“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৭

সৌরপথের আলোকবিম্ব

।। অশোকানন্দ রায়বর্ধন।।
     
(C)Image:ছবি
 
সুখের আখড়া দুখের ঝুপড়ি জুড়ে কুটিরশিল্পে তন্ময়তৎপর আলোজীবনসফর ৷ ভোরের দোয়েল জানে পুব আকাশের রঙের আড়াল ৷ ক্রমাগত দিগন্তজীবনে লঙমার্চ এগোয় ৷ আগুনের গিরিপথ ডিঙোতে ডিঙোতে আলোর জ্যামিতি ছড়িয়ে যায় কাশবিতান ৷ ঘাসফুল আর সোনালি শস্যসংলাপ ৷ সৈকত জুড়ে শাণিত অস্ত্র শুয়ে ৷ রক্ত মরে কালো পিচ ৷ বিদ্ধ আত্মারা সেখানে ডুকরে কাঁদে ৷ অপরিচিত সানাই করুণ হয় ৷ কোজাগরী চাঁদের আলো অচেতন হয়ে আসে ৷ মেঘের কুচকাওয়াজের ভেতর রাত নামে গভীর খাদে ৷ সোনাঝুরি গাছের তলায় ঝরে পড়া হলুদ ফুল রঙ হারায় ৷ পূর্বজ পথিকেরাও লৌকিক দার্ঢ্যে আঁধারের পথে এগিয়ে গেছেন নির্জন বাতিরেখা ধরে ৷ গর্জন তুলেছে মিছিল যুদ্ধসঙ্গীতে ৷ আলোর কোটরে লুকোনো কামনা-আনন্দ, হাসি-আহ্লাদ অশ্রু মুছে যায় ৷ ছুঁয়ে যায় জয়নাদ ৷ ভেজা নির্জনতার মণ্ডলে আনন্দাশ্রুতে ভরে যায় সুবর্ণকলস ৷
       যে নরম আলো দিয়ে ভোরের সূচনা তার ভেতর অবগাহনের রোমাঞ্চে জ্বলে ওঠে আগুন ৷ তার আগ্রাসী ধোঁয়ায় আর্তরব ওঠে ৷ দগ্ধ ময়ূরের পেখম খুলে পড়ে যায় জতুগৃহে ৷ প্রবহমান সহজিয়া গানের পাশে পাশে সহস্র লাশ ভেসে যায় ধর্মাতুর বাতাসে ৷ মায়াভরা সেই গান আর শবের ছবি চতুর মিডিয়াপার্সন ছেপে দেয় ভোরের কাগজে ৷ ধর্মলুন্ঠনে কপর্দকশূন্য হয়ে যায় ইতিহাসের অহংকার ৷ সভ্যতার সমৃদ্ধ ঘরানা ৷ হাজারো পরিজনের কান্নার নির্বাক স্লোগানগুলো পেশাদার সেলফিতে ভরে যায় ৷ গড়াতে গড়াতে মসৃণ হয়ে যাওয়া নুড়িগুলো দাম্ভিক দালানে গেঁথে প্রাসাদ বানায় কেউ কেউ ৷ কেউ বা স্বপ্নের খোঁজ করে ফেরিওয়ালাদের কাছে ৷ মনোহারী বিপননে রাজনীতির পসার বাড়ে ৷ কার্তিকের মুণ্ডিত মাঠে সন্ধ্যাবাতি জ্বালিয়ে আসে পূর্বজ পুরুষের কোনো জ্ঞাতিবউ ৷ কোমল শিখার সাথি ছায়ামোহনায় প্রাণের স্বপ্ন নিয়ে আঁচলে সন্ততির সুখ বেঁধে নেয় ৷ মিটি মিটি হাসে ঝরা ধানকণা ৷ এজন্যেই তার নির্জনবসত ৷ এজন্যেই অঙ্কুরপ্রয়াস ৷
        অমোঘ আলোকে আরাধনা করে অনুর্বর মাঠেও বেঁচে ওঠে জন্মবীজ ৷ হেমন্তরাতের কুয়াশাচিহ্ন চুমু খায় সৃজনের ইজেলে ৷ সবাই তো জীবনপ্রয়াসী ৷  জনজাতির শান্ত পল্লীপথে একাকী হাঁটেন তথাগত ৷ প্রান্তরের সিঁথান ঘেঁষে জলসত্র অপেক্ষায় থাকে ৷ দূরদিগন্তমোড়ের অলৌকিক ভয় চলে যায় বানপ্রস্থে ৷ তবুও কোনো কোনো  সূর্য আসে ভয়ের জ্যাকেট পরে ৷ মায়াহরিণের টানে হরিয়ানায় পাচার হয়ে যায় প্রত্যন্তবালিকা ৷ ভাস্কর্যনারীর নিষ্পাপ মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে স্বপ্নটুটা হাহাকার ৷ কেন মাঝে মাঝে বিষাদে ভরে ওঠে জনভূমি?  জাত আর ধর্মপরিচয়ে সর্বনাশ? বসুমাতার বিভাজন? বিমর্ষকন্ঠে একতারার সুর নিয়ে হননকোলাহল সরাতে প্রয়াসী অন্ধপাখি ৷ তার বিষণ্ণ প্রার্থনায় শান্তিসুগন্ধ ছড়ায় ইকোলিরিক ৷করুণালহরী পাতালে পরতে জেগে থাকা জ্বালানীভাণ্ডার ৷ পরোক্ষে ধরে রাখে জীবনাবহ ৷ অন্ধকারের শ্লোক মুছে ফেলে দৈবহাত শুরু করে আলোর আরতি ৷ নিখাদ ভালোবাসা মেরুপ্রান্ত অবধি ছড়িয়ে যাবার ঈপ্সায় ধর্মশ্লোকের বিপন্নতাকে জড়িয়ে ধরে ৷ আলোর কলসে অরণ্যজল তুলে রাখার সৃজনপ্রেরণায় বিশুদ্ধস্নান ভুবনবন জুড়ে ৷ বর্ষণসিক্ত আলো আসে নিকোনো উঠোনে ৷ মুছে যায় অকল্যাণসর্বস্বতা ৷ মৃত্তিকার শীতলপাটিতে জেগে ওঠে শুদ্ধ আলোকবয়ন ৷

কোন মন্তব্য নেই: