(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার উজান পর্বের অধ্যায় সাঁইত্রিশ ---সুব্রতা
মজুমদার।)
সাঁইত্রিশ
জলের প্রাণীকে মানুষ বোকা ভেবে শিকার করে, খুশিতে ঝলমল করে ওঠে মুখ যখন
দেখে হাতখলুই ভরে গেছে রূপালি ফসলে । কিন্তু বৈতল জানে, জলের জীব এত বোকা নয় । কিন্তু
লোভে আর কিছু নিরুপায় হয়ে ধরা দেয় মানুষের জালে, মানুষের টোপে । জলের ভিতর আছে
মাছের নিজস্ব সংসার, নিজস্ব এলাকা । এলাকা ছাড়া বড়ো একটা যায় না
তারা । মাছেদের মধ্যেও আছে গুণ্ডা বদমাশ । বড় মাছ ছোট মাছকে খায়, তাই মা মাছ পোনা মাছকে রক্ষা করে
। খাদ্যাখাদ্যের ভেদ জানে যারা তারা টিকে থাকে আর লোভী বোকার দল ধরা পড়ে ।
মাছভর্তি পুকুরে বোকা আর চালাক মাছের সংসার চেনে বৈতল । বোকা মাছ, যারা সহজে ধরা দেয় তেমন মাছে
উৎসাহ নেই বৈতলের । একটা সেয়ানের সঙ্গে সে সারাদিন লড়াই করতেও রাজি । সেই কোন ঝড়ের
রাতে বইয়াখাউরির বড় হাওরে এক দুই মণি বোয়ালের কামড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েও ব্যাটাকে কাবু
করেছে বৈতল । তখন আর তার বয়স কত, পনেরো ষোল হবে । বাপ খুশি হয় । বাপেরও আছে
বৈতলের সঙ্গে বুদ্ধির লড়াই, হাতখলুইএ আলদের বাচ্চা ঢুকিয়ে দেয় । নিজের
বাপকেই বোঝেনি বৈতল জীবনে । মারতে চেয়েছে, নাকি প্রতিকূলতা সয়ে জলের সংসারে
বাঁচতে শিখিয়েছে । বরাক নদীর জলে তার কালো হিলহিলে শরীরটা ভাসিয়ে দয়ে ভাবছে হঠাৎ
হঠাৎ কী থেকে যে কী হয়ে যায় । বন্ধুত্বের সংজ্ঞা খোঁজে, দুখুকে বৈতল তার প্রাণের থেকেও
বড় বন্ধু ভেবেছে । একদিন সন্ধ্যার আঁধারে নির্মীয়মাণ বরাক নদীর পুল থেকে পড়ে যখন
মৃত্যু অবধারিত, সেই নতুন দেশের নবীন বন্ধু দুখু মিয়াই তাকে বাঁচায়, বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ভাঙা
পুলের মুখে । বোকা মানুষ বৈতলের অন্ধকারের দৌড় থামিয়েছে বুক চিতিয়ে । দুজনেরই
মৃত্যু হতে পারত । শুধু কি দুখু, আরো দুজনও বোকা মানুষ তার পাশে দাঁড়িয়েছে।
আপদ আর বছই । ধর্মে আলাদা জেনেও মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছে । দুখু কি তবে তাকে
মুরগি পুষেছে এই দিনের জন্য । একবেলায়, এক অচেনা ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় কী
করে সব ওলটপালট হয়ে যায় । ধীরে ধীরে তৈরি-হওয়া সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় ।
দুখু কি ওকে রক্ষা করতে পারে না, মামুপিরের বাড়িতো সামনেই, ওখানে পৌঁছে দিলেই বেঁচে যায় ।
নাকি ওখানেও ধাওয়া করবে দাঙ্গাবাজের দল । দুখু তো জানে জলের নাগাল পেলে বৈতল হয়ে
ওঠে মহাবীর, তবু বোকার মতো ফেলে দেয় জলে । দুখু জানে বৈতলের রিক্সা তার
জান, তাও ফেলে দেয় জলে, এত নিষ্ঠুর । কিন্তু বৈতলও কম
নিষ্ঠুর নয়, সেও বদলা নিতে জানে । প্রাণের বন্ধু, শৈশবের বন্ধু, কৈশোরের বন্ধু কৈশোর-যৌবনের দোস্ত লুলাকেও গলা টিপে
মেরেছে । বৈতলের কোনও অনুশোচনা নেই । কিন্তু লুলা থেকে দুখুকে সে অন্য আসনে
বসিয়েছে, আরো বড় অনেক দিলদার । দুখুর সঙ্গে তার সব রাগ অভিমান ঝগড়া ।
সেই দুখু তাকে এমন দাগা দেবে বুঝতে পারে না ঘুণাক্ষরেও । বৈতল বুড় বুড় শব্দে তলিয়ে
যায় জলের অতলে আবার ভেসে ওঠে ভুস্ । জল যে এত প্রিয় তার, জলের গভীরে গিয়েও বৈতলের কোনও
সুখ নেই । বড় একাকী জলে নামলেই, জলের প্রাণীর সঙ্গে মিত্রতা চাইছে । আয় মাছ, আয় মকা পুঁটি কাতলা রুই মৃগেল
বোয়াল চিতল রিঠা, আয় সর্প আয় আলদ আয়, আয় অলগর্দা, চিতি ঢোঁড় শঙ্খচূড়, লাউডগা আয় কালী নাগ, অষ্টনাগ, ডাকে ঘড়িয়াল আয় । বৈতল ডাকে
সবাইকে, কুচুটে মানুষের রাজ্য থেকে সে আজ বিতাড়িত । প্রিয় বন্ধুও আজ
ধর্মের জন্য সমর্পণ করেছে জলে । বৈতল অবাক হয় জলের নীরবতায় । এমন চুপ, নেই কোনও জলজন্তুও । ভরা বর্ষার
নদীও বৈতলকে বঞ্চিত করে । একাকী বৈতল ডুবছে আর ভাসছে আর দেখছে পারের কাণ্ডকারখানা
। সার সার মশালের লাফঝাঁপ । কুতুবউদ্দিনের জন্য বড় কষ্ট হয় । সকালে এরকম এত মিষ্টি
ছেলেটি কী করে বদলে যায় রাতে । সকালে মসজিদ কমিটির কাছে সুপারিশ করে বৈতলের হয়ে ।
বলে সে তাকে বিনিপয়সায় রিক্শা চড়ায় । এই তার কৃতজ্ঞতা । ছেলেটার মুখ দেখে বড় মায়া
হয় । পোষাকটাও পরে ভারি সুন্দর, সাদা সালোয়ারের মতো পাজামা থাকে গোড়ালির উপর
। পাঞ্জাবিটা অন্যরকম । হিন্দুদের মতো নয়, একটু লম্বাটে সাদা । মাথায় টুপি
। মসজিদের ভিতর ছাত্রাবাসে শুধু সালোয়ারের বদলে সবুজ লুঙ্গি, চৌকো ঘরকাটা । বৈতলেরও একটা
সালোয়ারের আছে কুচি দেওয়া, মনসাপুথি পড়ার সময় পরে । নাগ পঞ্চমীর দিন
কালো মানুষ বৈতলের সর্বাঙ্গে তখন সাদা বেশ, হাতেও সাদা চামর । ব্রতধারিণীরা
ভক্তি ভরে সারাদিন শোনে আইমনসার অলৌকিক কাণ্ডকারখানা আর থেকে থেকেই ধুয়া ওঠে ‘জয় মা মনসার জয়’ ‘জয় বিষরি মাইর জয়’ । ঐ একটা দিন বৈতলের মধ্যে দেবভাব
বিরাজ করে । কুতুবউদ্দিনের মুখটা দেখলেও বৈতলের দেবশিশু মনে হয় । এমন নিষ্পাপ ।
সেই মিষ্টিমুখের ছেলেটি যে কী করে পারে এত বড় অন্যায় করতে । দুখুও একবার বলে না
বৈতলের রিক্সার নাম শুধু পক্ষীরাজ নয়, বুরবাকও । তার ধর্মেরও স্বর্গীয়
ঘোড়া ।
আসলে বৈতল শুধু একটি দেবশিশু দেখেনি । এক
জোড়া দেবদূতের দেখা পেয়েছে । কুতুবের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে দেয় ওরই সমবয়সী টোলের
ছাত্র যামিনী আচার্যর সঙ্গে । এক পা খোঁড়া এবং খর্বকায় কিশোর ছাত্রকে বন্ধুরা ডাকে
বাট্টি আচার্যি । এক আচার্যি আর এক লস্কর বৈতলের রিক্সায় ওঠে, যায় কাছাকাছির গন্তব্যে ।
দুজনকেই বৈতল টেনে নিয়ে যায় তার প্রিয় নদীচরে । ওপারে গ্রাম দুধপাতিল । মাঝে নদী
বরাক । শীতের সময় বৈতল তার মেয়েকে নিয়েও এসে বসে থাকে জল আর বালির মধ্যে ।
দুই ছাত্রেরই প্রধান আকর্ষণ বিস্তীর্ণ নদীর
চর । ‘দুজনই নদীর পারে এসে বাড়ির জন্য মন খারাপ করে । কুতুব যায়
বাঁধের নিচে, তার নানার কবরে জিয়ারত করে । আর বাট্টি-আচার্যি যামিনী যায় তার মামার
বাড়ির গ্রাম দুধপাতিল । নৌকো পেরিয়ে যায় ওপারে । দুজন এক হলে বৈতল দুজনকে দেয় এক
একটি শুকনো মহুয়ার ফুল । খাওয়ার কথা বলে না, সে নিজেই খায় একটা । ওরাও মুখে
দেয় । ভাল লাগে না ফেলে দেয় থু থু করে ।
বৈতল এবার দুজনকে বসিয়ে একই প্রশ্ন করে । একেকজনের জবাব হয় একেক রকম । বলে,
--- তুমি কিতা পড় ।
--- আমি আরবি পড়ি ।
--- আর কিতা পড় ।
--- বাংলা পড়ি ।
--- মনসাপুঁথি পড়ছ নি । রূপবানর গান
শুনছ নি ।
--- না । ইতা ইন্দুর বাড়িত পড়ইন ।
রূপবান শুনছি, ধাইমা গো ।
বৈতল যামিনীকেও প্রশ্ন কে কী পড়ে । যামিনীর
জবাব সংস্কৃত । এরপর বাংলার কথাও বলে, বাট্টি আচার্য বলে সে রূপবানের
গান শোনেনি, মনসা পূজা হয় বাড়িতে, পুঁথি পড়েনি ।
বৈতল দুই শিক্ষার্থীর মনের মিল করিয়ে দেয় ।
আরবি সংস্কৃতের মিল । দুজনের গন্তব্য এক জেনে সহাবস্থানের প্রস্তাব দেয় । বলে,
--- ভাড়া কম পড়ব । কও যাইবায় নি এক
রিকশাত । নাইলে তুমারে দিয়া আইয়া তারে লইয়া যাইমু । দুই পয়সা করি দিবায়, দেখ ।
দুজনেই রাজি হয়ে যায় । মনের আনন্দে দুই
ধর্মের দুই শিক্ষার্থী নিয়ে বৈতলের পক্ষীরাজ ছোটে নদীর পার । প্রথম পরিচয়েই দুজনে
বন্ধু হয়ে যায় । রিক্সায় বসে দুই সখায় গল্প করে আর শুনতে শুনতে বৈতল হাসে । কুতুব
বলে,
--- আমপারা সিপরাও পড়ন লাগে । কুরাণ
পড়মু কেমনে । বাংলাও পড়ন লাগে, মাতমু কেমনে ।
ল্যাংড়া ঠাকুর যামিনী বলে,
--- আমি আরবি জানি না সংস্কৃত জানি, বাংলা জানি । আরবি শিখাই দিবে নি
। ডাইন দিক থাকি লেখন লাগে নানি । খালি তেড়া তেড়া টানা দিয়া লেখা, মাত্রা উত্রা নাই । আমার বাবায়
খুব বিটলামি করতা, ঠাটা পড়লে আকাশে জিলকায় নানি, বাবায় মারে কইতা, অউ দেখ গো ভগবান আল্লা হই গেছইন, আকাশো আরবি লেখরা ।
--- নানায়ও সংস্কৃত মন্ত্র পড়া নিয়া
কইতা, সংগোস কিড়িমিড়ি, কইতা অংবংচং । আমারও খুব ইচ্ছা
সংস্কৃত পড়তাম ।
--- সংস্কৃত পড়িয়া কিতা করতে । টুলোউ
ছাত্র হয় না, টুল বুলে বন্ধ হই যাইব । সংস্কৃত শিখিয়া কিচ্ছু হয় না, এক পুরইতগিরি নাইলে কুষ্টি লেখা
। অউত্ত কাম ।
--- নারে, রামায়ণ মহাভারত পড়তাম ।
--- হি তো বাংলাত আছে । কাশীদাসী আর
কিরাতিবাসী ।
--- বাংলাত আছে নি । দিছ চাইন ।
--- সব অউ বাংলাত আছে । কুরানও
বাংলাত আছে ।
--- থাকলে কিতা অইব । আরবি ছাড়া অইত নায় ।
--- অইত নায় কেনে ? ওয়াইলেউ হয় । আরম্ভ করি দিলেউ
অইল ।
--- নাবে, ইসলামো ইতা অয় না । মারি ফালাই
দিব ।
--- কেনে মারত । আমার ইচ্ছা অইছে
মাতৃভাষাত পড়মু, তেউ ।
--- ইসলামি বেরাদবিত ইতা চলে না ।
তুইন পারবে নি অংবংচং সংস্কৃত মন্ত্র বাংলাত কইতে ।
--- লেখাত হয়, ঠিক অউ কইচছ । বিয়ার মন্ত্র
বাংলাত পড়ে না কেউ, গায়ত্রী মন্ত্র বাংলাত অয় না ।
এই পর্যন্ত বৈতল কুতুবকে যামিনীকে আলাদা করতে
পেরেছে কণ্ঠস্বর দিয়ে এবং বিষয় দিয়ে । ইটখোলা বাজারের কোলাহলে ঢোকার পর আর
কণ্ঠস্বর আলাদা করতে পারে না, কিন্তু বৈতলের সংলাপ এবং বিষয় বুঝতে অসুবিধে
হয় না । দুজনের যে কেউ একজন বলে,
--- বাংলাত অত পণ্ডিত আছলা না । সহজ
সরল মানুষ আছলা । তারা কত দামি দামি কথা কইছইন, কবিতা লেখছইন । আইচ্ছা কচাইন ই
কবিতা কার লেখা ।
‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি
হিংসে বঙ্গবাণী
সেসব কাহার জন্ম
নির্ণয় না জানি
দেশি ভাষা বিদ্যা যার
মনে না জুরায়
নিজ দেশত্যাগি কেন
বেদেশে না যায়
মাতা পিতামহক্রমে বঙ্গেতে বসতি
দেশি ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি ।’
একজনের প্রশ্নে অন্য কিশোর পণ্ডিত বিচলিত হয় ।
অনেক ভাবনা চিন্তার পর বলে,
--- রঘুনাথ শিরোমণি নানি । পঞ্চখণ্ডর
পণ্ডিত ।
--- ধুর বেটা ফেইল ।
--- তে কিতা । কুনু বৌদ্ধ কবি । এর
বাংলা ঠিক বাংলা না ।
--- না, খাটি বাঙলার লেখা । কবি আব্দুল
হাকিমর নাম হুনছস নি ।
--- ঠিক নি বে । তেউ ক । আমরা বাংলা
না শিখিয়া আরবি আর সংস্কৃত দিয়া ধর্ম শিখিয়ার । কী আড়ুয়া ক আমরা । মাতৃভাষা এক
ধর্মভাষা আর এক । ইংরাজি না জানলে মানুষ হয় না, জহরলালে আবার কইছইন হিন্দি অইব
রাষ্ট্রভাষা ।
--- আর রাজ্যভাষা আসামি ।
--- অত ভাষা, আর ধর্মভাষা শিখিয়া কিতা লাভ অর
ক চাইন ।
--- অর নানি তে । তর ঘর পড়ানির লাগি
। অউ যে রিক্সা চালাইরা তানে দেশ থাকি খেদানির লাগি ।
--- আমরার অউ দেশর এক কবিয়ে কইছইন, দুনিয়াত এমন কুনু মহাপুরুষ আইজ ও
আইছইন না যার লাগি ধর্ম সম্প্রদায়র সংখ্যা কমছে । একজন মহাপুরুষর জন্ম মানেউ আর
একটা নতুন সম্প্রদায় ।
--- নতুন করি আগুন । নতুন ধর্ম, ধর্মান্তরীকরণ ।
--- একেবারে হাচা কথা ।
--- কে ক চাইন ই কবি । আর তুই অততা
শিখলে কেমনে ।
--- হাচা কথা কইতাম নি । নতুনপট্টিত
অমূল্যর চার দুকানো গিয়া আমি চা খাই সকালে, তখন দুইজন মাস্টর আইন, নতুন আইছইন মলইবাজার থাকি । তারা
দুইজনে মাতইন, আমি গিলি ।
বৈতল অবাক হয়ে শোনে দুই পণ্ডিতের আড্ডা ।
বাচ্চা বাচ্চা ফাজিল পণ্ডিতের চিন্তার স্বচ্ছতায় মুগ্ধ হয় । সিটের উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে বলে,
--- সালাম, দণ্ডবৎ প্রণাম বাপ হকল ।
রিক্সা বাঁধের উপর রেখে দুই পণ্ডিতকে নিয়ে
নেমে যায় নদীর চরে । দুই ভিন্নধর্মী বন্ধুকে বলে,
--- বাবা হকল, একটা বিড়ি খাও ।
কুতুবউদ্দিন দুই গালে থাপ্পড় খেয়ে বলে,
--- রামো রামো ।
ল্যাংড়া পণ্ডিতও শ্মশ্রুবিহীন থুতনিতে হাত
বুলিয়ে বলে,
--- তওবা তওবা ।
বৈতল বর্ষারাতে দাঙ্গার রাতে নদীর জলে ডুবতে-ডুবতে ভাসতে-ভাসতে ভাবে, কী করে হয় পরিবর্তন । কী করে হয়
এমন হিংস্র । ধর্মভাবনা কি মানুষের জীবনের থেকেও বড়, মানবিক সম্পর্কের থেকেও বড় ।
গুরু সৃষ্টিধরের স্মরণও আজ তাকে সান্ত্বনা দিতে পারে না । গুরুজি বৈতলের মন ভাল
করার শান্ত করার কত উপায় বের করে দিয়েছেন । কিছুতেই কিছু হয় না বৈতলের । তবু ভাবে
গুরুর কথা নিয়ে । গুরু বলেন,
--- দেখো বাবাজি । একলা মানুষ বড়
ভালা । হে হিন্দুও নায় মুসলমানও নায় । হে মান আর হুশ আলা । হে তুমার কুনু ক্ষতি
করত নায় । কিন্তু হউ একলা মানুষ অউ জাতো পড়লে খুয়াই লায় হুশ্ । তখন হে রায়ট করে, ভাই মারে, ভইন মারে । বন্ধু মারে, মা-রে মারে বাপ-রে মারে ।
বৈতল ভাবে, দুখুর সঙ্গে তার হিসেবনিকেশ করবে
পরে । কিন্তু কুতুব । কুতুবের কী ক্ষতি সে করেছে । কুতুব তো পণ্ডিতের মতো কথা বলে ।
সেই তো মরে বেঘোরে ।
বৈতল
পরদিন ভোরের বেলা ভেসে ওঠে অন্নপূর্ণা ঘাটে,
দাঙ্গার রাতেই সান্ধ্য আইন ঘোষিত হয় শহরে ।
লালপাগড়ি পুলিশ আর হিন্দুস্থানী মিলিটারির ভারী বুটের শব্দে শহর স্বাভাবিক হয়
তিনদিনেই । চাক্কু খাওয়া গিলানিও সুস্থ হয়ে ওঠে । জোর গলায় বলার সাহস নেই কারো, রাজনীতির বাজারে কোনও প্রতিপক্ষ
যে নেই, তবু কানাঘুষায় সবাই জানে নকল রায়টের মহড়ার পিছনে কে বা কারা
। দেশভাগ স্বাধীনতার কাণ্ডারী জোয়াল কাঁধে জোড়া বলদের প্রতীককে অপ্রতিদ্বন্দ্বী
করার প্রস্তুতি মহড়া । নতুন দলবদল করা জমিদার যমুনাপ্রসাদ এবার বিধানসভার প্রার্থী
। পদ এবং নির্বাচন যে প্রায় নিশ্চিন্ত ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন