(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার উজান পর্বের অধ্যায় সাতাশ ---সুব্রতা মজুমদার।)
সাতাশ
বৈতল ইদানীং খেয়াল করেছে
দুর্গাবতীর পরিবর্তন । বৈতল সবসময়ই দুর্গাবতীর বুদ্ধি ও পরামর্শর উপর জোর দেয় ।
যমুনা জমিদারকে প্রথম দর্শনেই দুর্গাবতী বাতিল করে দেয়, বলে লোকটার চোখের দৃষ্টি ভাল না । আসতে চায়নি হরিৎবরণ ।
বৈতলের জারিজুরিতে এসেও খুব অস্বস্তিতে কাটিয়েছে । তারপর মূর্ছা যাওয়ার পর কী যে হয়
কে জানে, বৈঠকখানা থেকে অন্দরমহল ঘুরতে
ঘুরতে দুর্গাবতীও ঘুরে গেল কালীবাড়ির চর থেকে অন্নপূর্ণা ঘাট । একেবারে উল্টো ।
এখন তো জমিদার কিংবা জমিদারবাড়ি সংক্রান্ত কোনও কথা উঠলে আর বৈতলকে সমর্থন করে না
। ঐ শয়তান লোকটার পক্ষ নেয় । আর তখনই বৈতল দুর্গাবতীকে তুইতুকারি করে, যা নয় তা-ই বলে । দুর্গাবতীর শুকিয়ে রাখা মহুয়ার মালা ছিঁড়ে মুখে দেয়
। একটা খায় দুটো খায় তিনটে খায়, নেশার মৌতাত এলে রিক্সা নিয়ে
বেরিয়ে পড়ে রাতের খেপ খাটতে । গীতশ্রী থেকে সেকেন্ড শো এর প্যাসেঞ্জার নিয়ে ফেরা ।
নতুনপট্টি ঢাকাইপট্টি আ আর্যপট্টি আর ইটখোলা হলে চোখের ইশারায় বলবে উঠে যেতে ।
অন্যদিকের যাত্রী হলে ‘যাইতাম নায়’ পর্যন্ত বলে না, নির্বিকার বসে থাকে গাছতলায় রাজার মতো । মিরতিঙ্গার পাটপাথরের রাজা হয়ে বসে
থাকে । বৈতল তার মর্জির মালিক, সওয়ারি ঠিক করে সে নিজে, যাকে তাকে ওঠায় না । সন্ধ্যার পর কোনও মেয়ে
প্যাসেঞ্জার নেয় না । ইদানীং আর্যপট্টির মুখে পিডব্লিউডি কলোনির সামনের রাস্তা বড়
শুনসান, গাছগাছালিতে অন্ধকার গাঢ় হয় বেশি, অকারণ দুর্বৃত্তদের সঙ্গে আর লড়তে চায় না
বৈতল । একদিন, শ্যামসুন্দর মঠ থেমে যায় । নড়ে
না চড়ে না সামনে এগোয় না, বরং পেছনের দিকে টান । ভূতের ভয়
নেই বৈতলের, তবু আচমকা রিক্সার পিছুটানে অবাক
হয় বৈতল । বিরক্তি থেকে হাঁক দেয় ‘কিগুরে’ । দুই বৃদ্ধার কণ্ঠেও আতঙ্ক, চিৎকার । রাম নাম জপের মাঝখানে ভূত ভূত ডাক । বৈতল বলে,
--- কিতা করের ভূতে
দুই মহিলার সমবেত উত্তর,
--- গাত হাত দের ।
--- অ, ইতা গাত হাত দেওরা ভূত নি । অ হালার হালাইনত, উবা বার করিয়ার ভুতভুতি ।
বৈতল ততক্ষণে অন্ধকার ভেদ করে বের করেছে ভূতের
পাল ।
তিনটে টিংটিঙে ছোকরা । বৈতলের পরাক্রমে মোটেও
ভীত নয়, তাও বৈতলের কালো পিচ্ছিল হাতের
জাপট ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে হতাশাও ঝরিয়ে যায় অন্ধকারে । বলে,
--- ইতা বুড়িবে, ছাড়ি দে ।
বান্দর লাঠি, ছাতনি আর শিরিষ গাছের ঘন অন্ধকারে ভূত ধরার বিস্তর চেষ্টা
করেছে বৈতল কয়েকবার । ফাঁদ পেতে ধরতে চেয়েছে । দুর্গাবতীকে নিয়ে সেকেন্ড শো
সিনেমায় গেছে, ফিরেছে ফুরফুরিয়ে, নতুনপট্টি পেরোতেই চকিত থেকেছে, কোনও উৎপাত হয়নি । কিন্তু বৈতল ছাড়বার পাত্র
নয়, মেয়েশিকারি তিন ভূতকে ধরার নেশায়
দুর্গাবতীকে নিয়ে রোজ একবার বেরিয়েছে । দুর্গাবতীর মন্দ লাগেনি, যদিও জানে এ কোনও প্রেম ভালবাসা নয়, জ্যান্ত ভূতকে ধরার ভূতে পেয়েছে তাকে । নেশা
শেষ হলেই শেষ । তাই বলে,
--- আমি কুনু জির নি । বরির আগাত লাগাই ছাড়ি
দিলায় হুকনা পানিত । তুমার রিক্সা আর আটকাইত নায় পুয়াইনতে । আমারেও তারা বুড়ি
ভাবের ।
--- ভাবলেউ অইল, দাঁত চাপাটি নু ভাঙ্গি লাইমু ভুতর । তুমি অইলায় আমার
আনারকলি ।
--- অয়, তুমি যে খুঙা, অখন কইবায় আনারকলি, গুসা অইলেউ বেটির হুরইন বাড়ি । ইতা আমি জানি
।
--- কিতা জানছ বেটি । আমি এমনে নি গাইল্লাই, গাইল্লানির কাম করছ এর লাগি । হি যম জমিদার
ইগু তর কিতা । কেতুমামারে আমরা অত মানি । বুড়া ড্রাইভার, আমরারে অত ভালা পাইন, তান পিছে বইয়া তুই বেটি হিগুর লগে কিতা করছ ।
--- কেতুমামায় কইছইন নি ।
--- তাইন কইতা কেনে । ধর্মাত্মা মানুষ । মাইনষে
কয়, সবেউ দেখের নানি ।
--- তে তো তুমিও জানো, হক্কলেউ যখন জানে কিতা করি ।
বৈতলও জানে । বৈতল অসম্মতি জানায়নি কারণ বৈতল
জানে দুর্গাবতী এমন কোনও কাজ করবে না যাতে দুর্নাম রটে । বৈতলের ভয় এই হিসেবি
দুর্গাবতীকে । হিসেব করে সে বৈতলকেও ঠকাচ্ছে না তো । দুর্গাবতী জমিদারের গাড়ি চড়ে
। কেতুমামা ড্রাইভারের পিছনে বসে চন্দ্রধরকে নিয়ে যায় সাপনালায় । আর চন্দ্রধর তো
একা যায় না, খেলার সাথি তিলোত্তমা, বৈতলের প্রাণের পুত্তলি সোনাও যায় সঙ্গে ।
দুর্গাবতী বৈতলের সম্মতি নিয়েই রাজি হয়েছে । বৈতল খুশি মনেই সম্মতি দিয়েছে, খুশি হবে না – ই বা কেন । স্ত্রী কন্যার সুখে যে তারও সুখ । রিক্সাওয়ালার
বৌ দুর্গাবতীর রিক্সা চড়ায় ঘোর অনিচ্ছা, বৈতলের রিক্সায় উঠলে সিটিয়ে থাকে, হুড তুলে দেয় । ভালই তো এবারের প্রস্তাব এক লাফে চারচাকা । বৈতল সব পারে, দুর্গাবতীর জন্য সব পারে । দুর্গাবতীর সুখের
জন্য সে ভুলও করে । চিন্তাভাবনার সময় পায় না, অগ্রপশ্চাৎ ভেবে দেখে না । শহরে তো চারখানা মাত্র কালো গাড়ি, একখানায় চড়ে যাবে তার বৌ, নরসিং ইস্কুলের মোড় থেকে লুকিয়ে দেখতেও সুখ ।
কেমন রাজরানীর মতো দুই বাচ্চার মাঝখানে যেন রাণিমা । বেশ কিছুদিন তো এরকম দুর্লভ
দৃশ্য উপভোগ করেছে বৈতল । এর পরে তো বৈতলের কাটা খালে কুমির এল । আর সাপনালায় যায়
না কেতুমামা । তবে কোথায় যায় । বৈতলের অবসরের সময় শেষ হয়, আর লুকিয়ে লুকিয়ে বৌ দেখা নয়, শিশুর খেলা নয় । বৈতল এবার ট্রিপে যায় । যায় সদরঘাট যায়
জানিগঞ্জ কালিবাড়ি ফাটকবাজার গোপালগঞ্জ চামড়াগোদাম । ইস্টিশনের পেসেঞ্জার নিয়ে
ফেরার পথে কালোগাড়ির মুখোমুখি হয় ট্রাঙ্করোডে । কেতুমামাই চালাচ্ছে গাড়ি ।
দুর্গাবতীও মাঝখানে বসা, আর একদিকে দুই বাচ্চা একদিকে
সাদা পাজামা সার্টের যমুনা জমিদার । কেতুমামা গাড়ি জোরে চালায় না, অনেকক্ষণ মুখোমুখি আরোহীরা কেউ খেয়ালই করেনি
বৈতলকে, এমন মশগুল । বৈতল অবাক হয় বসার
ধরন দেখে, এ কেমন বসা । বাচ্চা দুটোকে
মাঝখানে রেখে ওরা দুজন দুদিকে বসতে পারে । তাহলে যে গায়ে গা লাগানো যায় না ।
বাচ্চা দুটো পরস্পরের সঙ্গে বকবক করেই যাচ্ছে । বৈতলের সোনামনিটাই ছটফটে বেশি, খেলার সঙ্গী পেয়ে বাপকে ভুলেছে । বাপের
শেখানো বুলিই হয়তো বন্ধুকে শেখাচ্ছে, শোনাচ্ছে ছড়া । ঘুঙ্গিঘুঙ্গি
খেলার বিবরণ । দুপায়ের উপর মেয়েকে বসিয়ে দোল খাওয়ানোর নাম ঘুঙ্গি । ঘুঙ্গিরে
ঘুঙ্গি তোর বাড়ি কৈ । দুল দুল দুলনি রাঙা মাথায় চিরুণি, বা ঘুঙ্গিতে বসিয়ে ঘোড়া ঘোড়া খেলার ছড়ায়ও বৈতলের গলা দোলে, হেট্ ঘোড়া বদরপুর, মঙ্গলবাজার কতদূর । বৈতলের মেয়ের সবচে মজার খেলা হল গু
খাওয়ার ছড়া,
‘একখান কথা,
কী কথা ।
বেঙের মাথা ।
কী বেঙ ।
ঘাড়ু বেঙ ।
কী ঘাড়ু ।
বাবন গরু ।
কী বাবন ।
ভট বাবন ।
কী ভট ।
গুয়া কট ।
কী গুয়া ।
ছাও গুয়া ।
কী ছাও ।
গু খাও ।’
শেষ লাইন শুনলেই মেয়ের খিলখিল হাসি । আর
দুর্গাবতীর বকাবকি মেয়েকে খারাপ কথা শেখানোর জন্য । বৈতল ভেবে পায় না কিসে খারাপ
কথা হয় আর হয় না । ভদ্রলোকের সমাজের সঙ্গে মেলাতে তার বড় কষ্ট হয় । দুর্গাবতী এখন
যে খারাপ কাজটা করেছে, তার বেলা । তাকে কী বলেছে সে
যমুনার সঙ্গে হাওয়া খেতে বেরোবে গাড়িতে । বৈতলের মনটা খিচ্ড়ে যায় । বৈতল সওয়ারির
সঙ্গে ঝগড়া করে বলে আর যাবে না । অন্য রিক্সা ধরে নিতে বলে । কারণ চেন খুলে গেছে, সে অনেক কেরামতি আছে তার । উল্টো প্যাডেল
দিয়ে আঙুলের ঠেলা দিলেই চেইন নেমে যায় । বৈতলও নেমে যায় ঘোড়দৌড়ের মাঠে । আজকের
ট্রিপ শেষ আর সওয়ারি নেবে না । একটু সময় বসবে মাঠে, ঘাসের গায়ে হাত বুলোবে, দুঃখ বেশি হলে মুখ ঘষবে । হিসেব নিকেশ করবে, সব দোষের বোঝা চাপাবে যম সিং-এর ঘাড়ে । তারপর সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলেই যাবে
নাগাপট্টি । আজকে আর দুর্গাসঙ্গ নয়, তার আনারকলি আজ পরপুরুষের তাই
বৈতলও যাবে মধুবালার কাছে ।
বৈতল পিয়াইন নদীর উদ্দাম জলোচ্ছ্বাসের রাতের
কথা মনে, একা কুমারী কন্যা দুর্গাবতীর
অসহায় মুখটাকে মনে করে । লুলা, বৈতলের বন্ধু রুল আমিন বেজ এর
হাত থেকে দুর্গাবতীকে রক্ষা করার পর বৈতলকে জড়িয়ে ধরার কথা মনে করে । অবিশ্রাম জলে-ভেজা দুটি মানুষের জড়াজড়িতে আজন্মের বন্ধন
সূচিত হয়েছে ভেবেছে বৈতল । খুনের আসামী অনিশ্চয় মাথায় নিয়ে কলার ভেলায় ভেসে স্বদেশ
ছেড়ে নতুন দেশের উদ্দেশ্য রওয়ানা দেয়, নতুন জীবনের স্বপ্নও দেখে সেদিন বৈতল । সেদিনের দুর্গাবতীর সঙ্গে আজকের
দুর্গাবতীকে মেলাতে বড় কষ্ট । বৈতল ভাবে বড় দ্রুত, যা তার নয় তার পিছনে ছুটতেও চায় না, কিন্তু মেয়ে তো তার । মেয়েকে নিয়েই বাঁচবে এবার । বৈতল তাই
কিছুতেই শিশুমুখ সরাতে পারে না মেঘলা মনের আকাশ থেকে । একা একা হাসে, ঝলমলিয়ে ওঠে মন । বৈতলের বাপ ছড়া শেখায়নি, তার বাপ উদোম বুকে উঠিয়ে বৈতলের সঙ্গে খেলা
করেনি কখনও । বরং সেই শিশু বয়স থেকেই বাপ বৈতলের সঙ্গে লড়াই লড়ত । জলে নামিয়ে
হাবুডুবু খাওয়ানোতেই ছিল বাপের সুখ, আনন্দ । আর বৈতলও বাপকে অমান্য
করেনি কখনও । বাপ যখনই বলেছে, ‘হেই বৈতল পানিত লাম’ বৈতল নেমে গেছে । মাছের খলই এ কেউটের বাচ্চা
ভরে দিয়েছে । বৈতল ভয় পায়নি, উঠিয়ে ফেলে দিয়েছে জলে । শৈশব
তাই মায়ের বুকটাই ছিল বৈতলের খেলার মাঠ, মা সুর করে ছড়া কাটে ‘বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দিব
কিসে’, আর বৈতল খিলখিলিয়ে হাসে । মা
তাকে ঘুঙ্গি থেকে ফেলে দেয় একপাশে, বলে,
--- ক, দুধহালো যাইতে না গুহালো যাইতে ।
মায়ের বাঁদিকে কখনও পড়তে চায় না বৈতল, মা বলেছে বাঁদিকে দুধ নেই । তাই বাঁদিকে হেলে
পড়লেও মায়ের শাড়ি-জড়ানো হাঁটু জোর করে জড়িয়ে ধরে ।
মায়ের কথা মনে পড়ে বৈতলের । বৈতল মাকে ডাকে,
--- মা, মাগো ।
বৈতল মাকে আশ্বস্ত করে, তার মেয়েকেও সে ঘুঙ্গিতে জড়িয়ে রাখবে । পড়তে দেবে গুহালে । ঝড় তুফান যাই
আসুক বৈতল তার সোনামনিকে ছেড়ে দেবে না কাউকে । এমনকি দুর্গাবতীকেও না । আবার বৈতল
দুভাগ হয়, দুর্গাবতী নিয়ে সে সিদ্ধান্ত
নিতে পারে না । বৈতল তো জানে দুর্গাবতী মায়ের মতো মা । জমিদারের সঙ্গে লেটপেট এর
একটা আভাস থাকলেও মেয়ে তার প্রাণের টুকরো । সন্তানকে চোখে হারায় দুর্গাবতী ।
সামান্য সর্দিজ্বর হলেও অমঙ্গল ভাবনায় কেঁদে ভাসায় মা দুর্গাবতী । তখন আর ধর্মাধর্ম
ভেদ থাকে না, মামুপিরের কাছে ছুটে যায় । মামু
তো কিছুই দেয় না অলৌকিক পিরদের মতো, সোনামনিকে ভালবাসে বৈতল দুর্গার
মতো, একা একা কাঁদে পির । দুর্গ ভাবে
দোয়া হল । দুর্গাবতী যায় ভৈরববাড়ি । হত্যে দেয়, পূজারী ব্রাহ্মণ একটা জবাফুল হাতে দিলে শান্তি । বৈতল
দুর্গাবতীর পাগলামি দেখে হাসে । দুর্গাবতী বলে,
--- কিতা করতাম কও, মা নু । আপদে মাই, বিপদে মাই, মাই ছাড়া আর কেউ নাই ।
--- কেনে বাপ কিতা ।
--- বাপ তালই ।
--- অ, তে আমার কাম শেষ নানি, যাইতাম গি ।
--- কই যাইতায় । ইতা এক কথার কথা কইলাম । তুমার
লগে অখন ঢঙও করা যায় না । নাকর আগাত ধানুমরিচ ।
মেয়ের অধিকার নিয়ে এরকম কথার কথা বলে
দুর্গাবতী । যেন মেয়ে তার একার । মেয়ে মানুষ করা নিয়ে যমপ্রসাদের কথাও মান্য করে ।
তা হলে কি দুখুর কথাই ঠিক, সোনা বৈতলের মেয়ে নয় । হারামজাদা
জমিদার কেন এত অধিকার ফলায় । সোনা নামে ডাকে না, তিলোত্তমা ডাকে । চন্দ্রধরের সমান অধিকার দেয় । নিজের বাড়ি
ছেড়ে যায় রামনগর বাগানবাড়িতে । ওখানে তো কেউ থাকে না এক পাহারাদার রায়ত ছাড়া ।
জমিদারের বৌ পর্যন্ত যায়নি কোনোদিন । কালো বৌকে নিয়ে জমিদার যায় না কোথাও ।
দুর্গাবতীও তো যেতে চায় না কোথাও কালো বৈতলের সঙ্গে । ধলা দুর্গাবতী ধলা যমুনার
সঙ্গী হয়ে যায়, কেতুমামা দেখে সব, বলে না কিছু । কিন্তু বৈতল মুখ বুজে থাকবে না, বৈতল দুর্গাবতীর কাছে জানবে সব । বর্ডার পার
করে নিয়ে এসে অনেক দুর্ভোগ ভুগেছে, প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে মেরেছে
দুর্গার জন্য । এবার নয় একই অপরাধে যমুনা সিংকে মারবে । তার আগে বৈতল নিশ্চিত হতে
চায়, ধারণার বশে দুর্গাকে অপরাধী করবে
না । যমকে নিয়ে বৈতলের কোনও দ্বিধা নেই । তাকে শাস্তি পেতেই হবে । শুধু দুর্গাবতীর
রঙ ঢঙ দেখে বৈতল বিচলিত হয়, মাস্টারের বাড়ির মেয়েদের মতো
মাথার উপর খোপা বাঁধে, ঘরের ভিতরও কুচি দিয়ে শাড়ি পরে ।
ঘরের ভিতর এখন শুধু বৈতল থাকে না, মেয়েকে দেখতে যখন তখন জমিদার
ঢুকে পড়ে বাঁশ বেড়ার ঘরে । যেদিন কালো গাড়ির বেড়ানো থেকে ফিরতে দেরি হয়, রাত হয়, সেদিন বৈতলের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে । দুর্গাবতীকে বলে,
--- আমি যাইমুগি ।
--- কই যাইতায় ।
--- আমি আবার বইয়াখাউরি যাইমুগি । জৈন্তার পাড়ো
পাড়ো ঘুরমু, পিয়াইনর পানিত খেপ মারমু । আমার
আর ইতা ভালা লাগের না ।
--- আবার নি মাথা চাড়া দিছে । আবার নি উন্মাদ দশা
। তে চল, ইবার আর থাকতাম নায় ।
--- তুমি কই যাইতায়, তুমার তো সব আছে ইনো । ইনো যমর বাড়িত আইয়া তুমি বউত বাড়ি
গেছো । খুব উগ্রচণ্ডী অইছ, খুপা বান্দার কী বাহার, লংলা গাইয়া বেটিনতর লাখান নাচ হিকছ খুব ।
--- কে নাচার জানো নানি । আমি আইতাম চাইছলাম নি ।
তুমার নু আউশ, জমিদারর কুটুম অইতায় । মাছুয়া
বেটা বাবন অইতায়, বাবন অইয়া রিক্সা চালাইতায় ।
--- জানি জানি বেটি, ইতা যে কইরে আমি জানি, সব দুষঅউ আমার । তর তো অখন খুব আল্লাদ, বাত্তি জালাইয়া পাদ্রে । খুব রিঙো উঠচছ, দেখবে নে । হুনছি লাতুত বডার খুলছে । আমার
পুড়িয়ে লইয়া আমি যাইয়ার আইজ অউ ।
--- অয়, যাওয়াইমু । পুড়ি । কিওর পুড়ি । পুড়ি আমার । আমার একলার । পুড়ি পুড়ি করিছ না
বেটা, দেখচছ নি পুড়ির রং । মাছুয়ার
পুড়ি নায় তাই । গাওর রং দেখিয়া কেউ কইব নি ।
বৈতল চুপ করে থাকে । রাগের মানুষ
দুর্গাবতীকে বুঝতে পারে না । এমন রূপ সে দেখে নি কোনোদিন । এমন সব কথা বলে
দুর্গাবতী যা সে কখনও বলে নি, এমন অর্থহীন । বৈতল ভাবে, তবে কি দুর্গা তার উপর প্রতিশোধ নিতে চায়, তার উপর অকারণ সন্দেহের বদলা নিতে চায় । তাই
তুইতুকারিও করে, বৈতলকে কষ্ট দেয় । বৈতল ভাবে
দাম্পত্য এমন হয় । জলের উপর ঢিল মারলে ছত্রখান হয় আবার জলতল সমান হয় । দুর্গাবতীর
রাগও তেমন, বেশিক্ষণ থাকে না । জল হয়, কাঁদে । বলে,
--- যাও, লইয়া যাও । আমারেও লইয়া যাও । পুড়ি যেমন তুমার বৌও তুমার । উক্কা যেবায় যায়, চিলিমও হবায় । তে কইয়ার হুন একখান কথা, গুসা করিও না, তুমি কালা এর লাগি
নি তুমার অত কষ্ট । কষ্ট করিও না, কথাত আছে কালায় ধলায় গৃহবাস, লক্ষী থাকইন বারমাস ।
--- আমার মারও রং আছিল ফক্ফকা, তাইর লাখান । মাও সুন্দর আছলা, দেবী প্রতিমার লাখান ।
--- আমি সুন্দর নায় নি ।
--- তুই তো সুন্দর অউ বেটি । কী সুন্দর চউখ, বলিচ্ছেদর লাখান ধার নাক । তুই অইলে আমার
বাগাডাইয়া ।
--- কিলাখান দেখতায় নি ।
রাগের বৈতলকে ঠাণ্ডা করতে দুর্গাবতী বুকের
কাপড় খুলে দুপাক ঘুরে দেখায় । গান গায়,
--- আমি বনফুল গো, ছন্দে ছন্দে নাচি আনন্দে ।
দুর্গাবতীর বোতলখোলা নেশায় বৈতলের রাগ জল হয় ।
বৈতল তখন মাছুয়া থেকে শর্মা হয় ।
বৌ এর পদবির সুখ সারা শরীরে । মুখবন্ধ হয়, বলার কথা কিছুই বলতে পারে না । আপাতত দেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল হয় ।
কিন্তু বৈতল কিছুতেই ভুলতে পারে না কালো গাড়ির যাত্রীদের কথা । পাশাপাশি বসে থাকা
যমুনাপ্রসাদ আর দুর্গাবতীর ফুর্তিমুখ । সে-রাতে
নাগাপট্টি থেকে ফিরে নেশার ঘোরে এক প্রস্থ ঝগড়া করে । বৈতলের ঝগড়া দুরকমের, একটা সত্যিকারের আর একটা সমঝোতার । সমঝোতার
গাড়ি যখন ছোটে তখন বৈতলের বুদ্ধিও ছোটে দুরন্ত । দুর্গাবতীর উপর তিন চার রকমের
ফতোয়া জারি করে । দুর্গাবতীও প্রতিরোধ করে, বৈতল মেনে নেয়, আসলটা মানে না । বৈতল হারতে
হারতে এগোতে থাকে, সে জানে শেষ দান তার । শেষ শর্ত মেনে নেয় দুর্গাবতী, জমিদারের গাড়িতে আর যাবে না তাদের সোনামনি । এক নিশানায় দুই পাখি মারে বৈতল ।
তার মেয়ে যাবে না মানে মেয়ের মাও যাবে না । বৈতলের বুদ্ধিতে রামনগর পর্বের ইতি হয়
যম সিং-এর ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন