মূল অসমিয়া: কৌশিক দাস
বাংলা অনুবাদ: আলি ইব্রাহিম
সংবাদ শিরোনামে এখন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধেয়কের কথাই
দখল করে আছে। বিধেয়কটির আড়ালে রয়েছে শাসক দলের গভীর চিন্তা-চৰ্চা, সতৰ্ক হিসাব-নিকাশ এবং কৌশল। বিধেয়কের
বিরোধিতা করতে হলে তেমন কূটকৌশলের দিকটি ভাল করে জনা প্রয়োজন।
প্রথমেই বলে রাখি, আমরা তৎকালীন রাজনীতির কোনো প্রাজ্ঞ বিশ্লেষক নই। তথাপিও, বিষয়ের গুরুত্ব আছে ভেবেই, আমরা এখানে দুটি দিক নিয়ে
আলোচনার চেষ্টা করছি। আশাকরি যোগ্য ব্যক্তিরা আলোচনাটি সঠিক পথেই নিয়ে যাবেন, আমাদের ভুল-ভ্রান্তি দূরে রেখেই।
প্রথম কথা হল, বিধেয়কটিতে
হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ আদি ধর্মের
মানুষ অন্য দেশে থেকে ধৰ্মীয় কারণে নিৰ্যাতিত হয়ে আসার জন্য তাদেরকে ভারতীয়
নাগরিকত্ব প্রদান করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বুঝতে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে,
অন্য ধৰ্মাবলম্বী লোকের কথা সেখানে থাকলেও, মুখ্য
টাৰ্গেট হচ্ছেন হিন্দু বাংলাদেশিরা। এই পটভূমিতে, এই পোষ্টে
আমরা গুরুত্ব সহকারে তিনটা দিকের কথা আলোচনা করার চেষ্টা করব।
১. NRC-র ব্যাপারে আসামের প্রায় সকল দল-সংগঠনের মধ্যে ঐকমত্য পরিলক্ষিত হয়েছিল। আসু সহ অসমিয়া জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো NRC-র প্রক্রিয়াদি সমৰ্থন করেছিল। কিছু অসমিয়া
জাতীয়তাবাদীরা ভেবেছিল যে "মিঞা’-দের(বাঙালি মুসলমান) মধ্যে NRC এক আতংকের সৃষ্টি করবে, এবং তারা এর বিরোধিতা করবে। কিছু অসমিয়া জাতীয়তাবাদীরা সকল "মিঞা’কেই অনুপ্রবেশকারী বলে ধরে নিয়েছিল (এখনোও নেয়)। তেমন
অযৌক্তিক ধারণার বশবৰ্তী হয়ে তারা ধারণা করেছিল যে "মিঞা’-রা NRC-র বিরোধিতা করবেই। স্বাভাবিকভাবেই সেটা আর হল না। বহু দশক ধরে নাগরিকত্বের
প্রশ্নে লাঞ্ছিত-অপমানিত হয়ে থাকা এই সকল আসামবাসী ভারতীয়ই NRC-কে সাদরে স্বাগত জানালো, NRC-র কাজে সক্রিয়
সহযোগিতায় এগিয়ে এলো।
ছোট্ট করে এখানেই আপনাদের মনে করে দিতে চাই যে
NRC-র ভিত্তিবৰ্ষ ছিল
১৯৭১সন। অসম চুক্তির (১৯৮৫ সনের) সাতে সেটাই ছিল সংগতিপূৰ্ণ।
অনুপ্রবেশের সাথে সম্পৰ্কিত ভিত্তিবর্ষের
প্রশ্নে বিভিন্ন দল-সংগঠন-জনগোষ্ঠীর মধ্যে তেমন ঐকমত্য আগে কখনও পরিলক্ষিত হয় নি।
কিন্তু তা থেকে আমরা এমন একটি সিদ্ধান্তে আসতে পারবনা যে অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত সকল
বিষয়ে সকল আসামবাসীর মত হঠাৎ একমাত্রিক হয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যেই উল্লেখ করা একটি
কথাকে উদাহরণ হিসেবে নিই। একাংশ জাতীয়তাবাদীরা NRC-র মাধ্যমে অধিক সংখ্যায় "মিঞা’(বাঙালি মুসলমান)
বিপৰ্যস্ত হয়ে পড়বে বলে উৎফুল্লিত হয়েছিল। অন্যদিকে মিঞারা NRC-র মাধ্যমেই বহু বছর ধরে ঝুলে
থাকা আত্মপরিচয়ের সংশয় দূর হবে বলে ধারণা করেছিল। স্বাভাবিকভাবেই
নিজেদের মধ্যে বিরোধ থাকা স্বত্বেও দুটো পক্ষই NRC-কে স্বাগত
জানিয়েছিল।
তেমন বিরোধ, তেমন অন্তৰ্দ্বন্দ্ব যে ছিল সেটা সত্যিই,কিন্তু উক্ত
দল-সংগঠন NRC-র ভিত্তিবর্ষের প্রসঙ্গে একমত হওয়ার জন্য বহু
দশক ধরে আসামকে ভারাক্রান্ত করা সমস্যাটির একটা সমাধান আংশিকভাবে হলেও যে বেরোনোর
সম্ভাবনা দেখা দিয়ে ছিল,সেটা তারা বিশ্বাস করেছিল।
অনুপ্রবেশের সমস্যাটিকে জীবনীশক্তি করে গড়ে ওঠা নোংরা রাজনীতির জন্য এই কথাটা খুব
অস্বস্তিকর হয়ে পড়েছিল কিছু রাজনৈতিক দলের জন্য। কারণ বহু বছর ধরে এই সমস্যাটি ছিল
সোনার ডিম পাড়া হাসের কাহিনীর মতোই।আসু-আমসু-কংগ্রেস-বিজেপি-এদের তাৎক্ষণিক
সুবিধাবাদী রাজনৈতিক অবস্থান কিম্বা অস্তিত্ব অনুপ্রবেশের সমস্যার সাথে বহুদূর
পর্যন্ত সম্পৰ্কিত ছিল। উল্লেখযোগ্য কথা হল, একমাত্র
বামপন্থী দলগুলিই এই সমস্যা থেকে তেমন কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মুনাফা লাভ করতে পারে
নি,বরং উক্ত সমস্যা একসময়ে তাদের প্রতি যথেষ্ট দুৰ্যোগ এবং
প্রত্যাহ্বান নিয়ে এসেছিল। গত শতকের অষ্টম দশকে তেমনই প্রত্যাহ্বানের বিরোধ করতে
গিয়ে তাদের করা বীরত্বপূ্ৰ্ণ সংগ্রাম এবং আত্মবলিদান আসামের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে
থাকবে।অবশ্য পরে একাংশ বামদল নিৰ্লজ্জের মতোই জাতীয়তাবাদী শিবিরের সাথে সংসদীয়
ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করেছিল।(সাথে বলে রাখি,অনুপ্রবেশের
প্রসঙ্গে বামপন্থী দলগুলোর মধ্যেও মতদ্বন্দ্ব আছে।সাথে এটাও বলে রাখি যে,অনুপ্রবেশের প্রসঙ্গে এই পোষ্টদাতারও বিরোধ আছে বামপন্থী দলগুলোর একসময়ের
বিচার-বিশ্লেষণের সাথে। সেগুলো অবশ্য প্রসঙ্গান্তরের কথা)।
যাই হোক,
NRC-র মাধ্যমে অনুপ্রবেশের সমস্যার সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা বিনষ্ট
করা সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দলগুলির জন্য খুব দরকারি হয়ে পড়ল। কথাটা বহুদূর পর্যন্ত
ভোট ব্যাঙ্কের সাথে সম্পৰ্কিত। হিন্দু বাঙালি এক্ষেত্রে তেমন দলগুলির টাৰ্গেট হয়ে
পড়ল। তেমনই একটি পটভূমিতেই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধেয়ক কাৰ্যকরী করতে সক্রিয় হয়ে
উঠার কথাটা সম্পৰ্কিত হয়ে আছে। মূলত কোন শিবির এক্ষেত্রে সক্রিয়, সেটা বলা বাহুল্য।
২. আসামবাসী বাঙালিদের প্রসঙ্গে নাগরিকত্ব সংশোধনী
বিধেয়কের কিছু আলোচনা এই ফেসবুকে ইতিমধ্যে হয়ে গেছে বা হয়ে আসছে। কিন্তু বিধেয়কটির
তাৎপৰ্য মাত্র ভাষিক পর্যায়েই সীমাবদ্ধ বলে ভাবলে ভুল হবে। এর সাথে ধৰ্মীয় দিকটিও
অনিবাৰ্যভাবে বিযুক্ত হয়ে আছে। বাংলাদেশি হিন্দু বাঙালিদেরকে নাগরিকত্ব প্রদানের
কথাটা আসামে বাস করা অসমিয়া,বাঙালি ও অন্যান্য ভাষিক জনগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া এই দুই কথাই বহুদূর পর্যন্ত
প্রভাবান্বিত করবে- প্রথমত, তাদের ভাষা, দ্বিতীয়ত ধৰ্ম। এইগুলির উপরে ভিত্তি করে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধেয়কটির
সন্দর্ভে, ক্ষেত্র বিশেষে, তারা উৎফুল্লিত
কিম্বা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠার সম্ভাবনা রয়েছে।
বলা বাহুল্য,আসামবাসী এক্ষেত্রে উৎফুল্লিত হয়ে উঠা কিন্তু মোটেও যুক্তিসঙ্গত কথা হবে না,তার সম্ভাবনাও হয়তো নেই বলব। কিন্তু
বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে,সেই ক্ষোভ সঠিক দিকে পরিচালিত নাহলে আসামের মাটি আরও একবার রক্তাক্ত হয়ে
উঠবে,সেটা নিশ্চিত বলা
যায়।কথাটি কোনো রাখঢাক না রেখে এভাবেও বলা যায়,যে বিপুল
সংখ্যক বাঙালি হিন্দু বাংলাদেশীকে নাগরিকত্ব প্রদান করার প্রস্তুতিতে অন্য ভাষিক
জনগোষ্ঠীর মনে বহুমাত্রিক (যেমন সংখ্যালঘু হয়ে পড়ার ভয়, সাংস্কৃতিক
আধিপত্যের সংকোচন ইত্যাদি) আশংকার জন্ম দেবে।এই আশংকাজনিত ক্ষোভ সমগ্র বাঙালি
সমাজের দিকে ধাবিত হওয়ার সম্ভাবনাই অত্যন্ত প্রবল।তেমন সম্ভাবনার সতর্কবাণী
ইতিমধ্যেই কোনো কোনো মানুষের মত-মন্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে,কথাটা
খুবই উদ্বেগের কথা কিন্তু। সবাই মনে রাখা ভাল যে সমগ্র বাঙালি সমাজটিই এক্ষেত্রে
কোনোভাবেই দায়ী নয়। তাদের বলির পাঠা
বানানো এসমস্ত ঘটনাবলীর আড়ালের অপশক্তি কারা,সে বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া অত্যন্ত জরুরী কিন্তু। নাহলে যতই তীব্র হোক তাদের
সকল বিক্ষোভ-প্রতিবাদ,সবই পথভ্রষ্ট পণ্ডশ্রম হয়ে পড়বে।কথাটা
এখানেই শেষ নয়, আসামবাসী বাঙালিসমাজ অন্য জনগোষ্ঠীর দ্বারা
আক্রান্ত হলে,নিরাপত্তার অলীক আশ্বাসে তারা বাধ্য হয়ে ধৰ্মীয়
সাম্প্রদায়িক অপশক্তির পাশে চলে যাবেন,এধরণের কূটকৌশল সমগ্র আসামবাসী
অনুধাবন করা খুবই প্রয়োজনীয়।
এক্ষেত্রে বলা যায় আসামের বাঙালি সমাজেরও কিন্তু একটি
গুরুদায়িত্ব আছে। তারা নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধেয়ক সম্পর্কে অন্যান্য আসামবাসীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সহযোগিতা করতে
হবে। ১৯৬০ কিম্বা ১৯৭১ সনের সেই পৈশাচিক উন্মাদনা নিশ্চয় কোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন
লোকই পুনরায় ঘুরে আসাটা কামনা করবেন না। সুখের কথা হল,কোনো কোনো আসামবাসী বাঙালি সংগঠনে
ইতিমধ্যেই কথাটির গুরুত্ব অনুধাবন করে সুস্থ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছে।আজকের
(১৫.১০.২০১৬) অসমিয়া সংবাদ পত্রে প্রকাশ
হয়েছে যে সারা আসাম বাঙালি যুব ছাত্র ফেডারেশন উক্ত বিধেয়কের তীব্র বিরোধিতা
করেছে। এটা অবশ্য খুব ভাল খবরই বলব। বাঙালি সমাজ এমনই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করলে সকলেরই
মঙ্গল।
৩. শেষের দিকটি সংক্ষেপে উপস্থাপন করে শেষ করব।
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধেয়কের লজিক্যাল ভিত্তিটাই বা কী? বলা হয়েছে যে বাংলাদেশে হিন্দুদের
ধৰ্মীয় কারণেই আজ তারা নিরাপত্তাহীন। কথাটা কি সত্য? তাহলে
এখানে একটি তথ্য দেওয়া যাক, ২০০৭ সালে বাংলাদেশে দূৰ্গা পূজার
মণ্ডপের সংখ্যা ছিল ২৭,০০০-টা। এবছর (২০১৬) এই সংখ্যা ২৯,৫০০। গত বছর (২০১৫) এই সংখ্যা ছিল ২৯,০৭৪। এই
পরিসংখ্যান কিই বা প্রমাণ করে? সেটা আপনারা বুঝবেন আশা করি।
অত্যন্ত আবেগের সাথে বলতে হয় যে,বাংলাদেশের হিন্দু এতো বেশি
নিৰ্যাতিত যে তাদেরকে আসামই নিরাপত্তা দেবে;কিন্তু বাস্তব
তথ্যই যেখানে সম্পূৰ্ণ বিপরীত, সেখানে এ ব্যাপারে কীই বা বলার।
(সীমিত জ্ঞান,ভুল-ভ্রান্তি
মিলিয়ে এই লেখাটি বঙ্গানুবাদ করেছি। আপনারা চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ এই বিষয়ে আরও ভালো
মতামত দিলে আলোচনা আরও ভাল ও সুস্থ হয়, সাথে ভুল ভ্রান্তিজনক
কোন অসুবিধে থাকলেও দেখিয়ে দেবেন।)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন