(লিখেছিলাম খেয়ালের বশে ব্লগের জন্যেই। তিনসুকিয়ার কবি-কথা শিল্পী বন্ধু, যে কিনা নাট্যকর্মী এবং সাংবাদিকও, নীলদীপের মনে হলো এটি ছাপানো দরকার। চুপি চুপি পাঠিয়ে দিল দৈনিক যুগশঙ্খ কাগজে। এটা জানিয়েই যে আমার লেখা। সম্পাদনা দফতর ঘটালো বিড়ম্বনা। ছেপে দিল ওর নামে। ১৯ জুন, গুয়াহাটি সংস্করণে , ৫এর পাতায়। আমরা ছবিতে নাম সম্পাদনা করে দিয়েছি।)
দৈনিক যুগশঙ্খে প্রকাশ পেল। |
চন্দন সেনের নাটক। বলাকা
বলছেন অমিতাভ চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত নাটক। সম্ভবত সেটি সামান্য অতিরঞ্জন। তিনি দিন
পনেরো কলকাতা থেকে এসে প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছেন। তার আগে পরে বলাকার হয়ে পরিচালনা
নিশ্চয় অন্য কেউ করেছেন। বলাকা নাম বলেন নি। উপলক্ষ ছিল ‘বর্ণালি শিশু কল্যাণ
সংস্থা’র ষটত্রিংশতি বার্ষিকী। প্রথম দিন। ১৭ জুলাই, ২০১৭। জেলা-গ্রন্থাগার মঞ্চ। গল্পটি নাগরিক মধ্যবিত্ত
মূল্যবোধের গল্প। ভদ্রলোক স্বাভিমান সংস্কৃতির স্বরূপ উন্মোচনের গল্প।
লরি চালক গগনের স্ত্রী সীতা
কন্যা ঝিনুককে নিয়ে ছোট্ট সংসার। চালকের সহকর্মী জীবনও এই পরিবারেরই একজন। গগন
সীতার সঙ্গে দাদা –বৌদি সম্পর্ক। ঝিনুক পড়ে কলেজে। মেধাবী ছাত্রী। সামনে পরীক্ষা।
তারপরেই ওকে পাত্রস্থ করা নিয়ে মায়ের চিন্তা। বাবার ভাবনা ও আরো পড়বে, নিজের পায়ে
দাঁড়াবে। এই নিয়ে সংঘাত। লরি চালকের স্ত্রীর আভিজাত্যবোধ নাটকের শুরু থেকেই দর্শক
মনে কৌতূহল জাগায়। চালক এবং তার সহকর্মীর মুখের অভদ্র শব্দাবলী, বাকভঙ্গী, মদ
পানের অভ্যেস তার পছন্দ নয়। যে দরিদ্র পাড়াতে থাকে, সেই পাড়ার বাস উঠিয়ে যাবার শখ
সীতার পুরোনো। এ পাড়ার লোকেরা পরনিন্দা পরচর্চার বেশি কিছু জানে না। তাদের ‘কালচার’
বলে কিছু নেই। তার কিছুটা যে মেয়ে ঝিনুকেও বর্তায় নি তা নয়। তবে বাবার সঙ্গে তার
ভালো বনিবনা। বান্ধবী প্রায় হয়ে উঠেছে। মায়ের কঠিন শাসন, বাবার অনাবিল প্রশ্রয়ের
দোলাচলে তার বেড়ে উঠা।
অথচ সেই সীতাই মেয়েকে বিয়ে
দিয়ে কন্যাদায় মুক্ত হতে চায়। স্বল্পশিক্ষিত বাবা চায় মেয়ে লিখুক পড়ুক বড় হোক। এই
হলো নাটকে সংঘাতের জায়গা। তার সঙ্গে জুড়েছে দেবু আর ঝিনুকের গল্প। ঝিনুককে বাড়ি
এসে পড়াতো দেবু, তাতেই প্রেম। এবং তাঁকে মেয়ের বর হিসেবে পাবার জন্যে সীতার
স্বপ্ন। কিন্তু সমস্যা হলো দেবু চাকরির
সন্ধানে ঘুরছে। বয়স পার হতে চলেছে। শেষমেশ উপায় একটা হচ্ছিল, কিন্তু তার জন্যে উপর
মহলে যোগাযোগ এবং প্রচুর টাকা চাই। সেই টাকা যে বাবার থেকে সংগ্রহ করে দিতে
ঝিনুককে বলে। ঝিনুক টাকা দিয়ে চাকরি নিতে মানা করে। এবং সে মনে করে যে বাবা তাদের
সম্পর্ককেই মেনে নেননি , তিনি টাকার কথা শুনলে আরো গররাজি হবেন। হলোও তাই।
কিন্তু সীতা দেবুকে টাকা
দেবার জন্যে এক কথাতে রাজি। এই নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে যখন সংঘাত বাঁধছিল তখন দর্শক
মনে প্রত্যাশা জাগে যে দেবন প্রতারণা করবে, আর তাতে সীতার চোখ খুলবে এই সরল রেখাতে
গল্প এগুবে। কিন্তু তা হয় নি।
গগন সীতার তর্ক এবং বিবাদ
এই পর্যায়ে গেল যে এক সময় সীতা গগনের বিরুদ্ধেই মেয়েকে প্রতারণা করবার অভিযোগ আনল।
মধ্যবিত্ত সংস্কার এতোটাই গভীর ছিল যে লরিচালকের পিতৃস্নেহকেও সে আঠারো বছর এক
সঙ্গে সংসার করেও সম্মান জানাতে শেখেনি। মন থেকে স্বামী হিসেবে গগনকে গ্রহণ করে নি সেই
কারণেই। সে আসলে স্বামী পরিত্যক্তা
স্ত্রী। পেশায় তার পূর্ব স্বামী অন্য এক শহরের চিকিৎসক। অভিনেতারা বলে গেছেন
শিলচর। মনে হয়েছে , এটি তাদেরই কল্পনা। গল্পকে অসমের সঙ্গে জুড়বার জন্যে করেছেন। মূল নাটকে অন্য কোনো শহর নাম থাকাই সম্ভব। শিশু কন্যা নিয়ে সীতা গেছিল রেলের চাকার তলায়
প্রাণ দিতে। গগন তখন তাঁকে বাঁচিয়ে আনে,
আশ্রয় দেয়---স্বামী স্ত্রীর মতো ঘর করে। কিন্তু বিয়ে থা করে নি তারা। সেই গগণ কিনা
কন্যাসমা ঝিনুককে নিজের কাছে রেখে দেবার জন্যেই বিয়েতে রাজি হচ্ছে না, সেরকমই সংশয়
সীতার।
এই কথাগুলো যখন দু’জনের
বিবাদে মেয়ের সামনে বেরিয়ে গেল, স্বাভাবিক ভাবেই গগণ এবং ঝিনুক ভেঙ্গে পড়ল। গগণ দেবুকে
পণ তথা ঘুসের জন্যে টাকা দিতে রাজি হয়ে গেল। আর ঝিনুক বিষ খেলো।
বিয়ে থা না করে একসঙ্গে ঘর
করবার কথা পাড়ার লোকেরাও জেনে গেলে তারা পাড়া ছাড়বার চাপ দিয়ে নিরঞ্জন মাস্টারকে পাঠাল।
যে মাস্টার নিজেও কিনা বিবাহ বিচ্ছিন্ন বহুদিন। সমাজ সংস্কার আইন তাঁকে সুখী
গৃহকোণ দিতে পারে নি---তাই সীতাও জানালো সে পাড়া ছেড়ে যাবে না। এতোদিন যাকে নিয়ে
ঘর করেছে তাকে নিয়েই প্রতিরোধ করে দাঁড়াবে। পরিবারের ভেতরকার সংগ্রামের নিষ্পত্তি
হল তো বটে, প্রতিবেশের সঙ্গে আসন্ন আরো এক বড় সংগ্রামের বার্তা দিয়ে নাটক শেষ হয়ে গেল।
প্রায় ঘণ্টা দুয়েকের নাটক।
হল যদিও ভর্তি ছিল না, কিন্তু যেটুকু ছিল পলক না ফেলে নীরব মুগ্ধতা নিয়ে সেই নাটক
দেখেছে এই দাবি করা যেতেই পারে। এই মুগ্ধতা নাটকের গল্পের জন্যে নয়, সেটি নিশ্চয়
আছে। কিন্তু গল্প বলবার এবং দেখাবার বলাকার উপস্থাপনাই আসলে দর্শককে বসিয়ে রাখতে সফল হয়েছে।
এমন এক নাটক মঞ্চস্থ করতে ‘বলাকা’কে
ডাকবার জন্যে, মঞ্চ দেবার জন্যে বর্ণালী ধন্যবাদার্হ হয়ে থাকবে। অন্যথা, এরা প্রতিবছর
এমন বার্ষিক অনুষ্ঠান করেন বটে কিন্তু পশ্চিম বঙ্গীয় শিল্পী এনেই ‘আকর্ষণীয়’ করে
ফেলবার মোহ থেকে যেন বেরোতে পারেন না। এবারে সেটি করে একটি সামাজিক দায়ের পরিচয়
দিলেন। আশা করছি, দর্শককে মুগ্ধ করতে পেরে বলাকাও অনুপ্রাণিত হলো। কিন্তু যারা
দেখলেন, তারাও অনুপ্রাণিত হলেন। তাদের মধ্যে তিনসুকিয়ারও বহু নবীন প্রবীণ অভিনেতা
অভিনেত্রী পরিচালক ছিলেন। যারা এককালে হয়তো ভালো নাটক করতেন, এখন আর করছেন না
তারাও পুনরুজ্জীবিত হবেন, আর এখন যারা করছেন তারাও আরো নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে
অনুপ্রাণিত হবেন।
গগনের ভূমিকাতে মৃদুল চক্রবর্তী
এবং সীতার ভূমিকাতে শান্তা ভট্টাচার্য অনবদ্য ছিলেন। দেবু এবং ঝিনুকের ভূমিকাতে
বিদ্যুৎ রক্ষিত এবং প্রান্তিকা ভট্টাচার্যের অভিনয় প্রশ্নাতীত। নিরঞ্জন মাস্টার সামান্য
সময়ের জন্যে দুবার এলেও অভিনয় ছিল ঋজু। তেমনি বাড়ির কাজের ঝি সন্ধ্যার ভূমিকাতে কেয়া
মণ্ডলও দুবারই এসে নজর কেড়েছেন। জীবনের
ভূমিকাতে অভিজিৎ গুহও প্রায় পুরো নাটক জুড়েই মঞ্চে ছিলেন। তিনি এবং কেয়া মণ্ডল
সামান্য অতি-অভিনয় করেছেন বলে মনে হল, তেমনি দেবুর চরিত্রে বিদ্যুৎ রক্ষিতের যেন
আরেকটু প্রাণ সঞ্চারের সুযোগ ছিল। কিন্তু পুরো নাটক যেভাবে উৎরে গেছে তার সামনে
এগুলো সামান্য ত্রুটিই বলতে হবে। সেরকম আরো দুই একটি ত্রুটিও নাটকের গতির তোড়ে মনে
হয় দর্শক মেনে নিয়েছেন। আলো শব্দ এবং মঞ্চের অলঙ্করণও বলতে গেলে ছিল সুসমঞ্জস। নিখুত
উচ্চারণ এবং সংলাপ নিক্ষেপ সম্ভবত একেবারে পেছনের সারিতে বসা দর্শকও উপভোগ করেছেন।
দেখতে
দেখতে যে কথাটা ভাবছিলাম,
অভিনেতাদের প্রায় প্রত্যেকেই ডিগবয়ের সুপরিচিত বাচিক শিল্পীও বটে। বাচিক
শিল্পের সঙ্গে
নাটকের সংলাপ নিক্ষেপ সম্পর্কটি যে অবিচ্ছেদ্য সেই বার্তাটি যদি দর্শকেরা
সবাই পেয়ে থাকেন তবে সেই হবে এক বড় পাওনা। আর যে সংকটের কথাটি
ভাবাচ্ছিল---
ঝিনুকের ভূমিকাতে প্রান্তিকাকে ছাড়া অভিনেতা অভিনেত্রীদের কাউকেই তরুণ বলা
যাবে
না। জীবন কিংবা দেবুর ভূমিকাতে যারা অভিনয় করেছেন তাঁরা ইতিমধ্যে চাকরি
থেকে অবসর
নিয়েছেন বলেই জানি। তারুণ্যের এই অনুপস্থিতি বুকে বাজে। তার বহু কারণ থাকতে
পারে।
কিন্তু মনে হয় বলাকার মতো একটি দলকে খানিক গভীরে গিয়ে ভাবাও উচিত , তারাই
পারবেন।
অসমিয়া নাটকে যদি তরুণ প্রতিভা আসছেন, বাংলা নাটকে না আসবার কী কারণ থাকতে
পারে?
এই নাটকের গল্পটি দেশ-প্রেদেশ
নিরপেক্ষ ভাবে সর্বজনীন। কিন্তু এমন বহু নাটক আছে—আমরা তিনসুকিয়াতেও এর আগেও
দেখেছি---যে গুলো আসামের জনজীবনের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। বলাকারও এ যাবত
করে আসা যেসব নাটকের নাম আমরা জানি, বা জানানো হল---সেগুলোর অধিকাংশই বহু দেখা বহু
শোনা পশ্চিমবঙ্গীয় নাটক। ওখানে মঞ্চ সফল হলেই এখানে অভিনীত হয়। অন্যথা নয়। ওখানকার
ভালো নাটকও নয়। যার জন্যে তৃতীয়ধারার নাটক ব্রহ্মপুত্রে প্রায় প্রচলিতই হতে পারল
না। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি তিনসুকিয়াতে সারা আসাম নাট্য সম্মেলনে সারা দেশের বহু
নাটক, মায় অতি উচ্চমানের অসমিয়া নাটকের দেখা মিলল, একটিও বাংলা নাটক আসাম থেকে কেউ
করলেন না। সম্ভবত করে উঠতে পারলেন না। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমাদের শেখার বহু কিছু আছে,
আমরা শিখব। অসমিয়া নাটকেও শেখা হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গীয় নির্ভরতা কাটিয়ে উঠবার
দীক্ষা এবং শিক্ষা না ছড়াতে পারলে মনে হয় না তরুণ –তরুণীরা সেভাবে নাটক করতে এগিয়ে
আসবেন। আর এলেও বেশিদিন চালিয়ে যাওয়া তাদের জন্যেও কঠিন হবে। এই নির্ভরতা যতটা যশের কাছে দায়বোধ জাগিয়ে রাখে,
মনে হয় না ততটা সমাজের কাছে জাগাতে পারে বলে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাংলা নাটকের
এটি একটি সাধারণ দুর্বলতা বলে আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাতে মনে হয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন