।। শিবানী দে।।
(C)Image:ছবি |
আশ্বিন মাস পড়তেই আজকাল
ভিতুর ডিমেদের ভয় করে। এই
শুরু হল হুল্লোড়ের ঋতু। এমনিতেই
আজকাল আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে
গরম বেড়েছে, গ্রীষ্ম
বর্ষার দিনগুলোকে কিছুটা দখল করে নেওয়ায় বর্ষা শরতকে ঠেলে দিয়েছে, হেমন্তের
ঘরে,( শরত
আর হেমন্ত জড়াজড়ি করে শীতকে ঠেলেছে, শীত এত ঠ্যালা সহ্য করতে না
পেরে মরেই যাচ্ছে , ওদিকে গ্রীষ্ম শুধু পরের বর্ষাকেই নয়, আগের
বসন্তকেও প্রায় খেয়ে নিয়ে অপ্রতিহত প্রতাপের একনায়ক
ঋতু হয়ে উঠছে ।) রোগবালাইর বাড়বাড়ন্ত। কিছু কিছু আগেও কি ছিল না, ছিল, কিন্তু
সেই সঙ্গে নীল আকাশে রৌদ্রমেঘের খেলা, শুকিয়ে
আসা মাঠঘাট, স্থলপদ্ম
শেফালির সৌরভ, কাশফুলের
দিগন্তজোড়া সাদা
আলো, জলভরা
পুকুর নদী, সন্ধ্যার
আকাশে মৃদু কলশব্দে ফিরে যাওয়া বলাকাপাঁতি, মনকে আলোড়িত করত---এসেছে, সে এসেছে। পুরোনো দিনের জাবরকাটা ভিতুর
ডিমেদের কাছে এই ছিল পুজোর গন্ধ, পুজোর বারতা।
এখন সে সব নেই, দরকার
ও নেই। আবহাওয়ার গরমের চাইতেও আগামীতে ফুর্তির গরমের আয়োজনে আমরা চাঙ্গা । গ্রামের
দিকে অল্পস্বল্প থাকলেও শহরে ইট লোহা কংক্রিটের মধ্যে প্রকৃতির রূপ পরিবর্তনটর্তন
আমাদের চোখে পড়ে না, আকাশে তো লেট বর্ষার জন্য সারাক্ষণই কালো মেঘের
আনাগোনা,
বৃষ্টি, তার চাইতে এই ভাল যে পুজো
আসার কাউন্টডাউন
শুরু করে টেলিভিশন। ‘ আর বাকি—দিন’----দুর্গাপুজো
শুরু হওয়া অবধি রোজ চলতে থাকে। বড়বড়
ব্যানারে বিজ্ঞাপন পড়ে যায় পুজোর, কোথায় কতবড় প্রতিমা, কি থিমের
প্যান্ড্যাল । বিজ্ঞাপন শুরু হয় পোশাক আশাকের, সব
উপভোগ্য জিনিষের, নিদেনপক্ষে মাসতিনেক
আগে থেকেই, আর
সেই সঙ্গে দোকানে দোকানে হামলে পড়া ও। ফলে রাস্তায়
বাজারে ভিড়, বাসে ট্রেনে সিটের তো বটেই, দাঁড়ানোর
জায়গারও আকাল। তাতে এমন আর কি ? দুটো
তিনটে মাস বড়োজোর কষ্ট । রোজকার প্রয়োজনীয় জিনিষের
দাম বেড়ে যায়, তা নাহয় বাড়ল। এদিকে বন্যা, ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, ভাইরাল
ফিভার, ডায়েরিয়া, ইত্যাদিতে
আক্রান্তদের কথা প্রথম প্রথম শোনা গেলেও পরে উৎসব আয়োজনের
চাপে তা পেছনে পড়ে যায়। চাপা
পড়াই উচিত, সেসব নিরানন্দের খবর খেতে কার ভাল লাগে? তাই
সেসব খবর হঠাৎ টিভি থেকে, খবরের
কাগজ থেকে উধাও হয়ে যায়, কারণ এইসময়
দেশে আপামর সবাই আনন্দের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। কোথায় প্রতিমাকে সোনার শাড়ি পরানো
হবে , কোথায়
সম্পূর্ণ সোনার অলঙ্কারে প্রতিমাকে সাজানো হবে, তার প্রচারে
সংবাদ মাধ্যম মেতে ওঠে। এতে আর খারাপ লাগার, অশ্লীল লাগার কি আছে, যখন
বলা হয় ‘মা’কে এত
সব সোনায় সাজানো হবে। ‘মা’য়ের জন্য এত সোনা, ‘মা’য়ের সন্তান
তারাই যারা এত সোনা জোগাতে পারে। মায়ের কৃপায় তাদের কখনো কোনো কিছুর অভাব হয় না ।
বন্যায় কার বাড়ি ভেসে গেছে, রোগে কারা মারা যাচ্ছে, কারা
দুবেলা খেতে পাচ্ছেনা তাদের কথা ভেবে আনন্দ নষ্ট করা যেতে পারে না।
দুতিনবছর আগে অবধি উৎসবের
মরশুম আরম্ভ হত বিশ্বকর্মাপুজো থেকে, অর্থাৎ ভাদ্রের শেষ দিন
থেকে। এখন তারও আগে
দেখা দিচ্ছেন গণেশ ঠাকুর। আগে তিনি খুবই সীমিত ছিলেন। এবছর তো তিনি অনেক রাস্তাই
দখল করে ফেলেছেন
। আশা করছি আগামী বছরগুলোতে তাঁর বাড়বাড়ন্ত আরো হবে। কলকাতা লন্ডন না হোক, মুম্বাইকে
টেক্কা দেবে, অন্তত গণেশপুজোর দিক দিয়ে।
কলকাতার নিজস্ব দুর্গাপুজো তো আছেই। রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিনের পর দিন মহাপুজোর
আয়োজন করতে হয়। কারণ সবই মহা, প্রতিপদ থেকে দশমী অবধি। তার
পর জ্যান্ত দুর্গার প্রযোজনার কার্নিভাল। বিসর্জনের পর কদিন
অল্প বিরতি, তারপর কালীপুজো দীপান্বিতা---মাত্র দুদিনের পরব, কিন্তু
বেশ কবছর থেকে শুরু হয়েছে ধন তেরস, যা
হবার কথা শুধু ত্রয়োদশীর দিনে, কিন্তু ব্যবসায়ের খাতিরে
ধনতেরসের বিক্রিবাটা আগে পিছে আরও অন্তত দুদিন চারদিন করে
ফিবছর বেড়ে যাচ্ছে। ফলে ফুর্তির দিন ও আরো বাড়ে। আবার
দোকানে ভিড়, এবারে সোনা রূপো, বাসনপত্র
বৈদ্যুতিন সামগ্রীর বিপণিগুলোতে। কত বিক্রিবাটা । বাঙালি
এখন ধনতেরস উৎসব খুব খাচ্ছে। খবরের
কাগজে কাগজে ধনতেরসের মাহাত্ম্য ছাপা হয় । ধনতেরস পালন করলে
নিশ্চয়ই বাঙ্গালি
ও মাড়োয়ারির মত বড়লোক হয়ে যাবে। । এই
উপলক্ষে দোকানে
দোকানে কেনাকাটার বহর দেখে দেখে বোঝা যায় অভাবটভাব গত
শতাব্দীর ব্যাপার। শিল্প না আসুক, বাণিজ্যের
বৃদ্ধি না হোক, গণেশ, ধনলক্ষ্মীর পুজোর দৌলতে আমরা
ধন সম্পদ পাবই, একেবারে ব্রতকথার মত।
কত বছর থেকে শুনছি শব্দবাজি
বন্ধ হবার কথা, পরিবেশবিদ
থেকে কোর্ট থেকে প্রশাসন, সকলের
কাছ থেকেই উপদেশ নির্দেশ আদেশ; কিন্তু
বহাল তবিয়তে শব্দবাজি চলছে, চলবে। কানের
পর্দা ফাটুক আর হার্ট ধড়ফড় করুক, শ্বাস ধোঁয়ায়
রুদ্ধ হোক বা সারা দিক ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে দৃষ্টিক্ষমতা কমে যাক, বাজি
পোড়ানো হবেই। বাজি পোড়ানো বিজয়া থেকে শুরু
হয়ে যায়, দীপাবলি
হয়ে ছটপুজো
পর্যন্ত, দিনে
রাতে যেকোনো সময়ই বাজি পোড়ানোর মোচ্ছব । তাছাড়া
আছে বিয়েশাদি উপলক্ষে, ক্রিকেট বা অন্য
কোন খেলার অথবা নির্বাচনের পর বিজয়ী দলের, তাদের সমর্থকদের ‘বিজয়োৎসব’। যতই
পরিবেশ আর স্বাস্থ্য নিয়ে লাফালাফি করা হোকনা কেন বাজিকে সঙ্গে নিয়েই
ফুর্তি করতে হবে । কারণ আমরা শব্দপ্রিয় জাতি। শব্দে ভূত ভাগাই, শব্দে
নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করি, বাক্যের
শব্দে অন্যকে জব্দ করি । আর
বাজি তো আমাদের দেশি শিল্প । চিনা নয় । আমাদের অলিতে গলিতে
বোমার সঙ্গে বাজি তৈরি হয়।
এই রাস্তাজোড়া উৎসব পালন, এই যে
কানের গোড়ায় বাজি ফাটানো, এই যে
কান ঝালাপালা সঙ্গীত, ডিজে, এইসব
তো আমাদের অধিকার। কে এগুলোকে হরণ করতে পারে ? পরধর্ম
মতাবলম্বীর কথা তো দূর, স্বধর্মের
কত শতাংশ এই হুল্লোড়বাজিতে আনন্দ পায়
এসব জেনে আমাদের কাজ নেই। আমাদের ফুর্তি করতে দাও শামিল হও, ঠিক আছে, আপত্তি
করলে বিপদ ডেকে আনবে ।
উৎসব ঋতুর শেষে আমরা বলি, আসছে
বছর আবার হবে, আরো বেশি করে হবে। ভিতুর ডিমেরা বলে, আর
এসো না, মা।
তবে আমরা জানি, মা না এলে বাবা আসবে, বাবা
না এলে দিদি দাদা আসবে। কেউ একজন এলেই হল, আমরা ফুর্তি ঠিকই জমিয়ে নেব।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন