(প্রবন্ধটি লেখা হয়েছিল বছর দেড় আগে। একটি বাংলা ছোট কাগজের জন্যে। কাগজটি এখনো না বেরোনোতে পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনাতে সম্পাদকের অনুমতি নিয়ে ব্লগে তুলে দিলাম।
---সুশান্ত কর)
১৯০৫এ লর্ড কার্জনের বাংলাভাগের
প্রস্তাবের বিরুদ্ধে লড়াই করতে নেমে যখন মুসলমান ভাইদের হাতে রাখি পরানো হয়েছিল
তখনই এই বার্তা দেয়া হয়েছিল সেই রাখির বাঁধন একটি ফস্কা গেরোই মাত্র। ‘রাখি’ একটি
বিশুদ্ধ হিন্দু প্রতীক। হিন্দু তরফে পরানো হল।এবারে,পছন্দ না হলে মুসলমানেরা খুলে ফেলতেই পারেন। কিন্তু
তার দায় হিন্দু নেবে না। ভালোবাসাটি হিন্দুর কাজ,তাকে অস্বীকার করাটি মুসলমানের।
এই ‘চাতুর্য’টি ছাড়া এই ‘রাখিবন্ধনে’র আর কোনো বার্তা ছিল না। ফলে ১৯৪৭এ যখন
দ্বিতীয়বারে জন্যে দেশভাগ হল কাউকে ‘রাখি’ নিয়ে এগোতে দেখা গেল না, তার বিপরীতে
দায়টি চাপিয়ে দেয়া হল একতরফা মুসলমানের কাঁধে। এই দায় নিয়েই এখনো মুসলমান এই দেশে
বাস করেন, এখনো এই দায় দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয় উপমহাদেশের রাজনীতি।
এর পেছনে শ্রেণি
স্বার্থ ছিল,সম্প্রদায় স্বার্থও ছিল, ছিল বর্ণ স্বার্থও। রবীন্দ্রনাথ যখন ঘরে
মুসলমান এলে জাজিমের একটা অংশ তুলে ধরবার কাহিনি শোনাচ্ছিলেন---তখন খুব স্পষ্ট করে
না হলেও সেই জাত-বর্ণ ব্যবস্থার দিকেই ইঙ্গিত করছিলেন। কিন্তু সেসব স্বার্থ তো এমনি এমনি সুরক্ষিত হবার ছিল না। ১৯০৫ যারা
ভাবছিলেন ‘ভদ্রলোক’ বাঙালির শ্রেণি-বর্ণ আধিপত্যের জোরে সেসব সুরক্ষিত করে নেবেন
পরের দিনগুলোতে তাদের কিছুটা সুবিধে দেয়া,কিছুবা দমন করবার স্বার্থে ব্রিটিশ যত
শাসনতান্ত্রিক সংস্কার নিয়ে ভোট রাজনীতির সূত্রপাত ঘটায় ততই তাদের কাছে স্পষ্ট হতে
থাকে ‘সংখ্যাগুরু’ হয়ে ওঠা ছাড়া সেসব অন্তত স্বাধীন দেশে সুরক্ষিত করা অসম্ভব। ফলে
১৯৪৭এ এসে নেমেছিলেন বাংলা ভাগের আন্দোলনে। সেই সঙ্গে ব্যবস্থা করে নিয়েছিলেন এমন
একটি আখ্যানকে প্রতিষ্ঠা দেবার যার মূল কথা হল,দেশভাগের জন্য মূলত মুসলমানই দায়ী।এখনো ‘সংখ্যাগুরু
আধিপত্য’কেই মনে করা হয় দেশ অখণ্ড রাখবার অবিকল্প সূত্র।
এখন ‘সংখ্যালঘু’
বললে ভারতবর্ষে এবং কাশ্মীর ছাড়া বাকি প্রায় সব প্রদেশে তাৎক্ষণিক-ভাবে শুধু
মুসলমানই বোঝায়। এটি একটি গড়ে তোলা আখ্যান। যার সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ক তখনও খুবই
ক্ষীণ ছিল এবং এখনো তাই রয়েছে। দেশভাগের আগে বাংলা এবং পাঞ্জাবে মুসলমান
সংখ্যাগরিষ্ঠই ছিল,সংখ্যালঘু ছিল হিন্দু। ফলে প্রদেশ হিসেবে এই দু’টোই বিভাজিত হয়।
এবং দুই প্রদেশেই মুসলমানের এক বড় অংশ প্রদেশ-বিভাজনের বিরোধিতাও করেন। অচিরেই বিভাজিত দুই দেশে ‘ভাষা’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
হিসেবে উপস্থিত হয়। দৃশ্যত যার সঙ্গে সম্পর্ক থাকবার কথা শিক্ষা এবং সংস্কৃতির,সে
সম্পর্কিত হয় রুটি-রুজি এবং মসনদ তথা
‘বিষয়-বাসনা’র সঙ্গে। যেরকম ধর্ম সম্পর্কিত হয় ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের
ঊর্ধ্বে আর সমস্ত জাগতিক বিষয়বাসনার সঙ্গে। এদেশেও,সেদেশেও।এদেশে হিন্দি আধিপত্য
চাপিয়ে দেবার বিরুদ্ধে সংগ্রামের পরিণামে আর দেশভাগ হল না বটে,কিন্তু ভাষার ভিত্তিতে
প্রদেশ-বিভাজিত হল।বাস্তবে কোথাও বা প্রদেশ-বিভাজনের ভিত্তি হলো নৃগোষ্ঠী।
পাকিস্তান থেকে ১৯৭১ এ বেরিয়ে এল বাংলাদেশ। পাকিস্তানে ১৯৫২র ভাষা আন্দোলনে রক্ত
ঝরল তবে,আসামের ১৯শে মে ১৯৬১র রক্তপতন যে একই প্রক্রিয়ার পরিণাম এখনো অনেকে বোঝেও
যেন না বুঝবার ভান করে বসে থাকেন। তাঁরা ৫২র ভাষা
আন্দোলন কিংবা ৭১এর মুক্তিযুদ্ধকে দেখেন মুসলমান পক্ষের ‘দ্বিজাতি-তত্ত্বে’র
ভ্রান্তির প্রমাণ হিসেবে মাত্র। কারণ স্বাধীন ভারতে টিকে থাকতে হলে ‘সংখ্যালঘু’
কথাটির বাকি সব অর্থকে গৌণকরে দিয়ে রাজনৈতিকভাবে নির্মিত প্রতাপের পরিভাষাটিকে
মেনে নেয়া ‘ভাষা-সংস্কৃতি’র দিক থেকে না হোক ‘বিষয়-বাসনা’র দিক থেকে সুবিধেজনক। সেই সত্যকে আড়াল করতে যে তাত্ত্বিক
ভিত্তির আশ্রয় নেয়া হয় তারই নাম ‘সাম্প্রদায়িক’তা। অথচ সংখ্যাগুরুকে প্রমাণ করতে
হবে যে তারা ‘সাম্প্রদায়িক’ নন। বিচিত্র ভারতে তারও বিচিত্র পন্থা। এই যেমন
সাম্প্রতিক আসামে শিলাপাথারে একটি ছাত্র সংগঠনের কার্যালয়ে আক্রমণ চালাবার দায়
যাদের কাঁধে চাপানো হল,তারা ‘সাম্প্রদায়িক’, কিন্তু যারা ভাষিক সংখ্যালঘুর
দোকান-বাড়ি পোড়ালো তারা অসাম্প্রদায়িক এবং অহিংস।প্রথম পক্ষের ফাঁসির দাবি
উত্থাপিত হলেও দ্বিতীয়পক্ষের হাজতবাসের দাবিটুকুও কাউকে বিশেষ তুলতে শোনা গেল না।
আসামের রাজনীতির সিংহভাগই যেহেতু এখনো দেশভাগ, বিশেষ করে
‘বাংলাভাগ’এর আবর্তে ঘোরাফেরা করে, এবং বাঙালি হিন্দুকে মনে করা হয় সেই বিভাজনের বলি--আমাদের মনে হল বাঙালি হিন্দু এবং সাম্প্রদায়িকতার
সম্পর্কটিকে একটু ঝালিয়ে নেয়া যাক।এই কাজটি স্বতন্ত্র ভাবে করেছেন জয়া চ্যাটার্জি
তাঁর ‘Bengal Divided’ বইতে। আমাদের
আশ্রয় সেই গবেষণা গ্রন্থটিই।ফলে এই আলোচনাটি
যুগপৎ সে বইয়ের একটি সমালোচনা হিসেবেও পড়া যেতে পারে। আশির দশকের শেষে তিনি
এটি লেখা শুরু করেন,তাঁর গবেষণা সন্দর্ভ হিসেবে।নব্বুইর শুরুতে শেষ করেন।১৯৯৪তে
ইংরেজিটি বেরোয় ক্যামব্রিজ থেকে,এক দশক পরে ২০০৩এ আবু জাফরের করা বাংলা অনুবাদ
বেরোয় ঢাকা থেকে। যদিও তাঁর বইটি সরাসরি ‘সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু ভাবনা’র বৃত্তে
ভ্রমণ করেনি। ১৯০৫এ যে বাঙালি ভদ্রসমাজ ‘বঙ্গভঙ্গে’র বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়ল,তারাই
কেন ১৯৪৭এ এসে বাংলাভাগের সপক্ষে উঠে পড়ে
নামলেন---এই ছিল তাঁর প্রথম এবং প্রধান জিজ্ঞাসা। এবং জিজ্ঞাসার জবাবে তিনি
অনুসন্ধান করেছেন ভদ্রলোক সাম্প্রদায়িকতার ‘সংস্কৃতি’র অবধারণাকেন্দ্রিক ‘গোপন
রহস্যের’। বলা ভালো --
আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু যে প্রক্রিয়াতে এই রহস্যটি গড়ে উঠেছে এবং বিকশিত হয়েছে
সেটি এই সংখ্যাগুরু হয়ে উঠবার প্রক্রিয়া,তাঁর লেখাতেও স্পষ্ট।
বাঙালি হিন্দুর
সমস্যা হল যে তারা বিভাগ পূর্ব বাংলাতে,বিভাগ পরবর্তী পুব পাকিস্তান তথা
বাংলাদেশে,এবং আসামে তথা পূর্বোত্তরে সংখ্যালঘু। সেই ‘সংখ্যালঘু’রাই তো ১৯০৫এ
মুসলমানকে নিয়ে মুসলমানের সঙ্গে থাকতে চাইছিলেন। সিলেট আসামে এলে সিলেটি
বর্ণহিন্দু বাংলাতে ফিরে যেতে চাইছিলেন। কী এমন ঘটে গেল যে ১৯৪৭ আসতে আসতে তারা
পুরো বিপরীত অবস্থান নিয়ে নিলেন,এবং এখনো মুসলমানের সঙ্গে আক্ষরিক অর্থেই
‘জল-পানি’র বিরোধ টিকিয়ে রাখতে উদগ্রীব। দেখা যাবে বিষয়টি আর কিছু না ---একটি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর
সংখ্যাগুরু হয়ে থাকবার ‘কৃত্রিম বাসনা’। বিষয়টি যদি ‘অকৃত্রিম’ হত তবে আসামের ইতিহাসে বারে বারে
শিলাপাথার হত না,হতে পারত না। শিলাপাথারের বিপরীত পক্ষের শব্দযুগল ‘খিলাঞ্জিয়ার প্রভুত্ব’ সেরকম কৃত্রিম
বাসনারই অসমিয়া নজির।
জয়া চ্যাটার্জি তাঁর বইয়ের বাংলা
সংস্করণ ‘বাংলা ভাগ হল’র মুখবন্ধে সঠিকভাবেই লিখেছেন, ১৯৮০ সালে তিনি যখন বইটির
কাজ শুরু করেন, “...তখন একটা সাধারণ ও অনুকূল ধারণা প্রচলিত ছিল যে, ভারত বা
বাংলার বিভক্তি মুসলমানের কাজ---হিন্দুরা তাদের মাতৃভূমির অখণ্ডতাকে ছিন্ন-
বিচ্ছিন্ন করতে কোনো কিছুই করেন নি।” (জয়া:ix)তিনি ছাড়াও অনেকেই সেই ‘অনুকূল ধারণা’কে প্রত্যাহ্বান
জানিয়েছেন ইতিমধ্যে। জয়া তাঁর বই লেখার আগের সময়টি সম্পর্কে লিখেছেন,“ঐ সময়ে
প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণায় প্রকাশ পায় যে,স্বাভাবিক ও ঐতিহ্যগত হিন্দুত্বের
বৈশিষ্ট্য হল সহনশীল এবং বহুত্ববাদী।তাই হিন্দুত্বে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার সুযোগ
নেই।” (জয়া:ix) তারপরেই লিখছেন,তবে তাঁর গবেষণায় “...বরং ভিন্ন তথ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঐ গবেষণায় প্রকাশ
পায় যে,বাঙলার হিন্দু ভদ্রলোকদের (elites) ক্রম-ক্ষয়িষ্ণু ক্ষমতা, ধনসম্পদ ও মর্যাদা হুমকির সম্মুখীন
হওয়ায় তারা সামাজিক অবস্থান অক্ষুণ্ণ রাখার লক্ষ্যে কূট-কৌশল অবলম্বন করে এবং
নিজেদের কাজের যৌক্তিকতা হিসাবে বিভিন্ন ভাবাদর্শকে (ideologies) ব্যবহার
করে।সত্যিকার অর্থে ঐ কূট-কৌশলকে একমাত্র সাম্প্রদায়িকতা হিসাবেই আখ্যায়িত করা
যায়।”(জয়া:x)
সাধারণত মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কথা বললে
ভদ্রলোক বাঙালিদের মধ্যে এই প্রশ্ন তোলা হয় না যে বক্তা বা লেখক সমানতালে হিন্দু
সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন কি না।কিন্তু হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কথা
বললে অনেকেই এই প্রশ্ন করেন মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার দিকে লেখক দৃষ্টি দিলেন কিনা।
লেখকের থেকে আশা করা হয় ‘ধর্মীয় নিরপেক্ষতা’-- হিন্দুত্ববাদীরাও একই আশা করেন। কেননা হিন্দুত্ববাদীরা নিজেদের কিছুতেই সাম্প্রদায়িক বলে
মনে করেন না। সেদিক থেকে বিচার করলেও জয়ার রচনাটি ‘পক্ষপাত দুষ্ট’ আদৌ নয়। কিন্তু
এহ বাহ্য। সাম্প্রদায়িকতার
প্রশ্নটি শ্রেণি প্রশ্নের
সঙ্গে নিশ্চয় জড়িত, কিন্তু বহু বাম কিংবা মার্ক্সবাদী বলে পরিচিত বুদ্ধিজীবিরাও প্রশ্নটিকে
দেখেন অত্যন্ত যান্ত্রিক ভাবে। তসলিমা
নাসরিণের মতো বহু আধুনিক ‘যুক্তিবাদী’ একে জড়িয়ে দেখেন বিশ্বাসের সঙ্গেই। যা
বস্তুবাদী চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীত। বিশ্বাস না থাকলেই সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না বলে
অনেকে নিদানও দিয়ে থাকেন। চল্লিশের মাঝামাঝি কলকাতা শহরে ডাইরেক্ট একশন ডে’কে
কেন্দ্র করে যে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা হয়েছিল সমরেশ বসুর সেই নিয়ে একটি সুবিখ্যাত
একটি গল্প আছে ‘আদাব’। সেখানে সাম্প্রদায়িকতার জন্যে দায়ী করা হয়েছে বিমূর্তভাবে ‘রাজনীতি’র লোকজনকে।
অথচ লেখককুল মোটেও তুলসিপাতা ছিলেন না।সুজিত চৌধুরীকেও দেখেছি ধর্মীয়
সাম্প্রদায়িকতার পেছনে পুঁজির ভূমিকা ব্যাখ্যা করে যাবার পরেও তাঁর বহু পঠিত এক
নিবন্ধে লিখেছেন,“ধর্ম যখন রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে তখন তাকে সাম্প্রদায়িকতা বলা
হয়। তাই সাম্প্রদায়িকতার সূত্র ধরেই দেশভাগ হলো” (সুজিৎ:৬৫) জয়া চট্টোপাধ্যায় পুরো গবেষণা নিবন্ধে বর্ণ-সম্প্রদায়
ধরে ধরে তাদের শ্রেণি অবস্থানকেও স্পষ্ট করেছেন,মুসলমানের বেলাও তাই করেছেন।যাতে
স্পষ্ট হয় যে বাঙালি ‘ভদ্রলোকেরা’ শ্রেণি এবং বর্ণ দুদিক থেকেই ছিলেন সামাজিক
স্তরভেদের সর্বোচ্চ স্তরের ক্ষমতাধর মানুষজন।নির্বাচনী রাজনীতির বিকাশ হতে হতে
যাদের সমস্যা ছিল শুধু তার সঙ্গে সংখ্যাগুরু হয়ে উঠবার,এবং নিজেদের আধিপত্যকে অক্ষুণ্ণ
রাখবার।এবং ইতিহাস শেষঅব্দি সেই দিকেই মোড় ফিরিয়েছিল,যেদিকটাতে তারা মোড় ফেরাতে
চেয়েছিলেন।যদিও সমাজ-ইতিহাসের এরকম এক মোড় ফেরানো পরিস্থিতি সম্পর্কে ফ্রেডরিখ
এঙ্গেলসের এই কথাও ১৯৪৭এ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল।এঙ্গেলস এক জায়গাতে লিখেছিলেন, “…ইতিহাসের
ক্ষেত্রে অসংখ্য ব্যক্তিগত ইচ্ছা আর ব্যক্তিগত ক্রিয়ার মধ্যে সংঘাতের পরিণামে যে
পরিস্থিতির উদ্ভব হয়,তার সঙ্গে অচেতন প্রাকৃতিক পরিস্থিতির সম্পূর্ণ সাদৃশ্য দেখা
যায়। কর্মের পেছনে বাঞ্ছিত লক্ষ্যের
অনুকূল বলেই মনে হলেও তার চরম পরিণামটা হয় বাঞ্ছিতের চেয়ে একেবারে
অন্যরকম।অতএব,ঐতিহাসিক ঘটনাও আপতিকতার শাসনাধীন বলে মনে হয়,কিন্তু যেখানে
ওপরে-ওপরে যা আপতিকতার ক্রিয়া মনে হয় সেখানে সর্বদাই প্রকৃত পক্ষে তা অভ্যন্তরীণ
নিগূঢ় নিয়মাবলী দ্বারাই শাসিত,এবং সমস্যা হল শুধু সেই নিয়মাবলীর আবিষ্কার।”
(ফ্রেডরিখ:২৪৭) এটা সত্য বটে ১৯৪৭এর বহু পক্ষ নিজেদের ইচ্ছে নিয়ে সক্রিয় ছিল। প্রায়
কারোরই হয়তো, ইচ্ছের পুরোটা কার্যকরী হয় নি। কিন্তু যদি সর্বভারতীয় বড় বোর্জুয়ারা
এবং বাংলার বর্ণহিন্দু শাসকশ্রেণি অন্যরকম ভাবতেন তবে দেশভাগ নিদেন পক্ষে অন্তত
বাংলা ভাগকে প্রতিরোধ করা যেতে পারত এরকমটা মনে করবার পক্ষে জয়া প্রচুর
বিশ্বাসযোগ্য নথিপত্র যুগিয়েছেন।
বাংলা ভাগের দুই কালপর্বের মাঝে জাতীয় রাজনীতির থেকে বাঙালির ক্রমেই
প্রস্থান ঘটে। কিন্তু সেই বাঙালির নেতৃত্বেই গড়ে উঠা, এবং পরে অবাঙালিদের আধিপত্যে
লালিত বিকশিত ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সম্পর্কেও তাঁর বক্তব্য এর “...অনেক কিছুই ধর্মনিরপেক্ষ নয়।...এই জাতীয়তাবাদী
চিন্তাধারা ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সহমত পোষণ করে যে,ভারতীয় সমাজের গোড়াতে
রয়েছে ধর্মীয়ভাবে সংজ্ঞায়িত সম্প্রদায়।”(জয়া:১) সেই ধর্ম হিন্দু। তাঁর আলোচনার কেন্দ্রে থেকেছেন ‘বাংলার
হিন্দু ভদ্রলোক’। ফলে ভূমিকাতেই তিনি বিস্তৃত ব্যাখ্যা করছেন-- ‘ভদ্রলোক’ কারা? ভদ্রলোকের হয়ে
উঠবার ইতিহাস।
ভদ্রলোকের অন্তরের প্রসার ও হৃদয়ের
কালচার:
বাংলায় ‘ভদ্রলোক’ শব্দে সবার কাছে বোধগম্য একটি
অর্থ রয়েছে। (জয়া:৩) কিন্তু সেটির
নানা জনে নানা অর্থ করেন।তিনি এদের শ্রেণি চিহ্নিত করে লিখেছেন,“চিরস্থায়ী
বন্দোবস্তের মাধ্যমে সম্পত্তির সাথে যে সম্পর্ক সৃষ্টি হয় তার অপরিহার্য উপজাত ফল
হল এই বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণী”(জয়া:৩) লোকে এদের
‘বাবু’ বলেও চেনেন। ‘বাবু’ বললে অবশ্যই হিন্দুকে বোঝায়, প্রায়ই একচেটিয়াভাবে
উচ্চবর্ণের হিন্দু, মনিব এবং পরের কালে উচ্চশিক্ষা,সংস্কৃতি ও ইংরেজভাবাপন্ন
হিন্দুদের ক্ষেত্রে পদবিটা সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। (জয়া:৩) তবে সব ভদ্রলোক
ইংরেজি বা পশ্চিমা শিক্ষাকে গ্রহণ করে নি।যারা করেছিলেন,বাকি ভদ্রলোকেরা তাদের
সামাজিক বয়কট অব্দি করতেন। এই কথাগুলো কিন্তু খুব প্রচারিত হয় না। ১৮৮৫ বা তার পরে
যখন জমিদারদের ক্ষমতা এবং আয় সীমিত হয়ে পড়ে তখনি বাকিরা ইংরেজি শিক্ষার দিকে ঝুঁকে
পড়েন।কিন্তু এই দুই শিবিরেই একটি বিষয়ে ঐক্য ছিল ---তাদের পা গ্রামের বাড়ি এবং শহরের বাসাতে ছড়ানো ছিল।
গ্রামের জমি থেকে আসা আয়ে এদের শহরের সংসার চলত। ফলে উনিশ শতকের শুরুতে যারা ধর্ম সংস্কার
দিয়ে যাত্রা শুরু করেন শতকের শেষ আসতে আসতে তাঁদের হাতেই ঘটে হিন্দু ‘পুনর্জাগরণ’।লন্ডনের
ক্যামব্রিজ ফেরত অরবিন্দের হাতে জন্ম নেয় ‘রাজনৈতিক বেদান্ত’।
পেশা হিসেবে মূলত
আইন, চিকিৎসা ইত্যাদিই এদের পছন্দের বিষয় ছিল---যেগুলো পড়তে হলে জমিবাড়ি আয় থেকে
ব্যয় দরকার। যাদের সেসব ছিল তারাই পারতেন।ফলে একটি নতুন শব্দগুচ্ছ ক্রমে ভদ্রলোককে
প্রতিস্থাপিত করতে শুরু করে—‘শিক্ষিত সম্প্রদায়’ বা ‘শিক্ষিত মধ্যবিত্ত’ এবং জমির
আভিজাত্যের জায়গা নিতে শুরু করে সংস্কৃতির আভিজাত্য। (জয়া:৮) এই পদগুচ্ছগুলো বাংলাতে বহুল ব্যবহৃত।এই ‘শিক্ষিত’দের
ধারণা তারা সংস্কৃতিবান ও বাংলার নবজাগরণের উত্তরসূরি এবং আধুনিকতার ধারক-বাহক
(জয়া:৮) এই অহমিকার সূত্র।আমরা দেখব,এখনো
মুসলমানদের সম্পর্কে ভদ্রলোকদের অন্যতম অভিযোগই হল ‘ইসলামে কোনো সংস্কার হয় নি’। সমাজ পুঁজিবাদের
দিকে এগোচ্ছে, আর ধর্ম সেই তার আদিরূপে আটকে আছে---এর তো কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা হতে
পারে না। ইসলামের সংস্কার
হয়েছে অন্য পথে,তা চালিত হয়েছে ব্রিটিশের এবং জমিদারের বিরুদ্ধে--- ফলে নবজাগৃত
ভদ্রলোক হিন্দুরা ‘হিন্দু পুনরুত্থানবাদে’ বহু সময় অন্যায় না দেখলেও ইসলামের
সংস্কারকদের আজ অব্দি সহজভাবে নেন না। শুধু সম্প্রদায় নয়,শ্রেণি-বর্ণগত কারণেই নেন
না।বঙ্কিম-বিবেকানন্দ-অরবিন্দে বহু প্রগতির দিকের সন্ধান পেলেও শাহ
ওয়ালিউল্লাহ,তার পুত্র শাহ আব্দুল আজিজ, সৈয়দ আহমদ বেরিলভি,এমন কি বাংলার
তিতুমীরের ‘মৌলবাদ’ সন্ধানটাই গুরুত্ব পায়। ঝাঁসির রানি স্বাধীনতা সেনানী, কিন্তু
কৃষক নেতা তিতুমীর মৌলবাদী। ব্রিটিশ অনুসারী ছিলেন বলে স্যার সৈয়দ আহমদ,আমীর আলিরা
বৌদ্ধিক স্তরে কিছু কিছু গুরুত্ব পেলেও মুসলমানের বাইরে ভারতীয় বা বাংলার সমাজ
তাদের সামান্য শ্রদ্ধা-সম্মানও জানায় না।স্মরণে রাখা তো দূর।বঙ্কিম এবং স্যর সৈয়দের তুলনা করতে গিয়ে অধ্যাপক
বাণীপ্রসন্ন মিশ্র এক জায়গাতে আক্ষেপ করে লিখেছিলেন,“... একজন নিজের কথা বলতে গিয়ে
উপন্যাসের আশ্রয় নিয়েছেন,আরেকজন সরাসরি বক্তব্য রেখেছেন।কিন্তু একজন বন্দিত হলে
অপরজন নিন্দিত হবেন,এর কোনও ব্যাখ্যা নেই।” (বাণীপ্রসন্ন মিশ্র:৩৩) সেই সব আলোচনাতে সেরকম বিস্তৃত জয়া যান নি।সম্ভবত তাঁর
বিষয় ছিল না বলে। কিন্তু যে ‘নবজাগৃত’ ভদ্রলোক অচিরেই ‘পুনর্জাগৃত’ হিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন তাদের
থেকে অন্যরকম আশা করাই যায় নি।তাঁরা আধুনিকতার মুখপাত্র বলে নিজেদের দাবি
করলেও জয়া লিখেছেন,“...সাধারণত ‘আধুনিকতা’
ও ‘ঐতিহ্যের’ মিশ্রণ দেখা যেত বেশি করে।” (জয়া:৯)
উনিশ
শতকের ‘নবজাগরণে’র কিংবা শতিকার শেষে এবং বিশ শতকের শুরু অব্দি যে সব
‘জাতীয়তাবাদী’ চিন্তাধারাতে ‘হিন্দু’ কিংবা পরবর্তীকালের ‘সাম্প্রদায়িক’ ‘বাগধারা
বা ভাষা’ দুর্লভ নাহলেও সেগুলোতে জয়ার মতে
একটি ব্রিটিশ বিরোধী মর্মবস্তুও ছিল। বিশ শতকের পরবর্তী কয়েক দশকে এই বাগধারাগুলোর
সূক্ষ্ম পুনর্বিন্যাস ঘটে এবং বিষয়বস্তুর দিক থেকে ব্রিটিশ তথা পাশ্চাত্য-বিরোধী
অবস্থান থেকে সরে গিয়ে মননে-মেজাজে মুসলিম
বিরোধী হয়ে উঠে।
এই প্রক্রিয়াটি বোঝার জন্যে তিনি ব্রিটিশ শাসনের শেষের পনের বছর ১৯৩২ থেকে ১৯৪৭ সময়টিকে বিশেষ কারণে বেছে নিয়েছিলেন। তার মধ্যে চতুর্থ অধ্যায় যার শিরোনাম ‘ভদ্রলোক সম্প্রদায়গত পরিচিতির ব্যাখ্যা: বাংলায় সংস্কৃতি ও সাম্প্রদায়িকতা’ গোটা বইটির প্রাণভোমরা বললে অত্যুক্তি হয় না। সাম্প্রদায়িকতার হিন্দু পক্ষটিকে বোঝা এর পরে খুব সহজ হয়ে যায়।
এই প্রক্রিয়াটি বোঝার জন্যে তিনি ব্রিটিশ শাসনের শেষের পনের বছর ১৯৩২ থেকে ১৯৪৭ সময়টিকে বিশেষ কারণে বেছে নিয়েছিলেন। তার মধ্যে চতুর্থ অধ্যায় যার শিরোনাম ‘ভদ্রলোক সম্প্রদায়গত পরিচিতির ব্যাখ্যা: বাংলায় সংস্কৃতি ও সাম্প্রদায়িকতা’ গোটা বইটির প্রাণভোমরা বললে অত্যুক্তি হয় না। সাম্প্রদায়িকতার হিন্দু পক্ষটিকে বোঝা এর পরে খুব সহজ হয়ে যায়।
‘সাম্প্রদায়িকতাকে
দেখবার প্রচলিত সব দৃষ্টিকেই প্রায় প্রত্যাখ্যান করে জয়া চ্যাটার্জি এক নতুন
ব্যাখ্যা উপস্থিত করেছেন বলেই আমাদের অভিমত। ভদ্রলোকের সম্প্রদায়গত পরিচিতি গড়ে তুলবার বিষয়টি এর আগে
ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যাবার জন্যে তিনি ন্যূনতম দুটি কারণের উল্লেখ করছেন।একটি
হচ্ছে ভারতে সাম্প্রদায়িকতার আলোচনা সাধারণত দেশভাগের আলোচনাতে পরিণত হয়,অথবা
দ্বিতীয়টি ঘুরে তাৎক্ষণিকভাবে সংগঠিত ‘দাঙ্গা’কে ঘিরে। প্রথমটির পক্ষে প্রচলিত ধারণা যে,“বাংলার মুসলমানেরা সহজাতভাবে
সাম্প্রদায়িক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং তাদের ‘উচ্চশ্রেণী’র নেতারা নিজেদের উদ্দেশ্য
সিদ্ধির জন্য তাদের সাম্প্রদায়িক অনুভূতিকে সহজে সংগঠিত করতে পারে।” (জয়া:১৭৭) ফলে মুসলমান বিচ্ছিন্নতাবাদের পরিণাম হল দেশভাগ
ইত্যাদি।এই ধারারই আরেকদল ঐতিহাসিক শ্রেণি-সম্প্রদায়ের সমান্তরাল ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের
দিকে নজর দিয়ে দেখাতে চান মুসলমানদের মধ্যেকার ‘কৃষক-সাম্প্রদায়িক’ চেতনার ফলেই
জমিদার –জোতদার বিরোধ বাংলাতে দ্রুত সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটায়। যেভাবেই দেখা
হোক,দুইপক্ষই মনে করেন যে মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার সমান্তরালভাবে হিন্দু
সাম্প্রদায়িকতার সেরকম উন্মেষ ঘটেনি। “সেই ধারণাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা হয় যে,
অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের চেয়ে মুসলমানেরা সহজাতভাবে ‘সাম্প্রদায়িক’।” (জয়া:১৭৮) দ্বিতীয়ত “এটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধারণা করে নেওয়া হয়
যে, সাম্প্রদায়িক পরিচিতি গঠনের সাথে আবশ্যিকভাবে বিশেষ ধর্মীয় (বা ‘পবিত্র’)
প্রতীক জড়িত,যেমন,মসজিদের সামনে গান-বাজনার,কোরবানি করা বা গো রক্ষা,মূর্তি
অপবিত্র করা,ধর্মীয় উৎসব পালনের সময় সংঘর্ষ,‘পবিত্র স্থান’ ও ‘পবিত্র সময়’
সম্পর্কিত বিষয়।” (জয়া:১৭৮) এই
প্রতীকগুলোর আবেদনকে তিনি মোটেও কম শক্তিশালী মনে করেন নি,এগুলো একটি সম্প্রদায়ের
সঙ্গে আরটির সীমানা নির্দিষ্টও করে দেয় তবু তাঁর মতে সেসব ‘বহিরাবরণ মাত্র’।(জয়া:১৭৯) এগুলোর প্রকৃতার্থ বুঝতে হলে কালিক এবং
কালানুক্রমিকভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াগুলোও অনুধাবন করতে
হবে। সেসব না করাতেই তাঁর মতে ভদ্রলোক সাম্প্রদায়িকতা ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি এড়িয়ে
গেছে।তিনি দাবি করেন,“বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভদ্রলোক পরিচিতির একমাত্র একক
নিদর্শন যদি কিছু থেকে থাকে তা নিঃসন্দেহে তাদের ‘সংস্কৃতি’।” (জয়া:১৭৯) বিশ শতকের শুরু থেকেই ভদ্রলোকেরা নিজেদের ভাবতে
শুরু করেন ‘বাংলার নবজাগরণে’এর উত্তরাধিকারী ‘সংস্কৃতিবান’ গোষ্ঠী বলে। সংস্কার
নিজেই ছিল হিন্দু সমাজের পুনর্গঠনের বিষয়। ইয়ঙ বেঙ্গল গোষ্ঠীর আদৌ বিশেষ সমর্থন
ছিল না, ব্রাহ্মরাও শতাব্দীর শেষ আসতে আসতে শুধু বিভাজনের স্বীকার হয়
নি,ভদ্রলোকেদের উপহাসের বিষয় হয়।জয়া কেন বিদ্যাসাগরকে ভদ্রলোকেদের প্রত্যাখ্যান
নিয়ে বিশেষ লেখেন নি,সে এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন।ধর্মসংস্কার পরিণত হয় হিন্দু
জাতীয়তাবাদে।বঙ্কিম বর্ণপ্রথার সমর্থনে দাঁড়ান এবং মহিলাদের প্রশ্নেও তাঁর অবস্থান
রক্ষণশীল ছিল।এইখানে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতিনিধি স্বরূপ রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’
চরিত্রের পূর্বভাগের উল্লেখ করেছেন জয়া চ্যাটার্জি।এক নতুন হিন্দু ধর্ম দাঁড়াল এবং
তার জন্যে সাহিত্যিকেরাই অগ্রণী ভূমিকা নিলেন।“এই প্রক্রিয়ায় হিন্দু ধর্মকে
নতুনভাবে ‘উপস্থাপন’ করা হয় অভ্যন্তরীণ দিক থেকে সুসমঞ্জস,একক ও একেশ্বরবাদী ধর্ম
হিসেবে,যাতে পৃথিবীর অন্য যে কোনো ধর্মের সাথে তুলনা করা সহজ হয়।”(জয়া:১৮২) উনিশ শতকের শেষ দিকে এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে ইতিহাস চর্চার মূল উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু
বাঙালিদের মধ্যে জাতীয় গৌরব এবং ‘সাংস্কৃতিক আস্থার’ চেতনা গড়ে তোলা। বঙ্কিম তো
প্রাচীন বাঙালির ‘ঔপনিবেশিকতা’র সন্ধান করেছেন বেশ গৌরবের সঙ্গে। ভারতীয় ইতিহাস
মানেও ছিল হিন্দুর ইতিহাস। সেই সব হিন্দু বীরেদের কাহিনি বর্ণন যারা মুসলমান
শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। বাংলাতে সেরকম বীর না পেয়ে মারাঠা রাজপুত বীরদেরও
এমনভাবে চিত্রিত করা হল যেন তাঁরা বাঙালিরই পূর্বপুরুষ ছিলেন।
বঙ্কিমের রচনার নজির দিয়ে দেখিয়েছেন কী ভাবে হিন্দুর দুর্বলতার কারণ সন্ধান
করছেন,আবার একই কারণে সেই দুর্বল বাঙালি মনে ‘মানুষের জন্যে ভালবাসা’র উন্মেষ
হয়েছিল তার পক্ষেও যুক্তি হাজির করছেন। “বঙ্কিমের মতে সাংখ্য (Sankhya) দর্শন হিন্দু
চরিত্রের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এবং এর ফলে তারা অতি মাত্রায় অতিজাগতিক ও
অদৃষ্টবাদী হয়ে ওঠে।” (জয়া:১৮৪) বাঙালি বাবুদের শারীরিক মানসিক
দুর্বলতাকে কঠোর ভাষাতে সমালোচনা করেন বঙ্কিম। পার্থ চ্যাটার্জির সূত্র উল্লেখ করে
‘টীকা’ অংশে জয়া দেখিয়েছেন বঙ্কিমের এই ধারণাগুলোও মৌলিক নয়, এগুলো মেকলের লেখার
থেকে ধার করা। (জয়া:২১৭) এই দৌর্বল্য ঘোচাতেই সারা বাংলায়
ব্যায়াম সমিতিগুলো গঠনে প্রেরণা যোগায়।“এসব আখড়া ও সমিতি পরবর্তীকালের গোপন
সন্ত্রাসী সমিতিগুলোর সদস্য সংগ্রহের সামনের সারির স্থান হিসেবে পরিণত হয়।” (জয়া:১৮৬) ভদ্রলোকেরা গ্রামে গিয়ে বিভিন্ন পল্লিসমিতি গঠনে জোর
দেয়, কৃষকদের সংগঠিত করতে নয়।‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকাতে অরবিন্দ যেভাবে আক্ষেপ করছেন
হিন্দুরা মাটির সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে, এবং লিখছেন হিন্দুদের স্থায়িত্ব
নিশ্চিত হবে যদি তারা মাঠে ফিরে যায় তাতে বোঝা যায় তিনি শহুরে ভদ্রলোকদের কথাই
ভাবছেন।
কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র সম্পর্কে আমাদের মনে এক
স্বতন্ত্র আবেগ কাজ করে। তিনি বঙ্কিম ঘরানার বিপরীতে, সম্প্রদায় নির্বিশেষে
বঞ্চিত,পীড়িত গ্রামীণ জনতা এবং নারীদের যন্ত্রণাকে ভাষা দিয়েছেন। জয়া চ্যাটার্জি
এই ভ্রান্তি ভেঙ্গে দেন। শরৎ চন্দ্র নিয়ে বাঙালি পাঠকের এক স্বতন্ত্র অনুরাগের কথা
মনে রেখেই সম্ভবত তিনি তাঁকে নিয়ে একটু বেশি বিস্তৃতই আলোচনা করেছেন,যাতে তাঁকে
‘সংস্কৃতি’ তথা ভদ্রলোক সাম্প্রদায়িকতার সুপরিচিত প্রতিনিধি ছাড়া আর কিছুই মনে হয়
না। ব্যায়াম সমিতিগুলো থেকে বেরিয়ে আসা আদর্শ স্বদেশী চরিত্র ‘পথের দাবী’
উপন্যাসের ‘সব্যসাচী’। পুলিশের নজর এড়াতে সে যেভাবে প্রবল স্রোতে পদ্মানদী পাড়ি দেয় বা হেঁটে হিমালয়
পার করে তাতে তনিকা সরকার লিখেছিলেন,“গুরুত্বপূর্ণ বাঙলা উপন্যাসের প্রথম নায়ক
সব্যসাচীকে রূপায়িত করা হয়েছে একজন অতিমানব হিসেবে।” (জয়া:১৮৭) “বঙ্কিমের মতো
শরৎচন্দ্র মনে করেন যে, জাতীয় মুক্তি হল আলোকপ্রাপ্ত শিক্ষিত লোকের
কাজ---সব্যসাচী হল তাদের প্রতিনিধি” (জয়া:১৮৭) কিন্তু “
শরৎচন্দ্র মনে করেন যে, জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপ চালানোর পথের প্রতিবন্ধকতা হল
ঐতিহ্যগত হিন্দু সংস্কৃতি।” (জয়া:১৮৭) ফলে সব্যসাচী
জাত মানে না। যা কিছু প্রাচীন ও ক্ষয়িষ্ণু সে সবই সে ধ্বংস করবার আহ্বান জানায়।
সুমিত্রা-ভারতীরা পুরুষের সঙ্গে একত্রে কাজই করে না,প্রথা ভেঙ্গে বাসও করে।কিন্তু
উপন্যাসের শেষে সব্যসাচী কবি শশীকে কৃষকের কথা
ভুলে যেতে বলে,তার বদলে শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান সম্প্রদায়ের বিপ্লবের গান
গাইতে বলে। ভারতীর কথার প্রত্যুত্তরে সব্যসাচী বলে,“...সে জাত মানে না,কিন্তু সে
না মানলেও শিক্ষিত ও নিরক্ষর লোকদের মধ্যে জাতের পার্থক্য রয়েছে।” (জয়া:১৮৮) নবজাগৃত লেখকেরা সন্ধান করে বেড়িয়েছেন,কী এমন গুণাবলী
যার জন্যে ভারত বারে বারে অধীনতার পাশে বাঁধা পড়েছে। একই সঙ্গে তাঁরা চেয়েছেন এমন
এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নির্মাণ যা পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির তুলনাতে শ্রেয় না হলেও
সমান। ফলে ‘পথের দাবী’র মতো বহু উপন্যাসে ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে হিন্দু গোঁড়ামিরও
তীব্র সমালোচনা করা হয়, কিন্তু তুলে ধরা হয় ‘সংস্কৃতি’।‘বিপ্রদাস’ উপন্যাসেরও একটি সংক্ষিপ্ত সমালোচনা উপস্থিত করে
জয়া দেখান,সেটিতে ব্রিটিশ শাসন কিংবা জাতিভেদের বিরোধিতা সেরকম নেই,তার চেয়ে সেই
‘হিন্দু সংস্কৃতি’র নজির স্থাপন করা হয়েছে। জয়া যে যুক্তিগুলো দেখাচ্ছিলেন সেই
কথাগুলো শরৎ চন্দ্র স্পষ্টই লিখেছিলেন‘ বর্তমান হিন্দু মুসলমান সমস্যা
প্রবন্ধে’,“শিক্ষা মানে যদি লেখাপড়া জানা হয় তাহা হইলে হিন্দু-মুসলমানে বেশী
তারতম্য নাই...কিন্তু শিক্ষার তাৎপর্য যদি অন্তরের প্রসার ও হৃদয়ের কালচার হয়,তাহা
হইলে বলিতেই হইবে উভয় সম্প্রদায়ের তুলনাই হয় না... শিক্ষা সমান করিয়া লইবার আশা আর
যেই করুক আমি তো করি না।হাজার বৎসরে কুলায় নাই,আরও হাজার বৎসরে কুলাইবে না।” (শরৎ:২১৩৫) এটি একটি বক্তৃতা। ‘হিন্দু সঙ্ঘ’ পত্রিকার ১৩৩৩ বাংলাতে ছাপা হয়।মুসলমান
সংক্রান্ত সমস্ত প্রচলিত বাগধারাতে এই বক্তৃতা পরিপূর্ণ।১৯২৯শের ফেব্রুয়ারিতে
মালিকান্দা ‘অভয় আশ্রমে’ এক যুবক ও ছাত্র সম্মিলনীর অধিবেশনে তিনি লাঠিখেলা
ইত্যাদির মাহাত্ম্য বুঝিয়ে বলছেন,“এতদিন physical culture-এর দিকে ছাত্রসমাজ একেবারে বিমুখ হয়ে পড়েছিল। মনে হয়,এইটে ধীরে ধীরে আবার যেন ফিরে আসছে।এই প্রত্যাগমনকে আমি সর্বান্তকরণে
অভিনন্দিত করি।তারা দেখেছে,দুর্বল শক্তিহীনেরই শুধু লাথির ঘায়ে প্লীহা ফাটে।শক্তিমান
পাঠান-কাবলীওয়ালার ফাটে না। ফাটে বাঙ্গালীর।” (শরৎ:২১৪০) অথচ একই
শরৎচন্দ্র যখন মুসলিম সাহিত্য-সমাজের দশম বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতি হয়ে গেছেন,
সেখানে তাঁর আপাত বিরোধী স্বর। “সাহিত্য-সাধনা যদি সত্য হয়,সেই সত্যের মধ্য দিয়েই ঐক্য একদিন আসবেই। কারণ, সাহিত্য-সেবকেরা পরস্পরের পরমাত্মীয়। হিন্দু হোক,মুসলমান হোক,কৃশ্চান হোক,তবু পর নয়—আপনার জন।” লীলাময় রায় নামে
এক লেখকের উল্লেখ করেছেন, যিনি হিন্দু –মুসলমান ঐক্যে অনাস্থা ব্যক্ত করেন। শরৎ
চন্দ্র বলেন কি না, “...এঁদের মতো শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক পণ্ডিত ও চিন্তাশীল
ব্যক্তিরাও আজ যদি এই কথা বলতে থাকেন ত নৈরাশ্যে যে সমস্ত দিক কালো হয়ে উঠবে। এ কি
এঁরা ভাবেন না? মনের তিক্ততা দিয়ে কোন মীমাংসাও হয় না, মিলনও ঘটে না।...”(শরৎ:মুসলিম
সাহিত্য-সমাজ:sarat-rachanabali.nltr.org) লীলাময়কে তিনি
যে প্রশ্নটি করলেন,“এ কি এঁরা ভাবেন না?” সেই প্রশ্নটি
কিন্তু এই সভার বাইরে তাঁর নিজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। জয়া লিখেছেন, হিন্দুত্ব
নির্মাণের জন্যে মুসলমানের ঠিক উলটো বৈশিষ্ট্যগুলোকেই বেছে নেয়া হয়।এই যেমন
হিন্দুরা “বিপ্রদাশের মতো গোঁড়া হতে পারে,কিন্তু তারা সবসময় সহিষ্ণু হয়;অথচ
মুসলমানেরা হয় নিশ্চিত ভাবে ‘ধর্মোন্মত্ত’।” (জয়া:১৮৮) হিন্দুর
শক্তিচর্চার মানে হচ্ছে ‘physical
culture’,তার বিপরীতে মুসলমানের শক্তি মানে হচ্ছে কাম-লালসা-লাম্পট্যের সমৃদ্ধি।শরৎ
চন্দ্রের ‘সংস্কৃতি’ যেহেতু আর শিক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে নেই,জন্ম থেকেই এটা হিন্দুর
সহজাত গুণ,ফলে প্রসারিত হিন্দু সমাজের মধ্যে ‘ছোটলোক’দেরও ভিড়িয়ে দেয়া সম্ভব
হল।তাঁর মনে হল,হিন্দুর সমস্যা এই নয় যে কীকরে ‘মিলন’ হবে, তার সমস্যা এই যে কী
করে সে ‘সঙ্ঘবদ্ধ’ হবে। (শরৎ:২১৩৫) মিলন এবং সঙ্ঘবদ্ধ শব্দ দুটির ব্যঞ্জনার্থ বর্তমান
আলোচনাতে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি স্পষ্টই মনে করেন,‘হিন্দুস্তান হিন্দুর দেশ’। (শরৎ:২১৩৬) অথচ, তাঁর সম্পর্কে কখনো ‘দ্বিজাতি তত্ত্বে’র কথা
শোনা যায় নি।
জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে একটি বইতে
লিখেছিলেন,“জাতীয়তাবাদ ধর্মনিরপেক্ষ ধারার মধ্য দিয়ে পরিচালিত সাম্প্রদায়িকতার
অতিরিক্ত কিছু নয়” (জয়া:২০০) জয়া বিষয়টিকে
বেশ জটিল বলে উল্লেখ করেছেন। সত্য বটে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ হিন্দু সম্প্রদায় ঘিরেই
তৈরি।তার পরেও একটি শিবির যখন উপনিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে লক্ষ্য হিসেবে বেছে
নেয়, অন্য শিবিরের উদ্দেশ্যটি শুরু হয় স্বাধীনতার প্রক্রিয়াতে মুসলমানের অংশগ্রহণ
সম্ভাবনাকেই অস্বীকার করা।এবং ক্রমেই সেই জাতীয়তাবাদী কর্মসূচীতে ‘ব্রিটিশ শাসনের
বিরোধিতা’র আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই থাকে না, লক্ষ্য বস্তুটিই হয়ে পড়ে
মুসলমান।এই প্রথম শিবিরের নজির দিতে গিয়ে তিনি উনিশ শতকের নবীন চন্দ্র সেনের
‘পলাশীর যুদ্ধ’ কাব্যের উল্লেখ করেছেন। যেখানে খলনায়ক অবশ্যই ক্লাইভ,নায়ক
সিরাজদ্দৌলা।কিন্তু ইতিমধ্যে ঔপনিবেশিক লেখকেরা ‘মুসলমান যুগে’র শাসককে যেভাবে
মন্দির ধ্বংসকারী ইত্যাদি বলে চিহ্নিত করেছেন,এই কাব্যেও তাই করা হয়েছে,সিরাজকে
চিত্রিত করা হয়েছে মাতাল লম্পট বলে,এবং মুসলমানদের সম্পর্কে গোটা কবিতায় ‘যবন’
শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।সিরাজের সংগ্রামকে বৈধ করতে গিয়ে রানি ভবানী চরিত্রকে
ব্যবহার করা হয়েছে,যেখানে তিনি বলছেন সাতশত বছর ধরে এদেশে থেকে মুসলমানেরা ভারতীয়ই
হয়ে গেছেন এবং ব্রিটিশের মতো দাসত্ব শেকলে কোনোদিনই বাঁধেনই নি।পলাশীর যুদ্ধ এবং
সিরাজ চরিত্রের এহেন জাতীয়তাবাদী নির্মাণের এক প্রক্রিয়া পরের শতকেও বহমান ছিল। এর
চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে ১৯৪০এ সুভাষ বসুর নেতৃত্বে হলওয়েল মনুমেন্ট সরিয়ে ফেলার
দাবিতে।সিরাজদৌল্লার নিষ্ঠুরতার প্রতীক হিসেবে ব্রিটিশ এটি গড়ে রেখেছিল। সুভাষ বসু
আশা করেছিলেন এই লড়াইতে হিন্দু মুসলমান দুই পক্ষই তাঁর পাশে দাঁড়াবে। বাংলার
রাজনীতির এক নতুন অসাম্প্রদয়িক ভিত্তি তৈরি হবে। টাউন হলের এক সভাতে তাঁর অনুগামী বামপন্থীরা তো বটেই মুসলিম লিগের অনেক
ছাত্ররাও যোগ দিয়েছিল। কিন্তু হলওয়েল সত্যাগ্রহের দিনেই সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে
সেই সম্ভাবনাকে ধ্বসিয়ে দেয়। সুভাষের দেশ ছেড়ে
যাবার আগে এটিই ছিল শেষ কোনো গণ-উদ্যোগ। কিন্তু এই ধরণের পালটা আখ্যান নির্মাণের
প্রয়াস খুবই কম। ভদ্রলোক লেখকেরা অনেকেই পলাশীকে দেখতেন মুসলমান অত্যাচারের থেকে
বাংলার মুক্তির মুহূর্ত হিসেবে।এদের মধ্যে ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারও ছিলেন। তিনি
জেমছ মিলের থেকেই ‘মুসলিম যুগে’র ধারণা
ধার করা ‘জাতীয়তাবাদী’ ঐতিহাসিক ছিলেন। সুভাষ বসু ‘মুসলিম যুগে’র এই ধারণাকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান
করেছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের শুরু যে দিনগুলো নেহরুর মতেও ছিল ‘নির্ভেজাল চুরি’ এবং
‘জবরদস্তি লুণ্ঠনে’র কাল,যদুনাথ সরকার সেই কালকে আধুনিকতার ‘যাদুদণ্ড’ হিসেবে
উপস্থিত করেন। (জয়া:২০৫)
ব্রিটিশ শাসনের
প্রশংসাও ভদ্রলোক সাম্প্রদায়িকতার পক্ষে কীভাবে কাজ করে তার চরম নজির ১৯৩২ এ
প্রকাশিত‘দি বেঙ্গল হিন্দু মেনিফেস্টো’তে মুসলমানের নিন্দে করে বলা হয়,“তারা কখনো
সৈনিক হিসেবে কাজ করে নি বা সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষার জন্য কোনো কিছু করে নি।” (জয়া:২০৭) স্পষ্টই বোঝা যায়,
স্বাধীন দেশের সেনাকে ‘দেশপ্রেমী’দের প্রতীকশীর্ষ করে তুলবার অভিযান ব্রিটিশ
ভারতের সেনাকে দিয়েই শুরু হয়েছিল।‘মডার্ন রিভিউ’ নামের এক গবেষণা পত্রের থেকেও এমন
তুচ্ছতাচ্ছিল্যের নজির জয়া তুলে ধরেন।(জয়া:২০৯) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
যতই উঁচু-নিচু নির্বিশেষে হিন্দুর শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করুন, খুব কম ভদ্রলোক সেই
আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন। এমন কি শ্যামাপ্রসাদও নন। গবেষকেরা মুসলমান তাচ্ছিল্যের
আরেক আছিলা বের করেছিলেন এই বলে যে মুলসমানেরা অস্পৃশ্য এবং জনজাতিদের থেকেই
ধর্মান্তরিত। ‘মডার্ন রিভিউ’তেই এমন গবেষণা নিবন্ধ বেরিয়েছিল।
ফলে ১৯৩২এ যখন
ব্রিটিশ সরকার ‘সম্প্রদায়ভিত্তিক রোয়েদাদে’র ঘোষণা করেন ১৯০৫এ ‘রাখি’ যাদের
পরিয়েছিলেন তাদের ভুলে যেতে মুহূর্ত সময় নেন নি এই সব ‘সংস্কৃতিবান
ভদ্রলোকে’রা।
সম্প্রদায়গত রোয়েদাদ এবং সংখ্যালঘু স্বীকৃতির দাবি
চিরস্থায়ী
বন্দোবস্তের ফলে এবং মণ্টেগু –চেমসফোর্ড সহ যা কিছু শাসন সংস্কার করেছিল তাতে
প্রশাসনে এবং সমাজে ভদ্রলোক হিন্দুদের একটা আধিপত্য ছিল। যদিও বিশ শতকের শুরুতে এসে বাংলাতে
সামগ্রিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী ছিল বাঙালি মুসলমান। রোয়েদাদে বাংলার
প্রাদেশিক আইন সভাতে হিন্দুদেরকে সংখ্যানুপাতে ন্যায্য প্রাপ্য থেকে কিছু কম আসন
দেওয়া হয়। কম আসন মুসলমানকেও দেওয়া হয়। কিন্তু আনুপাতিক হারে সেটি ছিল হিন্দুর
থেকে বেশি।
মুসলমানেরা সেরকম
‘রোয়েদাদে’র দাবিও করেন নি। এমন কি রোয়েদাদ নিয়ে অধিকাংশ মুসলমান শুরুতে কোনো
আগ্রহও দেখান নি।তাঁরা ভেবেছিলেন,জনসংখ্যার জোরে এমনিতেই তাদের প্রতিনিধিত্ব বেশি
হবে। কিন্তু তাতেই বর্ণহিন্দু ভদ্রলোকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। সেই সঙ্গে গান্ধি–আম্বেদকরের
মধ্যে হয় পুণা চুক্তি। যেখানে অবর্ণহিন্দুদেরও বেশ কিছু সুযোগ সুবিধে পাবার পথ
প্রশস্ত হয়। ফলে এতদিন যারা সামাজিক এবং
রাজনৈতিকভাবে আধিপত্য করে আসছিলেন তাঁরা সেই স্থিতি হারাবার ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে
পড়লেন। রোয়েদাদে অনুন্নত শ্রেণি সহ হিন্দুদের দেয়া হয় ৮০টি আসন,মোট আসনের শতকরা ৩২
ভাগ।অথচ আগেরবছরের আদমশুমারিতে বাংলাতে তাদের সংখ্যা ছিল জনসংখ্যার ৪৪ ভাগ।
অন্যদিকে মুসলমান ছিল জনসংখ্যার ৫৪ ভাগ।তাদেকেও দেয়া হয় শতকরা মাত্র ৪৭ ভাগ।এই
আশিটি আসনের মধ্যে ১০টি আসন আবার সংরক্ষিত হয় অনুন্নত শ্রেণির জন্যে। (জয়া:২৪-২৫) জয়া স্পষ্ট করেন নি হিন্দু জনসংখ্যাতে তাদের
ভাগিদারী কতটা ছিল।সাধারণ যুক্তি বলে যে ১০টির চাইতে বেশি,এমন কি হিন্দু জনসংখ্যার
আধার থেকেও বেশি হওয়া উচিত।অর্থাৎ হিন্দুদের মধ্যে বঞ্চিত হলে হয়েছেন এই
অনুন্নতরাই।ওদিকে জমিদার,বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদির নামেও কৌটা ছিলই।ভদ্রলোকেরা এই
ব্যবস্থাতে মুসলমানের বিরুদ্ধে চটে গেলেন। অথচ শতকরা একভাগেরও কম জনসংখ্যার ইউরোপীয়দের যে ২৫০টি আসনের
মধ্যে শতকরা ১০ ভাগ অর্থাৎ পঁচিশটি আসন দিয়ে দেয়া হল — সেই নিয়ে কিন্তু ‘স্বদেশী’,
‘জাতীয়তাবাদী’ ভদ্রলোকেরা নীরবে রইলেন।প্রতিটি সম্প্রদায়ের ভোটারেরা নিজেদের
প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। অর্থাৎ শুধু সংরক্ষণই নয় ‘পৃথক নির্বাচনে’রও ব্যবস্থা
হল।এটি একটি সর্বভারতীয় ব্যবস্থাপনা ছিল,কিন্তু বাংলাতে “ঐ রোয়েদাদকে ভদ্রলোকেরা
গণ্য করেন তাদের মর্যাদার ওপর সরাসরি আক্রমণ হিসেবে...” (জয়া:২৬) চিত্তরঞ্জন দাসের মৃত্যুর পরে বাংলা কংগ্রেস তাঁর দুই
অনুগামী যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত এবং সুভাষচন্দ্র বসু শিবিরের মধ্যে বিভাজিত হয়ে
পড়েছিল। কিন্তু রোয়েদাদ দুই পক্ষকেই একত্রে এনে ফেলে। দুই গোষ্ঠীর স্বতন্ত্র
মুখপত্র ছিল। যথাক্রমে ‘এডভ্যান্স’ এবং ‘লিবার্টি’।প্রথমটি লিখল ‘সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের কাছে লজ্জাহীন
আত্মসমর্পণ’, দ্বিতীয়টি লিখল ‘ভারতীয় জাতির প্রতি এই রোয়েদাদ একটি কলঙ্ক’। কিন্তু দুই পক্ষই
স্পষ্ট ‘হিন্দু’র পক্ষে দাঁড়াল। হিন্দু কখনো এর কাছে আত্মসমর্পণ করবে না,হিন্দুকে
দুর্বল করা হয়েছে,ইত্যাদি বলা হল। লক্ষ করবার জিনিস যে মুসলমান যখনই এভাবে নিজেদের
প্রতি অবিচার কিংবা বৈষম্যের কথা বলেছে---তাকেও সবসময়েই বিচার করা হয়েছে আর হয়ে
থাকে সাম্প্রদায়িক বলেই। এখানে উল্লেখ
করা মনে হয় অসমিচীন হবে না যে নাগরিক বিল, ২০১৬ নিয়ে অসমের হিন্দু মুসলমান বাঙালির
অবস্থানও অনেকটাই সেরকম। তখন, অমৃতবাজার,আনন্দবাজার পত্রিকাও দাঁড়াল হিন্দুদের
পাশে।এর আগে স্থানীয় বা জেলা বোর্ডে জনসংখ্যাতে কম হলেও ভদ্রলোকেরা বেশ আধিপত্য
করতেন। সেই আধিপত্যকে প্রাদেশিক শাসন কাঠামোকে বিস্তৃত করবার বাসনা বড়সড় আঘাত পায়
এই রোয়েদাদে। অর্থাৎ আক্রান্ত হয় তাদের শ্রেণি আধিপত্য। কিন্তু ক্ষোভের প্রকাশ ঘটে
জাতি তথা সম্প্রদায়ের নামে। এবং সংখ্যালঘু একটি জনগোষ্ঠীর ক্ষোভের মুখপাত্র হয়ে
উঠছে প্রধান সব দল, সংবাদ মাধ্যম---এমনটা আজকে আমরা কল্পনাও করতে পারি না। তখন এটা
সম্ভব হয়েছিল বর্ণহিন্দুর শ্রেণি আধিপত্যের জোরে।
শ্রেণি
প্রসঙ্গটি জড়িয়ে আছে বলেই শ্রেণিপ্রভু ব্রিটিশের বিরুদ্ধে কেউ টু শব্দটি করেন নি।
তাদের বিরুদ্ধে ‘ভাগ করে শাসন’ করবার অভিযোগ তখন তোলা যেতেই পারত,কারণ খিলাফত আন্দোলনের
ফলে যে মুসলমান ব্রিটিশের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন তাদের স্বপক্ষে টানবার ইচ্ছে
থেকেই ব্রিটিশ তা করেছিল। কিন্তু সেই
অভিযোগ তখন ভদ্রলোকেরা তুলেন নি। তার বিপরীতে কাগজগুলো নেমেছিল তখন সংখ্যাগুরু
কিন্তু শ্রেণি বিচারে দুর্বলতর মুসলমানের বিরুদ্ধে যথেচ্ছ প্রচারে। মুসলমানেরা
বিজয়োৎসব পালন টালন করে ইত্যাদি সংবাদ বেরিয়েছিল।যার কোনো সত্যতা ছিল না জয়া
দেখিয়েছেন। মুসলমান পক্ষে
সেরকম কোনো সংগ্রামও ছিল না। কিছু কিছু স্মারকপত্রে স্পষ্ট দাবি করা হলো,“বাঙলার
হিন্দুরা সাংস্কৃতিক দিক থেকে স্পষ্টভাবে শ্রেষ্ঠ—শিক্ষিত জনগণের মধ্যে তারা শতকরা
৬৪ ভাগ...” (জয়া:৩১) কোথাও আশঙ্কা ব্যক্ত করা হল রোয়েদাদ
“সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে বাঙলার অনুন্নত ও ঘৃণাযোগ্য মুসলমানদের
অধীনে স্থায়ীভাবে ভূমিদাসে পরিণত করবে।” (জয়া:৩১) অবশ্য এরই
মধ্যে আরেকটি স্মারক পত্র যাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, আচার্য
ব্রজেন্দ্রনাথ শীল প্রমুখ অনেকে সাক্ষর করেছিলেন তাতে স্পষ্টই লেখা হল হিন্দুরা
‘সংখ্যালঘু’ এবং সংগত দাবি উত্থাপিত হল “বাংলার সংখ্যালঘু হিন্দুরা স্বীকৃত
সংখ্যালঘুর অধিকার হিসেবে তাদের যথার্থ প্রতিনিধিত্ব দাবি করছে।”(জয়া:২৬) রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে টাউন হলে অনুষ্ঠিত একটি সভাতে
রাধাকুমদ মুখার্জির বক্তৃতার কিছুটা জয়া
উদ্ধার করে দিয়েছেন, যেখানে হিন্দু –মুসলমান দুই জাতির তত্ত্বর কথা বলা হয় এবং
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর তত্ত্ব তুলে ধরা হয়। যা কিনা মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাবে আরো বিকশিত রূপে আসবে আরো বেশ
কিছু বছর পরে। বস্তুত কেবিনেট মিশন বা শরৎ বসুর ‘যুক্তবাংলা’র কাঠামোও অনেকটাই
তাই। রবীন্দ্রনাথ এই আন্দোলনে ছিলেন।সুভাষ বসু এবং শরৎচন্দ্র বসুও ছিলেন।তার
বিপরীতে মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র এবং বিলম্বিত। খুব উচ্ছ্বসিত কেউই হোন
নি কারণ,প্রাপ্যের তুলনাতে তাদেরও কমই মিলেছে।কিন্তু কেউ কেউ
মন্দের ভালো বলে প্রশংসা করেছেন।ফজলুল হক প্রথমে এর বিরোধিতাই করেন,পরে মত
পাল্টান। বোঝা যাচ্ছে তার উপরে দু’দিক থেকে চাপ ছিল।মুসলমানেরা যে এই রোয়েদাদ
সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না তার পক্ষে জয়া পৌরসভা সম্পর্কে বি পি সিংহ রায়ের
এক বিলের উল্লেখ করেন,যেখানে যৌথ নির্বাচনের কথা ছিল এবং ফজলুল হক সহ বেশ কিছু
মুসলমান একে সমর্থন জানান। মুসলমানেরা ভাবছিলেন যৌথ নির্বাচনের মাধ্যমেও তারা
পরিশেষে প্রাদেশিক ক্ষমতা দখল করার জন্যে নিজেদের সংখ্যাধিক্যকেও কাজে লাগাতে
পারবেন। তার বিপরীতে তারা দাবি উত্থাপন করেন সার্বজনীন ভোটাধিকারের।তখন অব্দি
বিশেষ শিক্ষা,সম্পদ এবং অধিকারের ভিত্তিতেই ভোটাধিকার সাব্যস্ত হত। (জয়া:৩৫)কিন্তু বছর ফিরতে না ফিরতে হিন্দু পক্ষ থেকে ক্রমাগত
প্রচার এবং হুমকির বিপরীতে মুসলমানও সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে পড়েন।
ভদ্রলোক মানে যে
মূলত বর্ণহিন্দু বাঙালি সেই কথাটি আরো একটি ঘটনাতে স্পষ্ট হয়। সেটি হচ্ছে গান্ধি
এবং আম্বেদকরের মধ্যে পুণা চুক্তি। রোয়েদাদের সম্পর্কিত এবং পাশাপাশি ঘটনাটি
ঘটেছিল।এবং একই অধ্যায়ে বিষয়টির উপস্থাপন করেও জয়া বিশ্বাসযোগ্য ভাবে ছবিটি
উপস্থাপনও করেছেন।আম্বেদকর তথা অবর্ণহিন্দু নেতৃত্ব নিজেদের অবস্থান থেকে কিছু
সরেই আসেন পুণা চুক্তিতে।তখন অব্দি বর্ণহিন্দু নিজেরা অবর্ণহিন্দুদের এবং
অবর্ণহিন্দুরাও নিজেদের বিনা প্রশ্নে হিন্দু বলে মনে করতেন না।সংখ্যালঘুদের মতো
অবর্ণহিন্দুদের জন্যে খানিক বেশিই সুরক্ষা দাবি করছিলেন আম্বেদকর।কিন্তু গান্ধি এবং
তাঁর সমর্থকেরা অবর্ণহিন্দুদের সঙ্গে সংঘাতটিকে
বিশেষ করে অস্পৃশ্যতার প্রশ্নকে
হিন্দুদের ভেতরকার অরাজনৈতিক ধর্মীয় বিষয় বলে মনে করতেন। সুতরাং
অবর্ণহিন্দুদের থেকে আলাদা করে তাদের জন্যে স্বতন্ত্র সংরক্ষণের বিরোধিতা করেই ছিল
গান্ধির অনশন। পুণা চুক্তিতে সংরক্ষণকে মেনে নিতে হল, কিন্তু প্রার্থী তপশিলি বা
সাধারণ হোন ভোট পাবেন সব হিন্দুর। এভাবে বৃহত্তর হিন্দু ঐক্যের একটি পথ উন্মুক্ত
করে ফেলা হল,অন্যথা বর্ণহিন্দুরা সারা দেশেই সংখ্যালঘু হয়ে পড়বার সমস্যাতে
পড়েছিলেন।
বিভিন্ন প্রদেশে
হিন্দুদের মধ্যে আসন ভাগাভাগির ব্যবস্থাটি ভিন্ন হয়। বাংলাতে ৮০টি হিন্দু আসনের
৩০টি তপশিলিদের দেবার সিদ্ধান্ত হয়। অথচ সেখানে বাঙালি বর্ণহিন্দুর কেউ উপস্থিত
ছিলেন না। তাঁরা একে ‘বাঙালিদের ওপর অন্যায় ও অস্বাভাবিক অবিচার’ কিংবা
‘প্রধানমন্ত্রীর রোয়েদাদ অপেক্ষা অনেক বেশি খারাপ’ বলে অভিহিত করেন। (জয়া:৩৮) বাঙালিরা হিন্দুদের মধ্যে বর্ণভেদ প্রায় স্বীকারই করতেন
না। ফলে একদিকে ‘হিন্দু’ পরিচিতির মধ্যে
দুই বর্ণকে এক করবার পথ উন্মুক্ত করলেও,“শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে ঐক্যবদ্ধ এক
হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের দাবিদার ভদ্রলোকদের দাবি যে কতটা শূন্যগর্ভ”
(জয়া:৩৮) তা এই চুক্তি স্পষ্ট করে
দিয়েছিল। ১৯৩১এর আদমশুমারিতে স্বীকার করে
নেয়া হয়েছিল বটে বাংলাতে অস্পৃশ্যতার
সমস্যা অন্যপ্রদেশের মত উগ্র নয়,---কিন্তু ততটুকুই। ৬০ লাখের বেশি লোককে বাংলাতেও
অস্পৃশ্য বলে চিহ্নিত করেছিল আদমশুমারির প্রতিবেদন। জয়া বেশ কিছু জনজাতি এবং সম্প্রদায়ের
বিবরণ দিয়েছেন। ১৯৩৪শে প্রকাশিত মডার্ন রিভিউ থেকে একটি সারণির উল্লেখ করেও জয়া
দেখিয়েছেন বাংলাতে বর্ণ এবং শ্রেণি প্রায় একই। (জয়া:৩৯) অনুবাদক যদিও
বর্ণ বা নৃগোষ্ঠীকে ‘শ্রেণি’ এবং ‘শ্রেণি’কে ‘অর্থনৈতিক পার্থক্য’ বলে অনুবাদ
করেছেন। বাংলাতে প্রচলিত ‘ছোটলোক’ শব্দটি ব্যবহার করে তিনি লিখেছেন “...এরা
ভদ্রলোকদের জমিতে ও বাসাবাড়িতে কাজ করে,কিন্তু তারা বাস করে ভদ্রসমাজের গণ্ডির
বাইরে। বাঙলার ইতিহাসে এই প্রথমবারের মত রোয়েদাদে ও পুনা চুক্তিতে আভাস দেওয়া হয়
যে,এতদিন ধরে ভদ্রলোক গ্রুপ দ্বারা প্রভাবিত সাংগঠনিক রাজনীতির আবদ্ধ গণ্ডিকে
ছোটলোকদের অন্তর্ভুক্তির জন্য উন্মুক্ত করা যেতে পারে।” (জয়া:৩৯)
এই
দুই প্রশ্নেই কংগ্রেস হাইকমাণ্ডের সঙ্গে বাংলা কংগ্রেসের বিরোধ তীব্র হয়ে পড়ে।
কেন্দ্রীয় কংগ্রেসে মদন মোহন মালব্যের মত অনেকেই রোয়েদাদের বিরোধী ছিলেন।বাংলা
কংগ্রেসকে তখন পরিচালিত করতেন ‘ক্ষমতাধর পাঁচ’ (big five)ব্যক্তি। এরা যে একই
গোষ্ঠীর ছিলেন তা নয়। এরা লাগাতার পরস্পরের সহযোগী বা প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না।
রোয়েদাদ সব গোষ্ঠীকে এক করলেও সবাই হাইকমাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যেতে চাইলেন না। ইতিহাসের রসিকতা
হল-- পরে যারা হিন্দু মহাসভার বিরোধী অবস্থান নেবেন সেই বসু ভাইরা ১৯৩৪এ কলকাতাতে
যখন মদন মোহন মালব্য ন্যাশনালিস্ট পার্টি গঠন করেন তখন তাতে যোগ দেন।দলটির প্রধান
লক্ষ্যই ছিল রোয়েদাদ বিরোধী সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। শুধু হাইকমাণ্ডের বিরুদ্ধে
যাবেন না বলে ‘বিগ ফাইভে’র বাকি তিনজন বিধান চন্দ্র রায়, কিরণ শঙ্কর রায় এবং নলিনী
রঞ্জন সরকার বসু ভাইদের সঙ্গে তখন সম্পর্কচ্ছেদ করেন। জয়া লিখেছেন, “ঐ ‘পাঁচ জন’
ছিলেন ধনাঢ্য, সবার সাথে তাঁদের যোগাযোগ ছিল সুদৃঢ় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে
তাঁদের ছিল প্রবল ক্ষমতা।” (জয়া:৪৭) শেষ অব্দি বসুভাইদের নেতৃত্বাধীন বাংলা কংগ্রেস
পরাস্তই হয়। হাইকমান্ড আপসের চেষ্টা করলেও শেষে বেশ কড়াকড়ি অবস্থানই নেয়।এই সময়ে
শরৎ চন্দ্র বসু যুগান্তর গোষ্ঠীরও কাছাকাছি চলে আসেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রলুণ্ঠন
মামলাতে তিনি বন্দিদের অবস্থানের সমর্থন করেন। ৮ নভেম্বর ১৯৩৪এ বাংলা কংগ্রেস ঘোষণা করে
রোয়েদাদের প্রতিটি বক্তব্যই তারা গ্রহণ করে। পুনা চুক্তির প্রশ্নে তাদের অবস্থানের
কী হল সেটি কিন্তু জয়া স্পষ্ট করেন নি।তবে এক জায়গাতে লিখেছেন, “কেন্দ্রের ঘটনাপ্রবাহের ওপর
প্রভাব বিস্তার করতে ব্যর্থ হয়ে ভদ্রলোকদের রাজনীতি ক্রমাগতভাবে অন্তর্মুখী হয়ে
যায় এবং বাঙলায় তাদের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে হুমকি প্রতিরোধে তারা উদ্বিগ্ন হয়।”(জয়া:৫২) ঘটনাক্রমগুলোকে তিনি বহু প্রামাণ্য তথ্যে ব্যাখ্যা
বিচার করেছেন।
বাংলার রাজনীতিতে গ্রামীণ বিপরীত
পক্ষ
[ লেখাটি ইতিমধ্যে নয়া ঠাহর ওয়েবজিনেও প্রকাশিত। ] |
এরকম
একটি পরিস্থিতিতেই মৌলানা আকরম খাঁ,আবুল কাশেম ফজলুল হকের মতো নেতৃত্বের উঠে আসার
ইতিবৃত্ত ব্যাখ্যা করেন জয়া চ্যাটার্জি।ফজলুল হকের রাজনৈতিক মতাদর্শকে তিনি
ব্যাখ্যা করেন এভাবে---তাঁর মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ,বাঙালি স্বদেশপ্রেম ও
মুসলমান জনপ্রিয়তাবাদের ‘অপূর্ব সমন্বয়’ ঘটে। (জয়া:৮০) সামাজিক
স্তরভেদে ফজলুল হকের স্থিতি
সম্পর্কে জয়া লিখেছেন “এসব লোকেদের মধ্যে সাধারণভাবে পরিচিত ‘আশরাফ’ শ্রেণীর
মুসলমান নেতা ছিলেন না।...তাঁর পরিবার ‘আশরাফ’ বা উচ্চমর্যাদাপূর্ণ বলে দাবি করলেও
আসলে তাঁরা ছিলেন সাধারণ তালুকদার, অধিকন্তু তাঁরা ছিলেন বাঙলাভাষী।” (জয়া:৮০) সাধারণত দাবি করা হয়ে থাকে যে মুসলমানেরা ইংরেজি
শিক্ষাকে বর্জন করেছিলেন বলেই আর্থ-সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়েছিলেন। সম্প্রতি বেশ
কিছু অধ্যয়ন বাংলার ক্ষেত্রে এই তথ্যকে খণ্ডন করেছে।বিশ শতকের শুরুতে জমিদার
শ্রেণিটির পতন্মুখ অবস্থা এবং মুসলমান রায়তদের অবস্থার উন্নতিতে তারা নির্বিরোধ
স্কুলে যেতে শুরু করে।এমন কি তার জন্যে
ব্যক্তিগত স্তরে তাদের যে বেশ কঠোর শ্রম এবং
সংগ্রাম করে এগুতে হত। শহরে গিয়ে অধিকাংশই হোস্টেলে থাকবার অর্থ জোটাতে
পারতেন না,পরের বাড়িতে ‘জায়গির’ থাকতেন। কৃষক পরিবার থেকে যাবার জন্যেই “ ...তাদের
মধ্যে গ্রামীণ সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বর্তমান থাকে---তারা অমার্জিত ভাষায় কথা বলে,
গ্রামের লোকদের মতো পোশাক পরে ও খাদ্য খায়।” (জয়া:৮১)কিন্তু,“স্কুলগামী
মুসলমান ছাত্র সংখ্যার তুলনায় মাদ্রাসাগামী ছাত্রে সংখ্যা ছিল খুবই কম।” (জয়া:৮২) ১৯৩৫এর ভারত শাসন আইনের পরে এদের পক্ষে সহজ হয় গ্রামীণ
জনতার মধ্যে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে। যদিও এর আগেই প্রজা পার্টি এবং পরে নিখিল
বঙ্গ প্রজা সমিতি গঠন করেন ফজলুল হকেরা। অর্থনৈতিক মন্দার সময় পূর্ব বাংলায় প্রচুর
‘কৃষক সমিতি’ গড়ে উঠেছিল, যার প্রায় সবার সাথে এই নতুন দল সংযোগ গড়ে তুলতে শুরু
করে। (জয়া:৮৩)
সংস্কার আইনের পরে অচিরেই এই দল বাংলার মুসলমানের সাধারণ সংগঠনে পরিণত হয়।এক সময় আকরম
খাঁ এবং ফজলুল হকের নেতৃত্বে সংগঠন দু’ভাগ হয়।ফজলুল হক শিবির কৃষক প্রজা পার্টির
নামে নিজের শিবিরকে বের করে আনেন।মূল সংগঠন কয়েক মাস পরে মুসলিম লীগে বিলীন হয়ে
যায়। কিন্তু গণভিত্তি প্রবল প্রজা পার্টিরই ছিল।
প্রজা
পার্টির ঘোষিত নীতি ছিল জমিদারি প্রথা
বিলোপ করা। খাজনা মাফ এবং ঋণ মকুবের কর্মসূচী গ্রহণ করাতে বহু গরীব মানুষকে আকৃষ্ট
করলেও,জমিদারি বিলোপ ধনী কৃষকের আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন,কেননা জমির মালিকানা কিছু
মূলত তারাই পেয়েছিল। জমিদার এবং দাদন ব্যবসায়ীকে বাদ দিয়ে এরা প্রায় সব মুসলমানকে
সংগঠিত করবার কৌশল নিয়েছিল। ছোট জমির মালিক বা কৃষি শ্রমিকদের সমস্যা সেভাবে
গুরুত্ব পেত না।এই নিয়েই এরা সারা বাংলাতে প্রভাব বিস্তার করে। ১৯৩৬এ সারা
বাংলাদেশে স্থানীয় বোর্ডের অর্ধেকের বেশি আসন চলে যায় মুসলমানদের দখলে, শ্রেণির
বিচারে যায় আসলে জোতদারদের দখলে।এই প্রথম প্রাদেশিক রাজনীতিতে এরা প্রাধান্যে চলে
আসেন। পরবর্তী দিনগুলোতে
এই জমিদার জোতদার সংঘাতই হিন্দু-মুসলমান সংঘাতের চেহারা নেয়। যা দেশভাগ অব্দি
এগোয়। কিন্তু এর শ্রেণি চেহারা ঢাকা পড়ে যাবে,যদি মুসলমান জমিদারদের ভূমিকাগুলোকে
আলাদা করে না বোঝা যায়। জয়া সেদিকটিকেও সূক্ষ্মভাবে দেখবার চেষ্টা করেছেন।জমিদারি
বিলোপ ইত্যাদির দাবি জানালেও প্রজা পার্টি লীগ-নেতৃত্বকেই আক্রমণের লক্ষ্য হিসেবে
বেছে নিত।১৯৩৬এর আগষ্টে ত্রিপুরার কুমিল্লাতে এক মুসলমান সমাবেশে ফজলুল হক
সাধারণভাবে জমিদারদের বিরুদ্ধে বললেও নির্দিষ্টভাবে স্যার নাজিমুদ্দিন এবং স্যার
কে জি এম ফারুকীর বিরুদ্ধে আক্রমণে শান দেন। (জয়া:৮৩)
কেবলমাত্র
মুসলমানদের সংগঠিত করবার প্রয়াস চালান শ্রেণিগতভাবেই যারা জমিদার,এবং মুসলমানের
মধ্য ‘আশরাফ’,এবং অধিকাংশই বাঙালিও নন।ঢাকার নবাব হাবিবুল্লাহ, জলপাই গুড়ির নবাব
মোশারফ হোসেন, কলকাতার ব্যবসায়ী হাসান ইস্পাহানি,হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীরা ১৯৩৬এ
একটি নতুন দল গঠন করেন ‘ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি’ নামে। (জয়া:৮৮) অন্যদের বেলা যেমন,এদেরও
পরিবার,আয়ের উৎস,শিক্ষা ইত্যাদির বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন লেখিকা। শোহরাওয়ার্দির কম্যুনিস্ট
শ্রমিক সংগঠনের বিরোধিতায় শ্রমিক সংগঠন করবার তথ্য,উল্লেখ করেছেন অপরাধ জগতের
সঙ্গে তাঁর সংস্রবের কথা। লিখেছেন,“ধানের ক্ষেতে জুতা পরে কাদা মাড়াবার প্রবৃত্তি
বা ইচ্ছা এসব আশরাফ ভদ্রলোকের কারও ছিল না।” (জয়া:৯০) সে জন্যে
তাঁরা আকরম খাঁর এবং তাঁর দলের আতরাফ নেতাদের নতুন দলে যোগদান নিশ্চিত করান। এরা
ফজলুল হককেও টানবার চেষ্টা করেছিলেন,কিন্তু তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান
করেন।ঢাকার নবাবদের তো তিনি ‘ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত বাঙলার
আত্মস্বীকৃত নেতা’ বলে অবজ্ঞা করেছেন। ( জয়া:৯১) ইস্পাহানি একই
বছরে জিন্নাকে বাংলায় নিয়ে এলেন। মুসলিম লীগের ভেতরে নতুন দলের বিলয় ঘটালেন। ফজলুল হককে দলে টানবার চেষ্টা করে জিন্নাও ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেলেন।
স্বতন্ত্র নির্বাচনের একটি ভাল ফলের কথা জয়া উল্লেখ করেছেন,যা কিনা
সাম্প্রদায়িক ভাবনাকে প্রতিহত করতে কাজে আসতে পারত। মুসলিম আসনগুলোতে লীগ এবং
প্রজা পার্টি পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করল। লীগ সাম্প্রদায়িক কথা বার্তা বললেও
প্রজাপার্টি সেসবের বাইরে রইল। তারা মূলত জোর দিল কৃষি সংক্রান্ত বিষয়ে। সোহরাওয়ার্দি এবং অন্যান্য লীগ নেতারা জীবন যাপনে অনেক বেশি আধুনিক এবং বিদেশে
শিক্ষা সাঙ্গ করে ফেরা লোকজন ছিলেন।তারা সত্যিকার প্রজাদের প্রতিনিধিত্ব করা প্রজা
পার্টিকে আটকাতে সবচাইতে সহজ সাম্প্রদায়িকতার পথ নেন।কিন্তু বাস্তবের লড়াই “মুসলমান ও হিন্দুদের সরাসরি লড়াইয়ে যতটা নয়, মুসলমান
‘সম্প্রদায়ে’র নিজেদের মধ্যে এই লড়াই প্রায় গৃহযুদ্ধের রূপ লাভ করে” (জয়া:৯৩) অন্যভাষাতে
বলা চলে মুসলমানদের আভ্যন্তরীণ শ্রেণিবিরোধ এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছিল,যখন কিনা
কংগ্রেসের সঙ্গে সংগ্রামও ছিল অনেকটাই সেই শ্রেণিবিরোধেরই পরিণাম। পটুয়াখালিতে
(উত্তর) খাজা নাজিমুদ্দিনের বিরুদ্ধে নির্বাচনী যুদ্ধকে ফজলুল হক স্পষ্টই বলেন,“জমিদার ও কৃষকদের
মধ্যকার সর্বাত্মক সংগ্রাম।” (জয়া:৯৪) সেই সংগ্রামে নাজিমুদ্দিনের
শোচনীয় পরাজয় হয়েছিল। অথচ এক দশক আগে এই এলাকাতে ভয়ানক সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা হয়ে
গিয়েছিল। গ্রামাঞ্চলে সেই নির্বাচনে প্রজা পার্টি ভাল ফল করে,লীগ
করে নগরাঞ্চলে।শতকরা হিসেবে বেশি ভোট পেয়েও প্রজা পার্টি লীগের চেয়ে তিনটি আসন কম
পায়। আরো কিছু ছোট ছোট গোষ্ঠীও কৃষকদের বিষয়কে সামনে এনে নির্বাচনে বিজয়ী
হয়।“তুলনামূলকভাবে পরস্পর পার্থক্যহীন বাঙলার কৃষক সম্প্রদায়ের ঐক্যের অনুভূতি
কোনভাবেই যেমন নিছক ধর্মভিত্তিক ছিল না, তেমনি তাকে সব সময় স্বতঃস্ফূর্ত সাম্প্রদায়িক
ও বিচ্ছিন্নতার রাজনীতি বলে ধরে নেওয়া যায় না।” (জয়া:৯৪)যারা এখনো
সম্প্রদায় ভিত্তিতে সংরক্ষণ এবং পৃথক নির্বাচনী মণ্ডলী সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধি করবে
বলে নিদান দিয়ে থাকেন,তাঁরা সত্য বলেন না---এই ইতিহাস তারই নজির। যদিও আমাদের মনে
হয়েছে,তপশিলিদের সম্পর্কে প্রজাপার্টি বা এরকম দলগুলোর ঔদাসীন্য পরে মারাত্মক
স্থিতি নেয়। তার পূর্ণ সুযোগ হিন্দু মহাসভা গ্রহণ করে। তবু মনে রাখতে হবে
জমিদারদের অধিকাংশই যেখানে বর্ণহিন্দু, প্রজা পার্টি প্রত্যক্ষ আক্রমণের লক্ষ্য
করেছিল মুসলমান জমিদারদেরকেই।
অন্যদিকে ভদ্রলোকদের রায়তদের অধিকাংশই মুসলমান। মুসলিম লীগের মতো সমস্যাতে
কংগ্রেসও পড়েছিল। হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণি পুরোটাই
পড়েছিল।তারা বিশ্বাস করত জমিদারি অক্ষুণ্ণ রেখেই রায়তদের স্বার্থ রক্ষা সম্ভব।এমন
কি চিত্তরঞ্জন দাসের অনুগামীরাও সেরকমই বিশ্বাস করতেন। ফলে ১৯২৮এর টিন্যান্সি
এমেন্ডমেন্ট বিলের বিরোধিতা প্রায় সবাই করেন। আবার ১৯৩০এ যখন এক বিলে বলা হল
গ্রামের প্রাথমিক শিক্ষার ব্যয়ভার জমিদারি
এস্টেটের উপরে ন্যস্ত করা হবে---তারও এরা ঘোরতর বিরোধিতা করেন। ‘খাজনা না দেওয়ার
খারাপ মানসিকতা’র বিরুদ্ধে বাস্তবে এরা অনেকে বরকন্দাজ নিয়োগ করেও চাপ
দিচ্ছিলেন।প্রজারা প্রতিরোধ করলেই একে এরা সাম্প্রদায়িকতা না হলেও ডাকাতি বলে
চিহ্নিত করছিলেন। মুসলমান প্রজাদের সঙ্গে হিন্দু ভৃত্য বা প্রজা যোগ দিলেও সেসব
‘সাম্প্রদায়িক’ – তার মানে মুসলমানের ষড়যন্ত্র বলে বিবেচিত হত। “এরকম পরিস্থিতিতে”,জয়া লিখেছেন,“বেঙ্গল কংগ্রেস
নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করলে বিস্মিত হবার কিছু ছিল না” (জয়া:১০২) কিন্তু হাইকমাণ্ডের নির্দেশে
ঝাঁপিয়ে পড়তেই হয়।এই পরিস্থিতিতে আসরে প্রবেশ করে বামপন্থীরা,বিশেষ করে স্বদেশীদের
মধ্যে মার্ক্সবাদে দীক্ষিতরা। সিপি আই ১৯৩৫এ কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্তমোর্চা গঠন করে।
এবং কম্যুনিস্টরা কংগ্রেসের ভেতরে ঢোকে কৃষকদের সংগঠিত করতে শুরু করে।কংগ্রেসের
হয়ে কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলতে আগ্রহীদের মধ্যেও দেখা গেছে মুসলমানের সংখ্যা অনেক।
বিশেষ করে তিপেরায় কংগ্রেস তুলনাতে বেশিই কৃষক কর্মসূচী হাতে নেয়। যদিও সর্বত্রই
জমিদার সদস্যরা ছিলেন নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষাতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।ফলে কংগ্রেসীরা
কোথাও জমিদার কোথাও কৃষক স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছিলেন।জয়া লিখেছেন,‘টিপেরার অভিজ্ঞতায়
দেখা যায় যে,বেঙ্গল কংগ্রেসের জন্য কৃষক সম্পর্কিত বিষয়টি ছিল একটি ‘শাঁখের করাত’।” (জয়া:১০৬) নিজে টাকা যোগাতে না পারলে কংগ্রেস
কাউকে প্রার্থী করত না বিশেষ। ফলে সাধারণ আসনে সেরকম কোনো কৃষক নেতাকে তারা
নির্বাচনে প্রার্থী করে নি। নির্বাচনে গ্রামাঞ্চলে ৬৬টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস জয়ী
হয় মাত্র ৩৫টিতে। তারও ২৮টি ছিল বর্ণহিন্দু এলাকার। এই ফলাফল কংগ্রেসকে স্পষ্ট
ডান-বাম দুই শিবিরে বিভাজিত করে।
শ্রেণি-বর্ণ-সম্প্রদায়
ঘিরে বাংলা কংগ্রেসের দুর্বিপাক
১৯৩৬এর নির্বাচনে কংগ্রেস এবং প্রজা
পার্টির মধ্যে একটি অঘোষিত সমঝোতা ছিল। কংগ্রেস কোনো মুসলমান আসনে
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করল না,বিপরীতে প্রজা পার্টিও কোনো হিন্দু বা তপশিলি আসনে
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করল না।অথচ,দুই দলেই অন্য সম্প্রদায়ের মানুষজন ছিলেন।কিন্তু
নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে যখন সরকার গড়তে এরা সমঝোতা করতে ব্যর্থ হলেন এবং ফজলুল হক
বাধ্য হলেন প্রতিদ্বন্দ্বী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করতে -- তাতে আম জনতার
কাছে এরা হিন্দু মুসলমানের দুই ভিন্ন দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সহজ হল---এমনটা
ভাববার যথেষ্ট সংগত কারণ আছে। শরৎ বসুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস চাইছিল রাজবন্দীদের
মুক্তির বিষয়টি সরকারে অগ্রাধিকার পাক,প্রজা পার্টি চাইছিল কৃষকদের বিষয়। ফজলুক হক
বহু চেষ্টা করেও কংগ্রেসকে পাশে পেতে ব্যর্থ হন।নতুন সরকারে অধিকাংশই মুসলমান
সদস্য ছিলেন বটে,সেই সঙ্গে এদের অধিকাংশই ছিলেন অনাগরিক কৃষক জোতদার শ্রেণিটির
থেকেও উঠে আসা। তাঁদের প্রথম বড় প্রয়াস ছিল বেঙ্গল প্রজাস্বত্ব (সংশোধিত) বিল।
বিলে জমিদারদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে প্রজাদের জমি স্বাধীনভাবে ভাগ করা ও
হস্তান্তরের অধিকার দেওয়া হয়। “ফলে পল্লি এলাকায় জমিদারেরা এই বিলকে সাম্প্রদায়িক
ব্যবস্থা,বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ‘সম্পূর্ণ বিপ্লবাত্মক’ আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান
করে।তারা ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করে যে,এই বিল দেশে ‘বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি করে বিপর্যয়’
ডেকে আনবে।”(জয়া:১২৫)এক দশক পরে দেশভাগের মধ্য দিয়ে তাদের
সেই ভবিষ্যৎবাণী সত্যও প্রমাণিত হল বটে। ‘সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতা’কে সুচতুরভাবে
শ্রেণি স্বার্থে ব্যবহার করবার এই ভদ্রলোক কৌশলটি এখনো ‘ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরে’ কম
আলোচিত হয়।
সরকার ১৯৩৫এর
বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল ডেটরস এক্ট এর বাস্তবায়ন শুরু করে। ১৯৪০এ বেঙ্গল মানি
লেণ্ডারস এক্ট নিয়ে আসে। সবগুলোই ভদ্রলোক জমিদার,বানিয়া,সুদখোর মহাজন স্বার্থের
বিরুদ্ধে যায়।লীগের জমিদারেরাও শেষ আইনটি আটকাবার চেষ্টা করেছিলেন।কিন্তু ব্যর্থ
হন।পরে জমিদারদের বিভিন্ন পদে বসিয়ে ক্ষতিপূরণ করবার সর্তে সমর্থন দিতে বাধ্য
হন।স্বাভাবিক ভাবেই সরকারি ক্ষমতার বাইরের হিন্দু জমিদারেরা সেই সুবিধের থেকেও
বঞ্চিত হন।এছাড়াও পুলিশে কনেস্টবল চাকরিতে পঞ্চাশ শতাংশ মুসলমান নিয়োগ,সরকারি
চাকরিতে ষাট শতাংশ মুসলমানদের জন্যে সংরক্ষণ এমন অনেক ব্যবস্থা নেয় যা এতোদিনকার
বর্ণহিন্দু আধিপত্যকে প্রত্যাহ্বান জানায়। অথচ জনসংখ্যার বিচারে এর কোনোটাই
হিন্দুদের বঞ্চিত করে করা হয়েছে এমনটা নয়।সবচাইতে বড় আঘাত জয়া লিখেছেন,উচ্চশিক্ষার
নিয়ন্ত্রণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বদলে সেকেন্ডারি এডুকেশন বোর্ডের হাতে অর্পিত
হয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় হারানো মানে ভদ্রলোকদের ‘সাংস্কৃতিক প্রাধান্য’ হারিয়ে বসা,
“...যে ‘সাংস্কৃতিক প্রাধান্যটি’ ছিল ভদ্রলোক সাম্প্রদায়িক আলোচনার (discourse) মূল অবলম্বন।”
(জয়া:১২৫)
এই পরিস্থিতিতে
শরৎ বসু আবার চিত্তরঞ্জনের পথে ফেরার কথা ভাবতে শুরু করেন।নির্বাচনে মুসলমান
প্রার্থী না দেবার ভুল অনুভব করেন। এবং বাম-সমাজবাদী কংগ্রেসীদের সংঘবদ্ধ করবার
কথা ভাবতে থাকেন। কিন্তু রক্ষণশীল প্রতিপক্ষ ছিল দলের ভেতরে সংখ্যাতে অনেক বেশি।
তাঁর নেতৃত্বে জনসংযোগ আন্দোলন শুরু হয়। তাতেও জমিদারদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘাত
এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছিল।এবং মুসলমান
প্রশ্নে খুবই সস্তা কিছু পথ নেয়া হচ্ছিল। এমন প্রচারপত্রও বিলি করা হয় যেখানে লেখা
হয় ‘মুসলমানের হাত থেকে ইসলামের পতাকা ছিনিয়ে নিয়েছে’ (জয়া:১২৯) ব্রিটিশ শাসন। পীর উলেমাদের ধরা হয় যাতে কংগ্রেসের
দিকে লোক টানা সহজ হয়। কিন্তু তাতেই রক্ষণশীলেরা রুষ্ট হচ্ছিলেন,আর তাদের চিহ্নিত
করছিলেন বামপন্থী বলে। অন্যদিকে বামেদের দিক থেকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাতিল,খাজনা
বন্ধের দাবিও উঠতে শুরু করে। ১৯৩৯এ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাতিলের দাবি প্রাদেশিক
কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের অংশ হয়ে পড়ে। অন্যদিকে মুসলমান নেতৃত্বের ভেতরেও এই নিয়ে সন্দেহ সংশয় এবং
বিরোধের পরিবেশ বাড়ে। কিন্তু মুসলমানের কংগ্রেসে যোগদান সব কংগ্রেসি ভদ্রলোকেরা ভালোভাবে
নেন নি মূলত শ্রেণি স্বার্থেই। নোয়াখালির গোলাম সরোয়ার হোসেন প্রজা পার্টিতেও ছিলেন
না।কংগ্রেসে আসতে চাইলে কংগ্রেসও নেয় নি।উলটে জমিদারদের হাট বয়কটের ডাক দিলে কংগ্রেসিরাই
পুলিশে খবর দেয়।তিনি ক্রমে হিন্দু বিরোধী হয়ে উঠেন এবং মুসলিম লীগে জড়িয়ে
পড়েন।(জয়া:১৩২) ১৯৩৮এ সুভাষ বসু কংগ্রেসের
সর্বভারতীয় সভাপতি। তাঁরও একটি সভাতে মুসলমান লোকেরা ইটপাটকেল ছোঁড়েন।তবু তাঁর এবং
দাদা শরৎ বসুর প্রয়াস অব্যাহত থাকে।কিন্তু বিধান রায় প্রমুখদের বিরোধিতাও অব্যাহত থাকে।এক সময়
প্রদেশ কংগ্রেসের নীতিকে এরা ‘মুসলমানের দালালি’ বলেও অভিহিত করেন।অন্যদিকে একই
সময় এদের দলের ভেতরে কম্যুনিস্ট ঠেকানোও কাজ হয়েছিল। এবং এরা ক্রমেই তলায় তলায় শক্তি
অর্জন করছিলেন। ফলে মুসলমান এবং কম্যুনিস্ট উভয়পক্ষেই হতাশা বাড়তে থাকে।জনসংযোগ
আন্দোলন ‘জোড়াতালি দেয়া বিচ্ছিন্ন কিছু স্থানীয় উদ্যোগ’-এর বেশি কিছু রইল না।(জয়া:১৩৬) বেঙ্গল প্রজাস্বত্ব বিল নিয়ে শরৎ বসুর দোদুল্যমান
স্থিতিও তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা খর্ব করে। তবে এক অসাম্প্রদায়িক নেতা হিসেবে শরৎ বসুর
সুনাম অক্ষুণ্ণ থাকে।
কিন্তু ইতিমধ্যে
কেন্দ্রীয় কংগ্রেসেও সুভাষ বসুর সঙ্গে গান্ধি-প্যাটেল-রাজেন্দ্রপ্রসাদদের বিরোধ
বাঁধে এবং ১৯৩৯এ ত্রিপুরি অধিবেশনে তিনি সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন। কিছু
দিন পরেই দুই ভাইই কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হন।এই ঘটনা বাঙালিদের মধ্যে বহু জানা। কিন্তু সেই জানাতে
গণ্ডগোল আছে। প্রচার এমনতর করা হয় যেন,সব বিরোধ ছিল গান্ধির সঙ্গে ব্যক্তিগত।আর
বাংলা কংগ্রেসের সবাই তাঁদের সঙ্গে ছিলেন।ঘটনা এমনতর মোটেও নয়। হাইকমান্ডেও
বাম-দক্ষিণ পন্থার বিরোধের শিকার হয়েছিলেন সুভাষ বসু।নতুন সভাপতি হয়েছিলেন রাজেন্দ্র প্রসাদ—যনি পরে ভারতের
প্রথম রাষ্ট্রপতি হবেন।তাঁর কথাটি বেশি আলোচনাতে আসে না। নেতাজি সুভাষের একটি
‘হিন্দুত্ববাদী’ চেহারা গড়বার স্বার্থেই আসে না। বাংলা কংগ্রেসে বসুভাইদের এবং
তাদের অনুগামীদের বহিষ্কারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন বল্লভ ভাই প্যাটেল।এর পরে
থেকে বাংলা কংগ্রেস পুরোটাই হিন্দু সাম্প্রদায়িক ভদ্রলোকদের দখলে চলে যায়।১৯৪১এ
শরৎ বসু একবার নিজের ফরোয়ার্ড ব্লক এবং শ্যামাপ্রসাদের হিন্দু মহাসভা এবং
অন্যান্যদের সঙ্গে নিয়ে তিনি সরকার গড়বার দোরগড়াতে গিয়ে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু শপথ
গ্রহণের আগেই গ্রেপ্তার হলে তা আর হওয়া হয় নি।
সাম্প্রদায়িক
ভদ্রলোকেরা শরৎ বসুকে তবু কিছু সহ্য করে নিতেন। সরকারি প্রতিবেদনে স্বীকার করা
হয়েছে,“অনেক হিন্দু সুভাষ বসুকে ভীষণভাবে অবিশ্বাস করে” (জয়া:১৪৮) যুগান্তর গ্রুপে কেমন সব লোকজন ছিলেন তার পরিচয় মেলে
এককালের সুভাষ বসুর অনুরাগী যুগান্তর সদস্য সুরেন্দ্র মোহন ঘোষের একটি
সাক্ষাৎকারে,“...সুভাষের বাড়িতে আমি গিয়ে দেখি ইতর জন ও রাস্তার লোকে ভর্তি।তারা
সেখানে ভিড় করে ছিল।আমি শরৎ কে জিজ্ঞেস করি --- এরা কি আপনার অনুসারী ও সমর্থক?এরা
তো রাজনৈতিক কর্মী নয়,এরা হল ইতর শ্রেণীর লোকজন।” (জয়া:১৪৯) মাড়োয়াড়ি শিল্পপতিরাও সক্রিয় হন বসুদের
আটকাতে।বিড়লা,গোয়েঙ্কা,খৈতান ইত্যাদি ভারতের বড় বড় শিল্পপতিরা অর্থ এবং সক্রিয়তা
নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন।অমৃতবাজারের মতো কাগজ সরাসরি ‘হিন্দু স্বার্থকে উপেক্ষা’
করবার দায়ে অভিযুক্ত করে।১৯৩৯এ বীর সাভারকার এসে হিন্দু মহাসভা প্রতিষ্ঠা করেন
কলকাতাতে।শ্যামাপ্রসাদ তাঁর
নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।মাড়োয়ারি শিল্পপতিরা তাদের দান সেদিকে ঢালতে শুরু করেন। স্পষ্ট
বোঝা যায় হিন্দুত্বের জোর ছাড়া সারা দেশে সংখ্যালঘু এই মাড়োয়াড়ি শিল্পপতিদের
সংখ্যাগুরু হয়ে উঠা এবং দেশজোড়া বাজার সুরক্ষিত করবার দ্বিতীয় কোনো পথ ছিল না।
বাঙালি ভদ্রলোকেরা শুধু তাদের তাবেদার হয়ে উঠছিলেন মাত্র,বিপরীতে মুসলমান জোতদারেও
ক্রমেই আশরফ ইস্পাহানিদের তাবেদার করে তুলবার প্রয়াস দীর্ঘতর হচ্ছিল।
ক্ষমতাধর পাঁচের
একজন নলিনী রঞ্জন সরকার মাঝে কংগ্রেস ত্যাগ করেছিলেন। হক মন্ত্রীসভাতেও যোগ
দিয়েছিলেন।তিনি গান্ধির তথা হাইকমান্ডের
অনুগামী ছিলেন।হিন্দু মহাসভারও কাছাকাছি এলেও যোগ দেন নি। বসুভাইদের
বহিষ্কারের পরে সেই দরকারও মনে করেন নি।তিনি কংগ্রেসে ফিরে এলেন। হিন্দু মহাসভাতে
যেতে পারতেন এমন আরো অনেকেই কংগ্রেস সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে উঠাতে হিন্দু মহাসভা ‘অতি
আক্রমণাত্মক সাম্প্রদায়িক প্রচারণা শুরু করে’।(জয়া:১৫৫) ১৯৪১এ ঢাকাতে
এক সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা হয়। বিষয় ছিল বড় অদ্ভুত । সেকেন্ডারি এডুকেশন বিল---যেটি
ভদ্রলোকেরা পছন্দ করেন নি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব খর্ব করবার জন্যে। হিন্দুদের মধ্যে
প্রভাব হারাবার ভয়ে কংগ্রেসও হিন্দু পথ গ্রহণ করে। দাঙ্গায় আক্রান্তদের ত্রাণের
ব্যবস্থা যখন করে কেবল হিন্দুদের বেছে নেয়।পাছে হিন্দুদের দান পেতে কংগ্রেস ব্যর্থ
হয় -- কংগ্রেসের এই নীতি হাইকমান্ডও সমর্থন করে।এমন কি দাঙ্গার তদন্তের বেলাও
হিন্দু পক্ষের প্রতিনিধিত্ব করবার চাপ পড়ে নেতৃত্বের উপর। ঢাকার নেতা কামিনী দত্ত নলিনী রঞ্জন সরকারকে এক চিঠি
এমন লেখেন যেন তিনি মেনেই নেন যে কংগ্রেস একটি হিন্দু সংগঠন।(জয়া:১৫৫) অন্য হিন্দু সংগঠনকে বিপন্ন না করবার পরামর্শ দেন।
শুধু বিপন্ন করে নি নয়। দুই সংগঠন পরস্পর সহযোগিতাও শুরু করে।কংগ্রেস ছিল সাংগঠনিক
ভাবে সবল,হিন্দু মহাসভা আর্থিক দিক থেকে সবল। ১৯৪২এ কংগ্রেস নিষিদ্ধ হলে
গ্রেপ্তারি এড়াতে বহু কংগ্রেস নেতা হিন্দু মহাসভাতে আশ্রয় নেন।এই কথা এখানে উল্লেখ
করা ভাল যে মহাসভা ভারত ছাড় আন্দোলনে যোগ দেয় নি। কংগ্রেসের উপর নিষেধাজ্ঞা উঠে
গেলে আবার মহাসভা ফাঁকা হয়ে যায়। যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ যুদ্ধ প্রয়াসে সমর্থন দেবার
জন্যে কম্যুনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে কংগ্রেস ‘জাতি বিরোধী’ বলে প্রচার শুরু করে।
কিন্তু শুরু থেকেই এই যুদ্ধের সমর্থক হিন্দু মহাসভার বিরুদ্ধে টু শব্দটি করে নি।
মাঝে কিছু নির্বাচনে মহাসভা শোচনীয় ভাবে হারে। এবং একসময় তার নেতারাই কংগ্রেস
থাকতে মহাসভার স্বতন্ত্র অস্তিত্বের দরকার নিয়েই প্রশ্ন তোলেন।মাড়োয়ারি
শিল্পপতিরাও কংগ্রেসের উপরে তাদের আস্থা জানাতে থাকেন। জমিদার মহারাজারা তো বটেই।
‘মুসলমান স্বেচ্ছাচারে’র বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ
হিন্দুর আয়োজন
শরৎচন্দ্র যে
হিন্দুর মিলন নয়,সংঘবদ্ধতার আহ্বান রেখেছিলেন সে তাঁর একক চিন্তা ছিল না।ভদ্রলোক
সমাজ মুসলমানের উত্থান রুখতে তাঁর দরকার অনুভব করছিলেন।বস্তুত ‘সাম্প্রদায়িক
রোয়েদাদে’র পরেই বেশি বেশি করে তাঁদের এই অনুভব দেখা যায়।‘মুসলমান স্বেচ্ছাচারে’র বিরুদ্ধে ‘হিন্দু ঐক্য’।কিন্তু তাদের
সমস্যা ছিল তারা নিজ বর্ণগত আধিপত্যও ছাড়তে পারেন না। পুনা চুক্তির বিরুদ্ধে
ভদ্রলোকদের তীব্র প্রতিক্রিয়ার কথা ছেড়ে দিলেও ১৯৩৩এর ‘আনটাচেবিলিটি বিল’ কিংবা
১৯৩৪এর ‘ডিপ্রেসড ক্লাসেস স্ট্যাটাস বিল’কেও তারা সহজভাবে গ্রহণ করে নি। উনিশ
শতকের শেষ ভাগ থেকেই বিভিন্ন জাতবর্ণের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা
বাড়তে থাকে। যেমন নমঃশূদ্ররা ব্রাহ্মণের মর্যাদা দাবি করেন, রাজবংশীরা ব্রাত্য
কায়স্থ মর্যাদা দাবি করেন ইত্যাদি। ১৮৯১র প্রথম আদম সুমারির পরে থেকে এমন দাবি
পরিমাণে বাড়তে থাকে। নমঃশূদ্ররা পূর্ববাংলাতে কায়স্থ মর্যাদার দাবি জানালে এবং
কায়স্থরা তা প্রত্যাখ্যান করলে সংঘাত দেখা দেয়। কিন্তু বিশের দশকের শেষ বা ত্রিশের
দশকের শুরু থেকে বর্ণহিন্দুরা যখন বৃহত্তর
ঐক্যের দরকারটি মনে করেন,তখন তারাও গান্ধির মতোই ‘অস্পৃশ্যতা’কেই মূল বিষয় হিসেবে
দেখেন। কিন্তু সেখানেও তাদের বর্ণবাদী মানসিকতাই প্রকাশ পায়।অনেকে তারা শুদ্ধি আন্দোলন শুরু করেন।কংগ্রেস কোথাও কোথাও
নমঃশূদ্রদের মন্দিরে প্রবেশাধিকারের জন্যে সত্যাগ্রহ করে।‘সত্যম শিবম’ বলে একটি
সংস্থা সাঁওতালদের মধ্যে শুদ্ধিকরণ কর্মসূচী হাতে নেয়।তখন অব্দি এদের অনেকেই আদমশুমারিতে
নিজেদের ‘হিন্দু’ বলে লেখাতেন না। বর্ণহিন্দুরাও তার দরকার বোধ করতেন না।কিন্তু
দ্বিতীয় দশক থেকে বিভিন্ন শাসন সংস্কার শুরু হলে ‘হিন্দু’ অংশদারীত্ব বাড়িয়ে
আধিপত্য নিশ্চিত করবার স্বার্থেই হঠাৎ করে তারা সহানুভূতিশীল হতে শুরু করেন।১৯৩৭এর
নির্বাচনে বিষয়টি আরো বেশি স্পষ্ট হয়ে যায়। কংগ্রেসের ব্যর্থ গণসংযোগ
উদ্যোগ,“স্পষ্ট প্রমাণ করে যে,অনুন্নত শ্রেণীর সমর্থন প্রাপ্তির উদ্যোগে
ভূ-সম্পত্তি বিষয়ক চরম মতবাদকে ভিত্তি করা যাবে না;ভদ্রলোকদের অর্থনৈতিক স্বার্থকে
বিসর্জন দিয়ে হিন্দু ঐক্য গঠন করা যাবে না।তাই বিভিন্ন শ্রেণীর হিন্দুদের পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে
সংঘবদ্ধ হিন্দু রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের পরিধির বিস্তার একটি উল্লেখযোগ্য হাতিয়ার
হিসাবের আবির্ভূত হয়।” (জয়া:২২৮)
১৯২১এর আদম শুমারিতেও আসাম বিহার
বাংলার বহু জনজাতি নিজেদের হিন্দু না লিখে ‘জড়োপাসক’ বলে লেখালে ১৯৩১এর
আদমশুমারিতে যাতে তারা নিজেদের হিন্দু এবং বর্ণ ‘ক্ষত্রিয়’ উপাধি হিসেবে ‘সিংহ’ বা
‘রায়’ লেখান সেই আহ্বান জানায় হিন্দু সভা। সেই অনুসারে কাজও হয়। কিছু জনজাতি সাড়াও
দেন। (জয়া:২২৮) কোথাও কোথাও এরা কিছু জনজাতিদের মুসলমানের জমিতে কাজ
না করতেও প্ররোচিত করে সফল হয়। এইসব উদ্যোগ স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানেরাও ভালভাবে
নেন নি।মুসলিম লীগ কোথাও
কোথাও তারা যাতে আদিবাসী হিসেবে নথিভুক্ত করান সেই চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।তপশিলি
জাতি জনজাতিদের থেকেও প্রতিরোধ ছিল না নয়,কিন্তু সেসবও ব্যর্থ হয়। কেননা,কাগজে
পত্রে অন্তত তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির আশ্বাস দেওয়া হচ্ছিল।বিনিময়ে তাদের
কিছু কিছু পুরোনো আচার বাদ দিতে হয়। যেমন মুরগি শুয়োরের মাংস খাওয়া ইত্যাদি।এগুলো
মোটেও বর্ণপ্রথাকে সমূলে উৎপাটন করতে পারত না, বা করেও নি। বরং আচার বাদ দিয়ে উপরে
উঠে আসা বর্ণগুলো যারা সেসব বাদ দেয় নি তাদের অবজ্ঞাই করত।এই প্রক্রিয়াতে এই সব
জনগোষ্ঠীকে এখানে ওখানে মুসলমানের বিরুদ্ধে উস্কে দেবার কাজও পুরো দমে চলে।এবং
এভাবেই তাদের মধ্যে মসজিদের সামনে বাজনা বাজানো,বিসর্জনের যাত্রা, গো-মাংস ইত্যাদি
প্রতীকী তাৎপর্য লাভ করতে শুরু করে আর এখানে ওখানে সংঘর্ষ বাঁধে। জোতদারদের সঙ্গে
সংঘাতে এই সব জনগোষ্ঠীগুলোকে এইভাবেই ব্যবহার করে শহুরে ভদ্রলোকেরা। দশক জোড়া এমন
প্রয়াসের পরিণাম স্বরূপ ১৯৪৬এর নির্বাচনে ত্রিশটি তপশিলি আসনের মধ্যে তিনটি ছাড়া
বাকি সব ক’টি কংগ্রেস দখল করে। যেটি জয়া লেখেন নি, তাঁর নজর এড়িয়ে গেছে বলে মনে
হয়, লীগ বা প্রজা পার্টি রাজনীতিতে এই সব জনগোষ্ঠীকে অবহেলা করবার জন্যেই
ভদ্রলোকেদের এহেন প্রয়াস সফল হল কি না। অন্তত তাঁর তথ্য থেকে সেরকমই মনে হয়।
ত্রিশ চল্লিশ দশকে
দেখা যায় শহরে নগরে যেখানেই ভদ্রলোকেদের প্রভাব আছে,সেখানে তারা সংখ্যালঘু হলেও
সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। জয়া দেখিয়েছেন রোয়েদাদ ছিল আইন সভার
জন্য। স্থানীয় বোর্ড ইত্যাদিতে যৌথ নির্বাচন পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। সবাই যদিও ভোট
দিতে পারতেন না, সম্পদ এবং শিক্ষা আছে সেরকম প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার পনের শতাংশই
ভোট দিতেন। সেদিক থেকে ভদ্রলোকদের আধিপত্য নিয়ে সমস্যা হবার কথা ছিল না।কিন্তু উঠে
আসা মুসলমান গোষ্ঠীরা ক্রমাগত তাদের প্রত্যাহ্বান জানাতে থাকে,এমন কি পশ্চিম
বাংলার হিন্দু সংখ্যাগুরু এলাকাগুলোতেও মুসলমান প্রতিনিধিত্ব বেশ বেড়ে যায়।ওদিকে
স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের এক গণতান্ত্রিক উদ্যোগও নিয়েছিল
ফজলুল হক সরকার।তাতে ঋণমকুবের আন্দোলনে শক্তি বেড়েছিল।কংগ্রেসের কেউ কেউ সরকারে
‘কম্যুনিজম’ নিয়ে আসবার অভিযোগ তুলে বসেন।কিন্তু নিরুপায় হয়ে তাদের মধ্যে সেইসব
বোর্ড দখলের আগ্রহ বেড়ে যায়। নইলে গ্রামীণ রাজনীতির থেকে বাইরে বেরিয়ে যেতে হত।
ক্রমবর্ধমান মুসলমান বিদ্বেষ এবং শুদ্ধি আন্দোলনকে এই বাস্তবতার সঙ্গেও মিলিয়ে
দেখতে হবে। মনোনীত সদস্যের বেলা সরকার পক্ষও যে পক্ষপাত করত না তা নয়,মুসলমানদের
অগ্রাধিকার দিলে হিন্দুরা বঞ্চনার অভিযোগ তুলতেন।স্কুল বোর্ডগুলোতেও ভদ্রলোকেরা
আধিপত্য হারাতে শুরু করেন। স্কুলগুলোকে ধর্মনিরপেক্ষ করবার আয়োজন হয়।অর্থাৎ সরস্বতী
পুজো বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হয় কোথাও কোথাও,যা হিন্দু পক্ষ থেকে প্রতিরোধের মুখে পড়ে।
সেরকম পৌরসভার পথগুলোকেও ধর্মনিরপেক্ষ
করবার আয়োজন এবং তাকে নিয়ে সংঘাতের কিছু বর্ণনা জয়া দিয়েছেন। কারণ পথের পাশের
হিন্দুর পবিত্র অশ্বত্থ গাছ থাকে,তার সামনে দিয়ে মুসলমানের ধর্মীয় মিছিল গেলেও
বিপদ! (জয়া:২৪৩) বারোয়ারি পুজো ইত্যাদিও বেড়ে চলে
এবং সেগুলোকেও ধনাঢ্যরা নিজেদের প্রতিপত্তি বাড়াবার কাজে লাগাত। ব্রিটিশের নীতি
যদিও ছিল ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে হস্তক্ষেপ না করবার,তবু যদি মনে করেছে যে কোনো অনুষ্ঠান
আবহমান কাল ধরে চলে এসেছে তবে তাকে উৎসাহিত করত। সেরকম বহু ‘আবহমান’ কালের
অনুষ্ঠান হয়তো বাস্তবে ছিল একেবারেই সাম্প্রতিক উদ্ভাবনা।বিশ্বাস একটিকে দাঁড়
করানো নিয়ে কথা। যখন সংঘাত বাঁধত প্রশাসনের সিদ্ধান্ত নেবার সমস্যা হত,তখন কারটা
কত প্রাচীন প্রমাণ করবার প্রতিযোগিতা চলত।তাতে নির্ধারিত হত স্থানীয় ক্ষমতার
কাঠামো কারা নিয়ন্ত্রণ করছে বা করবে।কিন্তু সেই প্রতিযোগিতাতে পূর্ব বাংলাতে তো বটেই,পশ্চিম
বাংলার হিন্দু প্রাধান্য থাকা তিন জেলা ২৪ পরগণা,বর্ধমান,মেদিনীপুরেও ভদ্রলোকেরা
ক্রমাগত পরাস্ত হতে শুরু করে।ফলে,“...সামগ্রিকভাবে প্রদেশে ‘মুসলিম স্বেচ্ছাচার’
কে গ্রহণের অস্বীকৃতির সংকল্প আরও দৃঢ় হয়। সুতরাং এটা বিস্ময়কর নয় যে,১৯৪৭ সালে এই
তিন জেলা থেকেই প্রবলভাবে একটা পৃথক ‘হিন্দু আবাসভূমি’ সৃষ্টির আন্দোলন শুরু হয়।”
(জয়া:২৪৩)
দ্বিতীয়বারের বাঙলা বিভাগ: রাখির সেই
ফস্কা গেরো একেবারেই খুলে গেল
(মূল ইংরেজি বইয়ের আভাস এখানে) |
এইভাবে ১৯০৫এ যারা বাংলাভাগের বিরোধিতা
করেছিলেন,তাঁদের আসল স্বরূপ স্পষ্ট হয়ে গেল।এবং তারা প্রায় সবাই ১৯৪৭এ বাংলা তথা
দেশভাগের জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেলেন। শুরুতে কিছু সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটটিও ছুঁয়ে গেছেন।ব্রিটিশ সরকারের
ভারতকে ভাগ করবার সেরকম কোনো ইচ্ছে ছিল না। তারা চেয়েছিল সুয়েজের পুব দিকে এমন এক
উত্তরাধিকারী যে হবে,“... ব্রিটিশের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় সক্ষম।এ জন্য প্রয়োজন
ঐক্যবদ্ধ ভারত,শক্তিশালী কেন্দ্র ও অবিভক্ত সৈন্যবাহিনী।” (জয়া:২৪৩) চল্লিশের দশকে বাংলার কংগ্রেস কেন্দ্রের আজ্ঞাবহতে
পরিণত হয়,আর লীগ যাবতীয় দরকষাকষিতে বাংলার মুসলমান নেতাদের দূরে সরিয়ে রাখতে শুরু
করে।প্রাদেশিক সরকারে তাদের দুর্বল ভূমিকা একটি কারণ ছিল। অন্যদিকে কেন্দ্রের
কংগ্রেস যখন দেশভাগের সিদ্ধান্ত নেয়, বাংলা কংগ্রেস এবারে তার বিরোধিতা করে
নি।১৯৪৫-৪৬ আসতে আসতে নির্বাচনে কংগ্রেস নিজেকে ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধি বলে
দাবি প্রমাণে ব্যর্থ হয়।তারা মুসলমান ভোট পায় মাত্র ১.৩ ভাগ। প্রদেশগুলোকে কংগ্রেস পায় মাত্র ৪.৬৭ ভাগ।স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে
জিন্নাহ তথা লীগের দাবি জোরদার হয়। ১৯৪৬এর শেষদিকে এবং ১৯৪৭এর শুরুর দিকে লীগ-কংগ্রেসের
সংক্ষিপ্ত এক কোয়ালিশন সরকার হয়।অর্থমন্ত্রী লিয়াকত আলির কাজে কংগ্রেস সরকার
বিপাকে পড়ে। এবং দেশভাগ করতে আগ্রহী হয়ে পড়ে। এই সময় ক্যাবিনেট মিশন এসে একটি
যুক্তরাষ্ট্র কাঠামোর প্রস্তাব রেখেছিল।জিন্নাহ সেরকমই কিছু একটা চেয়েছিলেন,মন
থেকে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান দাবি না করলেও ধারণাটিকে একটি দরকষাকষির
বিষয় হিসেবে ব্যবহার করছিলেন। কিন্তু জয়া এটি জোর দিয়েই লিখেছেন যে,“জিন্নাহর
উদ্দেশ্য যা-ই থাকুক না কেন,তাঁর রাজনীতি ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে একটা শক্তিশালী
ধর্মীয় ও সম্প্রদায়গত জাতীয়তাবোধের চেতনা
জাগ্রত করে;তারা এমন এক আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয় যা আবশ্যিকভাবে উভয় সম্প্রদায়ের
মধ্যে সন্দেহ, ঘৃণা ও উগ্রতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখে।” (জয়া:২৬৫) এর পরেও দাবি করেছেন,এ যাবত অধিকাংশ গবেষণাতে দাবি করা
হয়েছে,দেশভাগ ছিল এককভাবে মুসলমানের দাবি এবং হিন্দুরা এককভাবে এর বিরোধিতা
করে---তিনি এই সিদ্ধান্তকে প্রত্যাহ্বান জানাবেন।কিন্তু তিনি কিছুতেই জিন্নাহর আগেই যে হিন্দু তরফে
‘দ্বি-জাতি’ তত্ত্ব খাড়া করা হচ্ছিল, বা মালব্য, লালালাজপত রায়, বল্লব ভাই প্যাটেল
এবং জিডি বিড়লা জিন্নাহ কিংবা মুসলিম লীগের আগেই পাকিস্তানের কথা ভেবেছিলেন এবং
জিন্নাহ, ইস্পাহানিদের সঙ্গে কথা বলে বিড়লা দেশভাগ নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন,সেইসব
কোনো তথ্যেরই উল্লেখ করেন নি।শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘পলাশি থেকে পার্টিশন’এ সর্বভারতীয়
প্রেক্ষাপট বেশ বিস্তৃত আলোচনা করলেও,তিনিও সেরকম কোনো তথ্য যোগাননি, যদিও
লিখেছেন,“উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের প্ররোচনা থেকেই মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন হয়ে
যাবার ভাবটি জেগে উঠে।” (শেখর:৪০৪) সেসব কথা বেশ
তথ্য সহ আলোচনা করেছিলেন সুজিত চৌধুরী তাঁর বহুপঠিত নিবন্ধ ‘ধর্ম, রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িকতা:
উৎস ও পটভূমি’তে (সুজিৎ:৫৭-৬৫)। তাঁর তথ্যগুলোর
মধ্যে বিড়লার চিঠিপত্রাদি,রাজেন্দ্রপ্রসাদের লেখা বই ছাড়াও কিছু গবেষণা নিবন্ধ
ছিল।বাণীপ্রসন্ন মিশ্রও এমন বেশ কিছু তথ্যের যোগান দিয়েছেন তাঁর ‘যদি, কিন্তু ও
সুতরাং:দেশভাগের কথকতা’ নিবন্ধে।বিড়লা প্রমুখের কাছে দেশটি ছিল ‘ব্যবসা’ মাত্র, তিনি
লিখেছেন।(বাণীপ্রসন্ন:৪৬)মেধা কুড়াশিয়ার
লেখা বিড়লার জীবনী গ্রন্থের থেকে বাণীপ্রসন্ন উদ্ধৃতি দিয়েছেন,“I suggest that we
allow Muslims to carry on propaganda in favour of this division without approving
of their demand, and when they make full commitment the alone we may accept the
principle” (বাণীপ্রসন্ন:৪৬) বিড়লার এই
চাতুর্যটি লাহোর প্রস্তাবের আগেকার,আর ১৯৪৬এর ক্যাবিনেট মিশনের ব্যর্থতার আগে
অব্দি মুসলিম লীগও ‘full commitment’ জানায় নি।ঘটনাক্রম ঠিক সেরকম ঘটেছিল,যেমনটি বিড়লা চেয়েছিলেন।বস্তুত মূল
পাকিস্তান প্রকল্পে বাংলাদেশটাও সেভাবে ছিলই না।
যাই হোক,জয়া
চ্যাটার্জির আলোচনার কেন্দ্রে আছে বাংলা।তিনি লিখছেন,“সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে বলা যায়
যে,বাঙালিরা তাদের প্রদেশ বিভক্তির সময় নিচেষ্ট নিষ্ক্রিয় দর্শক ছিল না;নিজেদের
সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরের ঘটনারও তারা শিকার ছিল না বা অনিচ্ছাকৃতভাবে নিজেদের
মাতৃভূমির বিভক্তিকে গ্রহণ করার জন্য তাদের বাধ্যও করা হয় নি।বরং ব্যাপারটি তার
বিপরীত।” (জয়া:২৬৬) ১৯৩৬এর নির্বাচনে যেখানে কংগ্রেস
বণিক-ভূমিমালিক সহ মোট ৯০টি হিন্দু আসনের ৫২টি পায়, ১৯৪৫-৪৬এ পায় ৮৬টি।
হিন্দু মহাসভা একটিই আসনে জেতে।আর সেটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার কেন্দ্র --বিশ্ববিদ্যালয়
আসন। জেতেন
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।তাও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।জয়া লিখছেন,এ ছিলনা
‘ধর্মনিরেপেক্ষতা’র বিজয়। বরং ততদিনে পুরো সংগঠিত হিন্দু সমাজ হিন্দু মহাসভার
স্বতন্ত্র দরকারটি আর মনে করে নি।কংগ্রেস হয়ে উঠে পরিপূর্ণভাবে ‘হিন্দু’র দল।যদিও
সরকার গঠন করে তখন মুসলিম লীগ।প্রধানমন্ত্রী হন সোহরাওয়ার্দী। চল্লিশের দশকের ভয়াবহ মন্বন্তরের
জন্য এর আগের সরকারে গণ-বণ্টন মন্ত্রী হিসেবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে দায়ী ছিলেন বলে
হিন্দু কাগজগুলো ব্যাপক প্রচার শুরু করে।
তিনিও ক্ষোভ দূর করবার জন্যে কোনো ব্যবস্থা নেন নি।সরকারে মন্ত্রী সংখ্যা ১৩ থেকে
কমিয়ে করেন ১১। হিন্দু মন্ত্রী সংখ্যা কমিয়ে করেন ৩,তারও দু’জন তপশিলি জাতির মানুষ।জয়া এই কথা
স্পষ্ট করেন নি যে এর আগেকার ফজলুল হক বা নাজমুদ্দিন সরকারে প্রধানমন্ত্রী ছাড়া
বাকি মন্ত্রীদের মধ্যে হিন্দু মুসলমানের সংখ্যা সমান হত।বর্ণহিন্দুরা স্বাভাবিকভাবেই ক্ষেপেন।শ্যামাপ্রসাদের মত
মানুষ মনে করেন,এভাবে চলতে থাকলে বাংলার হিন্দুরা ‘স্থায়ীভাবে মুসলমান শাসনের’
অধীন হয়ে যাবেন। কিন্তু তাঁর যে সব হিন্দুর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আদৌ ছিল না,তার নজির
জয়া উদ্ধার করেছেন এই মন্তব্য,“কিছু নিম্ন শ্রেণীর হিন্দু থেকে ইসলামে ধর্মান্তরিত
ব্যক্তিকে শান্ত করতে হলে অতি প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতিকেই বিসর্জন দিতে হবে।”(জয়া:২৬৯) সোহরাওয়ার্দীর আমলেই ১৬ আগষ্টের কুখ্যাত ‘ডাইরেক্ট
একশন ডে’-র হাঙ্গামা হয়। ফলে কলকাতা তথা পশ্চিম বাংলার ভদ্রলোকেরা বাংলা ভাগের
কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা মেনে নিতে শুরু করেন।
‘ডাইরেক্ট একশন
ডে’ তে বিবাদ প্রায় গৃহযুদ্ধের চেহারা নেয়। যে দাঙ্গা হয় তাতে কমেও পাঁচ হাজার
মানুষ মারা যান। সোহরাওয়ার্দী সেই হাঙ্গামা থামাতে বিশেষ ব্যবস্থা নেন নি সেও
সত্য। কিন্তু এই হাঙ্গামায় “...হিন্দু নেতারাও যে এই ঘটনায় গভীরভাবে জড়িত ছিল,এ
সত্যটা তেমন সুবিদিত নয়।ঐ লড়াইয়ে হিন্দুর চেয়ে অনেক বেশি মুসলমান নিহত হয়।” (জয়া:২৭১) বল্লভভাই প্যাটেলের একটি মন্তব্য উদ্ধার করেন জয়া,“হিন্দুরা
এতে তুলনামূলকভাবে বেশি লাভবান হয়েছে।” (জয়া:২৭১) লাভটি এই
নয় শুধু যে মুসলমান বেশি মারা গেছে।বরং এই যে দশক কয় আগে যারা বাংলা ভাগের
বিরুদ্ধে লড়েছিলেন,তারা এবারে বাংলা ভাগের পক্ষে জনমত গড়তে ঘটনাটিকে ব্যবহার করতে
পারলেন। বাংলাভাগকে আক্ষরিক অর্থে পাকিস্তান প্রকল্পে জুড়ে দিতে ভদ্রলোকেরা এই লীগ
আন্দোলনকে পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করলেন।এমন একটি সুযোগের সদ্ব্যবহার করবার জন্যে আর
এস এস সহ বহু হিন্দু সংগঠন এবং ব্যক্তির দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার বিস্তৃত তথ্য তিনি
তুলে ধরেছেন।বিড়লা সহ বহু মাড়োয়াড়ি বণিকও প্রত্যক্ষ অপ্রত্যক্ষভাবে এই উদ্যোগে
জড়িয়ে ছিলেন।দাঙ্গার অভিযোগে বহু ধনি ব্যবসায়ী,প্রভাবশালী সওদাগর,শিল্পী,দোকানদার
গ্রেপ্তার হন।তাঁদের মধ্যে হিন্দু মহাসভা ছেড়ে কংগ্রেসে ফেরা বিখ্যাত ডাক্তার
মহেন্দ্রনাথ সরকারও ছিলেন। সারা ভারতেই ‘ডাইরেক্ট একশন ডে’ -র ডাক দিলেও হাঙ্গামা কেন
শুধু কলকাতাতেই হল — সেই প্রশ্ন এযাবৎ সাধারণত করতে দেখা যায় না। কিন্তু জয়ার পরে
আরো অনেকেই করেছেন। এবং হিন্দু সংগঠনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।তাদের মধ্যে
অসীম রায়, তপন রায়চৌধুরী সহ অনেকেই রয়েছেন। তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশিত একটি কাগজ হিন্দুদের মনে মুসলমান ভীতি
ছড়াতে ব্যাপক গুজব ছড়িয়েছিল। এমন আরো বিস্তৃত তথ্য যুগিয়েছেন মুজিব স্বদেশি তাঁর
গবেষণা গ্রন্থে। (মুজিব:১২৬) জয়া চ্যাটার্জির তথ্যগুলোকে স্বীকার
করে নিয়েছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়, শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অনেকে। (শেখর:৫২৮) বছরের শেষ
হবার আগেই ‘বেঙ্গল পার্টিশন লীগ’ নামে একটি নতুন সংগঠনও গড়ে উঠে। ১৯৪৭এর এপ্রিলে
‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ দেশভাগের পক্ষে প্রচারের অংশ হিসেবে দেশভাগ নিয়ে একটি সমীক্ষা চালায়। তাতে ৯৮.৬ শতাংশ মানুষ দেশভাগের পক্ষে মত দেন, খুব ছোট্ট একটি অংশ
যুক্তবাংলার পক্ষে রায় দেন। প্রচুর সংগঠন দেশভাগের পক্ষে নানা ভাবে প্রচারে নামে। বাংলা
বিভাগের পক্ষে সারা বাংলা থেকে সংগঠিতভাবে আবেদন পত্রে সই সংগ্রহ করা হয়। দেখা
যাচ্ছে পশ্চিম বঙ্গ বা তার সংলগ্ন জেলাগুলো থেকেই অত্যধিক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। (জয়া:২৮৩) এতে কংগ্রেস এবং মহাসভা যুগপৎ জড়িত ছিল। জয়া
লিখেছেন,“ভ্রান্তভাবে বিশ্বাস করা হয় যে,এই আন্দোলন ছিল শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর
মস্তিষ্কপ্রসূত (নিশ্চয়ই তিনি বিভক্তির সমর্থক) এবং মহাসভার স্বেচ্ছাসেবকদের
দ্বারা সংগঠিত। বস্তুত বাঙলা –বিভাগ আন্দোলনের প্রধান সংগঠক ছিল বেঙ্গল কংগ্রেস।”(জয়া:২৮৬) ১৯৪৭এর মে মাসে বাঙলা ভাগের দাবিতে কংগ্রেস এবং মহাসভা
কলকাতাতে যৌথভাবে একটি জনসভা করে,যে সভাতে সভাপতিত্ব করেন ঐতিহাসিক যদুনাথ
সরকার।(জয়া:২৮৭) সেরকম সভা পশ্চিম বাংলাতেই, মূলত ২৪ পরগণা, বর্ধমান,
মেদিনীপুরে,এরা করতে থাকেন। বাংলা ভাগের পক্ষে মোট ৭৬টি সভা হয়, তার মধ্যে কংগ্রেস
একাই করে ৫৯টি। বিভিন্ন বোর্ড, ক্লাব, ইউনিয়ন ইত্যাদিকেও মাঠে নামায়। সেসবের
বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন জয়া। আর্য সমাজ, ব্রাহ্ম সমাজ, মহাবোধিনী সমাজ, হিন্দু
মিশন, সনাতন হিন্দু সভা বাংলার নবজাগরণ
এবং পুনরুত্থানের ফসল সব সম্প্রদায় একাকার হয়ে যায় একটি স্বতন্ত্র হিন্দু
রাষ্ট্রের স্বার্থে। পূর্ববঙ্গের আকর্ষণ জমিদারির স্বার্থেও আর তাদের ছিল
না,অন্যদিকে পাটশিল্পের পতনের পরে মাড়োয়াড়িদের ব্যবসার কেন্দ্রও পূর্ব থেকে
পশ্চিমে সরে যায়।মাড়োয়াড়িরা আগ্রহী ছিল তাদের একটি তাবেদার সরকার প্রতিষ্ঠাতে,যা
সম্ভব ছিল কংগ্রেস একক ভাবে ক্ষমতাতে এলে। আর সেটি সম্ভব বাংলা ভাগ হলে।ফলে এই
আন্দোলনে তারা ব্যাপক বিনিয়োগ করেন।
এই জোয়ারের
বিরুদ্ধে পুরোনো কংগ্রেসিদের মধ্যে তখন একা স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন শরৎ চন্দ্র বসু । চল্লিশের দশকের
মাঝামাঝি তিনি আবার কংগ্রেসে ফিরেছিলেন, কিন্তু দেশভাগের প্রশ্নে তিনি আবার ওয়ার্কিং
কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৪৭এর মার্চে যখন পাঞ্জাব ভাগের সিদ্ধান্ত দল নিয়ে ফেলে
তিনি বাংলা ভাগের আশঙ্কার বিরুদ্ধে সরব হন। তাঁর পাশে প্রাদেশিক কংগ্রেসের কাউকে প্রায় পান নি।
কিছুদিনের মধ্যেই বাংলা কংগ্রেস থেকে কিছু লোক মাউন্ট ব্যাটন সাহেবের সঙ্গে দেখা করে ভারতের ভেতরে পশ্চিম এবং উত্তর বাংলা
মিলিয়ে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশের দাবি জানান।অন্যদিকে শরৎ বসু একটি মে মাসে একটি
‘যুক্ত এবং সার্বভৌম বাঙলা’র রূপরেখা তৈরি করেন।এবং বাংলার লীগ নেতৃত্বের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন।ফজলুল হক
তখন ক্ষমতা বৃত্তের বাইরে।চুক্তিটির পক্ষে জনসমর্থন জোগাড়ের বা আন্দোলন গড়ে তুলবার
তখন আর সময় ছিল না,পরিবেশও ছিল না। মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী –আবুল
হাসিম নেতৃত্বে বাংলা লীগের তখন বিরোধ চরমে। তাঁরাও চাইছিলেন না পাকিস্তানের শরিক
হতে। কিন্তু সেটি কতটা হিন্দু বাঙালির সঙ্গে মিলে মিশে থাকবার চাহিদা আর কতটা
কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে বাংলার আঞ্চলিক নেতৃত্বের বা মুসলমান শাসক শ্রেণির বিরোধের পরিণাম সেই
প্রশ্ন এবং সংশয় থাকাই স্বাভাবিক ছিল। কেবল ভদ্রলোকদের প্রচারের ফলেই নয়,
সোহরাওয়ার্দী ইতিমধ্যে নিজের কাজের ফলেও সমস্ত বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে
ফেলেছিলেন। গান্ধি সর্তসাপেক্ষ এই
চুক্তিকে সমর্থন করলেও অচিরেই তাঁকে সমর্থন প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয়। হাইকমান্ডের
নীতি ছিল দেশভাগ হবে,কিন্তু যথা সম্ভব বেশি এলাকা ভারতে ধরে রাখতে হবে। এই প্রশ্নে নেহরু
প্যাটেল একজোট ছিলেন। প্যাটেলের অভিমত ছিল যুক্তবাংলা হচ্ছে ‘বোকার মতো মুসলিম
লীগে’র খপ্পরে পড়া’ (জয়া:২৯৭)। এই ধারণা একেবারে
ভিত্তিহীন এর জন্যেও ছিল না যে মুসলিম লীগের বাংলা নেতৃত্বও এই প্রশ্নে
দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন। “জিন্নাহর বিশ্বস্ত অনুসারী আকরম খাঁ এবং খাজা নাজিমুদ্দিন
নিশ্চিত ছিলেন যে,বাঙলা পাকিস্তানের অংশ হবে অথবা কমপক্ষে পশ্চিমাঞ্চলের নতুন
মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে তা একটা ঘনিষ্ঠ শাসনতান্ত্রিক সম্পর্ক বজায় রাখবে।”(জয়া:২৯৮) কিন্তু দিল্লির লীগ সম্মেলনে যুক্তবাংলার প্রস্তাব
প্রায় তুলতেই পারেন নি আবুল হাসিম।তাঁকে চীৎকার করে থামিয়ে দেয়া হয়। জিন্নাহ স্বয়ং
এই প্রস্তাবের সমর্থন বিরোধিতা কিছুই করেন নি।এই বিরোধ যে কালে গিয়ে ৭১এর মুক্তি
যুদ্ধ সম্ভব করেছিল---সেরকম ভাবাটা কি খুব অযৌক্তিক হবে?
“কিন্তু যুক্ত
বাংলার পরিকল্পনার সবচেয়ে মারাত্মক দুর্বলতা বাঙলার হিন্দুদের সত্যিকার সমর্থন
লাভে ব্যর্থতা।” (জয়া:২৯৮) শরৎ বসু
পশ্চিম বাংলার ‘উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কিছু লোক’ প্রদেশ ভাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে
বলে পূর্ব বাঙলার হিন্দুদের কাছ থেকে সমর্থন পাবার আশা করলেও তাদের কাছে সেই
আহ্বান পৌঁছালো দেরিতে,ইতিমধ্যে তাদের অনেকে দেশছাড়বার পরিকল্পনা করেই
নিয়েছিলেন।ফরোয়ার্ড ব্লকের ভেতরেও এই প্রশ্নে ভাঙন দেখা দেয়।সুভাষ বসুর অন্যান্য
অনুসারীরাও তাঁর বিরুদ্ধে বাংলা ভাগের পক্ষে দাঁড়ায়। তার জন্যে অবশ্য শরৎ বসুর
আরেকটি ভুল সিদ্ধান্তের কথা জয়া উল্লেখ করেছেন। ১৯৪৫এর নভেম্বরে আই এন এ
বন্দীমুক্তি আন্দোলন যেখানে কলকাতার ইতিহাসে ‘সবচেয়ে বড় একটা গণবিক্ষোভ হতে পারত’
শরৎ বসু তার থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন,এজেন্টের কাজ বলে। এতে সুভাষ অনুসারীদের
কাছে তাঁর ভাবমূর্তি ব্যাপক ভাবে নষ্ট হয়। তাঁরা তার বিরুদ্ধে ‘প্রতিশোধ’ গ্রহণে
দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে পড়েন। ১৯৩২এ রোয়েদাদের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ স্বাক্ষরিত এক
স্মারকপত্রের দাবিটি ছিল গণতান্ত্রিক। ‘স্বীকৃত সংখ্যালঘুর নায্যপ্রাপ্তী’র দাবি।
রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত টাউন হলের সভাতে রাধাকুমুদ মুখার্জির ‘যুক্তরাষ্ট্রীয়
বাংলা’র ধারণাটি ছিল আরো সমুন্নত। যদিও দাবিগুলো তখনকার মতো উঠেছিল ‘সংখ্যালঘু
হিন্দু’র স্বার্থে, সেই নীতি চিরদিনের মতো সাম্প্রদায়িকতার সমস্যাকেই বিলীন করে
দিতে পারত। শরৎ বসুর প্রকল্পটিকে তারই আদলে তৈরি
বলে ভাবা যেতে পারে। কিন্তু এবারে আর ‘সংখ্যালঘুর নায্যপ্রাপ্তী’ নয়, শরৎ
বসুর বিরুদ্ধে নব্য সুভাষ অনুরাগীরা একটি পুস্তিকা ছেপে বের করলেন। যার নাম ছিল
‘বাংলার হিন্দু সাবধান’।সেখানে তীব্র শরৎ বসু বিদ্বেষের সঙ্গে মুসলমান বিদ্বেষও
রয়েছে আর আকাঙ্ক্ষা জানানো হয়েছে,“আমরা বাঙলা ভাগ বা একটা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার
চাই।”(জয়া:৩০০)চারদিক থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে শরৎ বসু দাবি
করেছিলেন,“বাঙলার কণ্ঠকে রুদ্ধ করা হয়েছে এবং সর্ব-ভারতীয় খেলায় সে দাবার ঘুঁটি
হিসেবেই থাকবে।” (জয়া:৩০০) তাঁর এই
দাবিকে জয়া লিখেছেন, ‘কল্পনাপ্রসূত’।তাঁর এই ব্যর্থতা ছিল এই আন্দোলনের ‘স্বাভাবিক পরিণতি’।
বাংলা ভাগ সাম্রাজ্যবাদ
কিংবা দিল্লির নেতৃত্ব চাপিয়ে দেয় নি। কেবল মুসলমানের দাবিতেও বাংলা ভাগ হয় নি।
‘ভদ্রলোক’দের ব্যাপক সমর্থন ছাড়া বাংলা ভাগ সম্ভব ছিল না।তাদের সাম্প্রদায়িকতার
‘গোপন রহস্যকে উন্মুক্ত’ করাই ছিল জয়ার মূল কাজ। যে রহস্য হিন্দুর ‘সংস্কৃতি’
ধারণার মধ্যে রয়েছে।অনুসন্ধান করেছেন কী প্রক্রিয়াতে ‘জাতীয়তাবাদে’র পরিবর্তন ঘটে
‘সাম্প্রদায়িকতা’বাদে।এরা মুসলিম স্বৈরতন্ত্রের থেকে মুক্তি পেলেন বলে সাম্রাজ্যবাদের
কালকে উদযাপন করলেন,আর ব্রিটিশ যখন যায় তখন সেই ‘স্বৈরতন্ত্রে’র প্রত্যাবর্তন না
ঘটে সেটি প্রতিরোধ করাই ছিল মূল লক্ষ্য। মুসলমানেরা যে বাঙালি সেই কথাকে অস্বীকার
করেই এরা সম্প্রসারণ ঘটিয়েছিলেন ‘ভারতীয়তার’। আসাম বিধান সভাতে যেমন ১৯৪৭এর নভেম্বরে
প্রথম অধিবেশনে বাঙালির অধীনতার থেকে মুক্তির জন্যে আনন্দ ব্যক্ত করা হয়েছিল,তেমনি
সেবছর জুন মাসে যখন বাংলার বিধান সভাতে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব গৃহীত
হয়েছিল,“শ্যামাপ্রসাদ সানন্দে বলেছিলেন আজ হিন্দুর মুক্তির দিন।” (মুজিব:১৩৭)
একটা কথা মনে হয়
স্পষ্ট থাকা ভাল জয়ার বই পড়ে অনেকেই অত্যুৎসাহী হয়ে ভাবতে পারেন, ‘বাংলাভাগ’টি
ভদ্রলোকদের জন্যেই হলো মূলত, মুসলমানদের এখানে কোনো ভূমিকাই প্রায় ছিল না। এই
সত্যটি কী করে অস্বীকার করা যাবে যে যুক্তবাংলার প্রস্তাবটিও ছিল শেষ পর্যন্ত ছিল
ভারতথেকে বেরিয়ে যাবারই দাবি।যদিও সর্বভারতীয় পরিস্থিতিতেও পশ্চিমা বর্ণহিন্দু
শাসকশ্রেণি দেশ এক রেখে কোনো ধরণের বিকেন্দ্রীকরণের প্রস্তাবে রাজি ছিলেন না,এমনকি
ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব বাতিল করেছিলেন বলেই ভাগটি অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। নেহরু
প্যাটেলের একটি ‘শক্তিশালী’ কেন্দ্রের চাহিদার কথা জয়া লিখেছেন।(জয়া:২৬২) এবং সেই শক্তিশালী কেন্দ্র তারা চাইছিলেন ‘পাকিস্তান’
ভাগ করে হলেও। বিভক্ত পাকিস্তানের শাসকেরাও যে অন্যরকম ভাবেন নি তার জন্যে ৪৭
পরবর্তী ঘটনাক্রমের দিকে তাকানোই যথেষ্ট।মুসলমানের ভূমিকা ছিল,কিন্তু ভদ্রলোকেরা যে দায় এড়াবার সফল
প্রয়াসটি করলেন, জয়া সেই দিকটাই দিলেন উন্মোচিত করে। এবং এই ভদ্রলোকেরা নির্ধারকের
ভূমিকা নিয়েছিলেন, যা ভাগ পরবর্তী ভারতীয় সাম্প্রদায়িকতাকে বোঝার জন্যেও
গুরুত্বপূর্ণ।এভাবেই ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের কথিত ইতিহাসের ‘নিয়মাবলীর আবিষ্কার’এর
একটি চেষ্টা জয়া করলেন এবং তাতে তিনি অনেকটাই সফল হয়েছেন বলেই আমাদের মনে হয়।
কেননা, এর পরের বহু ইতিহাসবিদেরাও তাকে গ্রহণ করে স্বীকার করে গেছেন।
বহু জিনিস যে জয়া
ছুঁয়ে দেখেন নি তার কিছু ইঙ্গিত আমরা দেখিয়ে এলাম। কিন্তু বিভাগ মুহূর্তে কম্যুনিস্ট
পার্টি এবং তপশিলি সংগঠনগুলোর ভূমিকা নিয়ে তিনি বিশেষ কিছুই লেখেন নি। বাংলার
মাটিতে এই সময়ে ঘটা একটি বড় ঘটনা ‘তেভাগা’ আন্দোলন, ‘ভারতছাড়ো’ আন্দোলনের মতোই
তাঁর অধ্যয়নের বাইরে থেকে গেছে।এটি একটি বড় অসম্পূর্ণতা বলেই মনে হয়। হয়তো ভদ্রলোক
সাম্প্রদায়িকতার ‘গোপন রহস্যকে উন্মুক্ত’ করতে গিয়ে সেসবকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে
করেন নি। কিন্তু সবচাইতে বড় যে অসংগতিটি আমাদের নজরে পড়ে, তা এই যে সেই আবিষ্কৃত
‘গোপন রহস্য’টিকে প্রতিহত করবার কোনো দিশা তাঁর মধ্যে দেখি না। পশ্চিম বাংলাতে না
হোক, পূর্বপাকিস্তানের বাঙালি যে ‘দাবার ঘুটি’ হিসেবেই রইলেন সেই সত্যকে অস্বীকার
করা কী করে যাবে? ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধতো তারই পরিণাম। আর যারা উদ্বাস্তু হয়ে এলেন,
কিংবা সেদেশে গেলেন--- তাদের উত্তরসূরিরা তো এখনো পথের সন্ধান করে ফিরছেন। তাদের
তো আর ‘সংখ্যাগুরু’ হয়ে ওঠা হল না। কিন্তু এদেশে আসাদের মজ্জায় মজ্জায় এখনো সেই সব
শরৎ বসুর প্রকল্প বিরোধী ‘ভদ্রলোক’দের শিক্ষা, ‘ভদ্রলোক’দের সংস্কৃতি।
জয়ার ইতিহাসের বহু আগেই দেশভাগের ঠিক পরে পরে প্রবোধকুমার সান্যালের
‘হাসুবানু’ উপন্যাসে উদ্বাস্তু ‘ভদ্রসমাজে’র পালিয়ে আসবার বাস্তবতা এবং মনস্তত্ত্বকে
ধরবার প্রথম একটি প্রয়াস হয়েছিল। সেখানে বহু সংলাপের একটি হিরণের একটি এরকম,“…ক্ষুধার্ত কুকুরের সামনে মাংসখণ্ড ছুঁড়ে দিয়ে বলা চলবে না, আপনি দাতাকর্ণ!ওটা
নিজের সমারোহকে প্রচার করা,সম্পদের আত্মাভিমানকে লোকসমাজে জানানো।এই বদান্যতা আসে
কুৎসিত মনোবৃত্তি থেকে। মধ্যবিত্তের, এরই নাম হোলো বড়মানুষী ফলিয়ে দরিদ্রদের
বিষয়কে জাগিয়ে রাখা। সত্য কথা শুনুন, যাদের নাম ভদ্র সমাজ, তাদের সঙ্গে দেশের
মাটির যোগ ছিল না। তারা জ্ঞান বিতরণ করছে নিজেদের মধ্যে, শিক্ষাব্যবস্থা
রেখেছে নিজেদের সুবিধের জন্য, ইংরেজের
সাহায্যে আইন গড়েছে নিজেদের স্বার্থব্যবস্থা কায়েম রাখার জন্য। কিন্তু পিছন থেকে
রসদ যুগিয়েছে কারা---খোঁজ রেখেছেন তার? কারা যুগিয়ে এসেছে বিলাসের উপকরণ? দেখে
এসেছেন কি তাদের জীবনযাত্রা? তারা যদি দুশোবছরের দুঃখের পর মাথা তুলে দাঁড়ায়, সেটা
কি তাদের মস্ত বড় অপরাধ? জমিদারের দল আর ভদ্রসমাজ---এরা নিজের মাটি ছেড়ে আসার আগে
একবারও কি থমকে দাঁড়াতে পারলো না? একবারও কি এই কথাটা উচ্চারণ করতে পারলো না যে
এতকাল ধরে তোদের নিয়েছি,---আজ এইখানে দাঁড়িয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছি সব?
ধনে,মানে,জ্ঞানে,বিদ্যায়,ঐশ্বর্যে--- এতকাল ধরে তোদেরকে বঞ্চিত রেখেছিলুম---আর তার
জন্যে নতজানু হয়ে তোদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি! একটি বারও কি একথাটা বলতে পারলো
না? বহুকালের অপরাধবোধ যাদের মেরুদণ্ডের মধ্যে ঘুণ ধরিয়ে রেখেছে---আজ বড় আঘাতের
সামনে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি তাদের কোথায়? মানুষের সঙ্গে মানুষের হাত মেলাতে পারিনি
বলেই কি মানুষকে আজ বর্বর বলে গাল দেবো?”
শরৎ বসু-সোহরাওয়ার্দি চুক্তি ঠিক এর জন্যে
গুরুত্বপূর্ণ ছিল না যে এর মধ্যে ‘যুক্তবাংলা’র কথা ছিল। বরং এর জন্যে যে সেই
বাংলাকে যুক্ত রাখবার স্বার্থে তারা জনসংখ্যা অনুপাতে সংরক্ষণের নীতিটি গ্রহণ
করেছিলেন।প্রধান মন্ত্রী
হবেন মুসলমান এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হবেন হিন্দু।স্বাধীন বাংলা হবে
‘সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী।’এরকম ছিল তাদের অবস্থান। (জয়া:২৯৬) ব্রিটিশের প্রস্তাবিত ক্যাবিনেট মিশনেও পরিচিতি এবং
প্রদেশ ধরে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের আরো বিস্তৃত পরিকল্পনা ছিল। জয়া সেই নিয়ে
বিশেষ কিছু লেখেন নি,দেখে মনে হয় তিনি সেইদিক নিয়ে ভাবাটা গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবেন
নি। অথচ, পরিচিতির প্রশ্নকে কাঠামোগতভাবে মোকাবেলার এবং সাম্প্রদায়িক প্রতিযোগিতা
অবসানের এটাই হতে পারে এখনো সঠিক পথ। তার জন্যে ভারতীয় শাসক শ্রেণির
অতিকেন্দ্রিকতার স্বার্থ এবং স্বরূপটি বোঝা এবং তার বিরুদ্ধে লড়াটা জরুরি। বাকি সব
পথই শরৎ চন্দ্র কথিত প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে ‘সঙ্ঘবদ্ধ’তার পথ,‘মিলনে’র পথ নয়।
‘সার্বিক দৃষ্টি’ থেকে সেরকম এক কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসের মধ্য দিয়ে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু
বিবাদের সম্ভাবনার কথা অনেকেই এর পরেও ভেবেছেন,এবং কাজ করেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত
অরূপ বৈশ্যের এমন একটি লেখাতে সেসব বিস্তৃত আলোচিত হয়েছে। (অরূপ:সংখ্যালঘু প্রশ্ন ও ভারতীয় গণতন্ত্র) কিন্তু জনপ্রিয়ভাবনাটি
এখনো সেই সংখ্যাগুরু আধিপত্য বিস্তারেরই।মূলত গ্রুপিং প্রশ্নে আসাম এবং
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বাধার অজুহাত দেখিয়ে কংগ্রেস শুরুতে ক্যাবিনেট
মিশনে সম্মতি জানিয়েও পরে ঘুরে দাঁড়ায়। (শেখর:৫২৮) যার পরেই
শুধু দেশভাগ অনিবার্য হয়ে উঠে। অথচ,সেই গ্রুপিং ব্যবস্থা চূড়ান্ত কিছু ছিল
না।সংবিধানও স্বতন্ত্র রচিত হবার পথ খোলা ছিল।চাইলে অসম নিজের জন্যে স্বতন্ত্র
গ্রুপও দাবি করতে পারত। কিন্তু সমাধান তো সেদিন কেউ চায় নি। অসমিয়া শাসক শ্রেণিরও
তাগিদ ছিল শুধু বাঙালি হিন্দু-মুসলমান আধিপত্যের বাইরে বেরিয়ে নিজেদের
সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠা করবার।
সাম্প্রদায়িকতার
সমাধানটি মতাদর্শগত স্তরেই হয়ে যাবে বহু বিদ্বজ্জনেরও অবচেতনে এমন ভাবনা কাজ করে।
যারা ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’র তথা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র তৃতীয় শিবিরের পরিসর
বাড়াবার কথা ভাবতে থাকেন। সুজিৎ চৌধুরীর পূর্বোক্ত প্রবন্ধটি সেরকম এক অবস্থান
থেকে লেখা হয়েছিল। সেখানে সাম্প্রদায়িকতাকে তিনি ‘নিশ্চতই বহুরূপী’ বললেও তাঁর
উৎসের সন্ধানে পুরাণ মহাকাব্য অব্দি পৌঁছেছেন। এবং ইতিহাস জুড়ে সংঘাত সমন্বয়
সন্ধান করেছেন। যদিও তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে এই প্রবন্ধেরও ‘ছক’কে প্রাথমিক এবং
‘শূন্য স্লেটে দাগপড়া ভাল’ বলে লিখেছেন (সুজিৎ:৭০) এবং
লিখেছেন,“অন্যতর তত্ত্ব ও তথ্যের সাহায্যে সেগুলো খণ্ডন করাও সম্ভব। (সুজিৎ:৭০) তিনিও লিখেছিলেন,“ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশ- পর্বে
হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার প্রাধান্য সকল বিশ্লেষণেই পাওয়া যায়। কিন্তু তার অর্থনৈতিক
ভিত্তি কী ছিল সেই সম্পর্কে কোনও বক্তব্য চোখে পড়ে না।” (সুজিৎ:৩৭) তিনি সেই ভিত্তি সন্ধানের চেষ্টা করেছেন এবং ‘হিন্দু’
পুঁজি, ‘মুসলিম’ পুঁজি গড়ে উঠবার প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেছেন। এবং অন্য সবার আগেই
যে বিড়লারা ১৯২৭এই দেশভাগের কথা ভাবছিলেন বেশ সতথ্য আলোচনা করেছেন।(সুজিৎ:৫৭) কিন্তু তারপরেও তিনি লিখেছেন,“ধর্ম যখন রাজনীতিকে
নিয়ন্ত্রণ করে তখন তাকে সাম্প্রদায়িকতা বলা হয়। তাই সাম্প্রদায়িকতার সূত্র ধরেই
দেশভাগ হলো” (সুজিৎ:৬৫) ফলে তাঁর
পক্ষে সম্ভব ছিল না জয়ার মতো ‘সংস্কৃতি’ নামে
কোনো ‘গোপন রহস্য’ উন্মোচন করবার,যার সঙ্গে সরাসরি ধর্মবিশ্বাসের অন্তত
সংযোগটি আবশ্যিক নয়। এই ছকে ‘হিন্দু-মুসলমান’ সাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে
‘ধর্মনিরপেক্ষ’ তৃতীয় পক্ষের সন্ধান করে ফেরাটা আবশ্যিক হয়ে পড়ে। তাঁর নিবন্ধে
‘প্যান-ইসলামে’র তত্ত্বটি এমন এক ধারণার উপরেই দাঁড়িয়ে আছে, যে কিনা আরব থেকে আমদানি
একটি ‘ভাবধারা’। যে ‘ভাবধারা’ যে কোনো ধরণের ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ভারতীয় মুসলমানদের
মানসিক বিচ্ছেদের ব্যাপারটিকে সতত সক্রিয় রাখবার কাজ করে। (সুজিত:৪৪) । এবং স্বাধীনভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ‘মুসলিম পুঁজি’
বিশেষ ভূমিকা না রাখতে পারলেও ‘প্যান-ইসলাম’ মৌলবাদের শক্তি বাড়ায়। (সুজিত:৪৪) এই তত্ত্ব আসলে মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার পেছনে বিদেশী
মদতের হিন্দুত্ববাদী ব্যাখ্যাকেই শক্তি যোগায়।এর থেকে মুসলমান কেন এবং কখন
সাম্প্রদায়িক হয়,সোহরাবর্দি মতো প্রায় নাস্তিকেরও কেন মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার
দরকার পড়ে সেই প্রশ্নে জয়ার ব্যাখ্যা অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য। সুজিত চৌধুরীর এই ছকে তার পরেও ফজলুল হকের
প্রয়াসগুলো খুব কম স্থান পায়,শরৎ বসু প্রকল্প প্রায় অনুল্লেখিতই থাকে।ক্যাবিনেট মিশন--
যার মধ্যে পরিচিতির সমস্যা সমাধানের বহু বীজ ছিল-- সেসব ছুঁয়ে দেখা কঠিন হয়ে পড়ে।পরিচিতি
নিরপেক্ষ শ্রেণিমৈত্রীর সন্ধানটি তিনি চল্লিশের দশকে বাংলাতে কম্যুনিস্টদের
সংগ্রামের মধ্যে পান বটে। কিন্তু জয়ার মতো সেটিও বিস্তৃত ব্যাখ্যার বাইরেই থেকে
যাওয়াতে, তারও ব্যর্থতার কোনো কারণ বুঝে উঠা কঠিন হয়। শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো
সাম্প্রতিক কিছু গবেষকেরা কিন্তু শ্রমিক কিংবা কৃষক আন্দোলনেও পরিচিতির প্রশ্নটিকে
অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িয়ে থাকতে দেখেছেন। এক সময়ে যারা তেভাগার জন্যে লড়ছে, আর সময়
তারাই সাম্প্রদায়িক সংঘাতে জড়াচ্ছে। শেখর লিখেছেন,“শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের ধারণা
কৃষক চেতনার ও সত্তার মধ্যে এতো নিবিড়ভাবে নিহিত ছিল যে বিশ্লেষণ করে এই
ধারণাদুটিকে একে অপর থেকে আলাদা করা কঠিন।” (শেখর:৫০৯) দলিত-জনজাতি
প্রশ্নটি আগাগোড়াই সুজিত চৌধুরীর ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। ফলে যে শ্রমিক-কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে ‘ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরে’র
বিস্তার বেড়ে যাবার কথা, তাদের পরিচিতির প্রশ্নটির একটি ‘হিন্দুত্ববাদী’ সমাধান
দিয়ে ভদ্রলোকেদের পক্ষে অসম্ভব হয় না নিজেরা সংখ্যাগুরু হয়ে উঠবার। এবং সাম্প্রদায়িক
স্থিতাবস্থা সুরক্ষিত করবার।
ধর্মনিরপেক্ষতাকে
দেখবার নজরও আমাদের পুণঃপরীক্ষা করা দরকার। শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন,
জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডের মতে ১৯২০এর দশকে কংগ্রেসে ধর্মকে ব্যক্তিগত স্তরে সরিয়ে দিয়ে
ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে অবৈধ বলবার একটি প্রবণতা দেখা দিয়েছিল। সম্প্রদায়ের কথা
তুললেই নেহরুর মত অনেকে একে জাতীয়তাবাদ বিরোধী বা সাম্প্রদায়িক বলতেন। ফল হয়েছিল
এই--কংগ্রেসের সঙ্গে মুসলিম লীগের সমঝোতার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাতে
হিন্দু মহাসভার কোনো অসুবিধে হয় নি কংগ্রেসের কাঠামোর মধ্যে কাজ করবার এবং
ধর্মনিরপেক্ষদের কোণঠাসা করবার,সেই সঙ্গে মুসলমানের সঙ্গে যেকোনো সমঝোতাকে নষ্ট
করবার।(শেখর:৩৯৭-৯৮)
সেই পরম্পরা এখনো সমানে চলছে কেন---সেই প্রশ্নটি না করে ভারতবর্ষে
‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শক্তির বিস্তার বাড়ানো যাবে, এবং সমস্ত ধরণের সংখ্যালঘুদের, চাই কি আসামের মতো প্রদেশে তাবৎ ভাষিক সংখ্যালঘুর স্বার্থ আজকের
দিনেও পাকাপাকি সুরক্ষিত করবার পথ প্রশস্ত হবে বলে, অন্তত শিলাপাথার কাণ্ডের
পরে,আমরা বিশ্বাস করি না।
তথ্যসূত্র:
১) জয়া
চ্যাটার্জি:বাঙলা ভাগ হল; Bengal Divided -এর বাংলা অনুবাদ; অনুবাদক আবু
জাফর; দি ইউনিভার্সিটি
প্রেস লিমিটেড; ঢাকা; ১০০০; ২০০৭
২) ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস: ল্যুডভিগ ফয়েরবাখ এবং চিরায়ত জার্মান
দর্শনের অবসান;মার্কস
এঙ্গেলস ধর্ম
প্রসঙ্গে; প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮১।
৩) শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়:শরৎ রচনা সমগ্র অখণ্ড সংস্করণ; সম্পাদক সুকুমার
সেন; আনন্দ
পাবলিশার্সস
লিমিটেড; কলকাতা-০১;১৩৯২ বাং।
৪) শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: মুসলিম সাহিত্য-সমাজ:http://www.sarat-
৫) সুজিত চৌধুরী:ধর্ম, রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িকতা: উৎস ও পটভূমি;প্রবন্ধ একাদশ; সম্পাদনা
জয়দীপ বিশ্বাস; অক্ষর পাবলিকেশনস; আগরতলা; ২০১০।
৬) বাণীপ্রসন্ন মিশ্র:যদি, কিন্তু ও সুতরাং:দেশভাগের কথকতা; দেশভাগ-দেশত্যাগ--প্রসঙ্গ
উত্তর-
পূর্ব ভারত ; সংকলন ও
সম্পাদনা--প্রসূন বর্মণ; ভিকি পাবলিশার্স; গুয়াহাটি;২০১৩।
৭) পার্থ চট্টোপাধ্যায়:বাংলাতে হিন্দু নেতারাই চাইলেন যে, ভারতবর্ষ ভাগ হলে
বাংলাকেও ভাগ
৮) শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়:পলাশি থেকে পার্টিশন--আধুনিক ভারতের
ইতিহাস; ইংরেজি থেকে
অনুবাদ কৃষ্ণেন্দু
রায়; অরিয়েন্ট লংম্যান
প্রাইভেট লিমিটেড; ২০০৬; পুনর্মুদ্রণ ২০০৮।
৯) মুজিব স্বদেশি:বাংলা সাহিত্যে বঙ্গভঙ্গ ও দেশভাগ; সোপান পাবলিশার; কলকাতা -৮৪;
২০১৫।
১০) অরূপ বৈশ্য:সংখ্যালঘু প্রশ্ন ও ভারতীয় গণতন্ত্র;আমাদের সমকাল; সম্পাদক
স্নিগ্ধা নাথ; শিলচর; ডিসেম্বর , ২০১৭; পৃ:০২।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন