।। সুমন পাটারী ।।
(C)Image:ছবি |
আমাদের
ঘরে জন্ম নেওয়া অপত্য আমাদের থেকেই মানসিক ভাবে বিস্তার লাভ করে, তার
চিন্তার পরিধি ও সামগ্রীকতা আমরাই নির্ধারণ করি, আজকের দিনে
আমাদের আশি শতাংশ পিতামাতা খুব উচ্চ শিক্ষিত নয়, আর তাদের
পূর্বজ আরো--।মূলত কুলীন ও দাস থেকে উঠে আসা আমাদের পিতামাতা, তাদের চিন্তা ও সময় সমাজ হঠাৎ করে বদলে যায়, তাদের
চোখের সামনে। যার ফলে নিজেকে অনেকটা বেকডেটেড ভাবা ও পরের প্রজন্ম( যারা এখন ত্রিশ
থেকে চল্লিশ বছর বয়স) অল্পশিক্ষায় ইউজার ফ্রেন্ডলি প্রযুক্তি পেয়ে নিজেকে অনেক
কিছু ভেবে নিচ্ছে। নিজেকে প্রমাণ করতে চাইছে চূড়ান্ত আধুনিক,
এদের কাছে আধুনিক অর্থে শুধু ধুতি ছেড়ে প্যান্ট পরা। ছেলে মেয়েকে
বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করা ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে বই খাওয়ানো। তিন বছর বয়েসে যারা
কথা ঠিক করে বলতে জানে না ওরা শিক্ষার কী মূল্য বুঝবে? ওদের
কাছে শিক্ষা বেতের ভয়, কখনো মা বাবা ওদের মুক্ত ছেড়ে দিয়ে
হাতে রঙ পেন্সিল দিয়ে দেয় না, কিংবা ইত্যাদি। এরফলে মুক্ত
বিকাশের লক্ষণ নেই। আর নিজেকে অসম্ভব শিক্ষিত বলে দাবি করা এই সমাজ নিজের বিচার ও
বুদ্ধির ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, সবাই যে দিকে বলছে সে দিকে,
একজন বলছে ওই দিকে ঠিক অমুক স্কুল ভালো, এবার
কি ভালো কেন ভালো দরকার নেই। নিয়ে প্রেশারকুকারে সেদ্ধ করতে দাও। এর ফলে কোনো
ছাত্রছাত্রী শিক্ষাকে ভালোবেসে নিচ্ছেনা, নিজেকে বন্দি ভাবতে
ভাবতে একসময় এরা শিক্ষাকে ভিতরে ভিতরে ঘৃণা শুরু করছে। কীরকম নির্বুদ্ধিতায় ওরা
গর্ব করে বলে আমার ছেলেতো বাংলা লিখতেও জানে না। নাম্বারের চাপে নাচে গানে আর্টের
ঠেলায় মাঠঘাট কী জিনিষ ভুলে গেছে। এই যে একটা মানসিকতা তৈরি হচ্ছে যারা শিক্ষিত
ঘরের ওরা পাড়ার মাঠে খেলতে যাবে না, পাড়ার ছেলেদের সাথে মিশবে না,
ভবিষ্যৎ খারাপ হবে! কী খারাপ হবে এর থেকে খারাপ আর কী হতে পারে?
কারো সাথে মিশে যদি কেউ খারাপ হয় তবে ওর শিক্ষায় গলদ আছে। এভাবে
চাকরি আর ঘরযাপনে বাবার মতো ওদের ও স্বপ্ন এখানেই থেমে যায় কিছু নম্বর একটি
মার্কশিট ও কোথাও পেট ফুলাবার একটা চাকরি।
আমাদের
এই যান্ত্রিকতার পেছনে একটা প্রধান কারণ হল অনুকরণের স্বভাব, অনুকরণ
ছাড়া শেখা যায় না তাও ঠিক হয়তো কোথাও, কিন্তু সমাজ জীবন
অনুকরণে বিবর্তন হারিয়ে যায়। যেমন এই যে আমরা বিদেশী ও দেশী সিনেমায় দেখা ছেঁড়া
জামা কাপড় ও পথে পার্কে নাটকীয় প্রেম ও ঘষাঘষি, ওসব নকল বা
অনুকরণ। আমদানি করা, এখন এগুলো একদম খারাপ বলছিনা আমি কিন্তু
যে মুক্ত মানসিকতার লোক পাশ্চাত্য দেশে বাস করে আমরা ততোটা নই, একজন আমেরিকান তার জীবনকালে গড়ে 30 জনের সাথে
যৌনমিলন করে, ওটা ওদের কাছে স্বাভাবিক, ওদের ডিজিটাল দিনযাপন, ম্যানুয়াল লেবারের প্রাচুর্য
বাদে ওরা নানান পেশায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে রাখে। ওদের কাছে কৃষক আর প্রফেসারের
সামাজিক দূরত্ব নেই তদের রাজমিস্ত্রির যোগ্যতাও ন্যূনতম বি এ পাশ, কিন্তু আমরা ঠিক এর উল্টো, আমরা এখনো কুসংস্কার ও
জাতিভেদ থেকেও পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি। যা টিভিতে দেখছি তার সামান্য নকল ও
আমাদের কুসংস্কার ও বার মাসে তের পার্বণ সমাজ মিলেমিশে আমরা হয়ে উঠেছি এক
আধুনিক বর্বর।
এই
যে আমি,
আমার মতো একটা ছেলে দুহাজার পাঁচ পর্যন্ত জুতা আর কলগেট কী জিনিস
জানতো না, এমন হয়েছে একবার স্কুলে বন্ধুর সাথে মারামারি করে
আমার সুতির নীল স্কুলের শার্ট টা পিঠে দিয়ে মাঝ বরাবর বিশাল ছিঁড়ে গিয়েছে। বাড়ি
এসে উলের মোটা লাল সুতা দিয়ে ধানের বস্তা সেলাবার মতো নিজেই সিলিয়ে স্কুলে
গিয়েছিলাম, দেখলাম সবাই হাসছে, জুতার
জন্য বাবার কাছে গিয়ে বলেছি বাবা বললেন স্কুল বিদ্যার মন্দির, মন্দিরে আমরা জুতা নিয়ে যাই না, গর্বের সাথে স্কুলে
গিয়ে তাই বলতে লাগলাম, বড় পিসির বাড়ি গিয়েছিলাম, ওনাদের রান্নাঘরের সামনে ঝুড়িতে ব্রাশ কলগেট দেখলাম, কলগেট কী জিনিস জানতাম না, খেতে মিষ্টি লেগেছে অনেক
খেয়ে নিয়েছি, গলায় ঠাণ্ডা লাগছিলো, তারপর
ভয়ে কুয়ার পাড়ে লুকিয়েছিলাম, এই সব দিন থেকে হঠাৎ হাতের কাছে
সব পেয়ে গেছি। এখন ল্যাপটপ কে কোলবালিশের মতো রাখি যারা দশ বছর আগে টিভি দেখার স্বপ্ন
দেখতো। এই পাওয়ার সঠিক মূল্য বুঝতে পারিনি। টেন পর্যন্ত পড়ালেখা ভালো ছিলো, ইলাভেনে আত্মতুষ্টি দেখাদিলো,
কলেজে যেতে যেতে প্রেম গাঢ়, প্রেম বন্ধু
স্টাইল এসব করতে করতে কলেজের স্বপ্নময় গণ্ডি পেরিয়ে এলাম। এবার বাস্তব, সংসারের চাপ; লেন দেন, জীবনের
আসল রূপ; কিন্তু যারা পড়ালেখা করেছে শুধু, গভীর রাতে ফেসবুকে, ম্যাসেজিং অ্যাপে ওদের বন্দি
জীবনের কান্না শুনতে পাই। মুখস্থ যান্ত্রিকতার দাঁতকলে জিভের মতো বন্দি, আমাদের কোনো লক্ষ্য ছিলো না যেদিকে জল সেদিকেই ছুটেছি। সবাই এ এমন কেউ
ঘরের ভিতর উদ্বাস্তু কেউ ভিনশহরে। এভাবেই মরে মরে বিবর্তনহীন দিনযাপন.....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন