলে কিছু একটা
লিখছিলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় আমিও বেবাক। পরীক্ষক মশাইয়ের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে
ঝটিতি মোবাইলটি বুকপকেটে রেখে হাত বাড়িয়ে আপ্রাণ চেষ্টায় ধরতে গেলাম ছেলেটাকে। দু’জনের চেষ্টায় যখন প্রায় বাগে
এনে ফেলেছি ছেলেটাকে ঠিক সেই মোক্ষম সময়টাতেই পাশে দাঁড়ানো এক দুরন্ত অপরিচিত
যাত্রী এক পলকে ছোঁ মেরে আমার পকেট থেকে মোবাইলটা ছিনিয়ে নিয়ে কামরার অন্য দিকে দে
ছুট। ঘটনার ঘনঘটায় আমি হতভম্ব হয়ে ভাবলাম ছুটে গিয়ে পাকড়াও করি মোবাইল চোরটাকে।
কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে অনুধাবন করতে পারলাম আমি ঝুলন্ত ছেলেটাকে ছেড়ে দিলে ও
নির্ঘাত পড়ে যাবে। আর এভাবে দুরন্ত বেগে ছুটতে থাকা ট্রেন থেকে পড়ে যাওয়া মানে
নির্মম মৃত্যু। আমার মননে চিন্তায় এক তীব্র দোটানা। একদিকে পার্থিব জগতের আশা
নিরাশা আর অন্য দিকে মানবিকতার পরাকাষ্ঠা। নিমেষেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। না একটা
মোবাইলের মূল্য কিছুতেই একটা মানুষের জীবনের থেকে বেশি হতে পারে না। আরোও জোর লাগিয়ে
প্রায় টেনে হিঁচড়ে ছেলেটাকে উঠিয়ে আনলাম উপরে। গলদঘর্ম পরীক্ষক মশাই ডান হাতে
আমাকে একটা হ্যাণ্ডশেক করে আর বাঁ হাতে ছেলেটার গালে কষে একটা চড় মেরে টিকেটের আশা
ছেড়ে ফিরে গেলেন যেদিক থেকে এসেছিলেন সেদিকে। ইতিমধ্যে ট্রেন মার্ঘেরিটা স্টেশনে
এসে দাঁড়িয়েছে। আমি হন্তদন্ত হয়ে ছোকরাগুলোকে শাপ শাপান্ত করতে করতে গাড়ির ভিতরে, প্ল্যাটফর্মে খুঁজতে থাকলাম
আমার মোবাইল চোরকে। মনে মনে ভাবলাম এসব অশিক্ষিত, শয়তান, দুষ্ট ছেলে, কিশোরদের ভবিষ্যৎ কী? এমনি চোর ডাকাত হওয়া ? এই সুন্দর পৃথিবীতে এদের
প্রয়োজনটা কোথায়? চারদিকে তাকিয়েও প্ল্যাটফর্ম ভর্তি মানুষের মধ্যে কিছুই আর খুঁজে পেলাম না। না
চোর না বদমায়েশ ছেলেগুলো কারোরই টিকিটিরও দেখা নেই। প্রিয় মোবাইলটা হারিয়ে বিমর্ষ
হয়ে ফিরে এসে আবার বসলাম জানালার পাশে একটা খালি সিটে।
ট্রেন চলতে শুরু
করল। উদাস হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখে চমকে উঠলাম। ট্রেন
তখন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বাইরে এসে গেছে। দেখলাম সেই তিনটে ছেলে পরম যত্নে হাতে ধরে
রাস্তা পার করাচ্ছে অন্ধ ভিখারিটাকে।
আমার সিক্ত চোখের
সামনে তখন অন্ধকারের বুক চিরে আসা দেবদূতের আলোকদ্যুতির বিচ্ছুরণ। অজান্তে হাত দু’টো কপালে ঠেকিয়ে মনে মনে বললাম –হে ঈশ্বর এদের তুমি এভাবেই যুগ
যুগ ধরে বাঁচিয়ে রেখো।
--------------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন