“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৭

জীবনধর্ম : পর্ব তিন

।। সুমন পাটারী ।।
           
(C)Image:ছবি
 
মরা মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেরা, আমাদের তেমন কোনো লক্ষ্য থাকেনা, লক্ষ্য অর্থাৎ মানবজন্মের উদ্দেশ্য--ভালোভাবে দেখলে দেখাযায় এই পার্বত্য ত্রিপুরা অরণ্য বিস্তৃত এলাকা, এখানে খুব বেশী দিন হয়নি বাঙালি সমাজ শিকড় ছড়িয়ে বসেছে। মূলত দুহাজার পাঁচ সালের পর থেকেই এখানে প্রযুক্তির বিশাল আয়োজন এতো দ্রুতভাবে বিস্তার লাভ করেছে যে আমরা তার সঠিক মূল্যায়ন করে ওঠতে পারিনি। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এখানের গ্রামে গ্র্যাজুয়েট সংখ্যা ছিলো হাতে গোনা,২০০০ সালে তা অনেকটাই বেড়েছে আর আজ প্রায় সব ঘরেই পাওয়া যায়। যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা এখানে এখনও তেমন কোনো শিল্প স্থাপন করতে পারেনি, আর আই টি শিল্প এখানে প্রায় নেই বললে চলে। এ দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকলেও এখানে ইলেক্ট্রনিক্সের ব্যাবহার বিগত দশ বছরে অস্বাভাবিক পরিমাণ বেড়েছে। বিশেষ করে মোবাইলফোন। এই মোবাইল পরিসেবা আমাদের আধুনিক করে তুলেছে। বস্তুত কতোটা আধুনিক তার সঠিক মূল্যায়ন কী?
আমাদের ঘরে জন্ম নেওয়া অপত্য আমাদের থেকেই মানসিক ভাবে বিস্তার লাভ করে, তার চিন্তার পরিধি ও সামগ্রীকতা আমরাই নির্ধারণ করি, আজকের দিনে আমাদের আশি শতাংশ পিতামাতা খুব উচ্চ শিক্ষিত নয়, আর তাদের পূর্বজ আরো--।মূলত কুলীন ও দাস থেকে উঠে আসা আমাদের পিতামাতা, তাদের চিন্তা ও সময় সমাজ হঠাৎ করে বদলে যায়, তাদের চোখের সামনে। যার ফলে নিজেকে অনেকটা বেকডেটেড ভাবা ও পরের প্রজন্ম( যারা এখন ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর বয়স) অল্পশিক্ষায় ইউজার ফ্রেন্ডলি প্রযুক্তি পেয়ে নিজেকে অনেক কিছু ভেবে নিচ্ছে। নিজেকে প্রমাণ করতে চাইছে চূড়ান্ত আধুনিক,
এদের কাছে আধুনিক অর্থে শুধু ধুতি ছেড়ে প্যান্ট পরা। ছেলে মেয়েকে বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করা ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে বই খাওয়ানো। তিন বছর বয়েসে যারা কথা ঠিক করে বলতে জানে না ওরা শিক্ষার কী মূল্য বুঝবে? ওদের কাছে শিক্ষা বেতের ভয়, কখনো মা বাবা ওদের মুক্ত ছেড়ে দিয়ে হাতে রঙ পেন্সিল দিয়ে দেয় না, কিংবা ইত্যাদি। এরফলে মুক্ত বিকাশের লক্ষণ নেই। আর নিজেকে অসম্ভব শিক্ষিত বলে দাবি করা এই সমাজ নিজের বিচার ও বুদ্ধির ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, সবাই যে দিকে বলছে সে দিকে, একজন বলছে ওই দিকে ঠিক অমুক স্কুল ভালো, এবার কি ভালো কেন ভালো দরকার নেই। নিয়ে প্রেশারকুকারে সেদ্ধ করতে দাও। এর ফলে কোনো ছাত্রছাত্রী শিক্ষাকে ভালোবেসে নিচ্ছেনা, নিজেকে বন্দি ভাবতে ভাবতে একসময় এরা শিক্ষাকে ভিতরে ভিতরে ঘৃণা শুরু করছে। কীরকম নির্বুদ্ধিতায় ওরা গর্ব করে বলে আমার ছেলেতো বাংলা লিখতেও জানে না। নাম্বারের চাপে নাচে গানে আর্টের ঠেলায় মাঠঘাট কী জিনিষ ভুলে গেছে। এই যে একটা মানসিকতা তৈরি হচ্ছে যারা শিক্ষিত ঘরের ওরা পাড়ার মাঠে খেলতে যাবে না, পাড়ার  ছেলেদের সাথে মিশবে না, ভবিষ্যৎ খারাপ হবে! কী খারাপ হবে এর থেকে খারাপ আর কী হতে পারে? কারো সাথে মিশে যদি কেউ খারাপ হয় তবে ওর শিক্ষায় গলদ আছে। এভাবে চাকরি আর ঘরযাপনে বাবার মতো ওদের ও স্বপ্ন এখানেই থেমে যায় কিছু নম্বর একটি মার্কশিট ও কোথাও পেট ফুলাবার একটা চাকরি।

আমাদের এই যান্ত্রিকতার পেছনে একটা প্রধান কারণ হল অনুকরণের স্বভাব, অনুকরণ ছাড়া শেখা যায় না তাও ঠিক হয়তো কোথাও, কিন্তু সমাজ জীবন অনুকরণে বিবর্তন হারিয়ে যায়। যেমন এই যে আমরা বিদেশী ও দেশী সিনেমায় দেখা ছেঁড়া জামা কাপড় ও পথে পার্কে নাটকীয় প্রেম ও ঘষাঘষি, ওসব নকল বা অনুকরণ। আমদানি করা, এখন এগুলো একদম খারাপ বলছিনা আমি কিন্তু যে মুক্ত মানসিকতার লোক পাশ্চাত্য দেশে বাস করে আমরা ততোটা নই, একজন আমেরিকান তার জীবনকালে গড়ে 30 জনের সাথে যৌনমিলন করে, ওটা ওদের কাছে স্বাভাবিক, ওদের ডিজিটাল দিনযাপন, ম্যানুয়াল লেবারের প্রাচুর্য বাদে ওরা নানান পেশায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে রাখে। ওদের কাছে কৃষক আর প্রফেসারের সামাজিক দূরত্ব নেই তদের রাজমিস্ত্রির যোগ্যতাও ন্যূনতম বি এ পাশ, কিন্তু আমরা ঠিক এর উল্টো, আমরা এখনো কুসংস্কার ও জাতিভেদ থেকেও পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি। যা টিভিতে দেখছি তার সামান্য নকল ও আমাদের কুসংস্কার ও বার মাসে তের পার্বণ সমাজ মিলেমিশে আমরা হয়ে উঠেছি এক
আধুনিক বর্বর।

এই যে আমি, আমার মতো একটা ছেলে দুহাজার পাঁচ পর্যন্ত জুতা আর কলগেট কী জিনিস জানতো না, এমন হয়েছে একবার স্কুলে বন্ধুর সাথে মারামারি করে আমার সুতির নীল স্কুলের শার্ট টা পিঠে দিয়ে মাঝ বরাবর বিশাল ছিঁড়ে গিয়েছে। বাড়ি এসে উলের মোটা লাল সুতা দিয়ে ধানের বস্তা সেলাবার মতো নিজেই সিলিয়ে স্কুলে গিয়েছিলাম, দেখলাম সবাই হাসছে, জুতার জন্য বাবার কাছে গিয়ে বলেছি বাবা বললেন স্কুল বিদ্যার মন্দির, মন্দিরে আমরা জুতা নিয়ে যাই না, গর্বের সাথে স্কুলে গিয়ে তাই বলতে লাগলাম, বড় পিসির বাড়ি গিয়েছিলাম, ওনাদের রান্নাঘরের সামনে ঝুড়িতে ব্রাশ কলগেট দেখলাম, কলগেট কী জিনিস জানতাম না, খেতে মিষ্টি লেগেছে অনেক খেয়ে নিয়েছি, গলায় ঠাণ্ডা লাগছিলো, তারপর ভয়ে কুয়ার পাড়ে লুকিয়েছিলাম, এই সব দিন থেকে হঠাৎ হাতের কাছে সব পেয়ে গেছি। এখন ল্যাপটপ কে কোলবালিশের মতো রাখি যারা দশ বছর আগে টিভি দেখার স্বপ্ন দেখতো। এই পাওয়ার সঠিক মূল্য বুঝতে পারিনি। টেন পর্যন্ত পড়ালেখা ভালো ছিলো,  ইলাভেনে আত্মতুষ্টি দেখাদিলো, কলেজে যেতে যেতে প্রেম গাঢ়, প্রেম বন্ধু স্টাইল এসব করতে করতে কলেজের স্বপ্নময় গণ্ডি পেরিয়ে এলাম। এবার বাস্তব, সংসারের চাপ; লেন দেন, জীবনের আসল রূপ; কিন্তু যারা পড়ালেখা করেছে শুধু, গভীর রাতে ফেসবুকে, ম্যাসেজিং অ্যাপে ওদের বন্দি জীবনের কান্না শুনতে পাই। মুখস্থ যান্ত্রিকতার দাঁতকলে জিভের মতো বন্দি, আমাদের কোনো লক্ষ্য ছিলো না যেদিকে জল সেদিকেই ছুটেছি। সবাই এ এমন কেউ ঘরের ভিতর উদ্বাস্তু কেউ ভিনশহরে। এভাবেই মরে মরে বিবর্তনহীন দিনযাপন.....

কোন মন্তব্য নেই: