“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ২২ জুন, ২০১৭

উত্তর স্বাধীনতা যুগের ভারতীয় নাটকের রূপরেখা



প্রাঞ্জল শর্মা বশিষ্ঠ

বাংলা অনুবাদঃ সুশান্ত কর


( মূল অসমিয়া লেখাটি বেরিয়েছিল অসম প্রকাশন পরিষদ প্রকাশিত, মিহির চৌধুরী সম্পাদিত,অসমিয়া ‘সাময়িক পত্রিকা ‘প্রকাশ’-এর আগস্ট, ২০১৫ সংখ্যাতে। পৃষ্ঠা ১৯-২৩। তার থেকে আমরা অনুবাদ করলাম। এমন নয় যে লেখকের প্রতিটি তাত্ত্বিক ধারণার সঙ্গে আমরা সহমত পোষণ করি। যেমন ভারতীয় নাটকের একটি ধারা তিনি লিখেছেন ‘সংস্কৃতীয়া’। আমরা হলে লিখতাম ‘ধ্রুপদী সংস্কৃত’, কারণ প্রাকৃত নাটকও ছিল। সেরকম ঔপনিবেশিক নাটককে মোটাদাগে বাস্তববাদী নাটক বলা চলে কিনা, সেই নিয়ে আমাদের সংশয় আছে। লেখকের পক্ষপাত উত্তর-ঔপনিবেশিক নাটকদের দিকে থাকা সত্ত্বেও বিজয় তেণ্ডুলকারকে ‘সুদক্ষ পশ্চিমা-বাস্তববাদী নাট্যকার’ বলে লেখকও যেন প্রশংসা করলেন, এবং গিরীশ কার্ণার্ড যখন তাঁকে বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার বলে অভিহিত করেন, লেখক যেন সমালোচনার কিছু পান নি। তদুপরি, তিনি লিখেছেন এক জায়গাতে, ‘লভিতা’র মতো নাটকে সামাজিক সমস্যার পূর্ণ বিশ্লেষণ করা হলো না’ –নাটক প্রবন্ধের মতো সমস্যার বিশ্লেষণের জায়গা কিনা—সেই নিয়েও আমাদের প্রশ্ন আছে। কিন্তু এটি ঠিক যে ঔপনিবেশিক এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতীয় নাটকের এক সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তিনি তুলে ধরেছেন। সেদিক থেকে নিবন্ধটি মূল্যবান। তাই আমরা অনুবাদ করে নিলাম। অনুবাদটি প্রকাশিত হয় উজান , দ্বাদশ সংখ্যাতে  --অনুবাদক   )
ভারতীয় নাটকের পরম্পরা অত্যন্ত পুরোনো। সেই সঙ্গে তার সংস্কৃত, লোক এবং মধ্যযুগে লিখিত---এই তিনটি ধারাও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। সংস্কৃত ধারাটির শ্রেষ্ঠ নাটক ছিল শূদ্রকের মৃচ্ছকটিকমআনুমানিক খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকে লেখা এই নাটকের কাহিনি ছিল বৈপ্লবিক। নাটকটি ধারাটির অন্য নাটকের মতো রাজারঞ্জক ছিল না---তাতে রাজার বদলে এক দেউলিয়া,কিন্তু উদার এবং ধীরোদাত্ত ব্যক্তিকে নায়ক হিসেবে দেখা গিয়েছিল।নায়িকা হিসাবে রাজগোত্রীয়,কুমারী কন্যার বদলে দেখা গিয়েছিল এক সাধারণ নগরবধুকে।রাজন্যবর্গীয় ক্ষুদ্র সমাজের বদলে সেই নাটকে  উপস্থাপিত হয়েছিল  সাধারণ জনতার বৃহৎ সমাজ।তারউপরে কাহিনি বিন্যাস ছিল অত্যন্ত জটিল অথচ দক্ষতাপূর্ণ।ভাসের চারুদত্তনাটকের কাহিনির সঙ্গে মৃচ্ছকটিকমনাটকের কাহিনির মিল আছে।কিন্তু চারুদত্ত নাটকটি কাহিনি বিন্যাসের দিক থেকে মৃচ্ছকটিকমের সমান উৎকর্ষের দাবি করতে পারে না।মৃচ্ছকটিকমের পাঁচশ বছর পরে,আনুমানিক দশম শতিকাতে সংস্কৃত ধারাটির সোনালি যুগের শেষ হয় যদিও মধ্যযুগে লেখা নাটকের জন্যে---যেমন আমাদের শংকরদেবের নাটকের জন্যে---তার বহু দিক আদর্শ হিসেবে সজীব থেকে যায়।ভারতীয় লোকনাটকের ধারাটি যদিও স্বাভাবিকভাবেই সংস্কৃত ধারাটির থেকে জনপ্রিয় এবং ব্যাপক ছিল-- লিখিত প্রমাণ না থাকার জন্যে তার ইতিহাস জানা যায় নাতবু সাম্প্রতিক কালের লোকনাটকের প্রকার-প্রাচুর্য আর শৈল্পিক ঔৎকর্ষ দেখে খুব সহজেই বোঝা যে এ বিকাশের বহু স্তর বা পর্যায়ের কষটি পাঠরে ঘসা খেয়ে খেয়ে তবে এই পর্যায়তে এসে পৌঁছেছে শঙ্করদেবের নাটকের মতো মধ্যযুগের বহু নাটকে এই ধারা প্রভূতভাবে প্রভাবিত করেছিল।
ভারতীয় নাটকের সংস্কৃত এবং লোক এই দুই ধারার বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল মধ্যযুগের লিখিত নাটককে ভারতীয় নাটকের তৃতীয় ধারা বলতে পারি।এর ঔৎকর্ষ দেখে অবাক হতে হয়।শঙ্করদেবের নাটকের কথাই ভাবা যাক না।তাঁর নাটক এখন ধ্রুপদী নাটকের মর্যাদা পেয়েছে।তিনি ভাসদএবং সামাজিক লোক’ –উভয় শ্রেণির দর্শকের জন্যে নাটক লিখে গেছেন যদিও তাঁর প্রথম এবং অধুনা দুর্লভ নাটক চিহ্নযাত্রাসম্পর্কে যেসব তথ্য মেলে তাতে বোঝা যায় সামাজিক লোকই ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য।বৈষ্ণব (যেমন মাধব কন্দলি) এবং নব-বৈষ্ণব পূর্ব কবিরা (যেমন বাসব) ভারতজোড়া সাধারণ মানুষের জন্যে কাব্য রচনা করেছিলেন।কিন্তু সেই মানুষের জন্যে নাটক রচনার রূপকল্প দেখালেন সবার শুরুতে শঙ্করদেবইএ নিঃসন্দেহে ছিল এক বৈপ্লবিক কাজ।সাধারণ মানুষকে নাট্য-প্রক্রিয়াতে অন্তর্ভুক্ত করবার জন্যে শঙ্করদেবের অন্তরঙ্গ পরিবেশনের রূপকল্প উদ্ভাবন ছিল সবচেবেশি বৈপ্লবিক।স্বাধীনতা উত্তরকালের  ভারতীয় নাট্যজগতে বাদল সরকার যে ধরণের অন্তরঙ্গ থিয়েটারের জন্যে খ্যাতি লাভ করেছেন,তার অনেকগুলো দিক শঙ্করদেব প্রায় পাঁচশত বছর আগেই প্রয়োগ করে গেছেন।শঙ্করদেবমাধবদেবের পরে অসম সহ সারা ভারতেই ষোড়শ শতক থেকে উনিশ শতক অব্দি নাটক কিছু পরিমাণে স্তিমিত হয়ে পড়েছিল।
            উনিশ শতকে দৃশ্যপট বদলে গেল। সেই শতকে ব্রিটিশ উপনিবেশ বৃক্ষের রূপ নিয়ে ভারতবর্ষকে ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদের ছায়া দিতে শুরু করল।শতকের মধ্যভাগে ভারতীয় নাট্যকর্মীরা দেশীয় নাট্যপরম্পরাকে সরিয়ে রেখে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নাট্যপরম্পরাকে বরণ করে নিলেন।খুব সম্ভব স্তিমিত নাট্যজগতকে পুনরুজ্জীবিত করবার জন্যে এই যুগান্তকারী পরিবর্তন হয় নি।এটি হয়েছিল সম্ভবত ঔপনিবেশিক মানুষের স্বাভাবিক অনুকরণমুখী প্রবণতার জন্যেই।যাই হোক,ঔপনিবেশিক নাট্যাদর্শের পরম্পরাকে বরণ করে ফেলার ফলে জন্ম হল আধুনিকতার ইউরোপীয় ধারণা বয়ে বেড়ানো,নাগরিক এবং উচ্চশিক্ষিত নাট্যকর্মীদের নাট্যভাবনারআর জন্ম নিল নগরকেন্দ্রিক চিন্তাচেতনার প্রসেনিয়াম মঞ্চে মূলত শেক্সপীয়রের রীতিতে উপস্থাপিত আধুনিক ভারতীয় নাটক।তখন থেকে বিশ শতকের প্রথম চারটি দশক পর্যন্ত ভারতের প্রান্তীয় সাহিত্যক্ষেত্রগুলোতে     প্রবাহিত রোমান্টিকতার ঝড়ো বাতাসে নাট্যকর্মীদেরও মন উড়ু উড়ু করে রাখল।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো নাট্যকারের উপরেও তার প্রভাব পড়ল।উদাহরণ স্বরূপ রক্তকরবীতে (বাংলা,১৯২৪) তিনি মাটিতে পা ফেলতে পারেন নি।নাটকটিতে তিনি মানবজাতিকে কর্ষণজীবীআর আকর্ষণজীবী’ ---এই দুই ভাগে ভাগ করে দেখালেন যদিও,সে বাস্তব অভিলাষী মনকে খুব একটা ছোঁয় না। কেন না,দেখা যায় সেই মানব জাতি কল্পলোকেরই বাসিন্দা,বাস্তব জগৎ থেকে বহু দূরে তাঁদের অবস্থান।
এই সময় ভারতীয় নাট্যকারদের উপর রোম্যান্টিক নাটকের প্রভাব এতোটাই পড়েছিল যে তার থেকে তাদেরকে ইবসেন আর বার্ণার্ড শ্বয়ের বাস্তববাদী নাটকের নবলব্ধ প্রভাবেও সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করতে পারে নি।তার নজির আমাদের জ্যোতিপ্রসাদেররূপালীম’ (অসমিয়া,রচনা -১৯৩৬,মঞ্চায়ন-১৯৩৭,প্রথম প্রকাশ ১৯৩৮) এবং কারেঙর লিগিরী’ (অসমিয়া, ১৯৩৭?) নাটক। রূপালীম’-এ রূপালীমের মৃত্যুদণ্ড রোম্যান্টিক নাটকের সমগোত্রীয় ট্র্যাজিক প্রভাব সৃষ্টি করিলে,তার আগে মণিমুগ্ধর আত্মিক পরিবর্তন অতি আদর্শায়িত হল,বাস্তবিক বলতে নাটকটিতে থাকল শুধু আত্মক্ষয়প্রাপ্ত ইতিভেন। কিন্তু শেষঅব্দি তিনি ইবসেনের নোরার মতো বা শ্বএর কেণ্ডিডার মতো বাস্তব বুদ্ধি সম্পন্ন,যুক্তিপরায়ণ নতুন নারীরূপে দেখা দিলেন নাকারেঙর লিগিরীও একটি সর্বাঙ্গসুন্দর আধুনিক সমস্যামূলক নাটক হয়ে উঠল না।কারণ নাটকটির শেষে শেওয়ালির আত্মবলিদান সৃষ্টি করল রূপালীমের মতো ট্র্যাজিক প্রভাব।নিজেকে নতুন নারী রূপে তুলে না ধরে শেওয়ালি রোম্যান্টিক নারীর নায়িকার মতো বাস্তব জগতের অনুপযোগী ত্যাগের আদর্শ।এই আদর্শই সুন্দর কোঁয়রকে বাস্তব কর্তব্যের থেকে সরে গিয়ে বৈরাগী হতে অনুপ্রাণিত করল।এইসব দেখলে শেওয়ালি আর সুন্দর কোঁয়রের ব্যক্তি হৃদয়ের ঔজ্জ্বল্য আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়,আমাদের চোখে ভালো করে পড়েই না নাটকের পূর্বাংশ অধিকার করে রাখা সামাজিক সমস্যা আর উপস্থাপনের আড়ালে নাট্যকারের উদ্দেশ্য।
            শতকের পঞ্চম দশকে দৃশ্যপটে সামান্য,কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক পরিবর্তন এল।সামান্যই পরিবর্তন এল---যেমন জ্যোতিপ্রসাদের লভিতা’ (অসমিয়া, ১৯৪৮) নাটকে দেশপ্রেম আদর্শায়িত হল আগেকার নাটকের মতোই।তার উপরে লভিতার মতো নাটকে সামাজিক সমস্যার পূর্ণ বিশ্লেষণ করা হলো না,ঔপনিবেশিক মঞ্চাদর্শের প্রতিও কোনো রকম বিরোধ প্রদর্শন করা হলো না এগুলোতে (এই প্রবন্ধে প্রয়োজনসাপেক্ষে জ্যোতিপ্রসাদের কিছু নেতিবাচক দিক উল্লেখ করছি যদিও পাঠন না ভুল বোঝেন তাই বলে রাখি,বিভিন্ন কারণে জ্যোতিপ্রসাদই ব্যক্তিগতভাবে আমাদের সবচাইতে প্রিয় নাট্যকার,তাঁর রূপালীমআমাদের সবচাইতে প্রিয় অসমীয়া নাটক এবং রূপালীমের মণিমুগ্ধ আমাদের প্রিয়তম অসমিয়া চরিত্র)তাহলে কি সেই সামান্য,কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এল শতকের পঞ্চম দশকে?অপর্ণা ভার্গব ধারওয়াড়কার থিয়েটার্স অব ইণ্ডিপেন্ডেন্সঃ ড্রামা,থিয়রি এণ্ড আরবান পারফরম্যান্স ইন ইণ্ডিয়া সিন্স ১৯৪৭গ্রন্থে তার খতিয়ান তুলে ধরেছেন।তাঁর মতে ভারতীয় নাটকে পরিবর্তন এল ১৯৪৩ সনে,কারণ এই বছরে তখনকার বোম্বেতে প্রতিষ্ঠিত হল ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ,যে সংগঠন কিনা যুদ্ধং দেহী মনোভাবে  ঔপনিবেশিক থিয়েটারকে অবজ্ঞা করল আর এক প্রতিবাদ মুখর জাতীয় থিয়েটার জন্ম দিতে অগ্রণী ভূমিকা নিল।সংঘের মঞ্চায়িত প্রথম নাটকেই এই প্রতিবাদী মনোভংগী প্রকট হয়ে পড়ল।নাটকটি ছিল,বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন’ (বাংলা,১৯৪৪)নাটকটি এক ঔপনিবেশিক নাট্যাদর্শ বিরোধী প্রতিবাদমুখর জাতীয় নাট্য-চেতনা সৃষ্টি করল। ধারওয়াড়কার লিখেছেন গণনাট্য সংঘের প্রতিষ্ঠার বছরটিতেই উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতীয় নাটকের জন্ম হয়েছে,আর নবান্নই প্রথম উত্তর-ঔপনিবেশিক নাটক (পৃষ্ঠা ৩১)
            নবান্নপড়লে আমরা দেখব,সেই নাটক ১৯৪২-৪৩ সনের বাংলাতে দুর্ভিক্ষের বলি কৃষক জনতাকে এক শোষিত শ্রেণি হিসাবে চিহ্নিত করেছিল।তাঁদের উপস্থাপিত করেছিল শ্রেণি চেতনাতে উদ্বুদ্ধ ব্রিটিশের শোষণকারী ভূমিনীতির বিরোধী প্রতিবাদকারী হিসেবে।তারউপরে ব্রিটিশের ছড়ানো (এবং পরে,দেশবিভাজনের সময়ে এসে প্রবল রূপ নেয়া) সাম্প্রদায়িকতাবাদের প্রবল বিরোধী রূপে।নাটকে জাতীয়চেতনাকে সমাজ চেতনাতে পর্যবসিত করেছিল।এ এমন এক পরিবর্তন যাকে ফ্রঞ্জ ফেনন বলেছিলেন,সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাত করবার জন্যে অতি দরকারি বলে বিবেচনা করেছিলেন।নাটকের চতুর্থ অঙ্কে শোষিত জনতা সঙ্ঘবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছেন,পঞ্চম অঙ্কে জনতা সম্মিলিতভাবে নবান্ন উৎসব পালন করার দৃশ্যের মধ্য দিয়ে তাদের জয় ঘোষিত হয়েছে।আর এভাবেই নাটকের শেষে সঙ্ঘবদ্ধ জনতার সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। নাটকের শেষটি যেন মার্ক্স এঙ্গেলসের দু কম্যুমিষ্ট মেনিফেস্টোর শেষভাগেরই নাট্যরূপ।
            নাটকটিতে শ্রেণির উপস্থাপন সম্পর্কে আরেকটি লক্ষ করবার কথা এই যে তাতে নারীদের শোষিত শ্রেণির ভেতরে এক অধিক শোষিত প্রান্তীয় উপ-শ্রেণি হিসেবে দেখানো হয়েছে। এ যেন পরের কালের কৃষ্ণ-নারীবাদের কথিতদ্বি-শোষণএরই পূর্বকথন এই কথন সম্ভব হয়েছে,শব্দগত এবং দৃশ্যগত শ্লেষের যোগে।উদাহরণ স্বরূপ,রাধিকা নামের চরিত্রের কোনো ঋদ্ধি নেই,তার নামের অর্থ যদিও তাই।বিনোদিনী নামের চরিত্রটি হচ্ছে তার নামের অর্থের বিপরীতে বিনোদবিহীনা। আর মাতঙ্গিনী চরিত্রটি তার নামের অনুরূপ হস্তিনীর মতো বলবতী রূপে দেখা না দিয়ে,দিয়েছে নিতান্ত দুর্বলা হিসেবেতার উপরে দৃশ্যগুলো দেখায় এই কটি নারী চরিত্রের সামাজিক স্থিতি পুরুষের সামাজিক স্থিতির থেকে হীন।
            ঔপনিবেশিক শক্তির প্রতি প্রতিরোধমূলক প্রতিবাদ,জাতীয় চেতনার সমাজচেতনাতে উন্নয়ন,স্বদেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যার নির্মোহ বিশ্লেষণ,অধিক শোষিত প্রান্তীয় উপ-শ্রেণির উন্মুক্তি ইত্যাদি উত্তর-ঔপনিবেশিক নাটকের কিছু বিশেষ লক্ষণ। নবান্নতে এই লক্ষণগুলো পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল।তার পরিবেশনাতেও উত্তর-উপনিবেশবাদী নাটকের লক্ষণ উজ্জ্বল রূপে দেখা দিয়েছিল বিজন ভট্টাচার্য এবং শম্ভু মিত্রের পরিচালনাতে নাটকটি এক নতুন থিয়েটারি ভাষা আয়ত্ত করেছিল।কিরণময় রাহার ভাষাতে---‘Gone were the artificial sets,the painted wings and the striving after illusory effects;gone too were the histrionic pyrotechnics of individual brilliance and the familiar forced accommodation of available actors.” (Bengali Theatre,pg. 155) নাটকটিতে এই সব লক্ষণ ফুটে ওঠা দেখে, পরাধীন ভারতে রচিত আর পরিবেশিত হওয়া সত্ত্বেও তাকে নিঃসন্দেহে উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদী আখ্যা দেয়া যায়। তেমনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা পাবার মাত্র চারদিন আগে পরিবেশিত মনোরঞ্জন দাশের নাটক আগস্ট ন’-তেও (ওড়িয়া, ১৯৪৭) 'বছর আগেকার আগস্ট বিপ্লবের পটভূমিতে দেশবাসীর নৈতিক অবক্ষয়ের সমস্যাটি নির্মোহভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এদিক থেকে আগস্ট ন’-ও একটি উত্তর-ঔপনিবেশিক নাটক,যদিও আদর্শের দিক থেকে এটি নবান্নের কঠোর সাম্যবাদী আদর্শের থেকে বহু দূরের জিনিস,যদিও তার পরিবেশনা ভারতীয় নাট্যজগতে ঔপনিবেশিকতার বা ঔপনিবেশিক নাট্যাদর্শের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধমূলক ভাষার সংযোগ ঘটালো না।ভারতীয় গণনাট্য সংঘের উদ্যোগে সঙ্ঘটিত নাট্য-আন্দোলন পরে দীর্ঘস্থায়ী হলো না।তার কারণ---সংঘের মঞ্চে সাম্যবাদী আদর্শকে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল,তার ফলে নাট্য-কলা যথোপযুক্ত বিকাশের সুবিধে পেল না।নবান্নের অন্যতম পরিচালক শম্ভু মিত্র,রচয়িতা-পরিচালক বিজন ভট্টাচার্য,সংঘের অন্য বিশিষ্ট কর্মী, যেমন ---উৎপল দত্ত, হাবিব তনবির প্রমুখ সাম্যবাদী আদর্শের সঙ্গে নাট্য-কলারও একই সমান্তরাল বিকাশের কথা ভাবনাতে নিয়ে একে একে সঙ্ঘ করলেন। গড়ে তুললেন নিজেদের নাট্যগোষ্ঠী। শম্ভু মিত্র গঠন করলেন,‘বহুরূপী’ (১৯৪৯), বিজন ভট্টাচার্য গঠন করলেন কলিকাতা থিয়েটার’ (১৯৪৯),উৎপল দত্ত গঠন করলেন লিটল থিয়েটার গ্রুপ’ (১৯৪৯)  এবং পরে পিপলস লিটল থিয়েটার ’ (১৯৬৯) এবং হাবিব তনবির গড়ে তোলেন নয়া থিয়েটার’ (১৯৫৯)এই গোষ্ঠীগুলো ভারতে এক দীর্ঘকালীন নাট্যগোষ্ঠী আন্দোলনের সূচনা করল। গোষ্ঠীগুলো প্রধানত: রাজনৈতিক নাটকই মঞ্চস্থ করেছিল যদিও বিভিন্ন লোকনাট্য এবং ভাষাবৈচিত্র্যর রূপ এবং কাঠামোর উপাদানকে ব্যবহার করে সেই নাটকগুলোকে শৈল্পিক করে তুলেছিলেন। এরকম প্রয়োগ দেশীয় নাট্য-পরম্পরার প্রাচীনত্ব,প্রাচুর্য এবং ঋদ্ধিকে উত্তর-ঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ যেভাবে চেয়েছিল সেভাবে তুলে ধরেছিল।এক কালে শেক্সপীয়রের নাটক করে প্রভূত খ্যাতির অধিকারী উৎপল দত্ত পরে তাঁর লোকনাট্যমুখী নাটক এবং তত্ত্বধর্মী লেখাগুলোর মধ্য দিয়ে সচেতনভাবেই এক সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিকনাটকের পোষকতা করেছিলেন। এই সব করতে গিয়ে তাঁরা ব্রেখটের মহাকাব্যিক নাটক থেকেও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
        
    ‘নবান্নের পরে বিজন ভট্টাচার্যের শ্রেষ্ঠ কৃতি দেবীগর্জননাটক (বাংলা,১৯৬৬)তাতে শোষণকারী নারী ধর্ষণকারী সামন্তপ্রভুর বিরুদ্ধে শোষিত কৃষক শ্রেণি সম্মিলিতভাবে বিদ্রোহ করছে।নাটকের শেষে আছে দেবী দুর্গার আখ্যানের অনুষঙ্গে মহিষাসুর যেন সামন্তপ্রভুর নিধনের দৃশ্য এবং কৃষক শ্রেণির মুক্তির বার্তা। জীবন কালে বাংলা নাট্যজগতের কিংবদন্তীস্বরূপ হয়ে উঠা নাট্যকার,অভিনেতা এবং পরিচালক শম্ভু মিত্রের শ্রেষ্ঠ কৃতি হচ্ছে চাঁদবণিকের পালা’ (বাংলা,১৯৭৮)নাটকটি কখনো মঞ্চস্থ না হলেও বাংলা তথা ভারতীয় নাট্যজগতকে আলোড়িত করে রেখেছে। মহাকাব্যিক গাম্ভীর্য এবং বিস্তারের এই নাটকে উত্তর বাংলার খেটে খাওয়া মানুষের ভাষাবৈচিত্র্য এবং ব্রেখটীয় রুপকল্পে লোকনৃত্য-গীত জুড়ে দিয়ে সংখ্যালঘুর অবস্থা এবং বৈপ্লবিক মনোভাব ফুটিয়ে তুলা হয়েছে।উৎপল দত্ত আশিটির বেশি নাটক লিখেছেন।তার মধ্যে কোনটি শ্রেষ্ঠ বলা কঠিন। কেননা অঙ্গার’(বাংলা,১৯৫৯),‘ফেরারি ফৌজ’ (বাংলা,১৯৬১),‘কল্লোল’ (বাংলা,১৯৬৫),‘টিনের তলোয়ার’ (১৯৭১),‘সূর্যশিকার’ (বাংলা,১৯৭১) ইত্যাদি প্রতিটি নাটকই নানান দিক থেকে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখে।উৎপল দত্ত বেশ কিছু পালাঅর্থাৎ নাটক লিখে বাংলা যাত্রানামের লোকনাট্য ধারাটিরও উত্তর-ঔপনিবেশিক উত্তরণে সহায় করেছিলেন।এই নাটকগুলোর পাঠ এবং পরিবেশনে যাত্রার বেশ কিছু উপাদান ব্যবহার করে  তিনি তাঁর উপনিবেশবাদ বিরোধী রাজনৈতিককথাবস্তুকে সবল রূপে প্রকাশ করে রেখে গেছেন।হাবিব তনবির তাঁর নাটকে মধ্য এবং উত্তর ভারতের বিভিন্ন লোকনাট্যের রূপ এবং কাঠামোকে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন।সঙ্গে ব্যবহার করেছেন মধ্য,পশ্চিম এবং উত্তর ভারতের বিভিন্ন ভাষাবৈচিত্র্য,সংস্কৃত নাটকের কিছু উপাদান এবং তাৎক্ষণিক অভিনয়ের বাচনিক এবং শারীরিক অভিব্যক্তি। লোকনাট্য এবং ভাষাবৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে নিপীড়িত শ্রেণির উপস্থাপন করে প্রভাবী শ্রেণি মানুষের ক্ষমতার খেলা উদলা করে দেখানো নাটকগুলোর মধ্যে চরণদাস চোর’ (ছত্রিশগড়ী, ১৯৭৫), এবং হিরমা কী অমর কহানী’ (হিন্দী, ১৯৮৫) তববীরের শ্রেষ্ঠ নাটক।
            গণনাট্য সঙ্ঘের থেকে বেরিয়ে আসা এই সব সদস্যদের সঙ্গে অন্য কিছু নাট্যকার-পরিচালকও বিভিন্ন নাট্যগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করে এই নাট্যগোষ্ঠী (গ্রুপ থিয়েটার --অনুবাদক) আন্দোলনটিকে সবল পরেছিলেন। এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে  মনোজ মিত্রের সুন্দরম’ (১৯৫৭),‘কাবলম নারায়ণ পাণিক্করের সোপানম’ (১৯৬৪),বাদল সরকারের শতাব্দী’ (১৯৬৭),অরুণ মুখার্জিরচেতনা’ (১৯৭২),সফদর হাসমীর জন নাট্য মঞ্চবা সংক্ষেপে জনম’ (১৯৭৪),রতন থিয়ামের কোরাস রেপার্টরী থিয়েটার’ (১৯৭৬),এবং নীলম মানসিং চৌধুরীর কোম্পানি’ (১৯৮৪)এর মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত গোষ্ঠী দুটি হচ্ছে শতাব্দীআর জনমশতাব্দীপ্রখ্যাত তার মুক্তমঞ্চ তথা থার্ড থিয়েটারের ধারণার জন্যে। তার ধারণা গ্রহণ করা হয়েছিল লোকনাটক এবং পশ্চিমা থিয়েটার ইন দ্য রাউন্ডজাতীয় কিছু প্রসেনিয়াম বিরোধী নাট্য-পরিবেশন পদ্ধতির থেকে। এই সব ভাবাদর্শে তৈরি থার্ড থিয়েটার দিয়ে শতাব্দীব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নাট্যাদর্শের বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিবাদ সাব্যস্ত করেছে। তার জন্যে উত্তর-ঔপনিবেশিক পরিদৃশ্যে এই থার্ড থিয়েটার যথেষ্ট মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। আমরা আগেই লিখে এসেছি---থার্ড থিয়েটারের সঙ্গে মেলে এমন নাটক পরিবেশন পদ্ধতি আমাদের শঙ্করদেব বহু আগেই ব্যবহার করেছিলেন।অবশ্য শঙ্কর দেবের উদ্দেশ্য স্বতন্ত্র ছিলতিনি অন্তরঙ্গ থিয়েটার দিয়ে সাধারণ মানুষকে ধর্মের পথে আকর্ষণ করতে চাইছিলেন,কোনো প্রচলিত নাট্য-পদ্ধতির বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করতে চান নি (সে জন্যেই তিনি সংস্কৃত এবং লোক এই দুই ধারার থেকেই মুক্তভাবে উপাদান গ্রহণ করতে পেরেছিলেন)শতাব্দীর মতো  জনমও নতুন নাট্যপদ্ধতির সন্ধান করেছিল।সাধারণ মানুষকে নাট্য-প্রক্রিয়ার সঙ্গে অন্তরঙ্গতা স্থাপনের সুবিধা করে দেবার উদ্দেশ্যে জনমজনপ্রিয় করে তুলেছিল পথ নাটকজনমঅবশ্য পথ নাটকজনপ্রিয়ই করেছিল,সেই নাট্য ধারণার জন্ম দেয় নি।উৎপল দত্ত,হবীন তববীরেরা জনমএর বহু আগেইপথ নাটককরেছিলেন,এই কথাটি এখানে উল্লেখ করে রাখা ভালো।।
            শতাব্দীএবং জনমএর বাইরেও অন্যান্য নাট্যগোষ্ঠীগুলোও কথ্যবস্তু এবং শিল্প সম্বন্ধীয় অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছে। মনোজ মিত্র,রতন থিয়াম প্রমুখ নিজ নিজ নাট্যগোষ্ঠীর মাধ্যমে এমন বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ভারতীয় নাট্য জগতের প্রবাদ পুরুষে পরিণত হয়েছেনকিন্তু দুঃখ হয় ভেবে কাবলম নারায়ণ পাণীক্কর এবং অরুণ মুখার্জির মতো এক একজন জ্যেষ্ঠ নাট্যকর্মীরা তাদের প্রাপ্য সম্মান পেলেন না।অথচ,লোকনাটক,লোকসমর কলা এবং পুরাকাহিনির বিভিন্ন রূপ এবং কাঠামোকে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে পশ্চিমের বাস্তববাদী নাট্য-পদ্ধতির প্রতিরোধী উত্তর-ঔপনিবেশিক নাটক নির্মাণে তাঁদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল।এমনটা হবার কারণ কী? আমাদের মনে হয় এমনটা হবার কারণ হচ্ছে আমাদের সমালোচকদের তেলা মাথাতে তেল দেবার আগ্রহ।আমাদের বেশিরভাগ নাট্যালোচনার বই পত্র খুললেই দেখা যায় ---অধিকাংশ আলোচনা হয় কেবল মোহন রাকেশ, বিজয় তেণ্ডুলকর, বাদল সরকার এবং গিরীশ কার্ণার্ড কেন্দ্র করে। সেগুলোতে কাবলম নারায়ণ পাণিক্করের মতো সুদূর দক্ষিণের মালয়ালী নাট্যকার পরিচালকের কথা তো দূর,পূর্ব ভারতের বাংলার উৎপল দত্ত বা অরুণ মুখার্জি,মধ্য-ভারতের হবীব তনবীরের জন্যেও স্থান থাকে না বললেই চলে।আর এখন সহজ লভ্য ইংরেজি পাঠের জন্যে সেগুলোতে বহু নতুন ব্যক্তি স্থান পাচ্ছেন। সত্যি,প্রান্তীয় নাটকের অনুবাদের অভাবে এবং বই লেখা আর সম্পাদনার ভূতের প্রকোপে ভয় পাইয়ে দেবার মতো ইতিহাসের দেদার ভুল উপস্থাপন হচ্ছে।অবশ্য এই কথা ঠিক---জাতীয় নাট্য বিদ্যালয়,সিগ্যাল থিয়েটার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান এমনটা করেছে,আমরা দেখি নি।তাদের হিন্দি-ইংরেজি পত্রিকা পড়ে দেখেছি---তাঁরা বিভিন্ন প্রান্তীয় নাটককে গুরুত্ব দেবার প্রচেষ্টা নিয়মিত করে আসছেন।
ফিরে আসছি নাট্যগোষ্ঠী আন্দোলনের বিষয়ে।ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নাট্যগোষ্ঠী স্থাপিত হবার ফলে নাট্যগোষ্ঠী আন্দোলন লাভ করেছিল এক সর্বভারতীয় বিস্তৃতি।তারউপরে আন্দোলনের দিক থেকে এই গোষ্ঠীগুলো নগরকেন্দ্রিক ছিল যদিও আন্দোলনটির অংশ হিসেবে পরিবেশিত অধিকাংশ নাটকে প্রাক-স্বাধীনতা যুগের নাটকের নগরকেন্দ্রিক চিন্তা-চর্চা বা দৃষ্টিভঙ্গি অন্তর্হিত হয়ে পড়েছিল। নগর অবশ্যই দেখানো হয়েছিল,কিন্তু সেসব অধিকাংশ নাটকেই মূল পটভূমি বা চেতনার বিচরণস্থল ছিল না।আসলে লোকনাটকের উপকরণ ব্রিটিশ নাট্যাদর্শের প্রতিরোধমূলক মনোভংগীর অন্যতম অস্ত্র হিসেবে বিবেচিত হওয়াতে এবং নয়া থিয়েটার’,‘সোপানমইত্যাদি নাট্যগোষ্ঠীগুলো সাধারণ মানুষের অপরিশিলীত শরীর ভঙ্গি এবং কথন ভঙ্গি উপস্থাপন করবার উদ্দেশ্যে গ্রামীণ নিরক্ষর,নাট্য-শিক্ষাহীন মানুষকে অভিনেতা অভিনেত্রী হিসাবে নিযুক্তি দেবার ফলে এইসব নাটকে সংযুক্তি ঘটেছিল এক নতুন ধরণের গ্রাম্য-স্বাভাবিকতার।এই সংযোগ নাট্যগোষ্ঠী আন্দোলনটিকে সর্বভারতীয় বিস্তৃতি লাভ করতে প্রচুর সাহায্য করেছিলতবু এই কথা স্বীকার করতেই হবে,আন্দোলনটি উত্তর স্বাধীনতা যুগের ভারতীয় নাট্য ক্ষেত্রের সামগ্রিক রূপের প্রতিনিধিত্ব করে না।কারণ,প্রথমত এই নাট্যজগতের সব নাটক ঔপনিবেশিক নাট্যাদর্শের বিরোধিতা করে নি,কিছু কিছু নাটক বরং সেই পুরোনো আদর্শের অনুসরণই করে যাছে (উদাহরণ স্বরূপ আমাদের ভ্রাম্যমান থিয়েটারের নাটকগুলো আজও বহুলাংশে বাস্তববাদী এবং প্রসেনিয়াম প্রায় মঞ্চতেই অভিনীত হয়) এবং দ্বিতীয়ত,এই নাট্যজগতের অনেকেই ভালোর থেকে ভালো নাটক লিখেছেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে, কোনো নাট্যগোষ্ঠীর প্রতি সমর্পিত না হয়েই (সাময়িক ভাবে কোনো নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত হয়েছেন হয়তো, সেসব আমরা এখানে হিসেবে নিই নি)
     
      ব্যক্তিগত উদ্যোগে,নাট্যগোষ্ঠীর আদর্শের প্রতি সমর্পিত না হয়ে নাটক লিখে ভারতীয় নাট্য জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার বলে বিবেচিত হয়েছেন এমন ব্যক্তিত্বের মধ্যে রয়েছেন,ধর্মবীর ভারতী, হাবিব তনবির,বাদল সরকার,মোহন রাকেশ, আদ্য রঙ্গাচার্য,বিজয় তেণ্ডুলকর,গিরীশ কার্ণাড,চন্দ্রশেখর কম্বার প্রমুখ অনেকে (নিজ নিজ নাট্যগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করবার আগে হাবিব তনবির এবং বাদল সরকার কিছুদিন এরকমই নাটক লিখেছেন এবং পরিচালনা করছিলেন বলে তাঁদেরকেও এঁদের সঙ্গে জায়গা দিতে হবে বটে)এঁদের মধ্যে ধর্মবীর ভারতী এবং হবীব তনবীরের স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণনবান্নপ্রথমবার অভিনীত হবার দশ বছর পরে ১৯৫৪তে এরাই উত্তর-ঔপনিবেশিক নাটকের গতিপথে ঘূর্ণির সৃষ্টি করেছিলেন(অপর্ণা ভার্গব ধারওয়াড়কারের মতে নবান্নএর পরে এই নাটকের জগতে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা দুটো ছিল ১৯৫৬ এবং ১৯৮৯ সনে সংগীত নাটক অকাডেমি আয়োজিত দুটি পুনরালোচনামূলক আলোচনা সত্র)ধর্মবীর ভারতীর অন্ধ-যুগনাটকে (হিন্দি,১৯৫৪) মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পরের অংশের আশ্রয়ে বিশ্বযুদ্ধের পরের পৃথিবীর,বিশেষ করে ভারতের মানুষের নৈতিক অধঃপতনের চিত্র আঁকা হয়েছিল।ধর্মবীরের পুরাকাহিনির সাহায্যে সমসাময়িকতাকে উজ্জ্বল করে তুলবার বিপরীতে হাবিব তনবির তাঁর আগ্রা বাজারনাটকে (উর্দু,১৯৫৪) একই কাজ করেছিলেন শেষ মধ্যযুগের পটভূমিতে কাহিনি উপস্থাপন করে। শ্রেণি-বৈপরীত্য নির্দেশ করে উর্দুর দুটো উপভাষা ব্যবহার করাও আগ্রা বাজারনাটকের এক উল্লেখযোগ্য দিক।উপভাষা সম্পর্কিত এমন পরীক্ষাই ছিল পরের কালে নয়া থিয়েটারএর সমধর্মী সম্পরীক্ষাগুলোর ভিত্তি।নয়া থিয়েটারপ্রতিষ্ঠা করবার আগের বছরে,অর্থাৎ ১৯৫৮ সচে তনবীর শূদ্রকের সংস্কৃত নাটক মৃচ্ছকটিকমএর হিন্দুস্তানী অভিযোজনা পরিচালনা করে উত্তর-ঔপনিবেশিক  ভারতীয় নাটকের আর একটি মূলসন্ধানী ধারারও শুভারম্ভ করেছিলেন। মোহন রাকেশের আষাঢ় কা এক দিন’ (হিন্দি,১৯৫৮),‘লেহরো কি রাজহংস’ (হিন্দি,১৯৬৮),আদ্য রঙ্গাচার্যেরকেলু জন্মেজয়’ (১৯৬০),গিরীশ কার্ণার্ডের যযাতি’ (কানাড়া,১৯৬১) ইত্যাদি নাটক ধর্মবীর ভারতীর সৃষ্ট পুরাকাহিনির পটভূমিতে লেখা নাটকের ধারাটিকে শক্তিশালী করে তুলেছিল। হাবিব তনবিরের ইতিহাসের পটভূমির ধারাটিকে সমৃদ্ধ করেছিল গিরীশ কার্ণার্ডের টোগলকপ্রভৃতি নাটকগুলো। নাট্যগোষ্ঠীগুলোর নাটকে লোকনাটকের রূপ এবং কাঠামোগত উপাদান ইতিমধ্যে ব্যবহৃত হয়েই আসছিল; ব্যক্তিগত উদ্যোগে লেখা নাটকে সেইসব সম্পরীক্ষা চালানো হয়েছিল বিজয় তেণ্ডুলকারের সারি গা সারি’ (মারাঠি, ১৯৬৪),‘জ্বালা অনন্ত হনুমন্ত’ (মারাঠি, ১৯৬৮),‘রাজা-রাণীলা ঘাম হায়ে’ (মারাঠি,শিশু নাটক,১৯৭২),বিশেষ করে ঘসিরাম কটোয়াল’ (মারাঠি,১৯৭২) নাটকে। এছাড়াও গিরীশ কার্ণার্ডের হয়বদন’ (কানাড়া,১৯৭১),চন্দ্রশেখর কম্বারের জোকুমার স্বামী’ (কানাড়া, ১৯৭২) ইত্যাদি নাটকে।
  বাদল সরকার যতদিন নিজের নাট্যদল করেন নি,তখনকার কথাটি সামান্য আলাদা। সেই বাদল সরকার পাশ্চাত্য নাট্যাদর্শের অনুগামীরূপেই পরিচিত।এবং ইন্দ্রজিৎ’ (বাংলা,১৯৬৩),‘বাকী ইতিহাস’ (বাংলা, ১৯৬৫),‘ত্রিংশ শতাব্দী’ (বাংলা, ১৯৬৬),‘পরে কোনোদিন’ (বাংলা,১৯৬৬),‘পাগলা ঘোড়া’ (বাংলা,১৯৬৭) ইত্যাদি নাটকে বাদল সরকার ভারতে এবসার্ড নাটকের এক ধারার জন্ম দিয়েছিলেন।মধ্যবিত্ত মানুষের উপস্থাপনর প্রসঙ্গে বাদল সরকারের এইসব নাটকের এক গুরুত্ব আছে। মধ্যবিত্ত মানুষের জটিল মনোবস্থা এবং পরিপূর্ণতাহীনতা মোহন রাকেশও ফুটিয়ে তুলেছিলেন,তাঁর তৃতীয় নাটক আধে অধুরেত’-(হিন্দি, ১৯৬৯)কিন্তু মধ্যবিত্ত মানুষের জটিল রাজনৈতিক পরিপার্শ এবং তৎজনিত মনোবস্থা বিজয় তেণ্ডুলকারের সমানে বিস্তার এবং দক্ষতাতে কেউই তুলে ধরতে পারেন নি।বিজয় তেণ্ডুলকারের গিদ্ধাড়ে’ (মারাঠি,রচনা ১৯৫৯,মঞ্চায়ন ১৯৭০),‘এক হট্টী মুলগী’ (মারাঠি,১৯৬৬),‘শান্তাত! কোর্ট চালু আহে’ (মারাঠি,১৯৬৭),‘সখারাম বাইণ্ডার’ (মারাঠি,১৯৭৫), ‘ভাউ মুরাররাও’ (মারাঠি,১৯৭৫),‘পাহিজে জাতিচে’ (মারাঠি,১৯৭৬) প্রভৃতি নাটকে এসব সম্ভব হয়েছে তার সুদক্ষ পশ্চিমা-বাস্তববাদী নাট্যকার রূপটির জন্যে।গিরীশ কার্ণার্ডের মতো সমকালীন,বিচক্ষণ নাট্যকার তেণ্ডুলকারের এই রূপটি দেখে তাঁকে বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ ভারতীয় নাট্যকার বলে স্বীকার করেছেন (রঙ্গ প্রসঙ্গ,জুলাই সেপ্টেম্বর,২০০৮,পৃষ্ঠা ১৩৯,আউটলুক ২ জুন, ২০০৮,পৃষ্ঠা ৬৫)অবশ্য একটি কথা,তেণ্ডুলকারের এই রূপটিই সবচাইতে বেশী আলোচিত;ইংরেজি অনুবাদের অভাবে তাঁর ঘাসিরাম কটোয়াল’-এর বাইরে অন্য প্রতি-বাস্তববাদী নাটকগুলোর,শিশু নাটকগুলো সহ,আলোচনা প্রায় হয় নি বললেই চলে।
  
          বিশ শতকের নবম দশক থেকে বর্তমান অব্দি উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতীয় নাটকে নানা ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। সেগুলোতে প্রান্তিক তথা দ্বি-শোষিত সম্প্রদায়গুলোর উপরে চলা শোষণ নির্যাতনের ছবি বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে। নারীবাদী নাটক লেখা হয়েছে,যেমন নবনীতা দেবসেনের মেডেয়া’ (বাংলা,১৯৯৩),সমকামিতা এবং বিকল্প যৌনত্ব সম্পর্কিত নাটক লেখা হয়েছে। যেমন মহেশ দত্তানির ব্রেভলি ফট দ্য কুইন’ (ইংরাজি,১৯৯১),এবং অন আ মাগী নাইট ইন মুম্বাই’ (ইংরাজি,১৯৯৭);জাতিগত অবদমনের সম্পর্কে নাটক লেখা হয়েছে,যেমনএইচ জি শিবপ্রকাশের মহাচৈত্র’ (কানাড়া, ১৯৮৫)তারউপরে দলিত এবং জনজাতি জীবনের প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েছে শিবপ্রকাশেরই মাদারি মাদইয়া’ (কানাড়া, ১৯৮৫)কিন্তু এই চারটি বিষয়ই তেণ্ডুলকার তাঁর  বিভিন্ন নাটকে ভালো করেই ছুঁয়ে গেছেন। (উদাহরণস্বরূপ,ক্রমে চিরঞ্জীব সৌভাগ্যকাংক্ষিনী’,‘মিত্রচি গোষ্ট’,‘কন্যাদানএবং দাম্বদ্বীপপচা মুকাবেলানাটকে। নাটকগুলোর সময়ের ক্রম ১৯৮১,১৯৮১, ১৯৮৩ এবং ১৯৬৯)আর সেজন্যেই বলতে পারি,এই কটি বিষয়াশ্রয়ী নাটকের তিনি ছিলেন অগ্রপথিক।
                       
                                                            ~~~০০০~~~

কোন মন্তব্য নেই: