।। অভিজিৎ চক্রবর্তী ।।
দৈনিক সংবাদের ১৮ জুলাই, ২০১৭ সংখ্যাতে প্রকাশিত |
কবি জাফরের কবিতা পাঠও সেই রকম একটি অস্থিরতার
জগত সৃষ্টি করে ফেলে আমাদের মনে। একটা অনিশ্চয়তা। যদি ভাবি এই অস্থিরতা অনিবার্য
ছিল, তবে আমাদের সাজানো সংসার, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র প্রক্রিয়াটি প্রশ্ন-কণ্টকিত
হয়ে ওঠে। বিশ্বাসের পাকাপোক্ত ভিতটি
টলে যয়। এই মিথ্যাচার ও কূহকময় ধূর্ত সমাজ অস্বীকার করে এক প্রবল নৈরাজ্যের দিকে কি
যেতে হবে আমাদের? তলে তলে হাত মেলানো অথচ বাইরে ভিন্নধর্মী চরিত্র নিয়ে বেড়ে ওঠা
কপটতার কাছে তার একক লড়াই ও মৃত্যু বোধহয় তাই অতি স্বাভাবিকই ছিল।
আমরা একবার তার বেড়ে
ওঠার কালখণ্ডটির দিকে তাকাই। জন্ম- ৩
জানুয়ারি ১৯৭১, মৃত্যু- ২৯ ডিসেম্বর ১৯৯০। সত্তরের উত্তাল সময়ে তিনি নিতান্ত শিশু।
কিন্তু সত্তরোত্তর আশির দশকে তার চেতনা পল্লবিত হয়েছে। সামাজিক বা
রাজনৈতিক কোনো পরিবর্তন বা উন্মাদনা এই সময়ে বিশেষ ঘটেনি। বরং এই সময়ে সর্বত্র নেমেছিল স্থিতাবস্থা। সত্তরের রাষ্ট্রীয় নিগ্রহের পর এই
সময় প্রতিষ্ঠিত আদর্শের পতন, যেকোনো মুল্যে টিকে থাকার বা এডজাস্ট করার মানসিকতা
প্রবল হয়ে উঠেছিল। মূলত এই সময় থেকেই ধীরধীরে ক্যারিয়ারমুখি হয়ে উঠতে থাকে
যুবকেরা। আমরা দেখি যারা এস্টাব্লিশম্যান্টের বিরোধিতা করেছিলেন, এই সময়ে তারাই এস্টাব্লিশম্যান্টের ভেতরে সেঁধিয়ে
যাচ্ছেন। নব্বইয়ের গোড়ার দিকে সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি রাষ্ট্রীয় সংকট হয়ে দেখা দেয়। জাফর
এই পচনশীল কালে তার কৈশোর কাটিয়েছিলেন। তিনি চারপাশে দেখছিলেন অবিরাম অবক্ষয়।
জীবনানন্দের পচা চালকুমড়া থেকে ততদিনে পোকা বেরোতে শুরু করেছে।
“একটু জায়গা করে নিতে দাও
এই জনপদে প্রতিনিয়ত ভাঙছে
পুরুষের ঊরুসন্ধি
দ্যোতিত ঘরে শুয়ে থাকে পাগলী
ভাদুরী” ( তোমাকে দেবো জাতীয় সংগীত )
জাফরের কাছে তাই
কিছুই করার ছিলোনা অবিরাম বিদ্রোহ করা ছাড়া। তার ভাষার ভেতরের ইস্পাতটি তিনি
নিয়েছিলেন ষাট ও সত্তরের প্রতিষ্ঠানবিরোধী দধিচীদের কাছ থেকে। মূলত আশি-নব্বইয়ে
এমন জ্যা মুক্ত তিরের মত তীব্র ভাষারীতি সহজলভ্য নয়। যে দরজা খুললে মুক্তির আলো
আসবে কথা ছিল, যে দরজা কোনোদিন খোলেনি ও খুলবে না, তিনি সেই নিহত রাত্রির দরজার
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার আর্তনাদ শুনিয়েছেন। এটা সম্ভবত শেষ চিৎকার।
এরপরেই সমস্ত প্রক্রিয়াটি ডুবে গিয়েছিল চরম অন্ধকারে। আমাদের কৃতকর্ম, আমাদের সুবিধাভোগী মানসিকতার জটিল অন্ধকারে তাই তার কবিতাকে ধারণ ও প্রচারণা
ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। নিজের অস্তিত্ব নিয়েই টানাহ্যাঁচড়া শুরু হয়ে যায়। যখন জাফর বলেন--
“এখন আমরা কঙ্কালবাড়ির দিকে যাইতেছি।
নির্জনে দাঁড়ানো এক কিশোরীর প্রার্থনার মতন
বুদ্ধির স্বপ্ন চতুর্দিকে উৎরাইয়া
পড়িতেছি। কিছুটা যুদ্ধ করিয়া তাহার পরে শান্তির
কথা বলিব। এখন বঙ্কিম স্তবক ভাঙিয়া বাহুলীনা
স্বপ্নমুগ্ধা হইয়া উঠিতেছে।” (শ্মশান রাত্রির উৎসব)
তখন তার শ্লেষ ও বিদ্রূপের ভাষার ভেতরে নিজেদের লাশ
দেখে আশংকিত হয়ে উঠি আমরা। তার স্বপ্নগুলোকে ধূলিস্যাৎ হতে তিনি দেখেছিলেন। তাই
অনবদ্য ভঙ্গীমায় তিনি বলেছেন-
“মতের দেউটি নিভে গেলে আমার চিন্তা জুড়ে
যখন
বিপ্লাবন নামে
হাঁসের পালকের মতো ঝরে
যায় পংক্তিমালা
জেটিতে স্পর্শ করে বহুদূর চলে
গেছে বাণিজ্য জাহাজ”
স্বল্প বয়সের আয়ুতে
এমন এক উচ্চারণ আবিষ্কার করেছিলেন জাফর যা অভূতপূর্ব। নিরাভরণ সত্য নিজেই যে
কবিতা, তা তার কবিতা পাঠে বুঝা যায়। জাফর জীবনকে উ্লটেপালটে দেখেছেন। স্বাধীনোত্তর
ভারতের চেহারাটি কীভাবে ভোটমুখী ও চেয়ারমুখী কদর্য হয়ে উঠেছে তিনি তার চিত্র
এঁকেছেন।
“ আকাশ তুমি কার শেকড়ে আটকে
আছো
আমি আজ স্বপ্ন দেখি বড়ই খারাপ
পোড়ামাটির নীতিও দেখি,
দেখি আবার ফ্ল্যাগমার্চ
আকাশ তুমি কি বল আজকে
আমার দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছো
চেয়ারটা কি বল হয়ে যায়
লুফতে লুফতে দৌড়ে সবাই” (নষ্ট
করতালি অনির্বাণ ভারতবর্ষ)
নিশ্চিত মৃত্যুকে
হয়তো প্রত্যক্ষ করেছিলেন জাফর। তার কবিতায় অনিশ্চয় জীবনের সত্যতা আছে। একটি পাখি
আছে যে উদাসীন ডেকে ডেকে উড়ে যায়। তারে
একটাই বিস্ময়, ‘এ কললে আছে নাকি জনিতৃকোষ’। মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন তিনি।
তাই তার কবিতায় সত্য উৎসারিত হয়েছে জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে। তার মৃত্যুবোধ
ভারাক্রান্ত করে না, বরং তাচ্ছিল্য করতে শেখায়। তিনি ভাষাশিল্পী। আঞ্চলিক স্বরেও
অনুবাদ করেছেন অনুভব। প্রচল শব্দের পাশাপাশি হারিয়ে যাওয়া শব্দরাজিকেও বসিয়ে
কবিতার গতি পালটে দিয়েছেন।
“ যখন খুশি যাইবেন ডাকবেন
ধাক্কা দিয়া দরজা খুলবেন।
ঘরে কেউ থাকেন না
আগে থাকতেন অন্য কেউ
এখন আমি থাকি
ঘরের ভেতর ঘর থাকে” (যখন খুশি
যাইবেন ডাকবেন)
কবি জাফর অকুতোভয়। সমাজ, বিজ্ঞান, দর্শনের মৌল
কথাগুলি তিনি জানেন। ‘কবিতার কাছে যেতে পেরেছি তো ?’ এইই ছিলো একমাত্র প্রশ্ন। এ
কোনো শৌখিন মজদুরী নয়, এ তার আত্মার আর্তনাদ। এই নাদে হয়তো একদিন নিহত রাত্রির
দরজা খুলে যাবে, আমরাও দাঁড়াব নিজের মুখোমুখি সাহস করে, নিজের চোখে চোখ রেখে; ভয়
করবে না। কবি জাফর সাদেক
এক ব্যাতিক্রমী প্রতিভার নাম। উনিশ বছরের সময়সীমায় যিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন সুদীর্ঘকালের
যুগব্যাধিকে। ভাবি, এতো স্বল্প পরিসর জীবনে কিভাবে একজন কবি পরিণত
হয়ে ওঠেন! বক্তব্যে, উচ্চারণে, বলার শৈলীতে তিনি এমন এক নির্মাণের দিকে চালিত হয়েছিলেন,
যার কোনো উত্তরসূরী নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন