“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৬

সুরমা গাঙর পানিঃ উজান পর্ব ৩৬

(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই  উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার  উজান  পর্বের  অধ্যায়   ছত্রিশ   ---সুব্রতা 
মজুমদার।)   



ছত্রিশ

  দুখুও বদলে গেছে । রায়ট হলে মানুষ মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে । ইটখোলায় হরিৎবরণের তিন মাথা পেরিয়ে যায় বৈতল । নছিবালি হাকিমের দিঘী পেরিয়ে
যায়, বৈতল পায়ে জোর পায় না, প্যাডেলের গতি কমে । সংস্কৃত টোল পেরিয়ে যায়, বিধু চৌধুরির শেষ হিন্দুবাড়িটাও পেরিয়ে যায় । সুলতান আহমেদ পোস্টমাস্টারের বাড়ির গায়ে বেচুদার বাড়ি । এখানে সবার বাড়িতেই এক একটা পুকুর, পুকুর পারেই বেচুদা পাঁঠা খাসি কাটে । শহরের একমাত্র ভ্রাম্যমান কশাই । বিসমিল্লা করে হালাল করে । এসব দাঙ্গা হাঙ্গামা হলেই বেচুদার বিক্রিবাটা কমে যায় । তখন যে তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায় । মূল গ্রাহকের কাছাকাছি হতে পারে না । তখন মাংস নিয়ে হিন্দু মুসলমান তকরার শুরু হয় । পাড়ায় শুরু হয় রবিবাসরীয় পাঁঠাবলির মহোৎসব । বলিচ্ছেদের এক কোপে কাটা হয় সমবায়ী পাঁঠা, মানে কয়েকটি পরিবারের যৌথ উদ্যোগে কেনা হয় পাঁঠা, অবিকল বেচুদার অনুকরণে কিত্তা পাতার মচাবানিয়ে দিয়ে আসা হয় বাড়ি বাড়ি, আর বেচুদার বিরুদ্ধে প্রচারটাও হয়ে যায় মুখে মুখে । মুসলমান কসাই প্রাণীকে বড় কষ্ট দিয়ে মারে । কী নিষ্ঠুর, গলার নালী কেটে ছেড়ে দেয়, এর নাম হালাল । এত কষ্ট দিয়ে আড়াই পেঁচ দেওয়াকে সমর্থন করে না বৈতল । আসলে মৃত্যুর মুখোমুখি জন্তুটার ছটফটানি সহ্য করতে পারে না বৈতল । তাই দুখুকে দায়ী করে বলে,
--- অত কষ্ট দিয়া মারছ কেনে এক কুপে ত মারি লাইলে হয়
--- , এক ঝট্‌কায় মারলে মারা নায়, হালা করলেউ মারা, নানি । সব মারাউ মারা রে বলদ । আমারে ইতা কইছ না, ইতা হুনলেও আমারার গুনা হয় ।
--- মাতিছ না বেটা, বাঙালর লাখান আজাব আছে নি । পাঠা ছাগি মানে না । ছাগির পুন্দো বিচি ঝুলাই রাখছ ।
--- রাখে তোর লাখান খবিছ হকলর লাগি । ছাগি নু মা, গরু নু মা । খাওয়ার জিনিষ খাইতে বেটা, অত কিতা ।
--- তে গরিব মাইনষর ইতা নাই । তারা হক্কলতাউ খায় । আমি খাই নানি গোস্ত । খাই । এর মাঝেও তর লাখান গান্ধি পুক দুই একটা আছে । পাকিস্তানর ঝান্ডা উঠানির লাগি জান দিলায় । তুই জানছও না পাকিস্তানর ঝান্ডায় কিতা অয় আর ইন্ডিয়ার পতাকার কিতা অয় । তরে কই দিছে, তর মাথা খাইছে শহরর শয়তানে, পয়সার জুরে আর দুই এক ছত্তর লেখাপড়ার জোরে ইতায় শয়তানি করে । গরিবরে ঠগায়, পেটর ভাত দিত পারে না, কাপড় দিত পারে না, ধর্ম দেয় । ধর্ম পাইলেউ সব পাই লাইল, ঝান্ডা পাইলেউ পেট ভরি যায়, তনাইর তেনা অই যায় সিলিকর কাপড়, আর ধর্ম কই, মরারে মারাত ধর্ম । হালাল করাত ধর্ম এক কুপে মারাত ধর্ম । হুরইন দি মারো ইতা ধর্মর কপালো
--- চুপ যা, চুপ যা ইতা মাতিছ না বে ডগা । মাইর খাইয়া মরবে ।
--- কেনে মাততাম না । সারা বছর তো বেচুদার মচা খাইলে আর নূতন বছর আইলেউ তারাপুর  । নববর্ষর মাংস হিন্দু পাঁঠা না অইলে অইত নায় । সকাল থাকি লাইন । পাচ টেকা সের, এক পোয়া মাংসর লাগি কী খাকরা খাকরি । তেও পছন্দসই মাল তো পাইতে নায় । ছিনা গর্দান কওয়ার উপায় নাই । পর্দা মর্দা তেলে তুলে মিলাই দিল, তেও বাড়ি আইয়া যখন সিদ্ধ হয় না, কয়, কয়ফল দিলাও এক টুকরা । তেও না অইলে কইব ঠগাইছে মাধব হালার হালায়, জুতার চামড়া দিলাইছে । নাইলে কইব ছাগির মাংস দিলাইছে ।
--- দিলে দিছে, তর কিতা বে-আক্কল ।
--- কেনে তে । বেচুদার রুটি মারত কেনে খামকা । বেচুদা আমার ভাই । হে ও আনপড় আমিও আনপড়, হেও দিন আনে দিন খায়, আমিও অলাখান । বেচুদায় ঠগঠগামি করে না । বাবু হকলর পছন্দ জানে, কিত্তাপাতার মচাত ঠিকঠাক দেয় । মাংসর গন্ধে আর গরম মশলার গন্ধে যখন ঢেকইর তুলে তখন তো কয়, বেচুর মাংস! পয়সাও কুনু নগদ নেয় নি । যে যখন পারে দেয় তে কেনে । অখন কিগু এক গিলানিএ মাইর খাইছে, তুই ছলি গেচছ । পারছ তে যাছ না যম জমিদার ইগুরেও চাক্কু মারিয়া আয়, কইমু বেটা ।
    অকারণ কথা সাজায় বৈতল । দুখুর মন বোঝার চেষ্টা করে । দুখু রাগে । বলে,
--- কান মগজ খাইচ না । অখন চালা, কুনুরকম গিয়া উঠ বান্দর উপরে ।
--- তুই আমারে বান্দর উপরে আনলে কেনে হারামজাদা । আমারে মারতে । বৈতল ইতা ডরায় না । তুই ভাবিছ না বৈতল একলা মরব । তরেও ছাড়ত নায় । কাইল যে মরিবায় নিধি / এরে নি তুমি চাও । তরে বাচানির লাগি আইলাম আর তুই হিতারে ডাকরে । ডাক ।
    বৈতল বরাক নদীর জলে টইটুম্বুর বাঁধের উপর উঠিয়ে দিয়েছে তার পক্ষীরাজ । বৈতল দেখে একদিকে অন্ধকার আর মসজিদের দিকে সার সার মশাল । মশালের আলোর ভিতর জটলা । একজনকে পেয়েছে, লাঠি সড়কি দিয়ে খুব মারছে । বৈতলের তখন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য অবস্থা । আর বাঁচার কোনও উপায় নেই । বৈতলের রিক্সার টিমটিমে আলো দেখতে পেয়েছে মশালের আলো । আধমরাকে ফেলে হৈ হৈ করে জটলার আলো দৌড়তে শুরু করেছে । বৈতল সাহস হারায় না, বৈতলের যে ভয় ডর নেই । দুখুর দিকে তাকায় অবজ্ঞাভরে । বলে,
--- কিতাবে, মাইর খাইয়া কাজিমরা অইয়া পড়ি রইছে যেগু, ইগুরে বাজারি কিল দুই একটা দিয়া আইও যা । এর পরে তো আমার টান ।
  দুখুর মুখেও এবার বিদ্রূপ । বলে,
--- হিগুরে মারার সময় পাইমু অখন ত তরে ধরাই দেই আগে । মামুর লগে দেখা করতে নানি । যা কইয়া আয় দুখুয়ে তরে ধরাই দের । যা যা ।
    বৈতলের একবার মনে হয়েছে এক দৌড়ে চলে যায় পিরের বাড়ি । মনের দুঃখ জানিয়ে আসে । বাঁধের নিচে নদীর পারেই মামুর মোকাম । কিন্তু বৈতল তার রিক্সা ছেড়ে যাবে না, লড়াই ছেড়ে যাবে না । একাই লড়বে, লড়তে লড়তে মরবে । ওদিকে আধমরা লোকটাকে ফেলে লাঠিসোটা নিয়ে মশালের মিছিল সচল হয়েছে । বৈতল পিছন ফিরে দেখে দুখু নেই । দুখু ততক্ষণে রিক্সার পিছনে, বাঁধের উপর রিক্সা ওঠাতে যে ঠেলতে হয় । বৈতলও দুখুর দিকে এগোয়, মানে পিছোয় । দুখুও তখন মহাবীর । ঠেলতে ঠেলতে রিক্সা উঠিয়ে দেয় বাঁধের উপর । বাঁধ থেকে ঝপাং করে নদীর জলে । দুখুর পিছনে দৌড়য় বৈতল । নদীর পাড়ে দুই বন্ধু মুখোমুখি । শারীরিক শক্তিতে বৈতল কখনও দুখুর সঙ্গে পারে না । বৈতল কিছু বুঝে ওঠার আগেই দশাসই বেঁটে মানুষ দুখু ওকে দেয় জোরে এক ধাক্কা । বৈতল ততক্ষণে ক্রুদ্ধ নদীর জলে, অন্ধকারে জলের আলোড়নও বোঝা যায় না ।
   পাড়ে দাঁড়িয়ে দুখু মিয়ার আস্ফালন শুরু হয়েছে নদীর অদৃশ্য জলের সঙ্গে আক্রোশে । মাশালের আলোকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,
--- আল্লা হো আকবর ।
ওদিক থেকে ওঠে সমবেত জিগির,
--- নারায়ে তকবির ।
  দুখুর লম্ফঝম্প দেখে মসজিদের জনতা যত এগিয়ে আসে, দুখুর মুখ তত উজ্জ্বল হয় । বৃষ্টির কাটাকুটি আলোয় বেঁটে মানুষটা প্রকট হয় আলোয় মুখে । লুক্কা হাতে জনতার দিকে তাকিয়ে আবার দেয় সর্বশক্তিমানকে ধন্যবাদ । বলে,
--- আল্লা হো আকবর ।
বলে,
--- কিতা রেবা তুমরা । এলকুনি আইলায় । রিক্সাআলা ইগুর গাত নি অলা বল । এমন লেংড়ি একটা মারছিল হালার হালায়, আর আমারেও ত চিনে না, কয় বাঙাল মারিয়া বুলে স্বর্গত যাইত । যাওয়াইছি, হে কয় হে পানির পুক, পানিত অউ তার কবর দিলাইছি, লগে তার রিক্সা ইগুও । পক্ষিরাজো চড়িয়া হালার হালায় যার স্বরগোপুরিত । ইশাক ভাই তুমার লুক্কা ইগু লামাও চাইন, দেখি আমার পাওত অত খুন কিতা, ইগুরে মারার আগে আকতা এক তেলর শিশি বার করিয়া ভাঙল পাত্থরো আর ঢুকাই দিল আমার পাও । ইশ্‌ রক্তে বইয়া যার ।
--- ইগু তো বৈতল নানি । হে তো বা তুমার দোস্ত । তুমি কুনু মারবায় নি । তুমি তারে ভাগাই দিছ । মামুর মোকামো লুকাই রাখছ । তুমারে আমরা চিনি দুখু ভাই ।
--- বাল চিনো । বৈতলর লাখান শয়তান নি দুইটা আছে । ইগুয়ে দুস্তি করত আর আমরার সব খবর দিত গিয়া যম জমিদাররে । জাসুসি করত । তার বৌর লগে জমিদারর লেটপেটর কথা জান নানি । তার পুড়ি ইগুও তার নায় । জমিদারর লাখান চউখ মুখ ধার ধার ।
--- তেউ । ইতা দিয়া কিতা অইত । তুমরা চাইর ইয়াররে সবে চিনে । হুদ্দা মাত মাতিও না বা, অখন কও ইগুরে কই লুকাইছ ।
--- আমি মারি লাইছি, মারিয়া পানিত ফালাই দিছি ।
--- পানিত ফালাইলায় কেনে ।
--- হে গপ করছিল পাকিস্তানো হেও এক মুসলমান দোস্তরে মারিয়া নদীত ফালাই দিছিল রায়টর সময় । বদলা নিলাম ।
--- ঝুটা সব মিছা ।
--- কিওর ঝুট বেটা । জানছ নি কিতা করছে, আমারে কইছে বছইরে কইছে                  আপদরেও কইছে মুসলমান অইব । কলমা পড়ানির সব বন্দোবস্তও করছিলাম ঘনিয়ালা মজিদো ।
--- দেরি করলায় কেনে ।
--- দেরি কই করলাম । ধুরন্দর ইগু হালার হালা । সাপর থাকি বিষধর । কইল ঘনিয়ালাত পড়ত নায়, নদীর হিপারো দুধপাতিলর ইমাম সাবর লগেও কথা অইছে ।
--- তে ।
--- তে আর কিতা । ইতা হুদা, অইত নায় এর লাগিউ পিছলাই যায় ।
--- পিছলার না হাতরার ।
--- কিওর হাতরাইত । মরিয়া ভূত অই গেছে ।
--- দুখু ভাই ভালা করলায় না । ইগুরে আমি চিনি ইগু পানির পুক অউ । তুমি জানিয়া শুনিয়া ছাড়লায় ইগুরে । অখন গিয়া উঠব ইটখোলা ঘাটো । জমিদাররে কইব, জমিদার ইগুতো ঘড়িয়াল, কিতা করব কে জানে ।
--- বাচলে ত উঠত । তুমি খামকা সন্দ করবায় । আর যদি উঠেও, হে বাচত নায় । সব ঘাটোউ আমরার মানু আছে ।
--- সব খানো নাই ইটখোলা ঘাটোর বজিরাম ত হিন্দু ।
--- কেউ নাই, ঘাটআলা হক্কল ভাগছে ।
--- তুমারে কে কইলবা । তুমি তো আইলায় টাউন থাকি ।
--- না আমি গেছলাম ইটখলা ঘাটো । চলো দেখাইয়া আনি ।
   দুখুকে সবাই সন্দেহ করে । দুখু ওসব পরোয়া করে না । লুক্কাওয়ালা দলকে নিয়ে এগিয়ে যায় মামুপিরের মোকামের দিকে মামুর রান্নাঘর থেকে নিয়ে আসে কেরোসিন ভর্তি দুই বোতল । দড়ি বাঁধা বোতল দুটো নিয়ে এগোয় বাঁধের দিকে । উত্তরমুখি বাঁধ ধরে এগিয়ে যায় দুখু বুক চিতিয়ে । পেছনে মশালসহ জনতা । বৃষ্টির দাপট তেমন নেই । ঝিরি ঝিরি পড়ছে । ঘাটোয়াল রজিরামের ছোট চালায় পোয়াখানেক কেরোসিন ছড়িয়ে দেয় । ইশাককে বলে,
--- ইশাক ভাই, দেও দেখি শলই । হালারে বেটার ঘাট ইগু দেই জ্বালাইয়া ।
    ইশাক নয়, দুখুর হাতে এক ঘোড়ামার্কা দিয়াশলইর বাক্স এগিয়ে দেয় সকালের দেবদূত । কুতুবউদ্দিন লস্কর । টাউন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী । ইটখোলা ইদগায় আজ সকালেই যে বৈতলের নিগ্রহের প্রতিবাদ করেছে । দুখুর বড় ভাল লেগেছে ছেলেটাকে । রাতের বেলায় ধর্মরক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কুতুবকে দেখেও ভাল লাগে । বলে,
--- শাবাশ বেটা ।
   দুখু নিজেকে সামলে নেয় । হাত বাড়িয়েও গুটিয়ে নেয় । চোখের ইশারায় কুতুবকেই দায়িত্ব দেয় বজিরামের চালাঘর পুড়িয়ে দেওয়ার । নেতৃত্ব উজ্জ্বল পনেরো বছরের কিশোরকে মনে হয় ঈশ্বর প্রেরিত ফেরেস্তা । কুতুবের নির্ভুল হাতের প্রক্ষিপ্ত বারুদে জ্বলতে থাকে বিধর্মীর বাসস্থান, জ্বলেপুড়ে খাক হয় সামান্য তৈজসপত্র । দুখু ভাবে, বজিরামের শন-বাঁশের ঘর পোড়ে, তারও পরীক্ষা হয় ।
    ছোটঘর পুড়িয়ে কুতুবের তৃপ্তি হয় না । সে তার হাতের মশাল নিয়ে আবার ফেরে অকুস্থলে, যেখানে বৈতলকে জলে ফেলা হয়েছে । কুতুব লুক্কার আলোয় খোঁজে এদিক ওদিক । দেখে, কোথাও কি ঘাপটি মেরে আছে অন্যধর্মের রিক্সাচালক । জলের ক্রুদ্ধ গর্জন আর উথালপাথাল মশালের আলো ভয় পাইয়ে দেয় অন্ধকারকে । কিশোর দমবার পাত্র নয়, অনুসন্ধানী মশাল নিয়ে নেমে যায় নদীর পাড় বেয়ে নিচে । ডাক দেয় ধর্মযোদ্ধাদের । বলে,
--- ভাইসব । চাচা হকল ।
   সবাই তৎপর হয় । তবে কি পাওয়া গেল বৈতল ওঝাকে, কিংবা তার লাশ । দুখু প্রমাদ গোনে । না, সবার হাতধরাধরি করে জলের কিনারা থেকে উঠে আসে বৈতল দাসের চার বছরের পুরনো পক্ষীরাজ । বৈতলের খুব দেমাগ তার রিক্সা নিয়ে । বলে,
--- আমার তো পুয়া নাই, এক পুড়ি । পক্ষীরাজ অউ আমার পুয়া ।
   মামুর শহর পরিক্রমার সাধ হলে বৈতলের রিক্সাই এখন একমাত্র ভরসা । বছইর গাড়ি এখন ভগ্নদশায়, মামুকে টানতে পারে না । মামু রিক্সায় চড়লে বৈতল কোনোদিন সিটে চড়ে না । হেঁটে হেঁটে রিক্সা নিয়ে দৌড়য় । বলে,
--- আমি কুনু পির থাকি উচা নি । মামু আমরার দাতা, তানে মাথাত লইয়াও দৌড়াইতাম পারমু । সিটো বইতাম নায় ।
    ধর্মযোদ্ধা কুতুবউদ্দিনের নেতৃত্বে বৈতলের রিক্সা জল থেকে ওঠে । হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যায় বৈতলের প্রথম সন্তানকে । বজিরামের ঘরে আগুনের শিখা তখনও জ্বলছে দাউ দাউ সেই আগুনে জ্বলে পুড়ে মরে বৈতল ওঝার বুরবাক । দুখু বৈতলকে বলেছিল বেহেস্তের ঘোড়ার কথা । ওঝা বৈতলও মাঝেমাঝে আদর করে তার পক্ষীরাজকে ডাকে, বুরবাক ।






চলবে 
< পড়ুন উজান পর্ব ৩৫                                                      পড়ুন উজান পর্ব ৩৭>      

কোন মন্তব্য নেই: