।। সুদীপ নাথ।।
(C)Image:ছবি |
শিল্পকলা আমাদের এবং
আমাদের সন্তান-সন্ততিদের গভীর এবং সূক্ষ্মভাবে সবকিছু দেখতে শেখায়। কিন্তু
শিল্পকলা উপলব্ধির জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তুতিরও প্রয়োজন আছে। ঠিক সেই জন্যেই
আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বোধশক্তি গড়ে তোলা উচিৎ। সৌন্দর্য উপলব্ধি করার প্রকৃতি
প্রদত্ত মহা মূল্যবান এই ক্ষমতাটি বিকশিত করা উচিৎ। মানুষের সৌন্দর্য বোধ বিকাশ
করা এমন এক বিষয়, যাতে
ওতপ্রোতভাবে একদিকে জড়িত রয়েছে,
শিল্পকলা
বিষয়ক বিজ্ঞান তথা কান্তিবিদ্যা,
আর অপরদিকে
জড়িত রয়েছে নৈতিকতা বিষয়ক,
সমাজের
সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের বিধি বিষয়ে,
শিক্ষা তথা
নীতিবিদ্যার সমস্যাগুলো।
শিশুদের
কান্তিগত শিক্ষার বিষয়ে যখনই কথা উঠে,
তখনই আমরা
সাধারণত কল্পনা করি, বা আলোচনা
সীমাবদ্ধ রাখি, আর্টের স্কুল, নাচের স্কুল, কোনও
স্টুডিও বা আবৃত্তি নাটক গান বাজনা ইত্যাদি শেখানোর স্কুল আর কলাভবনের মধ্যেই বা
প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে তালিম নেয়াতেই। এই সমস্ত প্রতিষ্ঠান নিঃসন্দেহে
ছেলেমেয়েদের সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে শেখায়। এই সমস্ত প্রতিষ্ঠান অবশ্যই শিল্পকলার
সংস্পর্শে আসার অপূর্ব এক উপায় এবং শিল্প-রুচি গড়ার ভালো মাধ্যম।
কিন্তু যারা
এই সকল প্রতিষ্ঠানে যায় না,
যাদের মা-বাবারা
ঘন ঘন যাদুঘর ইত্যাদিতে নিয়ে যায় না,
যারা
সারাক্ষণ টিভির সামনে বসে থাকে,
কেউ গেইম আর
কার্টুনে সময় নষ্ট করে,
আর বই পড়ে
বাছ-বিচার ছাড়া, তাও আবার
পড়াশুনা কম করে, তাদের নিয়ে
কি করা ? যাদেরকে
গান-বাজনা, বই, যাদুঘর এসব
এখনও আকৃষ্ট করছেনা, তাদেরই বা
কি গতি হবে ? তাদেরও তো
কান্তিগত শিক্ষার প্রয়োজন আছে। এবং তা মোটেই উপেক্ষণীয় নয়।
সরকারি
বেসরকারি উদ্যোগে প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যে ক্লাস ইত্যাদি রয়েছে। তারা যাতে সহজে
শিল্পকলার জগতে প্রবেশ করতে পারে তার জন্য কোথাওবা, বিশেষ কম্পিউটার বা নেট কর্মসূচিও চালু রয়েছে। কিন্তু এই
সমস্ত উদ্যোগ উপর উপরই কাজ করে। এসব প্রচেষ্টা সমস্ত ছেলেমেয়েদের উপর, কার্যকরী
প্রভাব বিস্তার করতে পারেনা,
যতক্ষণ না, মা-বাবারা
বিষয়টিতে আগ্রহী হয়ে এগিয়ে আসেন। উপরন্তু তারা ছেলেমেয়েদের এসব বিষয়ে প্রতিযোগিতায়
ঠেলে দেন। ফলে শিল্প চর্চা প্রায় সবার ক্ষেত্রে, এক বিরক্তিকর আর ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার মাধ্যম হয়ে
উঠে। তা হয়ে উঠে পণ্য।
তাই আসুন, সৌন্দর্যের
সংস্পর্শে আসার ব্যাপারে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের কীভাবে সাহায্য করতে পার তা নিয়ে
খোলাখুলি আলোচনা করি।
ধরুন একটি
বাড়ির সামনে, বালির
স্তূপে একটি ছেলে বালির দুর্গ,
প্রাচীর আর
শহর গড়ছিল। রাস্তার লোকজন দাড়িয়ে দাড়িয়ে তা দেখছিল এবং হাসি মুখে তার প্রশংসা
করছিল আর বলছিলো- বাঃ চমৎকার,
তুমি যে
দেখছি একেবারে উস্তাদ স্থপতি,
তোমার কাজটা
দস্তুরমত এক শিল্প রচনা ইত্যাদি। তখন হঠাৎ ছেলেটির বাবা এসে তারিফ শুনে ছেলেকে বললেন:
- বাড়ি চল এখন, অনেক হয়েছে।
আর শিল্প গড়তে হবেনা। ওসব ছাড়াই চলে। আগে পড়াশুনা কর মন দিয়ে। মা ভেবে মরছে, আর তুই কিনা
এখানে ধুলো-বালি ঘাটছিস।
পিতা কিন্তু
ঠিকই বলেছেন যে, সময় মত
ইস্কুলের পড়া-লেখা তৈরি করা দরকার। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি ভুলও করেছেন। কারণ
শিল্পকলা ছাড়া মানুষের পক্ষে জীবন যাপন করা একপ্রকার অসম্ভব। লেখকেরা তাদের
ডায়েরিতে তাদের জন্মভূমির মাটিতে,
বিদেশ ভ্রমণে, বনে
প্রান্তরে ঘোরার সময়, জীবনের
প্রতিটি মৃদু এবং সূক্ষ্মতম অনুভূতির কথা লিখে রাখেন, অনেকে
স্মৃতির মণিকোঠায় ধরে রাখেন। এই সমস্ত সংক্ষিপ্ত বর্ণনার ভিত্তিতে, তারা রচনা
করেন অপূর্ব সব কাব্যিক,
সাহিত্যিক
গ্রন্থ। কার জন্য তারা ডায়েরি লিখেন?
পাঠকের জন্য, হ্যাঁ অগণিত
পাঠকের জন্য, যাদেরকে
তারা চিনেন না। একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখকের ভাষায় (পাঠকের বিষয়ে
বলেছেন)-“আমি নিজে
তাকে দেখিনা, কেবল জানি
যে সে আছে। সে আছে, এবং আমি
লিখছি, কেবল লিখছি, আর তার মানে
আমি তাদেরকে ভালোবাসি, তাই লিখছি”।
কিন্তু
মানুষের জন্য, ছোট এবং
বড়দের জন্য, লেখক-শিল্পীদের
সৃষ্টিগুলো কী করতে পারে ?
লেখকের কথাগুলো
আমাদেরকে বিশ্বকে আবিষ্কারের ক্ষমতা দিয়ে ভূষিত করতে পারে। কিন্তু আপনারা প্রশ্ন
তুলতে পারেন আমাদের এত আপন,
এত পরিচিত
পৃথিবীকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করার প্রয়োজন আছে কি ? আমরা তো
প্রতিদিনই তার দিকে তাকাই।
তাকালেই যে
দেখা হয়, এমন ধারণাটা
সঠিক নয়। লিও তলস্তয়, ম্যাক্সিম
গোর্কি, গ্যাটে এবং
অন্যান্যরা যেখানে আমাদের সামনে অমূল্য সম্পদের জগৎ উদঘাটন করেন, সেখানে কোনো
উদাসীন ব্যক্তি কোনকিছুই লক্ষ্য করবে না এটাই স্বাভাবিক। পারিপার্শ্বিক সমস্ত কিছু
দেখটাও শেখাতে হয় এবং তা অতি অল্প বয়সেই শেখানো দরকার। তাদের অনুসন্ধিৎসু করে গড়ে
তোলার কাজটি মা-বাবা ছাড়া কে করবে ?
ছেলে-মেয়েদের পড়তে, শুনতে, তাকাতে এবং
দেখতে শেখানো মা-বাবারই কর্তব্যের বিষয়। এই কর্তব্যগুলো আমাদের সামনে অর্থাৎ
মা-বাবা, গুরুজন আর
শিক্ষকদের সামনে উপস্থিত করে খোদ আমাদের জীবন। এই কথাটা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, পরিবারে
সান্ধ্যকালীন পড়াশুনা, একসঙ্গে
যাদুঘর দেখা এবং প্রদর্শনী বা মেলায় যাওয়া শিশু, বালক-বালিকা আর কিশোর-কিশোরীকে অনেক কিছুই দেয়। বিভিন্ন
সামগ্রী সংগ্রহ করতে গিয়ে ছেলেমেয়েরা শিল্পকলারও সান্নিধ্যে আসে। নিজের
সৌন্দর্যবোধও বিকশিত করে তুলে। কিশোরদের জন্য লিখিত হয় পঠন-কলা বিষয়ক বই; চিত্রকলা, কাব্য, কবিতা, গান, সঙ্গীত, স্থাপত্য আর
থিয়েটার বিষয়ের বই। ভাল ভাল লেখক আর নাট্যকারদের রচনাবলী মঞ্চস্থ করা হয়, টিভির
মাধ্যমে বিশেষ পাঠ্যসূচি প্রচার করা হয়। তাছাড়া আছে মহান সুরকারদের অমর রচনা
সম্বলিত রেকর্ড/টেপ/সিডি যাতে সুর দিয়েছেন সেরা গায়ক আর শিল্পীরা এবং বিখ্যাত অর্কেস্ট্রাগুলো।
শিল্পীরা
তাদের সারা জীবনের কঠোর শ্রম এবং সাধনার মাধ্যমে তাদের রচনায়, আমাদের জন্য
এবং আমাদের সন্তান-সন্ততিদের জন্য যা কিছু রেখে যান, তা আমাদের ছেলেমেয়েদের গ্রহণ করতে সহায়তা করার মানেই হচ্ছে
তাদেরকে সৌন্দর্যের জগতে নিয়ে যাওয়া। এই সমস্ত ব্যাপারে মা- বাবারা তাদের
ছেলেমেয়েদের বিশেষভাবে সাহায্য করতে পারেন।
শিল্পকলা
ছাড়া মানুষের পক্ষে জীবন যাপন করা একপ্রকার অসম্ভব। শিল্পকলার জন্ম হয়েছে এইজন্যে
নয় যে, কোনও একজন
মানুষ হঠাৎ করে তা উদ্ভাবন করেছে ,
আর তার
ইচ্ছে না থাকলে সে তা উদ্ভাবনই করতো না। ব্যাপারটি আসলে তা নয়। শিল্পকলার জন্ম
হয়েছে এইজন্যে যে, তা
মানবজাতির পক্ষে শুধু প্রয়োজনীয়ই নয়,
অপরিহার্যও
বটে। তা হচ্ছে নিজেকে আর বিশ্বকে আবেগ সহকারে প্রকাশের উপায়। শিল্পকলা আমাদের
জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই জুড়ে থাকে এবং বিভিন্ন আকারে ও বিভিন্নভাবে অভিব্যক্তি
লাভ করে। কান্তিগত চিন্তা,
সৌন্দর্যের
ধারণা এবং সৌন্দর্যের প্রয়োজনীয়তা আমাদের জীবনে বদ্ধমূল হয়ে আছে। সৌন্দর্য অনুভব
করা করার এবং সৌন্দর্য সৃষ্টি করার ক্ষমতা হিসেবে শিল্পকলা এমনকি কাজের সময়ও
আমাদের সঙ্গে থাকে।
যে মানুষের
আত্মিক জগত রিক্ত, সে
সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করতে সক্ষম নয়। জীবনের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি খুবই সেকেলে এবং
নিঃস্ব। তাই সমস্ত মা-বাবাদের কর্তব্য হবে,
ছেলেমেয়েদের
এরূপ আত্মিক বধিরতা থেকে রক্ষা করা,
খোলামনে
তাদের সৌন্দর্যকে বুঝতে ও উপলব্ধি করতে শেখানো।
উদাসীন বা
আবেগ শূন্য ব্যক্তি, কাউকে রক্ষা
করতে বা কোন কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। সে কেবল ধ্বংস করতেই পারে। তবে তা
সর্বদা যে ক্ষতি সাধনের ইচ্ছার বশবর্তী হয়েই করে, তা নয়,
প্রায়শই তা
এমনিতেই। অনেক সময় সে জানেই না যে,
সে জীবনের
সৌন্দর্য বিনাশ করছে। সেই জন্যই বৃদ্ধ লেখকরা তাদের রচনার উদ্দেশ্য হিসেবে বেছে নেন, উদাসীনতার
বিরুদ্ধে সংগ্রাম। কাব্যের মাধ্যমে নিজস্ব জীবনের প্রতিটি ঘটনা লেখকের কলমে, বা শিল্পীর
তুলিতে নিজস্ব এক অনুপম বৈশিষ্ট্য লাভ করে।
সৌন্দর্য
উপলব্ধির ক্ষমতা হচ্ছে প্রকৃতি প্রদত্ত একটি গুণ। তা রক্ষা করা এবং বিকশিত করা
উচিত যাতে, যে কোন
ক্ষেত্রেই তার ফলপ্রসূ ব্যবহার করা সম্ভব হয়। অথচ এটাই এখন একটা ফ্যাশন হয়ে দেখা
দিয়েছে যে, শৈশবস্থায়
যে যত বেশি পারো, প্রতিযোগিতায়
মেতে উঠো। এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ছেলেমেয়েদের শৈল্পিক দৃষ্টি ভঙ্গি গুরুতর
বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে। শিল্পচর্চা নিয়ে প্রতিযোগিতা, সৌন্দর্য
উপলব্ধির ধারণাটাকেই নস্যাৎ করে দেয়। ইতিমধ্যেই যাদের মধ্যে এই ধারণা বিকশিত হয়েছে, যতটুকুই হোক, তা বিপর্যস্ত
হয়। এর মুখ্য কারণ কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক। যারা এতে অংশ নেয় তাদের মুষ্টিমেয়
কয়েকজনকে পুরস্কৃত করা হয়। অতি অল্প বয়েসে এইসব পুরষ্কার যারা পায় না, তারা
নৈরাশ্যের শিকার হয়। তারা শিল্প চর্চাকে যান্ত্রিক ভাবেই গ্রহণ করে। তারা উৎসাহ
হারায়। এভাবেই মা-বাবারা তাদের সন্তানকে শিল্প চর্চার প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে বঞ্চিত
করে। বিপরীতে যারা পুরষ্কার পায়,
তারাও মনে
করে, তাদের
শিল্পকর্মটি যথাযথ হয়েছে। ফলত নিজের কাজে আরও সমৃদ্ধ হবার বাসনা তারা ত্যাগ করে।
এভাবেই আমাদের বিভিন্ন সংস্থা ও সরকারী কর্তৃপক্ষ সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি করে যাছে।
এসব দেখার দেখার নেই।
এখানে বই
পড়া সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই,
যদিও পড়ার
বিজ্ঞান সম্মত নিয়মাবলী নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে কম। কথাটা হল, অনেকে বলে
থাকেন শিশুদের জন্য লেখা বইয়ে ভাল নায়ক নায়িকা থাকতে হবে, যাতে
বাচ্চারা তাদেরকে নিজেদের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করতে পারে। এইসব বই নাকি ছেলেমেয়েদের
মানুষ করে তোলে। কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক-দার্শনিকেরা বলেন, বই তখনই
ছেলেমেয়েদের মানুষ করে,
যদি তাতে
শিল্পীয় গুণাবলী থাকে, যদি তাতে
রচয়িতার উচ্চ নৈতিক মতাবস্থান থাকে। তখন এমনকি আদর্শ নায়ক বা নায়িকা না থাকলেও ক্ষতি নেই। মনে রাখতে
হবে ললিত সাহিত্য বিশেষ নিয়মাবলীর সংকলন নয়।
আবার, কখনও এমনও
বলতে শোনা যায় যে, যারা বই
ভালবাসে তারা নাকি খুব ভালো লোক। বই পড়ার প্রতি প্রবল আকর্ষণের জন্যে, মানুষ যদি
তার দায়-দায়িত্ব ভুলে যায় এবং আশেপাশের লোকজনের প্রতি উদাসীন থাকে, সেটা ক্ষমার
অযোগ্য বলতে বাধা কোথায় ?
মানুষকে মহৎ
করে পড়ার প্রক্রিয়া নয়,
মহৎ করে এই
প্রক্রিয়ার ফল। এবং অবশ্যই তখনই,
যদি তা
যথেষ্ট উজ্জ্বলভাবে প্রকাশ লাভ করে তার আচরণে, মানুষের প্রতি এবং কাজের প্রতি মনোভাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন