“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৮

স্মৃতিচারণ: ভাঙ্গা ঘড়ির বৃত্তান্ত



|| শরীফ আহমদ ||

মার একটা হাতঘড়ি ছিল। সম্ভবত স্যুইস মেড। স্পোর্টস ওয়াচ। চারটে চাবি। সাথে কম করেও দুশ পাতার একখানা ম্যানুয়াল এসেছিল। কোল্ড ড্রিঙ্কের ক্যানের ডিজাইনের মোড়কে থাকা ঘড়িটি বের করে হাতে পরে খালি ক্যানটা সেই প্রথম দিন‌ই ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। দেড় বছর আগে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে এক ইলেকট্রনিক একজিবিশন থেকে কেনা। ডিসকাউন্টে মাত্র ১১৫ দিরহাম। শুরুতে কয়েকদিন রোজ ঘড়িটি হাতে দিতাম। রাতের বেলায় একসঙ্গে দুটো বোতাম টিপে ধরলে ভেতরে নিওন আলো জ্বলে উঠত। অন্ধকারে দিব্যি টাইম দেখা যেত। অনেক ফাংশন ছিল কিন্তু জানতাম না আর দরকার‌ও ছিল না।

কয়েকদিন পর ভাবলাম ওজনে  এত ভারি ঘড়িটি কেন পরতে হবে! আসলে এই ভাবনা এলো গত বছর একটি স্মার্ট‌ওয়াচ উপহার পাওয়ার পর। অফিসের বস আমার পারফরম্যান্স খারাপ না হ‌ওয়ায় সুন্টো ঘড়িটি দিলেন। তখন থেকেই দিনরাত এই মোটাসোটা সুন্টোই আমার শীর্ণ কব্জিতে পার্মানেন্ট জায়গা বানিয়ে নেয়। দেখতেই বড়ো ছিল কিন্তু ফাইবারের বডি থাকায় খুব একটা ওজন ছিল না। রোজ কতটা পায়ে হেঁটেছি তাও দেখাত এই সুন্টো।

মাসখানেক আগে থেকে পুরনো ঘড়িটির একটি রোগ ধরা পড়ল। মাঝে মাঝে আপনা আপনি এলার্ম দেয়া শুরু করে দেয়। মিনমিনে আওয়াজ কিন্তু দীর্ঘক্ষণ চলতে থাকবে। কোনো টাইমের ঠিক নেই। যখন তখন রাত বিরেতে বিরক্তিকর এই এলার্ম শুরু হয়ে যায়। যতক্ষণ দুপাশের দুটি বোতাম টিপে ধরব না ততক্ষণ বাজতেই থাকবে। চিরতরে এলার্ম বন্ধ করা জানি না কারণ ম্যানুয়াল পড়া হয়নি। একদিন ভোররাতে শুরু হলো এলার্ম। রুমে আমি একা। এলার্ম বেজে চলছে। কানে বালিশ চাপা দিয়েও লাভ হলো না। ভেঙ্গে গেলো ঘুম। টেবিলের ড্রয়ার থেকে খুঁজে বের করলাম ভুতুড়ে ঘড়িটি। রাগের মাথায় আছড়ে দেয়ায় এলার্ম বন্ধ হয়ে গেল আর সাথে সাথে ঘড়িটির‌ও অকাল মৃত্যু হলো। আফসোস হলো না। এটি হাতে দিতাম না।

কয়েকদিন আগে অফিস সংলগ্ন মসজিদ মুত্তাকীনে ওজু করার সময় হাত থেকে নালায় পড়ে যায় প্রিয় সুন্টো। টাইলসে আছড়ে পড়ায় কাচ ভেঙ্গে যায়। এখন টাইম ভালো করে দেখা যায়না। কাচ ভেতরের থেকে ফেটে গিয়ে কুয়াশার মত আবছা হয়ে আছে। অত‌এব আমি ঘড়ি হীন।

ঘড়ির বিষয়ে ভাবতে গিয়ে আব্বার কথা মনে পড়ে গেল। আব্বার একটি কালো রঙের ডায়েল আর  স্টিলের চেইন থাকা এইচ‌এমটি কোম্পানির ঘড়ি ছিল। রোজ সকালে চাবি দিতে হতো। আমি তখন আহমেদাবাদে থাকি। আব্বা ছুটিতে বাড়ি গেলেন। জলে পড়ে ওনার ঘড়ি বন্ধ হয়ে যায়। আব্বা তখন অসুস্থ ছিলেন। আরেকটি নতুন ঘড়ি আর কিনলেন না। ছোটভাই হানীফের দু তিনটে ঘড়ি ছিল। ওর সোনালী রঙের ঘড়িটি আব্বা নিয়ে নিলেন। ছুটি থেকে ফেরার পর আব্বার হাতে হানীফের ঘড়ি দেখে খারাপ লাগল। আব্বা নিজের জন্য কখনও কিছু কিনতে চাইতেন না। আমি একটি দামি ঘড়ি কিনে দিলাম আব্বাকে। আব্বা দাম জিজ্ঞেস করছিলেন বারবার। ওনাকে বলিনি। এর প্রায় চারমাস পর আহমেদাবাদ হাসপাতালে আব্বা মারা যান। অসুস্থ ছিলেন অনেকদিন।

এখন আর আমার হাতে ঘড়ি নেই কিন্তু জীবনের ঘড়ি তো আর থামছেনা! কখন বন্ধ হবে কে জানে!

(ছবি আন্তর্জাল থেকে নেয়া)


কোন মন্তব্য নেই: